পেটে খিদের খোঁচায় চোখজোড়া ফাঁক হয়ে পড়লে কুলসুমের নজরে পড়ে দরজার কপাট একটা হাট করে খোলা। তমিজের বাপের বাঁ পায়ের কাদামাখা পাতা চৌকাঠের ওপর। দরজা কি খুলে পড়েছে এই পায়ের ধাক্কাতেই? কী করে হয়? ঐ পায়ে কি সেই জোর আছে? মাটিতে শুয়ে রয়েছে; এর মানে মানুষটা রাত্রে উঠে বাইরে গিয়েছিলো; তার মানে কালাহারের কাদাপানি তার পায়ের না হলেও দুই আনা রক্ত টেনে নিয়েছে। আজ দুপুরবেলা পর্যন্ত হাঁটার ক্ষমতা তার হবে কি-না সন্দেহ। তার ডান পা অসাড় হয়ে পড়ে রয়েছে দরজার ভেজানো কপাটের শেষ প্রান্তে। তার রঙ-জ্বলা ভবনের অনেকটাই ওপরে ওঠানো, কাপড় তার জায়গামতো নাই। অনেকদিন আগে, এই ঘরে তখন তমিজের মায়ের সংসার, একদিন অমাবস্যার রাতে তমিজের বাপ কালাহার বিলে নামলে মুনসির পোষা গজারের একটি এক কামড়ে তার উরু থেকে খুবলে নিয়েছিলো এক ছটাক মাংস। তমিজের বাপের বন ওপরে ওঠায় সেই কামড়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। তার নিচে হাঁটুতে দগদগ করে বছরখানেকের একটি ঘা। এই ঘা শুরু হলো বড়শির খোঁচা খেয়ে। বড়শি পেতে তমিজের বাপ বসেছিলো ফকিরের ঘাটের শ্যাওড়াগাছের নিচে। মস্ত একটা মাগুর বড়শিতে গেঁথে গেলে তমিজের বাপ হঠাৎ করে টান দেয়। মাগুরশুদ্ধ বড়শি এসে লাগলো তার হাঁটুর ওপর, বড়শি থেকে মাছ ছিটকে পড়ে শ্যাওড়াগাছের নিচু একটা ডালে আর বড়শি গেঁথে যায় তার হাঁটুর ভেতর। মাছটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি, পানিতে যে ওটা ফিরে গেছে তারও কোনো আলামত তমিজের বাপ দেখে নি। মাছটা তবে ডাঙায় এসেছিলো কার ইশারায় যে তার কারসাজিতে বড়শির ঘা তার আজো সারলো না? তমিজের মায়ের আমলের গজার মাছের কামড়ের দাগ আর হাল আমলের বড়শিবেঁধার ঘা কিন্তু কাছাকাছিই থাকে। ঘা তার দিনে দিনে বাড়ে, ভাব দেখে মনে হয়, গজারের কামড়ের দাগকে বুঝি এই ছুঁয়ে ফেললো। কিন্তু ঐ দাগের সীমায় পৌঁছে শালা আর এগোয় না, আর ওপরে ওঠার লক্ষণ তার নাই। তবে ঘা তার শুকায়ও না, যেটুকুই আছে পুঁজে রসে তাই আরো পুরুষ্ট হয়ে ওঠে।
কাদা লেগে রয়েছে হাঁটুর নিচেই। আর একটুখানি ওপরে লাগলে ঘায়ের আঁশটে গন্ধে কালাহার বিলের সোঁদা গন্ধ মিশে অন্য একটি গন্ধ পাওয়া যেতো। ঐ গন্ধটাও কুলসুমের খুব চেনা। এখন পর্যন্ত আগলে-রাখা নাকছাবিপরা নাকটিকে কুঁচকে নিশ্বাস নিলে বিলের পানির একটু সোঁদা, একটু পানসে ও একটু আঁশটে গন্ধের সঙ্গে তার নাকে ঝাপটা মারে অন্য আরেকটি হালকা বাস্না। কিসের বাস্না গো? মাচার ওপর উঠে কুলসুম এদিক দেখে, ওদিক দেখে। গন্ধে গন্ধে দিশা পেলে জিনিসটা তার চোখে পড়ে। কী গো?–না, তমিজের বাপের রোগপটকা কালোকিষ্টি গতরের পিঠের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে শাপলা ফুলের হেঁড়াখোড়া পাপড়ি। এবার কুলসুমের নাকের সঙ্গে সারা পেট ও বুক নিয়োজিত হয় গন্ধ শোকার কাজে। সারাটা শরীর দিয়ে বাতাস টেনে টেনে ছোটো ও মাঝারি নিশ্বাসগুলিকেও সে প্রসারিত করে লম্বা একটি নিশ্বাসে। তা সেটাকে দীর্ঘশ্বাসই বলা যায়। এই দীর্ঘশ্বাসটিকে শব্দে হেঁকে নিলে তার কথাগুলি হবে এরকম : বুড়া যদি শাপলার উঁটা কয়টা তুলে আনতো! তাহলে কী হতো? তাহলে বেশি করে মরিচ দিয়ে, রসুনের কয়টা কোয়া কুচিয়ে ফেলে কুলসুম কী সুন্দর চচ্চড়ি বেঁধে ফেলে। একটু চচ্চড়ি হলে পোড়া মরিচ কয়টা ডলে নিয়ে তমিজের বাপ তিন সানকি ভাত সেঁটে ফেলতে পারে একাই। রাতভর হাঁটাহাঁটি করে আর কাদাপানি ঘেঁটে ঘরে ফিরলে পরদিন অনেক বেলা করে উঠে তমিজের বাপ কী ভাতটাই না গেলে! এই হাড়গিলা গতরটার ভেতর বুড়া এতো এতো ভাত রাখে কোথায়?
বুড়ার জন্যেও বটে, তার নিজেরও বেশ খিদে পেয়েছে, আজ সকাল সকাল ভাত চড়ানো দরকার। কাল দুপুর থেকে ঝমঝম বৃষ্টি, উঠানের চুলা পানিতে টইটম্বুর। পরশুদিনের ভাতে পানি দেওয়া ছিলো, কাল বিকালে তমিজের বাপ একলাই তার সবটা গিললো। পান্তা খেয়ে হুকায় কয়েকটা টান দিয়ে মাচায় উঠে বুড়া সেই যে নিন্দ পাড়তে শুরু করলো, আল্লা রে আল্লা, সন্ধ্যাবেলার ঝড়, ঝড়ের পর বৃষ্টি, তারপর আসমানের একটু জিরিয়ে নেওয়ার পর ফের টিপটিপ বৃষ্টি, মানুষটা এসবের কোনো খবরই যদি রাখে! পেট ঠাণ্ডা থাকলে বুড়া কী ঘুমটাই যে পাড়ে!
কাল সকালে কয়েকটা শাক আলু পেটে জামিন দিয়েছিলো কুলসুম। ব্যস ওই পর্যন্ত। এ ছাড়া এ পর্যন্ত তার মুখে একটা দানা পড়ে নি। তার আর ঘুম হয় কোখেকে? ঘরে ভোলা-উনান একটা আছে, কিন্তু পরের দিন বাদলা হলে চাল জুটবে কী করে—এই বিবেচনায় হাঁড়ির চালটুকুতে গন্ধ নিয়ে কুলসুম গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েছিলো স্বামীর পাশে। ঘরে এবার নতুন চাল ছাওয়া হয়েছে, কোনোখান দিয়ে পানি পড়ছে না—এই সুখে বিভোর কুলসুমের চোখেও যে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছিলো সে কিছুই টের পায় নি। তারপর তমিজের বাপ কখন উঠলো, বাইরে গেলো কখন, আবার ফিরে এসে শুয়ে পড়লো মেঝেতে,-কুলসুম এসব কিছুই টের পায় নি। তমিজের বাপ এখন যতোই ঘুমাক, বেলা করে ঘুম থেকে উঠে পিঁচুটি-জড়ানো চোখে ঘরের কোণে হাঁড়িবাসনের দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকবে, তারপর ভাত না পেলে তার সারা শরীরে সাড়া পড়ে যাবে, তখন গলা থেকে কাশি জড়ানা যে স্বর বেরোবে তাতে আর কারো ঘরে টেকা দায়।
তবে সেই স্বর বেরুতে এখনো দেরি আছে, বুড়া অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগে ঘরের দুটো এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার মাটির সরা তুলে কুলসুম প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়। এই কম্ম করতে তাকে মেঝেতে নামতে হয় নি, মাচায় বসেই মাচার শেষ প্রান্তের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা যায়। তো তার তিনটে কি চারটে নিশ্বাসে হাঁড়ির সের দেড়েক চালে বলকানো ভাতের সুবাস পাওয়া যায়। এতে তার পেট, তারপর তলপেট এবং তলপেট থেকে ফের পেট হয়ে ওপরদিকে বুক ও একেবারে জিভ পর্যন্ত চনচন করে ওঠে। চালের ভাতের গন্ধ পেয়ে পেটের এই তোলপাড়ে কুলসুমের গতর কিন্তু এলিয়ে পড়ে না, বরং আরো চাঙা হয়ে ওঠে। গতরের সাড়ায় সে তখন এটা করে, ওটা করে। যেমন, কয়েক মাস আগে টাউন থেকে তমিজের নিয়ে-আসা বড়ো এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার মাটির সরা সরিয়ে তমিজের মায়ের আমলের একটা ওষুধের শিশি আলগোছে তুলে তার খরখরে আঙুলে কাচের মসৃণ ছোঁয়া নেয়। ছোটো গোল আয়নাটা ডান হাতে নিয়ে একবার নিজের মুখের ডানদিকে, একবার বাঁদিকে এবং একবার চিবুক দেখে। দুই গাল ও চিবুক দেখার পুনরাবৃত্তি চলে বেশ কয়েকবার। দুই গালের মধ্যে তার তেমন ফারাক নাই, শরীরের শ্যামলা রঙ গালে ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে বলে নিজের মুখটাকে তার প্রায় ফর্সাই ঠেকে। টিকলো না হলেও নাকটা তার উঁচুই, সামনের দিকটা একটু বড়ো। ঠোঁটজোড়া তার দাদার মতো অতোটা পাতলা নয়, কিন্তু পান খেলে দাদার মতোই দুটো ঠোটই টুকটুকে লাল দেখায়। দাদার মুখে পানশুপারি থাকতে দিনরাত, কুলসুম পান পায় কোথায়? আয়না ভালো করে দেখে সেটা পাশে রেখে হাঁড়ির ভেতর থেকে একটা একটা করে তমিজের পুরনো পিরান, লুঙি ও তিলে-ধরা কিস্তি টুপি হাতে নিয়ে নাকের সঙ্গে ঠেকিয়ে কুলসুম জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে গন্ধ নেয়। তমিজের পিরানের পিঠটা হেঁড়া, তমিজ ফেলে যাবার পর আর ধোয়া হয় নি। জামার বুকে ঘামের গন্ধ দিনদিন ফিকে হয়ে আসছে, কুলসুমের নিশ্বাসের তোড়ে শিগগরিই মুছে না যায়! না-কি নিশ্বাসে নিশ্বাসেই এর গন্ধ এখন পর্যন্ত টিকে আছে কি-না তাই বা কে জানে?
রোজ সকালবেলার এইসব কাজকাম সেরে কুলসুম মেঝের দিকে আড়চোখে তাকায়। না, তমিজের বাপ আঘোরে ঘুমায়। কুলসুম এবার মাচার সব হাঁড়িপাতিল বস্তার আড়ালে লুকিয়ে-রাখা ঘরের সবচেয়ে পুরোনো জিনিস তার দাদার জরাজীর্ণ বইটা বার করে জান ভরে গন্ধ নেয়। বইটা তার দাদার, দাদা হলো তার বাপের বাপ, অথচ তমিজের বাপ এটাকে আগলে রাখে যক্ষের ধনের মতো। জাহেল মানুষ, মাঝির বেটা, বইয়ের সে বোঝেটা কী? অথচ কুলসুম এটায় হাত দিয়েছে টের পেলেই কটমট করে তাকায়। পাতায় পাতায় চৌকো চৌকো দাগ দেওয়া আর হাবিজাবি কী লেখায় ভরা এই বই তার দাদা যে কী বুঝতো আল্লাই জানে, এ নিয়ে কুলসুমের মাথাব্যথা নাই। তবে হাজার হলেও দাদার জিনিস, অনেকক্ষণ ধরে গুঁকলে দরজায় দাদার চেহারাটা ভেসে ওঠে। কিন্তু তারিয়ে তারিয়ে দাদাকে দেখার সময় কোথায় তার? মাটিতে কুলসুমের ভারি পায়ের চাপে তমিজের বাপের রোগা কালো গতরে অল্প একটু হলেও সাড়া পড়ে, কীসব বিড়বিড় করতে করতে লুঙিটা সে তোলে আরেকটু ওপরে। এতোক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো তার হাঁটুর ঘা, এবার তমিজের মায়ের আমলের কাটা দাগটাও বেরিয়ে পড়লো। লুঙি আরেকটু ওপরে উঠলেই বুড়ার কালো কালো কুচকুচে বিচি দুটোর ওপর ন্যাতানো নুনুখানও বেরিয়ে পড়বে। ওটা দেখে লাভ কী কুলসুমের? কিন্তু স্বামীর লুঙি ঠিক করার চেষ্টা না করে কুলসুম চুপচাপ দাড়িয়েই থাকে। কান দুটো তার খাড়া করে রাখা, সমস্ত মনোযোগ দিয়ে সে তমিজের বাপের বিড়বিড় ধ্বনির আস্ত আস্ত শব্দগুলো শুনতে চায়। তমিজের বাপের থুথুতে জড়ানো তলাত তাজল তাছ ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ছপছপ করে গড়িয়ে পড়লে কুলসুম আরো ভালো করে কান পাতে। তমিজের বাপ এখন কী স্বপ্ন দেখছে? কাজল বলতে গিয়েই কি তার মুখ দিয়ে তাজল বেরুলো? দাদা বলতো, কাজলের স্বপ্ন দেখলে ছেলেমেয়ে বাপমায়ের কলজে ঠাণ্ডা করে দেয়। এর মানে হলো, ছেলেমেয়ের হাতে বাপমায়ের জান জুড়ায়। তা তমিজের বাপের ফরজন্দ বেটা আছে, এরকম খোয়াব তো সে দেখতেই পারে। নিজের খালি কোলে হাত রেখে স্বামীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত কুলসুম চোখ বুলায় এই আবোর মানুষটা কি তার বিয়ে-করা বিবির শূন্য কোলের কথা কখনো ভাবে? তার কি হুঁশজ্ঞান কিছু আছে?–বেহুঁশ হয়ে ঘুম পাড়তে পাড়তে তমিজের বাপ নতুন করে বিড়বিড় করে উঠলে কুলসুম ফের সেদিকে কান পাতে। কিন্তু অন্য সময়ের মতো এখনো তার কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে গলার ভেতর ভাত খাবার সুড়ঙ্গ দিয়ে সেঁধিয়ে পড়ে তমিজের বাপের পেটের ভেতর। কুলসুম কখনো তার নাগাল পায় না। দিনের বেলা কিংবা রাতেও জাগনা থাকলে শোলোক বলার ক্ষমতা তমিজের বাপের লোপ পায়। তখন যতোই পুস করো, ক্যা গো, নিন্দের মদ্যে কার সাথে কি শোলেক কচ্ছিলা, কও তো? শুনে তমিজের বাপ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, তার ঘুমের ভেতরকার কথা জানবার জন্যে কুলসুম বেশি পীড়াপীড়ি করলে সে ভুরু কোঁচকায়, মেজাজ ভালো থাকলে হয়তো স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নে বলা শোলোক মনে করার চেষ্টা করে, চেষ্টা করতে করতে ঝিমায়, চেষ্টা করার ক্লান্তিতে তার স্বর নিচু হয়ে আসে এবং ঘুমের ভেতরে যেভাবে বলে প্রায় সেভাবেই বিড়বিড় করে, নিন্দের মদ্যে মানুষ কী কয় না কয়, কিছু মনে থাকে? কী জানি বাপু, কী যে কলাম। কী বা দেখলাম। তার স্বপ্ন মনে করার জন্যে কুলসুম আরো মিনতি করলে তার দাম বাড়ে, ধমক দিয়ে ওঠে তখন, অঙের কথা এখন থো। ভাত দে। ভাদ্দে। কামোত যাই। কুলসুমের গো তবু যায় না, স্বামীর ধমক খেয়েও তার হুশ হয় না, এমন কি তমিজের বাপের হাতের মারও সে থোরাই পরোয়া ক্লরে। ঘুমন্ত মানুষ কথা বলে মুনসির সাথে, না হলে জিন পরির সাথে, মাসুম বাচ্চাদের আলাপ হয় ফেরেশতাদের সাথে। আগুনের জীবদের সাথে তমিজের বাপের কি যোগাযোগ হয় না? দাদা বলতো, মানুষটাক আবোর ঠেকলে কী হয়, জাহেল মাঝির বেটা হলে কী হয়, অর মদ্যে বাতেনি এলেম থাকবার পারে রে! মানুষটার মদ্যে আগুন জ্বলে!
এমন কালোকিষ্টি ছাইয়ের গাদার ভেতর আগুন উস্কে তোলার জন্যেই কি দাদা তাকে এর হাতে সোপর্দ করে কেটে পড়লো? তা সেই দাদার তত্ত্বতালাশ কি তমিজের বাপ কিছুই করতে পারে না? দাদার সঙ্গে কতো বছর ধরে এতো মেলামেশা করলো, এতো গুজুরগাজুর এতো ফুসুরাসুর করেও তমিজের বাপ কি দাদার কি কিছুই রপ্ত করতে পারলো না? দাদার যে হেঁড়াখোড়া পুরোনো বই, বইয়ের ভেতরে নানা কিসিমের চিহ্ন, চৌকো রেখা, হাবিজাবি কীসব লেখা,-এইসব দেখে দেখে, মাটিতে ওইসব রেখা এঁকে এঁকে দাদা কতো মানুষের খোয়াবের মানে বলে দিয়েছে, হারানো জিনিসের হদিস করে দিয়েছে; কত মানুষের হাউসের মেয়েমানুষের সঙ্গে আশেকের পথ বাতলে দিয়েছে; বলতে নাই, কুলসুম শুনেছে জোয়ান বয়সে এই বই দেখে দেখেই মানুষের কাছে পয়সা নিয়ে দাদা অনেকের সংসার ভেঙেও নাকি দিয়েছে।তো সেই বইটাই রয়ে গেলো তমিজের বাপের কাছে। বইয়ের মালিক হয়েও মানুষটা কুলসুমের দাদার কোনো খবরই বার করতে পারে না। ঘুমের মধ্যে এই যে উঠে কোন মুলুক ঘুরে আসে, ঘরে যতোক্ষণ ঘুমায় ঘুমের মধ্যে কী কী বলে, দাদার শোলোকগুলোই তোতলায়, তা সে কি কোনো ইশারাই পায় না? নাঃ! তার কথা বোঝবার কোনো উপায়ই কুলসুমের নাই। এইযে কথা কয়টা মুখ থেকে ছাড়তে ছাড়তেই তমিজের বাপ ফের মিহি সুরে নাক ডাকতে শুরু করলো, কখন খান্ত দেয় কে জানে? মেঝে জুড়ে বুড়া যেভাবে শুয়ে থাকে তাতে মাচা থেকে কুলসুমের নামাটাও মুশকিল। ওই হাড়গিলা শরীরে তিল পরিমাণ জায়গাতেও তার পা ঠেকে তো সর্বনাশ, বুড়া একটা হুলুস্থুল কাণ্ড করে বসবে। এই পা লাগানো নিয়ে একদিন তার কম ভোগান্তি হয় নি।
সেও তো অনেকদিন হয়ে গেলো। তার বিয়ের তখন বোধহয় বছর দুয়েক কেটেছে, তমিজের বাপ সন্ধ্যারাতে বসে ভাত খাচ্ছে, ল্যাম্ফোর কালচে আলোয় ঘর একটু থমকে ছিলো, বাইরে চাঁদের আলোয় উঠানে বসে হুঁকা টানছিলো তমিজ। তামাকের ধোঁয়ার নেশায়-মাতাল জ্যোৎস্নার অনেকটাই খোলা দরজা পেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে কালচে লাল আলোতে হলুদ রঙ মিশিয়ে দেওয়ায় কুলসুমের মাথাটা হয়তো এতটু ঘুরেই গিয়েছিলো। এমন সময় ট্যাংরা মাছ দিয়ে গোগ্রাসে ভাত খেতে খেতে তমিজের বাপ একটা পেঁয়াজ চাইলো। কুলসুম উঠে দাঁড়িয়ে মাচার ওপর মাটির হাঁড়ি থেকে পেঁয়াজ পেড়ে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে স্বামীর পাতে দেবে বলে উপুড় হয়েছে, কিংবা উপুড় হয়ে বসতে গেছে স্বামীর সামনে, এমন সময় তার বাম পা লেগে গেলো তমিজের বাপের ডান হাতের কনুইতে। ফলে ভাতের সানকিখান একটু কাৎ হয়ে পড়লো। ঘরের মেঝে লেপামোছায় কুলসুম একটু অকর্মা, সারা মেঝে জুড়ে সম্পূর্ণ সমান জায়গা, একটাও যদি পাওয়া যায়! তা তমিজের বাপের সানকির ডালের একটুখানি ছলকে পড়লো মেঝেতে। না, আর কিছু পড়ে নি। ছলকে-পড়া ডালের সঙ্গে ভাতের কয়েকটা দানা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। ট্যাংরা মাছের চচ্চড়ির মাছের কণা কি বেগুনের কুচি কি পোড়া মরিচের কামড়ানো টুকরা সব যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গিয়েছিলো সানকির ভেতরেই। তাতেও মানুষটার রাগ কী! তড়াং করে লাফিয়ে উঠলো ভাত ছেড়ে, তারপর শুরু হলো তার সাটাসাটি, তুই আমার ভাতেত পাও দিস? এই নাপাক ভাত হামি এখন মুখোত তুলি ক্যাংকা করা? সঙ্গে সঙ্গে ওই এঁটো হাতের কিল পড়তে লাগলো কুলসুমের পিঠে। বাপরে, ভাতের সঙ্গে বহুদিন পর মুখে দুটো মাছ পড়তে না পড়তে বুড়ার তেজ কী! হাতের কিল আর তার থামে না। ওদিকে চাঁদের আলোয় হুকা টানা খান্ত দিয়ে দরজায় এসে দাড়ালো তমিজ। বাপের রাগে জোগান দেয়। সেও, বাজানের ভাতের থালিত তুমি পাও দেও? ইটা কেমন কথা গো? মুখের রন্ন তুমি পাও দিয়া ঠেললা? নক্ষ্মীর কপালেত তুমি নাথি মারো? কেমন মেয়ামানুষ গো তুমি?
ছেলের সমর্থনে শক্তি পেয়ে বাপ বৌয়ের চুল ধরে টেনে আনে উঠানে, বলে, অতো খলবল খলবল কিসক রে? হুঁশিয়ার হয়া কাম করা যায় না? বেহায়া মাগী, মনে হয় চুলকানি উঠিছে, খালি নাফ পাড়ে, খালি নাফ পাড়ে। আর এই তমিজ জোয়ান মরদটা, কিছুই জানলো না, বুঝলো না, শুরু করলো প্যাচাল পাড়তে, ওজগার তো করো না, ফকিরের ঘরের বেটি, ওজগারের কষ্ট তো বোঝো না! মানুষের ভাতের থালিত তুমি নাথি মারবা না তো মারবি কেটা? তমিজের আক্ষেপে তার বাপের তেজ কিন্তু বাড়ে না। সানকি থেকে ভাতের কয়েকটা দানা গড়িয়ে পড়ার বেদনায় ক্লিষ্ট মুখে সে আরো কয়েক গ্রাস ভাত তোলে এবং তবুও অর্ধভুক্ত থাকার কষ্ট বুকে নিয়ে উঠানের দিকে মুখ করে বসে পড়ে চৌকাঠের ওপর। উঠানের ছোটো ফাঁকা জায়গাটা হালকা ফ্যাকাশে জোৎস্নায় একটুখানি ওপরে উঠেছিলো, ঊর্ধ্বগামী সেই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে সে হুঙ্কার ছাড়ে, তামুক দে! বৌকে বকার হঠাৎ উত্তেজনায় সে হাঁপায়, ফলে তার হুঙ্কারে রুগ্ন ঘর্ঘরতা, সেই শব্দে জোৎস্নায় এতোটুকু চিড় ধরে না এবং কুলসুম পর্যন্ত ওই হুকুম কিংবা তমিজের হালকা ক্ষোভ এবং জ্যোৎস্নাপীড়িত ছটফটে শূন্যতাকে কিছুমাত্র পরোয়া না করে পায়ের দুমদাম আওয়াজে ঘরে ঢোকে। ঐ যে ঘরে ঢুকে মাচার ওপর শুয়ে পড়লো, সারারাত সে আর উঠবে না। মেঝেতে তার ভাতের খোলা হাঁড়ি যেমন ছিলো তেমনি খোলাই পড়ে থাকবে, এলোমেলোভাবে ছিটানো থাকবে এটা ভাতের সানকি, পানি খাবার খোরা, পানির বদনা। এসব এমনি পড়েই থাকবে। এই যে না খেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো, এখন মারো আর বকো, কারো সাধ্যি নাই তাকে মাচা থেকে ওঠায়। ওদিকে মণ্ডলবাড়িতে রাতভর সের দুয়েক চাল নিয়ে ঘরে ফেরা, তাই বা কম কী? এখন এই মাগীকে মাচা থেকে ওঠায় কে? বৌকে মাচা থেকে ওঠাবার ক্ষমতা হয় না বলে এবং গলার জোরও মিইয়ে আসায় তমিজের বাপকে অব্যাহত রাখতে হয় আগের প্যাচাল। তবে প্যাচালে এখন আফসোসই বেশি, মেয়ামানুষ, তার এতো কোদ্দ ভালো লয়, ভালো লয়। আজ পাছাবেলা থ্যাকা খলবল, খালি খলবল। নাফপাড়া মেয়ামানুষের কপলেতে দুষ্ক থাকে, সংসার ছারেখারে যায়।
মাচায় শুয়ে এসব শুনতে শুনতে কুলসুমের সত্যি সত্যি লাফ পাড়তে ইচ্ছা করে। বুড়া তার লাফ পাড়ার দেখলোটা কী? খিয়ার এলাকায় ধান কাটা সেরে আগের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিলো তমিজ। গাঁয়ের বাইরে রোজগার করতে যাওয়া জীবনে তার সেই প্রথম। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো কম করে হলেও তিন আনা কম দুইটা টাকা। আকালের দুই বছর আগে সেটা কি কম টাকা গো? খিয়ারের ধান নিয়ে এসেছিলো তাও সের আষ্টেক তো হবেই। কাল সন্ধ্যায় তমিজ যখন বাড়ি পৌঁছয় কুলসুম তখন মণ্ডলবাড়িতে। পরদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে সে দেখে, তমিজ গিয়েছে নিজগিরিরডাঙায়, মণ্ডলের জমির ফলন আর ধান কাটা দেখতে। তারপর কাৎলাহার বিল ঘুরে এসেছে তৌড়া জালটা নিয়ে, কয়েকটা ট্যাংরা নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে তার দুপুর পেরিয়ে বিকাল। মাঝির ঘরের ছেলে হলে কী হয়, মাছ ধরায় তার হাউস কম, কেরামতিও একটু কমই। তবে মাছ ছাড়া খিয়ারের চিকন চালের ভাত খেতে মন চায় না। সেই জন্যেই তার জাল নিয়ে বিলে যাওয়া। খিয়ারের চিকন চালের ভাত, চিরল চিরল করে কাটা এলোকেশী বেগুনের সঙ্গে খুব ঝাল দিয়ে বাঁধা মাছ। চচ্চড়ি, মাসকলায়ের ডাল আর নতুন আলুর ভর্তা,এতোসব রান্নাবান্নার উত্তেজনায় কুলসুম সেদিন তমিজের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলো একটু বেশি। হাসাহাসিটাও বোধহয় বেশিই হয়ে গিয়েছিলো। তা কুলসুমের দোষ কী? বুড়া খালি তার পেছনে লেগে থাকে, নিজের বেটার ইয়ার্কি মারা তার চোখেই পড়ে না। রঙ করে তো তার বেটা, আজ দেখা হওয়ার পর থেকে তো সে কেবল মজা করে খিয়ারের গল্পই করলো সেখানে একোজন জোতদারের দেড়শো দুইশো পাঁচশ্যে হাজার বিঘা জমি। তাদের জমিতে দাঁড়ালে যতোদূর চোখ যায় খালি ধানের ভিউ। মাঠের পর মাঠ সেখানে ধানের জমি। কোন কোন মুলুক থেকে সেখানে ধান কিনতে যায় পাইকাররা। মণকে মণ ধান কিনে ধানের বস্তা নিয়ে রেলগাড়ি করে তারা চলে যায় কোথায় কোথায়! তালোড়া না কাহালু-কীসব জায়গায় রেলের স্টেশন আছে, স্টেশনের পাকা বারান্দায় ধানের বস্তার পাহাড় জমে ওঠে! এতো ধান হলে কী হবে, খিয়ারের মানুষ নাকি কিপটের একশেষ, ফকির মিসকিনকে তারা খয়রাত দেয় না, রাত্রে মুসাফির এলে তারা ঘরের দরজা আটকে রাখে। দেশে পানি না থাকলে মানুষের জানে দয়ামায়া একটু কমই হয়। সেখানে নদী নাই, খাল নাই, খালি বড়ো বড়ো পুকুর। সেগুলো তো আর আল্লার দান নয়, মানুষের কাটা। নদীই নাই, সেখানে বান হবে কোত্থেকে? বানের পানির কামড়ে পায়ে ঘা হয় শুনে কোন বর্গাদারের বেটার বৌ ও মা! কী কচ্ছে? পানি বলে কামড়ায়? পানির দাঁত জালায় নাকি? বলে কীরকম আঁতকে উঠেছিলো তমিজ অদ্ভুত ভঙ্গি করে তার নকল করলে কুলসুম হেসে বাঁচে না। তবে খিয়ারের মানুষের সুখ বুঝি আর টেকে না।–উত্তর থেকে পশ্চিম থেকে নতুন নতুন ঢেউ আসছে, বর্গাদাররা সব ধান নিজেদের ঘরে তোলার জন্যে একজোট হচ্ছে। ইগলান কী কথা?-কুলসুমের বিস্ময়ে উৎসাহিত হয়ে তমিজ গম্ভীর হয়ে যায়। তবে কুলসুমকে আবার আশ্বাসও দেয়, কোথায় এখন যুদ্ধ চলছে, সবাই সেই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, বর্গাদারদের নেতারা কী করবে বুঝে উঠতে পাচ্ছে না। তা যুদ্ধের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী?—কুলসুমের এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া তমিজের পক্ষে একটু মুশকিল। তবে সে জানায়, যুদ্ধের জন্যে সব জিনিসের দাম বাড়ছে। টাউনে তমিজ নিজে নিজে দেখে এসেছে গোরুর গোশতের সের উঠেছে। চার আনায়। দর না উঠলে সেরখানেক গোশত সে নিয়ে আসতো। এই যে বাজারে সাদা কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছে না, মণ্ডলরা হ্যারিকেন জ্বালাতে টাউন থেকে চড়া দামে সাদা কেরোসিন আনে,—এসবই যুদ্ধের জন্যে। যুদ্ধের সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম চড়বে কেন?—কুলসুমের কৌতূহলে সাড়া না দিয়ে তমিজ তখন টাউনের গপ্পো ধরে। তাকে খিয়ারে যাওয়া আসা করতে হয়েছে তো টাউন হয়ে। টাউনের মানুষ সব দোকানে বসে চা খায়, গরম চা দেয় ছোটো একটা খোরার মধ্যে করে। যুদ্ধের জন্যে নাকি সাদা। চিনিও পাওয়া যায় না, তারা লাল চিনির চা খায়, একেক খোরা দুই পয়সা। একবার খেতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে তমিজের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে বাবা, আর নয়! টাউনের মানুষ সব মানুষ সুবিধার লয় গো, কথার প্যাচে তারা মানুষকে ঠকায়, চার আনার জিনিস তারা দর হাঁকে আট আনা দশ আনা। সেখানকার হোটেলে কতো কিসিমের খাবারই যে পাওয়া যায়, কুত্তা জবাই করে তারা খাসি বলে চালায়। তমিজ তাই টাউনে আর যাই করুক, গোশত কখনোই খায় না। তাকে ঠকাবার জো নাই, পুবের পাড়াগাঁর মানুষ হলে কী হয়, টাউনের ফন্দি ফিকির ধরতে আর দেরি হয় নি। তারপর ধরো টাউনের মেয়েমানুষেরা! তারা কীভাবে কথা বলে, মাজা দুলিয়ে তাদের হাঁটা, বিয়ের বয়েসি ল মেয়েরা, বিয়ে দিলে দুই তিন ছেলের মা হতো, বুকের সঙ্গে বই জড়িয়ে ধরে ইস্কুলে যায়, রিকশায় শাড়ি জড়িয়ে পর্দা করে বসেও শাড়ির ওপর দিয়ে মুখ তুলে তারা টাউন দেখতে দেখতে, কথা বলতে বলতে চলে,-শরীর দুলিয়ে তমিজ এসব বিত্তান্ত এমনভাবে বলে যে হেসে কুটিকুটি না হয়ে কুলসুমের আর জো থাকে না। তা এসব কথাবার্তা আর হাসাহাসিতে তমিজের বাপের মন থাকবে কোত্থেকে? ঘরে থাকলে বেশিরভাগ সময়ই তো সে ঘুমায়, না হয় হুঁকাটা হাতে গুড়ক গুড়ুক টানে, না হলে চৌকাঠে বসে ঝিমায়। তা এতোদিন পরে তমিজ সেদিন ঘরে ফিরেছিলো, সেবার সেই তো তার প্রথম গাঁয়ের বাইরে যাওয়া। ছেলে রোজগার করে ঘরে এলো তো কুলসুম। একটু খুশি হবে না? হোক না তার সৎ বেটা, হোক না সতীনের বেটা, পেটে নাই বা ধরলো তাকে, তবু বেটা তো!
সেই কতোদিন আগের কথা, কতো দিন আগের উচ্ছ্বাস, আকালের আগের খুশি, আকালের কাঁটাবেঁধা বছর উজিয়ে এসে কুলসুমের বুকে ছলছল করে ওঠে। গর্ভে তো সে কাউকে ধরলো না, ছেলে বলো আর মেয়ে বলো তমিজই তার সব। এই আবেগ বুকে উপচে পড়লে সারাটা শরীর তার শিরশির করে এবং শরীরের এই উৎপাত থেকে রেহাই পাবার তাগিদে তমিজের দোষ ধরার জন্যে সে হঠাৎ করে হন্যে হয়ে ওঠে। কিন্তু সে হলো মুখ মেয়েমানুষ, ফকিরের ঘরের বেটি, অতো বড়ো জোয়ান মরদ তমিজের আয়াব তার চোখে পড়ে কী করে? বরং তমিজের বাপের অঘোরে ঘুমের সুযোগে ছেলের ওপর বাপটার এই রাগের খানিকটা চুরি করে সে চাখে : ক্যা বাপু, কামের খোজে খিয়ার এলাকাত না গেলে হয় না?-কিন্তু আবার কাজের সুযোগ এদিকে দিনে দিনে কমে আসছে। এ কথাও তো ঠিক। বেশি দিন নয়, ময়মুরুব্বির কাছে শোনা গেছে, ১০/১২ বছর আগে এই গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙায়, বিলের এপার ওপার জুড়ে ধান রোপা, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা—সব কামই পাওয়া গেছে। এখানেই। তখন নাকি কামলা দেওয়ার মানুষই ছিলো কম। আর যখন তখন কোনো কাজ বাধলে যেতে হতো বিলের ওপারের পচার বেটা কসিমুদ্দির কাছে। লোকটা বাপের মতোই বোকা ছিলো। জমি ছিলো না তার এক ফোঁটা। থাকতো চাষাদের খুলিতে, এর বারান্দায়, ওর গোয়ালে। গাছ কাটা কি ঘর মেরামতের দরকার হলে মানুষ তার হাতে পায়ে ধরতো। আর দেখো, এই কয় বছরে যেদিকে তাকাও হাজার কসিমুদ্দি। সব শালা খালি কাম খুঁজে বেড়ায়। আকালের বছর এতো মানুষ মরলো, এতো মানুষ ভিটাজমি বেচে দেশান্তরি হলো, তবু শালার মানুষ তো কমে না। জমি-বেচা মানুষ যারা গাও ছাড়ে নি, সব কামলা খাটার জন্যে পাগল। কামের জুত কৈ? আগে বর্গাদাররা জমিতে মানুষ খাটাতো, এখন বর্গাদার তার কোলের ছেলেকে পর্যন্ত জমিতে লাগায়।-ঠিক আছে, সবই ঠিক? এরকম হলে তমিজ খিয়ারে না গিয়ে। করবে কী?—কিন্তু তার বাপের কথাটাও বোঝো, ভালো করে বুঝে দেখো। খিয়ারে কাম করতে গিয়ে মেয়েমানুষের সঙ্গে তোমার অতো ঢলাঢলি কিসের গো? তমিজের বাপ তো সবই জানে, কুলসুমও অনুমান করতে পারে, খিয়ারের মানুষ মানুষ ভালো লয়। জোয়ান মরদ, কামের মরদ দেখলে তারা নিজেদের মেয়েদের লেলিয়ে দেয় তার পেছনে। মেয়ের সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে ঐ ছেলেকে তারা ধরে রাখে নিজেদের ঘরে। ওদের দিয়ে নিজেদের বর্গা-নেওয়া জমিতে কাম করায়, গোরুবাছুরের দেখাশোনা করায়, ঘর। তোলে; মাটি ছেনে দেওয়াল গেঁথে তার ঘর তোলে, মেহনত কম নয়। ছেলে। চিরকালের জন্যে তাদেরই হয়ে যায়। ঐসব ডাইনি মেয়েরা ধুলা ঝাড়ে আর পুরুষগুলি তাদের গোলাম হয়ে জীবন কাটায়। নিজেদের বাপমায়ের কথা তাদের আর মনেও পড়ে না। বিয়ে করে পুরুষমানুষ শ্বশুরবাড়িতে কায়েম হবে, ব্যাপারটা কুলসুমের কাছে হঠাৎ করেই অসহ্য ঠেকে। তমিজের বাপ কি ব্যাজার হয় এমনি? তমিজের বাপ। তো যি সি মানুষ লয় বাপু!—ঘুমের মধ্যে সে কার ডাকে বাইরে চলে যায়, কতোদূর যায়, কোথায় যায়, কেউ জানে না। তমিজের বাপকে নিয়ে মানুষ কতো কথাই না বলে! এমনিতে টোপ পাড়লে কী হবে, কামে গেলে তার জুড়ি নাই। শরাফত মণ্ডলের দখলে যাবার আগে কাৎলাহার বিলের মাছ তো ভোগ করেছে মাঝিপাড়ার মানুষই। তখন তমিজের বাপের তৌড়া জালেও পাঁচ সের সাত সের রুই কাৎলা উঠেছে কয়েকটা করে। মাছের ভারে এইসব ছোটো জাল বিলের তলায় এমনি করে আটকে গেছে যে তমিজের বাপকে গলা পানিতে নেমে জালের দড়ি গোটাতে হয়েছে। মুরুব্বি মাঝিরা বলেছে, তুমি বাপু বিলে নামার সময় হুঁশিয়ার হয়া নামো। তুমি জাল ফালালেই ব্যামাক মাছ মনে হয় দৌড়াদৌড়ি করা খালি তোমার জালতই আসে। কথা ভালো লয় বাপু। কেউ কেউ আরো ভয় দেখিয়েছে, একটা গজার যদি একদিন জালেত পড়ে তো বড়ো মুসবিত হবি। কেউ কেউ তার রক্তে তার দাদা বাঘাড় মাঝির অসাধারণ কেরামতি প্রবাহিত হয় বলে মন্তব্য করেছে। এসব অনেক আগের কথা। এখানে। তখন তমিজের মায়ের সংসার, কিংবা আরো আগে তমিজের বাপ তখনো বিয়েই করে। নি। তবে কুলসুমের দাদা চেরাগ আলি জানতো আসল খবর।ওসব দাদা পরদাদা কোনো ব্যাপার নয়। তমিজের বাপের শক্তি আসে পাকুড়গাছ থেকে। কালাহার বিল এখন মণ্ডলের দখল, মাঝির বেটা তমিজের বাপ এখন আর মাছ ধরার কেরামতি দেখায় কোত্থেকে?-দাদার কথা কুলসুম বিশ্বাস করে কীভাবে? এখানে আসার পর থেকে, তার বিয়ের অনেক আগে থেকেই তমিজের বাপকে সে তো এরকম ঝিমাতে আর ঘুমাতেই দেখে আসছে। কাৎলাহার বিল তো মণ্ডল ইজারা নিয়ে দখল করলো সেদিন, আকালের পরের বছর। তার আগে থেকেই তমিজের বাপ একইরকম মানুষ। তবে হ্যাঁ, কামে কোনোমতে একবার লাগলে সে নাকি অন্য মানুষ। জমিতে কাম। করতে গেলেও এখনো সে নাকি তিন কামলার খাটনি খাটে একলাই। আবার ঐ মানুষই ঘরে এলে শুরু হলো তার ঘুম আর টোপ-পাড়া। তবে একটা কথা আছে।-তমিজের বাপের ঘুম মানে তো খালি চোখ বন্ধ করে নাক ডাকা নয়; ঘুমের মধ্যেই তার নড়াচড়া, তার হাটা, ঘুমের মধ্যেই তার সব চলাচল। কতো মানুষ তাকে নিয়ে কতো কথা কয়। এতে মানুষের ভয় আর ভক্তি দেখেও বেটা তার কথা শোনে না কেন? বাপ যখন পছন্দ করে না তো তমিজ বছর বছর খিয়ারের দিকে না দৌড়ালেই পারে। এই যে আজ ২০/২১ দিন তমিজ বাড়ি নাই, এই বাদলায় খিয়ারে সে কী করছে কে জানে? এখন এখানে বিলের ওপারে মণ্ডলের জমিতে আউশ কাটা চলছে, হুরমতুল্লা একলাই তার জমি বর্গা করছে। আউশ কাটার পর বীজতলা থেকে চারা নিয়ে আমন। রোপা হচ্ছে। কাজের অভাব আছে? তমিজের ফুটানিটাও একটু বেশি। এখানে শরাফত মণ্ডলের জমি বর্গা করতে চাইলো, মণ্ডল রাজি হলো না দেখে সোজা হাঁটা দিলো খিয়ারের দিকে। তা বাপু ওখানেও তো কামলাই খাটবি, ওখানে তোকে জমি বর্গা দেওয়ার জন্যে মানুষ কি বসে আছে নাকি? এই বাদলায় সারা দিন পানিতে ভিজতে ভিজতে ধান কাটতে হবে তো ওখানেও। সন্ধ্যাবেলা কোনো বর্গাদারের ঘরের বারান্দায় সে হয়তো বর্গাদারের গোলগাল বৌ কি ছিনাল মেয়ের হাত থেকে চালভাজা কি কঁঠালের বিচি ভাজা খাচ্ছে। তা মাগীরা কি তাকে এমনি এমনি খেতে দেয়? বাঁশের খুঁটির সঙ্গে সুতা বেঁধে জাল বুনে নিচ্ছে না? তাদের আরো কতো ফন্দি আছে তাও কুলসুম ঠিক বোঝে!
এই সময়ে একটি টিকটিকির ঠিকঠিক আওয়াজ কুলসুমের অনুমানের যাথার্থ নিশ্চিন্ত করে। আসলে টিকটিকি নয়, মেঝেতে পাশ ফিরতে ফিরতে তমিজের বাপই বোধহয় তার সন্দেহে সায় দিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো। মানুষটা কী কয়? কাল রাতে বেরিয়ে কার সাথে কী নিয়ে কথাবার্তা বলে এসেছে? কুলসুমের দাদাই কি তমিজের বাপের স্বপ্নে এসে কিছু ইশারা দিয়ে যাচ্ছে?—ইশ! কথাগুলো যদি একটু বোঝা যায়! তমিজের বাপের ঘুমের ভেতর বলা কথা শুনতে কুলসুম মাটিতে উপুড় হয়ে কান পাতলো তমিজের বাপের মুখের কাছে। ঘুমের মধ্যেই তমিজের বাপ লুঙি আরেকটু ওপরে ওঠায়, তার হাত দুটো রাখে নিজের উরুসন্ধিতে এবং কথা বলার বদলে সে জোরে নাক ডাকতে থাকে। কুলসুম তার। লুঙিটা একটু নামাতে গেলে তমিজের বাপের নাক ডাকা থামে এবং সুস্বাদু কিছু খাবার ভঙ্গিতে জিভে ও টাকরায় চপচপ আওয়াজ করে?—তা হলে চেরাগ আলি কি তার স্বপ্ন থেকে সরে পড়লো নাকি? না-কি তমিজের বাপ নিজেই তার সব কথা গুটিয়ে নিচ্ছে নিজের গলার ভেতরে? চপচপ করে কথাগুলো গিলে ফেললে সেগুলো ঝাপসা হতে হতে ঠাঁই নেয় তমিজের বাপের কোন খোয়াবের শাঁসের মাঝখানে কুলসুম তার নাগাল পায় না।
কানে কথা ঢোকার বদলে তার নাকে ঢোকে তমিজের বাপের মুখের পচা আঁশটে গন্ধ। কুলসুমের টিকালো-না-হলেও উচু নাক বেয়ে তমিজের বাপের মুখের এই পরিচিত গন্ধ ঢুকে পড়ে তার পেটে। গলায় তো লাগেই, এমন কি একটুখানি ধাক্কা দেয় তার মগজেও। কুলসুমের জিভ জুড়ে এখন পচা মাছের বাস্না। মাচার নিচে বারবার থুথু ফেলে গন্ধটা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতেই কুলসুম স্বামীর নাকের কাছে নিজের নাক এগিয়ে দেয়। এতে তো পেটটা তার ভরে যাবার কথা, কিন্তু ফল হয় উল্টো। নিস্তেজ খিদেটা তার পেট থেকে তলপেটে এবং ফের পেট হয়ে বুক, এমন কি গলা পর্যন্ত হাঁচড়েপাঁচড়ে ঘোরে। শরীরের এইসব অঙ্গে তোলপাড় ওঠে যে একই সঙ্গে তা নয়। তার চোখের একেকটি পলকে একেকটি অঙ্গে খিদে খুব জোরেসোরে জানান দিয়ে যায়। তবে বারোভাতারি খানকি খিদেকে কাবু করার কায়দাও কুলসুমের জানা। আছে। জানে তো জন্ম থেকেই, তবে নতুন ফন্দিটা শিখেছে বছর দুই আগে আকালের সময়। সেটা কী রকম?—জোরালো কোনো গন্ধ পেট ভরে নিতে পারলেই পেটটা তার বেশ ফুলে ওঠে। তবে থুথু ফেললে চলবে না। থুথু যতোবার আসে একটু জমতে দিয়ে গিলে ফেলতে হবে, তাতে পাতলা ডাল খাওয়ার কাজ হয়। বমি বমি লাগবে; কিন্তু বমি করা চলবে না, বমি হলেই পেট খালি।
গন্ধের ভাবনাই কুলসুমের নাকে খেলিয়ে দেয় পানজৰ্দার হালকা সুবাস। গোলাবাড়ি হাটের বৈকুণ্ঠের মুখের এই গন্ধ বৈকুণ্ঠকে ছাড়াই এসে হাজির হলো,এরকম মাঝে মাঝে তো হয়ই, তবে এতে পেট ভরে না। গন্ধটা নাক দিয়ে ঢুকে গলা পর্যন্ত নেমে ফের উঠে যায় মাথায় এবং মগজে অনেকক্ষণ ধরে ম ম করে কখন মিলিয়ে যায় সে ঠিক ধরতে পারে না।
উঠানে ভাঙা মাটির মালসা চাপা-দেওয়া চুলার ভেতর ছাই গত রাতের বৃষ্টিতে ভিজে কাদা। এর ভেতর থেকে কয়লার দুটো টুকরা নিয়ে ফের ঘরের ভেতর দিয়ে বাইরের উঠান পেরিয়ে ডোবায় পৌঁছে খিদে মেটাবার তাড়া কিন্তু তার আর রইলো না। ডোবার ওপারে একটু উঁচু সরু পথ, খানিকটা গিয়ে গাঁয়ের শেষে এই পথ মিশেছে। গোলাবাড়ি যাবার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড়ো রাস্তার সঙ্গে। বর্ষার ভিজে হাওয়ায় গোলাবাড়ি থেকে পানজর্দার সুবাস কি একেবারেই আসে না? পুবদুয়ারি ঘর তাদের, দাদা বলতো, দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের রাজা, পুবদুয়ারি তাহার প্রজা। যমুনার তীরে তাদের মাদারিপাড়া, দরগাতলার মতো এদিককার সব বাড়িও পুবদুয়ারি। এখানে এসে কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে পুবদুয়ারি ছাপরা ঘর পেয়ে চেরাগ আলি মহা খুশি, দেখ, একইরকম ঠেকিচ্ছে না রে? আবার বিয়ের পর ডোবার এদিকে তমিজের বাপের ঘরে ঢুকলো কুলসুম, এটাও পুবদুয়ারি। একটু বাতাস বইলেই তাদের ঘরে হাওয়া ঢোকে। ডোবার ঘাসপাতাশ্যাওলা, অল্প পানির খলসে পুঁটি কি ডোবার ধার ঘেঁষে কাদার ঘরসংসার-করা শোল বেলের তাজা আঁশটে গন্ধ, মানুষের গুয়ের গন্ধ, গোরুবাছুরের গোবরের গন্ধ-সব মিলেমিশে ঝাঁ ঝাঁ রোদে শুকিয়ে কিংবা বৃষ্টিতে নেতিয়ে পড়ে ঘরে ঢুকে মাচার ওপরটা, মাটির মেঝেটা বা ঘরের ছোটো শূন্যতাটিকে কখনো ভারি করে তোলে, কখনো হালকা করে ফেলে।
এসব গন্ধ কি কুলসুমের আজকের চেনা? তমিজের বাপের সঙ্গে বিয়ের কতো আগে থেকে কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ের ভেতর ছাপরা ঘরে থাকতেই তো তার থাল-বাসন ধোয়াপাকলা, কাপড় কাচা, মুখ ধোয়া, হেগে ছোচা, গোসল করা সবই তো হয়েছে এই ভোবাতেই। কালাম মাঝির বাড়িতে পাতকুয়া কাটার আগে খাবার পানিও নেওয়া হতো এখান থেকেই। তখন এটা অবশ্য পুকুরই ছিলো। বড়ো বানের পলি জমে উত্তর দিকটা ভরে গেলে ওখানে আরো মাটি ভরে মরিচবেগুনের খেত করে কালাম মাঝি জায়গাটা নিজের দখলে নিয়ে আসে। এসব তো কুলসুমের চোখের সামনের ঘটনা। আল্লারে আল্লা, বিয়ের পরও কুলসুমের সেই আগের নিয়মের কোনো বদল হলো না।
ডোবার ধারে বসে চোখ বন্ধ করেও সে ঠাহর করতে পারে ডোবার ওপারে সরু রাস্তায় সাইকেল চেপে চলেছে সাকিদারদের ইস্কুলে-পড়া ছেলে। ধানের ভার নিয়ে মণ্ডলবাড়িতে যাচ্ছে অহিদ পরামাণিক।
খেজুরগাছের পিড়িতে বসে ডোবার পানিতে ঝুঁকে কুলকুচো করছে কুলসুম, তার মুখের ছাইকয়লামাখা পানিতে ডোবার ঘোলা পানির রঙ পাল্টায় না। সেই অপরিবর্তনীয় পানির দিকে তাকিয়ে ডান হাতের তর্জনীর সাদা দাঁতগুলি চকচক শব্দ করে মাজতে মাজতে এবং বারবার কুলকুচো করতে করতে কুলসুম ঠিক বোঝে, দক্ষিণের কলুপাড়ার গফুর কলু গোলাবাড়ি যাচ্ছে দলবল নিয়ে। লোকটা গফুর কলু না। হলে তার কিছুই এসে যায় না, শ্যামলা মুখটা যতোটা পারে ফর্সা করে তুলতে অবিরাম পানির ঝাপটা মারতো। কিন্তু গফুর কলু মানুষটা বেহায়া ধরনের আলাপি মানুষ, আবার তার মুখে কথা শুনতেও কুলসুমের কান দুটো উসখুস করে। তা কথা বেশি বললে কী হয়, গফুর ভাইটা কামের মানুষ। অসুখে পড়ে বাপটা তার তেলের ঘানি ঘোরাতে পারে না, তার একরকম ভিক্ষা করে খওয়ার দশা হয়েছিলো। গফুর কিন্তু তেলের ঘানি টানি বাদ দিয়ে ঘুরতে লাগলো মণ্ডলের ছোটোবেটা কাদেরের পিছে পিছে। বছরখানেক তার লীগের পাট্টির হুজুগে মেতে থাকায় তার মেলা ফায়দা হয়েছে। সে এখন কাজ পেয়েছে কাদেরের তেলের দোকানে। এই এলাকায় শুধু কোরোসিন তেল বেচার দোকান প্রথম করলো শরাফত মণ্ডল, সেই দোকান চালায় কাদের। এক বছরেই দোকানের সাইজ বড়ো করে ফেলেছে, আগে টাউন থেকে সপ্তাহে দুইবার ৬/৭টা করে তেলের টিন আসত টমটমে করে, এখন জোড়া জোড়া গোরুর গাড়ি ভর্তি টিন এনেও আশেপাশের চাহিদা মেটাতে পারে না। এর সব দেখাশোনার ভার গফুরের ওপর। কিন্তু এ নিয়ে গফুরের দেমাক নাই, মাঝিপাড়ার আর আর মানুষের সঙ্গে তমিজের বাপও যে তাকে কলুর বেটা কলুর বেটা বলে হেলা করেছে এসব কথা সে মনেও রাখে না। কুলসুমের সঙ্গে দেখা হলেই সে একটু দাঁড়াবে, গোলাবাড়ি হাটের খবর দেবে, তমিজের বাপের কথা জানতে চাইবে, তমিজ কবে ফিরবে জিগ্যেস করবে এবং কুলসুমের দাদার খোয়বের মানে বলার একটা দুটো নজির দেবে। আজকাল কলুপাড়ার কয়েকটা চ্যাংড়াপ্যাংড়া তার সঙ্গে থাকবেই। লীগের পাট্টির হুজুগ বেশ ভালোই শুরু হয়েছে, হুজুগে সে এদের শরিক করায়, দোকানের কাম কম থাকলে সে নিজেও কাদেরের পিছে পিছে ঘোরে। তা করো, মনিবের মর্জি মতো তোমাকে তো চলতেই হবে। কিন্তু আজ আবার ওই ছিনাল মাগীটাকে নিয়েছো কেন? বুলু মাঝির ভাতারের ভাত-না-খাওয়া বৌ আবিতন এই সাত সকালে কলুর বেটার পাছার সঙ্গে সেঁটে যায় কোথায়? বেশরম বেলহাজ মাগী, দুদিন পর ভাতার তালাক দেবে, আজ তুই রাস্তা দিয়ে হাঁটিস অন্য জায় তর মানুষের বগল ধরে। শরম করে না?
ক্যারে কুলসুম, আত্রে ঘরের দুয়ার দিস নাই? রাত্রে কুলসুমের দরজা খুলে রাখার কারণ জানার আগেই গফুর কলু বলে, কাল তালতলাত হাঁটু পানি জমিছিলো রে, তাই। ঘুরা তোর ঘরের খুলির উপর দিয়া গেনু। তোর দুয়ার দেখি খোলা। ভুলকি দিয়া দেখি তুই নিন্দ পাড়িচ্ছ। তমিজের বাবোক ক্যামা দেখনু না।
বলতে বলতে তার ডান হাতের পুঁটলিটা পাচার হয়ে যায় বা হাতে। বলে, মনে হলো বাঁশের আড়াত গেছে। আড়ার ধার দিয়াই তো হ্যাটা গেনু, দেখনু না তো। একলা একলা তোক ঘরত থুয়া তাই কোটে গেছিলো রে?
তমিজের বাপের অনুপস্থিতিতে গভীর রাত্রে তার ঘরে উঁকি দিয়ে লোকটা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে গেছে—এই খবরে কুলসুমের অস্বস্তি হতে না হতে ভাতারের ভাত-না-খাওয়া আবিতন মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, ঘর দুয়ার খুল্যা নিন্দ পাড়িস কিসক? তোর বাপের বাড়ির কথা ভিন্ন। ওটি আছিলো কী, আর চোরে লিবিই বা কী? এটি না। হলেও বাসনকোসনগুলা তো আছে। মামুর জাল যে কয়খান আছে তাই চুরি হলে তোক বেচলেও দাম উঠবি না, বুঝলু?
আবিতন মাঝিদের মেয়ে। তমিজের বাপ কোনো না কোনোভাবে এর চাচা মামু দাদা খালু নানা ভাই ভাতার লাঙ একটা কিছু হয়ই। সেই সুবাদে কুলসুমের বাপের বাড়ি নিয়ে খোটা মেরে গেলো।-মাঝির ঘরের বেটি, তুই দুই দিন বাদে লিকা বসবু কলুর বেটার সাথে। তমিজের বাপের সাথে তোর আত্মীয়তা কুটুম্বিতা তখন কোটে যায় দেখা যাবি।তা দেখে নেওয়ার কাজটা কুলসুম এখনি করতে পারে। কিন্তু গফুর কলু তাগাদা দেয়, চলো চলো। কাদের ভাই কছে লওটার মদ্যে গোলাবাড়ি পৌঁছা লাগবি। জোড়াগাছত সভা দশটার সময়। গোলাবাড়িত থ্যাকা মেলা করলে এক ঘন্টার কম। লাগবি? চলো বাপু, এ্যানা পাও চালাও।
আরে বাপ! কুলসুম আর কতো দেখবে? মণ্ডলের দোকানে কাম নিয়ে গফুর কলু আজকাল সময় ঠিক করে ঘড়ির সময় দিয়ে। আবার সভা করে বেড়ায়। কলুর বেটা কলু, তার আবার ফুটানি কতো দেখবো? আবিতনের কথার ঝাঁঝে কুলসুমের রাগ হয় গফুর কলুর ওপর। দাদা এই কলুটাকে বেশি খাতির করতে, এক আধ পোয়া সর্ষের তেলের লোভে কী মনোযোগ দিয়েই না তার খোয়াবের বিত্তান্ত শুনতো। সেই কলুর বেটা এখন। ঘোরে মাঝির ঘরের বৌয়ের সাথে। মরার গাঁয়ে এদের গাঁয়ে আঁটার বাড়িও কেউ মারে না।