দ্বিতীয় যুবকের নাম মজিদ। আবদুল মজিদ। আবদুল মজিদের কাছে এলে তার বন্ধু-বান্ধবদের সময় ভালো কাটে এই তথ্য মজিদের ফুপু এবং ফুপা দুজনের কেউই জানেন না। তারা মজিদকে চেনেন এক জন অপদাৰ্থ, অকৰ্মণ্য স্বল্পবুদ্ধির মানুষ হিসেবে ইতোমধ্যেই চোর হিসেবে যার কিঞ্চিৎ অখ্যাতি রটেছে।
মজিদ ছোটাখাটো এক জন মানুষ। সাধারণত ছোটখাটো মানুষের স্বাস্থ্য ভালো হয়, মজিদের তা না। সে বেশ রোগা। স্কুলে তার নাম ছিল স্কু ড্রাইভার। এই বিচিত্র নামের তেমন কোন ইতিহাস নেই। স্কুলে প্রতিভাবান ছেলে হিসেবে তার খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা দুই-ই ছিল। তবে তার প্রতিভা পড়াশোনার খাতে বয় নি। তার প্রতিভার সবটাই ছিল অনুকরণে। সে যে কোন মানুষের চরিত্র একটি কথা বা ক্ষুদ্র একটি ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলতে পারত। আর পারত উল্টো কথা বলতে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উল্টো করে জবাব দিত এবং তা এত দ্রুত বলে দিত যে মনে হত সে এই ভাবেই কথা বলে। যেমন কেউ যদি বলত, কেমন আছিস মজিদ। সে বলত, লোভা, ইতু নমকে। অর্থাৎ ভালল, তুই কেমন?
তার উল্টো কথা বলার খ্যাতি স্কুলের হেড স্যারের কানেও পৌঁছেছিল। তিনি তাকে একদিন ডাকিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ তার উল্টো কথা বলার বিদ্যা পরখ করলেন এবং শেষ মেষ বললেন, তুই একটা অসাধারণ ছেলে। ভালো মতো পড়া লেখা করিস। আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলিস।
মজিদ ঘাড় কাত করে চলে এল তবে তার অসুবিধার কথা স্যারদের বা বন্ধু-বান্ধবদের কাউকে বলল না। যে দিন তার বাবা মারা গেল তার পরদিনও সে স্কুলে। এল এবং অন্যান্য দিনের চেয়েও অনেক বেশি হাসি তামাশা করতে লাগল। সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে গানটি সঠিক সুরে উল্টো করে গেয়ে সারা স্কুলে একটা হৈ-চৈ ফেলে দিল।
তার এত প্ৰতিভা তেমন কাজে লাগল না। মেট্রিক পরীক্ষায় পরপর দুবার ফেল করার পর মজিদের ফুপা তাকে তাঁর রেশন সপে ঢুকিয়ে দিলেন। বর্তমানে তার কাজ হচ্ছে চাল, চিনি এবং গম ওজন করা এবং তার ফুপা জমির সাহেবের কাছে গাল খাওয়া। জমির সাহেবের ধারণা মজিদের মতো বড় গাধা বাংলাদেশে আর জন্মে নি। ভবিষ্যতেও যে জন্মাবে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
ইদানীং তাঁর মনে হচ্ছে মজিদ শুধ যে গাধা তাই নয় খানিকটা হাত-টানের অভ্যাসও আছে। মাঝে-মধ্যে রেশন সপে চিনি কম পড়ছে। একবার কম পড়ল পাঁচ সের, আরেকবার তিন সের। তার কিছু দিন পর দেখা গেল আটার একটা বস্তা উধাও।
তিনি মজিদের হাতে একটা কোরাণ শরীফ দিয়ে বললেন, সত্যি কথা বল। হারামজাদা। সত্যি কথা না বললে তাকে খুন করে ফেলব। কস্তা গেল কোথায়?
মজিদ নিরীহ ভঙ্গিতে বলল, আমি জানি না।
হাতে কোরাণ শরীফ আছে, খবরদার মিথ্যা কথা বলবি না।
মিথ্যা কথা শুধু শুধু কেন বলব?
তুই বস্তা বিক্রি করে দিস নাই?
না।
সত্যি কথা বল।
বলেছি তো।
বস্তা কোথায় গেল তুই জানিস না?
জ্বি না।
জমির সাহেব আর রাগ সামলাতে পারলেন না, প্রচণ্ড একটা চড় কষলেন। মজিদ উলটে পড়ে গেল। মজিদের ফুপু বললেন, থাক বাদ দাও।
জমির সাহেব বললেন, বাদ দাও মানে? একটা আটার বস্তায় কত আটা থাকে তুমি জান? এই হারামজাদা আমাকে শেষ করবার জন্যে এসেছে। এই শোন, তুই এক্ষুনি বিদায় হ। এক্ষুনি। তোকে যেন এই বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি।
মজিদ মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বলল, জ্বি আচ্ছা।
জমির সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, আবার জ্বি আচ্ছা বলে? এত বড় সাহস আবার বলে জ্বি আচ্ছা।
তিনি আরেকটি চড় কষলেন। এই চড়ের জন্যে মজিদ প্রস্তুত ছিল বলে সে পড়ল না।
বেরিয়ে যা, এক্ষুনি বেরিয়ে যা। বিছানা বালিশ নিয়ে যা। চোরের চোর। আমার দোকান ফাঁক করে দিচ্ছে।
মজিদ বিছানা-বালিশ নিয়ে বের হয়ে গেল। রাতটা কাটাল রেশন সপের বারান্দায়। পরদিন যথারীতি কাজ করতে লাগল। রেশন কার্ডে দাগ দিয়ে দিয়ে জিনিস ওজন করা। জমির সাহেব কিছু বললেন না। মজিদকে বিদায় করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। তার জন্যে তাকে কোনো বেতন দিতে হয় না। মজিদ কোনো হাত খরচ চায় না। সাপ্তাহিক ছুটি চায় না। মাঝেমাঝে জমির সাহেব যখন নতুন কাপড় কিনে দেন সে এমন ভঙ্গি করে যেন নিজের সৌভাগ্য সে বিশ্বাস করতে পারছে না। নতুন কাপড় পড়ে প্রতিবারই সে ফুপা এবং ফুপুকে কদমবুসি করে।
ছলছল চোখে তাকায় যেন সে আনন্দে কেঁদে ফেলবে। ফুপা ফুপুর প্রতি তার ভক্তি শ্রদ্ধার কোনোরকম ঘাটতি দেখা যায় না। তবে রাতে ঘুমুতে যাবার আগে সে বেশ কয়েকবার বলে, ন রেক বলফে যার মানে খুন করে ফেলব।
আজ আশ্বিনের এই পূর্ণিমার রাতে মজিদের হাতে কোনো কাজ ছিল না। রেশন সপ শুক্ৰ, শনি এই দুই দিন বন্ধ থাকে। আজ হচ্ছে শনিবার।
মজিদ বারান্দায় বসেছিল। আকাশের চাঁদের দিকে তার চোখ ছিল না। সে তাকিয়ে ছিল তার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। গতকাল পাল্লার দড়ি ছিঁড়ে দশ কেজি ওজনের বাটখারা তার নখে এসে পড়েছে। নখ একেবারে থ্যাতলে গেছে। গাঁদা ফুলের পাতা চিবিয়ে নখে বেশ কয়েক বার দেয়া হয়েছে। লাভ হয় নি। বাঁ পা আজ খানিকটা ফুলেছে। যন্ত্ৰণাও হচ্ছে প্রচণ্ডা মজিদ দুহাতে বাঁ পা চেপে ধরে মুখ কুঁচকে বুড়ো আঙুলের নখটার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক এই সময় আলম বাইরের গেট থেকে ডাকল, এই মজিদ।
মজিদ মুখ না তুলেই বলল, রেভি য় (অর্থাৎ ভিতরে আয়)। আলম বলল, কী করছিস? মজিদ বলল, দেখছিস না কী করছি? পা ধরে বসে আছি। একেই বলে কপাল। নিজের পা নিজেকে ধরতে হয়।
আলম বলল, তোর পায়ে কী হয়েছে?
ছুকি না (কিছু না)।
চল বের হই।
বিনা বাক্য ব্যয়ে মজিদ উঠে দাঁড়াল। আলম তার অনেক দিনের বন্ধু। স্কুলে তারা এক সঙ্গে পড়েছে। তারা যখন রাস্তায় নামল ঠিক তখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ডি.সি. টেন ঢাকার আকাশে চক্কর দিচ্ছে। নামবার জন্যে ট্রাফিক কনট্রোলের অনুমতি চাচ্ছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার আকাশের জোছনা ফিকে হয়ে আসছে। অতি দ্রুত মেঘ জমছে। আশ্বিন মাসে মাঝে-মাঝে এ রকম হয়। অতি দ্রুত ঝড় এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এই ঝড়ের সঙ্গে কালবোশেখীর কিছুটা মিল আছে।
দুই বন্ধু রাস্তায় হাঁটছে। মজিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, লাশা।
আলম বিরক্ত গলায় বলল, উল্টো করে কথা বলিসনাতো, চড় খাবি।
আচ্ছা আর বলব না। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে—তুই আমাকে কোলে নিয়ে নে। অনেকদিন কারো কোলে উঠি না।
আলম হো হো করে হেসে উঠল।
মজিদও হাসছে।
দুই বন্ধু হাসাহাসি করে খানিকটা এগিয়ে যাক আমরা এই ফাঁকে ডি. সি. টেন বিমানের ভেতর থেকে একটু ঘুরে আসি। বিমানের এক জন যাত্রীর সঙ্গে এই গল্পের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। যাত্রীর নাম মির্জা করিম। এই গল্পে আমরা তাঁকে মির্জা সাহেব বলব।