নরহরি চৌধুরী কোম্পানির দপ্তরে নানা ধরনের নথিপত্রের দেখাশুনা করতেন। মাইনে পেতেন অতি সামান্য। বোধহয় সাত বা আট টাকা। দুঃখে কষ্টে কোনোমতে সংসার চলে। হঠাৎ বুড়ো সাহেব বদলী হয়ে বিলেত চলে গেলেন, এলেন এক ছোঁকরা সাহেব। দু চার মাস যেতে না যেতেই সাহেব কাজকর্ম দেখা প্রায় ছেড়ে দিলেন। নরহরির উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে সাহেব জানবাজারের এক বড়লোক বাঙালিবাবুর সঙ্গে রোজ বাইজিদের নাচ দেখতে শুরু করলেন। খুব জরুরী কাজকর্ম থাকলেও নরহরি নথিপত্র নিয়ে বাইজি বাড়ি হাজির হয়ে সাহেবের শরণাপন্ন হতো। খুব বেশি। মদ না খেলে সাহেব নথিপত্র সই করে নরহরিকে বিদায় করতেন কিন্তু মদ্যপান একটু বেশি হলে। বা বাঈজির নাচ বেশি জমে উঠলেই মুশকিল হতো। সাহেবনথিপত্রে সই তো দিতেনই না, উপরন্তু নরহরিকেও আটকে রাখতেন।
নরহরি মদ্যপান করতেন কিনা বা বাইজিদের সঙ্গে তার কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিনা, তা কেউ জানে না। তবে একথা সবাই জানে জাল নথিপত্রে সাহেবের দস্তখত করিয়ে নেবার ফলেই দীনদুঃখী নরহরি আহিরীটোলার বিরাট সম্পত্তির মালিক হয়। আস্তে আস্তে আরো অনেক কিছু হলো। আহিরীটোলার সম্পত্তি ছাড়াও নিমতলা আর কালীঘাটের অনেক বাড়ি ও জমিজমা হলো। হুগলির গ্রামের বাড়ি পাকা করার সময় হলো না নরহরির, কিন্তু সে অপূর্ণ কাজ পূর্ণ করলেন তার ছেলে শ্রীহরি চৌধুরী।
দেবব্রত হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আগে আমাদের দেশের কোনো বড়লোকই বোধহয় জোচ্চুরি না করে বড়লোক হননি।
এখনও কি জোচ্চুরি না করে আমাদের দেশে বড়লোক হওয়া যায়? এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে বললাম, আগে শুধু জমির মালিকানা এদিক-ওদিক করে বড়লোক হতো, এখন ব্যবসা বাণিজ্য সম্পত্তি সব কিছু নিয়েই জোচ্চুরি করে বড়লোক হচ্ছে।
তবে মাই ফোর ফাদার নরহরি ওয়াজ এ গ্রেট স্কাউনড্রেল!
চৌধুরীবাড়ির দীর্ঘ ইতিহাস দেবব্রত জানে না। তবে শুনেছে অনাচার ব্যভিচারের জন্য আস্তে আস্তে চৌধুরীবাড়ির গৌরব ম্লান হতে শুরু করল। বৃন্দাবন চৌধুরী নিজে বিশেষ লেখাপড়া না জানলেও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। শোনা যায় স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের জন্য উনি নিমতলার একটা বাড়ি আর নগদ পাঁচ শ টাকা বিদ্যাসাগর মশাইকে দিয়েছিলেন। বহু আত্মীয়স্বজনের পরামর্শ উপেক্ষা করে উনি তার বড় ছেলে জনার্দনকে ডাক্তারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠালেন। সাত-আট বছর পর আহিরীটোলার বাড়িতে যেদিন বিলেত থেকে খবর এলো জনার্দন পাস করেছে, সেদিন বৃন্দাবন চৌধুরী বেঁচে নেই। স্ত্রী বহু আগেই গত হয়েছিলেন। আহিরীটোলার বাড়িতে তখন জনার্দনের ছোট ভাই গদাধর কিছু দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের নিয়ে থাকেন আর কলেজে এফ-এ পড়ছেন।
ডাক্তারি পাস করার পরও জনার্দন বিলেতে থেকে গেলেন। লেখাপড়া করার জন্য উনি ছোট ভাইকেও বিলেত যেতে বললেন কিন্তু আত্মীয়দের অনুরোধে ও কিছু বন্ধু বান্ধবের চাপে গদাধর কলকাতাতেই থেকে গেলেন। বিশেষ করে হেমন্ত মামা কিছুতেই যেতে দিলেন না। হেমন্ত সরকার আপন মামা না হলেও বৃন্দাবন চৌধুরীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। বৃন্দাবনবাবুর মৃত্যুর পর ইনিই সম্পত্তির দেখাশুনা করতেন। সুতরাং তার পরামর্শ উপেক্ষা করা গদাধরের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আরো একটা বিশেষ কারণ ছিল। বাবা-মা নেই, দাদা বিলেতে। কিছু নেই নেই করেও আহিরীটোলা-নিমতলার সাতখানা বাড়ি ছাড়াও সামান্য কিছু শেয়ার আর বেশ কিছু সোনাদানার মালিক। কিছু রসিক বন্ধুবান্ধব গদাধরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করেছিল। এমন সময় হেমন্ত মামা তার এক দূর সম্পর্কের শালীর সঙ্গে গদাধরের বিয়ের প্রস্তাব আনলেন। ক্ষিদের মুখে হাতের কাছে পাকা আমটি পেয়ে গদাধর মামার প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে পারলেন না।
এই গদাধর চৌধুরীই আমার দাদু।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তারপর?
বছর দুই পরে বড় দাদু দেশে ফিরলেন। ঠিক করেছিলেন কলকাতায় প্র্যাকটিশ করবেন, কিন্তু জাহাজে আসার সময় সব প্ল্যান উল্টে গেল।
কেন?
দেবব্রত হাসল। ঐ জাহাজেই কাপুরতলার মহারাজাও দলবল নিয়ে বিলেত থেকে দেশে ফিরছিলেন। মহারাজার এক প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে বড়দাদুর আলাপ হয়। মহারাজার কাছ থেকে ছুটি পেলেই উনি বড় দাদুর সঙ্গে গল্প করতেন। কখনও কেবিনে, কখনও আপার ডেকে। কখনও আবার বার-এ। রাজাদের রাজপ্রাসাদের গল্প শুনতে বড় দাদুর ভারি মজা লাগত।…
.
মহারাজার পার্সোন্যাল পার্টির জন্য ছটা ফার্স্ট ক্লাস কেবিন ছিল। মহারাজা নিজে একটা স্পেশ্যাল ডিলক্স কেবিনে ছিলেন। এছাড়া কয়েকজন সাধারণ কর্মচারী সেকেন্ড ক্লাস কেবিনে ছিলেন। ডাঃ জনার্দন চৌধুরী দেখেশুনে অবাক। মহারাজা কি ফ্যামিলি নিয়ে ট্রাভেল করছে?
প্রাইভেট সেক্রেটারি হাসলেন, ফ্যামিলি নিয়ে মহারাজা বিলেত যাবেন? ফ্যামিলি নিয়ে গেলে কি আনন্দ হয়?
দেন হু আর ট্রাভেলিং উইথ হিম? এতগুলো কেবিনে কারা যাচ্ছেন?
ডিল্যুক্স কেবিনে হিজ হাইনেস। চারটি ফার্স্টক্লাস কেবিনে মহারাজার চারজন গার্ল ফ্রেন্ড, ফিফথ কেবিনে আমি আর অন্যটিতে হিজ হাইনেসের একজন এ-ডি-সি।
চারজন গার্ল ফ্রেন্ড?
প্রাইভেট সেক্রেটারি সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, হিজ হাইনেস হ্যাঁজ গট ফোর হানড্রেড গার্ল ফ্রেন্ড।
মাই গড!
মহারাজাস আর লাইক দ্যাট।
সত্যি? সত্যি।
ডাঃ চৌধুরী স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে ভাবেন। একটু পরে জিজ্ঞাসা করলেন, সেকেন্ড ক্লাস কেবিনে কারা আছেন?
গার্ল ফ্রেন্ডদের দুজন লেডি অ্যাটেনডান্ট, হিজ হাইনেসের চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট, আমার একজন অ্যাটেনডান্ট আর একজন ট্রেজারী অফিসার।
এই জাহাজেও চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট চাই মুহারাজার?
দিস ইজ দি লিস্ট রিকয়ারমেন্ট। হিজ হাইনেস যখন প্যালেসে থাকেন তখন প্রত্যেক সিফট এ পঞ্চাশ জন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট ডিউটি দেয়।
মন্থর গতিতে জাহাজ চলে। এক পরিবেশ, এক দৃশ্য দেখে দেখে যাত্রীর দল ক্লান্ত হলেও ডাঃ জনার্দন চৌধুরীর দিনগুলো বেশ কেটে যায়। এই চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্টের কি কাজ?
একজন হিজ হাইনেসকে ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ফুড সার্ভ করছে, একজন টয়লেট অ্যান্ড বাথ-এ হেলপ করে, একজন হিজ হাইনেসকে জামাকাপড় পরিয়ে দেয় আর একজন নাইট ডিউটি দেয়।
টয়লেট আর বাথ-এ কি হেলপ করতে হয়?
হিজ হাইনেস কি নিজে নিজে স্নান করবেন?
মহারাজাকে স্নান করিয়ে দিতে হয়?
অব কোর্স।
জাহাজ ফ্রেঞ্চ কোস্ট ছাড়ার পরই মহারাজার এক গার্ল ফ্রেন্ডের খুব সিরিয়াস সী সিকনেস হলো। এ-ডি-সির কাছে খবর পেয়েই হিজ হাইনেস অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে ওর পার্সোন্যাল ফিজিসিয়ানকে খবর দিতে বললেন। এ-ডি-সি মুহূর্তের জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জানালেন, ইওর হাইনেস, আপনার পার্সোন্যাল ডাক্তার তো আমাদের পার্টিতে নেই।
ব্যস! হিজ হাইনেস রেগে লাল। তলব করলেন প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। প্রাইভেট সেক্রেটারি কেবিনে ঢুকতেই রাগে ফেটে পড়লেন, ডু ইউ থিংক আই অ্যাম এ বেগার? আমি আমার একজন ডাক্তারকে নিয়ে বিলেত যেতে পারি না? জানেন, আমি পুরো একটা জাহাজ ভাড়া করে সারা পৃথিবী চক্কর দিতে পারি? আজ যদি আমার অসুখ হতো, তাহলে? তাহলে কি হতো? কে দেখত? আমি মরে গেলে কে রাজত্ব সামলাবে? এক নিঃশ্বাসে হাজারটা প্রশ্ন করার শেষে বললেন, আপনার মতো প্রাইভেট সেক্রেটারির আমার দরকার নেই। হ্যাঁ, জাহাজের ডাক্তার দিয়ে যেন আমার গার্ল ফ্রেন্ডদের চিকিৎসা না করা হয়।
প্রাইভেট সেক্রেটারি অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে নিবেদন করলেন, ইওর হাইনেস! আমি আপনার অনুমতি না নিয়েই বিলেত থেকে একজন অত্যন্ত ভালো ডাক্তারকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি।
মহারাজা লাফিয়ে উঠে বললেন, রিয়েলি?
ইয়েস ইওর হাইনেস!
কোথায় সেই ডাক্তার?
এক্ষুনি ডেকে আনছি ইওর হাইনেস।
একটু পরেই প্রাইভেট সেক্রেটারি ডাঃ জনার্দন চৌধুরীকে এনে মহারাজার সামনে হাজির করলেন, ইওর হাইনেস, ইনিই আপনার নতুন পার্সোন্যাল ফিজিসিয়ান।
.
চৌধুরীবাড়ির গল্প শুনতে শুনতে হাসি পায়। প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হলেও জানি এমন হতো। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বহু রাজপ্রাসাদে গেছি, থেকেছি। নানাজনের সঙ্গে মিশেছি, শুনেছি অসংখ্য কাহিনি। এর চাইতেও অনেক অনেক অবিশ্বাস্য কাহিনি।
গল্প করতে করতে হুইস্কির গেলাস খালি হয়। আমি আবার ভরে নিই, দিই। দুজনেই চুমুক দিই। ও একটু ভাবে। আনমনে একবার জানলা দিয়ে লন্ডনের ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকায়।
বড় দাদুর আর কলকাতায় ফেরা হলো না। বোষে থেকে সোজা চলে গেলেন কাপুরতলা। তারপর সিমলা।
সিমলায় কেন?
মহারাজা বছরের চার-পাঁচ মাস সিমলায় কাটাতেন বলে বড় দাদু ওখানেই থাকতেন। সিমলার কাপুরতলা হাউসে গেলে এখনও বড় দাদুর সঙ্গে অনেক বড় বড় লোকের ছবি দেখতে পাবেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমি দাদার সঙ্গে অনেকবার সিমলা গেছি আর প্রত্যেকবার কাপুরতলা হাউসে গিয়ে বড় দাদুর ছবিগুলো দেখেছি।
.
শুধু কতকগুলো ফটো নয়, আরো কিছু আছে। এখনও অনেক বৃদ্ধের মুখে ডাঃ জনার্দন চৌধুরীর কথা শোনা যাবে, জানা যাবে অনেক মজার ঘটনা। নতুন বিলেত ফেরত ডাক্তার বলে মহারাজা ওঁকে বেশি পছন্দ করতেন। বিশ্বাসও করতেন অনেক বেশি। সেজন্য মহারানী বা মহারাজার প্রমোদ সঙ্গিনীদের কোনো কিছু হলেই ডাঃ চৌধুরীর তলব হতো। রাজপ্রাসাদের অন্য দুজন পুরনো ডাক্তার। এজন্য অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং ডাঃ চৌধুরীর কুৎসা প্রচার করতে শুরু করলেন। মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারিই ছিলেন ডাঃ চৌধুরীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও একমাত্র ব্যক্তিগত বন্ধু। মহারাজাও ওঁকে ভালোবাসেন। সুতরাং হিজ হাইনেসের কানে সেই কুৎসার কাহিনি পৌঁছে দেওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু তবু একদিন সত্যি সত্যি পৌঁছল। কোর্ট মিনিস্টার দেওয়ান গুরুবচন সিং মহারাজাকে বললেন, ইওর হাইনেস, ডাঃ চৌধুরী সম্পর্কে অনেক কথা শুনছি। অবশ্য ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না হলেও অনেকের কাছে শুনছি বলেই আপনাকে জানান কর্তব্য মনে করলাম।
ডাক্তার ড্রিঙ্ক করা শুরু করেছে নাকি?
না ইওর হাইনেস, উনি ড্রিঙ্ক করেন না ঠিকই কিন্তু শুনছি…
কি শুনছেন?
শুনছি চিকিৎসা করার সুযোগ নিয়ে ডাঃ চৌধুরী আপনার কয়েকজন বান্ধবীদের সঙ্গে…
কি? ইজ হি এনজয়িং দেয়ার কোম্পানি?
তাইতো শুনছি ইওর হাইনেস।
মহারাজা গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কিছু শুনেছেন?
শুনছি তো আরো অনেক কিছু কিন্তু ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
আরো কি শুনছেন?
ইওর হাইনেস, সেসব কথা আপনার না শোনাই ভালো।
মহারাজার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না কোর্ট মিনিস্টার। শেষ পর্যন্ত বললেন, শুনছি দু-একজন মহারানীদের সঙ্গেও ডাঃ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা নাকি অনেক দূর গড়িয়েছে।
মহারাজা হাসতে হাসতে শুধু বললেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং।
ঠিক পরের দিনই মহারাজা অর্ডার দিলেন, মহারানী ও বান্ধবীদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ডাঃ চৌধুরীর। শুধু তাই নয়। কারুর একটু সামান্য মাথা ব্যথা করলেই মহারাজ ডাঃ চৌধুরীকে ডেকে বলতেন, ডক্টর, রাতে পেসেন্টের কাছে থাকবেন।
ডাঃ চৌধুরী হাসতে হাসতে বলতেন, ইওর হাইনেস, সেরকম কিছু হলে আমি নিশ্চয়ই থাকব কিন্তু দিস ইজ নাথিং।
তা হোক। আপনি থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকব; নয়তো চিন্তায় সারা রাত ঘুমুতে পারব না।
কোনো মহারানী বা মহারাজার প্রিয় বান্ধবীর কিছু হলেই তার পাশের ঘরে ডাঃ চৌধুরীর থাকার ব্যবস্থা হতো। দুটো ঘরের মাঝখানে দরজা। যখন ইচ্ছা পেসেন্টকে দেখাশুনা করা যাবে। ডাঃ চৌধুরীর ঘরে ওষুধপত্র ইনজেকশন থাকত। হসপিটালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে টেলিফোন। ডাঃ চৌধুরী মনে মনে হাসেন, অস্বস্তি বোধ করেন, কিন্তু অসহায়। প্রাইভেট সেক্রেটারি সাহেবকে সব কথা জানালেন।উনি সুযোগ মতোমহারাজার কাছেও কথাটা তুললেন কিন্তু মহারাজা বললেন, নো নো নো।
তিন মাস কেটে গেল।
সেদিন রাত্রে মহারাজার ডিনার। কয়েকজন নিমন্ত্রিত। কোর্ট মিনিস্টার, প্রাইভেট সেক্রেটারি, তিনজন ডাক্তার, দুজন এ-ডি-সি, চীফ প্যালেস গার্ড কর্নেল হরকিষণ সিং আর সমস্ত মহারানী ও বান্ধবীরা। ডিনারের আগে ড্রিঙ্কস এলো কিন্তু মহারাজা কাউকে বেশি ড্রিঙ্ক করতে দিলেন না। বললেন, ডিনারের পরে গল্প করবেন। ডিনার শেষ হলো। তারপর মহারাজা একটা বিরাট ডায়মন্ডের আংটি আর একটা সোনার ঘড়ি ডাঃ চৌধুরীকে উপহার দিতেই সবাই চমকে উঠলেন। হিজ হাইনেস অনেককেই অনেক কিছু উপহার দেন কিন্তু এমন সুন্দর ও দামি উপহার বিশেষ কেউ পান না। মহারাজা হাসতে হাসতে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, শুনেছিলাম ডাঃ চৌধুরীর চরিত্র নাকি ভালো নয়, সেজন্য মহারানী ও বান্ধবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার জন্য ডাঃ চৌধুরীকে অনেক সুযোগ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল হরকিষণকে অর্ডার দিলাম মহারানী ও বান্ধবীদের ঘরের স্কাই লাইটের পাশে ক্যামেরা নিয়ে একজন প্যালেস গার্ড বসে থাকবে।
মহারাজের কথা শুনে সবাই হতবাক। মহারাজা থামলেন না, কর্নেলকে বলেছিলাম ডাঃ চৌধুরীর দুর্বল মুহূর্তের একটা ছবি নিতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেব। কিন্তু পুরস্কারের টাকা আমি কাউকে দিতে পারলাম না বলে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।
এরপর শুরু হলো ড্রিঙ্কস, আনন্দ হুল্লোড়। মহারাজা একটা স্কচের গেলাস নিয়ে ডাঃ চৌধুরীকে বললেন, আজ একটু টেস্ট করবে নাকি?
.
দেবব্রত আমার হাতটা চেপে ধরে বললো, জানেন, বড়দাদু কি বলেছিলেন?
কি?
বলেছিলেন ইওর হাইনেস, আপনার হুকুম অমান্য করতে পারি, কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই।
আমি কৌতূহল চাপতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, মহারাজা কি বললেন?
না, মহারাজ অনুরোধ করেননি। কোনোদিন করেননি।
কর্নেল হরকিষণ সিং এখনও জীবিত। সোলনে থাকেন। অনেক বয়স হয়েছে। চুল দাড়ি সাদা ধবধবে। তার কাছে গেলে এখনও ডাঃ চৌধুরীর অনেক গল্প শোনা যায়। কাপুরতলা বা সিমলার আরো অনেকের কাছে শোনা যায়, জানা যায়।
বড় দাদুর খুব ইচ্ছা ছিল কলকাতায় থাকার, কিন্তু পারেননি। কাপুরতলার মহারাজকে ছেড়ে আসতে পারেননি। তাছাড়া এত লোকের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব, হৃদ্যতা হয়েছিল যে তাদের সবাইকে ছেড়ে আসাও অসম্ভব ছিল।
আমি বললাম, তা তো বটেই।
দেবব্রত বললো, বড় দাদুর জন্য আমার দাদুও প্রায় কাপুরতলা বা সিমলা আসতেন। তারপর আস্তে আস্তে উনিও একদিন সিমলার বাসিন্দা হয়ে গেলেন।