০২. নেই তো নেই

নেই তো নেই। চা খেতেও এল না। বোগি সে-বিষয় কোনো কথা না বলে বাড়ির চারপাশটা একবার খুঁজে এল। রুমু রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুকে একটু বলতে গিয়েছিল। ঝগড়ু চেঁচিয়ে মেচিয়ে এক কাণ্ড করে বসল। আমি যেতে পারি নেড়িকুত্তো খুঁজতে এই সাত সকালে, যদি তোমরা দুজন কুয়ো থেকে জল তুলে স্নানের ঘরের চৌবাচ্চা ভরে, রান্নাঘরের ট্যাঙ্কি ভরে, চারাগাছে জল দিয়ে–দিদিমাও রান্নাঘর থেকে ডেকে বললেন, আচ্ছা, নেড়িকুত্তো কখনো পোষ মানে শুনেছিস? হাজার চান করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে, কানা-তোলা থালায় করে খেতে দিস, সেই এর বাড়ি ওর বাড়ি আঁস্তাকুড়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে–যা দিকিনি এখন, সকাল বেলাটা হল গিয়ে সংসারের চাকায় তেল দেবার সময়।

রুমু ঘরে ফিরে এল। বোগি কোলের উপর বই নিয়ে বসে আছে।

দাদা, হলদে পালকটা দেখি।

অদ্ভুত পালকটা। অন্য পালকের রোঁয়াগুলো একসঙ্গে সেঁটে মোলায়েম হয়ে থাকে। হলদে পালকটার রোঁয়াগুলো কোঁকড়া, রোদ লেগে ঝকমক করছে, হাওয়ায় ফুরফুর করছে। গোড়াটা সাদা কাচের একটা ফুলের মতো।

রুমুর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। এমনি সময় ওরা হাসিটা শুনতে পেল। ঝগড়ুর ঘরের ওদিক থেকে খিলখিল করে কে হাসছে। বোগি রুমু তখুনি এক দৌড়ে সেইখানে।

ঝগড়ুদের দাওয়ায় একটা ছেঁড়া মাদুরের উপর একটা ছোট্ট কালো ছেলে বসে আছে। এত মোটা যে পেটে ভাঁজ ভাঁজ পড়ে গেছে, মাথায় কয়েকগাছি কোঁকড়া চুল, খালি গা, একগাল হাসি, পাটকিলে রঙের চোখ আর বড়ো বড়ো দুটো কান, মাথা থেকে পাখনার মতো আলগা হয়ে রয়েছে, উপর দিকটা একটু ছুঁচলো।

ঝগড়ুর বউ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটাকে টপ করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, আমার ভাইয়ের ছেলে, এখেনে কয়েক দিন থাকবে। তোমাদের এখন পড়ার সময় না?

রুমু জিজ্ঞেস করল, কখন এল? কাল তো ছিল না। কোত্থেকে এল?

বউ বলল, আজ ভোরে এসেছে দুমকা থেকে। তোমরা যাও, তোমাদের দিদিমা রাগ করবে। চাকর-বাকরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা ভালো নয়।

বোগি দাওয়ার উপর বসে পড়ল। কেন ভালো নয়?

বউ একটু রেগে গেল। দেখ, বোগিদাদা, এখন আমার রাঁধাবাড়ার সময়। অন্য সময় এসো।

ছেলেটাকে দাও, এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।

অ মা! ছেলে নিয়ে তুমি কী করবে?

না দিলে কিছুতেই যাব না।

ঝগড়ুর বউ রেগেমেগে দুম করে ছেলেটাকে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে ঘরে চলে গেল।

বোগিও অমনি তাকে তুলে নিয়ে দে দৌড়।

বারান্দায় তাকে ছেড়ে দিতেই সে হামাগুড়ি দিয়ে সটান ভুলোর থালার কাছে গেল। তারপর খালি থালা দেখে তার রাগ দেখে কে!

রুমু একটু রুটি এনে দিতে তবে থামল। বোগি আস্তে আস্তে ডাকল, ভুলো, ভুলো, ভুলো!

ছেলেটা খিলখিল করে হেসে, হামা দিয়ে কাছে এসে, ভিজে ভিজে জিব দিয়ে বোগিকে চেটে দিল।

রুমু কাঁদতে লাগল। গোলমালের মধ্যে ঝগড়ু এসে ছেলেটাকে বারান্দা থেকে নামিয়ে মোমলতার তলায় ছেড়ে দিল।

তোমরা এইখেনে খেলা করো দিদি। বারান্দার উপরে দিদিমা দেখলে রাগ করবে।

ঝুরঝুর করে মোমলতার ফুল ঝরে পড়ছে, তাই দেখে ছেলেটা আহ্লাদে আটখানা। মুঠো মুঠো তুলে মুখে পুরতে চায়! শিশু গাছে দলে দলে বুনো হাঁস এসে বসেছে, দেখে মনে হয় বুঝি বড়ো বড়ো সাদা ফুলে গাছ ভরে গেছে। তাই দেখে খিলখিল করে ছেলেটা হেসে ওঠে।

অমনি যেন নিশানা পেয়ে হাঁসের ঝাঁক একসঙ্গে আকাশে উড়ে পড়ে। আকাশের দিকে দুই হাত তুলে ছেলেটা কাঁদতে থাকে।

রুমু বলল, দাদা, আগেই তো ভালো ছিল।

বোগি ছেলেটাকে খুব আস্তে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলে, কেন খেইছিলি হলদে পাখি? কে বলেছিল খেতে?

ছেলেটার কান্না থেমে যায়, এই বড়ো বড়ো ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে।

রুমু হঠাৎ উঠে পড়ে, ওকে বুকে জাপটে ধরে একেবারে ঝগড়ুর ঘরে বউয়ের কাছে দিয়ে আসে।

বউয়ের হাঁড়িতে টগবগ করে ভাত ফুটছে, বুদবুদ উঠছে, ফেটে যাচ্ছে, ফুটন্ত জল ছিটুচ্ছে, বউ ভারি খুশি!

কী, এরই মধ্যে শখ মিটে গেল? আগেই জানি।

ওখানে আর দাঁড়ানো নয়। ঘরে এসে দেখে বোগি পালকটাকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেছে। বোগি বলল, ধেত। নেড়িকুকুর পুষতে হয় না। ওদের জাত খারাপ, পোষ মানে না, যা-তা খায়। তার চেয়ে বিলিতি কুকুর ঢের ভালো। সেজো মামা একটা দেবে, চাইলেই দেবে। তার জন্য নতুন লাল কলার কিনব। এটাকে ফেলে দে।

রুমু অমনি জানলা গলিয়ে কলারটা বাইরে ফেলে দিল। নেড়িকুত্তোর কলার আবার কে পরবে?

বোগি উঠে দাঁড়াল।

দেখ রুমু, তারপর যদি কখনো ভুলোটা ফিরে আসে, খবরদার ঢুকতে দিবিনা কিন্তু। ঠেলে বের করে দিবি।

দাদা, ভুলোকে ঠেলে দিলে যে আবার দৌড়ে দৌড়ে ফিরে আসে! মনে হয় ঠেলে দিলে খুশি হয়।

তা হলে বেঁটে লাঠি দিয়ে মেরে তাড়াবি।

ওকে মারলে ও নিশ্চয় আমাকে কামড়ে দেবে। কক্ষনো যাবে না।

দেখ, কলারটা বরং আবার তুলে নিয়ে আয়। ছেলেটার গলায়ও মন্দ দেখাবে না। ও কী, এ-সময়ে শুয়ে পড়লি যে? সর, আমিও সোব, আমার শরীর খারাপ লাগছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *