পায়ের কাছে প্রকাণ্ড জানালা।
শহরের গ্রীলদেয়া জানালা না, খোলামেলা জানালা। এত প্রকাণ্ড জানালা যে মনে হয় আকাশটা জানালা গলে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। ঘন নীল আকাশ, যেন কিছুক্ষণ আগে গাদাখানিক নীল রঙ আকাশে লাগানো হয়েছে। রঙ এখনও শুকায়নি। টাটকা রঙের গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে।
নীতুর ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ হল। সে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। নৌকায় ঘুমিয়ে পড়ার পর থেকে তার আর কিছু মনে নেই। কখন সে পৌঁছল, কে তাকে এনে বিশাল এই বিছানায় শুইয়ে দিল কিচ্ছু মনে আসছে না। এই তার সমস্যা–একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর ঘুম ভাঙতে চায় না। এখন ঘুম ভেঙেছে কিন্তু বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছে না। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখছে।
বিছানায় পাশাপাশি দুটা বালিশ। আপা আজ রাতে তার সঙ্গে ঘুমিয়েছে–এটা জেনে ভাল লাগছে। রাতে ঘুম ভেঙে সে যদি দেখত এতবড় বিছানায় একা শুয়ে। আছে–অপরিচিত ঘর, চারদিকে সব অপরিচিত আসবাবপত্র, তাহলে ভয়েই মরে যেত।
পুরানো দিনের আসবাবপত্র সব এমন গাবদা ধরনের হয় কেন? খাট এত উঁচু যে গড়িয়ে পড়লে মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে যাবে। নীতুর আবার খাট থেকে গড়িয়ে পড়ার অভ্যাস আছে। ভাগ্যিস সে দেয়ালের দিকে শুয়েছিল। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধে গা কেমন কেমন করছে। পুরানো দিনের মানুষরা এত ন্যাপথলিন পছন্দ করে কেন? ওদের গা থেকেও ন্যাপথলিনের গন্ধ বের হয়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে নীতু আঁচ করতে চেষ্টা করল কটা বাজে। সূর্য দেখা যাচ্ছে না–নীল আকাশ আর নীল আকাশে ধবধবে শাদা মেঘ। এমন শাদা মেঘ শুধু শরৎকালেই দেখা যায়। শ্রাবণ মাসের মেঘে কালো রঙ মাখানো থাকে। আল্লাহর স্টকে বোধহয় কালো রঙ শেষ হয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কটা বাজছে নীতু বুঝতে পারছে না। বারান্দায় থপ থপ শব্দ হচ্ছে–মনে হয় চারপায়ে একটা প্রকাণ্ড ভালুক যেন হাঁটছে। ঘরে এসে যে দাঁড়াল সে ভালুকের মতই। এ বাড়ির প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড আসবাবের মতই প্রকাণ্ড একটা মানুষ–যার মাথার চুল শাদা। মনে হচ্ছে শাদা রঙের সঙ্গে ম্যাচ করে তিনি শাদা একটা লুঙ্গি পরেছেন। খালি গা—গা ভর্তি ভালুকের পশমের মত শাদা লোম।
ভালুকটা মেঘের মত গর্জনে বলল, কি রে, এখনও ঘুমুচ্ছিস?
নীতু কিছু বলল না, চোখ পিট পিট করতে লাগল। ভালুকটা বলল, আরো ঘুমুবি? নাকি নাশতা-পানি করবি? তোর জন্যে আমিও না খেয়ে আছি। আমাকে চিনতে পারছিস? চেনার কথা না–একবারই শুধু দেখেছিস তোর যখন তিন বছর বয়স। এখন বয়স কত?
বার।
হুঁ, ন বছর আগের ঘটনা। মনে থাকার কথা না। তুই এত রোগা কেন? নিজে নিজে খাট থেকে নামতে পারবি না-কি কোলে করে নামিয়ে দেব?
নীতু চট করে নেমে পড়ল। ভালুক টাইপ মানুষ হয়ত সত্যি সত্যি কোলে করে নামাতে আসবে।
কোন ক্লাসে পড়িস?
ক্লাস সেভেন।
রোল নাম্বার কত?
পঁচিশ।
রোল পঁচিশ! তুই তো দেখি গাধা টাইপ মেয়ে। পড়াশোনা করিস না?
করি।
পড়াশোনা করলে রোল পঁচিশ কি করে হয়? বল দেখি তিন উনিশে কত?
ফিফটি সেভেন।
হয়েছে। এখন হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়–সব গরম আছে… চালের আটার রুটি আর ঝাল ঝাল ভুনা মুরগি। দুপুরে খাবি পাংগাস মাছ। খাস তো? শহরের মানুষ মাছ খাওয়া ভুলে গেছে…
নীতু বলল, বাথরুম কোন দিকে?
দূর আছে। শোবার ঘরের ভেতরে টাট্টিখানা এইসব নোংরামি শহরে চলে, এখানে চলে না–আয় আমার সঙ্গে–কই, কদমবুসি করেই রওনা হয়ে গেলি–মুরুব্বীদের সালামের ট্রেনিং বাবা-মা দেন না?
নীতু লজ্জিত ভঙ্গিতে নিচু হল। কদমবুসির নিয়ম-কানুন সে ঠিক জানে না। দুহাত দিয়ে দুপা ছুঁতে হয় না-কি এক হাত দিয়ে? পা ছোঁয়ার পর হাতের আঙুলে চুমু খেতে হয়, না হাতের আঙুল মাথায় ছোঁয়াতে হয়? পা কবার ছুঁতে হয়–একবার না দুবার? নীতুর মনে হচ্ছে–ছোটখাট কোন ভুল করলেই এই মানুষটা ধমক দেবেন। ধমক দেয়াই হয়ত তার স্বভাব।
নীতু পুরোপুরি নিচু হবার আগেই ইরতাজুদ্দিন দুহাতে তাকে ঝাপ্টে ধরে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে ফেলার ভঙ্গি করে আবার ধরে ফেলে বললেন–তোরা এসেছিস, আমি এত খুশি হয়েছি। রাতে তোরা ঘুমুচ্ছিলি, আমি তোদের খাটের মাথায় বসে বসে কেঁদেছি। জ্ঞানবুদ্ধি হবার পর আমি মোট কবার কেঁদেছি জানিস?–চারবার। প্রথম তিনবার দুঃখে কাদলাম–শেষবার আনন্দে।
নীতু অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে–মানুষটা তাকে কোলে করে আছেন। মনে হচ্ছে। কোলে করেই বাথরুমে নিয়ে যাবেন। কি লজ্জা! আবার তার ভালও লাগছে। বড় হবার পর এত আদর করে কেউ কি তাকে কোলে নিয়েছে? না, কেউ কোলে নেয়নি। এই বুড়ো মানুষের গায়ে শক্তি তো অনেক। কি ভাবে তাকে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলে আবার। লুফে নিল…।
নীতু তোর নাম?
হুঁ।
তুই দেখতে যেমন সুন্দর তোর নাম তত সুন্দর না। আমি তোর সুন্দর নাম দিয়ে। দেব। এত আনন্দ হয়েছে তোদের দেখে–কেঁদে ফেলেছিলাম–এই জীবনে। চারবার কাঁদলাম।
চারবার না–পঁচবার। এখনও তো কাঁদছেন।
আরে তাই তো, এখনও তো চোখে পানি এসে গেছে। লক্ষ্য করিনি। নীতু, তোর। তো অনেক বুদ্ধি। তোর বাবা ছিল অকাট গাধা–তার মেয়েগুলি এত বুদ্ধিমতী হবে ভাবাই যায় না।
বাবা মোটেই গাধা না।
বাবার সাফাই গাইতে হবে না। তোর বাবার বুদ্ধি কেমন তা তোরা আমার চেয়ে বেশি জানবি না।
ইরতাজুদ্দিন সাহেব সত্যি সত্যি নীতুকে কোলে করে একেবারে বাথরুমের দরজায় নামিয়ে দিলেন। শুধু শুধু বাথরুমে গিয়ে নীতু করবে কি? তার টুথপেস্ট লাগবে, ব্রাস লাগবে… এই কথা মানুষটাকে বলতেও ইচ্ছা করছে না–বললে তিনি হয়ত আবার কোলে করে ঘরে নিয়ে যাবেন। এ তো দারুণ সমস্যায় পড়া গেল।
শাহানার সঙ্গে ইরতাজুদ্দিন সাহেবের এখনও কথা হয়নি। শাহানার ধারণা, দাদাজান সব কথা জমা করে রেখেছেন–নাশতার টেবিলে কথা হবে। তিনি নিশ্চয়। জানতে চাইবেন–কেন তারা খোঁজখবর না দিয়ে হুট করে চলে এল। কেন কাউকে সঙ্গে আনল না। অথচ তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করছেন না। সকালে দেখা হলে জিজ্ঞেস। করেছেন, ঘুম ভাল হয়েছে? তার সঙ্গে এই পর্যন্তই কথা। তার পর পরই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নাশতার আয়োজনে। শাহানা রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখে–বড় কড়াইয়ে কি যেন জ্বল হচ্ছে। তিনি খুন্তি হাতে কড়াইয়ের পাশে। বৃদ্ধা একজন মহিলা লম্বা ঘোমটা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে–সে মনে হয় রাধুনী।
শাহানা বলল, দাদাজান, আপনি রান্না করছেন না-কি?
ইরতাজুদ্দিন হাসিমুখে বললেন–হুঁ। তোরা কি ঝাল বেশি খাস না কম খাস?
মোটামুটি খাই।
মুরগির ঝোল ঝাল না হলে মজা নেই। ও রমিজের মা, দেখ, এই হচ্ছে আমার নাতনী। তুখোড় ছাত্রী, ডাক্তার। অসুখ-বিসুখ থাকলে চিকিৎসা করে নিও। এমবিবিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। এখন আমেরিকায় জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে পিএইচ. ডি. করতে যাচ্ছে। কি রে শাহানা, ঠিক বলছি না?
ঠিকই বলেছেন–এত কিছু জানেন কি ভাবে?
আমি সবই জানি। তোরাই আমার ব্যাপারে কিছু জানিস না। আমাকে সাপে কেটেছিল, তোরা জানিস?
না তো। বলেন কি?
দুর্বল ধরনের সাপ। বিষদাঁত ফুটিয়েও বিষ ঢালতে পারেনি, তার আগেই পা দিয়ে কচলে ভর্তা বানিয়ে ফেলেছি।
কি সর্বনাশ!
সাপের জন্যে সর্বনাশ, আমার জন্যে না। আমি তো ভালই আছি। রান্নাঘরের ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি কর, খিদেটা জমুক। চালের আটার রুটি খাস তো?
খাই। পরোটা খেতে চাইলে পরোটা করে দেবে। খাবি পরোটা?।
চালের আটার রুটিই ভাল।
রাঁধতে জানিস?
না
রমিজের মা ট্রেনিং দিয়ে দিবে। তিন দিনে পাকা রাঁধুনি হবি। ডাক্তার মেয়েদেরও তো বেঁধে খেতে হবে।
ধোয়ায় শাহানার কষ্ট হচ্ছিল। সে বারান্দায় চলে এল। বিশাল টানা বারান্দার পুরোটা কাঠের। ধুলো-ময়লা নেই–পরিষ্কার ঝকঝক করছে। কে পরিষ্কার করে এত বড় বাড়ি? রমিজের মা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজের লোক এখনো শাহানার চোখে পড়েনি। তবে আছে নিশ্চয়ই–এত বড় বাড়িতে দুজন মানুষ বাস করে—এটা হতেই পারে না।
শাহানা বাড়ির চারদিক কৌতূহলী হয়ে দেখছে। জায়গাটা অদ্ভুতভাবে অন্যরকম। চারদিকে জেলখানার পাচিলের মত পঁচিল। শ্যাওলা পড়ে ঘন সবুজ হয়ে আছে। পুরো বাড়িটা যেন সবুজ দেয়ালে ঘেরা। বাড়ির পেছনটায় গাছ-গাছালিতে জঙ্গল হয়ে আছে। আম এবং কাঠাল এই দুই ধরনের গাছ ছাড়া শাহানা আর কোন গাছ চিনতে পারছে না। একটা বোধহয় তেতুল গাছ–চিড়ল চিড়ল পাতা। তেতুল। ছাড়া অন্য কোন গাছের পাতা কি এমন চিড়ল চিড়ল হয়? শাহানা জানে না। নিজের দেশের গাছপালা সে নিজে চিনে না–কি লজ্জার কথা! শাহানা ঠিক করে ফেলল, এই গ্রামের সব কটা গাছের নাম সে এবার জেনে যাবে। শুধু যে জানবে তাই না, খাতায় নোট করবে। গাছের বর্ণনা লেখা থাকবে, মোটামুটি ধরনের একটা ছবি আঁকবে এবং গাছের একটা করে পাতা স্কচ টেপ দিয়ে সঁটা থাকবে। গাছগুলি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। বাগানে নামাটা ঠিক হবে কি না শাহানা বুঝতে পারছে না। হাঁটু সমান উঁচু ঘাস। ঘাস না থাকলে বাগানটা বেড়ানোর জন্যে সুন্দর হত। কাঠাল গাছের নিচু ডাল থেকে বড় একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিলে সুন্দর হবে। ভরদুপুরে দোলনায় দোল খেতে খেতে বই পড়ার আনন্দই অন্য রকম।
নাশতার টেবিলেও ইরতাজুদ্দিন সাহেব কিছু বললেন না। শাহানা বলল, দাদাজান, আপনি কি আমাদের দুজনকে আসতে দেখে অবাক হননি?
না।
না কেন?
তোরা যে আসবি সেটা জানতাম।
কি ভাবে জানতেন?
স্বপ্নে দেখেছি।
নীতু বিস্মিত হয়ে বলল–স্বপ্ন দেখেছেন?
হুঁ। সোমবার শেষরাতে স্বপ্ন দেখলাম। তোরা দুইজন হাতে দুটা ভারী স্যুটকেস নিয়ে আসছি। আমাকে জিজ্ঞেস করছিস–ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বাড়িটা কোথায়?–আমরা তাঁর নাতনী। আমি স্বপ্নের ভেতরই ভাবছি। আমার নাতনী তো তিনজন। আরেকজন এল না কেন? স্বপ্ন ভাঙতেই শুনি আজান হচ্ছে… তখনই বুঝেছি, তোরা আসছিস। লোকজন এনে ঘর-টর পরিষ্কার করালাম।
শাহানা বলল, সত্যি বলছেন দাদাজান।
হুঁ। তোদের সায়েন্স এসব স্বপ্ন স্বীকার করে না–তাই না?
স্বীকার-অস্বীকারের কিছু না। আপনার মনের মধ্যে ছিল যেন আমরা আসি। এই জন্যেই স্বপ্ন দেখেছেন। মনের ইচ্ছাগুলি স্বপ্নে চলে আসে। আপনি নিশ্চয়ই মাঝে মধ্যে স্বপ্ন দেখেন–দাদীজান এসেছেন। দেখেন না?
দেখি।
দাদীজান কিন্তু আসেন না। মৃত মানুষ আসতে পারে না।
তোর বুদ্ধিও তো ভাল হয়েছে। বাবার মত গাধা হয়ে জন্মাসনি।
কথায় কথায় বাবাকে গাধা বলবেন না দাদাজান, আমার ভাল লাগে না।
যে গাধা তাকে গাধা বলায় দোষ হয় না।
দোষ হয়ত হয় না তবে গাধার মেয়েদের জন্যে মনোকষ্টের কারণ হয়। বিশেষ করে তারা যখন তাদের বাবাকে বুদ্ধিমান হিসেবে জানে।
তোরা তোর বাবাকে বুদ্ধিমান হিসেবে জানিস?
হুঁ।
কেন?
শাহানা জবাব দেবার আগে নীতু বলল–আমরা বাবাকে খুব কাছ থেকে দেখছি বলেই জানি। আমার কাছে বরং আপনাকে একটু বোকা বোকা লাগছে।
ইরতাজুদ্দিন নীতুর দিকে তাকালেন। তার চোখে হাসি ঝলমল করতে লাগল। তবে মুখ গম্ভীর। নীতু বলল, আশা করি আপনি আমার কথায় রাগ করেননি।
কি জন্যে আমাকে বোকা মনে হচ্ছে সেটা বল, তাহলে রাগ করব না।
আমাদের সামনে একটু পর পর বাবাকে গাধা বলছেন এই জন্যেই আপনাকে বোকা মনে হচ্ছে। কোন বুদ্ধিমান মানুষ এটা করবে না।
ইরতাজুদ্দিন শব্দ করে হাসতে শুরু করলেন। হাসি বাড়তেই থাকল। নীতুর মনে হল, হাসির শব্দে ঘর-বাড়ি কাঁপতে শুরু করেছে। একটা মানুষ এতক্ষণ হাসতে ধরে পারে! নীতু বিস্মিত হয়ে তার বোনের দিকে তাকাচ্ছে…
ঘাট থেকে ধরাধরি করে একটা পাংগাস মাছ আনা হচ্ছে। মাছের দিকে তাকিয়ে নীতু হকচকিয়ে গেল। এতবড় মাছ। জীবন্ত। ছটফট করছে। ইরতাজুদ্দিন হাসি থামিয়ে বললেন–মাছটা লম্বা করে ধর। নীতু, যা মাছের পাশে গিয়ে দাঁড়া। দেখি, কে লম্বা, তুই না মাছটা।
মাছের সঙ্গে নিজেকে মাপতে ইচ্ছা করছে না দাদাজান।
দাঁড়াতে বললাম। দাঁড়া। আমি বোকা মানুষ, ফট করে রেগে যাব।
নীতু মাছের পাশে দাঁড়াল। দেখা গেল মাছটা তারচে সামান্য বড়। ইরতাজুদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন–এই মাছ খেয়ে আরাম পাবি। খাওয়ার শেষে দেখবি হাতে চর্বি জমে গেছে। সাবান দিয়ে চবি ধুতে হবে।
নীতু বলল–ভাবতেই আমার ঘেন্না লাগছে।
ঘেন্না-টেন্না ভুলে যা। আমার রাজত্বে এসেছিস, আমার হুকুমমত চলতে হবে। আজ পাংগাস মাছ। কাল খাবি চিতল। হাওরের চিতল–এর স্বাদই অন্য। তোদের শহরের বরফ দেয়া এক মাসের বাসি চিতল না।
শাহানা বলল, আমরা কিন্তু আগামীকাল চলে যাব। বাবাকে তাই বলে এসেছি। আমেরিকায় যাবার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করার শখ ছিল, তাই এসেছি।
তোরা কবে যাবি বা যাবি না সেটা আমি ঠিক করব। সব মিলিয়ে তোরা এখানে থাকবি দশদিন। এই দশদিন যেন আনন্দে থাকতে পারিস সেই ব্যবস্থা আমি করব।
সেটা তো দাদাজান সম্ভব না।
সবই সম্ভব। আমার রাজত্বে সম্ভব।
নীতু বলল, বাবা ভয়ংকর চিন্তা করবে।
চিন্তা করবে না, তাকে খবর পাঠিয়েছি।
নীতু অসহায়ের মত তার আপার দিকে তাকাল।
ইরতাজুদ্দিন কঠিন গলায় বললেন–এই ভাবে তাকালে হবে না। তোর ভুল করে আমার এলাকায় চলে এসেছিস। আমার এলাকা আমার হুকুমে চলে।
শাহানা বলল, আমরা তাহলে বন্দি!
হ্যাঁ বন্দি। আগামী দশদিন আমার রাজত্বে যেখানে ইচ্ছা যেতে পারবি–রাজত্বের বাইরে পা ফেলতে পারবি না।
আপনার রাজত্ব কতদূর পর্যন্ত?
আপাতত, সুখানপুকুর, নিন্দালিশ আর মধ্যনগর এই তিন গ্রাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা এককালে এই তিন গ্রামের জমিদার ছিল।
নীতু বলল, তিন গ্রামের মানুষদের অত্যাচার করে মেরেছে, তাই না?
হ্যাঁ অত্যাচার করেছে। ভয়ংকর অত্যাচার করেছে। জমিদারর কখনো প্রজাদের কোলে বসিয়ে আদর করে না। তাদের খাজনা আদায় করতে হয়। ডাণ্ডা বেড়ি ছাড়া খাজনা আদায় হয় না।
নীতু ভীত মুখে বলল, এখন যদি গ্রামের মানুষ আমাদের উপর সেই অত্যাচারের শোধ নেয় তখন কি হবে! ধরুন আমি একা একা বেড়াতে বের হয়েছি–ওরা ধরে আমাকে শক্ত মার লাগাল—তখন? ইরতাজুদ্দিন তার বিখ্যাত হাসি আবার হাসতে শুরু করলেন–ঘর-বাড়ি কাঁপতে লাগল।
দ্রুতগামী একটা গাড়িকে হঠাৎ ব্রেক কষে থামার মত তিনি হঠাৎ হাসি থামিয়ে ফেলে শাহানাকে বললেন–শাহানা, তুই আয় তো আমার সঙ্গে। তোকে একটা গোপন কথা জিজ্ঞেস করি।..
শাহানা উঠে গেল। ইরতাজুদ্দিন তাকে বারান্দার এক কোণায় নিয়ে গেলেন।
গলা নিচু করে বললেন–তোর কি কোন পছন্দের ছেলে আছে?
শাহানা বিস্মিত হয়ে বলল, পছন্দের ছেলে মানে!
পছন্দের ছেলে মানে–এমন কেউ যাকে খুব পছন্দ? যাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করিস, কফি হাউসে কফি খাস…
না আমার এমন কেউ নেই।
যদি থাকে তাকেও আসতে বলে চিঠি লিখে দে–আমি তোক দিয়ে পাঠিয়ে দেব। ও এলে তোদের ভাল লাগবে। সঙ্গে নিয়ে ঘুরবি–দূর থেকে দেখে আমার ভাল লাগবে।
দাদাজান, আমার এমন কেউ নেই।
মহসীন নামের একটা ছেলের কথা তো জানতাম। ওকে কি এখন আর ভাল লাগে না?
শাহানা বিস্মিত এবং কিছুটা হতভম্ব হয়ে বলল–দাদাজান, আপনি স্পাই লাগিয়ে রেখেছেন না-কি?
ইরতাজুদ্দিন হাসিমুখে বললেন–খবর দেবার লোক লাগিয়ে রেখেছি–করব কি–তোরা খবর দিবি না। গত সাত বছরে তোর বাবা কোন চিঠি লিখেনি।
আপনিও লিখেননি।
সে না লিখলে আমি কেন লিখব? আমার কিসের দায় পড়েছে? আমি কি তার খাই না তার পরি? যাই হোক, খবর পাঠাবি মহসীনকে?
না।
ও এলে তুই আনন্দে কাটাচ্ছিস দেখে আমার ভাল লাগত। নয়ত মুখ গোমড়া করে থাকবি…।
মুখ গোমড়া করে থাকব না দাদাজান, যদি সত্যি দশ দিন থাকতে হয়–আমি থাকব। আনন্দেই থাকব।
ঐ ছেলের সঙ্গে এখনও ভাব আছে?
অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করুন তো।
ইরতাজুদ্দিন সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি তাঁর নাতনীর গালে লালচে আভা দেখতে চাচ্ছেন। আজকালকার মেয়ে লজ্জায় লাল হওয়া ভুলে গেছে। হয়ত এই মেয়েও ভুলে গেছে।
কি ব্যাপার দাদাজান, আপনি এভাকে তাকিয়ে আছেন কেন?
ইরতাজুদ্দিনের মুখে হাসি দেখা গেল। না, তাঁর নাতনী লজ্জায় পুরোপুরি লাল হওয়া ভুলে যায়নি। এই তো চোখে-মুখে রক্ত এসে গেছে। মাথা নিচু করে ফেলেছে। তিনি ঠিক করে ফেললেন–চিঠি দিয়ে লোক পাঠিয়ে দেবেন। ছেলে চলে আসুক। এই বাড়িতেই বিয়ের উৎসব করা যেতে পারে। এ পরিবারের শেষ বিয়ে এখানেই হোক। তার মৃত্যুর পর কে কোথায় যাবে বা যাবে না তাতে কিছু আসে যায় না।
শাহানা!
জ্বি।
তোদের শোবার ঘরের টেবিলে চিঠি লেখার কাগজ-খাম সবই আছে। তোর চিঠি লেখার ইচ্ছা হলে লিখে ফেল–আমি লোক মারফত পাঠাব।
দাদাজান, আপনি অসহ্য একটা মানুষ। নীতু ঠিকই বলেছে–আপনি আসলেই খানিকটা বোকা।
শাহানা রাগ করে চলে যাচ্ছে। ইরতাজুদ্দিন মনে মনে হাসছেন। তিনি তার দুই নাতনীকে নিয়ে সোমবার ভোররাতে যে স্বপ্ন দেখেছেন সেই স্বপ্নের শেষ অংশটি তাদের বলেননি। স্বপ্নের শেষ অংশে পরিষ্কার দেখলেন–শাহানার বিয়ে হচ্ছে এই বাড়িতে। বিয়ে উপলক্ষে তিন গ্রামের সবাইকে তিনি দাওয়াত করেছেন। বিয়ের খাওয়া হচ্ছে তিনদিন তিনরাত ধরে…।
দীর্ঘ দিন তার এই প্রকাণ্ড বাড়ি খালি পড়ে আছে। নীরব নিস্তব্ধ পাষাণপুরী। ভূতের বাড়িতে এরচে বেশি শব্দ হয়। কত রাতে ঘুম ভেঙে ইরতাজুদ্দিন শুনেছেন–বাড়ি কাঁদছে। জনমানবহীন বাড়ি মানুষের সঙ্গের জন্যে কাঁদে। অল্পবয়েসী কচি মেয়েদের গলায় বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে।
আগামী দশদিন এই বাড়ি কাঁদবে না। বাড়ি জেগে ওঠবে। এরচে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। ইরতাজুদ্দিন ডাকলেন, নীতু, নীতু।
নীতু সামনে এসে দাঁড়াল।
এক কাজ কর, বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দৌড়ে যা।
কেন?
শব্দ হোক।
শব্দ হোক মানে কি?
কাঠের উপর দিয়ে হেঁটে যাবি, ধুপধাপ শব্দ হবে।
তাতে কি হবে?
বাড়ি ঘুমিয়ে ছিল তো–বাড়ি জাগবে।
নীতু হতভম্ব গলায় বলল, বাড়ি কি কোন জন্তু দাদাজান যে সে জাগবে, ঘুমিয়ে পড়বে?
বাড়ি জন্তু না হলেও বাড়ির প্রাণ আছে। যা, কথা বাড়াবি না, দৌড়ে এ-মাথা ও মাথা কর।
নীতু চোখ সরু করে তার দাদাজানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না।