পথ আর পথ। শুধুই পথ অতিক্রমণ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর পথ অতিক্রম করেও তার যাত্রা শেষ হলো না।
পথের আকর্ষণ অবশ্য বাল্যকাল থেকেই। ক্ষেত্রকরের পুত্র সে, কিন্তু কুলবৃত্তিতে তার মতি ছিলো না। গোচারণে গেলে কোনো না কোনো অঘটন ঘটাতোই সে। হয় তার গাভীটি প্রতিবেশীর ক্ষেত্র নষ্ট করেছে, নয় তার একটি গোবৎসকে সন্ধ্যাকালে পাওয়া যাচ্ছে না। পিতা হেমন্তদাস লাঠৌষধি কম প্রয়োগ করেননি–কিন্তু কাজ হয়নি তাতে। দেওয়া হলো তাকে হল চালনার কাজ, দেখা গেলো, দ্বিপ্রহর না হতেই বলীর্বদ দুটির পশ্চাৎপদগুলি রক্তাক্ত। লাঙলে তার মুষ্টি কখনই দৃঢ় হয় না। অমন কৰ্ষণকারীকে সহ্য করবে কোন গৃহস্থ? হোক না সে নিজ পুত্র!
দেখা যেতো সংসারে তার মন নেই। যখনই তার সন্ধান হতো, দেখা যেতো নদীতীরে ভাসমান নৌকাগুলির নিকটে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নৌযানের মানুষগুলির মুখে সে দূর দূর দেশের নাম শুনতো–বারাণসী, প্রয়াগ, কামরূপ, সোমদ্বীপ, বিক্রমপুর আর এইসব নাম তার কিশোর মনের কল্পনায় নানান চিত্র মুদ্রিত করে দিতো।
বণিক নতুন হলেই হলো, সে তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাবেই। বলতো, মহাশয় কি দূর দেশ থেকে আসছেন? রাজধানীতে গিয়েছিলেন কি? আপনার নৌযানে কি প্রকার পণ্য? এ স্থানে কতদিন অবস্থান করবেন? এই প্রকার সব উপর্যুপরি প্রশ্ন। কোনো বণিক বিরক্ত হতো। বলতো, কেন হে, এতো প্রশ্ন কেন তোমার? তুমি কি ভগিনী দান করবে? কোনো আসবমত্ত বনিক অশ্লীল ইঙ্গিত করতো। বলতো, বৎস, তোমার বোধ হয় পিতা নেই, তাই পিতার সন্ধান করতে এসেছো–যাও, তোমার মাতাকে আসতে বলো–তিনিই উত্তমরূপে আমার পরিচয়টি জেনে যাবেন।
কিন্তু ঐ প্রকার কর্কশ স্থূল বিদ্রুপেও বসন্তদাস নিবৃত্ত হতো না। শুধু বণিকেরা নয়, আর একটি আকর্ষণ ছিলো নদীতীরে। সে হলো কুটিরবাসী একজন যোগী। প্রায়, অষ্টপ্রহরই তিনি গীত গাইতেন। রামায়ণ–কাহিনী, ভারত–কথা, পুরাণ–বৃত্তান্ত–সমস্তই থাকতো তাঁর গীতে। ঐ প্রৌঢ় যোগীটি আবার শিক্ষাদানও করতেন। এক প্রকার উন্মাদ ছিলেন সম্ভবত। না হলে ধর্মহীন চণ্ডাল, হড্ডি, শবর ইত্যাদি নীচ জাতীয় বালকদের কেউ শিক্ষাদান করে? মৃত্তিকায় রেখা টেনে টেনে বর্ণপরিচয় হতো। কাজটি ছিলো গর্হিত। কেননা কে কবে শুনেছে যে, ডোমের পুত্র, হড়ডির পুত্র, বিদ্যাভ্যাস করে?
একদিকে বণিকদের মুখে দূর দেশের কাহিনী, অন্যদিকে উন্মাদ যোগীর কাছে বিদ্যাভ্যাস–এই দুটি আকর্ষণ ছিলো প্রবল। ঐ সঙ্গে ছিলো আবার প্রাকৃত গীতগুলি। ঐ গীতগুলি তার বড় প্রিয় ছিলো। আর সেই কাহিনী, রামের বনগমনের দৃশ্যটি–পিতা মূৰ্ছাহত, মাতা উন্মাদিনীপ্রায়, নগরবাসী হা রাম হা রাম বলে হাহাকার করছে–কিন্তু। রাম অবিচল। দৃঢ় পদক্ষেপে বনবাসে চলেছেন। কিংবা ধরো, গঙ্গা শান্তনুর বৃত্তান্তটি সত্যভঙ্গ হয়েছে বলে গঙ্গা চলে যাচ্ছেন, শিশু সন্তান কাতরস্বরে মা মা বলে ডাকছে, স্বামী মিনতি করছেন, কিন্তু দেবী গঙ্গা অবিচল। শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যেতো কিশোর বসন্তদাস। ওদিকে পিতার লাঠৌষধি প্রায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু তাতে গ্রাহ্য ছিলো না বসন্তদাসের।
এবং প্রায়ই সে পলায়ন করতো। শীত আরম্ভ হলো–তারপর দেখো বসন্তদাস আর গৃহে নেই। সন্ধান করো, দেখবে, কিশোর বসন্তদাস মেলায় মেলায় পুত্তলি বিক্রয় করছে। শেষে কৈশোর অতিক্রান্ত হলে, নবীন যৌবনে একদা সত্য সত্যই সে পলায়ন করলো। কোথায় গেলো, কি বৃত্তান্ত, কেউ জানলো না। স্ত্রী রোদন করলে হেমন্তদাস শাসন করতেন। বলতেন, ঐ কুৰ্মাণ্ডটার জন্য অহেতুক অশ্রুপাত করছো, ওর কি পিতামাতা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান আছে? অমন পুত্র না থাকাই উত্তম।
কিন্তু যখন সে ফিরলো, পিতা কিছু বলতে পারলেন না। কি বলবেন? ঐ যুবা পুরুষকে কি আর তখন কিছু বলা যায়? দেখছেন, দীর্ঘদেহ যুবা পুরুষটি–পরিধানে শুভ্র বস্ত্র, মস্তকে দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশ, কর্ণে দুটি স্বর্ণ কুণ্ডল, ঊধ্বাঙ্গের উত্তরীয়খানি স্বর্ণাভ চীনাংশুক, অন্তরাল থেকে অঙ্গদের উজ্জ্বলতা চমকিত হচ্ছে। আর গমন ভঙ্গিটি এমত যে মনে হয় দূর দেশাগত ধনী কোনো শ্রেষ্ঠী অথবা সার্থবাহ ভ্রমণে বাহির হয়েছেন। অমন বয়স্ক সুপুরুষ পুত্রকে কি কিছু বলা যায়? বিশেষত সে পুত্র যখন বাণিজ্য করে গৃহে ফিরছে।
হেমন্তদাসের অর্থের প্রয়োজন ছিলো। গৃহসংস্কার হয়নি বহুকাল। গো–শালার খুঁটিগুলি হয়ে পড়েছিলো দুর্বল ও কীটদষ্ট, ভাণ্ডার গৃহের চালাগুলিতে পচন ধরেছিলো, শয়ন প্রকোষ্ঠের গবাক্ষ ও দ্বারগুলির অবস্থা ছিলো শোচনীয়। এমতাবস্থায় পুত্রের উপার্জিত অর্থ তিনি সদ্ব্যবহার করলেন নিঃসংকোচে। ওদিকে আবার মাতৃদেবীরও সাধ, গৃহে বধূ আনবেন। পিতারও ঐ ব্যাপারে সমর্থন ছিলো। কারণ তিনি ভালো জানেন যে, যুবতী রমণীর বাহুপাশ ছিন্ন করে কোনো নবীন যুবকের পক্ষে বিদেশ যাত্রা করা সম্ভব নয়। সুতরাং সন্ধান করো, কন্যা যেন যুবতী এবং রূপসী হয়। পুনর্ভবা তীরের দীনদাস নামক একটি লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো হেমন্তদাসের। সে–ই এনে দিলো প্রকৃত সংবাদ।
কন্যাটি প্রকৃতই রূপবতী, যদিও বর্ণটি শ্যামল ভিন্ন অন্য কিছু বলা যায় না। বসন্তদাসের মাতা কন্যাটিকে দেখে আনন্দিত হলেন। সধবা রমণীরা হুলুধ্বনি করছিলো, তিনি ধানদূর্বা দিয়ে বধূবরণ করবেন। গৃহদ্বারে পিঁড়িখানি পাতা, বধূ পিঁড়িতে দাঁড়াবার পরও মাতা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছেন রূপবতী বধূটিকে। আহা কপালখানি যেন নবচন্দ্রিকা। ওষ্ঠ দুটির তো তুলনা হয় না–যদি হতো, তাহলে বলা যেতো কামকুসুম–আর গ্রীবাটি দেখো, কী মসৃণ, বাহু দুখানি কেমন সুগোল–আর বক্ষোদেশ? অমন কি দেখেছেন কোথাও? না, মনে পড়ে না।
অমন রূপবতী যুবতী যদি বাহুপাশে বাঁধতে না পারে নিজ পুরুষকে, তাহলে ধিক সে যুবতাঁকে।
কি হলো, বিলম্ব কেন? বধূবরণ করো? স্বামীর তাড়নায় বসন্তদাসের মাতা ধান–দূর্বা কুসুম–চন্দনাদি দিয়ে বধূকে বরণ করলেন।
অতঃপর বলাই বাহুল্য যে বসন্তদাসের দিবারাত্রির জ্ঞান লোপ পেয়েছিলো। পক্ষকাল যেন কাটলো ভয়ানক এক ঘোরের মধ্যে, রমণীদেহ তাকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছিলো বলতে হবে। ওদিকে পিতা নিশ্চিন্ত, মাতার আনন্দ আর ধরে না।
তবে ভোগেরও শেষ আছে। পক্ষকালও গত হয়নি, বসন্তদাস পুনরায় উন্মন হয়ে। উঠলো। ঐ সময় নদীতীরের ঘাটে নতুন বণিকেরা এসেছে। বসন্তদাসের সময় অতিবাহিত হয় তাদের সান্নিধ্যে। উপার্জিত অর্থও ততদিনে নিঃশেষিত প্রায়। সে বুঝে নিয়েছিলো, যাত্রার সময় হয়ে এসেছে।
কিন্তু ব্যাপারটিকে ত্বরান্বিত করলো গ্রামপতি কুশল দত্ত। কার মুখে কী শুনেছিলো ঈশ্বর জানেন, একদা এসে হস্ত প্রসারিত করে দাঁড়াল। বললো, আমাকে দুইশত মুদ্রা ঋণ দাও।
কুশল দত্ত এমন ব্যক্তি যার হস্ত প্রসারিত হলে প্রত্যাহৃত হয় না। তা সে রমণী হোক অথবা ধনসম্পদ। তার এক কথা, তোমার নেই, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। তিন দিবসের মধ্যে আমার দুইশত মুদ্রা চাই–যদি স্বেচ্ছায় দাও, উত্তম, না হলে আমাকে বলপ্রয়োগ করতে হবে।
বসন্তদাস ঘটনাটি কাউকে জানতে দিলো না। কেবল পিতাকে জানালো, আপনার পুত্রবধূ পিত্রালয়ে যেতে চায়। ঐটুকুই কথা। একই শকটে দুজনে গৃহত্যাগ করলো অতঃপর। শেষে দেখা গেলো, পুত্রবধূ যথাস্থানে উপনীত হয়েছে কিন্তু পুত্র নিরুদ্দেশ।
আত্রেয়ীবক্ষে অপেক্ষমাণ অন্যান্য বণিকদের সঙ্গে যাত্রারম্ভ। তারপর শকটারোহণ– দক্ষিণে যাত্রা, কখনও আবার ঈষৎ পশ্চিমে। এক জনপদ থেকে আর এক জনপদে। এক হাট থেকে অন্য হাটে–যদি শকট দুস্পাপ্য হয়, তাহলে অশ্বারোহণ, কিংবা পদব্রজ। কোথাও তৈজসাদি কেনে, কোথাও কেনে গন্ধদ্রব্য, কোথাও লবণ, কোথাও ক্ষৌমবস্ত্র, কোথাও আবার দুকূল–জীনাংশুক। এই প্রকার ক্রয় এবং বিক্রয়। কখনও ক্ষতি এমন হয় যে, মনে হয়, এইবার তার বাণিজ্য শেষ। কিন্তু পরবর্তী উদ্যোগই তাকে আশাতীত লাভবান করে দেয়। দু দুবার তার আশাতীত লাভ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ লাভ থাকেনি। দস্যু এবং রাজ পুরুষদের উপদ্রব এমনই প্রবল যে বণিকের পক্ষে তিষ্ঠানে কঠিন। দস্যুরা কিছুই বলে না, আকস্মিকভাবে আসে এবং পণ্যসামগ্রী লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। কখনও কখনও প্রহারও করে। কিন্তু রাজপুরুষেরা তোমার বিপণীতে এলে ব্যবহার এমন করবে, যেন কততদিনের পরিচয়। পানগুবাক খাবে, আলাপে নিমগ্ন হবে, হাস্যকৌতুকও করবে। শেষে প্রসারিত হস্তের অঙ্গুলি নির্দেশে একে একে দ্রব্যগুলি ভূত্যের হাতে উঠতে থাকবে। ঐ ওঠার যেন শেষ নেই। মনে হবে, পারলে যেন সমস্ত বিপণীটিই স্কন্ধে তুলে নিয়ে যায়।
দুকূল বস্ত্রখানি নিলাম হে, ভারী সুন্দর এর রঞ্জনটি–মুক্তামালাগুলি বুঝি নব্যা বকাশিকার? দুখানি দাও, গৃহিণী পেলে সুখী হবে–আরে! তোমার কাংস্য স্থালীগুলি তো চমৎকার–এগুলি কি পশ্চিমের? আমার গৃহে কয়েকখানির প্রয়োজন, ওরে সুখদাস, স্থালীগুলি গৃহে নিয়ে যা।
বসন্তদাস ক্লান্তি বোধ করে একেক সময়। গণনা করে দেখে, লাভালাভ শেষে একই প্রকার থেকে যাচ্ছে। অতিরিক্ত উপার্জন চলে যাচ্ছে দস্যু নয়তো সামন্তপতি গ্রামপতিদের হাতে। সে ক্রমে হতাশ হতে আরম্ভ করে। যখন যাত্রারম্ভ করে তখন শীতের শেষ। আশা ছিলো, বর্ষার পূর্বেই গৃহে ফিরবে। কিন্তু দেখলো অসম্ভব। সঞ্চয়ে প্রায় কিছুই নেই। অগত্যা স্থির করে, পথিমধ্যেই বর্ষাযাপন করবে। এবং সেই সিদ্ধান্ত মতে সে গ্রাম্য বণিকের মতো হাটে হাটে সামান্য পণ্য ক্রয় বিক্রয় আরম্ভ করে। ঐভাবেই যায় বর্ষাকাল। কিন্তু তাতেও লাভ হয় না। অবস্থা থেকে যায় যথাপূর্বং তথাপরং। সর্বত্রই কোনো না কোনো দুর্বিপাক। ধবলদীর্ঘিকা হাটে বন্ধু শখদত্ত করে প্রতারণা। সমস্ত পণ্য সে ক্রয় করে কিন্তু মূল্য পরিশোধ না করেই পলায়। ফলে বাণিজ্যে আর তার উৎসাহ থাকে না। শঙ্খদত্তের সন্ধানে তাকে যেতে হয় দেবীকোটের মেলায়। প্রাচীন নগরী দেবীকোট তখন পরিত্যক্তপ্রায়। কিন্তু বৎসরান্তে মেলাটি নিয়মিত বসে। শুনেছিলো শঙ্খদত্ত মেলায় অশ্ব ক্রয় করবে। কিন্তু দেখলো, ঐ মেলায় শঙ্খদত্তকে সন্ধান করা কঠিন। তার সঙ্গে তখনও কয়েকখানি মুক্তামালা ছিলো। সে মণিকার বিপণীগুলিতে ঐ মালা কয়খানি একে একে বিক্রয় করলো। বলা বাহুল্য, মূল্য পাওয়া গেলো আশাতীত। কিন্তু তারপর? তারপর আর তার বিক্রয় করার মতো কিছু নেই। সে স্থির করলো, এখন কদিন সে মেলা দেখবে এবং শঙ্খদত্তের সন্ধান করবে।
এও বোধ হয় ভবিতব্যই। না হলে সে বিলম্ব না করে গৃহে ফিরতে পারতো। জীবন তার হতো অন্য প্রকার। কেননা ঘটনা মানুষকে নানা বিষয়ের সঙ্গে সংলগ্ন করে দেয়। মেলার ঘটনাগুলি আকস্মিক, কৌতূহলপ্রদ, কৌতুকময় এবং কোনো কোনোটি দুঃখবহও বটে। আর ঐ সকল ঘটনাই তাকে বিচিত্র পথে চালিত করে।
মেলার প্রান্তে একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই এবং বড়ই জীর্ণদশা তার। কোনো এক সময় সম্ভবত পূজা হতো–এখন একেবারেই পরিত্যক্ত। শোনা যায়, ঐ মন্দিরে দেবী বজ্রতারা অধিষ্ঠিতা ছিলেন। কোনো এক সময় নাকি মঞ্জুশ্রী মূর্তিও সেখানে স্থাপিত হয়েছিলো। নিকটবর্তী দুখানি গ্রামের নাম বজ্রেশ্বর ও মঞ্জুকল্প। গ্রাম দুখানিই কেবল ঐ দুই দেবদেবীর নাম ধারণ করে আছে–নতুবা আর কোনো চিহ্ন তাদের নেই। মেলাটি যে কি উপলক্ষে বসে, তাও কেউ বলতে পারে না এখন।
বসন্তদাস পরিত্যক্ত মন্দিরটি দেখতে গেলে পরিচিত হয় এক যবন বৃদ্ধের সঙ্গে। বৃদ্ধটিও মন্দির দেখতে এসেছিলেন। সৌম্য শান্ত মুখাবয়ব, দেখলেই শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। আলাপে বসন্তদাস জানলো বৃদ্ধটি অশ্ববিক্রেতা। দশটি অশ্ব এনেছিলেন, সবই প্রায় বিক্রয় হয়েছে, অবশিষ্ট দুটি বিক্রয় হলেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করবেন। ঐ অশ্ব বিক্রেতাই জানালেন, শঙ্খদত্তের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে এবং সে দুএকদিনের মধ্যেই একটি অশ্ব ক্রয় করবে বলে অঙ্গীকার করেছে।
ঐ সংবাদের পর কে আর স্থির থাকতে পারে। বসন্তদাস মেলার পশু হাটে শঙ্খদত্তের সন্ধান করতে থাকে। স্থানটি একেবারে নরকবিশেষ। অশ্ববিক্রয়ের স্থানটি সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। দুদিকে অশ্বের সারি, মধ্যস্থলে প্রশস্ত পথ। ঐ পথেই চলেছে অশ্বের পরীক্ষা। কোন অশ্ব কতখানি শিক্ষিত ক্রেতারা তা পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। ফলে কখন যে ধাবমান অশ্ব কার স্কন্ধে এসে পতিত হবে তার স্থিরতা নেই। হৈ চৈ চিৎকার, ধাবমান অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, তাদের গ্রীবায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘুন্টিকা মালার ঝুম ঝুম শব্দ এবং মানুষের উল্লম্ফ পলায়ন, সমস্ত একত্রে স্থানটিকে যুগপৎ আকর্ষণীয় ও বিপজ্জনক করে রেখেছে।
আর হস্তি বিক্রয়ের স্থানটি তো একেবারেই অসহ্য। কপি পড়ে আছে ইতস্তত আর স্থানে স্থানে পুরীষপ। সেই স্থূপ আবার প্রায়শঃই মূত্রস্রোতে বিগলিত ও ভাসমান। দুর্গন্ধে ও স্থানে দাঁড়ানো যায় না। তদুপরি সময় নেই, অসময় নেই, মাহুতেরা কুলিশাঘাত করে আর দিগন্তকম্পী বৃংহণধ্বনি ওঠে। সে এমন চিৎকার যে কর্ণপটাহ ছিন্নভিন্ন হবার উপক্রম হয়। তবে সর্বাপেক্ষা অধিক জনসমাগম হয় গো–হট্টে। কতো প্রকার, কতো আকারের যে গোধন হতে পারে তা এই মেলায় না এলে ধারণা করা যাবে না। এ স্থানেও দুসারি গবাদিপশুর মধ্যবর্তী একটি প্রশস্ত পথ রাখা হয়েছে। সেখানে শকটবাহী বলীবর্দদের শক্তি এবং কৌশলের পরীক্ষা হচ্ছে। তাদের সুচিক্কণ লোমাবৃত দেহ, গর্বোচ্চ গ্রীবাভঙ্গী এবং সুছন্দ গমন দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না যে এগুলি বলীবদ। মনে হয় এগুলি অন্য কোনো প্রাণী। আর গাভীগুলিকে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। পশ্চিম দেশীয় গাভীগুলি বিদ্ধনাসা, তবে নথের সঙ্গে রঞ্জু বাঁধা থাকলেও ক্রেতাদের পীড়নে একেকবার এমন লম্ফ দিয়ে উঠছে যে তাদের শান্ত করতে বিক্রেতাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। তাদের দুগ্ধস্থলীটি বিশাল এবং বাটগুলি প্রায় ভূমিস্পর্শী। প্রতিদিন নাকি দশ ভাণ্ড দুগ্ধ দিতে পারে এরা। দেশীয় গাভীগুলিই কি কম! খর্বাকার, কিন্তু এদের ওলানগুলিও কম স্ফীত নয়। শোনা যায়, এদের দুগ্ধদানের ক্ষমতাও প্রতিদিন পাঁচ ছয় ভাণ্ডের মতো।
বসন্তদাসের এই এক কাজ। প্রতিদিন পশুহট্টে বিচরণ, আর শঙ্খদত্তের সন্ধান। প্রতিদিনই যবন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়। তিনিও অপেক্ষায় আছেন, কখন লোকটি আসে এবং তার শেষ অশ্বটি ক্রয় করে নিয়ে যায়। বৃদ্ধটি একই পান্থশালার অতিথি, যদিও রাত্রিযাপন করেন ভিন্ন একটি প্রকোষ্ঠে। তবে অন্তরঙ্গতা হতে বিলম্ব হয়নি। দেখা হলেই বলেন, কি বৎস, তোমার মিত্র শঙ্খদত্তের দর্শন পেলে?
বৃদ্ধটি একেবারেই বৃদ্ধ–পক্ককেশ, শ্বেত শ্মশ্রু, এমনকি ভ্রূ–যুগল পর্যন্ত শুভ্র। তাঁর কাছে কতো যে কাহিনী সংখ্যায় গণনা করা যায় না। একবার আরম্ভ করলেই হলো, বিরতি হবে না সহজে, ক্লান্তিবিহীনভাবে বলে যেতে থাকবেন। অতিথিশালার অন্য আর একজনের সঙ্গেও বসন্তদাসের হৃদ্যতা হয়েছে–তবে সে হৃদ্যতা অন্য প্রকারের। বৃদ্ধ যখন তার কাহিনী বলেন, তখন তাতে কৌতুক থাকলেও মাথা নত করে শুনতে হয়। শ্রদ্ধা ও প্রীতির এমন একাকার ভাব পূর্বে কখনও বসন্তদাস অনুভব করেনি।
বৃদ্ধ এবার গৃহাভিমুখে যাত্রা করবেন। বাণিজ্য যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। গৃহে সকলে অপেক্ষা করে রয়েছে। একটি বালিকা কন্যা আছে তাঁর। কন্যাটি বড় আদরের। ইতোমধ্যে হয়তো বিবাহের বয়স হয়েছে। বৎস বলতে পারো, বিবাহের বয়স হলে দুহিতারা প্রবাসী পিতার কথা চিন্তা করে, না ভাবী স্বামীর চিন্তায় অধিক সময় ব্যয় করে? সাধ্য কি বসন্তদাসের যে ঐ দুরূহ প্রশ্নের উত্তর দেবে। সে হাসে প্রশ্ন শুনে। বলে, মহাশয় বুঝি আশা করেন যে কন্যারা সকলেই পিতার চিন্তায় নিশিদিনযাপন করুক?
না, তা নয়, একটি দীর্ঘশ্বাস নিঃসৃত হয় বৃদ্ধের বক্ষ থেকে। বলেন, বড় আদর করতাম কন্যাটিকে–ঐটিই কনিষ্ঠা কিনা–আর অপরূপ সুন্দরী হয়েছে সে দেখতে, যদি তুমি দেখতে! তুমি স্বজাতীয় হলে আমি তোমাকে জামাতা করতাম।
কথাটি কৌতুক, না সত্যভাষণ, কিছুই বোঝা যায় না। তথাপি সে জানায়, মহাশয়, আমি কিন্তু বিবাহিত।
তাতে কি, আমাদের সমাজে চারিটি পর্যন্ত স্ত্রী রাখার বিধান রয়েছে।
তাই বলে আপনি সপত্নী গৃহে কন্যাদান করবেন?
হ্যাঁ করবো, বৃদ্ধ হাসেন। বলেন, কারণ আমি জানি, আমার কন্যাটিই হবে জামাতার সর্বাপেক্ষা আদরণীয়া।
বস্ত্র ব্যবসায়ী অক্রূরদাস একেবারেই বয়স্য স্বভাবের। তার কৌতুকাদিতে বারণ থাকে না। যতো উদ্ভট প্রসঙ্গ তার আলাপে। একদা জানতে চাইলো, সখা বসন্ত, এদেশে রমণীদের বক্ষ স্তনশূন্য কেন বলতে পারো?
