ফার্গো খুবই ছোট শহর।
আমেরিকানরা একে সিটি বলে না, বলে টাউন। সাধারণ একটি সিটিতে যা যা থাকে, এখানে তার সবই অবশ্যি আছে। আকাশছোঁয়া দালানই শুধু নেই। দুটি নাইট ক্লাব আছে। মেয়েরা সেখানে নগ্ন হয়ে নাচে। একটা বড়ো ক্যাসিনো আছে। সেখানে সপ্তাহে ছ দিন দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ব্লাক জ্যাক খেলা হয়। অত্যাধুনিক শপিং মল আছে বেশ কয়েকটি, তবু-ফার্গো সিটি নয়, টাউন। নিউইয়র্ক বা শিকাগো থেকে যে-সব বাঙালী এখানে আসে তারা চোখ কপালে তুলে বলে, আরো এ তো আমাদের কুমিল্লা শহর। ভিড় নেই হৈ-চৈ নেই। বাহ্, চমৎকার তো!
কিন্তু বেশিদিন কেউ থাকে না। এখানে। শীতের সময় প্রচণ্ড শীত পড়ে। কানাডা থেকে উড়ে আসে ঠাণ্ডা হাওয়া। থার্মোমিটারের পারদ ক্রমশ নিচে নামতে থাকে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তাপমাত্রা শূন্যের ত্রিশ ডিগ্ৰী নিচে নেমে থমকে দাঁড়ায়। অসহনীয় অকল্পনীয় ঠাণ্ডা। একটা শীত কোনোমতে কাটাবার পরই ফার্গোর মোহ কেটে যায়। ঘরের মধ্যে ছ মাস বন্দী হয়ে থাকতে পারে কেউ? বাঙালীরা মুখ কুচকে বলাবলি করে, এখানে মানুষ থাকতে পারে? এখানে বাস করতে পারে পোলার বিয়ার আর সীল মাছ।
তবু অনেকেই আসে। ঘরবাড়ি কিনে স্থায়ী হয়ে যায় কেউ কেউ। যেমন স্থায়ী হয়েছেন আমিন সাহেব। শহরে বাড়ি করেছেন। মিনেসোটায় পেলিকেন লেকের ধারে সামার হাউস কিনেছেন। বিশ বছর আগে যে-দেশ ছেড়ে এসেছিলেন, আজ আর তার জন্যে মন কাঁদে না।
অথচ শুরুতে কী দিন গিয়েছে! ইউনিভার্সিটি থেকে সন্ধ্যাবেলা ব্লকান্ত হয়ে ফিরতেন। ঘরে রাহেলা একা। কিছুই করবার নেই। কতক্ষণ আর টিভির সামনে বসে থাকা যায়? একা একা দোকানে ঘুরতে কার ভালো লাগে? আমিন সাহেব সান্ত্বনা দিতেন, আর একটা মাত্র বৎসর। পি… এইচ… ডি করব না। এম… এস… করে ফিরে যাব। আর মাত্র কয়েকটা দিন কষ্ট কর।
পরিবর্তন হল খুব ধীরে। আমিন সাহেব একদিন অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, রাহেলা চমৎকার ইংরেজি শিখেছে।
বাহু, তুমি তো চমৎকার ইংরেজি বল! কোথেকে শিখেছি? একেবারে আমেরিকান এ্যাকসেন্ট। কীভাবে শিখলে?
টিতি দেখে দেখে শিখেছি। কী আর করব বল? দু বছরের মাথায় চাকরি হল রাহেলার। আহামরি কিছু নয়। রিসার্চ ল্যাবে সূর্যমুখী ফুলের চারা বাছা। সেই বছর গাড়ি কিনলেন আমিন সাহেব। নাইনটিন সেভেন্টি ওয়ান মডেল ডজ পোলারা। প্রকাণ্ড গাড়ি। নিজের গাড়িতে করে স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন ডেডিলস লেকে। রাহেলার মনে হল সে বোধহয় আগের মতো অসুখী নয়।
দেখতে–দেখতে কত দিন হয়ে গেল। প্রচুর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশে যাওয়া হয়ে উঠল না। বেড়াতে যাবার জন্যেও নয়। একটা-না–একটা ঝামেলা থাকেই। পিএইচ.ডির বছর দেশে যাবে না। নতুন চাকরি, দেশে যাওয়া যাবে না। ইমিগ্রেশন না হওয়া পর্যন্ত বের হওয়া ঠিক হবে না। নতুন বাড়ি কেনা হয়েছে। এখন বাড়ি ঠিকঠাক করতে হবে, দেশে যাওয়া পিছতে হবে। প্রথম বাচ্চা হবে, এ সময়টা তো আমেরিকাতে থাকতেই হবে।
তারা প্রথম বারের মতো যখন দেশে গেল তখন গ্রুনকির বয়স চার বছর। প্ৰায় এক যুগ পর দেশে ফেরা। কি দারুণ উত্তেজনা গিয়েছে। কিন্তু দেশে ফিরে কিছুই ভালো লাগল না। নোংরা ঘরবাড়ি। দেয়ালগুলি ময়লা। রাতের বেলা কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগে চারদিক। মানুষজনও কেমন যেন বদলে গেছে। কেউ যেন ঠিক সহজ হতে পারে না। বড় খালা, যিনি সারা জীবন তুই তুই করে কথা বলতেন, তিনি পর্যন্ত তুমি বলা শুরু করলেন।
এক মাস পরই রুনকি পড়ে গেল অসুখে। যা খায়, কিছুই হজম করতে পারে না। রাহেলা আমেরিকা ফিরে এসে হপ ছাড়ল।
দেখতে–দেখতে কত দিন হয়ে গেল। বিশ বছর অনেক লম্বা সময়। রাহেলার বাবা-মা মারা গেলেন। আমিন সাহেবের বাবা-মা তো আগেই ছিলেন না। কোনো পিছুটান রইল না। রাহেলার সবচেয়ে ছোট বোনটির বিয়ে হয়ে গেল। কোথায় আছে সে, কিছুই জানা নেই। জািনবার জন্যে সে রকম উৎসাহও এখন হয় না। সবকিছু যেন হারিয়ে গেছে। আজকাল আয়নায় মুখ দেখলে রাহেলার তীক্ষ্ণ ব্যথা বোধ হয়। মুখের চামড়া শ্লথ হয়ে এসেছে। কানের দু পাশের সাদা চুল সাপের মতো কিলবিল করে। এখন তাঁর অন্য এক ধরনের আলস্য বোধ হয়। সকালবেলা চেয়ার পেতে বারান্দায় একা একা বসে থাকেন। আমিন সাহেব তাঁকে বিরক্ত করেন না। কেমন একটা দূরত্ব এসে গেছে তাঁদের মধ্যে। মাঝে মাঝে রুনকি আসে, ঝড়ের মতো।
আবার তুমি চেয়ার নিয়ে বসেছ? শিকড় গজিয়ে শেষে তুমি একটা গাছ হয়ে যাবে মা।
আয়, তুইও বোস।
হুঁ, আমার যেন কোনো কাজ নেই!
রুনকি দেখতে তাঁর মতো হয় নি, তবু চমৎকার হয়েছে। গায়ের রঙ চাপা, কিন্তু কী কালো শান্ত চোখ। তাকালেই কেমন যেন মন খারাপ হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রুনকি যখন চুল ব্রাশ করে, তিনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন। রুনকি ঠোঁট বাঁকায়, এমন করে তাকাও কেন মা?
কেমন করে তাকাই?
কেমন যেন পুরুষ-পুরুষ চোখে তাকাও।
তিনি তাঁর নিজের মেয়েকে একটুও বুঝতে পারেন না। মাঝে মাঝে অনেক কায়দা করে জিজ্ঞেস করেন, তুই কী রকম ছেলে বিয়ে করতে চাস রুনকি?
বিয়ের কথা আমি মোটেই ভাবছি না। বছরের পর বছর একটা ছেলের সঙ্গে থাকা বড্ড আগলি।
এসব আবার কী ধরনের কথা?
সত্যি কথাই বলছি তোমাকে। যে-সব ছেলে আমার সঙ্গে ডেট করে, তুমি কি ভাবছ আমি ওদের কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবি? হলি কাউ। তাছাড়া ওরাও বিয়ে করতে চায় না। ভুলিয়েভালিয়ে ঘরে নিয়ে শুতে চায়।
রাহেলা মুখ কালো করে বললেন, তুই নিশ্চয়ই ওদের ঘরে যাস না?
মা, যাই কি না-যাই সেসব আমি তোমার সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই না! আমার বয়েস উনিশ হয়েছে। তোমাদের কোনোই রেসপনসিবিলিটি নেই।
রাহেলা চান একটি হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান বাঙালী ছেলেকে বিয়ে করবে রুনকি। জীবনে যে-সমস্ত সুখ ও আনন্দের কথা তিনি সারা জীবন কল্পনা করেছেন, তাঁর মেয়ে সে-সব ভোগ করবে। কিন্তু এই দূর দেশে তেমন ছেলে পাওয়া যাবে কোথায়? রাহেলা লং ডিসটেন্সে পরিচিত সবাইকে একটি ছেলের কথা বলেন। খোঁজ যে আসে না, তাও নয়। প্রথমেই জানতে চায় মেয়ের কি ইমিগ্রেশন আছে? বিয়ে করলে এখানে থেকে যাবার ব্যাপারে কোনো সাহায্য হবে কি? মেয়ের ছবি দেখতে চায় না, মেয়েটিকে দেখতে চায় না। গ্ৰীন কার্ড দেখতে চায়।
আমিন সাহেব নিজের ঘরে বসে কী যেন লিখছিলেন। একতলার সর্বপশ্চিম কোণার ছোট ঘরটি তাঁর নিজস্ব ঘর। ঘরটিতে আসবাব বলতে ছোট একটা লেখার টেবিল, একটা ইজিচেয়ার, বুকশেলফ। বুকশেলফে কয়েকটি রেফারেন্স বই, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কিছু পুরনো সংখ্যা এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যয়ের ইছামতী ছাড়া অন্য কোনো বই নেই। আমিন সাহেব মাঝেমাঝেই দরজা বন্ধ করে এই ঘরে বসে কী-যেন লেখেন। রাহেলা কৌতূহল হলেও কখনো কিছু জিজ্ঞেস এই ঘরে বসে কী-যেন লেখেন। রাহেলার কৌতূহল হলেও কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। আমিন সাহেবের কোনো বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করতে আজ আর তাঁর ভালো লাগে না।
রাহেলা দরজায় দু বার টোকা দিয়ে মৃদু গলায় বললেন, আসব? জবাব পাবার আগেই তিনি পর্দা সরিয়ে আমিন সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। আমিন সাহেব তাঁর লেখাটি আড়াল করবার চেষ্টা করলেন। রাহেলা ভান করলেন যেন তিনি এসব কিছুই লক্ষ করছেন না।
আমি আজ সন্ধ্যায়। কয়েক জনকে খেতে বলেছি। আমিন সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না। তুমি টিচি থেকে শুঁটকি মাছ এনে দেবে।
শুঁটকি মাছ পাওয়া যায়?
মাঝে মাকে যায়।
আমি নিয়ে আসব।
রাহেলার মনে হল আমিন সাহেব অস্বস্তিবোধ করছেন, যেন তিনি চান না রাহেলা এখানে থাকে। কিন্তু এ-রকম মনে করার কারণ কী? রাহেলা নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, কী লিখছ?
তেমন কিছু নয়।
রাহেল খানিকক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে থেকে তোতলায় চলে গেলেন। দোতলার একেবারে শেষ কামরাটি রুনকির। সে দরজা বন্ধ করে গান শুনছে।
রুনকি, দরজা খোল তো মা।
রুনকি দরজা খুলে দিল। তার চোখ ভেজা। মনে হল সে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে।
কী হয়েছে রুনকি?
কিছু না মা। নেইল ডাইমণ্ডের গান শুনছিলাম। ওর গান শুনলে খুব লোনলি ফিলিং হয়।
রুনকি মিষ্টি করে হাসল। রাহেলা থেমে থেমে বললেন, আমি কয়েকটি ছেলেকে খেতে বলেছি। তুমি সন্ধ্যাবেলা যেও না কোথাও।
ঠিক আছে, মা।
তোমার নীল শাড়িটা পরবে।
বেশ। বিশেষ কাউকে আসতে বলেছ?
রাহেলা ইতস্তত করে বললেন, আনিস নামের একটি ছেলে আসার কথা, এনডি-এস-ইউয়ের টীচার, খুব ভালো ছেলে।
কী করে বুঝলে–খুব ভালো ছেলে?
শাফিক বলেছে।
রুনকি হাসি-হাসি মুখে বলল, নিশ্চয়ই আনিমেরিড। এবং নিশ্চয়ই তুমি চাও আমি খুব ভদ্র—নমভাবে তার সঙ্গে কথা বলি।
চাওয়াটা কি খুব অন্যায়?
না, অন্যায় হবে কেন? তবে মাস্টারদের আমি দু চোখে দেখতে পারি না।
রাহেলা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। রুনকি বলল, তোমার চিন্তার কিছুই নেই। আমি খুব ভদ্র ও নাম ভাবে থাকব, একটুও ফাজলামি করব না। দেখবে, মিষ্টি মিষ্টি হাসছি শুধু।