০২. দ্য স্কার
হ্যারির হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙে গেল। চিৎ হয়ে চোখে হাত চাপা দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। যেন অনেকটা পথ অসম্ভব জোরে দৌড়ে হাঁফিয়ে পড়েছে…। ও হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরল। কপালে বিদ্যুৎ চমকানোর আঁকা–বাঁকা কাটা দাগটা অসম্ভব ব্যথা নয় শুধু জ্বালাও করতে লাগল। মনে হল এক অদৃশ্য একটা গরম সাদা তার ওর গায়ে চেপে ধরেছিল।
কপালের দাগটা এক হাতে চেপে অন্য হাতে অন্ধকারের মধ্যে চশমাটা খুঁজতে লাগল। চশমাটা ওর শোবার খাটের পাশে টেবিলের ওপর রেখে শুয়েছিল। চশমাটা পরার পর ঘরটা তেমন অন্ধকার মনে হল না। পর্দা ঢাকা জানালার ফাঁক দিয়ে কমলা রঙের রাস্তার আলো ঘরে এসে পড়েছে।
হ্যারি টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে কপালের কাটা দাগে চাপ দিতে লাগল। ব্যথা তখনও কমেনি, মাঝে মাঝে দপদপ করছে। তারপর ও লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের এক কোণে রাখা আলমারি খুলে আলমারির পাল্লায় ফিট করা আয়নাতে মুখটা দেখল। বছর চৌদ্দ বয়স, মুখ পাতলা, গোল হাঁটু, কালো চুল… উজ্জ্বল দুই সবুজ চোখ। গোল গোল কাঁচের চশমা। হ্যারি নিয়ম করে চুল আঁচড়ায় না। ও আয়নাতে কপালের কাটা দাগটা খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। ব্যথা আর চুলকানি।
হ্যারি ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগে কী স্বপ্ন দেখেছিল ভাবতে চেষ্টা করল।… স্বপ্নটা যেন সত্যি… তিনজন লোক… তাদের মধ্যে ও দুজনকে চেনে… অচেনা লোকটিকে মনে করবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।
গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঘর ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। ঘরের মধ্যে এক বিরাট সাপ নোংরা–ময়লা কার্পেটে শুয়ে আছে। বেঁটে লোকটা পিটার, সকলে ওকে ওয়ার্মটেল বলে ডাকে।… কানে এল বরফ শীতল এক কণ্ঠস্বর… কণ্ঠস্বর লর্ড ভোল্ডেমর্টের। ওর সেই স্বপ্নের কথা ভাবতেই মনে হল কে যেন ওর পাকস্থূলীর মধ্যে একগাদা বরফের ছোট ঘোট টুকরো পুরে দিয়েছে।
ও দুচোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করল ভোল্ডেমর্ট কেমন দেখতে, কিন্তু মনে করতে পারলো না… এইটুকু মনে করতে পারলে ভোল্ডেমর্টের চেয়ারটা যখন দুলছিল, তখন কেউ যেন সেই চেয়ারে বসেছিল; সেই দৃশ্য দেখে, দারুণ ভয় পেয়ে ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সেই ভয়ার্ত দৃশ্য দেখে ওর কাটা দাগে যন্ত্রণা আর জ্বালাতে ওর ঘুম ভেঙেছে।
কিন্তু স্বপ্নের সেই আধপঙ্গু বৃদ্ধ মানুষটি কে?… হা হ্যারি তাকে দেখেছে, হ্যারি ওকে মেঝেতে ধপাস করে পড়ে যেতে দেখেছে। সব কিছু যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। হ্যারি দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল। সেই স্বপ্নের দৃশ্য মন থেকে হটিয়ে নিজের ঘরের কথা ভাবতে লাগল। ঘরটা তখনও অন্ধকার। কিন্তু ও হাজার চেষ্টা করেও সেই দৃশ্য মন থেকে সরাতে পারছে না। অনেকটা হাতের তালুতে জল ধরে রাখার প্রয়াসের মতো।… ভোল্ডেমর্ট আর ওয়ার্মটেল একজনকে হত্যা করেছে তার সম্বন্ধে কথাবার্তা বলছে… যাকে হত্যা করেছে কিছুতেই তার নাম মনে আসছে না।… তাছাড়া ওরা আরও একজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল… কিন্তু সে কে?… কাকে… ও কে।
হ্যারি হাত সরিয়ে বন্ধ চোখ দুটো খুলল। অন্ধকার ঘরে… কিছু যেন অস্বাভাবিক জিনিস দেখার প্রত্যাশা করতে লাগল।… ওর বিছানার পায়ের কাছে একটা ভোলা ট্রাঙ্ক, ট্রাঙ্কের মধ্যে রয়েছে একটা কলড্রন, ঝাড়ু, কাল রঙের একটা রোবস আরও কিছু বাছাবাছা জাদুমন্ত্রের বই।… ওর টেবিলের একধারে পড়ে রয়েছে একগাদা গোল করে রাখা পার্চমেন্ট পেপার… যে তাঁচাতে ওর প্যাঁচা হেডউইগ থাকে সেটা শূন্য। ঘরের মেঝেতে একটা বই পড়ে রয়েছে। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ার সময় বইটা হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। বইটার দিকে তাকাতেই দেখল বই-এর ছবিগুলো স্থির নয়, নড়ছে। ঝাড়ুর মধ্য থেকে কিছু লোক উঁকি মারছে। তাদের পরনে উজ্জ্বল কমলা রঙ-এর পোশাক। ওরা একটা লাল বল লোফালুফি করছে।
হ্যারি বইটা তুলে নিল। দেখল একজন কিডি প্লেয়ার প্রায় পঞ্চাশ ফুট হাই হুপের মধ্য দিয়ে বলটা ফেলে অদ্ভুত সুন্দর একটা গোল করল। তারপর ও বইটা শব্দ করে বন্ধ করে দিল। হ্যারির কাছে সবচেয়ে প্রিয় খেলা কিডিচ। তা হলেও ওর স্বপ্নের দেখা দৃশ্যের বিক্ষিপ্ত মন কিছুতেই শান্ত হল না। ও ফ্লাইং উইথ ক্যানন্স বইটা ওর টেবিলের ওপর একপাশে রেখেছিল।… তারপর জানালার ধারে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল।
শনিবারের ভোর। শহরতলির উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরা প্রিভেট ড্রাইভে বাস করে। ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। আশেপাশে সব বাড়িতে জানালায় পর্দা ফেলা। রাস্তাটা জনমানব শূন্য। একটা কুকুর বা বেড়াল দেখতে পেলো হ্যারি।
হ্যারির মন অসম্ভব চঞ্চল। কোনো কিছু ভেবে মাথা থেকে সেই স্বপ্নের দৃশ্য অপসারিত করতে পারছে না। ও ছটফট করতে করতে বিছানার ওপর বসল। কপালের কাটা দাগে আঙ্গুল বোলাতে লাগল। কপালের কাটা দাগে ব্যথাতে ও কাবু নয়। ব্যথা করে মাঝে মাঝে। একবার ওর ডান হাতের সব হাড়গুলো ভেঙে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল… এক রাতের মধ্যেই হাড়গুলো নতুনভাবে গজিয়ে ব্যথার অবসান হয়েছিল। আরেকবার সেই হাতটা খেলতে খেলতে তীক্ষ্ণ বর্শার ফলকে বিদ্ধ হয়েছিল–সেরেও গেছে। গতবছরে তো ঝাড়ু নিয়ে আকাশে ওড়ার সময় পঞ্চাশ ফুট উঁচু থেকে পড়ে গিয়েছিল। ওইসব দুর্ঘটনা, আঘাতেও অভ্যস্ত… সেগুলোতে ঘটবেই… রোধ করা যাবে না। হোগার্ট উইচক্র্যাক্ট এ্যান্ড উইজার্ডরি স্কুলে পড়তে গেলে ওইসব বিপদ–আপদ মেনে নিতে হবে। এসব ওর ধাতস্থ হয়ে গেছে।
গতবার ভোল্ডেমর্ট কাছে থাকায় কাটা দাগের জন্য যন্ত্রণা হয়েছিল, কিন্তু এখন তো ভোল্ডেমর্ট প্রিভেট ড্রাইভে নেই–তবে কেন ব্যথা! কিন্তু ভোল্ডেমর্ট তো এখানে আসতে পারে না, ভোল্টেমর্টের প্রিভেট ড্রাইভের আশেপাশে ঘুরে বেড়ান একদম অসম্ভব ব্যাপার।… ভোর্টে তো নেই… তবে ওকে জড়িয়ে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখল কেন?
হ্যারি চতুর্দিকে নীরবতার মাঝেও যেন কিছু শোনার প্রতীক্ষায় রয়েছে। ও কী একটা সিঁড়ি ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনবে না আলখেল্লাতে হাওয়া লেগে বোঁ বোঁ, পৎ পৎ শব্দ শুনবে? তারপর পাশের ঘরে আন্টির পুত্র নিদ্রারত ডাডলির প্রচণ্ড নাক ডাকার শব্দ। হ্যারি সেই শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠল।
নীরবতা ভঙ্গ করে সরবতার আশা করা–ভেবে হ্যারি নিজেকে একটা আস্ত বোকা বা মূর্খ মনে হল। বাড়িতে রয়েছেন আঙ্কেল ভার্নন, আন্টি পেটুনিয়া আর তাদের ছেলে ডাডলি। ওরা তো তখনও ঘুমুচ্ছে। ওরা তো হ্যারির মত বীভৎস স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে না, ব্যথা যন্ত্রণা হীন সুখ নিদ্রায় সুখস্বপ্ন!
ডার্সলে পরিবার ঘুমিয়ে থাকলে হ্যারির অনেক শান্তি! ওরা জেগে থেকে তো হ্যারিকে কোনও সাহায্য করবে না। তাহলেও হ্যারির জীবিত আত্মীয় বলতে ওরা তিনজন। ওরা মাগল (যারা জাদুকর নয়)। ওরা প্রচণ্ডভাবে জাদুবিদ্যাকে ঘৃণা করে, পরিহার করে চলে। তোঁ হ্যারি ম্যাজিক স্কুলে পড়ে, বাবা-মাও জাদুকর–জাদুকরী ছিল, তাই ভার্নন পরিবারে ও শুকনো পাতার মতো অনাহুত। ডার্সলে পরিবার পারতপক্ষে হ্যারি হোগার্টসে পড়াশুনা করে কাউকে জানাতে চায় না। বলে, হ্যারি সেন্ট ব্রুটাস লিকিউ সেন্টারে ফর ইনকিউবেরল ক্রিমিন্যাল বয়েজের স্কুলে থাকে। গত তিন বছর ধরে সেখানে আছে। ভার্নন জানে ওর মতন বয়সের ছেলেদের জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করা অন্যায়-একমাত্র স্কুলে যা করতে পারে। তাহলেও তাদের সংসারে যা কিছু ঘটুক না কেন তার জন্য দায়ী করে হ্যারিকে। অলক্ষুণে হ্যারি বাড়িতে আছে বা থাকে বলেই বাড়িতে নানা অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানা হয়। হ্যারি অবশ্য ওর স্কুলের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে আঙ্কেল ভার্নন বা আন্টি পেটুনিয়াকে কিছুই জানায় না বা তাদের সঙ্গে তা নিয়ে বচসা করে না। তাই ওরা ঘুম থেকে ওঠার পর ওর কাটাদাগে ব্যথা ভোল্ডেমর্ট সম্বন্ধে উদ্বেগ… জানানোর কোনও মানে হয় না। হাস্যকর!
তাহলেও ভোল্ডেমর্টের উৎপাতের জন্য হ্যারিকে ডার্সলে পরিবারে এসে থাকতে হয় স্কুল ছুটির সময়। তাহলেও হ্যারির বাবা-মার মৃত্যুর পর হ্যাগ্রিডের সাহায্যে ও অনেক গ্যালিয়ন, সিকেল পেয়েছে। ডার্সলেদের ওর জন্য কিছু খরচ করতে হয় না। তাহলেও ডার্সলে দম্পতি হ্যারিকে গ্রহণ করলেও আদরযত্ন করে না, ওর ঘুমোবার জন্য ভাই ডাডলির পাশে ছোট একটা ঘর, ডাডলির পরিত্যক্ত পুরনো কাপড় পরে ওকে থাকতে হয়।
হ্যারির যখন এক বছর বয়স… একদিন রাতে ভোল্ডেমর্ট শক্তিশালী ডার্ক জাদুকর, যে এগার বছর চেষ্টা করে নানা অসৎ উপায়ে শক্তি লাভ করে, ওদের বাড়িতে এসে ওর বাবা-মাকে হত্যা করে ছিল। তারপর ও জাদুদণ্ড হ্যারির দিকে ঘোরায়। যে জাদুমায়ায় ভোল্ডেমর্ট ছোট ছেলেটার মা-বাবাকে হত্যা করার পর বাচ্চা ছেলেটাকে হত্যা করতে আসে সেটা বুমেরাং হয়ে ভোল্টেমর্টের কাছে ফিরে যায়। হ্যারি বেঁচে যায়–থাকে শুধু কপালের কাটা দাগ, ভোল্ডেমর্ট বলতে গেলে নামমাত্র বেঁচে থাকে। ওর ক্ষমতা নিঃশেষ হয়, জীবনের সবকিছু নিভে যায়। এরপর ও পালিয়ে যায়। যার ভয়ে ও আতঙ্কে জাদুকর–জাদুকরী সম্প্রদায় গোপনে দিন যাপন করছিল তার অবসান হয়। ভোমের্টের সহচরদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, তারপর হ্যারি পটারের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ওর যখন এগার বছর বয়স তখন জানতে পারে, ও জাদুকর সম্প্রদায়ের একজন। হ্যারি যখন হোগার্ট জাদু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন ও আশ্চর্য হয়ে যায় সকলে তার নাম জানে। যেখানেই যায় সেখানে সকলে ওকে দেখে গুঞ্জন করে। এসব দেখেশুনে এখন ওর সবকিছু অভ্যাস হয়ে গেছে। এ বছর গরমের ছুটির পর ও হোগার্টের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়বে; স্কুল খোলার অপেক্ষায় বসে আছে। আঙ্কেল ভার্নন, পেটুনিয়াদের ওর একটুও ভাল লাগে না।
এখনও আরো পনের দিন ওকে ডার্সলে পরিবারে থাকতে হবে। ও বিরক্তি মাখা মুখে ঘরে পায়চারি করতে করতে ওর দুই বন্ধুর পাঠানো জন্মদিনের শুভেচ্ছা কার্ডের দিকে চোখে পড়ে। গত জুলাই মাসে কার্ড দুটো এসেছে। ও যদি এখন গত রাতের দুঃস্বপ্ন আর কপালে কাটা দাগের যন্ত্রণা ও জ্বালার কথা দুই বন্ধুকে লিখে পাঠায় তাহলে বন্ধুরা কি বলবে?
তখনই ও শুনতে পেল কানের কাছে হারমিওন গ্রেঞ্জাবের কথা। শোনার পর ওর মাথা জমে গেল–শিহরিত, আতঙ্কগ্রস্ত হল।
তোমার কপালের কাটা দাগে ব্যথা? হ্যারি তাই যদি হয় তাহলে সত্যিই সেটা মারাত্মক… অবশ্যই মারাত্মক। তুমি প্রফেসর ডাম্বলডোরকে লিখবে! আমি সেখানে যাব ও কমন মেডিক্যাল এলমেন্টস অ্যান্ড অ্যাফ্লিকসন কথা বলব… এমনও হতে পারে জাদুর বিদ্যার জন্য কাটাদাগে অস্বস্তি ও ব্যথা।
হ্যারি একটা বই নিয়ে পড়বার চেষ্টা করে, কিন্তু বইয়ের পাতায় মন দিতে পারে না। তারপরে জানালার ধারে দাঁড়ায়–আকাশের দিকে তাকায়।
আকাশের রংটা হালকা নীল। ভোল্ডেমর্ট হিংসাবশত: ও পরাজয়ের পর ওর বাবা-মাকে হত্যা করেছে, এখন ওকে হত্যা করতে চাইছে? সে তাদের পরিবারের সে একমাত্র জীবিত ও সকল সময়েই ভোল্টেমর্টের দ্বারা আক্রান্ত। হারমিওনের কথামত কমন ম্যাজিক্যাল এলমেন্টস অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশনে ওর এই অসুখ সম্বন্ধে কিছুই পাওয়া যাবে না। হেডমাস্টার ডাম্বলডোরকে গরমের ছুটিতে পাওয়া যাবে কি যাবে না সে সম্বন্ধে নিশ্চিত নয়। ভাবতে ভাবতে ওর স্কুলের হেডমাস্টার প্রফেসর ডাম্বলডোরের সৌম্য চেহারাটা চোখে ভেসে ওঠে। মুখ শুভ্র লম্বা দাড়ি বুক পর্যন্ত ঝুলে পরেছে পরণে ঢোলা ঢোলা জাদুকরদের আলখেল্লা, লম্বা টুপি, নাকে সানট্যান লোসন লাগান। ডাম্বলডোর যেখানেই থাকুন না কেন হেডউইগ তাকে ঠিক খুঁজে বার করবে। ওর বিশ্বস্ত প্যাঁচা আজ পর্যন্ত কোনও কাজে অকৃতকার্য হয়নি। এমনকি ঠিকানা না দিয়ে শুধু নাম লিখে চিঠি পাঠালেও পৌঁছে দেয়। কিন্তু কি লিখবে সেটাই একমাত্র প্রশ্ন!
প্রিয় প্রফেসর ডাম্বলডোর,
আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, কিন্তু কেন জানি না সকাল থেকেই আমার কপালের কাটা দাগটা ব্যথা করছে, জ্বালা করছে।
আপনার অনুগত
হ্যারি পটার
চিঠিটা লেখার পর হ্যারির মনে হলো বড়ই বোকাবোকা চিঠি। তাই ও তার অপর এক বন্ধু রনের মতামত জানার জন্য ব্যগ্র হলো। ওর প্রিয় বন্ধু রন উইসলি। রনের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। লম্বা নাক, সারা মুখে ঈষৎ হলুদে তিল। মুখে হতবুদ্ধির ছাপ।
তোমার কপালের কাটা দাগের ব্যথা? কি… কিন্তু ইউ–নো–হু কেমন করে এখন তোমার কাছে আসবে, আসতে পারে কী? আমি মনে করি তুমি সবই তো জান তাই না? ও তোমাকে আবার আঘাত হানার চেষ্টা করছে–তাই না? আমি কি বলতে পারি হ্যারি, মনে হয় কপালের কাটা সব সময় ওই রকম হয়… আচ্ছা আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করব…
ওর বাবা মি. উইসলি একজন বিচক্ষণ জাদুকর। জাদু মন্ত্রণালয়ে মিসইউজ অফ মাগল আর্টফ্যাক্টস অফিসে কাজ করেন; কিন্তু সে সম্বন্ধে তার কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতাই নেই… হ্যারি এইটুকু জানে। হ্যারি অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল ওর কপালে কাটা দাগের ব্যাপারে উইসলি পরিবারে সমস্ত ব্যাপারটা জানানো ঠিক হবে না। মিসেস উইসলি হারমিওনের চাইতে বেশি হই চই করে উঠবেন। জর্জ ও ফ্রেড রনের ষোল বছর বয়সী দুই যমজ ভাই স্বভাবমত হাসাহাসি করবে। ভাববে হ্যারি দারুণ ভয় পেয়েছে। পৃথিবীতে শুভাকাক্ষী–বন্ধু বলতে হ্যারির কাছে উইসলি পরিবার। ও অপেক্ষায় আছে যেকোনও সময়ে ওরা ওকে তাদের কাছে গ্রীষ্মের ছুটির বাকি কটা দিন কাছে থাকার নেমন্তন্ন করবেন (রন কিছুদিন আগে কিডিচ ওয়ার্ল্ড কাপ সম্বন্ধে লিখেছে)। হ্যারি ওর আনন্দমুখর দিনগুলো তার কাটা দাগের বিষয় জানিয়ে নষ্ট করে দিতে চায় না।
ও এমন কোনও মানুষ পাচ্ছে না যাকে ও বাবা-মার মতো আপনজন ভেবে ওর দুঃস্বপ্ন আর কাটা দাগের ব্যথা ও যন্ত্রণা সম্বন্ধে জানাতে পারে, জেনে, তারা সান্ত্বনা দেবে। জন্য কাঁদের ডার্ক ম্যাজিক সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা আছে হ্যারি জানে না।
তখনই সিরিয়সের কথা মনে পড়ে গেল। একমাত্র গডফাদার সিরিয়স ওকে সাহায্য করতে পারে তার বুদ্ধি–বিবেচনা অভিজ্ঞতা ও ভালবাসা দিয়ে। হ্যারি বিছানা থেকে উঠে একটা মোটা হলুদ শক্ত কাগজে (পার্চমেন্ট) কালিতে পালকের কলমটা অনেকটা সময় চুবিয়ে রেখে লিখল
প্রিয় সিরিয়স…. এইটুকু লিখে থেমে গেল। ভাবতে লাগল ওর সমস্যার কথা কেমন করে গুছিয়ে লিখবে। প্রথমে তো পিতৃবন্ধু সিরিয়সের কথা মাথায় আসেনি।… যাকগে পিতৃবন্ধু ছাড়া সিরিয়স ওর গডফাদার। মাত্র দুমাস আগে ব্যাপারটা জেনেছে।
সিরিয়স ওর কাছে সম্পূর্ণ এক অজানা মানুষ ছিলেন। তার প্রধান কারণ হ্যারি যখন হোগার্টে সিরিয়স তখন আজকাবানে বন্দি থাকার পর পলাতক। আজকাবান জাদুকরদের লোমহর্ষক ভয়ঙ্কর এক কয়েদখানা। এখানে অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেই কয়েদখানা পাহারা দেয় ডেমেন্টররা। ওদের চোখ নেই, রক্ত পিপাসু শয়তান। হোগার্টে ওরা সিরিয়সকে ধরতে এসেছিল। তখন থেকেই পলাতক। সকলেই জানে সিরিয়স কোনও অপরাধ করেনি, কাউকে হত্যা করেনি। ভোল্ডেমর্টের কারসাজিতে ও অপরাধী। আসল অপরাধী ও হত্যাকারী ছিল ওয়ার্মটেল ভোল্ডেমর্টের সব কুকর্মের সহচর। এখন সকলেই জানে ভোভের্ট বেঁচে নেই। হ্যারি, রন, হারমিওন কিন্তু বিশ্বাস করে না শয়তান তোভেমট মৃত। যাই হোক গত বছরে ওরা ওয়ার্মটেলের মুখোমুখি হয়েছিল। ওদের সঙ্গে ছিল প্রফেসর ডাম্বলডোর। ভোল্ডেমর্ট যে জীবিত প্রফেসর ডাম্বলডোর বিশ্বাস করেন, ও যে কোনও সময় অন্ধকার থেকে উদয় হয়ে জাদু মন্ত্রণালয়ের কিছু বিশ্বাসঘাতক ও তার শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ডাম্বলডোরকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবে।
কোনও এক সময়ে সিরিয়স হ্যারিকে ডার্সলে পরিবার থেকে নিয়ে গিয়ে ওর কাছে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হলো কই। ভোল্টেমর্টের ষড়ন্ত্রে ও হত্যার দায়ে আজকাবানে বন্দি হয়ে থাকার পর পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছে।
সিরিয়সের সঙ্গে থাকার সুযোগ আর নেই। হ্যারি অবশ্য ওকে বাকবিকের সাহায্যে আজকাবান থেকে পালাতে সাহায্য করেছিল। তারপর থেকেই সিরিয়স আন্ডারগ্রাউন্ডে। ওয়ার্মটেলও আজকাবান থেকে পালিয়ে সিরিয়সকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ডার্সলেদের কাছে সিরিয়সের আসার কোনও সম্ভাবনা নেই, কারণ ওরা জানে সিরিয়স আজকাবান থেকে পলাতক।
তাহলেও ও জানে সিরিয়স যেখানেই থাকুক হ্যারিকে বিপদের সময় সাহায্য করতে পারে। একমাত্র সিরিয়সের জন্যই ও ডার্সলে পরিবারে ওর স্কুলের সব জিনিসপত্র নিয়ে এসে ওর শোবার ঘরে রাখতে পেরেছে। ডার্সলেরা কখনই সেটা মনে–প্রাণে অনুমোদন করেনি। ওরা চায় তারি অসুবিধেতে থাকুক, কষ্ট পাক।… কিন্তু ডার্সলে দম্পতি আগে ওর স্কুলের জিনিসপত্র একটা ট্রাকে ভরে সিঁড়ির তলায় রেখে দিত। ওরা জানে ওর কাছে একটা জাদুদণ্ড আছে তা দিয়ে অনেক কিছু করতে পারে। যাতে সেটা ব্যবহার না করতে পারে তাই লুকিয়ে রাখত। কিন্তু যখন থেকে জেনেছে ভয়ঙ্কর খুনি সিরিয়স ওর গডফাদার তখন থেকে ওরা নরম হয়েছে, গরমের ছুটিতে এলে ট্রাঙ্কটা আর লুকিয়ে রাখে না। হ্যারি অবশ্য কখনও ওদের জানায়নি সিরিয়স ভাল লোক–খুনি নয়।
হোগার্ট থেকে প্রিভেট ড্রাইভে আসার পর হ্যারি সিরিয়সের কাছ থেকে দুটো চিঠি পেয়েছে। দুটি চিঠি পাচারা নিয়ে আসেনি জাদুকরদের প্রথামত। চিঠি দুটো দিয়ে গেছে রং–বেরং-এর বড় দুই ডানাওয়ালা একটা পাখি। হেডউইগ তাকে সিরিয়সের চিঠি আনতে দেখে কণামাত্র খুশি হয়নি। সেই পাখি উড়ে এসে ওর জলের পাত্র থেকে ঠোঁট ডুবিয়ে জল খাবে তাও পছন্দ করে না। হ্যারির সেই বিচিত্র রং-এর পাখি খুব ভাল লাগে। সেই পাখিগুলো ওকে পাম গাছ আর বিস্তীর্ণ বালুকা বেলা মনে করিয়ে দেয়। সিরিয়স চিঠি পাঠিয়ে কখনও জানায় না পাছে কেউ মাঝপথে আটকে না রাখে কিন্তু হ্যারির খুব ভাল লাগে, হ্যারি বিশ্বাস করে না ডেমেন্টররা প্রখর সূর্যের আলোতে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারবে। সেই কারণেই হয়তো এখন তারা দক্ষিণ অঞ্চলে থাকে। হ্যারি দুটো চিঠিই ওর খাটের বিছানার তলায় লুকিয়ে রেখেছে। দুটো চিঠিতেই হ্যারিকে লিখেছে, যদি কখনও দরকার পড়ে তো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
বেলা বাড়তে লাগল। টেবিল ল্যাম্পের আলো আর দরকার হয় না। সোনালী সূর্যের আলো এসে ঘর ঝলমলে করে দিল। আঙ্কেল ভার্নন আর আন্টি পেটুনিয়ার গলার স্বর শুনতে পেল হ্যারি। ডেস্কের মধ্যে পার্চমেন্ট পেপারে যে চিঠিটা সিরিয়সকে লিখেছে সেটা পাঠাবার আগে আর একবার পড়ল।
প্রিয় সিরিয়স,
আপনার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। পাখিটা বেশ মোটাসোটা আর বড়, তাই জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকতে ওর অসুবিধে হয়েছে। এখানকার খবর আগের মতোই। ডাডলি আরও মোটা হয়েছে। আন্টির বকুনিতে ডায়েট করছে। তাহলে কি হবে, গতকাল ওর ঘরে একগাদা ডানাট
দেখে খুব রেগে গেছেন। ধমকে
বলেছেন, কথামত না চললে
পকেটমানি কমিয়ে দেবেন।
তাই, কথাটা শুনে অসম্ভব
রেগে ওর প্লেস্টেশান জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ওটা দিয়ে কম্পিউটার গেম খেলা যায়। কি বোকা বলুন তো!
ও এখনও মন–মেজাজ ঠিক করে
রাখার বই, মেগাসিউটেলেসন
পার্ট থ্রি আনেনি। যাক
সে কথা, আমি বেশ ভাল আছি; তার প্রধান কারণ আপনি। আপনাকে আঙ্কেল–আন্টি খুব ভয়
পায়–আপনি চাইলে ওদের জাদুবলে বাদুড় বানিয়ে দিতে পারেন সেই আশঙ্কায়।
আজ ভোর রাতে অদ্ভুত–বিশ্রী–ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন দেখেছি। সেই স্বপ্ন দেখার পর আমার কপালের
দাগটা ব্যথা করছে, চুলকুনি থামছে না। গত বছর এমন হয়েছিল, তার কারণ ভোল্ডেমর্টের হোগার্টে
হঠাৎ আগমন। তবে আমার মনে হয় না এখন ও আমার কাছাকাছি থাকতে পারে–পারে কি? আপনার কি
মনে হয় কার্স করলে কাটা দাগ বছরের পর বছর কষ্ট দিয়ে চলবে? হেডউইগ এখন শিকারে গেছে, ও ফিরে এলে আমি
ওর পায়ে বেঁধে চিঠিটা আপনার কাছে পাঠাব, বাকবিককে আমার তরফ থেকে হ্যালো জানাবেন।
হ্যারি
চিঠিটা ও ডেস্কে রেখে দিল। হেডউইগ ফিরে এলে পাঠাবে। চিঠি লেখার পর ওর অশান্ত মন অনেকটা শান্ত হলো। ও চায় না কেউ ওর মুখ দেখে জানতে পারে ও ভয় পেয়েছে, অস্থির মনে হচ্ছে। আলমারি খুলে পোশাক বদলাবার জন্য পোশাক–আশাক নিয়ে নাইট ড্রেস পাল্টাল। আলমারি খোলার সময় ইচ্ছা করেই আয়নাতে মুখ দেখল না।