কি অদ্ভুত কথা! স্তনশূন্য বক্ষ যার সে রমণী হবে কি প্রকারে? বোঝে সে, পীতাঙ্গী পার্বত্যজাতীয়া রমণীদের কথা বলছে অক্রূরদাস।
সে জানায়, অক্রূরদাস, একবস্ত্রা ঐ রমণীদের বক্ষদেশে স্তন দুর্লক্ষ্য হলেও তাদের নারীত্বে সন্দেহ পোষণ করো না–বিপদে পড়বে–রমণ রণে কিন্তু তারাই প্রথম আক্রমণ করে এবং পুরুষকে নিঃশেষিত না করে ত্যাগ করে না।
বসন্তদাস লক্ষ্য করছে, রাঢ়দেশবাসী অক্রূরদাসের নারী বিষয়ে আগ্রহ অত্যধিক। ঐ প্রসঙ্গ একবার পেলেই হলো, প্রহরের পর প্রহর সে আলাপ করে যাবে।
শঙ্খদত্তের সন্ধান করার সময় একটি বিচিত্র দৃশ্য দেখলো সে একদিন। কাষায় বস্ত্রধারী, পীতবর্ণ, মুণ্ডিতমস্তক একদল লোক সারিবদ্ধভাবে প্রাচীন মন্দিরের দিকে যাচ্ছে। সকলের মতো তারও কৌতূহল হলো, এরা কারা? কেউ বললো, এরা বণিক–কেউ বললো, এরা সদ্ধর্মী ভিক্ষু, হিমালয়ের পরপর তিব্বত দেশ থেকে এসেছে–আবার কেউ বললো, না হে, এরা সমুদ্রপারের মানুষ, তীর্থস্নানে চলেছে।
প্রকৃত পরিচয় কেউ দিতে পারে না। তবে লক্ষ্য করা গেলো, দেশী ভিক্ষুরা তাদের সঙ্গে সাগ্রহে আলাপ করছে।
পরদিন প্রভাতে আর তাদের দেখা গেলো না। তবে জল্পনা–কল্পনা চললো পরদিনও। অশ্বহট্টের লোকদের মুখে উদ্বেগ চিহ্ন। তাদের আশঙ্কা, ভয়ানক কিছু ঘটবে–সদ্ধর্মীদের এতো সংখ্যক লোক একত্র হয়েছে, এ শুভ লক্ষণ নয়। বসন্তদাস শঙ্খদত্তের কথা জিজ্ঞাসা করলে একজন বিরক্ত হয়ে জানায়, মহাশয়, আপনার কি মস্তিষ্কের দোষ হয়েছে, প্রতিদিন এক কথা? আমরা কি রাজার গূঢ় পুরুষ যে প্রতিটি লোকের আগমন নির্গমনের সন্ধান জেনে রেখেছি? এখন যান, বিরক্ত করবেন না।
সন্ধ্যাকালে দেখা গেলো মেলার নোক পলায়ন করছে। কি বৃত্তান্ত, কেউ জানে না। শুধু জনরব শোনে। ঐ আসে তারা, শীঘ্র পলাও–ঐ এসে গেলো। পলায়ন করুন মহাশয়, যদি প্রাণ রক্ষা করতে চান।
ক্রমে জানা গেলো, নিকটেই কোথাও ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হবে। রাজার সেনাদল আসছে বিদেশী সদ্ধর্মীদের দমন করতে। যতো শীঘ পারা যায়, পলায়ন করা উত্তম। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।
কোথায় কি! শেষাবধি কিছুই হলো না। পরদিন দ্বিপ্রহরে দুজন অশ্বারোহী দেখা গেলো–তারা ভিক্ষুদের সন্ধান করলো প্রথমে, তারপর মন্দিরগৃহে বিশ্রাম করতে গেলো। অপরাহ্বে দেখা গেলো ক্ষুদ্র একটি সৈন্যদল আসছে। তারা মেলার কিছু খাদ্যদ্রব্য ও কয়েকটি বিপণী লুণ্ঠন করে বিদায় হলো।
কিন্তু ততক্ষণে মেলার অর্ধাংশ শূন্য হয়ে গেছে।
ঘটনাটি বসন্তদাসকে হতাশ করে দিলো। সে বুঝলো, শঙ্খদত্তকে আর পাওয়া যাবে না।
অপরাহ্নের দিকে একদিন অক্রূরদাস তাকে শয্যা থেকে তুললো। বললো, চলো সখা, আজ কিঞ্চিৎ আনন্দ উপভোগ করে আসি। তোমাকে আজ অতীব উপভোগ্য বস্তু দেখাবো।
অক্রূরদাসের স্ফূর্তির কারণ ছিলো। সমস্ত বস্ত্র তার বিক্রয় হয়ে গেছে, এখন সে মুক্ত পুরুষ। দিন দুই আমোদ উপভোগ করবে, তারপর গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যাবে। সে ইতোমধ্যে দুখানি শাটিকা বসন্তদাসকে উপহার দান করেছে। ভারী সুন্দর বস্ত্র দুখানি। একখানি স্বর্ণাভ চীনাংশুক–কল্পনায় মায়াবতীর দেহে ঐ বস্ত্র দেখে সে সাগ্রহে বস্ত্রখানি গ্রহণ করে। আর অন্যখানি গাঢ় নীল বর্ণের পট্টবস্ত্র। তাতে আবার স্বর্ণসূত্রের সূচিকর্ম। শাটিকাখানি মেলে ধরলে মনে হবে তারকাখচিত রাত্রির আকাশ। শ্যামবর্ণা মায়াবতীর দেহে ঐ বর্ণের বস্ত্র যে মানাবে না, তা সে জানতো। তাই বস্ত্রখানি গ্রহণ করতে তার ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো। তাতে অক্রূরদাস হেসে ওঠে। বলেছিলো, নাও সখা, নিয়ে রাখো–সমস্তই যে পত্নীকে দিতে হবে এমন তো কথা নেই–পত্নী ব্যতিরেকেও তো কোনো রমণী বাঞ্ছিতা হতে পারে।
অক্রূরদাসের আগ্রহে সে সঙ্গী হলো। কিন্তু এমন স্থানে সে নিয়ে গেলো যেখানে যাবার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। অক্রূরদাস তাকে নিয়ে তুললো একেবারে বারাঙ্গনা পল্লীতে। তাকে অপ্রতিভ দেখে জানতে চাইলো, সখা বসন্ত, এই কি তোমার প্রথম? পূর্বে কখনও এরূপ স্থানে আসোনি?
বসন্তদাস বিরক্ত হচ্ছিলো। উত্তর না দিয়ে বললো, চলো, কোথায় যাবে।
সে এক অদ্ভুত জগৎ। কুটিরের দ্বারে দ্বারে বাররমণীরা। ওষ্ঠ রক্তিম, কপোলে শঙ্খচূর্ণ এবং তদুপরি কুঙ্কুম বিন্দু। কঞ্চলিগুলি এতোই স্ফীত যে সন্দেহ হয় ভিতরে গোলাকার প্রস্তরখণ্ড বাঁধা। সে এমন কখনও দেখেনি। নিজ গ্রামে হাটের প্রান্তে কয়েকটি ডোম এবং হড়ডি কুটিরের কথা সে জানে, যেখানে কয়েকটি শিথিলশাসনা রমণী বাস করতো। তারা এমন সাজসজ্জা করতো না। অন্য দশটি রমণীর মতোই ছিলো তাদের বেশবাস। জনরব ছিলো যে তারা অর্থের বিনিময়ে দেহোপভোগ করতে দিতো। কিন্তু এ যে দেখছে, একেবারেই অন্য রূপে যেমন, তেমন আকার প্রকারেও।
মাদকসেবী নাগরেরা যথেচ্ছ ব্যবহার করছিলো। কেউ নীবিবন্ধন ছিন্ন করার কপট ভঙ্গি করছিলো, কেউ মুখ চুম্বন করছিলো, কেউবা অহেতুক চিৎকার করছিলো। অক্রূরদাস একটি কুটিরের দ্বারদেশে উপনীত হয়ে বললো, সখা, এখানে দাঁড়াও। অতঃপর কুটিরের রুদ্ধদ্বারে করাঘাত করলে ভিতর থেকে চিৎকার শোনা গেলো। রমণীকণ্ঠ চিত্তার করে বলছে, রে কুক্কুরীপুত্র, রজ্জু দিয়ে বেঁধে রাখ নিজেকে, আমার কুটিরে এখন লোক আছে।
ঐ কথা শুনে বসন্তদাস আমূল বিচলিত হলো। একটি বিবমিষার ভাব তার সমগ্র দেহাভ্যন্তরকে আলোড়িত করতে লাগলো। অন্য লোক যে রমণীতে উপগত হয়েছে সেই রমণীতেই তুমি গমন করবে? এ কীভাবে সম্ভব? তোমার কি ঘৃণা নেই? যদি অন্যজনের উপগমন হতো তোমার অজ্ঞাতে, তাহলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু এ–তো স্পষ্ট, তবু তোমার রুচি থাকবে? ছি ছি। সে ডেকে বললো, অক্রূরদাস, আমি চললাম–তোমার আনন্দ নিয়ে তুমি থাকো।
অক্রূরদাস আসব পান করেছিলো। তার তখন ঈষৎ মত্তাবস্থা। বললো, কেন সখা, তোমার কি যুবতী রমণী অভিপ্রেত নয়? যদি বলল, তাহলে কিশোরী অথবা বালিকা সন্ধান করি।
বসন্তদাস কি বলবে ভেবে পায় না। তবু বলে, অক্রূরদাস, তোমার ঘৃণা হবে না? যে রমণীকে ক্ষণমাত্র পূর্বে অন্য লোকে ব্যবহার করেছে তার কাছে যেতে তোমার রুচি হবে?
কেন হবে না? অক্রূরদাস বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে বসন্তদাসের মুখপানে চায়। ক্রমে যেন বোঝে কথাটি। শেষে হা হা রবে হেসে ওঠে। বলে, তুমি হাসালে সখা, অন্যের উপগমনের চিহ্ন কি ঐ স্থানে খোদিত হয়ে থাকবে? বারেক ধৌত করে নিলেই হলো।
ঐ সময় একটি কোলাহল সৃষ্টি হয় স্থানটিতে। দেখা যায়, সশস্ত্র প্রহরীদের একটি ক্ষুদ্র দল সদর্পে অগ্রসর হচ্ছে কুটিরগুলির দিকে। বসন্তদাস অনুমান করে, একটি গোলযোগ আসন্ন। সে বিলম্ব না করে ঐ স্থান ত্যাগ করে।
পান্থশালার দ্বারদেশে উপবিষ্ট ছিলেন যবন বৃদ্ধটি। বসন্তকে দেখে বললেন, বস তুমি না বন্ধুর সঙ্গে আনন্দোপভোগের জন্য গেলে–তা এতো শীঘ্র ফিরলে যে? কি দেখলে, নাটগীত নাকি বাজিকরের খেলা?
বসন্তদাস সামান্য ইতস্তত করে। তারপর ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, না মহাশয়, ওসব নয়–আমরা বারাঙ্গনাদের পল্লীতে গিয়েছিলাম।
বৃদ্ধ অপ্রস্তুত হলেন। শেষে সহজ হওয়ার জন্য ঈষৎ হেসে বললেন, তাহলে শীঘ ফিরলে যে?
বসন্তদাস নিজেরই কাছে অপমানিত বোধ করছিলো ঐ সময়–ক্রোধ হচ্ছিলো তার। বৃদ্ধের কথা তার বিরক্তি উৎপাদন করলো। বললো, হ্যাঁ, শীঘ্রই ফিরলাম। সকলের রুচি কি একপ্রকার?
না, তা বলিনি আমি, বৃদ্ধ সহজ স্বরে বলেন–সে তুমি যা-ই বলো, কেউ তোমার কথা এখন বিশ্বাস করবে না!
মানুষের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য কি আমার কোনো প্রকার দায় আছে?
না, তা নেই, বৃদ্ধ স্বীকার করেন। বলেন, বরং তুমি চলে এসে উত্তম কাজই করেছো–ঐ অভ্যাস কুৎসিত, শাস্ত্রে বলে, অত্যধিক রমণীআসক্তি পুরুষকে দরিদ্র ও নির্বীর্য করে।
ঐ সময় একটি কোলাহল শোনা গেলো। স্থলিত কণ্ঠে চিৎকার এবং গালাগালি করতে করতে একদল লোক এদিকেই আসছে। নিকটে এলে দেখা গেলো, সকলেই পান্থশালাবাসী এবং বিভিন্ন শ্রেণীর বণিক। এরা সকলেই আনন্দ সম্ভোগের সন্ধানে সন্ধ্যাকালে পান্থশালা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলো।
একজন বললো, ওহে বালিকাটি বোধ হয় সত্যই সুভগা ছিলো।
অপরজন বললো, আর ঐ যুবতীটি! নিতম্ব দুটি যেন পূর্ণকুম্ভ।
অন্য আরেকজন জানতে চাইলো, ওহে এতো বাক্যব্যয় যে করছো, অগ্রে বলল, তোমরা ঐ বালিকা এবং যুবতীটিকে কি শয্যায় পেয়েছিলে?
না সখা, পাইনি, শূকরপুত্র সৈনিকেরা এমত তাড়না করলো যে আমাদের পলায়ন করে উপায় রইলো না–আহা, বালিকাটি এতো কোমল–যদি একবারের জন্যও পেতাম।
আরে মর্কট, অন্য আর একজন ধিক্কার দিয়ে উঠলো, ধিক তোকে যে, যুবা পুরুষ হয়েও বালিকা বালিকা করছিস। বালিকা রমণে আর এমন কি সুখ! পারঙ্গমা যুবতী রমণরণে স্বেদাক্ত হলে কেমন দেখায়, দেখেছিস কখনও?
ঐ সময় হঠাৎ এক ক্ষীণাঙ্গ প্রৌঢ় ছুটে এসে বৃদ্ধের পদপ্রান্তে উপবেশন করে। বলে, আপনিই বিচার করুন মহাশয়, রাজপ্রহরীরা কী মনে করে নিজেদের? রমণী সম্ভোগের অধিকার কেবল কি ওদেরই? আমাদের দেহে কি বস্তুটি নেই, আঁ? এ কি বিচার তাদের!
প্রত্যেকেই লম্পট এবং প্রত্যেকেই মাদক সেবন করে এসেছে। তাদের প্রমত্তাবস্থার ব্যবহার ন্যক্কারজনক–প্রত্যেকের মুখে দুর্গন্ধ। আর কথা কি তাদের! ঐ স্থানে তিষ্ঠানো দায়। দেখা গেলো বসন্তদাস নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। সে চিৎকার করে গালাগালি করতে লাগলো। বললো, তোমরা কৃমিকীট, বুঝেছো? মলভাণ্ডই তোমাদের যথার্থ স্থান–তোমাদের শাস্তির এখনই কি হয়েছে? অচিরেই তোমরা শিক্ষা পাবে, চোরের দল, লম্পটের দল কোথাকার।
কিন্তু ঐ ভর্ৎসনায় কী লাভ! সম্বিৎহীনদের কানে তো ঐ প্রকার ভর্ৎসনা পশে না। তাকে উত্তেজিত দেখে বৃদ্ধ হাত ধরে নিয়ে গেলেন অদূরে এক বৃক্ষতলে। বললেন, তুমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছে বৎস–এ–তো তোমার একার দায় নয়–তুমি একাকী উত্তেজিত হয়ে কোনো লাভ আছে, বলো?
বড় বিচিত্র তোমাদের এই দেশ, বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, এতো দস্যু এতো মাদকপায়ী এবং এমন বিশৃঙ্খল শাসন আমি আর কোথাও দেখিনি। এদেশের মানুষ যে কীভাবে জীবনযাপন করে, আমি ভেবে পাই না। বণিকবৃত্তি ধনাগমের প্রধান উৎস। কিন্তু দেখছি। এদেশে বণিকবৃত্তি অসম্ভব। সকল দেশে রাজপুরুষেরা বণিকদের রক্ষা করে–কিন্তু এদেশে দেখছি ভিন্ন রীতি, এখানে রাজপুরুষেরা পারলে বণিকের সমস্তই গ্রাস করে। এদিকে বণিকদের মধ্যেও দেখো, নিজ বৃত্তি রক্ষার কোনো চেষ্টা নেই। এই যে দেখছো ক্ষুদ্র বণিকদের, এদের কারও মধ্যে উচ্চাশা লক্ষ্য করেছো? অল্পেই এরা তুষ্ট। আর যেটুকু বা উপার্জন করে, তার প্রায় সমস্তটাই ব্যয় হয়ে যায় ব্যসনে। ঐ যে গন্ধ বণিকটিকে দেখলে, আসবপান ও গণিকালয়ের ব্যয় সংকুলানের পর তার আর কী অবশিষ্ট থাকবে, ভাবো তো?
এ আবার অধিক হয়ে যাচ্ছে, বসন্তদাসের মনে হলো। বিদেশী মানুষ তিনি, কেন এতো অধিক কথা বলবেন? সামান্য বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্বদান একেই বলে। সে বলে উঠলো, মহাশয় দেখছি ক্ষুদ্র বিষয়কে অহেতুক গুরুত্বদান করছেন, আপনার কথা মিথ্যা নয়–কিন্তু সংসারের তো এই–ই রূপ, সমস্ত কিছুই উত্তমানুত্তমে মিশ্রিত। রাজপুরুষের শাসনের মধ্যেও কি প্রকারভেদে পার্থক্য অধিক থাকে? পীড়ন ও যথেচ্ছাচারকেই তো শাসন বলা হয়, এর অন্যথা যদি কোথাও কিছু থাকে, তাহলে বলতে হবে সেটি ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমকে কি বিধান বলবেন? আজীবন আমরা এই–ই দেখে আসছি। আর বণিকেরা বিলাসব্যসন না করলে কে করবে বলুন? শুধু বণিক কেন, অর্থবান মানুষমাত্রই বিলাসব্যসন করে। দরিদ্রকে বিলাসী হতে দেখেছেন কখনও?
