০২. নবনীর ঘুম

নবনীর ঘুম ভাঙ্গে সকাল দশটায়।

সপ্তাহে দুদিন, মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবারে তার ক্লাস থাকে ন’টায়। এই দু’দিন ঘড়িতে এলার্ম দেয়া থাকে। যথাসময়ে এ্যালার্ম বাজে। ঘুমের ঘোরে নবনী হাত বাড়িয়ে ঘড়ি হাতে নেয়। এ্যালার্ম বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। অ্যালার্মের পর তার ঘুম গাঢ় হয়। খুব শান্তি শান্তি লাগে। তার ঘুম ভাঙ্গে যথারীতি সকাল দশটায়। ক্লাস করা হয় নি এ নিয়ে তাকে মোটেও চিন্তিত মনে হয় না। দরজা খুলে সে বের হয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, আমার চা কোথায়? বলেই সে আবার নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় এলিয়ে পড়ে। বড় কাপ ভর্তি চা আসবে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আস্তে আস্তে ঘুম কাটাবে। তারপর আসবে দাঁত ব্ৰাস করার প্রশ্ন। হাত মুখ ধোয়ার প্রশ্ন।

আজ বৃহস্পতিবার সকালের ক্লাস মিস হয়েছে। একটা টিউটোরিয়েল ক্লাস আছে দুপুর দুটায়। এডগার এলেন পোর কবিতা নিয়ে আলোচনা।

It was mamy and manya years ago
In a Kingdom by the sea,
That a maiden there lived whom you may know
By the name of Annabel Lee;
And this maiden she lived with no other thought
Tham to love and be lowed by me.

আচ্ছা এই কবিতাটার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা একই গায়ের খুব মিল আছে না?

আমার নাম তো জানে গাঁইয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।

এডগার এলান পোর এনাবেল লীই কি রবীন্দ্রনাথের রঞ্জনা?

স্যারকে এই প্রশ্ন করলে কেমন হয়? স্যার কি খুব রেগে যাবেন? স্যার আবার অস্বাভাবিক রবীন্দ্ৰভক্ত। ইংরেজির অধ্যাপকরা রবীন্দ্ৰভক্ত হন না। শহীদ স্যার রবীন্দ্ৰভক্ত। শহীদ স্যারের ক্লাসটা না করলে আজ ছুটি। শুক্র শনি এমিতেই ছুটি। তিনদিনের ছুটি। নবনী চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, দ্রুত চিন্তা করছে। দুপুরের ক্লাসটা করবে। কী করবে না। মন স্থির করতে পারছে না। ক্লাস করাটা জরুরি। আবার পরপর তিনদিনের ছুটিটাও জরুরি। কোন জরুরিটা বেশি জরুরি?

নবনীর শীত লাগছে। সারারাত এসি চলেছে। ঘর এখন উীপ ফ্রীজের মতো ঠাণ্ডা। ভোররাতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে একবার ঘুম ভেঙ্গেছে। সে হাত বাড়িয়ে এসি বন্ধ করার রিমোট কনট্রোল খুঁজেছে। পাওয়া যায় নি। বিছানা থেকে নেমে এসির রিমোট কনট্রোল খোঁজার কোনো মানে হয় না। সে কুকড়ি মুকড়ি দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল শেষ রাতে নবনীর মনে হয়েছে সে এই পৃথিবীতে আগে আগে এসে পড়েছে। আরো বিশ পঁচিশ বছর পর তার জন্ম হলে যন্ত্রণা কম হতো। তখন বিজ্ঞান আরো অনেকদূর এগিয়ে যেত। ঘর বেশি ঠাণ্ড হয়ে গেলে হাত বাড়িয়ে রিমোট কনট্রোল খুঁজতে হত না। সে মুখে বলবে–এসি বন্ধ।

ওম্নি এসি বন্ধ।

টিভির চ্যানেল বদলাবার জন্যে বোতাম টিপা টিপি করতে হবে না। মুখে বললেই হবে–চ্যানেল নাম্বার সেভেন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। ওমি চ্যানেল বদলে যাবে। শুরু হয়ে যাবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির চ্যানেল।

রাতে শোবার সময় নবনী সবকিছু হাতের কাছে নিয়ে ঘুমায়। এক বোতল পানি, এসির রিমোট কনট্রোল, টিভির রিমোট কনট্রোল পছন্দের একটা গল্পের বই এবং একটা খাতা-কলম। বিশেষ ধরনের কলম, লেখার সময় কলম থেকে আলো বের হয়। সেই আলোয় রাতেও লেখা যায়। খাতাটা সে রেখেছে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলে স্বপ্নটা সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলার জন্য। কারণ দিনের বেলায় রাতের কোনো স্বপ্নই তার মনে থাকে না। ইদানীং প্রতি রাতেই নবনী ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন দেখছে। নবনীর দূরসম্পর্কের এক চাচা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রির প্রফেসর। তিনি তাঁকে শোবার সময় খাতা-কলম নিয়ে শুতে বলেছেন। নবনীর চিকিৎসা করার সময় তার স্বপ্নগুলো জানা না-কি বিশেষ প্রয়োজন।

গত রাতে কোনো স্বপ্ন দেখেছে কি-না। নবনী মনে করতে পারুল না। শেষ রাতে একবার যখন ঘুম ভেঙ্গেছে তাহলে ধরে নেয়া যায় স্বপ্ন দেখেই ঘুম ভেঙ্গেছে। নবনী হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিল। পাতা উল্টাল। হ্যাঁ, স্বপ্ন দেখেছে। গোটা গোটা করে স্বপ্ন লেখা আছে। এমিতে নবনীর হাতের লেখা জড়ানো কিন্তু আধো ঘুম আধো তন্দ্রার সময়ের হাতের লেখা বেশ পরিষ্কার। নবনী লিখেছে—

স্বপ্নে দেখলাম পানির ওপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি। পানি বরফ শীতল।। যতই সামনের দিকে এগুছি ততই পানি বাড়ছে। মনে হচ্ছে মি গভীর পানির দিকে যাচ্ছি। দৌড়ানো বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। যে দিকে দৌড়াচ্ছিলাম। তার উল্টোদিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। সেদিকেও পানি বাড়ছে। আমি ক্ৰমাগত গভীর পানির দিকে যাচ্ছি। আবারো দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার চারদিকে হিম শীতল পানি। দিগন্তরেখা বলে কিছু নেই। আমি দাঁড়িয়ে আছি এক দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের মাঝখানে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি। সেখানটা গভীর না। পানি আমার কোমর পর্যন্ত। কিন্তু যে দিকে যাওয়া যায়–গভীরতা বাড়ে। হঠাৎ শো শো শব্দ হওয়া শুরু হলো। আমার চারদিক থেকে উঁচু হয়ে পানি আসছে। যে-কোনো মুহূর্তে আমাকে ড়ুবিয়ে দেবে। ঘুম ভেঙ্গে গেল।

নবনী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। স্বপ্নটা রাতে যত ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল আসলে তত ভয়ঙ্কর না। এই স্বপ্ন দেখার পেছনে কারণ আছে। সে স্বপ্নে দেখেছে হিমশীতল পানি। এর কারণ ঘর এসির জন্যে খুব ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। সে শীতে কাঁপছিল। এক্সটার্নেল ষ্টিমুলাই স্বপ্ন তৈরি করেছে। চারদিক থেকে পানি এসে তাকে গ্রাস করছে–এর পেছনেও কারণ আছে। ঘুমুতে যাবার আগে সে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির চ্যানেল দেখছিল। দক্ষিণমেরু নিয়ে প্রোগ্রাম। পক্ষিণমেরুতে পানি পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে মহা চিন্তিত। দক্ষিণমেরুতে পানি পাওয়ার কথা না। তাহলে কি বরফ গলতে শুরু করেছে? যদি দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে যায় তাহলে পুরো পৃথিবী চব্বিশ ফুট পানির নিচে তুলিয়ে যাবে। এ রকম ভয়ঙ্কর প্রতিবেদন দেখে ঘুমুতে গেলে রাতে পানিতে ড়ুবে যাবার স্বপ্ন দেখাইতো স্বাভাবিক।

স্বপ্নের খাতায় কিছু ফুটনোট লিখে রাখা কি দরকার? স্বপ্ন প্রসঙ্গে তার নিজের ব্যাখ্যাও থাকল। এই ব্যাখ্যা সাইকিয়াট্রিস্ট সাহেবের কাজে লাগলেও লগতে পারে। যে সাইকিয়াট্রিস্ট নবনীকে দেখছেন তার নাম এ. কে. হোসেইন। আইনস্টাইনের চেহারার সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারার খুব মিল আছে। মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুল। আইনস্টাইনের গোঁফ ছিল, ভদ্রলোকের গোঁফ নেই। সাইকিয়াট্রিস্টরা উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করেন এই রকম কথা শোনা যায়। এই ভদ্রলোকের বেলায় সে রকম মনে হয় না। ভদ্রলোকের প্রশ্নগুলো সুন্দর। তবে প্রশ্নের ধরন দেখে বুঝা যায়। ভদ্রলোক কিছু না জেনেই নবনীর দুঃস্বপ্লের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। প্রশ্নগুলো করা হচ্ছে সেদিক থেকে। নবনীর ধারণা প্রফেসর এ. কে. হোসাইন মোটামুটি নিশ্চিত, যে ডাক্তার ছেলের সঙ্গে নবনীর বিয়ে হয়েছে তার সঙ্গে বনিবানা হচ্ছে না। নবনী দুঃস্বপ্নগুলো এই কারণে দেখছে। সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক প্রশ্ন করার সময় চোখ বন্ধ করে প্রশ্ন করেন। এটা নবনীর কাছে খুব অস্বস্তিকর মনে হয়। কয়েকবার সে ভেবেছে সেও জবাব দেবার সময় চোখ বন্ধ করে রাখবে। দু’জন কথা বলছে, দু’জনেরই চোখ বন্ধমজার ব্যাপার।

আচ্ছা মা নবনী, দুঃস্বপ্নগুলো কি তুমি বিয়ের আগেও দেখতে?

মাঝে মাঝে দেখতাম।

বিয়ের পর বেশি দেখছ, তাই না?

হুঁ।

প্রায় রোজ রাতেই দেখছি?

হুঁ।

তোমার ডাক্তার হাসবেন্ড আনিসও তো শুনেছি। গ্রামের দিকে কোথায় কাজ করছে।

ঠিকই শুনেছেন চাচা।

তুমি ওর সঙ্গে থাকিছ না?

কীভাবে থাকিব–ইউনিভার্সিটি তো খোলা।

ওর কাছে যাও না? –

একবার গিয়েছি, গত মাসের এগারো তারিখ। তিন দিন ছিলাম।

তখনো কি দুঃস্বপ্ন দেখেছি?

হুঁ।

কী দেখেছি মনে আছে?

একটা শুধু মনে আছে। বাড়িতে আগুন লেগে গেছে। আমরা বের হতে পারছি না, কারণ দরজা খুঁজে পাচ্ছি না।

কাঠের বাড়ি, না দালান?

মনে নেই।

আগুনের সঙ্গে প্রচুর ধোয়া ছিল না কি শুধুই আগুন?

তাও মনে নেই।

সেই স্বপ্নে তুমি একা ছিলে, না-কি তোমার সঙ্গে তোমার হাসবেন্ডও ছিল?

মনে নেই চাচা। আমার স্বপ্ন মনে থাকে না। রাতে যা দেখি সকালবেলা ভুলে যাই।

তাহলে এই স্বপ্নটা মনে আছে কীভাবে?

কিছু কিছু স্বপ্ন মনে থাকে।

তোমার শ্বশুরবাড়ি তো ঢাকাতেই, তাই না?

শ্বশুরবাড়ি ঢাকায় না, তবে আমার শ্বশুর শাশুড়ি ঢাকায় থাকেন। কলাবাগানের একটা ফ্ল্যাটে।

তুমি তাঁদের সঙ্গে থাক না?

জ্বি না। মাঝে মাঝে দেখা করতে যাই কিন্তু থাকি না।

থাক না কেন?

নিজের ঘর ছাড়া আমার ঘুম হয় না। তাছাড়া ওদের বাড়িতে এসি নেই। আমার খুব একটা খারাপ অভ্যাস হয়েছে। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় এসি লাগে। শীতের সময়ও আমি এসি ছেড়ে রাখি। ডাবল লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমাই।

শ্বশুর শাশুড়ি তোমার কেমন লাগে??

মোটামুটি লাগে। খারাপও না, আবার ভালোও না।

এই দু’জনের মধ্যে কাকে তোমার বেশি অপছন্দ?

আমার শ্বশুরকে। উনি বেশি কথা বলেন। উনি কাউকে কথা বলতে দেবেন। না। নিজে কথা বলবেন। অন্য কেউ কথা বললে তিনি কেমন জানি বিরক্ত হন। ভ্রূ কুঁচকে তাকান।

কী নিয়ে কথা বলেন?

বেশির ভাগ সময় হোমিওপ্যাথি নিয়ে। রিটায়ার করার পর হোমিওপ্যাথির বই পড়ছেন তো। হোমিওপ্যাথি মাথার ভেতর ঢুকে গেছে।

চিকিৎসা করছেন?

নিজের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে করছেন। আমি যে কবার তার কাছে গিয়েছি তিনি জোর করে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন।

কী ওষুধ?

ইপিকাক। আপনি যদি কিছুক্ষণ তাঁর সামনে থাকেন তাহলে আপনাকেও হয়তো কোনো ওষুধ খাইয়ে দেবেন।

তুমি যে সব দুঃস্বপ্ন দেখ তার মধ্যে তোমার শ্বশুরকে কখনো দেখেছ?

মনে নেই চাচা।

মা শোন, মাথার কাছে সব সময় একটা খাতা রাখবে। আর কলম রাখবে। খাতাটা হলো স্বপ্ন-খাতা। স্বপ্ন দেখে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়। সঙ্গে সঙ্গে খুব গুছিয়ে স্বপ্নটা লিখে ফেলবে। অবশ্যই তারিখ দেখে। সময় লিখে রাখবে। আপাতত ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি–ডরমিকাম। সাইড এফেক্ট নেই বললেই হয়। বিছানায় যাবার আধঘণ্টা আগে একটা ডরমিকাম খাবে।

চাচা আমারতো ঘুমের কোনো সমস্যা নেই, বিছানায় যাওয়া মাত্র আমার ঘুম পায়। ঘুমের ওষুধ খাব কেন?

ঘুমের ওষুধটা খাবে যাতে সাউন্ড শ্ৰীপ হয়। ঘুম গাঢ় হলে দুঃস্বপ্ন দেখবে না।

দুঃস্বপ্ন না দেখলে স্বপ্নের খাতায় দুঃস্বপ্নগুলো লিখব কীভাবে? আমার সমস্যাটা কী তা বুঝার জন্যেই তো স্বপ্নগুলোর বিষয়ে আপনার জানা দরকার।

নবনীর কথায় প্রফেসার এ. কে. হোসাইন এমনভাবে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকালেন যে নবনীর হাসি পেয়ে গেল। সে হাসি চাপা দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, চাচা। আপনি ভুরু টুরু কুঁচকে ফেলেছেন কেন? আপনি কি আমার কথায় বিরক্ত হয়েছেন?

সামান্য হয়েছি। কেউ যখন তুচ্ছ কথা নিয়ে পেঁচায়–আমার ভালো লাগে না। তোমার মধ্যে এই অভ্যাসটা আছে।

নবনী আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, চাচা আপনার মেজাজ খিটখিটোতো, এই জন্যেই আমার কথা পেঁচানো মনে হচ্ছে। আমি মোটেও পেঁচানো কথা বলছি না। আপনার নাক্সভূমিকা খাওয়া উচিত। খিটখিটে মেজাজের মানুষদের প্রধান ওষুধ হলো নাক্সভূমিকা। দুইশ পাওয়ারের নাক্সভূমিকা সকালে চারটা আর রাতে চারটা করে খাবেন। এই ওষুধ আমি শিখেছি আমার শ্বশুরের কাছ থেকে। আপনি বললে আমি আমার শ্বশুরের কাছ থেকে ওষুধ এনে দেব।

ভদ্রলোক কিছু বললেন না। স্থির চোখে নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সেদিন তাঁর দৃষ্টি দেখে নবনীর মনে হয়েছিল নবনীর মতো রোগী তিনি খুব বেশি দেখেন নি। দেখার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহও নেই।

 

ভারী গম্ভীর গলায় কে যেন ডাকল, নবনী!

নবনী ভ্রূ কুচকাল। গলাটা কার চিনতে পারল না। এ বাড়িতে এ রকম গম্ভীর গলাতো কারো নাই। তারপর মনে হলো এটা তার বাবার গলা। খুব চেনা মানুষকে মাঝে মাঝে যেমন অচেনা মনে হয়, দীর্ঘদিনের পরিচিত গলাও হঠাৎ হঠাৎ খুবই অপরিচিত লাগে। বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয় কে কথা বলছে?

নবনীর বাবা ফরহাদ সাহেব সকাল ন’টার মধ্যে বের হয়ে যান। তার কোনো ছুটি ছাটা নেই। সপ্তাহের যে দু’দিন অফিস বন্ধ সে দুদিন তিনি যান কারখানায়। তাঁর দু’টা সুতার কারখানা আছে। গাজীপুরে জাপানি কোলাবরেশনে চিনামাটির কারখানা দিচ্ছেন। প্ৰডাক্টের নাম হবে ‘নবনী’। আজ বের হন নি তার মানে কোনো সমস্যা আছে। নবনীর সমস্যা ভালো লাগে না। নিজের সমস্যা তো ভালো লাগেই না। আশেপাশের মানুষদের সমস্যাও ভালো লাগে না। সে চায়ের কাপ হাতে শোবার ঘর থেকে বের হলো। এই কাজটা করতেও তার ভালো লাগছে না। দিনের প্রথম চা সে আরাম করে নিজের ঘরে বসে খেতে ভালোবাসে। দিনের প্রথম অংশ এবং দিন শেষের অংশটি তার নিজের। বাকি অংশগুলো অন্যরা ভাগাভাগি করে নিক।

ফরহাদ সাহেব মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তার খালি গা, পরনে লুঙ্গি। গৌর বর্ণের মানুষ। মাথা ভর্তি ধবধবে সাদা চুল। তিনি অত্যন্ত মিষ্টভাষি, কারো সঙ্গেই উঁচুগলায় কথা বলেন না; তারপরেও তাকে মনে হয় দূরের মানুষ। কাছের কেউ না। ফরহাদ সাহেবের সামনে খবরের কাগজ বিছানো। নবনীকে দেখে তিনি হাসি মুখে বললেন, তোর বয়েসী একটা মেয়ে সকাল দশটা পর্যন্ত কী করে ঘুমায় আমিতো ভেবেই পাই না।

নবনী গম্ভীর গলায় বলল, তুমি যেমন আমার ব্যাপারটা ভেবে পাও না, আমিও ভেবে পাই না তুমি কী করে দিনের পর দিন ভোর পাঁচটায় উঠ। তোমার বয়েসী মানুষদের মধ্যে আলস্য থাকবে। ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেলেও কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করবে। ঘুম ভাঙা মাত্র লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামবে না।

ফরহাদ সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, অভ্যাস করলেই হয়। চার পাঁচ দিন চেষ্টা করলেই দেখবি ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গার অভ্যাস হয়ে যাবে।

এরকম বিশ্ৰী অভ্যাস করার দরকার কী?

ভোরবেলায় ঘুম ভাঙ্গা বিশ্ৰী অভ্যাস?

অবশ্যই বিশ্ৰী অভ্যাস। শরীরকে আরাম দিতে হয়। বাবা। শরীরকে কষ্ট দেবার মানে কী? শরীরকে কষ্ট দেবার মানে হলো, শরীরের ভেতর যে আত্মা বাস করে তাকে কষ্ট দেয়া।

ফরহাদ সাহেব হাসি মুখে বললেন, ভুল লজিকে তোর মাথাটা ভর্তি। তোর যেটা করা উচিত সেটা হচ্ছে একটা চিমটা দিয়ে তোর মাথা থেকে এক এক করে ভুল লজিক বের করে ফেলা।

নবনী বাবার পাশে বসতে বসতে বলল, তুমি আজ অফিসে যাবে না?

ফরহাদ সাহেব বললেন, না।

যাবে না কেন? শরীর খারাপ?

শরীর ঠিকই আছে। যে মানুষ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে তার শরীর এত সহজে খারাপ হয় না। তুই কি মুখ না ধুয়েই চা খাচ্ছিস?

হুঁ।

তোকে দেখেইতো মা আমার কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগছে।

কিছু করার নেই বাবা, আমি এ রকমই।

ফরহাদ সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, তোর এমন অদ্ভুত আচার আচরণ দেখে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিছু বলে না?

এখনো বলে নি। নতুন বউতো, চক্ষুলজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। লজ্জাটা কেটে গেলে বলবে।

এরা বোধহয় তোর ব্যাপার স্যাপার টের পায় নি। তুইতো থাকিস এখানে। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে তোর বোধহয় দেখাই হয় না?

সপ্তাহে একদিন যাই।

আজ যাবি?

না।

এক কাজ কর—আজ যা।

আজ যেতে বলছ কেন?

ওদের একটা সারপ্রাইজ দে। আমি বিরাট এক মাছ কিনে এনে দেব। মাছ নিয়ে যা। তোর শ্বশুর শাশুড়ি খুশি হবে। আমি নিউমার্কেট লোক পাঠাচ্ছি। বাজারের সবচে’ বড় মাছটা কিনে আনবে। বাংলাদেশে এমন কোনো মানুষ নেই যে বড় মাছ দেখে খুশি হয় না।

তাদের খুশি করার আমার দরকার কী?

মানুষকে খুশি করার মধ্যে আনন্দ আছে। সেই মানুষ যদি শ্বশুর শাশুড়ি হয় তাহলেতো কথাই নেই। মাছ কিনতে পাঠাব?

না!

সেকেন্ড থট দিবি?

সেকেন্ড শুধু না আমি ফোর্থ থট পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছি। মাছ নিয়ে আমি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। এটা ভাবতেই ঘেন্না লাগছে। চারদিকে মাছ মাছ গন্ধ পাচ্ছি। এই যে চা খাচ্ছি চায়ের মধ্যেও মাছের আঁশটে গন্ধ।

নবনীর চা শেষ হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতে চা খাওয়া হয়ে গেছে বলে চা খাওয়ার মজাটা ঠিক পাওয়া যায় নি। আরেক কাপ খেতে পারলে ভালো হতো। তার জন্যে যন্ত্রণা করতে হবে। দোতলা থেকে একতলায় নামতে হবে। তাদের বাড়ির রান্নাঘর, খাবার ঘর, বসার ঘর, লাইব্রেরি সবই এক তলায়। দুতলাটা স্লীপিং কোয়ার্টার। দুটা প্ৰকাণ্ড শোবার ঘর। একটা তার, অন্যটা তার বাবার। মাঝখানে ছোটখাট খেলার মাঠের মতো ফ্যামিলি লাউঞ্জ আছে। সেখানে টিভি, মিউজিক সেন্টার। ফ্যামিলি লাউঞ্জে মোটা গদির ডিভান আছে। শুয়ে শুয়ে ছবি দেখা হলো নবনীর ছোটবেলাকার অভ্যাস। মানুষের কিছু ছোটবেলাকার অভ্যাস বাড়বেলাতেও থেকে যায়। নবনীর এই অভ্যাসটি রয়ে গেছে।

দ্বিতীয় কাপ চায়ের জন্যে নবনীকে এক তলায় রান্নাঘরে যেতে হবে। যতক্ষণ ফরহাদ সাহেব আছেন ততক্ষণ কাজের লোকদের কেউই দোতলায় আসবে না। তাদের সে রকম নির্দেশ দেয়া আছে। নবনীর এক তলায় নামতে ইচ্ছা করছে না। ফরহাদ সাহেব বললেন, মুখ শুকনা করে বসে আছিস কেন?

নবনী জবাব দিল না। ফরহাদ সাহেব পত্রিকা ভাঁজ করতে করতে বললেন–আজ ইউনিভার্সিটি নেই?

দুটার সময় একটা ক্লাস আছে।

যাবি না?

এখনো বুঝতে পারছি না।

কখন বুঝতে পারবি?

ক্লাস শুরু হবার আধঘণ্টা আগে বুঝতে পারব।

ফরহাদ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেললেন।

নবনী বলল, হাসছ কেন?

তোর অভিনয় দেখে হাসছি?

নবনী বিস্মিত হয়ে বলল, অভিনয় কী করলাম?

ইনডিসিশনের একটা সুন্দর অভিনয় তুই সব সময় করিস। প্রায়ই দেখি তোর মধ্যে একটা দিশাহারা ভাব–কাজটা করব কি করব না। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত ভাবটা লোক দেখানো। কেন এরকম করিস?

নবনী জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফরহাদ সাহেব বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?

চা আনতে যাচ্ছি। তুমি দোতলায় আছ–এখন হাজার ডাকাডাকি করেও কাউকে আনা যাবে না। বাবা, তোমাকে কি এক কাপ চা দিতে বলব? খাবে?

না। তোর দুঃস্বপ্ন দেখা কেমন এগুচ্ছে?

ভালোই এগুচ্ছে।

কাল রাতেও দেখেছিস?

হুঁ।

খাতায় সব লিখছিস?

হুঁ লিখছি।

সাইকিয়াট্রিস্ট কে খাতাটা দেখতে দিয়েছিস?

না।

দিসতো আমাকে খাতাটা। পড়ে দেখব ঘটনা। কী।

আচ্ছা। ফরহাদ সাহেব হঠাৎ সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেন। তবে মুখের হাসি আগের মতোই রইল। চোখ। গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি।–সরাসরি জবাব দিবি। নকল কনফিউশান না। স্ট্রেইট আনসার–ইয়েস নো টাইপ। প্রশ্নটা হলো–আনিস ছেলেটাকে কি তোর পছন্দ হয়েছে?

নবনী সঙ্গে সঙ্গে বলল, না।

পছন্দ হয় নি কেন?

কারণগুলো নিয়ে চিন্তা করি নি। পছন্দ হয় নি এইটুক জানি।

সে কি তোকে পছন্দ করেছে?

হ্যাঁ করেছে। আমার যত সমস্যাই থাকুক আমি পছন্দ করার মতো মেয়ে।

আনিসের সঙ্গে তোর কি এখন যোগাযোগ নেই?

আছে। সে সপ্তাহে দু’টো করে চিঠি পাঠায়।

তুই চিঠি লিখিস না?

আমিও লিখি।

তুই কটা চিঠি লিখিস?

আমিও সপ্তাহে দু’টো। আর কিছু জিজ্ঞেস করবে?

না।

আমি কি এখন চায়ের সন্ধানে এক তলায় যেতে পারি?

ফরহাদ সাহেব জবাব দিলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হলো। আজ তিনি অফিসে যান নি মেয়েকে এই কথাগুলো জিজ্ঞেস করার জন্যে। কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছে–এখন তিনি যেতে পারেন। দুপুর একটায় জাপানি ডিজাইনার মি. ওসাকু সানের সঙ্গে তাঁর লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। ওসাকু সান চিনামাটির বাসনকোসনের ডিজাইন দেখাবেন। এই জাপানি শিল্পী না-কি বাংলাদেশী মাটিফ নিয়ে কাজ করেছেন। ফরহাদ সাহেবের দুপুরের লাঞ্চে যেতে ইচ্ছা করছে না। তিনি নিজের ওপর সামান্য বিরক্ত বোধ করছেন। তাঁর মেয়ের বয়স বাইশ। সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারে। তাঁর বয়স সাতান্ন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারেন না।

নবনী নিজেই চা বানোল। নিজের হাতে বানানো চা তার নিজের কখনো পছন্দ হয় না। আজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। চমৎকার চা হয়েছে। লিকার ঘন হয় নি। আবার পাতলাও হয় নি। চিনি যতটুকু দেয়া হয়েছে তারচে’ এক দানা বেশি হলে চা মিষ্টি হয়ে যেত। একদানা কম হলেও মিষ্টি কম লাগত। চা হলো এমন এক পানীয় যার সব অনুপাত নির্দিষ্ট এবং একেক জনের জন্যে একেক রকম।

নবনীর মন এখন ভালো। মন ভালো থাকা অবস্থায় ছোটখাট কিছু অপ্রিয় কাজ করে ফেলা যায়। তেমন খারাপ লাগে না। নবনী ঠিক করে ফেলল কলাবাগানে তার শ্বশুরবাড়িতে যাবে। মাছ সঙ্গে নিয়েই যাবে। দুপুরে ঐ বাড়িতেই খাবে। বাবাকে বলে মাছ কিনাতে হবে। কাউকে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে এক পাতা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট আনাতে হবে। শ্বশুর সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময় অবশ্যই তার মাথা ধরবে। হাতের কাছে মাথা ধরার ট্যাবলেট থাকা দরকার। আজ একটা ছোটখাট এক্সপেরিমেন্টও করা যেতে পারে–মাথা ধরার ট্যাবলেট আগেভাগে খেয়ে রাখা। মাথা ধরার সুযোগই হবে না। শরীরে আগে থেকেই ওষুধ বসে আছে।

 

দরজা খুললেন নবনীর শ্বশুর সালেহ সাহেব। নবনীর মনে হলো তিনি খুবই চিন্তিত, বিরক্ত এবং উদ্বিগ্ন। মানুষটা ছোটখাট, দুশ্চিন্তায় এবং উদ্বেগে আরো ছোট হয়ে গেছেন। এই ভদ্রলোককে নবনীর কাছে কাটুন চ্যানেলে দেখায় এমন কোনো কাটুন ক্যারেক্টরের মতো মনে হয়। কোন ক্যারেক্টার এটা মনে পড়ছে।

সালেহ সাহেব নবনীকে দেখে গলা নামিয়ে বললেন, বৌমা তুমি স্ট্রেইট আমার ঘরে চলে যাও। তোমার শাশুড়ির সঙ্গে কোনো কথা বলবে না। আগে আমার কথা শুনবে–তারপর তুমি যদি তার কথা শুনতে চাও শুনবে। তুমি এসে ভালো করেছ। আমি তোমাকে টেলিফোন করে আনাবার ব্যবস্থা করছিলাম। নাম্বারা ভুলে গেছি বলে টেলিফোন করতে পারছিলাম না। নাম্বার তোমার শাশুড়ির কাছে। তার কাছে।তো আর নাম্বার চাইতে পারি না।

নবনী চিন্তিত গলায় বলল, নাম্বার চাইতে পারেন না কেন?

অবস্থা সে রকম না। আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তুমি নতুন বউ। তোমার চোখে যেন কিছু না পড়ে এই জন্যে ঢাকা দিয়ে রাখি। ঢাকাঢাকি আর সম্ভব না। এনাফ ইজ এনাফ।

নবনী বলল, আপনাদের জন্যে একটা মাছ এনেছিলাম। গাড়িতে আছে।

রাখি তোমার মাছ। আসা, আমার ঘরে আস।

সালেহ সাহেব উত্তেজনায় কাপছেন। কথাও ঠিকমতো বলতে পারছেন না–শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ লাল–মনে হচ্ছে গত রাতে ঘুমান নি।

সালেহ সাহেব নবনীর হাতে ধরে প্রায় টানতে টানতে তাঁর নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। ছোট্ট ঘর। লেখার টেবিল আর বুক শেলফ ভর্তি ম্যাগাজিন ছাড়া আর কিছু নেই। রিটায়ার করার পর থেকে প্রতি দুপুরে এই ঘরের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তিনি ঘুমান। স্ত্রীর সঙ্গে মন কষাকষি হলে রাতেও তাকে এই ঘরে থাকতে হয়।

ঘরে একটা মাত্র চেয়ার। সেই চেয়ারে নবনীকে তিনি বসালেন। হাত নাড়তে নাড়তে হড়বড় করে কথা বলতে লাগলেন।

মা, খুব মন দিয়ে ঘটনাটা শোন। ঘটনার সূত্রপাত দুই দিন আগে। হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম–তোমার শাশুড়ি তার মুখের ওপর সব সময় একটা বই ঘরে আছে–বইটার নাম হলো ‘সাত কাহান’। সমরেশ মজুমদারের লেখা। মা তুমি বইটা পড়েছ?

জ্বি না।

আমিও পড়ি নাই। তোমার শাশুড়ি যা করে তার মধ্যে বাড়াবাড়ি থাকে। এই যে পড়ছে। এর মধ্যেও বাড়াবাড়ি আছে। সবসময় মুখের সামনে বই ধরে রাখা চাই। রাতে ঘুমাতে যাচ্ছি। সে বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ছে। বাতি জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম হয় না। এটা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। বই নিয়ে ঢং করতে পারলেই হলো। সকালে নাশতা খাচ্ছি। সেখানেও মুখের সামনে বই।

তারপর?

আমি আজ নাস্তার টেবিলে খুবই ভদ্র ভাষায় বললাম, বই যে পড়ছ–কাহন শব্দের অর্থ জান?

সে বই থেকে চোখ না তুলে বলল, না।

আমি সামান্য রাগ করে বললাম, একটা বই পড়ছি, তার নামের অর্থ জানার ইচ্ছা হলো না?

সে বই থেকে চোখ না তুলে বলল, পড়ার সময় বিরক্ত করবে না।

আমি বললাম, ঘরে চারটা ডিকশনারি। একটা ডিকশনারি দেখলেওতো অর্থটা জানতে পারতে। সে বই নিয়ে গাঁটগাট করে শোবার ঘরে চলে গেল।

নবনী বলল, আপনিও উনার পেছনে পেছনে শোবার ঘরে গেলেন?

অবশ্যই। তাকে গিয়ে খুবই ভদ্রভাবে বললাম, নামের অর্থ জানলে বইটা পড়ে আরাম পাবে। তুমি একটা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছ, সেই ছেলের নাম জানবে না। এটা কেমন কথা!

তোমার শাশুড়ি থমথমে গলায় বলল, বই পড়া আর মেয়ে বিয়ে দেয়া এক হলো?

আমি বললাম, অবশ্যই এক।

তখন সে খটাস করে বই বন্ধ করে রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল–বল কাহনের অর্থ কী আমাকে বল। অর্থ জেনে তারপর পড়ব।

আমি তোমার শাশুড়ির ভাবভঙ্গি দেখে একটু টেনশনে পড়ে গেলাম। তার নেচারতো জানি। লোকজন তিলকে তাল করে। তোমার শাশুড়ি তিলকে বড় সাইজের কঁঠাল করে। ভালো কথা মা, তুমি কি কাহন শব্দের অর্থটা জান?

জ্বি না। কাহনের অর্থ কি কাহিনী? সাত কাহন হলো সাত কাহিনী।

না। কাহিনী হলো সংখ্যাবাচক। ঐ যে—
চার কড়ায় এক গণ্ডা
দুই গণ্ডায় এক পন
ষোল পনে এক কাহন।

কাজেই এক কাহন হলো একশ বত্ৰিশ। এক কাহন আম মানে একশ বত্ৰিশটা আম। সাত কাহন মানে হলো নয়শ চব্বিশ।

নবনী হাসি মুখে বলল, বই এর নাম নয়শ চব্বিশ?

হ্যাঁ তাই। এটা তোমার শাশুড়িকে বললাম। বলার পর সে যে কী করল। তুমি বিশ্বাস করবে না। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মহিলা এই কাজটা করতে পারে না। সে বলল, কাহন নামের অর্থ জানার পর বইটা পড়তে ভালো লাগছে না। এই বলে জানোলা দিয়ে বইটা ফেলে দিল। বই পড়ল নর্দমায়। ঘটনার এই হলো সারমর্ম। মা আমি ঠিক করেছি, তোমার শাশুড়ির সঙ্গে এক ছাদের নিচে আমি আর বাস করব না। স্বামী-স্ত্রীর একজন যদি উত্তর মেরু হয় এবং আরেকজন যদি হয় দক্ষিণ মেরু তাহলেও এক ছাদের নিচে থাকা যায়। কিন্তু আমাদের অবস্থাটা দেখ–আমি হলাম দক্ষিণ মেরু; তোমার শাশুড়ি উত্তর মেরু ও না, এক্কেবারে মঙ্গল গ্ৰহ। আমাদের এক ঘরে থাকা সম্ভবই না।

আপনি যাবেন কোথায়?

তোমার কি ধারণা আমার থাকার জায়গার অভাব? থাকার জায়গার আমার অভাব নাই। সুটকেস, বিছানা গুছিয়ে রেখেছি। তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে–ভালোই হয়েছে। তুমি আনিসকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিও। প্রয়োজন বোধে টেলিগ্রামও করতে পার।

নবনী আতঙ্কিত গলায় বলল, আপনি সত্যিই সত্যিই চলে যাবেন না-কি?

সালেহ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, অবশ্যই চলে যাব। তুমি মা আমাকে চিন নাই। আমি দুই কথার মানুষও না, তিনি কথার মানুষও না। আমি এক কথার মানুষ। আমি ঐ Old vixen এর সঙ্গে বাস করব না। wixem মানে জানতো মা? vixenমানে হলো মহিলা শিয়াল। আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি চলে যাব, তখন অবশ্যই চলে যাব।

কখন যাবেন?

এখনই যাব, আবার কখন? পঞ্জিকা দেখে ঘর থেকে বের হবার দরকার নেই। সুতা কেটে গেলে ঘর থেকে বের হতে হয়। সুতা তো কাটা হয়ে গেছে। বাবা একটা কাজ করলে কেমন হয়? দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যান।

আমি আপনাদের জন্যে বিরাট একটা রুই মাছ এনেছি।

সালেহ সাহেব পুত্রবধুর দিকে তাকিয়ে ছোটখাট একটা ধমক দিলেন। তারপর নিজের মনে বিড় বিড় করে বললেন, বাংলায় একটা প্রবচন আছে—

মরিচ জব্দ শিলে
বউ জব্দ কিলে

বলেই ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–বিরাট ভুল হয়ে গেছে। বিয়ের পর পর যদি এই প্রবচন অনুযায়ী কাজ করতাম তোমার শাশুড়ি জব্দ থাকত।

নবনী হেসে ফেলল। সালেহ সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে পুত্রবধুর দিকে তাকালেন। এবং হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেলেন। তিনি সিঁড়ি ভেঙে নোমছেন, তার ধুপধাপ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

নবনী তার শাশুড়ির কাছে ছুটে গেল।

নবনীর শাশুড়ি ফরিদা বেগম নিরুদ্বিগ্ন গলায় বললেন, মা তুমি দুঃশ্চিন্তা করো নাতো। তোমার শ্বশুর এর আগে খুব কম করে হলেও তিনশবার ঘর থেকে বের হয়েছে। এটা নতুন কিছু না। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবে। তোমার শ্বশুরের দৌড় হচ্ছে রেলস্টেশন পর্যন্ত। রাগারগি করে রেলস্টেশন পর্যন্ত যাবে, তারপর মুখ শুকনা করে ফিরে আসবে। রাগ করে অন্তত একবার সপ্তাহ খানেক বাইরে থেকে এলেও বুঝতাম। পুরুষ মানুষের কিছু তার মধ্যে আছে। কিছুই নাই।

নবনী হাসল। শাশুড়িকে তার বেশ পছন্দ। এ বাড়িতে এলেই সে তার শাশুড়ির সঙ্গে গুটুর গুটুর করে গল্প করে।

ফরিদা বললেন, মা তুমি কি আজ দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে?

নবনী হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।

ফরিদা বললেন, তাহলে এক কাজ কর–তুমিই মাছটা রান্না কর। বৌমার হাতের রান্না খাই।

নবনী বলল, মা আমি রাঁধতে পারি না। শুধু চা বানাতে পারি।

ফরিদা বললেন–রান্না কোনো ব্যাপারই না। আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি।

নবনী রান্না চড়িয়েছে। জীবনের প্রথম রান্না। সে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করছে। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে রান্নাটা যদি সত্যি সত্যি ভালো হয় তাহলে বাটিতে করে এক বাটি মাছ সে তার বাবার জন্যে নিয়ে যাবে।

ফরিদ রান্নাঘরে বসে জাতি দিয়ে সুপুরি কাটছেন। চিকন করে সুপুরি কাটার অস্বাভাবিক দক্ষতা তাঁর আছে। এই বিদ্যাটিও তিনি তাঁর পুত্রবধূকে শেখাতে চান। আজ না, অন্য কোনোদিন। একদিনে অনেক কিছু শেখাতে নেই। ফরিদা সুপুরি কাটা বন্ধ করে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন–আনিসকে তোমার কেমন লাগে মা?

নবনী কিছু বলল না।

ফরিদা হালকা গলায় বললেন, পৃথিবী উত্তর দক্ষিণে চাপা। আর আমার ছেলেটা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই চাপা। কিন্তু মা ছেলেটা ভালো। খুবই ভালো। কিছু দিন ধৈর্য ধরে যদি তার সঙ্গে থাক তাহলে দেখবে তাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে।

নবনী তার শাশুড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফরিদা তাঁর পুত্রবধূর দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সুপারি। কাটতে কাটতে বললেন–চট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিও না মা।

নবনী বলল, আমি কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি। বলেই তার মনে হলো সে ভুল কথা বলেছে। সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে। কঠিন সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তের কথা কাউকে জানাতে ইচ্ছা করছে না।

ফরিদা শান্তগলায় বললেন, মাগো আমি তোমার শ্বশুরের মতো বোকা মানুষ না। আমার অনেক বুদ্ধি। তুমি যে একটা কিছু ঠিক করেছ তা আমি জানি। তোমার মাছ হয়ে গেছে। মাছের ডেগচিটা নামাও।

নবনী চুলা থেকে হাড়ি নামাল। ফরিদা বললেন, তরকারির রঙ ভালো হয়েছে। এখানে যে সব হলুদ পাওয়া যায়। তাতে তরকারিতে রঙ হয় না। পাটনাইয়া হলুদে ভালো রঙ হয়। লবণ মনে হয় সামান্য বেশি হয়েছে। সুরুয়া কেমন ছাড়াছাড়া লাগছে। একটু লবণ চেখে দেখতো।

নবনী লবণ চোখে বিস্মিত গলায় বলল, আপনি এত কিছু শিখেছেন কোথায়?

আমার মা’র কাছে শিখেছি। তোমার মা বেঁচে থাকলে তিনি তোমাকে শেখাতেন। এখন আমি শিখাব।

নবনী কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। ফরিদা বললেন, মা তুমি কি বলতে চাও বলে ফেল।

কিছু বলতে চাচ্ছি না।

কিছু অবশ্যই বলতে চাচ্ছিলে, শেষ মুহূর্তে তোমার কাছে মনে হয়েছে বলা ঠিক হবে না। তুমি বলতে পার–আমি যে-কোনো কিছুই সহজভাবে নিতে পারি।

নবনী বলল, ধরুন কোনো কারণে যদি আপনার ছেলের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপরেও কি শেখাবেন?

ফরিদা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তারপরেও যদি তোমার আমার এখানে আসার মতো সাহস থাকে তাহলে অবশ্যই শেখাব।।

দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। ফরিদা বেগমের ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসির রেখা। তিনি নবনীর দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন–তোমার শ্বশুর চলে এসেছেন। আজ মনে হয় স্টেশন পর্যন্ত যেতে পারে নি। তার আগেই ফিরে এসেছে।

নবনী বলল, মা আপনি খুবই ভাগ্যবতী একজন মহিলা। ফরিদা বললেন, অবশ্যই আমি ভাগ্যবতী। বাংলাদেশে প্রথম পাঁচজন ভাগ্যবতী স্ত্রীর তালিকা তৈরি হলে সেখানে আমার নাম থাকবে।

দরজার কড়া অতি দ্রুত নড়ছে। সালেহ সাহেবের গলার স্বরও পাওয়া যাচ্ছে–ফরিদা। ফরিদা।

নবনী দরজা খোলার জন্যে উঠতে যাচ্ছে, ফরিদা বললেন, তুমি বোস মা। দরজা খোলার দরকার নাই। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করুক। শাস্তি হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *