ভাঁড়ারায় নকুলেশ্বর দাসের যাত্রার দল অনেক পুরনো। নকুলেশ্বর পেশায় কুমোর, তার অভিনয়ের বেশ নাম-ডাক আছে। দলটি তার নিজের হাতে গড়া, প্রতি বছর অন্তত দুটি পালা নামেই। সপ্তাহে দুদিন ছাড়া অন্যদিন হাটখোলাটা ফাঁকাই থাকে, সেইখানে হয় মহড়া।
এ-দলের নিয়মিত সদস্য দশ-বারোজন, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সকলেই নিরক্ষর। নকুলেশ্বরও সেই দলে। তবে, যশোরের বৃত্তি পাঠশালায় দুবছর পাঠ নিয়ে এসেছে মতিলাল, সে গড়গড় করে বাংলা পড়ে দিতে পারে। নকুলেশ্বর শহর-গঞ্জ থেকে যাত্রাপালার পুঁথি জোগাড় করে আনে, মতিলাল সেগুলো পড়ে পড়ে শোনায়। যে-পালাটি পছন্দ হয়, সেটির পার্ট বিলি হবার পর মতিলালের সাহায্যেই শুরু হয় মুখস্থ করা। কিন্তু শুধু মুখস্থ করলেই তো হল না, নকুলেশ্বর তাদের ভাব শেখায়, ক্রোধ কিংবা কান্না, দুটোই সে ভালো ফোটাতে পারে।
নকুলেশ্বরের দলটি ইদানীং বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, কারণ যে প্রধান ফিমেল পার্ট করত, সেই গুপী কর্মকার এই কয়েক মাস হল তাহের দস্তিদারের দলে যোগদান করে চলে গেছে। কীসের টানে যে সে দলবদল করল, তা এখনও জানা যায় না। তাহের দস্তিদারের দল শুধু কুষ্টিয়াতেই আবদ্ধ থাকে না। তারা জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ায়। এই তো এখন তারা রয়েছে খুলনার বাগের হাটে।
দাসপাড়ার লালু নামের ছোকরাটি কোনও কর্মের না। ঘাটে-অঘাটে আর বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, যাতে দুপয়সা রোজগার হয়, তাতেও তার মন নেই। ধান রোয়ার সময় কিংবা কাটার সময় কেউ তাকে মাঠের কাজেও নেয় না, কারণ সে নির্ভরযোগ্য নয়, কবে সে আসবে আর কবে ডুব দেবে, তার কোনও ঠিক নেই যে! বৃষ্টির মধ্যে জ্বরজারি গায়ে নিয়েও আসতে পারে। আবার দিব্যি খটখটে শুখার দিন, লালুর অসুখ হয়নি, বাড়িতেও বসে নেই। তবু সে কাজে আসে না। হয়তো দেখা যাবে নদীর ঘাটে হাঁটুতে থুতনি দিয়ে সে বসে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এখানে বসে কী করছিস রে লালু? জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসে।
দুই যাত্রার দলের অধিকারীই তাকে দলে টানার চেষ্টা করেছে, লালু কিছুতেই রাজি হয় না। প্রস্তাব শুনলেই সে দৌড়ে পালায়। আর দু-তিনদিন তার দেখাই মেলে না, কোথায় লুকিয়ে থাকে কে জানে!
তার বিশেষ বন্ধু-বান্ধব নেই। শত্রুও নেই। নির্বিরোধী মানুষ। উপার্জনে মন নেই, কিন্তু প্রয়োজনে মিনি মাগনায় অন্যের উপকারের কাজে লাগতে পারে। গত বর্ষায় যখন হঠাৎ বন্যা হল, ভেসে গেল বাড়ি-ঘর, তখন এই লালুই তো কাঁধে করে ছোট ছোট শিশু আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পৌঁছে দিয়েছে বাঁধের ওপর। এইসব সময়ে সকলেই নিজের নিজের সংসার আর ঘটি-বাটি সামলাতে ব্যস্ত থাকে, কে আর পরের কথা ভাবে। বলতে গেলে এ গাঁয়ে একমাত্র লালুই নিজের বাড়ির কথা ভাবেনি, অন্যদের বাঁচাবার জন্য পরিশ্রম করেছে অসুরের মতন। শিবু গড়াইয়ের মা ফুলু ঠাকুরানির বিশাল বপু, এক শরীরে তিন মানুষের ওজন, তিনি তো ডুবেই মরতে বসেছিলেন, তাঁর ছেলেরাও তাঁকে ফেলে পালিয়েছিল, লালুই তাঁকে ঘাড়ে নিয়ে কোমর-জল ঠেলে পৌঁছেছিল চণ্ডীমণ্ডপে। ফুলু ঠাকুরানি সবাইকে ডেকে ডেকে বলেন যে, ওই লালুই তাঁর আসল পোলা, আগের জন্মে সে আপন গর্ভের সন্তান ছিল।
ফুলু ঠাকুরানি মাঝে মাঝেই লালুকে ডেকে সামনে বসিয়ে মোয়া-নাড়ু খাওয়ান, তবে অনেক সময় সে ডাকলেও আসে না। খাদ্যদ্রব্যের প্রতি তার লোভ নেই। কেউ তার প্রশংসা করলে লজ্জা পায়, সরে যায় সেখান থেকে।
বন্যার সময় লালুর নিজের বাড়িও ভেঙে পড়েছিল। সামান্য মাটির বাড়ি। খড়ের চাল। বেশি ঝড়-বাদলের দাপট সহ্য করতে পারে না। প্রতি বছরই নতুন করে দেওয়াল তুলে ছাউনি দিতে হয়। তা এক হিসেবে ভাললাই, প্রতি বছরই নতুন বাড়ি! এবারে বন্যার পর প্রতিবেশীরাও হাত লাগিয়েছে, ভিতরটা বাড়িয়ে বড় করা হয়েছে ঘরখানা, সামনে একটা দাওয়া। শিবু গড়াই ও আরও কয়েকজন বাঁশ ও খড় দিয়ে সাহায্য করেছে বিনামূল্যে।
লালুর মা বেশ সবলা রমণী। শরীর-স্বাস্থ্য পেটাই করা, মনেরও জোর আছে তেমনি। অল্প বয়সে শিশু সন্তান নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন। বিধবার প্রধান শত্রু তার যৌবন। শরীরে যদি রূপ থাকে, তা হলে তো কথাই নেই, শুধু স্বাস্থ্য ভালো হলেই তার প্রতি অনেকের নজর পড়ে। হিন্দু বিধবাকে কেউ বিয়ে করতে পারে না, কিন্তু তাকে কুপথে টানার জন্য মানুষের অভাব হয় না। পদ্মাবতী ধর্মশীলা রমণী, অল্প বয়স থেকেই নানারকম ব্রত পালন করেন, তিনি শত প্রলোভনেও সাড়া দেননি। তাতেও কি নিশ্চিন্ত থাকা যায়? যাকে ভোগ করতে পারে না, পুরুষরা তার ওপর শুরু করে অকথ্য অত্যাচার।
অনাত্মীয়দের এইসব অত্যাচার ও শরিকদের শত্রুতায় অতিষ্ঠ হয়ে পদ্মাবতী একদিন কোলের সন্তানকে নিয়ে স্বামী-শ্বশুরের ভিটে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আশ্রয় নিলেন এসে চাপড়া গ্রামের পিত্রালয়ে।
কায়স্থ পরিবারে মেয়েদের মোটা পণ দিয়ে বিয়ে দিতে হয়। আর সে বিয়ে মানেই জন্মের মতন পার করে দেওয়া। তার মধ্যে যদি সে মেয়ে বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসে, তবে সে গলগ্রহ ছাড়া আর কী? কে তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে সারা জীবন? তা ছাড়া যুবতি দশা থাকলে তো তাকে নিয়ে বিপদের শেষ নেই। বাড়ির পুরুষরাই তাকে নষ্ট করতে চেয়ে নিজেরাও নষ্ট হয়।
পদ্মাবতীর মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তিনি এই বিধবা কন্যাটিকে আগলে রেখেছিলেন, কিন্তু বছর চারেকের মধ্যেই তাঁর দেহান্ত হয়। ততদিনে বাবা অন্ধ এবং অথর্ব, পরিবারের সব দায়িত্ব বড় ভাইয়ের ওপর। তাঁর স্ত্রী প্রথম থেকেই পদ্মাবতী ও তাঁর সন্তানকে সুনজরে দেখেননি, পরিবারের কর্ত্রী হবার পর তিনি শুরু করলেন নানা ধরনের নিপীড়ন। তাঁর দুটি সন্তান, তারা ফেনা ভাতে ঘি খায়, লালুকে দেওয়া হয় না। তারা দুধ খায়, লালু খায় পিটুলি গোলা। তারা খায় মাছের মুড়ো, লালুর পাতে রোজ এক টুকরো মাছও জোটে না। তবু প্রকৃতির কী আশ্চর্য লীলা, সেই ছেলে-মেয়েগুলির চেয়ে লালুর স্বাস্থ্য অনেক ভালো। অন্যরা নানান রোগে ভোগে, লালুর কিছুই হয় না।
অবস্থাটা অসহ্য হয়ে উঠল পদ্মাবতীর বড় ভাইয়ের প্রথম সন্তানের বিয়ের পর। পরিবারে একজন নতুন মানুষ এসেছে, তাকে নিয়ে কত আনন্দ। কিন্তু সে আনন্দে পদ্মাবতী ও লালুর কোনও অংশ নেই। বরং ছেলে-বউয়ের জন্য বেশি জায়গা লাগবে, এই অছিলায় পদ্মাবতীদের ঘর থেকে বার করে দিয়ে স্থান করা হল গোয়ালঘরের পাশে এক মাচার তলায়।
পদ্মাবতী নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আত্মসম্মান জ্ঞান হারাননি। তিনি বুঝলেন, এবার তাকে বাপের বাড়ির মায়াও কাটাতে হবে। এর মধ্যে লালুর যোলো বছর বয়স হয়ে গেছে, জোয়ান পুরুষেরই মতন দেখায়, আর ছেলে এখন অন্য জায়গায় দিব্যি থাকতে পারবে।
কিন্তু যাবেন কোথায়? সম্বল কিছু নেই। তবে পদ্মাবতী দু-চারবার এদিক ওদিক ঘুরে জেনেছেন যে, দাসপাড়ায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এমনিতে পতিত জমি, আদাড় পাদাড়, সেখানে দুচারজন নমঃশূদ্র ঘর তুলছে। কার জমি কে জানে, কেউ তো আপত্তি করে না। এই অঞ্চলটাও ঠাকুরদের জমিদারির মধ্যে পড়ে, কিন্তু তাদের কোনও গোমস্তা, কর্মচারী এদিকে আসে না কখনও।
একজোড়া তালগাছের ধারে একটা জমি পদ্মাবতীর মনে মনে বেশ পছন্দ হল।
এই সময় একটাই ভুল করলেন পদ্মাবতী। বড় ভাইয়ের পরামর্শে লালুর একটা বিয়ে দিয়ে দিলেন। বড় ভাইয়ের ছিল পণের টাকার প্রতি লোভ, আর পদ্মাবতীও ভেবেছিলেন ছেলের বিয়ে দিয়ে কিছু টাকা পেলে সেই টাকায় ঘর তুলতে পারবেন। কিন্তু পণের টাকা পেলেন মাত্র কিছুটা অংশ, আর তাড়াহুড়োর মধ্যে ঠিক মতন পাত্রী দেখা হল না। পুত্রবধূ করে যাকে ঘরে আনলেন, সে ঠিক কালা-বোবা না হলেও অনেকটা হাবার মতন। দু-চারটের বেশি কথাই বলতে চায় না, সম্ভবত বেশি কথা জানেও না। আর সবসময়েই তার ভয়। যে-কোনও শব্দ হলেই ভয়ে কাঁপে। ঝড়ের মধ্যে বাজ পড়লে সে কেঁদে কেঁদে ডুয়ে গড়ায়। এমনকী পাকা তাল পড়ার ঢিপ শব্দ হলেও সে উরে বাবা রে বলে ওঠে!
যা হোক, সেই বউকেও মানিয়ে নিয়েছেন পদ্মাবতী। বউয়ের নাম গোলাপি, সে বেশি কথা বলে না বটে, ঝগড়াও তো করে না। শাশুড়িদের তো সেটাই প্রধান আশঙ্কা থাকে।
বাপের বাড়ি ছেড়ে আসার পর দাসপাড়ায় ঘর তুলে পদ্মাবতী মোটামুটি শান্তিতেই আছেন। লালুর উপার্জনের ধান্দা নেই, কাজকর্মে মন নেই। কেমন যেন বাউন্ডুলে আর উদাসী স্বভাবের হয়েছে। তাতেও তিনি বিচলিত নন। ছেলে যে অসৎ প্রকৃতির হয়নি, সেটাই যথেষ্ট। সে বাড়ি ছেড়ে বেশি দূরে কোথাও যায় না, মাকে ভালোবাসে ভক্তি করে, বউকেও অবহেলা করে না। পদ্মাবতী নিজেই লোকের বাড়িতে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভেজে আর মুড়ি-চিঁড়ে ভেজে যা রোজগার করেন, তাতেই পেট চলে যায়। বউও ঘরে বসে বড়ি দিতে পারে, কাসুন্দি, তেঁতুলের আচার বানাতে পারে, তাতেও কিছু আয় হয়। মানুষ একেবারে অনাহারে থাকলে শান্তি পায় না, কিন্তু দুবেলা যদি মোটামুটি অন্ন জুটে যায়, তা হলেই ইচ্ছে করলে সুখী হওয়া যায়। এতদিন পর নিজস্ব একটা সংসার পেয়ে পদ্মাবতী প্রকৃত সুখী। হাট থেকে একটা রাধাকৃষ্ণের পট আর লক্ষ্মীর সরা কিনে সাজিয়ে রেখেছেন ঘরের কোণে। প্রতিদিন সন্ধেবেলা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কয়েকবার শাঁখে ফু দেন তিনি, তারপর ধূপ জ্বালিয়ে বসেন সেই রাধাকৃষ্ণের পট ও লক্ষ্মীর সরার সামনে, কিছুক্ষণ থাকেন চোখ বুজে, মন্ত্র-টন্ত্র কিছুই জানেন না, কী
ভাবেন কিংবা কী চিন্তা করেন কে জানে। তখন মুখে ফুটে ওঠে অপূর্ব তৃপ্তির ছায়া।
সন্ধ্যার পর লালু বাড়ি ফিরলে খেতে বসার আগে সেই পট ও সরার সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে। গুনগুন করে কিছু একটা গান গায়।
যাত্রা দলে যোগ দিতে রাজি হয়নি লালু। কিন্তু হাটখোলায় মহড়ার সময় সে এক পাশে বসে থাকে। কিছু বলে না, মন দিয়ে সব শোনে। সব পালাতেই অন্তত সাত-আটখানা গান থাকে, সেই সব গান তার মুখস্থ হয়ে যায়। তার কণ্ঠেও বেশ সুর আছে। দু-চারজন তার গান শুনে ফেলেছে। কুষ্টিয়া-নদিয়ায় নানা সম্প্রদায়ের গানের আখড়া আছে। এ অঞ্চলে অনেকেরই মুখে মুখে গান ফেরে। লালু যাত্রাদলে যদি অভিনয় করতে না-চায়, শুধু গান গাইলেও তো পারে। তাও সে রাজি হয় না।
শুধু একবার নকুলেশ্বরের দলের গৌর-নিতাই পালার সময় মূল গায়েন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন আর উপায় অন্তর ছিল না। তাকে প্রায় জোর করেই নিতাই সাজিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়। মোট তিনখানা গান সে গেয়েছিল, তাকে প্রশংসাই করেছিল দলের লোকেরা, স্বয়ং নকুলেশ্বর তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পালা সাঙ্গ হবার পর লালুর সে কী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। সবাই অবাক। কেন কাঁদছে, কী হয়েছে, তা প্রথমে সে কিছুতেই বলতে চায় না। তারপর সে জানাল যে, সে তিনটি গানেই সুর ভুল করেছে, সেইজন্য তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সবাই তা শুনে হেসেছিল, একজন বলেছিল, তুই কি মিঞা তানসেন হইতে চাস নাকি রে লাউল্লা।
এক সন্ধেবেলা মহড়ার সময় কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন সেনের বাড়ির পাহারাদার যদু এসে জিজ্ঞেস করল, দাসপাড়ার লালুরে কোথায় পাওয়া যাবে কইতে পারো? বাড়িতে সে নাই।
একজন বলল, ওই তত দ্যাখেন খুঁটিতে হেলান দিয়া বইস্যা আকাশ দ্যাখতাছে।
যদু দেখল, দূরে এক কোণে একটা দোকানের বন্ধ দরজার সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে লালু। উর্ধ্ব নেত্র দেখলে মনে হয়, সে বুঝি আকাশের তারা গুনছে।
তার সামনে গিয়ে যদু বলল, চল, আমাগো কত্তামশাই তোরে এত্তেলা দিছেন।
লালু কয়েক মুহূর্ত যদুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন সে ওর কথা শুনতে বা বুঝতে পারেনি। যেন সে এ জগতে ছিল না।
তারপর ঘোর ভেঙে বলল, কারে ডাকছে কইলা? আমারে?
যদু বলল, হ, হ, তোরে। এহনি যাইতে কইছে।
মহড়া ছেড়ে অনেকে উঠে এসেছে কৌতূহলী হয়ে। কবিরাজমশাইয়ের মতন একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ লালুর মতন একজন এলেবেলেকে ডাক পাঠাবেন কেন?
মাসখানেক আগে লালু যে ওই বাড়িতে চোর হিসেবে ধরা পড়েছিল, সে খবর অস্পষ্টভাবে কয়েকজনের কানে এসেছে। কেউ বিশ্বাস করেনি। চোর হতে গেলেও একপ্রকার দক্ষতা লাগে। লালুটা তো একেবারেই ট্যালা।
অতবড় একজন মানুষের ডাক অবহেলা করার কোনও উপায় নেই। লালুকে যেতে হল যদুর সঙ্গে।
কবিরাজমশাই তখন তাঁর বাড়ির সামনের দিকে চাতালে সপার্ষদ বসে আছেন। আজ আর তাঁকে রুগি দেখতে যেতে হয়নি। সন্ধ্যার আকাশে অজস্র তারা ফুটেছে, মৃদু মৃদু বাতাসে স্নেহ স্পর্শ। হুঁকোয় কয়েক টান দিয়ে কবিরাজ সেটি পাশের একজনকে দিলেন। ব্রাহ্মণের হুঁকো আলাদা। কবিরাজ মীর মহম্মদ নামে এক দোস্তের সঙ্গে প্রায়ই দাবা খেলতে বসেন, তাঁর জন্যও পৃথক হুঁকো রাখা থাকে।
লালু হাঁটু গেড়ে বসে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করল।
মাসখানেক কেটে গেছে, তবু এই বিচিত্র চোরটির কথা কবিরাজমশাই ভুলে যাননি। তার নামও মনে রেখেছেন।
কবিরাজ বললেন, কী রে, আর কোনও গৃহস্থবাড়িতে চুরি-টুরি করতে যাস নাই তো?
এইসব মানুষের সামনে এলেই কেমন যেন ভয় ভয় করে। লালু দীনকণ্ঠে বলল, না, কর্তা।
কবিরাজ বললেন, বেশ, বেশ। বলেছি না, তোর একটা বড় ফাঁড়া আছে। যদি বাঁচতে চাস তো সাবধানে থাকবি। তুই নাকি গান করোস?
লালু মাথা নিচু করে রইল। কোনওরকম কথায় প্রতিবাদ করলেই তা অবিনয় বলে মনে হবে।
কবিরাজ বললেন, একখান গান শোনা। তুই রামপ্রসাদের গান জানিস?
এবারে মুখ তুলে লালু বলল, না, কর্তা। আমি গান শিখি নাই। কবিরাজ বললেন, দে মা আমায় তবিলদারি, আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী, অহো, বড় মনোহর গানখানি রচেছে। তুই যা জানোস, সেই গানই একখান গা।
প্রতিবাদ না-করে লালু একটা যাত্রার গান ধরল, ভবনদী পার হবি কে আর–।
গান শেষ হবার পর কবিরাজ তাঁর পাশের লোকদের দিকে ফিরে বললেন, মন্দ না, কী বলো তোমরা?
এক বৃদ্ধ বললেন, শুদ্ধস্বর ঠিক লাগে নাই। তার সপ্তকে গলা ওঠে না।
আর একজন বললেন, গান গায় বটে নদের চান্দ। তুই তার গান শুনেছিস?
লালু বলল, না, কর্তা।
কবিরাজমশাই বললেন, শোন, তোরে কেন ডেকেছি। আমার বড় গিন্নির শখ হয়েছে গঙ্গাস্নানে যাবে। আমিও কিছুদিন ধরে ভাবতেছি… যেতে হলে এই বর্ষার আগেই ঘুরে আসতে হয়। গঙ্গা দর্শনের জন্য যেতে হবে সেই বহরমপুরে। দূর আছে। তুই যাবি আমাগো সাথে?
এ প্রস্তাব শুনে লালু কয়েক মুহূর্ত বিহ্বল হয়ে রইল। হিন্দু ঘরে জন্ম, বাল্যকাল থেকে গঙ্গার মাহাত্ম শুনে এসেছে। ভূ-ভারতের মধ্যে সবচেয়ে পুণ্যবতী নদী। এ নদীতে একবার ডুব দিলে সব পাপ হরণ হয়ে যায়।
জন্মাবধি লালু এই দু-তিনখানা গ্রাম ছাড়া আর কিছুই দেখেনি। এর বাইরেও রয়েছে কত দেশ, কত মানুষ। সবই তো দেখতে ইচ্ছে করে। রাত্তিরে চুপিচুপি ঘোড়ায় চেপে সে মনে মনে কত অচেনা দেশে চলে গেছে।
তারপরই তার বাস্তববোধ ফিরে এল। সে বলল, কর্তা, আমার তো পয়সাকড়ি নাই, অত দূর দেশে যাব ক্যামনে?
কবিরাজ বললেন, পয়সাকড়ি নাই, শরীরে তো তাগত আছে। তুই পালকি বইতে পারবি?
কোনওদিন তো ও কাজ করি নাই।
তাইলে পারবি না। শিখতে লাগে। শোন, আমি তো পালকিতে যাব না, পা গুটায়ে বসতে পারি না, মাজায় ব্যথা হয়। ঘোড়ার পিঠেই আমার সুবিধা। এতখানি পথ, যাতায়াতে দিন পনেরো তো লাগবেই। এই পনেরো দিন মানিকচাঁদকে তো খিদমত করা লাগবে। তুই ঘোড়া ভালোবাসোস, তুই এই কাজ পারবি। তুই আমার লগে লগে যাবি, যেখানে থামব, সেখানে তুই মানিকচাঁদরে দানাপানি খাওয়াবি, তোর কোনও রাহা খরচ লাগবে না। যাবি?
অবশ্যই। যদি দয়া করেন।
এই মঙ্গলবারই যাত্রা। শুভদিন আছে। দ্বিপ্রহর দুইটা বেজে এগারো মিনিটে গমন শুরু। তুই সকাল সকাল তোর পোঁটলাপুঁটলি যা থাকে নিয়ে চলে আসবি। দুই-তিনখান গান শিখে নে এর মইধ্যে। আমারে গান শুনাবি। আর একটা কথা মনে রাখবি, মানিকচাঁদরে চাঙ্গা রাখাই তোর আসল দায়িত্ব।
লালু ফেরার পথ ধরল প্রায় নাচতে নাচতে। এত আনন্দের সংবাদ সে বহুদিন শোনেনি।
বহরমপুর কত দূর সে জানে না। গঙ্গা নদীরই বা কেমন রূপ? এই নদী নাকি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। কোথায় আছে হিমালয় পাহাড়, সেখানে দাঁড়িয়ে স্বয়ং মহাদেব এই নদীকে নিজের জটায় ধারণ করেছেন। পাণ্ডব বিজয় নামে একটা পালায় এই সব জেনেছে লালু।
মনে মনে সে চলে যাচ্ছে বহরমপুরে। সেখানকার গাছপালা সব অন্যরকম। পথের দুধারের গাছে গাছে কত ফল ফলে আছে, তার একটাও সে চেনে না। কতরকম পাখি, তাদের কণ্ঠে কতরকম সুর। বহরমপুর, বহরমপুর, সে স্থান স্বর্গের খুব কাছে!