নৌকোর ভেতর থেকে ফারুক আস্তে আস্তে বাইরে এসে বসলো। কিছুই ভালো লাগছিল না। তার। বেলে জ্যোছনা ছড়িয়েছে আকাশে। আর সেই আলো–আঁধারে নদীর ওপার হয়ে এসেছে আবছা। মিশে গিয়েছে আকাশের সাথে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বার–দরিয়া দিয়ে নৌকো চলেছে।
এমনি করে আরো ঘণ্টা দুয়েক যেতে হবে। ফারুক একটা সিগারেট ধরিয়ে মাঝিকে শুধালো, কী নাম তোমার?
ইয়াসিন, হুজুর
আচ্ছা ইয়াসিন, এ নদীতে কুমির নেই?
আছে হুজুর। একটু থেমে বলল, কেন আপনার ডর করে নাকি? ডরের কী আছে?
না, না। এমনি বলছিলাম ইয়াসিন।
কিছুক্ষণ শুধু দাঁড় টানার শব্দ। কোথাও বুঝি মাটির ধ্বস ভেঙে পড়ল অনেক দূরে। ইয়াসিনের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কপালের ছায়া এসে পড়েছে চোখের ওপর। চোখের ভ্র প্রায় পেকে গেছে তার। মাথায় শুধু দুএক গাছি অগোছাল সাদা চুল। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বয়সের নিষ্ঠুর ছাপ তার মুখে আর সারা দেহে। কুঁজো হয়ে গেছে পিঠ। দাঁড় টানার। সাথে সাথে বাহুর মাংসপেশী মোটা কাছির মত ফুলে উঠে দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছিল। ইয়াসিন খানিকটা যেন আপন মনেই বলল, আমাদের সায়েবের কিন্তু কুমির শিকারে ভারী নেশা।
কোন সাহেব? আবিদ?
ফারুক একটু উদ্বেগভরা গলায় শুধালো।
ইয়াসিন খানিকটা সলজ্জ হেসে উত্তর করল, গরিব মানুষ, সায়েবের নামে কি দরকার হুজুর?
কেন খুব রাগী বুঝি উনি?
ইয়াসিন হেসে মাথা নাড়ল। বলল, না, তওবা তওবা। এই তো সেদিন তার বোটমাঝির অসুখ বলে আমার নায়ে করে বেরিয়েছিলেন শিকার করতে।
হঠাৎ তাহমিনার কথা জিজ্ঞেস করতে লোভ হলো ফারুকের। শুধালো, তোমাদের মেমসাব যান না?
না, হুজুর। বড় ভর করে নাকি ওনার। সায়েবকে তো উনি কিছুতেই বেরুতে দেন না বন্দুক নিয়ে।
ইয়াসিন বলে চলল তাহমিনার এই ডর করার উপাখ্যান।
একদিন নাকি, কথাটা সে শুনেছে আবিদের বোটমাঝি গফুরের কাছ থেকে, ভোর সকালে উঠেই আবিদ বলেছে শিকারে যাবে। কুমির না, আজ দূর চরে পাখি শিকার করবে সে। তাহমিনাও সাথে যাক এই তার ইচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেতে চায়নি ও। আবিদের একটা কথা একটা অনুরোধও শোনেনি। এরপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে আবিদ, এসে দাঁড়িয়েছে বাংলোর বারান্দায়। সেখানে আবদুল টোটার বেল্ট আর হ্যাঁট হাতে দাঁড়িয়ে। আবিদ বেল্ট আড়াআড়ি মাথার ভেতর দিয়ে গলিয়ে স্ট্যাপ বেঁধে হ্যাঁট তুলে নিয়েছে তারপর কী ভেবে আবার ফিরে গেছে শোবার ঘরে! সেখানে তাহমিনা রাতের বাসি বিছানা ভাঁজ করে রাখছিল। পায়ের শব্দে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিয়েছে ও। আবিদ বলেছে, তাহলে তুমি যাবে না?
এ কথার কোন উত্তর দেয়নি তাহমিনা।
বেশ, যাচ্ছো না বুঝতে পারছি। কিন্তু মুখে সেটা বলতে বাধে নাকি? তুমি কী—-
ইয়াসিন এখানে বলল, গফুরও ভালো করে জানে না কি কথা হয়েছিল। খানিকক্ষণ বাদেই আবিদ গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এসেছে। সেদিন এলোপাথারি শিকার করেছে সে। রেঞ্জের ভেতরে যা কিছু এসেছে স্থির নিশানা করে ট্রিগার টিপেছে। এমনি করে চর থেকে চরে সমস্ত টোটা শেষ করে বোটে এসে ধপ করে বসে বন্দুক ফেলে বলেছে, বোট ছাড়, গফুর।
হুজুর, পাখিগুলো?
আবদুল আর গফুর গুলি খাওয়া সব পাখি এনে পাড়ে জড় করে রেখেছিল। গফুর সেদিকে আঙুল তুলে ভয়ে ভয়ে শুধালো। আবিদ বলেছে, আজ ওগুলো সব তোদের দিলাম। নিজেরা যা পারিস রেখে গায়ে বিলিয়ে দিস আমার নাম করে।
সেদিন আমরা খুব খেয়েছি হুজুর ওনার কৃপায় ইয়াসিন একটু হেসে বলল। এখনো যে কটি দাঁত তার অবশিষ্ট আছে অন্ধকারে তাই চকচক করে উঠল। কিন্তু তারপরেই কেমন বিষণ্ণ হয়ে এলো সে। ভারী গলায় বলল, মেমসাব আমাদের খুব স্নেহ করেন হুজুর। বলতে কী মায়ের ব্যবহার পাই তার কাছ থেকে। কোনদিন দোরে হাত পেতে ফিরিনি। ভাবি. কোনদিন হাসতে দেখি না কেন ওকে! তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, থাক ও সব কথা, আমরা গরিব মানুষ দিন আনি দিন খাই ও আমাদের ভেবে ফায়দা নেই হুজুর।
ফারুক চুপ করে শুনলো। তার হাতের সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল, নতুন আর একটা ধরালো এবার! ভাবলো হয়ত ওর কাছে জিজ্ঞেস করে কিছু খবর পাওয়া যেতে পারে। কী হয়েছে ওদের? পরমুহূর্তেই ভালো, না থাক। এতখানি কৌতূহল দেখানো হয়ত ভালো হবে না। কিন্তু শেষ অবধি না শুধিয়ে পারল না।
আচ্ছা ইয়াসিন, তোমাদের সায়েবের কিছু হছে, জানো তুমি?
কই নাতো। আর জানবোই বা কী করে? দেড় হপ্তা ধরে অসুখে বেহুস হয়ে ছিলাম। গতর খাঁটিয়ে খাই। আজকেই মাত্তর নাও নিয়ে বেরিয়েছি। পয়লা কেরায়া এই আপনি কই শুনিনি তো কিছু।
ও।
কেন, খারাপ কিছু নাকি?
উঁহু না, এমনি। ফারুক কথাটা সহজ করে দেবার জন্য ঘুরিয়ে মিছে বলল, অনেকদিন কোনো খবর পাইনে, তাই।
আল্লা মালেক।
ইয়াসিন নদীর একটা বাঁক পেরুলো। বোধহয় অর্ধেকটা পথ এসে গেছে তারা।
বাইরের বাতাস কেমন ঠান্ডা আর তীব্র। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ফারুক ছইয়ের ভেতর গিয়ে শুয়ে পড়ল। বিছানাটা পেতে নিয়েছিল নৌকোয় উঠেই। এখন আলস্যে গা এলিয়ে দিল। ছইয়ের ফাঁক দিয়ে একটু আকাশ। জ্যোছনাটা ভারী মিষ্টি। অপলক, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়।
ফারুক সেদিকে তাকিয়ে রইল। পিঠের নিচে তরল নদীর স্রোত আর ঢেউ ভাঙার একটানা শব্দ। দূরে আকাশে একজোট কয়েকটা তারা দুলছে।