যবন বণিকটি মৃদু হাসেন বসন্তদাসের কথা শুনে। বলেন, তুমি আহত হবে জানলে কথাটি আমি ঐভাবে বলতাম না। বৎস, চিন্তা করে দেখো, কিরূপ বেদনার কথা। বঙ্গ ও বরেন্দ্রে বণিকবৃত্তিই ছিল প্রধান–এদেশের পণ্য এতো দূর দূর দেশে যেতো যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। সমুদ্র পর্বত অতিক্রম করে দূরদূরান্তরে পণ্য বিক্রয় সহজ কথা নয়। অথচ সেই কাজটিই করতো এ দেশীয় বণিকেরা। এখন স্বর্ণরৌপ্য তোমরা দেখতে পাও না–কিন্তু এদেশে গৃহে গৃহে এতো স্বর্ণরৌপ্য ছিলো যে বলার কথা নয়।
বৃদ্ধ ভিন্ন দেশবাসী কিন্তু এদেশের কতো সংবাদ জানেন। বসন্তদাসকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হয়। তার শোনা ছিলো, কয়েকশতাব্দ পূর্বে বঙ্গ বরেন্দ্রের সেনাবাহিনী দিগ্বিজয় সম্পন্ন করে অঙ্গ কলিঙ্গ মগধ মিথিলা বিদেহ কোশল ইত্যাদি কতো যে দেশ জয় করেছিলো তার নাকি ইয়ত্তা ছিলো না। সে বুঝতে ঐ সব অতীতের কল্পকথা ব্যতীত অন্য কিছুই। নয়। কিন্তু এখন, বৃদ্ধের কথা শোনার পর, মনে হচ্ছে, কে জানে, হয়তো ঐ দিগ্বিজয়ের ঘটনাটিও সত্য সত্যই ঘটেছিলো। তবে বৃদ্ধের সকল কথায় আর তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। এতো অকল্পনীয় ঘটনার কথা কি বিশ্বাস করা যায়?
সে জানতে চাইলো একদা, মহাশয় এতো কথা আপনি কোথায় জেনেছেন? আমি তো কখনও শুনিনি।
বৃদ্ধ বসন্তদাসের মুখপানে চেয়ে হাসেন। বলেন, বৎস, তোমরা নিজেকে জানো –আত্মবিস্মৃতির মতো পাপ আর নেই। এ সকল সংবাদ তুমি যেমন আমার কাছ থেকে জানছো, সেই রূপই আমি অন্যের কাছ থেকে জেনেছি। প্রয়াগের এক বৃদ্ধ বণিক তোমাদের এই সমৃদ্ধ দেশের কাহিনী আমাকে বলেছিলেন। তোমার সন্দেহ হলে কোনো জ্ঞানী পণ্ডিতের নিকট সন্ধান করে জেনে এসো, আমার কথা সত্য না মিথ্যা।
বসন্তদাস দুতিনটি দিন মাত্র বৃদ্ধের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করে। কিন্তু ঐ দুতিন দিনেই বৃদ্ধ তার কাছে বহু কথা বলেছেন। পশ্চিম দেশে নাকি এক শ্রেণীর শস্ত্রধারী যবনের। আবির্ভাব হয়েছে যাদের নাম তুরুক। ঐ যবনেরা একের পর এক রাজ্য জয় করছে। তারা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনই নাকি বর্বর। ধ্বংস ও লুণ্ঠন ব্যতীত তারা অন্য কিছু বোঝে না। আবার এও এক অদ্ভুত কথা যে যবন বণিকদের ধর্ম ও তুরুকদের ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব নেই–বরং শত্রুতা ভাবই পোষণ করে গোপনে গোপনে এইরূপ নানান কথা বৃদ্ধের। তবে এই সকল কথার মধ্য দিয়ে বসন্তদাস একটি ভিন্নতর জগতের সন্ধান পাচ্ছিলো। যেমন, সমস্ত কিছুই ললাটলিপি নয়–রাজা রাজপুরুষ কেউ অজেয় নয়। রাজার বিরুদ্ধে প্রজা দ্রোহ উত্থাপন করতে পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সফলও হয়। আরও বুঝছিলো, ছুম্মার্গ একেবারেই অহেতুক। স্পর্শ মাত্রই খাদ্যবস্তু নষ্ট হয় না। যে মনে করে হয়, সে মূর্খ। চণ্ডাল ব্রাহ্মণভেদে জলের গুণাগুণের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না–জল জলই থাকে। কেবল দেবতা সম্পর্কিত বিষয়টি সে বোঝেনি। প্রকৃত কথা এই যে, মেলায় অবস্থান এবং যবন বণিকের সান্নিধ্য বসন্তদাসের মনের মধ্যে একটি রূপান্তরের প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে দেয়। বস্তুর আপাত অবয়বের পশ্চাতেও যে অন্যকিছু থাকতে পারে, সে বিষয়ে সে এখন সজাগ ও সচেতন।
শঙ্খদত্তের আশা সে ত্যাগ করেছিলো। সুতরাং মেলায় অবস্থানের কোনো যুক্তিই তার ছিলো না। কেবলি মনে হচ্ছিলো, অহেতুক তার কালক্ষেপণ। অতঃপর সে গৃহে প্রত্যাগমনের সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধান করে সে পূর্বগামী একদল বণিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। হ্যাঁ, তারা জানায়, শকটারোহণে বসন্তদাস স্বচ্ছন্দে তাদের সঙ্গে যেতে পারে।
সুতরাং বিলম্ব কেন, শিবনাম স্মরণ করে এবার যাত্রা করো, অক্রূরদাস পরামর্শ দেয়।
মেলায় সে তিনটি ক্ষুদ্র দ্রব্য ক্রয় করে। বলাবাহুল্য, সবই মায়াবতীর জন্য। একটি স্বর্ণাঙ্গুরীয়, যার পৃষ্ঠে তিনখানি ক্ষুদ্র বর্ণাঢ্য প্রস্তুরখণ্ড, দুটি রক্তবর্ণ চুনির মধ্যস্থলে একটি শুভ্র মুক্তাফল। দেখলে নয়ন জুড়ায়। তার দ্বিতীয় ক্রয়ের বস্তু একটি ক্ষুদ্র তৈলপাত্র। কাংস্যনির্মিত, কিন্তু এমনই উজ্জ্বল যে চক্ষু ধাধে–ভ্রম হয়, বুঝিবা স্বর্ণ। তবে পাত্রটির আকর্ষণ উজ্জ্বলতার কারণে নয়। তার আকর্ষণ বহিরঙ্গের খোদিত ফুল লতাপাতার কারণে। আর তৃতীয় বস্তুটি হলো গজদন্ত নির্মিত ক্ষুদ্র একটি সিন্দুর পাত্র। পাত্রটি এমনই হৃদয়গ্রাহী যে একবার দৃষ্টিপাত করলেই মনে হবে, আহা এমন আর হয় না।
সন্ধ্যাকালে মেলায় যখন ঐ দ্রব্যগুলি ক্রয়ে সে ব্যস্ত, ঐ সময় যবন বৃদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি তরল পদার্থে পূর্ণ ক্ষুদ্র একটি পাত্র এনে দিলেন হাতে। পাত্রটির মুখ বন্ধ ছিলো। এবং আকারে সেটি অঙ্গুলি পরিমাণ হবে কি না সন্দেহ। পাত্রটি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকের বাতাস সুগন্ধে এমন আমোদিত হয়ে উঠলো যে বলার কথা নয়। তরল পদার্থটি নাকি পুষ্পসব। তথ্যটি জানিয়ে বৃদ্ধ বললেন, বধূমাতাকে দিও এটি, শয়নকালে যেন বিন্দু পরিমাণ অঙ্গে লেপন করেন।
পদার্থটির নাম নাকি ইতর। হাস্যকর নাম বলতে হবে। বসন্তদাসের কৌতুক বোধ হয় নাম শুনে। বলে, এক দেশের বুলি তাহলে সত্যসত্যই অন্য দেশের গালি হয়ে থাকে।
বৃদ্ধের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা পূর্বেই হয়েছে। তথাপি ঐ স্নেহের দান গ্রহণ করে সে অভিভূত বোধ করে। বলে, মহাশয়, আমি আপনাকে বিনিময়ে কী দেবো বুঝতে পারছি না। বৃদ্ধ হাসেন। অতঃপর জানান, তোমার কিছু দেওয়ার প্রয়োজন নেই–তুমি এই বৃদ্ধকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তাতেই আমি অভিভূত–এদেশে এমন আত্মীয়জ্ঞান আমাকে কেউ করেনি।
বৃদ্ধ বিদায় নিলেন। বললেন, আমি কিঞ্চিৎ অসুস্থ বোধ করছি। প্রভাতে যদি নিদ্রিত থাকি, কিছু মনে করো না।
ইতস্তত ভ্রমণকালে অক্রূরদাসের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ।
সে কৌতুক স্বরে বললো, সখা বসন্ত, যাবে নাকি একবার, শেষবারের মতো?
বারাঙ্গনা পল্লীতে যাবার ইঙ্গিত। বসন্তদাস হাসে। বলে, না সখা, আমার সঞ্চয়ে অতো রস নেই যে যত্র তত্র ঢালবো, তুমি যাও।
সে আরও দ্রব্য ক্রয় করতে পারতো, কিন্তু করলো না। নিজের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে যা আছে। তা সে অন্যভাবে ব্যয় করতে চায়। অর্থোপার্জন যে কি বস্তু, সে তো তার দেখা হয়েছে। না, আর বাণিজ্য নয়। বন্ধু শঙ্খদাস তাকে যথোপযুক্ত শিক্ষাটি দিয়ে গেছে। ক্ষেত্রকরের পুত্র সে, তার ক্ষেত্রকর হওয়াই উচিত। গৃহে যদি স্বর্ণমুদ্রা কটি অক্ষত অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে, তাহলেই সে নিজেকে সৌভাগ্যবান বিবেচনা করবে। যা তার সঞ্চয়ে আছে, একজন ক্ষেত্রকরের কাছে তার মূল্য বিপুল। এই অর্থে সে দুই কূলব্যাপ পরিমাণ ভূমি ক্রয় অনায়াসে করতে পারে। ঐ পরিমাণ ভূমি ক্রয় কম কথা নয়। দুই না হোক, এক কূলব্যাপ ভূমি অবশ্যই ক্রয় করবে সে। সামন্তপতিরা কেউ না কেউ স্বর্ণের বিনিময়ে নিশ্চয়ই ভূমিদান করতে সম্মত হবে। অন্য কেউ না হোক, কুশলদত্ত তো নিশ্চয়ই হবে। কেননা তার অর্থাভাব সর্বক্ষণ থাকে। সুতরাং এখন থেকে বসন্তদাস ক্ষেত্রকরের পুত্র ক্ষেত্রকর। সে চিন্তা করে দেখেছে, এই ব্যবস্থাই উত্তম। দেশে দেশে ভ্রমণ–কিন্তু পরিণামে লাভ বন্ধুর প্রতারণা, দস্যুর আক্রমণ এবং রাজপুরুষদের তাড়না। কি প্রয়োজন ঐ বৃত্তির। ক্ষেত্ৰকৰ্মই তার জন্য উত্তম।
পরদিন প্রত্যুষে সে যাত্রার আয়োজন দেখতে গিয়েছিলো। সেখানেই গৃহগামী বণিকদের সঙ্গে আলাপে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হয়। পান্থশালায় যখন প্রত্যাগমন করছে তখন সূর্যোদয়ের পর দণ্ডাধিককাল অতিক্রান্তপ্রায়। ঐ সময় লক্ষ্য করে মেলার লোকেরা পলায়ন করছে। কি ব্যাপার! সে একজনকে ডাকলো। জানতে চাইলো, কিছু হয়েছে কি?
সর্বনাশ হয়েছে মহাশয়, প্রাণরক্ষা করতে চান তো পলায়ন করুন। বিসূচিকা, বিসূচিকা দেখা দিয়েছে।
বসন্তদাস ক্ষণেক দাঁড়ায়। সে জানে বিসূচিকা মারী রোগ। এবং মেলায় যদি ঐ রোগ দেখা দেয়, তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। সে পলায়নকারীদের ত্রস্ত ভঙ্গি ও মুখভাবে ভয়ানক আতঙ্ক দেখতে পায়। মনে মনে চিন্তা করে, তারও বিলম্ব করা উচিত। নয়।
কিছুদূর অগ্রসর হলে দেখে অক্রূরদাস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। নিকটে এসে বলে, সখা বসন্ত, চললাম, যদি জীবিত থাকি দেখা হবে।
বসন্তদাস কঠিন মুষ্টিতে অক্রূরদাসের হাত ধরে। বলে, কি হয়েছে তোমার, উন্মাদের মতো আচরণ করছো কেন?
সখা, আমার, আমারও যেন বমন ভাব হচ্ছে, শেষে আমিও কি আক্রান্ত হলাম? হে ভগবান রক্ষা করো–আমি ছিলাম তার পার্শ্বের শয্যাটিতে। হায়, হায়, কেন যে পান্থশালায় স্লেচ্ছ যবনদের স্থান দেওয়া হয়।
ঐ কথা শোনার পর বসন্তদাস আর মুহূর্তেকও দাঁড়ায় না। তার অনুমান হয়, অন্য কেউ নয়, যবন বৃদ্ধটিই আক্রান্ত হয়েছেন। গত রাত্রে তিনি অসুস্থতার কথা বলেছিলেন।
পান্থশালায় এসে দেখে একটি লোকও নেই। প্রকোষ্ঠে বৃদ্ধ একাকী শয্যাশায়ী। একবার উঠতে চাইলেন, পারলেন না। চক্ষু দুটি কোটরাগত। সুন্দর গৌর মুখখানিতে পাণ্ডুর ছায়া। একটি দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসছিলো। লক্ষ্য করে দেখলো, বৃদ্ধের নিম্নাঙ্গের শয্যা সিক্ত। শয্যার দুপাশের ভূমিতে বমন চিহ্ন। বোঝা যায়, তাঁর দেহ এখন উত্থানশক্তিরহিত। সে কী করবে বোধগম্য হচ্ছিলো না। একবার ভাবলো, পলায়ন করে। কিন্তু ঐ সময়ই বৃদ্ধ হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন। বসন্তদাসের আর পশ্চাদপসরণ করা হলো না। নিকটে গেলে বৃদ্ধ বললেন, জল দিতে পারো? সে কলস থেকে জল এনে বৃদ্ধের মুখে ধরলো। জলপান করে বৃদ্ধ চক্ষু দুটি মুদিত করে বললেন–তুমি চলে যাও, আমার মৃত্যুর আর বিলম্ব নেই।
মাত্র ঐ কটি কথা উচ্চারণ করেন বৃদ্ধ। কিন্তু বসন্তদাসের মনে হয়, ঐ কথা কটি উচ্চারণ করে যেন জগৎ সংসারকে তার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। কথা কটির মধ্যে দারুণ তাচ্ছিল্যের ভাব। যেন বলতে চাইলেন, তোমরা আমাকে ত্যাগ করলে, আমিও তোমাদের ত্যাগ করলাম। সে ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে, বসন্তদাস তুমি কি পলায়ন করবে? তৎক্ষণাৎ মনে হয়, পলায়ন করাই তার উচিত। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার মনে হয়, বৃদ্ধের শয্যাটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। পুনরপি লক্ষ্য করে, তার পানের জন্য জলও আবশ্যক হবে। পলায়ন তো সে করতেই পারে। পদযুগল সচল করলেই হয়। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী লোকটির মুখে জল কে দেবে? ঐ নষ্ট শয্যাতেই বা তিনি কেমন করে থাকেন। সে বৃদ্ধকে তুলে পার্শ্ববর্তী শয্যায় নিয়ে গেলো। এবং পুনর্বার জিজ্ঞাসা করলো, জল পান করবেন? জল দেবো?
বৃদ্ধের সম্ভবত আর জ্ঞান ছিলো না। আল্লাহ আল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করলেন কয়েকবার, নিজ ভাষায় কিছু যেন বললেন কাউকে। কিছুই বোধগম্য হয় না বসন্তদাসের। সে তখন পান্থশালার বাইরে আসে। মেলার লোক তখনও পলায়ন করছে। পলায়নপর একজনকে ডাকলে লোকটি কর্ণপাত করে না। সে ছুটে লোকটিকে ধরলো। জানতে চাইলো, একজন বৈদ্যের সন্ধান দিতে পারেন? লোকটি আর্তনাদ করতে লাগলো, ভ্রাতঃ আমাকে যেতে দিন–গৃহে আমার স্ত্রী-পুত্র আছে।
মুক্ত হয়ে লোকটি এমন গতিতে ধাবমান হলো যে মুহূর্তেক পরে আর তাকে দেখা গেলো না।
বসন্তদাসকে অবিলম্বে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে একজন বৈদ্য ডেকে আনতে হয়। বৈদ্য এসে দূর থেকে রোগীর অবস্থা দেখে আর অগ্রসর হন না। বলেন, ম্লেচ্ছ যবনদের চিকিৎসা আমি করি না।
বসন্তদাস তখন একপ্রকার মরিয়া। বৃদ্ধের স্কন্ধে হাত রেখে বলে, মহাশয়, আমি আপনার শমন, ঐ ম্লেচ্ছ যবনের সঙ্গে যদি একত্রে যমালয়ে গমনের বাসনা না থাকে, তাহলে রোগীর চিকিৎসা করুন।
বৈদ্যটি অম্বোষ্ট কায়স্থ, সম্ভবত তাঁর কৌলীন্যেরও দাবি আছে–অন্তত উপবীতটি দেখে তাই মনে হয়। উপবীত স্পর্শ করে তিনি বসন্তদাসকে যথেচ্ছ অভিসম্পাত দিলেন। তারপর রোগীকে পরীক্ষা করলেন। শেষে বললেন, এ রোগীর আশা নেই–পারলে প্রস্তর লবণের চূর্ণ মিশ্রিত করে জলপান করাও। অন্য কিছু করণীয় নেই।
বৈদ্যটি প্রস্থান করার সময় হস্ত প্রসারণ করতে ভুললেন না। একটি মুদ্রা হাতে পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে বিদায় হলেন।
বৃদ্ধ পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন। প্রস্তর–লবণ তখন আর কোথায় সন্ধান করবে? পান্থশালার রন্ধনস্থলে কৃষ্ণ–লবণ ছিলো, তাই জলে মিশ্রিত করে বার দুই দেওয়া সম্ভব হলো। তারপরই বৃদ্ধের শেষ নিঃশ্বাসটি নির্গত হয়ে চলে গেলো।
শিয়রে তখন সে উপবিষ্ট। মৃত্যুকে এতো নিকট থেকে পূর্বে সে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। তার অদ্ভুত লাগছিলো। এই লোকটির সঙ্গে গত রাত্রেই না তার আলাপ হয়েছে। এরই দেওয়া পুষ্পসবের সুগন্ধ পাত্রটি এখনও না তার সঙ্গে। অথচ লোকটি জগৎ থেকে বিদায় হয়ে গেলেন। দূরদেশে স্ত্রী–সন্তান পরিবার অপেক্ষায় রয়েছে আর ইনি নির্বান্ধব অবস্থায়, প্রবাসে এক পান্থশালায়, শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করে বসলেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ কেউ জানতেও পারলো না। সে বৃদ্ধের চক্ষু দুটি মুদিত করে দিলো। একখানি হাত শয্যার বাইরে ভূমিস্পর্শ করেছিলো। হাতখানি সে বক্ষোপরি স্থাপন করলো। তারপর বললো, মহাশয় বিদায়, এবার আমি যাই, পরকালে আপনার মঙ্গল হোক।
কুটির ত্যাগ করে সে অগ্রসর হলো। মন ভারাক্রান্ত। অনিত্য মানব জীবনের কথা বারংবার মনে উদিত হচ্ছে। এই জীবনের কি কোনো অর্থ আছে? জীবন যদি এই প্রকার অজ্ঞাতে, অগোচরে, মৃত্যুতে সমর্পিত হয়, তাহলে সংসার কেন? পুত্র কলত্রেরই বা কি। প্রয়োজন?
সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়। মেলায় এখন জনপ্রাণী নেই। সামান্য পথ অতিক্রম করেছে, এমন সময় দেখলো, দুটি শ্মশান শৃগাল অগ্রসর হয়ে আসছে।
শৃগাল দুটি দেখে সে দাঁড়ায়। তার স্পষ্ট অনুমান হয়, বৃদ্ধের দেহ এখন শৃগাল দুটির উপাদেয় ভক্ষ্য হবে।
যবন বৃদ্ধের মৃতদেহের পরিণাম অনুমান করে সে আর পদক্ষেপণ করতে পারলো। সৌম্য সুন্দর মুখখানি, কোমল মমতাময় হাতের অঙ্গুলিগুলি, শ্বেত শুভ্র কেশভার– সমস্তই এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে শৃগাল দুটির দ্রংষ্ট্রাঘাতে। দৃশ্যটি কল্পনায় আসা মাত্র সে ফিরলো।
সে জানে না, যাবনী ধর্মে শেষকৃত্যের বিধান কী। শুনেছিলো যে যবনেরা মৃতের দাহ করে না, সমাধি দেয়। কিন্তু কি মন্ত্র, কোন দেবতাকেই বা আহ্বান করা হয়, কিছুই তার জানা নেই। কিন্তু হতোদ্যম হলো না সে। পান্থশালাতেই পাওয়া গেলো খনিত্র খানি। সে কালবিলম্ব না করে খনন আরম্ভ করে দিলো।
পিঙ্গল পশ্চিমাকাশে তখন বঙ্কিম চন্দ্রটি উদিত হয়েছে, পরিত্যক্ত জনহীন মেলায় একটি ভৌতিক ভাব, দূরে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। সম্ভবত যজ্ঞানুষ্ঠান করে মারী–ভয় দূর করার চেষ্টা করছে পল্লীবাসীরা। দুটি কুকুরের ক্রন্দনধ্বনি শোনা গেলো অদূরে। বসন্তদাসের খনন যখন সমাপ্ত হলো তখন রাত্রি গম্ভীর হয়েছে।
অতিশয় ক্লান্ত সে তখন। দেহ আর চলে না। পান্থশালা থেকে মৃতদেহটি বহন করে আনার সময় দুবার তার পদস্খলন হয়। তথাপি কাজটি করে সে। মৃতদেহটি সমাধিগর্ভে নিক্ষেপ করে দেখে, নিক্ষেপ যথাযথ হয়নি। ঊর্ধ্বাঙ্গ সমাধিগর্ভে গেলেও পদযুগল রয়েছে বাইরে। তখন আবার নামতে হয় সমাধিগর্ভে। দেহটিকে লম্বমান করে শায়িত করতে হয়। ঐ সময় সে আবিষ্কার করে বৃদ্ধের কটিবন্ধটি স্কুল এবং কঠিন, সম্ভবত সেখানে কোনো কঠিন বস্তু গ্রন্থিবদ্ধ। তখন সেটি সে মোচন করে নেয়। শেষে উঠে এসে মৃত্তিকা নিক্ষেপ করে পূর্ণ করে দেয় সমাধিগৰ্ভটি।
প্রক্রিয়াটি যেমন দীর্ঘ তেমনই কষ্টকর। সমাধি পার্শ্বের ভূমিতে সে কিছুক্ষণ লম্বমান হয়, এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে সে। তারপর বিদায়।
কতক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে জানে না। বোধ হয় তখন মধ্যরাত্রি। শীত বোধ হওয়াতে সে উঠলো। এবং তখনই দৃষ্টি পতিত হলো বৃদ্ধের স্কুল কটিবন্ধটির উপর। সেটির গ্রন্থিমোচন করার পর যা দেখলো তাতে তার চক্ষুস্থির।
একেবারেই অবিশ্বাস্য কাণ্ড। স্বর্ণমুদ্রাগুলি সে চেনে কিন্তু ক্ষুদ্র প্রস্তরবৎ বস্তুগুলি কী? একটি হাতে তুললে দেখলো তার মধ্য থেকে আলোক বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এগুলি হীরক? নাকি পদ্মরাগ? নাকি বৈদূর্য? সংখ্যায় সাতটি, কিন্তু কোনোটির পরিচয়ই সে জানে না। তার চিন্তা হলো, এখন সে কী করবে? এই স্বর্ণখণ্ড ও মণিমাণিক্যগুলি কি নিজে নেবে, না সমাধির কাছেই রেখে যাবে?
বিচিত্র এক মানসিক অবস্থা তখন তার। স্বাভাবিক চিন্তা করার অবস্থাটুকুও নেই। না হলে অমন মূল্যবান বস্তু সে সমাধি পার্শ্বে রেখে আসার চিন্তা করে? কি অদ্ভুত কাণ্ড, হঠাৎ সে বিপুল সম্পদের অধিকারী। হীরক মাণিক্যের মূল্য সে জানে না, কিন্তু দশখানি স্বর্ণখণ্ড? এক কূলব্যাপ ভূমির মূল্য তিন দীনার। তার অর্থ চারি কূলব্যাপ ভূমি সে ক্রয় করতে পারবে। কি ভয়াবহ কাণ্ড। হায়, হায়, মানুষ জানলে একেবারে নিশ্চিত মরণ। পিতা হেমন্তদাস জানলে তাকে গৃহ থেকে বিতাড়ন করবেন। যদি তা নাও করেন, ধনরত্নগুলি নিশ্চয়ই আত্রেয়ী জলে নিক্ষেপ করবেন। দস্যু হস্তে প্রাণ কে দিতে চায়?
একবার মনে হলো, সন্ধান করলে যবন বণিকের স্বদেশবাসী কাউকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে–আর তার হাতে স্থলীটি তুলে দিতে পারলেই সে দায়মুক্ত হয়ে যাবে। পরক্ষণেই তার ভিন্ন চিন্তা হয় আবার। যার হাতে সে স্থলীটি দেবে সে যদি যথাস্থানে সেটি না দেয়, তাহলে?
অর্থাৎ এই দশখানি স্বর্ণখণ্ড এবং মণিমাণিক্যগুলি তাকে নিতেই হচ্ছে–অন্য কোনো গত্যন্তর নেই।