০২. ধনঞ্জয়

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ধনঞ্জয়

কিছুক্ষণ পরে যে লোকটি পরদা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল তাহাকে কিন্তু বাংলা দেশের ঘটক সম্প্রদায়ভুক্ত করা একেবারেই অসম্ভব। লোকটি বাঙালী নয়, তবে কোন্ জাতীয় তাহা চেহারা বা বেশভূষা দেখিয়া অনুমান করা কঠিন। মাথায় মাড়োয়ারী ধরনের খুনখারাবী রঙের পাগড়ি, গায়ে দামী সিল্কের সেকেলে ধরনের পুরা আস্তিন আত্রাখা, পরিধানে বারাণসী চেলী, পায়ে লাল মখমলের উপর সাঁচ্চার কাজ করা নাগরা। গলায় সরু সোনার শিকলি দিয়া আটকানো একটা মোহর—তাহার মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড পান্না ঝকঝক করিতেছে। দুই কানে দুইটি সুপারির মত রুবি হইতে আলো ঠিকরাইয়া পড়িতেছে।

লোকটির বয়স বোধ হয় পঞ্চাশের কাছাকাছি, গোঁফ কাঁচাপাকা। গায়ের বর্ণ নিকষের মত কালো। কিন্তু কি অপূর্ব দেহের ও মুখের গঠন! যেন হাতুড়ি দিয়া লোহা পিটিয়া তৈয়ারি করা হইয়াছে। ঘন ভুর নীচে চক্ষু দুটা ইস্পাতের ছুরির মত ধারালো।

।লোকটি ঘরে ঢুকিয়াই দ্বারের কাছে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল; তাহার দৃষ্টি দেয়ালে টাঙানো কালীশঙ্করের তৈলচিত্রটার উপর নিবদ্ধ হইল। কিছুক্ষণ নিষ্পলকনেত্রে সেই দিকে তাকাইয়া থাকিয়া সে ধীরে ধীরে চক্ষু ফিরাইয়া বিশুদ্ধ বজ্রবুলিতে জিজ্ঞাসা করিল— এ ছবি এখানে কি করে এল?

আগন্তুকের অদ্ভুত বেশভুষা দেখিয়া দুই ভাই অবাক হইয়া গিয়াছিলেন, এইবার গৌরী হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।

লোকটি কিছু অপ্রতিভ হইয়া বলিল— মাপ করবেন। আমার ব্যবহারে আপনারা কিছু আশ্চর্য হয়েছেন। আমি এখনি নিজের পরিচয় দেব; কিন্তু তার আগে ইনি কে জানতে পারি কি?

গৌরী ঈষৎ হাসিয়া বলিল— উনি আমাদের পূর্বপুরুষ দেওয়ান কালীশঙ্কর রায়।

কালীশঙ্কর রাও!—লোকটির দুই চোখ উত্তেজনায় জ্বলিয়া উঠিল; সে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া যেন নিজেকে সম্বরণ করিয়া লইল; তারপর বলিল— বসতে পারি কি?

গৌরী স্বহস্তে একখানা চেয়ার অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিল—বসুন।

লোকটি উপবেশন করিয়া বলিল— বাবুসাব, সমস্তই নিয়তির খেলা। তা না হলে নিতান্ত অপরিচিত আমি, আমি দেওয়ান কালীশঙ্কর রাওয়ের বংশধরদের সঙ্গে কথা কইছি কি করে?

গৌরী হাসিতে হাসিতে বলিল—এ আর আশ্চর্য কি? কালীশঙ্কর রায়ের বংশধরদের সঙ্গে অনেকেই তো কথা কয়ে থাকেন।

লোকটি বলিল— তা নয়। আপনি এখন আমার কথা বুঝবেন না। — আচ্ছা, আপনারা কখনো ঝি দেশের নাম শুনেছেন কি?

গৌরী স্মরণ করিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—— ঝি! ঝিন্! নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে—

শিবশঙ্কর বলিলেন–ঝি মধ্যভারতের একটা ছোট্ট স্বাধীন রাজ্য। দাঁড়ান বলছি। তিনি উঠিয়া একটা আলমারি হইতে একখণ্ড মোটা বই বাহির করিয়া সেটার পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে একস্থানে আসিয়া থামিলেন। বলিলেন—এই যে ঝি-ঝড়োয়া। মধ্যভারতেরই বটে। স্বাধীন— ইংরাজের মিত্ররাজ্য। ঝিন্ এবং ঝড়োয়া দুটি পাশাপাশি যুগ্ম রাজ্য। পার্বত্য দেশ–একটি নদী আছে, নাম কিস্তা (সম্ভবত কৃষ্ণতোয়ার অপভ্রংশ), ঝিন্দের আয়তন– ১৫৫৪ বর্গ মাইল, রাজধানী সিংগড়। ঝড়োয়ার আয়তন ১৪৮৫ বর্গ মাইল; রাজধানী— বেতপুর। সর্বসুদ্ধ জনসংখ্যা ১১৮৯৫৩; প্রধান উপজীব্য শিল্প; খনিজ সম্পত্তি প্রচুর। দুই রাজ্যেই হিন্দু রাজা।

আগন্তুক বলিল— হ্যাঁ, ঐ ঝিন্দ-ঝড়োয়া। এইবার আমার পরিচয় দিই— আমি ঝিন্দের একজন ফৌজী-সদার— আমার নাম সর্দার ধনঞ্জয় ক্ষেত্রী। ঝিন্দের রাজার আমরা বংশানুক্রমিক পার্শ্বচর।

শিবশঙ্কর শিষ্টতা দেখাইয়া বলিলেন–আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে খুবই আনন্দিত হলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে ঝিন্দের ফৌজী-সদারের কি প্রয়োজন থাকতে পারে, সেইটেই ঠিক বুঝতে পারছি না।

ধনঞ্জয় ক্ষেত্ৰী বলিলেন—বাবুসাব, কিছুক্ষণ আগে ঐ ছবিটি সম্বন্ধে প্রশ্ন করায় আপনারা কিছু আশ্চর্য হয়েছিলেন। কিন্তু আমি আপনাদের এমন একটা কাহিনী বলতে পারি যা শুনে আপনারা আরো আশ্চর্য হয়ে যাবেন। আপনাদের এই পূর্বপুরুষটির যে অদ্ভুত জীবন বৃত্তান্ত আমি জানি, তার শতাংশের একাংশও আপনারা জানেন না। কিন্তু সে-কথা এখন নয়; যদি কখনো সময় পাই বলব। এখন আমার প্রয়োজনের কথাটাই বলি।

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ধনঞ্জয় ক্ষেত্রী আবার আরম্ভ করিলেন—আপনারা যে দুই ভাই তা আমি ইতিপূর্বেই আপনাদের বেয়ারার কাছে জেনেছি, তাই যে-কথা আজ শুধু একজনকে বলব বলেই। এসেছিলাম তা আপনাদের দুজনকেই বলছি। আশা করি, আমাদের কথাবার্তা অন্য কেউ শুনতে পাবে না।

ধনঞ্জয় ক্ষেত্রীর কথার ভঙ্গিতে দুইজনেই গভীরভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন; গৌরী উঠিয়া গিয়া ঘরের দ্বারগুলা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া একখানা চেয়ার অধিকার করিয়া বসিল। বলিলএবার বলুন; আর কারুর শোনবার সম্ভাবনা নেই।

ধনঞ্জয় বলিলেন— আর এক কথা। আপনারা আমার প্রস্তাবে রাজী হন বা না হন, আমার কথা ঘুণাক্ষরে কারুর কাছে প্রকাশ করবেন না, এই প্রতিশ্রুতি না পেলে আমি কিছু বলতে পারব না।

দুইজনেই প্রতিশ্রুত হইলেন।

ধনঞ্জয় ক্ষেত্ৰী তখন বলিতে আরম্ভ করিলেন দেখুন, ঝিন্ঝড়োয়া রাজ্য দুটি বরোদা বা হায়দ্রাবাদের মত বড় রাজ্য নয়। ইতিহাসে এবং ভূগোলে তাদের নাম ছোট করেই লেখা আছে— তাই ব্রিটিশ ভারতবর্ষের শিক্ষিত সম্প্রদায় মধ্যেও অনেকে ঝি-ঝড়োয়ার নাম জানে না। কিন্তু ছোট হলেও তারা একেবারে নগণ্য নয়। সেখানে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রতিনিধি আছে, ভারত সম্রাটের দরবারে এই দুই রাজ্যের রাজার একটা নির্দিষ্ট আসন আছে।

আপনারা ঝিন্দ-ঝড়োয়ার সম্বন্ধে কিছু জানেন না বলেই এর পূর্বতন ইতিহাস কিছু বলা দরকার। ভারতবর্ষের হুণ অভিযানের কথা আপনারা পড়েছেন। সেই সময় মথুরার যুবরাজ স্মরজিৎ সিংহ। এবং তাঁর ভগিনীপতি বেত্রবর্মা হ্রণ কর্তৃক রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। দক্ষিণাপথে সপরিবারে পালাতে পালাতে তাঁরা এক দুর্গম পর্বতবেষ্টিত উপত্যকায় এসে উপস্থিত হলেন। স্থানটি প্রাকৃতিক পরিবেষ্টনে এমনভাবে সুরক্ষিত যে স্মরজিৎ সিংহ তাঁর দক্ষিণ যাত্রা এখানেই নিরুদ্ধ করলেন এবং সেখানকার আটবিক বন্য জাতিকে বাহুবলে পরাস্ত করে এই ঝি-রাজ্য স্থাপন করলেন। অতঃপর ভগিনীপতি বেত্রবর্মার সঙ্গে মনের মিল না হওয়াতে দুজনে রাজ্য সমান ভাগ করে নিলেন। পৃথক হয়ে বেত্রবর্মা তাঁর রাজ্যের নাম রাখলেন ঝড়োয়া। দুই রাজ্যের মাঝখানে পার্বত্য নদী কৃষ্ণতোয়া সীমানা রক্ষা করছে।

সেই অবধি এই দুই রাজবংশ ঝি ও ঝড়োয়ায় রাজত্ব করে আসছে। ভারতবর্ষের ওপর দিয়ে। নিয়তির শত শত ঝড় বয়ে গেছে পাঠান, মোগল, ইরাণী, মারাঠী, ইংরেজ হিন্দুস্থানকে নিয়ে টানাটানি হেঁছেড়ি করেছে, কিন্তু ঝিন্ঝড়োয়া তার দুর্ভেদ্য গিরিসঙ্কটের মধ্যে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে, কখনো তার গায়ে একটা আঁচড় লাগেনি। একে অনুর্বর পাহাড়ে দেশ, তার ওপর বাহিরের কলহে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, তাই কোনোদিন কোনো শক্তিশালী জাতির লোলুপ দৃষ্টি তার ওপর পড়েনি।

এই তো গেল অতীতের কাহিনী। বর্তমানের কথা সংক্ষেপে বলছি। বর্তমানে অবস্থা হচ্ছে এই যে, ঝিন্দের মহারাজ ভাস্কর সিংহ আজ ছমাস হল গতাসু হয়েছেন। মহারাজ ভাস্কর সিংহের দুই পুত্ৰ কুমার শঙ্কর সিংহ ও কুমার উদিত সিংহ। কুমার শঙ্কর স্বর্গীয়া পাটরানী রুক্সা দেবীর গর্ভজাত, আর কুমার উদিত স্বর্গীয়া দ্বিতীয়া মহিষী লখিমা দেবীর গর্ভজাত। দুজনের বয়স সমান, শুধু কুমার শঙ্কর উদিতের চেয়ে ঘণ্টাখানেকের বড়। সুতরাং তিনিই সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী।

এইখানেই গণ্ডগোলের আরম্ভ। বাপের মৃত্যুর পর উদিত সিংহ ছোট হয়েও গদীতে বসবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ঝিন্দের সিংহাসন যে ন্যায়ত তাঁরই, এ কথা প্রমাণ করবার জন্য তিনি তাঁর জন্মকালীন ধাত্রী, ডাক্তার প্রভৃতিকে সাক্ষী করে দাঁড় করালেন; কিন্তু দেশের লোক তাঁকে চায় না, তারা চায় কুমার শঙ্কর সিংকে। তার একটা কারণ, মাতাল লম্পট হলেও কুমার শঙ্করের প্রাণটা ভারি দরাজ, আর উদিত সিং দুর্দান্ত অত্যাচারী। এত বড় কুরপ্রকৃতি স্বার্থপর ভোগবিলাসী লোক খুব কম দেখা যায়।

দেশে নিজের পরিপোষক না পেয়ে উদিত সিং গোপনে গোপনে ইংরাজ গভর্নমেন্টকে নিজের দাবি জানিয়ে দরখাস্ত করলেন। কিন্তু ভারত সরকারও সেদিকে কর্ণপাত করলেন না; দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাঁরা কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবেন না বলে জানালেন। ওদিকে সুবিধা করতে না পেরে কুমার উদিত অন্য রাস্তা ধরলেন।

এদিকে কুমার শঙ্করের অভিষেকের আয়োজন হতে লাগল। সমস্ত ঠিক, স্বয়ং ইংলণ্ডেশ্বরের কাছ থেকে রাজকীয় অভিনন্দন পত্র পর্যন্ত এসে উপস্থিত —এমন সময় এক অচিন্তনীয় ব্যাপার ঘটল; যখন অভিষেকের আর দশদিন মাত্র বাকি, তখন কুমার শঙ্কর সিং নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। সেইসঙ্গে একজন আমাণী ব্যবসাদারের সুন্দরী স্ত্রীকেও খুঁজে পাওয়া গেল না। চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল।

অভিষেক পিছিয়ে গেল। তারপর মাসখানেক পরে যুবরাজ রাজ্যে ফিরে এলেন।

আবার অভিষেকের দিন স্থির হল এবং এবারও নির্দিষ্ট দিনের এক সপ্তাহ আগে কুমার হঠাৎ গা-ঢাকা দিলেন। এবার তাঁর সঙ্গিনী একটি বিবাহিতা কাশ্মীরী সুন্দরী।

বারবার দুবার এই রকম বিশ্রী কাণ্ড দেখে দেশসুদ্ধ লোক কুমার শঙ্করের ওপর চটে গেল। ইংরাজ গভর্নমেন্টও জানালেন যে, ভবিষ্যতে যদি ফের এইরূপ হাস্যকর অভিনয় হয়, তাহলে তাঁরা কুমার উদিতের দাবি গ্রাহ্য করে তাঁকেই সিংহাসনে বসাবেন।

আপনারা বুঝতেই পারছেন যে, এ সমস্ত কুমার উদিতের কারসাজি। সোজাপথে বিফল হয়ে তিনি চেষ্টা করছেন–বড় রাজকুমারকে দায়িত্বশূন্য অপদার্থ প্রতিপন্ন করে নিজের দাবি পাকা করতে। সত্য বলতে কি, কিয়ৎ পরিমাণে কৃতকার্য হয়েছেন। এরই মধ্যে দেশে একদল লোক দাঁড়িয়েছে, যারা উদিত রাজা হলেই বেশী খুশি হয়।

আমাদের মত যারা ন্যায্য অধিকারীকে সিংহাসনে বসাতে চায়, তাদের অবস্থা একবার ভেবে। দেখুন। একদিকে উজ্জ্বল রাজকুমার—সরল, সাহসী, কাণ্ডজ্ঞানহীন, কিছুতেই পরোয়া নেই অপরদিকে কূটচক্রী রাজ্যলোলুপ তাঁর ছোট ভাই। বাবুসাব, আমি ঝিন্দের রাজপরিবারের বংশগত ভৃত্য, বৃদ্ধ মহারাজ ভাস্কর সিং মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আমার হাত ধরে বলে গিয়েছিলেন, যেন কুমার শঙ্করকে গদীতে বসাই। মুমূর্ষ রাজার সে হুকুম আমি ভুলিনি। আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম, যেমন  করে পারি শঙ্কর সিংকে সিংহাসনে বসাব।

তাই, বৃদ্ধ দেওয়ান বজ্ৰপাণির সঙ্গে পরামর্শ করে শেষ বার রাজ্যাভিষেকের দিন স্থির করলাম। আগামী ২৩শে আশ্বিন হচ্ছে সেইদিন, অর্থাৎ আজ থেকে সাত দিন মাত্র বাকি। দিন স্থির করে যুবরাজের মহালের চারিদিকে পাহারা বসালাম। জেলখানার কয়েদীকেও বোধ হয় এত সতর্কভাবে পাহারা দিতে হয় না। মহালের মধ্যে তিনি যখন যেখানে যান সঙ্গে লোক থাকে, বাইরে যেতে চাইলে দশজন সওয়ার নিয়ে আমি সঙ্গে থাকি।

যুবরাজ প্রথমটা কিছু বলতে পারলেন না, কিন্তু ক্রমে আমাকে ডেকে নানারকম ভর্ৎসনা তিরস্কার আরম্ভ করে দিলেন। আমি অটল হয়ে রইলাম, বললাম— যুবরাজ, তোমাকে সিংহাসনে বসিয়ে তবে মুক্তি দেব, তার আগে নয়। তিনি আমাকে অনেক আশ্বাস দিলেন যে, এবার কিছুতেই রাজ্য ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু আমি তাঁর দুর্বল চিত্ত জানতাম, কিছুতেই রাজী হলাম না।

এই সময় কুমার উদিত একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন; দুইভায়ে বাহিরে বেশ সৌহার্দ্য ছিল— তার কারণ আপনারা বুঝতেই পারছেন; সুন্দরী স্ত্রীলোকের লোভ দেখিয়ে উদিত বড় ভাইকে বশ করে রেখেছিলেন। স্বার্থ সাধনের উদ্দেশ্যেই যে উদিত তাঁকে ব্যভিচারের পথে নিয়ে যাচ্ছে, একথা গোঁয়ার শঙ্কর সিং বুঝেও বুঝতেন না।

উদিতকে আসতে দেখে আমি ভারি ভয় পেয়ে গেলাম। দুইভায়ে কি কথা হল জানি না; কিন্তু উদিত চলে যাবার পরই আমি প্রহরীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিলাম এবং স্বয়ং রাজকুমারের ঘরের দরজায় পাহারা দেব স্থির করলাম।

কিন্তু কিছুতেই তাঁকে ধরে রাখা গেল না—পরদিন সকালে দেখলাম পাখি উড়েছে। কিস্তার জলে নৌকার বন্দোবস্ত ছিল, কুমার শোবার ঘরের জানালা থেকে জলে লাফিয়ে পড়ে, সেই নৌকায় চড়ে অন্তহিত হয়েছেন।

এবার আর ব্যাপারটা জানাজানি হতে দিলাম না। পাহারা যেমন ছিল তেমনই রইল। মহালে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না—এই হুকুম জারি করে দিয়ে আমি যুবরাজকে খুঁজতে বেরুলাম। দুদিন সন্ধান করবার পর খবর পেলাম যে, তিনি কলকাতায় এসেছেন।

তখন আমার অধীনস্থ একজন বিশ্বস্ত সেনানী সর্দার রুদ্ররূপকে আমার জায়গায় বসিয়ে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। রাজ্যে রটিয়ে দেওয়া হল যে, কুমারের শরীর অত্যন্ত খারাপ, তাই তিনি কারুর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।

আজ দুদিন হল আমি কলকাতায় এসেছি। এসে পর্যন্ত চারিদিকে কুমারের খোঁজ করে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কোথাও তাঁর সন্ধান পাচ্ছি না। এতবড় শহরে একজন লোককে খুঁজে বার করা সহজ কথা নয়, এদিকে অভিষেকের দিনও ক্রমে এগিয়ে আসছে।

কুমার শঙ্কর খুব মিশুক লোক, তাই এ শহরে যত বড় বড় ক্লাব আছে, সেইসব ক্লাবে কুমারের খোঁজ নিলাম, তারপর বড় বড় হোটেলে তল্লাস করলাম কিন্তু কোথাও কোনো ফল পেলাম না। বুক দমে গেল। তবে কি মিথ্যা খবর পেয়ে এতদূর ছুটে এলাম! যুবরাজ কি এখানে আসেননি?

আজ বৈকাল বেলা নিতান্ত হতাশ হয়েই একটা ট্যাক্সিতে চড়ে আপনাদের এই লেকের চারধারে ঘুরছিলাম আর ভাবছিলাম, এখন কি করা যায়? এমন সময়ে হঠাৎ আমার নজর পড়ল, একটি যুবাপুরুষ একখানা প্রকাণ্ড বাড়ির সামনে মোটর থেকে নামছেন।

এই পর্যন্ত বলিয়া ধনঞ্জয় চুপ করিলেন, তারপর গৌরীশঙ্করের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন—সে যুবাপুরুষটি আপনি?

শ্ৰোতৃযুগল এতক্ষণ তন্ময় হইয়া গল্প শুনিতেছিলেন, চমক ভাঙ্গিয়া গৌরী বলিল— ক্লাবের সামনে আমাকে নামতে দেখে থাকবেন।

ধনঞ্জয় ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন— হ্যাঁ, ক্লাবের সামনেই বটে। আপনাকে দেখে আমি প্রথমটা হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম, তারপর এক লাফে ট্যাক্সি থেকে নেমে আপনার অনুসরণ করলাম।

আপনি তখন ক্লাবের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। আমি দারোয়ানকে বললাম— কুমার শঙ্কর সিংহের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই— তাঁকে খবর দাও।

দারোয়ান বললে–শঙ্কর সিং বলে কাউকে সে চেনে না। আমি একটা তাড়া দিয়ে বললাম— এইমাত্র যিনি এ বাড়িতে ঢুকলেন তিনিই শঙ্কর সিং— শীঘ্র আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চল।

দারোয়ানটা হেসে বললে— আপনি ভুল করছেন; যিনি এইমাত্র এলেন তাঁর নাম জমিদার বাবু গৌরীশঙ্কর রায়।

আমি বললাম-কখনই না। তিনি শঙ্কর সিং-আমি স্বচক্ষে তাঁকে এখানে ঢুকতে দেখেছি। দারোয়ান বললে—হুজুর, বিশ্বাস না হয় সেক্রেটারি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করুন। বলে আমাকে সেক্রেটারির ঘরে নিয়ে গেল।

সেক্রেটারিবাবুটি অতি ভদ্রলোক। তিনি আমার কথা শুনে বললেন–শঙ্কর সিং বলে ক্লাবের কোনো সভ্য নেই, তবে কোনো সভ্যের বন্ধু হিসাবে ক্লাবে এসে থাকতে পারেন। বিশেষত আজ ক্লাবে তলোয়ার খেলার একটা প্রদর্শনী আছে— তাই বাইরের লোকও অনেক এসেছেন। এই বলে তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাবের ভিতরে গেলেন। একটি হলে অনেক লোক জমা হয়েছিল এবং তারই মাঝখানে তলোয়ার খেলা চলছিল। সেক্রেটারিবাবু আমাকে বললেন দেখুন দেখি, আপনার শঙ্কর সিং এখানে আছেন কি না।

প্রথম দৃষ্টিতেই চিনতে পেরেছিলাম, যে দুজন লোক তলোয়ার খেলছেন, শঙ্কর সিং তাঁদেরি একজন। আমি আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম—ঐ শঙ্কর সিং।

সেক্রেটারিবাবু হেসে উঠলেন— আপনি ভুল করেছেন। উনি গৌরীশঙ্কর রায়, আমাদের ক্লাবের একজন সভ্য।

আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এও কি সম্ভব! পৃথিবীতে দুজন লোকের কি এক রকম চেহারা হয়? না—এরা সকলে মিলে আমাকে ঠকাবার চেষ্টা করছে?

গৌরীশঙ্কর আস্তে আস্তে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল। ধনঞ্জয় তাহার মুখের উপর দৃষ্টি স্থাপন করিয়া বলিলেন— ব্যাপারটা বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন? অমন অদ্ভুত সাদৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি, এ যে হতে পারে তা কখনো কল্পনা করিনি। আপনার শরীরে এমন কোনো স্থান নেই যা অবিকল শঙ্কর সিংয়ের মত নয়। এমন কি আপনার গলার আওয়াজ পর্যন্ত হুবহু তাঁর মত। সৃষ্টির এ যেন এক অদ্ভুত প্রহেলিকা! অন্তত তখন আমার তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু আপনাদের এই ঘরে ঢুকে আমার মনে হচ্ছে যেন সে প্রহেলিকার উত্তর পেয়েছি। বলিয়া তিনি দেয়ালে লম্বিত কালীশঙ্করের ছবিখানার দিকে চোখ তুলিয়া চাহিলেন।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত সকলে নীরব হইয়া রহিলেন। তারপর দুইভায়ের বুক হইতে বহুক্ষণের নিরুদ্ধ নিশ্বাস সশব্দে বাহির হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *