০২. নবিতুনের এবার চলবে কেমন করে

কিন্তু, নবিতুনের এবার চলবে কেমন করে?

 তিন তিনটে ধানভানা আর ডাল ভাঙার কল বসেছে বাজারে। চৌধুরীরা, মুনশিরা, পালরা, সবাই ধান ভানছে কলে। আজ এক মাস ধরে বাড়ি বাড়ি ঘুরেছে নবিতুন। বারা বান্দনীর প্রয়োজন নেই কোনো বাড়িতে। গত দুটো বছর এসব বাড়ির ধান ভেনেই দিন গুজরান হয়েছে নবিতুনের। কিন্তু এখন? চোখে অন্ধকার দেখে নবিতুন।

তিন মাস, ছয় মাস বাদ টাকা আসত সারেংয়ের। মায়ে-ঝিয়ে এক রকম ফেলে ছড়িয়েই দিন কাটত ওদের। যাবার সময় থোক টাকা দিয়ে গেছিল কদম। বলেছিল, গিয়েই যে জাহাজ পাচ্ছি তার কোনো ভরসা নেই। আগের মতো গেলেই লুফে নিত তেমন অবস্থা নেই আজকাল। হিন্দুস্তানের অনেক লোক নেমেছে জাহাজের কাজে। তাই এ টাকা দিয়ে ছটা মাস কাটিয়ে দিবি। ছমাসের ভেতর টাকা পাবিই।

ছমাস কেটে বছরটাও পেরিয়ে গেল। তবু মাথা ঘামায়নি নবিতুন।

ভেবেছে হয়তো কাম পেতে দেরি হচ্ছে কদমের। ছমাসের টাকা দিয়েই টেনে টুনে বছরটাকে চালিয়ে দিয়েছে নবিতুন। কিন্তু বছর ঘুরেও যখন টাকা এলো না, চিঠি এলো না, তখন সত্যি ভাবনায় পড়ে নবিতুন। এক সারেংয়ের ভাবনা। দোসরা নিজের এবং আককির খাওয়া-লওয়ার ভাবনা। নানা ফিকির খুঁজে নিতে হয়েছে নবিতুনকে। মুরগি পালা, হাঁস পালা, চাটাই বোনা, কোরা বানানো, ডুলা বানানো আর মণকরা চুক্তি করে বারা বান্দা। এর মাঝে শেষের কাজটাই ছিল নবিতুনের বড় নির্ভর। সারা বছরই থাকত কাজটা। অন্যগুলো মাঝে মাঝের ফরমাইশি কাম। কেউ বাঁশ আর বেত দিয়ে গেল, দাও একটা কোরা বানিয়ে। কেউ দিয়ে গেল বেত আর পাটি পাতা, দাও একটা চাটাই বানিয়ে। ধীরেসুস্থে অবসর মতো করে দিত নবিতুন। তাতে আর কপয়সা রোজগার!

পাল বাড়িতে আর একবার ধর্ণা দিল নবিতুন। বলল, কলের মতন সাফ করেই চাল কাঁড়ব গো। মেহনতের জন্য যা দিতে সেটা না হয় কমিয়েই দাও। তবু মণখানিক ধান দাও, আমি আস্তে-আস্তে ভানি।

পাল বৌর বোধহয় দয়ার শরীর! বলে, এখন তো মটকা ভর্তি চাল, এখন চাল করে রাখবই-বা কই। তা তুমি যখন এত করে বলছ, এসো সামনের মাসে। তখন দেখা যাবে।

.

তখন না হয় দেখবে পাল বৌ, কিন্তু এখন? এক সের চাল যে কোথাও ধার উধার মিলবে তারও উপায় নেই। বড় হিস্যার বড় গুমান। একদিন উধার দিবে তো তিন দিন খোটা দিবে। তবু শরবতি কতদিন আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে একখোরা খুঁদ, আধখোরা চাল দিয়ে গেছে। এখনো দিয়ে যায়। বড় খারাপ লাগে নবিতুনের। তিরস্কার করেছে শরবতিকে, কেন চুরি করিস আমার জন্যে।

তুমি যে আমার বুয়া। হাসতে হাসতে বলেছে শরবতি।

নবিতুন হাসতে পারেনি। কি এক অন্যায় বোধ খচ খচ করে বিঁধেছে ওর বুকটায়।

পালদের বাড়ি থেকে ফিরতে চৌধুরীদের পাড়ভাঙা পুকুর। নবিতুন দেখল বেশুমার ফুল ফুটিয়ে শাপলায় ভরে রয়েছে পুকুরটা। গো–গোল আর সাদা-সাদা ফুলে ঢাকা পড়েছে পুকুরের কালো পানি।

শাড়ি বাঁচিয়ে যতটুকু নামা যায় ততটুকু পানিতে নামল নবিতুন। টেনে টেনে তুলল শাপলা। দুহাতের দুটো মুঠি ভরিয়ে উঠে এলো। একখানি কচি শাপলা কচর কচর করে চিবিয়ে তৃপ্তিভরে খেল ও। সারা দিন দানাপানি কিছু পড়েনি পেটে।

সকালবেলা হাঁড়ি মালসা ঝেড়ে-ঝুড়ে মুঠ দেড়েক তুষ ভরা খুদ খুঁজে পেয়েছিল নবিতুন। সেই খুদ দিয়ে জাউ রেঁধেছিল। জাউটা আককিই খেয়েছে।

তুমি একটু খাও না মা। খেতে বসে বলেছিল এবং জিদ ধরেছিল আককি।

না, তুই খা। দুপুরে ভাত রাঁধব। তখন একসাথে খাব আমরা। কিন্তু, নয় বছরের মেয়েটি সবই যেন বোঝে। মায়ের মিথ্যেটাও বুঝি বুঝে নিয়েছিল ও। হয়তো তাই সারা দুপুর মায়ের কাছ ঘেঁষেনি। শরবতির বোনঝিটার সাথে খেলা করেছে। বেলা জোহরের দিকে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাল বাড়ি রওনা হবার আগে ওর ঘুমন্ত মুখখানির দিকে একবার তাকিয়েছিল নবিতুন। কেমন শুকিয়ে গেছে মুখখানি। আধ-পেটা খেয়ে খেয়ে বড় কাহিল ওর শরীর। নবিতুনের মনে হয়েছিল এই এক বেলাতে যেন আরো কাহিল হয়েছে আককি। আহা তা হবে না, কোনোদিন তো আর একেবারে না খেয়ে থাকেনি মেয়েটি?

নবিতুন নিজেই-বা কোন দিন না খেয়ে ছিল! বাপের ঘরেও না, খসমের সংসারেও না। কিন্তু এ কটা বছরের একটানা মসিবতে আগের সেই পেট ভরে ভাত খাওয়ার দিনগুলোকেই যেন সত্য বলে মনে হয় না নবিতুনের। বাড়িতে পা রেখেই নবিতুনের সারা গায়ে যেন কাঁটা ফুটে গেল। বড় হিস্যার দাওয়ায় বসে হুঁকো টানছে লুন্দর শেখ। পড়বি তো পড় একেবারে তার সামনেই পড়ে গেল নবিতুন।

একনজরে ওর দিকে চেয়ে থাকে লুন্দর শেখ। নজর তো নয় যেন এক জোড়া লালাঝরা জিহ্বা। সে জিহ্বা দিয়ে নবিতুনের সারা গাটা যেন চেটে গেল লুন্দর শেখ। ত্ৰস্তে উঠোনটা পেরিয়ে ঘরে এসে খিল দিল নবিতুন। এখনো ঘুমোচ্ছে আককি। আককিকে বুকে টেনে জড়সড় হয়ে শুয়ে রইল নবিতুন। শুয়ে রইল যতক্ষণ না লুন্দর শেখ বড় হিস্যার দাওয়া ছেড়ে চলে গেল।

তারপর চুলো ধরিয়ে একটু নূন মেখে শাপলাগুলো সেদ্ধ করে নিল নবিতুন। কোরবানের বৌর কাছ থেকে চেয়ে আনল দুটো শুকনো মরিচ। মরিচ দুটো পুড়িয়ে গুঁড়ো করল। গুঁড়োগুলো মেখে নিল শাপলার সাথে। মায়ে-ঝিয়ে ভাগ করে খেল।

সন্ধ্যা হয়ে এলো।

নবিতুনের হাঁস-মুরগির পালটাও দিনে-দিনে ছোট হয়ে এসেছে। এখন শুধু এক জোড়া হাঁস আর এক জোড়া মুরগি। এগুলো এখনো বিক্রি করেনি নবিতুন। উপোস দিয়েও ওদের ধরে রেখেছে।

দরজা বন্ধ দেখে দাওয়ায় উঠে এতক্ষণ ডাকাডাকি করছিল হাঁসগুলো। ওদের ঠিক জায়গাটিতে রেখে দরজাটা ভেতর থেকে ভালোভাবে এঁটে দেয় নবিতুন। তারপর এসে বসে আধো অন্ধকার দাওয়ায়।

ও নবিতুন, কই তুই?

গুঁজাবুড়ির গলাটা যেন এই ভর সন্ধ্যায় অলক্ষ্মী প্যাঁচার ডাক। শিউরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে নবিতুনের গায়ের লোম।

এই অন্ধকারে বসে আছিস? ও, কেরাসি নাই বুঝি? যেন বড় দরদ মাখা স্বর গুঁজাবুড়ির।

তা কেরাসি নেই বলতে হয়। গলার স্বরে আবারও অন্তরঙ্গতা ছড়ায় গুঁজাবুড়ি। তারপর লাঠিটা পাশে শুইয়ে রেখে বসে পড়ে নবিতুনের গা ঘেঁষে।

কি না মনে-মনে ঠিক করছিল নবিতুন? কচুবাটা পুরে দেবে গুঁজাবুড়ির গায়ে, ঠুসিয়ে উড়িয়ে দেবে তার থুতনিটা? কিভাবে কি করা যায় তাই মনে-মনে আর একবারটি ভেবে নেয় নবিতুন।

শুনলাম দুপুরে নাকি পাক চড়েনি তোর। শুনে অবধি পেরেসান আর বেচাইন মনটা– আহারে বাছারা আমার কত কষ্টই না হচ্ছে ওদের। অন্ধকারে দেখা গেল না কিন্তু স্বরের কম্পনে বুঝিয়ে দেয় গুঁজাবুড়ি, নবিতুনের দুঃখে ছলছল ওর চোখ!

আহা তুই কি আমার পর? না পর ওই সোনামানিক আককি? আহা তোর মা শরফিন– সগির মা বুয়া বলতে ছিল অজ্ঞান। আর কদম? সে তো আমার সাক্ষাৎ তালতো বইনের পোলা। আক্ষেপ গুঁজাবুড়ির, নবিতুন স্বীকার করে না ঘনিষ্ঠ এই আত্মীয়তার সম্পর্ক।

না, থুতনি ভাঙবে না, কচু বাটারও দরকার নেই। এখনি এই অন্ধকারে কুটনী বুড়ির গলাটা টিপে ধরলে কেমন হয়? নবিতুন ভাবে।

নে, বাছা ধর। সের আড়াই চাল, যা ছিল ঘরে তাই নিয়ে এসেছি। সঙ্গে দুটো আণ্ডা, কয়েকটা মরিচ, পেঁয়াজ, একটু মিডা। আর এই বোতলটায় একটু কালা তেল নে রাখ। জিনিসগুলো বুঝি নবিতুনের দিকে এগিয়ে দেয় গুঁজাবুড়ি। বলে আবার– নিজের দোষেই তো আজ এই অবস্থা তোর। কত করে বলি তোরে, তুই তো উলটো পিঁড়ি ছুড়ে মারিস।

হঠাৎ যেন খেয়াল হলো গুঁজাবুড়ির নবিতুন শুনছে না তার কথা। জিনিসগুলোও ধরছে না হাত বাড়িয়ে। কি হলো নবিতুনের?

নবিতুন ভাবছে।

কুটনী বুড়ির ছিনালি মাথায় নতুন চাল।

নিকা শাদিতে যদি তোর এতই আপত্তি হবে দরজাটা না হয় মাঝে মাঝে খোলা রাখিস? এ তো আর কেউ জানছেও না, কেউ দেখছেও না। তোরও মান থাকছে, ঘর থাকছে, খসম থাকছে। কি বলিস?

কিছু বলে না নবিতুন। নবিতুন ভাবছে।

যেন অন্ধকারে নবিতুনের মুখের কথাটা ঠাওর করার জন্য সামনের দিকে একটু ঝুঁকে এলো গুঁজাবুড়ি। ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলল– আজ রাত ঠিক দুঘড়ি বাদ, দরজাটা খোলা রাখিস। লুন্দর শেখ…কথাটা শেষ করতে পারে না গুঁজাবুড়ি। আচমকা এক ধাক্কায় কোঁত করে কঁকিয়ে উঠেছে গুঁজাবুড়ি। শরীরটা তার নবিতুনের উঁচু দাওয়া থেকে গড়িয়ে পড়ছে উঠোনে।– ওরে মেরে ফেললরে। তোরা আয়। মেরে ফেলল। মেরে ফেলল। চিৎকার করে ওঠে গুঁজাবুড়ি।

কি হলো, কি হলো? বুড়ির চিৎকারে ছুটে আসে সবাই। কোরবান আর কোরবানের বৌ। শরবতির বাবা, ভাই, শরবতি সবাই।–কি হলো? কি হলো?

কি আবার হবে, দেখ না? দূরে যেখানে ডুমুর গাছের তলায় থমথমিয়ে রয়েছে ঘন অন্ধকার সেদিকে আঙুল দেয় গুঁজাবুড়ি।

তা তোমাকে মারল কে? শুধায় কোরবান।

হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে গুঁজাবুড়ি। লাঠিটা তুলে নিয়েছে হাতে। হঠাৎ কোরবানের দিকে খেঁকিয়ে উঠল গুঁজাবুড়ি– মারল আবার কে? পালোয়ানিটা একবার ওদিকে গিয়ে দেখাও না! তবে না বুঝি কেমন পালোয়ান তুমি? আবার ওই ডুমুর তলায় ঘন অন্ধকারের দিকে আঙুল দেখায় গুঁজাবুড়ি।

তা ওখানে কি? শরবতির বাপ পাতের ভাত ফেলে ছুটে এসেছে। তাই গলাটা তার চড়া।

ওখানে বাগডাঁশ গো, বাগডাঁশ। বলছি কি এতক্ষণ? এই এখান দিয়ে মাগো, আমাকে এক ঢুঁস মেরে চলে গেল বাগডাঁশটা, ওই ওদিকে। ভাগ্যিস সঙ্গে সঙ্গে লাফ মারছিলাম…. মাগো…।

ইতিমধ্যে কে যেন একটা লণ্ঠন নিয়ে এসেছে। লণ্ঠনটা লয়ে ওরা ছুটে গেল ডুমুরতলার দিকে বাগডাঁশার খোঁজে। লাঠিটা সামনের দিকে ঠুকে ঠুকে পথ ঠাওর করে গুঁজাবুড়ি। পথ ঠাওর করে ধীরে ধীরে পা ফেলে।

সগির মা গুঁজাবুড়ি, অনেক অপবাদ তার। অনেক কলঙ্কের দূতী, অনেক কলঙ্কিনীর দোসর গুঁজাবুড়ি। কুল কন্যার কুল ভেঙেছে, গৃহবধূর গৃহ ভেঙেছে, সতী নারীর সতীত্বের পণ্য সওদা করেছে গোপন হাঁটে… সবই স্বীকার করে গুঁজাবুড়ি। কিন্তু হাঁটে কখনো হাঁড়ি ভাঙেনি। কারও মান ভাঙেনি গুঁজাবুড়ি। ঘোর দুশমনও এমন অপবাদ দিতে পারে না গুঁজাবুড়িকে।

শঙ্কামুক্ত হয়ে মনে-মনে হাসে গুঁজাবুড়ি। খুশি হয়। সামান্য অসাবধানে কামটা ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছিল আজ।

হঠাৎ হাতের লাঠিটা ছিটে পড়ে যায় গুঁজাবুড়ির। চালের পোঁটলাটা যে ছুঁড়ে মেরেছে নবিতুন, ওটা এসে পড়েছে গুঁজাবুড়িরই লাঠির গায়ে। মরিচ, পেঁয়াজ, বালা তেলের শিশি, হোগলাপাতায় বাঁধা গুড়, একে-একে সবই উড়ে উড়ে আসে গুঁজাবুড়ির দিকে। কোনটাবা বুড়ির পিঠে এসে লাগে, কোনটা মাটিতে পড়ে ছিটিয়ে যায়। তেলের শিশিটা ভেঙে যায়। অন্ধকারে যতটা পারল হাতড়ে হাতড়ে জিনিসগুলো খুঁজে নিল গুঁজাবুড়ি। চালগুলোর জন্যই সবচেয়ে বেশি আফসোস হলো ওর। তবু যতটা পারল তুলে নিল। বালা তেলটা শুষে নিয়েছে ধুলোয়। তবু উপর উপর হাত বুলিয়ে যা উঠে এলো হাতে মুখে মাথায় মেখে নিল গুঁজাবুড়ি।

অনেক তেজীর তেজ নাবিয়েছে, অনেক দেমাকির দেমাক কিনেছে গুঁজাবুড়ি। গুঁজাবুড়ি জানে কত সবুর করতে হয় এসব কামে, সবুরে মেওয়া ফলে। ঠুকঠুক লাঠির আগায় পথ খুঁজে-খুঁজে চলে আর মনে-মনে হাসে গুঁজাবুড়ি।

অন্ধকারে বুঝি ভেসে ওঠে কদমের মুখখানি।

যত ভাবনাই থাকুক, যত দুশ্চিন্তাই থাকুক নবিতুনের মনে, শুলেই সব ভাবনা দুশ্চিন্তা এক পাশে ঠেলে উঠে আসে কদমের মুখখানি। কদমের মুখ খিদের জ্বালাটাও ভুলিয়ে দেয়, দিনমানের এতসব লাঞ্ছনা-যন্ত্রণা। কি যে জাদু এ মুখে! তিন বছরেরও ওপর নবিতুন দেখে না সে মুখ। তবু এই অন্ধকার রাতে কেমন স্পষ্ট হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই শালতি শালতি হাত, সেই রসিক হাসি ভরা মুখ।

আককিকে আরো কাছে টেনে নেয় নবিতুন। আককির মাথাটা তুলে নেয় বুকের ওপর। বুকের ওপর চেপে ধরে আককির মুখখানি। ঘুমের ঘোরে আককি বুঝি জড়িয়ে ধরে মায়ের গলাটা। মেয়েটা ঘুমোয়। মা জেগে থাকে। জেগে জেগে মনটা বুঝি ওর চলে যায় কোন দূর-দূরান্তে। কোন দূরের সাগরে জাহাজ ভাসিয়েছে কদম, কে জানে। নবিতুন শুনেছে সে সাগরে নাকি কূল নেই কিনারা নেই। আর সে জাহাজ তো জাহাজ নয়। ওই লুন্দর শেখের দোতলা দালানটার চেয়েও বড় দালান, যন্ত্রের কেরামতিতে অথৈ পানির উপর দিয়ে ওটা ভেসে চলে। আসমান উঁচু সব ঢেউয়ের উপর চড়ে চড়ে সাঁতার কাটে।

ভাবতে গেলে তাজ্জব বনে যায় নবিতুন। সেই জাহাজের বোতাম টেপে, কল ঘোরায় সেই জাহাজের সারেং নবিতুনের কদম? আহা, নবিতুন যদি একবারটি দেখতে পেত কদমকে, সেই আসমান উঁচু ঢেউয়ের মাথায় আজব জাহাজের কাণ্ডারি কদমকে! কত দিন সাধ জেগেছে ওর। কিন্তু ভেবে ভেবেও কিছুতেই বেড় পায় না, দিশে পায় না নবিতুন। আন্দাজ পায় না নবিতুন, কূল নেই কিনারা নেই থৈ থৈ পানি, তার মাঝে বিরাট দালানবাড়ির মতো জাহাজ, হেলেদুলে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। সে যে কি, সে যে কেমন, মনের বাহু মেলে বেড় পায় না নবিতুন।

কেমন করেই-বা বেড় পাবে ও? বাপজান ওকে কোলে চড়িয়ে আদর করত, সেই তখন কয়ালের উপর দিয়ে নৌকা চড়ে মামা বাড়ি নাইয়োর গেছিল নবিতুন। বাবারে, সে কি নদী, একূল-ওকূল কিছুই চোখে পড়ে না। শুধু পানি আর পানি। নবিতুনের তো মাথা গেছিল ঘুরে। লোকে বলে,

যে দেয় কয়াল পাড়ি
বৌ তার দুপুরে রাঁড়ি।

কিন্তু, এই কয়াল সেও নাকি সমুদ্রের কাছে কিছু না। সমুদ্রের পাশে কয়াল! বড় জোর বদনার সরুনলের এক সুতো পানি অথবা সারেং বাড়ির পেছনের চিকন নালাটি।

আচমকা টিপ করে ওঠে নবিতুনের বুকটা। বেঁচে আছে তো সারেং? নবিতুন শুনেছে মানুষের চেয়ে উঁচু উঁচু সেই সব ঢেউয়ের বাড়ি খেয়ে পানির তলায় লুকিয়ে থাকা পাহাড়ের আঘাতে জাহাজ নাকি ভেঙে যায়, কিনারা তো নেই যে সাঁতার কেটে ডাঙায় উঠবে?

না, এই চিন্তাটাকে আমল দেবে না নবিতুন। ঘুমোতে আসলেই অন্যসব ভাবনার সাথে এই অলুক্ষণে চিন্তাটাও যেন কোত্থেকে ধেয়ে আসে।

কানটা খাড়া করল নবিতুন। কে যেন বেড়ার গায়ে নখ বুলোচ্ছে, আঁচড় কাটছে। বিড়াল কি?

না, বিড়াল নয়। ধপধপ দুটো থাপ্পড়ও পড়ল বেড়ার গায়ে। তারপর কুই পড়ল, একটা, দুটো। পরপর আরও কয়েকটা।

দুঘড়ি বাদ দরজাটা খোলা রাখতে বলেছিল গুঁজাবুড়ি। বেজন্মা লুন্দর শেখ নয় তো?

সজাগ হয় নবিতুন। উঠে বসল। হাত বাড়িয়ে শিথানের কাছে রাখা ছেনিটা তুলে নিল। চেঁচিয়ে বলল– কোন্ হারামজাদা কমজাত রে? বুঝি নবিতুনের গলা পেয়ে বন্ধ হলো কুইটা। বেড়ার গায়ে আঁচড়টাও। এবার নিঃসন্দেহ নবিতুন, এ নিশ্চয় কোরবানের কাজ। ইদানীং আসতে যেতে কোরবান নজর ফেলছে ওর দিকে। এর আগেও কয়েক বার আঁধার রাতে কুই দিয়েছে।

আবার কুই পড়ল। এবার খুব আস্তে এবং দরজার দিকে। কয়েকটা টোকা পড়ল দরজার গায়।

খবরদার, ছেনি মারব বলে দিচ্ছি। উঁচু গলায় সাবধান করে দিল নবিতুন। সাবধানী পেয়েও থামে না টিনের দরজার গায় ঠনঠন শব্দটা। কেমন বেলাজ বেহায়ারে। ঘরের বৌ থুয়ে এসব বেশরম কাণ্ড। দাঁড়া তোর কানটা যদি কেটে না রাখি তবে আমার নাম নবিতুন নয়। ঝট করে চৌকি ছেড়ে নেমে আসে নবিতুন। ঝনাৎ করে খুলে ফেলল টিনের দরজাটা।

অন্ধকারেই যেন দেখল নবিতুন, অন্ধকারের চেয়েও কালো একটা মানুষ শক্ত মাটিতে ধপধপ শব্দ তুলে দৌড়ে চলে গেল পুব হিস্যার দিকে। কি দুঃসাহস নবিতুনের! এই ঘুরঘুট্টি আঁধারে খুলে ফেলল দরজাটা। লোকটা না পালিয়ে যদি ঝাঁপিয়ে পড়ত ওর ওপর? কি করতে পারত নবিতুন? ঝটপট দরজাটা বন্ধ করে চৌকিতে ফিরে আসে নবিতুন। গরগরিয়ে কাঁপছে ওর গাটা।

কিন্তু এমন করে নিজেকে কত রাত রক্ষা করে চলবে নবিতুন! এত উৎপাত। এত যন্ত্রণা, এত অভাব, এত প্রলোভন। কতদিন কতদিক সামলাবে নবিতুন?

ভেসে যায় নবিতুনের বুকটা।

রাতের আঁধারের মৌন সমর্থন পেয়ে গমকে-গমকে বেরিয়ে আসে কান্না আর নিঃশব্দ একটি জিজ্ঞাসা– সারেং কি আর আসবে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *