পূর্ব বাংলার পুনর্জন্ম
পূর্ব বাংলা, যাকে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৪৭ এর আগস্টে শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে। শূন্য হাত কথাটি কথার কথা নয়। ঢাকা হলো পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী। পুরোনো শহর, কিন্তু দুই শতাব্দীর অবহেলায় তা প্রাণহীন। সমস্ত বাংলার সব সম্পদ গিয়ে জমা হতো কলকাতায়। কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে গিয়ে ঢাকাকে করা হয় হতশ্রী। প্রাণ বলতে ঢাকায় ছিল শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সেই নীলক্ষেত রমনা এলাকায়, যা মূল ঢাকা শহর থেকে সামান্য দূরে এবং এক পাশে, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা হতো। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা হতো। বড় বড় পণ্ডিতেরা বাস করতেন নীলক্ষেত ও রমনায়।
ঢাকা আজ পত্রপত্রিকায় সয়লাব। শত শত দৈনিক, সাপ্তাহিক প্রকাশিত হচ্ছে। ষাটের দশক থেকেই পত্রপত্রিকা প্রকাশের প্রবণতা দেখা যায়। ষাটের দশকেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো কয়েকটি উন্নতমানের বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক। দৈনিক পাকিস্তান, পূর্বদেশ প্রভৃতি এবং দ্য পাকিস্তান অবজারভার, মর্নিং নিউজ এর মান কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, দ্য স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকা বা হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এর চেয়ে কম ছিল, তা বলা যাবে না। কিন্তু সেই ঢাকাতে ১৯৪৭ সালে কোনো দৈনিক পত্রিকা ছিল না। একটি বাংলা দৈনিকও ছিল না, একটি ইংরেজি দৈনিকও নয়। ঢাকাবাসীর তথা পূর্ব বাংলার মানুষের পত্রিকা পাঠের শখ মেটাতে হতো কলকাতার কাগজ দিয়ে। অর্থাৎ কলকাতার পত্রিকার বাজার ছিল ঢাকা ও বাংলাদেশ। কলকাতার দৈনিক কাগজ দিনেরটি দিনেই ঢাকায় ও চট্টগ্রামে পৌঁছাত। অবশ্য বিকেল হয়ে যেত। কলকাতা থেকে কাগজ ঢাকায় আসত কিছু বিমানে, বেশির ভাগই আসত ট্রেনে ও স্টিমারে।
সাতচল্লিশের পর পূর্ব বাংলার প্রথম দৈনিক প্রকাশিত হয় ঢাকা নয় চট্টগ্রাম। থেকে। তার নাম দৈনিক পাকিস্তান। স্বত্বাধিকারী ছিলেন কাজী বজলুল হক। সম্পাদক ছিলেন কবি আবদুস সালাম। সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক কাজী আফসারউদ্দীন আহমদ। দৈনিক পাকিস্তান ছিল চার পাতার পত্রিকা, কোনো দিন ছয় পাতা। আমাদের বাড়িতে তার কিছু কপি ছিল। এখনো দু-চার কপি সম্ভবত আছে। এই তো চল্লিশের দশকের পূর্ব বাংলার অবস্থা। যেখানে পত্রপত্রিকাই নেই, সেখানে উন্নত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা কীভাবে হবে?
পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন ঢাকায় মাত্র একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। কাগজটি অনেক পুরোনো। তার নাম দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমস। খুব মানসম্মত সাপ্তাহিক নয়। সামান্যই ছাপা হতো। ঢাকার মানুষও ওটি না পড়ে কলকাতার কাগজই বেশি পড়তেন। ১৯৪৭-এর পরে অনেক শিক্ষিত ও বিত্তবান হিন্দুর মতো দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমসের মালিকও কলকাতা চলে যান। তবে পত্রিকাটি চালু রেখে যান। দায়িত্ব দিয়ে যান তাঁর ছেলে ও ছেলের স্ত্রীকে। ডিক্লারেশন পরিবর্তন করে নতুন সম্পাদক হলেন তাঁর পুত্রবধূ কল্যাণী গুহ।
আমার আব্বার কাছে শুনেছি, নতুন স্বাধীন দেশ পাকিস্তানের মন্ত্রী ও আমলাদের দুর্নীতির কথা অল্প পরিমাণে দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমসে প্রকাশিত হতো। মুসলিম লীগ সরকার তাতে পত্রিকাটির ওপর ক্ষিপ্ত হয়। আরও ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ তার মালিক ও সম্পাদক হিন্দু। নানাভাবে পত্রিকার সম্পাদিকা কল্যাণী গুহকে হয়রানি করতে থাকে সরকারি লোকজন। একপর্যায়ে মালিক পত্রিকা বন্ধ করতে বাধ্য হন। ঢাকায় কোনো পত্রিকার ওপর সেটাই প্রথম আঘাত। ইস্ট বেঙ্গল টাইমস কোনো লাভজনক কাগজ ছিল না। আট পৃষ্ঠার কাগজে কোনো দিন ১২ পৃষ্ঠার কাগজটির দু-একটি সংখ্যা আমি কাজী আনওয়ার-উল হকের বাড়িতে দেখেছি আশির দশকে।
স্বাধীন বাংলাদেশে আজ আমরা সুখী ও সমৃদ্ধ। সমস্ত আধুনিক উপকরণ আমাদের করায়ত্ত। মোটরগাড়ি আজ ঘরে ঘরে। কোনো পরিবারে একাধিক গাড়ি। উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীর পর্যন্ত দামি গাড়ি। চল্লিশের শেষ ও পঞ্চাশের শুরুতে ঢাকা ছিল নিষ্প্রাণ নগরী। কয়েক মিনিট পর ঢাকার রাস্তায় দেখা যেত একটি মোটরগাড়ি। উঁচুপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা চড়তেন ‘উইলি’ নামক জিপে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই শক্ত জিপ সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধের পরে বিভিন্ন দেশে বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে প্রথম যেদিন আমি কোনো অফিসারের জিপে চড়ি, সে কি আনন্দ! আর ঢাকার রাস্তায় চলতে দেখেছি বেডফোর্ড কোম্পানির পিকআপ। তা-ও ব্যবহৃত হতো সরকারি কাজে। এখন বিভিন্ন প্রজেক্টের দামি গাড়িগুলো যেমন যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়, সেকালে তা সম্ভব ছিল না। যুগ্ম-সচিবের নিচে কারও গাড়ি ব্যবহারের সৌভাগ্য হতো না। তবে জেলা ও মহকুমা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার গাড়ি পেতেন।
পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় কোনো কোনো ভাগ্যবানের ছিল ব্যক্তিগত অস্টিন মিনি কার। ছোট্ট গাড়ি ইঁদুরের মতো ছুটত। অধিকাংশই কালো রঙের ছিল মরিচ মাইনর মোটরগাড়ি। অস্টিনের চেয়ে মরিচ সামান্য বড়। আর ছিল জার্মান কোম্পানির ফোক্সওয়াগান। ফোক্সওয়াগান দেখতে কাছিমের মতো। আদমজী বাওয়ানীদের দু-চারটি ছিল মস্ত বড় দামি গাড়ি। মার্সিডিজ বেঞ্জ বা ক্যাডিলাক। রাস্তায় তা দেখলে মানুষ দাঁড়িয়ে যেত। ঢাকায় সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য ছিল ছোট ‘টাউন সার্ভিস বাস।
শূন্যতা থেকে শুরুর কথা বলেছি। সত্যি আমাদের ছিল না কিছুই। ১৯৫৪ তে আমার আব্বার সঙ্গে আমি প্রথম ইডেন বিল্ডিংয়ে বা প্রাদেশিক সচিবালয়ে ঢুকি। আমাদের এক আত্মীয় নিচের পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর অফিস দেখতে যাব, খুবই উদ্দীপনা। নিশ্চয়ই সুন্দর সুসজ্জিত কিছু হবে, যা আমাদের থানার বড় দারোগার অফিসঘরের চেয়ে অনেক উন্নত। গিয়ে দেখি চার-পায়া এক বড় টেবিল। তার ওপর ফাইলপত্র এপাশে ওপাশে সাজানো। কিছু ফাইলপত্র মাটিতে হোগলাপাতার চাটাইয়ের ওপর রাখা। আলমারি ও র্যাকের অভাব। আমার আত্মীয়ের মাথার ওপর কোনো ফ্যান ছিল না। তালপাতার হাতপাখা তাঁর সম্বল। এক হাতে হাতপাখায় নিজেকে বাতাস করেন, আরেক হাতে ফাইলে নোট লেখেন। পাকিস্তানের প্রথম বছর দশেক অবস্থা ছিল এ রকম।
মনে আছে, ১৯৫৫-র বর্ষাকালে আব্বার সঙ্গে গিয়েছিলাম খাদ্যমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের অফিসে। মন্ত্রীর অফিস না জানি সে কি! বন্যা হচ্ছিল আমাদের এলাকায়। কিছু রিলিফ সামগ্রীর জন্য তদবির করতে আমার বাবা ও আরও দু-একজন মন্ত্রীর দপ্তরে যান। খুবই সাধারণ অফিসকক্ষ। এসি নেই। ফ্যান ঘুরছে মন্ত্রীর মাথার ওপর। এক সেট সোফা আর কয়েকটি কাঠের চেয়ার। খুব কালো। রঙের এক সেট ফোন মন্ত্রীর টেবিলে। আমি জড়সড় হয়ে একটি সোফার কোনায় বসি। নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হয়। মন্ত্রীর অফিস, যেমন তেমন ব্যাপার নয়! সেকালে কলিংবেল ছিল ঘণ্টির মতো।
মধ্য-পঞ্চাশের তত দিনে অবশ্য ঢাকায় একাধিক বাংলা-ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের বাড়িতে ইত্তেফাঁকও থাকে, মর্নিং নিউজ থাকে। আমাদের পরিবারের একজন মর্নিং নিউজে কাজ করতেন বলে সেটি বিনা পয়সায় পাওয়া যেত। সকালবেলা খবরের কাগজ পড়ার জন্য অনেকেই ব্যাকুল হয়ে থাকত। সেকালে এক খবরের কাগজ একজন পড়ে অন্যকে তার বিষয়বস্তু বলতেন। সাধারণ। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা। আন্তর্জাতিক খবরেও মানুষের কম উৎসাহ নয়। কোথায় কোরিয়ায় যুদ্ধ হচ্ছে বা অন্য কিছু হচ্ছে, মানুষ তা জানার জন্য সংবাদপত্রে চোখ রাখছে। বড় সুপারমার্কেট ছিল না। মুদি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বা চা-দোকানে বসে মানুষ পাকিস্তানের অবস্থা ও পৃথিবীর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। সাধারণ মানুষ আলোচনা করে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে যা প্রাপ্য তা দিচ্ছে না। তাতে মন খারাপ করে, তা চেহারা দেখে বোঝা যায়।
তবে বাংলাবাজার বইপাড়াটি বহু পুরোনো। শত বছরের পুরোনো। বাংলাবাজার প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি ও প্রেসিডেন্সি প্রিন্টিং ওয়ার্কসের মালিক অনিলচন্দ্র ঘোষ ছিলেন আমার আব্বার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী। বাড়ি মানিকগঞ্জে। তিনি ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতাসংগ্রামী। বাংলাবাজার প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি ও কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীনের আল হামরা লাইব্রেরিতে মাঝে মাঝে যেতাম। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগত। বাংলাবাজার বইপাড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা যেতেন। তাদের কথাবার্তা শুনতাম। অনেক পরে বুঝতে পারি, পূর্ব বাংলার মানুষের পুনর্জন্ম হয়েছিল পঞ্চাশের শুরুতে।
পঞ্চাশের দশক ছিল বাঙালি মুসলমানের নতুন গন্তব্যে যাত্রার লক্ষ্যে প্রস্তুতির সময়। তবে সেই প্রস্তুতির সময়টির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারেননি শিক্ষিত মুসলমান। তাঁদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল আর ছিল না উপযুক্ত নেতৃত্ব। নেতৃত্বহীন জাতি বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খায়। বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম আরও মারাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক সততা আরও বেশি প্রয়োজন।