রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি || ২। ৬৪ ||
উক্ত চতুঃষষ্টিতম শ্লোকের ব্যখ্যাকালে আমরা এ বিষয়ে আরও কিছু বলিব।
আমরা দেখিতেছি যে দ্বাদশ শ্লোকে হিন্দুধর্ম্মের প্রথম তত্ত্ব সূচিত হইয়াছে-আত্মার অবিনাশিতা। ত্রয়োদশ শ্লোকে দ্বিতীয় তত্ত্ব-জন্মান্তরবাদ। চতুর্দ্দশ, পঞ্চদশ, এবং ষোড়শ শ্লোকে তৃতীয় তত্ত্ব সূচিত হইতেছে-সুখদুঃখের অনাত্মধর্ম্মিতা ও অনিত্যত্ব। সাংখ্যদর্শনের ব্যাখ্যার উপলক্ষে আত্মার সঙ্গে সুখদুঃখের সম্বন্ধ পূর্ব্বে যেরূপ বুঝাইয়াছিলাম, তাহা বুঝাইতেছি।
“শরীরাদি ব্যতিরিক্ত পুরুষ। কিন্তু দুঃখ ত শারীরদিক; শারীরাদিতে যে দুঃখের কারণ নাই,-এমন দুঃখ নাই। যাহাকে মানসিক দুঃখ বলি-বাহ্য পদার্থই তাহার মূল। আমার বাক্যে তুমি অপমানিত হইলে, আমার বাক্য প্রাকৃতিক পদার্থ, তাহা শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা তুমি গ্রহণ করিলে, তাহাতে তোমার দুঃখ। অতএব প্রকৃতি ভিন্ন দুঃখ নাই, কিন্তু প্রকৃতিঘটিত দুঃখ পুরুষে বর্ত্তে কেন? “অঙ্গোহয়ম্পুরুষঃ। পুরুষ একা, কাহারও সংসর্গবিশিষ্ট নহে। (১ম অধ্যায়ে ২৫শ সূত্র।) অবস্থাদি সকল শরীরের, আত্মার নহে। (ঐ, ১৪ সূত্র)। “ন বাহ্যান্তরয়োরুপরজ্যোপরঞ্জকভাবোহপি দেশব্যবধানাৎ স্রুঘ্নাস্থপাটলিপুত্রস্থয়োরিব।” বাহ্য এবং আন্তরিকের মধ্যে উপরজ্য এবং উপরঞ্জক ভাব নাই; কেন না, তাহা পরস্পর সংলগ্ন নহে, দেশব্যবধানবিশিষ্ট, যেমন এক জন পাটলিপুত্র নগরে থাকে আর এক জন স্রুঘ্ন নগরে থাকে, ইহাদিগের পরস্পরের ব্যবধান তদ্রূপ।
তবে পুরুষের দুঃখ কেন? প্রকৃতির সংযোগই দুঃখের কারণ। বাহ্যে আন্তরিকে দেশব্যবধান আছে বটে, কিন্তু কোন প্রকার সংযোগই নাই, এমত নহে। এমন স্ফাটিক পাত্রের নিকট জবাকুসুম রাখিলে পাত্র পুষ্পের বর্ণবিশিষ্ট হয় বলিয়া, পুষ্প এবং পাত্রে এক প্রকার সংযোগ আছে বলা যায়, এ সেইরূপ সংযোগ। পুষ্প এবং পাত্র মধ্যে দেশব্যবধান থাকিলেও পাত্রের বর্ণ বিকৃত হইতে পারে; ইহাও সেইরূপ। এ সংযোগ নিত্য নহে, দেখা যাইতেছে; সুতরাং তাহার উচ্ছেদ হইতে পারে। সেই সংযোগ উচ্ছেদ করিলেই দুঃখের কারণ অপনীত হইল। অতএব সংযোগের উচ্ছত্তিই দুঃখনিবারণের উপায়, সুতরাং তাহাই পুরুষার্থ। “যদ্বা তদ্বা তদুচ্ছিত্তিঃ পুরুষার্থস্তদুচ্ছিত্তিঃ পুরুষার্থঃ (৬, ৭)।47
অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্ব্বমিদং ততম্।
বিনাশমব্যস্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্ত্তুমর্হতি || ১৭ ||
যাহার দ্বারা এই সকলই ব্যাপ্ত, তাহাকে অবিনাশী জানিবে। এই অব্যয়ের কেহই বিনাশ করিতে পারে না।১৭।
“যাহার দ্বারা” অর্থাৎ পরমাত্মার দ্বারা। এই “সকলই” অর্থাৎ জগৎ। এই সমস্ত জগৎ পরমাত্মার দ্বারা ব্যাপ্ত-শঙ্কর বলেন, যেমন ঘটাদি আকাশের দ্বারা ব্যাপ্ত, সেইরূপ ব্যাপ্ত।
যাহা সর্ব্বব্যাপী, তাহার বিনাশ হইতে পারে না; কেন না, যত কাল কিছু থাকিবে, তত কাল সেই সর্ব্বব্যাপী সত্তাও থাকিবে। যত কাল কিছু থাকিবে, তত কাল সেই সর্ব্বব্যাপী সত্তা সর্ব্বব্যাপীই থাকিবে। অতএব তাহা অব্যয়।আকাশ সর্ব্বব্যপী, আকাশের বিনাশ বা ক্ষয় আমরা মনেও কল্পনা করিতে পারি না। আকাশ অবিনাশী এবং অব্যয় । যিনি সর্ব্বব্যাপী, সুতরাং আকাশও যাঁহার দ্বারা ব্যাপ্ত, তিনিও অবিনাশী ও অব্যয়। কাজেই কেহই ইঁহার বিনাশসাধন করিতে পারে না।
এক্ষণে এই কথার দ্বারা আর কয়েকটি কথা সূচিত হইতেছে। সেই সকল কথা হিন্দুধর্ম্মের স্থূল কথা, এ জন্য এখানে তাহার উত্থাপন করা উচিত।
প্রথমতঃ এই শ্লোকের দ্বারা সিদ্ধ হইতেছে যে, ঈশ্বর নিরাকার, সাকার হইতে পারেন না। যাহা সাকার, তাহা সর্ব্বব্যাপী হইতে পারে না।সাকার ইন্দ্রিয়াদির গ্রায্য। আমরা জানি যে, ইন্দ্রিয়াদির গ্রায্য সাকার কোন সর্ব্বব্যাপী পদার্থ নাই। অতএব ঈশ্বর যদি সর্ব্বব্যাপী হয়েন, তবে তিনি সাকার নহেন।
ঈশ্বর সাকার নহেন, ইহাই গীতার মত। কেবল গীতার নহে, হিন্দুশাস্ত্রের এবং হিন্দুধর্ম্মের ইহাই সাধারণ মত। উপনিষৎ এবং দর্শনশাস্ত্রের এই মত। সে সকলে ঈশ্বর সর্ব্বব্যাপী চৈতন্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছেন। সত্য বটে, পুরাণেতিহাসে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর প্রভৃতি সাকার চৈতন্য কল্পিত হইয়া অনেক স্থলে ঈশ্বরস্বরূপ উপাসিত হইয়াছেন। যে কারণে এইরূপ ঈশ্বরের রূপকল্পনার প্রয়োজন বা উদ্ভব হইয়াছিল, তাহার অনুসন্ধানের এ স্থলে প্রয়োজন নাই। কেবল ইহাই বক্তব্য যে, পুরাণেতিহাসে শিবাদি সাকার বলিয়া কথিত হইলেও পুরাণ ও ইতিহাসকারেরা ঈশ্বরের সাকারতা প্রতিপন্ন করিতে চাহেন না, ঈশ্বর যে নিরাকার, তাহা কখনই ভুলেন না। পুরাণেতিহাসেও ঈশ্বর নিরাকার।
একটা উদাহরণ দিলেই আমার কথার তাৎপর্য্য বুঝা যাইবে। বিষ্ণুপুরাণের প্রহ্লাদচরিত্র ইহার উদারণস্বরূপ গ্রহণ করা যাউক। তথায় বিষ্ণুই ঈশ্বর। প্রহ্লাদ তাঁহাকে “নমস্তে পুণ্ডরীকাক্ষ” বলিয়া স্তব করিতেছেন। অন্য স্থলে স্পষ্টতঃ সাকারতা স্বীকার করিতেছেন। যথা-
ব্রহ্মত্বে সৃজতে বিশ্বং স্থিতৌ পালয়তে পুনঃ।
রুদ্ররূপায় কল্পাতে নমস্তুভ্যং ত্রিমূর্ত্তয়ে ||
এবং পরিশেষে পীতাম্বর হরি সশরীরে প্রহ্লাদকে দর্শন দিলেন। কিন্তু তথাপি এই প্রহ্লাদচরিত্রে বিষ্ণু নিরাকার; তাঁহার নাম “অনন্ত,” তিনি “সর্ব্বব্যাপী”। যিনি অনন্ত এবং সর্ব্বব্যাপী, তিনি নিরাকার ভিন্ন সাকার হইতে পারেন না; এবং তিনি যে নির্গুণ ও নিরাকার, তাহা পুনঃ পুনঃ কথিত হইয়াছে। যথা-
নমস্তস্মৈ নমস্তস্মৈ নমস্তস্মৈ পরাত্মনে।
নামরূপং ন যস্যৈকো যোহস্তিত্বেনোপলভ্যতে || ইত্যাদি। ১।১৯।৭৯
পুনশ্চ বিষ্ণু “অনাদিমধ্যান্তঃ,” সুতরাং নিরাকার।
এরূপ সকল পুরাণে ইতিহাসে। অতএব ঈশ্বর নিরাকার, ইহাই যে হিন্দুধর্ম্মের মর্ম্ম, ইহা এক প্রকার নিশ্চিত।
তবে কি হিন্দুধর্ম্মে সাকারের উপাসনা নাই? গ্রামে গ্রামে ত প্রত্যহ প্রতিমা-পূজা দেখিতে পাই, ভারতবর্ষ প্রতিমার্চ্চনায় পরিপূর্ণ। তবে হিন্দুধর্ম্মে সাকারবাদ নাই কি প্রকারে বলিব?
ইহার উত্তর এই যে, অন্য দেশে যাহা হউক, হিন্দুর প্রতিমার্চ্চনা সাকারের উপাসনা নয়; এবং যে হিন্দু প্রতিমার্চ্চনা করে, সে নিতান্ত অজ্ঞ ও অশিক্ষিত না হইলে মনে করে না যে, এই প্রতিমা ঈশ্বর, অথবা ঈশ্বরের এইরূপ আকার বা ইহা ঈশ্বরের প্রকৃত প্রতিমা। যে একখানা মাটির কালী গড়িয়া পূজা করে, সে যদি স্বকৃত উপাসনার কিছু মাত্র বুঝে, তবে সে জানে, এই চিত্রিত মৃৎপিণ্ড ঈশ্বর নহে বা ঈশ্বরের প্রতিমা নহে, এবং সে জানে, তাহা ঈশ্বরের প্রতিকৃতি হইতে পারে না।
তবে সে মাটির তালের পূজা করে কেন? সে যাঁহার পূজা করিবে, তাঁহাকে খুঁজিয়া পায় না। তিনি অদৃশ্য, অচিন্তনীয়, ধ্যানের অপ্রাপ্য, অতএব উপাসনার অতীত। কাজেই সে তাঁহাকে ডাকিয়া বলে, “হে বিশ্বব্যাপিনি সর্ব্বময়ি আদ্যাশক্তি! তুমি সর্ব্বত্রই আছ, কিন্তু আমি তোমাকে দেখিতে পাই না; তুমি সর্ব্বত্রই আবির্ভূত হইতে পার, অতএব আমি দেখিতে পাই, এমন কিছুতে আবির্ভূত হও। আমি তোমার যে রূপ কল্পনা করিয়া গড়িয়াছি, তাহাতে আবির্ভূত হও, আমি তোমার উপাসনা করি। নহিলে কোথায় পুষ্পচন্দন দিব, তদ্বিষয়ে মনঃস্থির করিতে পারি না।
এই প্রতিমাপূজার উপরে আমাদের শিক্ষাগুরু ইংরেজদিগের বড় রাগ এবং তাঁহাদিগের শিষ্য নব্য ভারতবর্ষীয়েরও বড় রাগ। ইংরেজের রাগ, তাহার কারণ-বাইবেলে ইহার নিষেধ আছে। শিক্ষিত ভারতবর্ষীয়ের রাগ; কেন না, ইংরেজের ইহার উপর রাগ। যাহা ইংরেজ নিন্দা করে, তাহা “আমাদের” অবশ্য নিন্দনীয়। প্রতিমাপূজা ইংরেজের নিকট নিন্দনীয়, অতএব প্রতিমাপূজা অবশ্য “আমাদের” নিন্দনীয়, তাহার আর বিচার আচারের প্রয়োজন নাই। ইংরেজ বলে যে, এই প্রতিমাপূজার জন্য ভারতবর্ষ উৎসন্ন গিয়াছে, এবং ইহার ধ্বংস না হইলে একেবারে উৎসন্ন যাইবে; সুতরাং আমরাও তাহাই বিশ্বাস করিতে বাধ্য; তাহার আর বিচার আচারের প্রয়োজন নাই। সত্য বটে। রোম গ্রীস প্রভৃতি প্রাচীন রাজ্য প্রতিমাপূজা করিয়াও উন্নত হইয়াছিল, কিন্তু ইংরেজ বলে যে, ভারতবর্ষ প্রতিমাপূজায় উৎসন্ন যাইবে, অতএব ভারতবর্ষ নিশ্চয় প্রতিমাপূজায় উৎসন্ন যাইবে; তদ্বিষয়ে বিচারের প্রয়োজন নাই। এইরূপ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে ভাবিয়া থাকেন। অন্যমত বিবেচনা করা কুশিক্ষা, কুবুদ্ধি, এবং নীচাশয়তার কারণ মনে করেন।
আমরা এরূপ উক্তির অনুমোদন করিতে পারি না। ঈশ্বর সর্ব্বজ্ঞ, সকলের অন্তর্যামী। সকলের অন্তরের ভিতর তিনি প্রবেশ করিতে পারেন, সকল প্রকারের উপাসনা গ্রহণ করিতে পারেন; কি নিরাকারের উপাসক, কি সাকারোপাসক, কেহই তাঁহার প্রকৃত স্বরূপ অনুভূত করিতে পারেন না। তিনি অচিন্তনীয়। অতএব তাঁহার চক্ষে সাকার উপাসকের উপাসনা ও নিরাকার উপাসকের উপাসনার তুল্য; কেহই তাঁহাকে জানে না। যদি ইহা সত্য হয়, যদি ভক্তিই উপাসনার সার হয় এবং ভক্তিশূন্য উপাসনা যদি তাঁহার অগ্রাহ্যই হয়, তবে ভক্তিযুক্ত হইলে সাকারোপাসকের উপাসনা তাঁহার নিকট গ্রাহ্য; ভক্তিশূন্য হইলে নিরাকারোপাসকের উপাসনা তাঁহার নিকট পৌঁছিবে না। অতএব আমাদের বিশ্বাস যে, ভারতবর্ষীয়ের যদি ঈশ্বরে ভক্তি থাকে, তবে সাকার উপাসনার ভাবে আচ্ছন্ন হইলেও কেহ উৎসন্ন যাইবে না, আর ভক্তিশূন্য হইলে নিরাকারোপাসনায়ও উৎসন্ন হইবে তদ্বিষয়ের কোন সংশয় নাই। সাকার ও নিরাকার উপাসনার মধ্যে আমাদের মধ্যে কোনটাই নিষ্ফল নহে; এবং এতদুভয়ের মধ্যে উৎকর্ষাপকর্ষ নাই। সুতরাং উৎকর্ষাপকর্ষের বিচার নিষ্প্রয়োজনীয়।
সাকারোপাসকেরা বলিয়া থাকেন, নিরাকারের উপাসনা হয় না। অনন্তকে আমরা মনে ধরিতে পারি না, সুতরাং তাঁহার ধ্যান বা চিন্তা আমাদের দ্বারা সম্ভব নহে, এ কথারও বিচার নিষ্প্রয়োজন বোধ হয়। কেন না, এমন যদি কেহ থাকেন যে, তিনি আপনার সান্ত চিন্তা শক্তির দ্বারা অনন্তের ধ্যান বা চিন্তায় সক্ষম, এবং তাঁহাতে ভক্তিযুক্ত হইতে পারেন, তবে তিনি নিরাকারেরই উপাসনা করুন। যিনি তাহা না পারেন, তাঁহাকে কাজেই সাকারের উপাসনা করিতে হইবে। অতএব সাকারোপাসক নিরাকারোপাসকের মধ্যে বিচার, বিবাদ ও পরস্পরের বিদ্বেষের কোন কারণ দেখা যায় না।
পাঠক স্মরণ রাখিবেন যে, আমি “সাকারের উপাসনা,” এবং “সাকারোপাসক” ভিন্ন “সাকারবাদ” বা “সাকারবাদী” শব্দ ব্যবহার করিতেছি না। কেন না, “সাকারবাদ” অবশ্য পরিহার্য্য। ঈশ্বর সাকার নহেন, ইহা পূর্ব্বেই বলা গিয়াছে।
কথাটা উঠিতে পারে যে, ঈশ্বর যদি সাকার নহেন, তবে হিন্দুধর্ম্মের অবতারবাদের কি হইবে? এই গীতার বক্তা কৃষ্ণকে উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করা যাউক। ঈশ্বর নিরাকার, কিন্তু কৃষ্ণ সাকার। ইঁহাকে তবে কি প্রকারে ঈশ্বরাবতার বলা যাইবে? এই প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর আমি কৃষ্ণচরিত্র নামক মৎপ্রণীত গ্রন্থে দিয়াছি, সুতরাং এখানে সে সকল কথা পুনর্ব্বার বলিবার প্রয়োজন নাই। ঈশ্বর সর্ব্বশক্তিমান্, সুতরাং ইচ্ছানুসারে তিনি যে আকার ধারণ করিতে পারেন না, একথা বলিলে তাঁহার শক্তির সীমা নির্দ্দেশ করা হয়।
“যেন সর্ব্বমিদং ততম্” ইত্যাদি বাক্যে অনেকের এইরূপ ভ্রম জন্মিতে পারে যে, বিলাতী Pantheism এবং হিন্দুধর্ম্মের ঈশ্বরবাদ বুঝি একই। স্থানান্তরে এই ভ্রমের নিরাস করা যাইবে।
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যসোক্তাঃ শরীরিণঃ।
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য অস্মাদ্যুদ্ধস্ব ভারত || ১৮ ||
নিত্য, অবিনাশী এবং অপ্রমেয় আত্মার এই দেহ নশ্বর বলিয়া কথিত হইয়াছে। অতএব হে ভারত! যুদ্ধ কর।১৮।
নিত্য, অর্থাৎ সর্ব্বদা একরূপে স্থিত (শ্রীধর)।
অপ্রমেয় অর্থাৎ অপরিচ্ছন্ন। প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের দ্বারা অপরিচ্ছেদ্য। প্রত্যক্ষাদির অতীত।
শ্রীধর এই শ্লোকের এইরূপ ব্যাখ্যা করেন-“নিত্য অর্থাৎ সর্ব্বদা একরূপ, অতএব অবিনাশী, ও অপ্রমেয় অর্থাৎ অপরিচ্ছিন্ন যে আত্মা, তাঁহার এই দেহ সুখদুঃখাদিধর্ম্মক, ইহা তত্ত্বদর্শীদিগের দ্বারা উক্ত; যখন আত্মার বিনাশ নাই, সুখদুঃখাদি সম্বন্ধ নাই, তখন মোহজনিত শোক পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধ কর, অর্থাৎ স্বধর্ম্ম ত্যাগ করিও না।”
এই শ্লোকের ব্যাখ্যার পর শঙ্করাচার্য্য যাহা বলিয়াছেন, তাহার প্রতি বিশেষ মনোযোগ আবশ্যক। তিনি বলেন-“ইহাতে যুদ্ধের কর্ত্তব্যতা বিধান করা হইতেছে না। যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াও তিনি শোকমোহপ্রতিবদ্ধ হইয়া তূষ্ণীম্ভাবে আছেন, ভগবান্ তাঁহার কর্ত্তব্যপ্রতিবন্ধের অপনয়ন করিতেছেন মাত্র। অতএব ‘যুদ্ধ কর’ ইহা অনুবাদ মাত্র, বিধি নয়।”
অনেকের বিশ্বাস যে, এই গীতাগ্রন্থের স্থূল উদ্দেশ্য-যুদ্ধের ন্যায় নৃশংস ব্যাপারে মনুষ্যের প্রবৃত্তি দেওয়া। তাঁহারা যে গীতা বুঝিবার চেষ্টা করেন নাই, তাহা বলা বাহুল্য। গীতা বাজারের উপন্যাস-গ্রন্থ নহে যে, একবার পড়িবা মাত্র উহার সমস্ত তাৎপর্য্য বুঝা যাইবে। বিশেষরূপে উহার আলোচনা না করিলে বুঝা যায় না। গীতার এতদংশের উদ্দেশ্য-স্বধর্ম্মপালনে অপরিহার্য্যতা প্রতিপন্ন করা। স্বধর্ম্ম বলিলে শিক্ষিত সম্প্রদায় বুঝিতে কষ্ট পাইতে পারেন, ইহার ইংরাজি প্রতিশব্দDuty ধর্ম্মের অবশ্যসম্পাদ্যতা প্রতিপন্ন করা। সকল মনুষ্যের স্বধর্ম্ম একপ্রকার নহে- কাহারও স্বধর্ম্ম দন্ড-প্রণয়ন; কাহারও স্বধর্ম্ম ক্ষমা। সিপাহীর স্বধর্ম্ম শত্রুকে আঘাত করা, ডাক্তারের স্বধর্ম্ম সেই আঘাতের চিকিৎসা। মনুষ্যের যত প্রকার কর্ম্ম আছে, তত প্রকার স্বধর্ম্ম আছে। কিন্তু সকল প্রকার স্বধর্ম্মমধ্যে যুদ্ধই সর্ব্বাপেক্ষা নৃশংস ব্যাপার। যুদ্ধ পরিহার করিতে পারিলে যুদ্ধ কাহারও কর্ত্তব্য নহে। কিন্তু এমন অবস্থা ঘটে যে, এই নৃশংস কার্য্য পরিহার্য্য ও অবশ্যসম্পাদ্য হইয়া উঠে। তৈমুরলঙ্গ বা নাদের দেশ দগ্ধ ও লুণ্ঠিত করিতে আসিতেছে, এমন অবস্থায় যে যুদ্ধ করিতে জানে, যুদ্ধ তাহারই অপরিহার্য্য ও অবশ্য সম্পাদ্য স্বধর্ম্ম। অতএব গীতাকার স্বধর্ম্ম পালন সম্বন্ধে ইংরাজি দর্শনশাস্ত্রে যাহাকে Crucial instance বলে, তাহাই অবলম্বন করিয়া স্বধর্ম্মের অবশ্যসম্পাদ্যতা এবং তদুপলক্ষে সমস্ত ধর্ম্মেরও নিগূঢ় রহস্য ব্যাখ্যাত করিতেছেন। উদাহরণস্বরূপ যে স্বধর্ম্ম সর্ব্বাপেক্ষা নৃশংস ভয়াবহ ও যাহাতে সাধুজন মাত্রই স্বতঃ অপ্রবৃত্ত, তাহাই গ্রহণ করা হইয়াছে। কেবল তাহাই নহে-যুদ্ধের মধ্যে যে যুদ্ধ সর্ব্বাপেক্ষা নৃশংস ও ভয়াবহ, যাহাতে স্বভাবতঃ নৃশংস ব্যক্তিও সহজে প্রবৃত্ত হইতে চাহে না, তাহাই উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করিয়াছেন। Crucial instance বটে। গীতার উদ্দেশ্য ইহাই প্রতিপাদন করা যে, স্বধর্ম্ম এরূপ নৃশংস, ভয়াবহ এবং সাধুজনপ্রবৃত্তির আপাত-বিরোধী হইলেও তাহা অবশ্য পালনীয়।
কিন্তু শ্লোকটার ভাবার্থ বোধ করি, এখনও পরিষ্কার হয় নাই। ‘আত্মা অবিনাশী-কেহ তাহার বিনাশ করিতে পারে না-অতএব যুদ্ধ কর,’ এই কথার অর্থ কি? আত্মা অবিনাশী বলিয়া কাহাকে হত্যা করায় কি দোষ নাই? ভগবদ্বাক্যের সে তাৎপর্য্য নহে।ইহার তাৎপর্য্য উপরিধৃত শঙ্করভাষ্যে যাহা কথিত হইয়াছে, তাই। অর্জ্জুন যুদ্ধে প্রবৃত্ত, তবে মোহে অভিভূত হইয়া, মানুষ মারিতে হইবে, এই দুঃখে তাহা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইতেছেন। ভগবান্ বুঝাইতেছেন যে, দুঃখ করিবার কারণ কিছুই নাই-কেন না, কেহই মরিবে না। শরীর নষ্ট হইবে বটে, কিন্তু শরীর ত অনিত্য, অর্জ্জুন যুদ্ধ না করিলেও এক দিন অবশ্য নষ্ট হইবে। কিন্তু শরীর নষ্ট হইলে মানুষ মরে না-যাহার শরীর, সে অমর-কেহই তাহাকে মারিতে পারে না। অতএব যুদ্ধের প্রতি অর্জ্জুন যে আপত্তি উপস্থিত করিতেছেন, সেটা ভ্রমরজনিত মাত্র। অতএব তিনি যুদ্ধ করিতে পারেন।
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে || ১৯ ||
যে ইঁহাকে হন্তা বলিয়া জানে, এবং যে ইঁহাকে হত বলিয়া জানে, ইহারা উভয়েই অনভিজ্ঞ। ইনি হত্যা করেন না-হতও হয়েন না।১৯।
প্রাচীন টীকাকারেরা এই শ্লোকের এইরূপ ব্যাখ্যা করেন; যথা-ভীষ্মাদির, মৃত্যু নিমিত্ত অর্জ্জুনের শোক, উক্ত বাক্যে নিবারিত হইল। এক্ষণে “আমি ইহাদের বধের কর্ত্তা।” এই নিমিত্ত যে দুঃখ, প্রথম অধ্যায়ে ৩৪।৩৫ ইত্যাদি শ্লোকে অর্জ্জুনের দ্বারা উক্ত হইয়াছে, তাহার উত্তরে ভগবান্ বুঝাইতেছেন যে, আত্মা যেমন কাহারও কর্ত্তৃক হত হয়েন না, তেমনি তিনি কাহাকেও হত্যা করেন না। কেন না, আত্মা অবিক্রিয়।
শঙ্কর ও শ্রীধর প্রভৃতি মহামহোপাধ্যায়েরা যেরূপ অর্থ করিয়াছেন, আমি এক্ষণে সেইরূপ বলিতেছি। ইহার পরবর্ত্তী শ্লোকেরও সেইরূপ অর্থ করিব। অন্য অর্থ হয় কি না, তাহাও বলা যাইবে। টীকাকারেরা বলেন, আত্মা যে অবিক্রিয়, তাহার প্রমাণ পরবর্ত্তী শ্লোকে দেওয়া হইতেছে।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি-
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে || ২০ ||
ইনি জন্মেন না বা মরেন না, কখন হয়েন নাই, বর্ত্তমান নাই বা হইবেন না। ইনি অজ, নিত্য, শাশ্বত, পুরাণ; শরীর হত হইলে ইনি হত হয়েন না।২০।
টীকাকারেরা বলেন, আত্মা বা অবিক্রিয়, ইঁহার ষড়্ভাববিকারশূন্যত্বের দ্বারা দৃঢ়ীকৃত করা হইতেছে। ইনি জন্মশূন্য-এই কথার দ্বারা জন্ম প্রতিষিদ্ধ হইল; মরেন না-ইহাতে বিনাশ প্রতিষিদ্ধ হইল। ইনি কখন উৎপন্ন হয়েন নাই, এজন্য বর্ত্তমান নাই। যাহা জন্মে, তাহাকেই বর্ত্তমান বলা যায়; কিন্ত ইনি পূর্ব্ব হইতে স্বতঃ সদ্রূপে আছেন, অতএব উৎপন্ন হইয়া যে বিদ্যমানতা, তাহা ইঁহার নাই। এবং সেই জন্য ইনি আবার জন্মিবেন না। সেই জন্য ইনি অজ অর্থাৎ জন্মশূন্য, ইনি নিত্য অর্থাৎ সর্ব্বদা একরূপ, শাশ্বত অর্থাৎ অপক্ষয়শূন্য, পুরাণ অর্থাৎ বিপরিণামশূন্য।
এক্ষণে পাঠক, এই দুইটি শ্লোকের প্রতি মনোভিনিবেশ করিলেই দেখিতে পাইবেন যে, আত্মার এই অবিক্রিয়ত্ববাদ সম্বন্ধে কোন কথা স্পষ্টতঃ মূলে নাই। অস্পষ্টতঃ “নায়ঃ হন্তি” এই কথাটা আছে, কিন্তু ইহার অন্য অর্থ না হইতে পারে, এমনও নহে। যদি কেহ মরে না, তবে আত্মাও কাহাকে মারে না।
আত্মা যে অবিক্রিয়, ইহা প্রাচীন দর্শনশাস্ত্রের একটি মত। তত্ত্বটা কি, তাহা পাঠককে বুঝান যাইতে পারে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ উত্থাপিত করা আবশ্যক বোধ হইতেছে না। আবশ্যক বোধ হইতেছে না, তাহার কারণ, আমরা গীতার ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত, কিন্তু এই দুটি শ্লোক গীতার নহে। শ্লোক দুটি কঠোপনিষদের। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের যেটি ১৯শ শ্লোক, তাহা কঠোপনিষদেরও দ্বিতীয় বল্লীর ১৯শ শ্লোক; আর গীতার ঐ অধ্যায়ের যেটি ২০শ শ্লোক, তাহাও কঠোপনিষদের ঐ বল্লীর ২৮শ শ্লোক। গীতার শ্লোক ও কঠোপনিষদের শ্লোক পাশাপাশি লেখা যাইতেছে।
গীতা
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে || ২।২৯
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ম্পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে || ২।২০
কঠোপনিষদ্
হন্তা চেন্মন্যতে হন্তুং হতশ্চেন্মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে || ২।১৯
ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ম্পুরাণো ন হন্যতে হন্যমনে শরীরে || ২।১৮
শ্লোক দুইটি কঠোপনিষদ্ হইতে গীতায় আনীত হইয়াছে, গীতা হইতে কঠোপনিষদে নীত হয় নাই। এ কথা লইয়া বোধ করি বেশী বিচারের প্রয়োজন নাই। আমরা দেখিব, উপনিষদ্ হইতে অনেক শ্লোক গীতায় আনীত হইয়াছে। অন্ততঃ প্রাচীন ভাষ্যকারদিগের এই মত। শঙ্করাচার্য্যয় লিখিয়াছেন-“শোকমোহাদিসংসারকারণনিবৃত্ত্যর্থং গীতাশাস্ত্রং ন প্রবর্ত্তকমিত্যেতৎ পার্থস্য সাক্ষীভূতে ঋচাবানিনায়” এবং আনন্দগিরি লিখিয়াছেন-“হন্তা চেন্মন্যতে হন্তুং ইত্যাদ্যামৃচমর্থতো দর্শয়িত্বা ব্যাচষ্টে য এনমিতি।”
এক্ষণে এই শ্লোক সম্বন্ধে দুইটি কথা বলিতে বাধ্য হইতেছি।
প্রথম, আত্মা যদি কর্ত্তা নহে, তবে কর্ম্মযোগ জলে ভাসাইয়া দিতে হয়। শঙ্করাচার্য্যের যে তাহাই উদ্দেশ্য, ইহা বলা বাহুল্য। কর্ম্মযোগের কথা যখন পড়িবে, পাঠক তখন এ বিষয়ের বিচার করিতে পারিবেন।
দ্বিতীয়, আত্মার অবিক্রিয়ত্ব একটা দার্শনিক মত। প্রাচীন কালে সকল দেশে, দর্শন ধর্ম্মের স্থান অধিকার করে এবং ধর্ম্ম দর্শনের অনুগামী হয়। ইহা উভয়েরই অনিষ্টকারী।ধর্ম্ম ও দর্শন পরস্পর হইতে বিযুক্ত হইলেই উভয়ের উন্নতি হয়, নচেৎ হয় না। এই তত্ত্বটি সপ্রমাণ করিয়া কোম্ৎ ও তৎশিষ্যগণ দর্শন ও ধর্ম্ম উভয়েরই উপকার করিয়াছেন। আমাদিগেরও সেই মার্গাবলম্বী হওয়া উচিত।
দার্শনিক মত যাহাই হউক, হিন্দুধর্ম্মের সাধারণ মত-আত্মাই কর্ত্তা। ইহা প্রমাণ করিবার জন্য শত পৃষ্ঠা ধরিয়া বচন উদ্ধৃত করিতে পারা যায়। আমরা কেবল দুইটি কথা তুলিব। একটি উপনিষদ্ হইতে, আর একটি পুরাণ হইতে।
আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীৎ।
নান্যং কিঞ্চন মিষৎ।
স ঈক্ষত লোকান্ নু সৃজা ইতি || ১
স ইমাল্লোঁকানসৃজত অম্ভো মরীচীর্ম্মরমিত্যাদি।
ঋগ্বেদীয়ৈতরেয়োপনিষৎ।
আত্মাই সব সৃষ্টি করিয়াছেন, সুতরাং আত্মাই কর্ত্তা।
দ্বিতীয় উদাহরণ পুরাণ হইতে গ্রহণ করিতেছি। উহা কঠোপনিষদের শ্লোকের সঙ্গে তুলনা করিয়া পাঠক দেখিবেন, হিন্দুশাস্ত্রের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করা কি যন্ত্রণা-
কঃ কেন হন্যতে জন্তুর্জন্তুঃ কঃ কেন রক্ষ্যতে।
হন্তি রক্ষতি চৈবাত্মা হ্যসৎ সাধু সমারণ্ ||
বিষ্ণুপুরাণ।১।১৮।২৯
যে ইহাকে অবিনাশী, নিত্য, অজ এবং অব্যয় বলিয়া জানে, হে পার্থ, সে পুরুষ কাহাকে মারে? কাহাকেই বা হনন করায়?।২১।
ভাবার্থ-যে জানে যে, দেহ নাশ হইলেই শরীরীর বিনাশ হইল না, সে যদি কাহারও দেহধ্বংসের কারণ হয়, তবে তাহার উচিত নহে যে, সে “আমি ইহার বিনাশের কারণ হইলাম” বলিয়া দুঃখিত হয়। কেন না আত্মা অবিনাশী। শরীরের বিনাশে তাহার বিনাশ হইল না।
তবে যদি বল যে, “ভাল, আত্মার বিনাশ না হউক, কিন্তু শরীরের ত বিনাশ আছেই। শরীরনাশেরই বা আমি কেন কারণ হই?” তাহার উত্তর পরশ্লোকে কথিত হইতেছে।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী || ২২ ||
যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া অপর নূতন বস্ত্র48 গ্রহণ করে, তেমনি আত্মা পুরাতন শরীর পরিত্যাগ করিয়া নূতন শরীরে সংগত হয়।২২।
অর্থাৎ যেমন তোমার জীর্ণ বস্ত্র কেহ ছিঁড়িয়া বা না দিক, তোমাকে জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র গ্রহণ করিতেই হইবে, তেমনি তুমি যুদ্ধ কর বা না কর, যোদ্ধৃগণ অবশ্য দেহত্যাগ করিবে, তোমার যুদ্ধবিরতিতে তাহাদের দেহনাশ নিবারণ হইবে না। তবে কেন যুদ্ধ করিবে না?
স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য যে, যে ব্যক্তি বধকার্য্য করিতে হইবে বলিয়া শোকমোহপ্রযুক্ত ধর্ম্মযুদ্ধ হইতে বিমুখ হয়, তাহার প্রতি এই সকল বাক্য প্রযোজ্য। নচেৎ আত্মা অবিনশ্বর এবং দেহমাত্র নশ্বর, ইহার এমন অর্থ নহে যে, কেহ কাহাকে খুন করিলে তাহাতে দোষ নাই। খুন করিলে দোষ আছে কি না আছে-সে বিচারের সঙ্গে এ বিচারের কোন সম্বন্ধই নাই-থাকিতেও পারে না। এখানে বিবেচ্য, ধর্ম্মযুদ্ধে শোকমোহের কোন কারণ আছে কি না? উত্তর-কারণ নাই, কেন না, আত্মা অবিনশ্বর, আর দেহ নশ্বর। দেহী কেবল নূতন কাপড় পরিবে মাত্র-তাহাতে কাঁদাকাটার কথাটা কি?
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ || ২৩ ||
এই (আত্মা) অস্ত্রে কাটে না, আগুনে পুড়ে না, জলে ভিজে না, এবং বাতাসে শুকায় না।২৩। আত্মা নিরবয়ব, এই জন্য অস্ত্রাদির অতীত।
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।
অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে || ২৪ ||
ইনি ছেদনীয় নহেন, দহনীয় ক্লেদনীয় নহেন এবং শোষণীয় নহেন। (ইনি) নিত্য, সর্ব্বগত, স্থাণু, অচল, সনাতন, অব্যক্ত, অচিন্ত্য অবিকার্য্য বলিয়া কথিত হন।২৪।
স্থাণু-অর্থাৎ স্থিরস্বভাব। অচল-পূর্ব্বরূপ অপরিত্যাগী। সনাতন-চিরন্তন, অনাদি। অব্যক্ত-চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অবিষয়। অচিন্ত্য-মনের অবিষয়। অবিকার্য্য অচল-কর্ম্মেন্দ্রিয়ের অবিষয়।
শঙ্কর এই শ্লোকের অর্থ এইরূপ করেন। আত্মা অচ্ছেদ্য ইত্যাদি, এজন্য আত্মা নিত্য; নিত্য-এজন্য সর্ব্বগত-এজন্য স্থিরস্বভাব; স্থিরস্বভাব-এজন্য অচল; অচল-এজন্য সনাতন, ইত্যাদি।
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি || ২৫ ||
অতএব ইহাকে এইরূপ জানিয়া, শোক করিও না। ২৫।
অথ চৈন নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং49 শোচিতুমর্হসি || ২৬ ||
আর যদি ইহা তুমি মনে কর, আত্মা সর্ব্বদাই জন্মে, সর্ব্বদা মরে, তথাপি হে মহাবাহো! ইহার জন্য শোক করিও না।২৬।
কেন তথাপি শোক করিবে না? শঙ্কর বলেন, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী বলিয়া। পরশ্লোকেও সেই কথা আছে। কিন্তু পরশ্লোকে “ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ”-এই বাক্যে আত্মার অবিনাশিতাও সূচিত হইতেছে। তাহা হইলে আর আত্মার বিনাশ স্বীকার করা হইল কৈ? এবং নূতন কথাই বা কি হইল? এই জন্য শ্রীধর আর এক প্রকার বুঝাইয়াছিলেন। তিনি বলেন যে, আত্মাও যদি মরিল, তাহা হইলে তোমাকেও ফলভোগী হইতে হইবে না, তবে আর দুঃখের বিষয় কি?
কেন তথাপি শোক করিবে না, তাহা পরশ্লোকে বলা হইতেছে।
জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্য্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি || ২৭ ||
যে জন্মে, সে অবশ্য মরে; সে অবশ্য জন্মে; অতএব যাহা অপরিহার্য্য, তাহাতে শোক করিও না।২৭।
আত্মার অবিনাশিতা গীতাকারের হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করিয়াছে। “নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্” বলিয়া মানিয়া লইয়াও, উত্তরে আবার বলিতেছেন, “ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।” যদি মরিলে আবার অবশ্য জন্মিবে, তবে আত্মা অবশ্য অবিনাশী, “নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্” বলা আর খাটে না। তবে শ্রীধরের ব্যাখ্যা গ্রহণ করিলে এ আপত্তি উপস্থিত হয় না।
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব ত্র কা পরিবেদনা || ২৮ ||
জীবসকল আদিতে অব্যক্ত, (কেবল) মধ্যে ব্যক্ত, (আবার) নিধনে অব্যক্ত; সেখানে শোকবিলাপ কি? ২৮।
অব্যক্ত শব্দের অর্থ পূর্ব্বে বলা হইয়াছে। শঙ্কর অর্থ করেন, “অব্যক্তমদর্শন-মনুপলব্ধির্যাং ভূতানাং” অর্থাৎ যে (যে অবস্থায়) ভূতসকলের দর্শন বা উপলব্ধি নাই। শ্রীধর অর্থ করেন; “অব্যক্তং প্রধানং তদেবাদি উৎপত্তেঃ পূর্ব্বরূপম্।” অর্থাৎ ভূত সকল উৎপত্তির পূর্ব্বে কারণরূপে অব্যক্ত থাকে। অপর সকলে কেহ শ্রীধরের, কেহ শঙ্করের অনুবর্ত্তী হইয়াছেন। শঙ্করের অর্থ গ্রহণ করিলেই অর্থ সহজে বুঝা যায়।
শ্লোকের অর্থ এই যে, যেখানে জীব সকল আদিতে অর্থাৎ জন্মের পূর্ব্বে চক্ষুরাদির অতীত ছিল; কেবল মধ্যে দিনকত জন্মগ্রহণ করিয়া ব্যক্তরূপ হইয়াছিল, শেষে মৃত্যুর পর আবার চক্ষুরাদির অতীত হইবে, তখন আর তজ্জন্য শোক করিব কেন? “প্রতিবুদ্ধস্য স্বপ্নদৃষ্টবস্তুষ্বিব শোকো ন যুজ্যতে” (শ্রীধর স্বামী)-ঘুম ভাঙ্গিলে স্বপ্নদৃষ্ট বস্তুর ন্যায় জীবের জন্য শোক অনুচিত।
এখানেও আত্মার অবিনাশিত্ববাদ জাজ্বল্যমান।
আশ্চর্য্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেন
মাশ্চর্য বদ্বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চর্য্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি
শ্রুতাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ || ২৯ ||
এই (আত্মা)কে কেহ আশ্চর্য্যবৎ দেখেন; কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ বলেন; কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ শুনিয়া থাকেন। শুনিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারিলেন না।২৯।
এই শ্লোকের অভিপ্রায় এই।আত্মা অবিনাশী হইলেও পন্ডিতেরাও মৃত ব্যক্তির জন্য শোক করিয়া থাকেন বটে। কিন্তু তাহার কারণ এই যে, তাঁহারাও প্রকৃত আত্মতত্ত্ব অবগত নহেন। আত্মা তাঁহাদের নিকট বিস্ময়ের বিষয় মাত্র-তাঁহারা আশ্চর্য্য বিবেচনা করেন। আত্মার দুর্জ্ঞেয়তাবশতঃ সকলের এই ভ্রান্তি।
এ কথাতে এই আপত্তি হইতে পারে যে, “আত্মা অবিনাশী” এবং “ইন্দ্রিয়াদির অবিষয়” এই সকল কথাতে এমন কিছু নাই যে, পণ্ডিতেও বুঝিতে পারে না। কিন্তু ভগবদুক্তির উদ্দেশ্য কেবল দুর্ব্বোধ্যতা প্রতিপাদন করা নহে। আমরা আত্মার অবিনাশিতা বুঝিতে পারিলেও কথাটা আমাদের হৃদয়ে বড় প্রবেশ করে না। তদ্বিষয়ক যে বিশ্বাস, তাহা আমাদের সমস্ত জীবন শাসিত করে না। এই বিশ্বাসকে আমরা একটা সর্ব্বদা জাজ্বল্যমান, জীবন্ত, সর্ব্বথা-হৃদয়ে-প্রস্ফুটিত-ব্যাপারে পরিণত করি না। ইহাই ভগবদুক্তির উদ্দেশ্য।
দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্ব্বস্য ভারত।
তস্মাৎ সর্ব্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি || ৩০ ||
হে ভারত! সকলের দেহে, আত্মা নিত্য ও অবধ্য। অতএব জীব সকলের জন্য তোমার শোক করা উচিত নহে।৩০।
আত্মার অবিনাশিতা সম্বন্ধে যাহা কথিত হইল, এই শ্লোক তাহার উপসংহার।
স্বধর্ম্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে || ৩১ ||
স্বধর্ম্ম প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ভীত হইও না। ধর্ম্ম্য যুদ্ধের অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয় আর নাই।৩১।
এক্ষণে ১১ ও ২২ শ্লোকের টীকায় যাহা বলা গিয়াছে, তাহা স্মরণ করিতে হইবে। স্বধর্ম্ম কি, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যুদ্ধব্যবসায়ীর স্বধর্ম্ম-যুদ্ধ। কিন্তু যোদ্ধার স্বধর্ম্ম যুদ্ধ বলিয়া যে, যুদ্ধ উপস্থিত হইলেই যে যোদ্ধাকে তাহাতে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, এমন নহে। অনেক সময়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া যোদ্ধার পক্ষে অধর্ম্ম।অনেক রাজ্য পরস্বাপরহণ জন্যই যুদ্ধ করেন। তাদৃশ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া ধর্ম্মানুমত নহে। কিন্তু যুদ্ধব্যবসায়ী, মনুষ্যসমাজের দোষে তাহাকে তাহাতেও প্রবৃত্ত হইতে হয়। যোদ্ধৃগণ রাজা বা সেনাপতির আজ্ঞানুবর্ত্তী। তাঁহাদের আজ্ঞামত যুদ্ধ করিতে, অধীন যোদ্ধৃমাত্রেই বাধ্য। কিন্তু সে অবস্থায় যুদ্ধ করিলেও তাঁহারা পরস্বাপহরণ ইত্যাদি পাপের অংশী হয়েন। এই অধর্ম্মযুদ্ধই অনেক। যোদ্ধা তাহা হইতে কোনরূপে নিষ্কৃতি পান না। ভীষ্মের ন্যায় পরমধার্ম্মিক ব্যক্তিরও অন্নদাসত্ববশতঃ দুর্য্যোধনের পক্ষাবলম্বনপূর্ব্বক অধর্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়ার কথা এই মহাভারতেই আছে। ইউরোপীয় সৈন্যমধ্যে খুঁজিলে ভীষ্মের অবস্থাপন্ন লোক সহস্র সহস্র পাওয়া যাইবে। অতএব যোদ্ধার এই মহৎ দুর্ভাগ্য যে, স্বধর্ম্ম পালন করিতে গিয়া, অনেক সময়েই অধর্ম্মে লিপ্ত হইতে হয়। ধার্ম্মিক যোদ্ধা ইহাকে মহদ্দুঃখ বিবেচনা করেন। কিন্তু ধর্ম্মযুদ্ধও আছে। আত্মরক্ষা, স্বজনরক্ষা, সমাজরক্ষা, দেশরক্ষা, সমস্ত প্রজার রক্ষা, ধর্ম্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ উপস্থিত হয়। এইরূপ যুদ্ধে যোদ্ধার অধর্ম্ম সঞ্চয় না হইয়া পরম ধর্ম্ম সঞ্চয় হয়। এখানে কেবল স্বধর্ম্মপালন নহে, তাহার সঙ্গে অনন্ত পুণ্য সঞ্চয়। এরূপ ধর্ম্মযুদ্ধ যে যোদ্ধার অদৃষ্টে ঘটে, সে পরম ভাগ্যবান্। অর্জ্জুনের সেই সময় উপস্থিত, এরূপ যুদ্ধে অপ্রবৃত্তি পরম অধর্ম্ম-অনর্থক স্বধর্ম্মপরিত্যাগ। অর্জ্জুন সেই অনর্থক স্বধর্ম্মপরিত্যাগরূপ ঘোরতর অধর্ম্মে প্রবৃত্ত। ইহার কারণ আর কিছু নহে। কেবল স্বজনাদি নিধনের ভয়। সেই ভয়ে ভীত শোকাকুল বা মুগ্ধ হইবার কোন কারণ নাই, তাহা ভগবান্ বুঝাইলেন; বুঝাইলেন যে, কেহ মরিবে না-কেন না, দেহী অমর। যাইবে কেবল শূন্য দেহ। কিন্তু সেটা ত জীর্ণ বস্ত্র মাত্র। অতএব স্বজনবধাশঙ্কায় ভীত হইয়া স্বধর্ম্মে উপেক্ষা করা অকর্ত্তব্য। এই ধর্ম্মযুদ্ধের মত এমন মঙ্গলময় ব্যাপার ক্ষত্রিয়ের আর ঘটে না। ইহাই শ্লোকার্থ।
যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়া পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্ || ৩২ ||
মুক্ত স্বর্গদ্বারস্বরূপ ঈদৃশ যুদ্ধ, আপনা হইতে যাহা উপস্থিত হইয়াছে, সুখী ক্ষত্রিয়েরাই ইহা লাভ করিয়া থাকে।৩২।
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
ততঃ স্বধর্ম্ম্যং কীর্ত্তিঞ্চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি || ৩৩ ||
আর যদি তুমি এই ধর্ম্ম্য যুদ্ধ না কর, তবে স্বধর্ম্ম এবং কীর্ত্তি পরিত্যাগে পাপযুক্ত হইবে।৩৩।
৩১ শ্লোকে টীকায় যাহা লেখা গিয়াছে, তাহাতেই এই দুই শ্লোকের তাৎপর্য্য স্পষ্ট বুঝা যাইবে।
অকীর্ত্তিঞ্চাপি ভূতানি কথয়িষ্যতি তেহব্যয়াম্।
সম্ভাবিতস্য চাকীর্ত্তির্মরণাদতিরিচ্যতে || ৩৪ ||
লোকে তোমার চিরস্থায়ী অকীর্ত্তি ঘোষণা করিবে। সমর্থ ব্যক্তির অকীর্ত্তির অপেক্ষা মৃত্যু ভাল।৩৪।
ভয়াদ্রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ।
যেষাঞ্চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্ || ৩৫ ||
মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়ে রণ হইতে বিরত হইলে। যাঁহারা তোমাকে বহুমান করেন, তাঁহাদিগের নিকট তুমি লাঘব প্রাপ্ত হইবে।৩৫।
অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ।
নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্ || ৩৬ ||
তোমার শত্রুগণ তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিবে ও অনেক অবাচ্য কথা বলিবে। তার পর অধিক দুঃখ আর কি আছে? ।৩৬।
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাদুক্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ || ৩৭ ||
হত হইলে স্বর্গ পাইবে। জয়ী হইলে পৃথিবী ভোগ করিবে। অতএব হে কৌন্তেয়! যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর।৩৭।
৩৪।৩৫।৩৬।৩৭, এই চারিটি শ্লোক কি প্রকারে এখানে আসিল, তাহা বুঝা যায় না। এই চারিটি শ্লোক গীতার অযোগ্য। গীতায় ধর্ম্মপ্রসঙ্গ আছে, এবং দার্শনিক তত্ত্বও আছে। এই চারিটি শ্লোকের বিষয় না ধর্ম্ম, না দার্শনিক তত্ত্ব! ইহাতে বিষয়ী লোকে যে অসার অশ্রদ্ধেয় কথা সচরাচর উপদেশ স্বরূপ ব্যবহার করে, তাহা ভিন্ন আর কিছু নাই। ইহা ঘোরতর স্বার্থবাদে পূর্ণ, তাহা ভিন্ন আর কিছুই নহে।
৩৩শ শ্লোক পর্য্যন্ত ভগবান্ অর্জ্জুনকে আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় পরম পবিত্র উপদেশ দিলেন। ৩৮ শ্লোক হইতে আবার জ্ঞান ও কর্ম্ম সম্বন্ধীয় পরম পবিত্র উপদেশ আরম্ভ হইবে। এই চারিটি শ্লোকের সঙ্গে, দুইয়ের একেরও কোন প্রকার সম্বন্ধ নাই। তৎপরিবর্ত্তে লোক-নিন্দা-ভয় প্রদর্শিত হইতেছে। বলা বাহুল্য যে, লোক-নিন্দা-ভয় কোন প্রকার ধর্ম্ম নহে। সত্য বটে, আধুনিক সমাজ সকলে ধর্ম্ম এতই দুর্ব্বল যে, অনেক সময়ে লোক-নিন্দা-ভয় ধর্ম্মের স্থান অধিকার করে। অনেক চোর চৌর্যে ইচ্ছুক হইয়াও কেবল লোক-নিন্দা-ভয়ে চুরি করে না, অনেক পারদারিক লোক-নিন্দা-ভয়েই শাসিত থাকে। তাহা হইলেও ইহা ধর্ম্ম হইল না; পিতলকে গিল্টি করিলে দুই চারি দিন সোনা বলিয়া চালান যায় বটে, কিন্তু তাহা বলিয়া পিতল সোনা হয় না। পক্ষান্তরে এই লোক-নিন্দা বহুতর পাপের কারণ। আজিকার দিনে হিন্দুসমাজের ভ্রূণহত্যা ও স্ত্রীহত্যা অনেকই এই লোক-নিন্দা-ভয় হইতে উৎপন্ন। এক সময়ে ফরাসীর দেশে উচ্চ শ্রেণীর লোকের মধ্যে পারদারিকতার অভাবই নিন্দার কারণ ছিল। সিয়াপোষ কাফরদিগের মধ্যে, যে একজনও মুসলমানের মধ্যে কাটে নাই, অর্থাৎ যে নরঘাতী নহে, সে সমাজে নিন্দিত-তাহার বিবাহ হয় না। সকল সমাজেরই সহস্র সহস্র পাপ লোক-নিন্দা-ভয় হইতেই উৎপন্ন; কেন না, সাধারণ লোক নির্বোধ, যাহা ভাল, তাহারও নিন্দা করিয়া থাকে। লোকে যাহা ভাল বলে, মনুষ্য এখন তাহারই অন্বেষণ করে বলিয়াই মনুষ্যের ধর্ম্মাচরণে অবসর বা তৎপ্রতি মনোযোগ নাই। লোক-নিন্দা-ভয়ে অনেকে যে ধর্ম্মাচরণ করিতে পারে না, এবং ধর্ম্মাচরণে প্রবৃত্ত ব্যক্তিকে অসার লোকে লোক-নিন্দা-ভয় প্রদর্শন করে, ইহা সচারচর দেখা গিয়া থাকে। যে লোক-নিন্দা-ভয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত, সে সাক্ষাৎ নরপিশাচ। ভগবান্ স্বয়ং যে অর্জ্জুনকে সেই মহাপাপে উপদিষ্ট করিবেন, ইহা সম্ভব নহে। কোন জ্ঞানবান্ ব্যক্তিই ইহা ঈশ্বরোক্তি বলিয়া গ্রহণ করিবেন না। ইহা গীতাকারের নিজের কথা বলিয়াও গ্রহণ করিতে পারা যায় না; কেন না, গীতাকার যেই হউন, তিনি পরম জ্ঞানী এবং ভগবদ্ধর্ম্মে সুদীক্ষিত; এরূপ পাপোক্তি তাঁহা হইতেও সম্ভবে না। যদি কেহ বলেন যে, এই শ্লোক চারিটি প্রক্ষিপ্ত, তবে তাঁহাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, ইহা শঙ্করের পর প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। অভিনবগুপ্তাচার্য্য এই কয় শ্লোককে “লৌকিক ন্যায়” বলিয়াছেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যদি “লৌকিক ন্যায়” পরিত্যাগ না করিবেন, তবে আর দাঁড়াই কোথায়! যাহাই হউক, লোকনিন্দা কথার পর ও পৃথিবীভোগের কথার পরই “এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে” ইত্যাদি কথা অসলংগ্ন বোধ হয় বটে। অতএব যাঁহারা এই চারিটি শ্লোক প্রক্ষিপ্ত বলিবেন, তাঁহাদের সঙ্গে আমরা বিবাদ করিতে ইচ্ছুক নহি।
বলিতে কেবল বাকি আছে যে, যদিও ৩৭শ শ্লোকে লোক-নিন্দা-ভয় দেখান নাই, তথাপি ইহা স্বার্থবাদ-পরিপূর্ণ। স্বর্গ বা রাজ্যের প্রলোভন দেখাইয়া ধর্ম্মে প্রবৃত্ত করা, আর ছেলেকে মিঠাই দিব বলিয়া সৎকর্ম্মে প্রবৃত্ত করা তুল্য কথা, উভয়ই নিকৃষ্ট স্বার্থপরতার উত্তেজনা মাত্র।
সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি || ৩৮ ||
অতএব সুখ-দুঃখ লাভালাভ, জয়পরাজয় তুল্য জ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ উদ্যুক্ত হও। নচেৎ পাপযুক্ত হইবে।৩৮।
যুদ্ধই যদি স্বধর্ম্ম অতএব অপরিহার্য্য, তবে তাহাতে সুখ দুঃখ, লাভালাভ, জয় পরাজয় সমান জ্ঞান করিয়া তাহার অনুষ্ঠান করিতে হইবে; কেন না, ফল যাহাই হউক, যাহা অনুষ্ঠেয়, তাহা অবশ্য কর্ত্তব্য-করিলে সুখ হইবে কি দুঃখ হইবে, লাভ হইবে কি অলাভ হইবে, ইহা বিবেচনা করা কর্ত্তব্য নহে। ইহাই পশ্চাৎ কর্ম্মযোগ বলিয়া কথিত হইয়াছে। যথা-
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে || ৪৮ ||
পাঠক দেখিবেন, ৩৭শ শ্লোকের পর আবার সুর ফিরিয়াছে। এখন যথার্থ ভগবদ্গীতায় মহিমাময় শব্দ পাওয়া যাইতেছে। এই যথার্থ কৃষ্ণের বংশীরব। ৩৪-৩৭শ শ্লোক ও ৩৮শ শ্লোকে কত প্রভেদ!
এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগ ত্বিমাং শৃণু।
বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্ম্মবন্ধং প্রহাস্যসি || ৩৯ ||
তোমাকে সাংখ্যে এই জ্ঞান কথিত হইল। (কর্ম্ম)যোগে ইহা (যাহা বলিব) শ্রবণ কর। তদ্দ্বারা যুক্ত হইলে, হে পার্থ! কর্ম্মবন্ধ হইতে মুক্ত হইবে।৩৯।
প্রথম-সাংখ্য কি? “সম্যক্” খ্যায়তে প্রকাশ্যতে বস্তুতত্ত্বমনয়েতি সংখ্যা। সম্যগ্জ্ঞানং তস্যাং প্রকাশমানমাত্মতত্ত্বং সাংখ্যম্।” (শ্রীধর)। যাহার দ্বারা বস্তুতত্ত্ব সম্যক্ প্রকাশিত হয়, তাহা সংখ্যা। তাহার সম্যগ্জ্ঞান প্রকাশমান আত্মতত্ত্ব সাংখ্য। সচরাচর সাংখ্য নামটি এক্ষণে দর্শনবিশেষ সম্বন্ধেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তজ্জন্য ইংরেজ পণ্ডিতেরা গুরুতর ভ্রমে পড়িয়া থাকেন। বস্তুতঃ এই গীতাগ্রন্থে সাংখ্য শব্দ “তত্ত্বজ্ঞান” অর্থেই ব্যবহৃত দেখা যায়, এবং ইহাই ইহার প্রাচীন অর্থ বলিয়া বোধ হয়।
দ্বিতীয়-যোগ কি? যেমন সাংখ্য এক্ষণে কপিল-দর্শনের নাম, যোগও এক্ষণে পাতঞ্জলদর্শনের নাম। পতঞ্জলি যে অর্থে যোগ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন,50 এক্ষণে সচরাচর যোগ করিলে তাহাই আমরা বুঝিয়া থাকি। কিন্তু গীতার যোগ শব্দ সে অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই। তাহা হইলে “কর্ম্মযোগ” “ভক্তিযোগ” ইত্যাদি শব্দের কোন অর্থ হয় না। বস্তুতঃ গীতায় “যোগ” শব্দটি সর্ব্বত্র এক অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে, এমন কথাও বলা যায় না। সচরাচর ইহা গীতায় যে অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহাতে বুঝা যায় যে, ঈশ্বরারাধনা বা মোক্ষের বিবিধ উপায় না সাধনাবিশেষই যোগ। জ্ঞান, ঈদৃশ একটি উপায় বা সাধন, কর্ম্ম তাদৃশ উপয়ান্তর, ভক্তি তৃতীয়, ইত্যাদি-এজন্য জ্ঞানযোগ, কর্ম্মযোগ, ভক্তিযোগ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হইয়া থাকে। সচরাচর এই অর্থ, কিন্তু এ শ্লোকে সে অর্থে ব্যবহৃত হইতেছে না। এ স্থলে “যোগ” অর্থে কর্মযোগ। এই অর্থে “যোগ” “যোগী” “যুক্ত” ইত্যাদি শব্দ গীতায় ব্যবহৃত হইতে দেখিব। স্থানান্তরে “যোগ” শব্দে জ্ঞানযোগাদিও বুঝাইতে দেখা যাইবে।
অতএব এই শ্লোকের দুইটি শব্দ বুঝিলাম-সাংখ্য, জ্ঞান; এবং যোগ, কর্ম্ম। এক্ষণে মনুষ্যপ্রকৃতির কিঞ্চিৎ আলোচনা আবশ্যক।
মনুষ্যজীবনে যাহা কিছু আছে, পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতেরা তাহা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন;-Thought, Action and Feeling.আমরা না হয় পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতের মতাবলম্বী নাই হইলাম, তথাপি আমরা নিজেই মনুষ্যজীবন আলোচনা করিয়া দেখিলে জানিব যে, তাহাতে এই তিন ভিন্ন আর কিছুই নাই। এই তিনকেই ঈশ্বরমুখ করা যাইতে পারে; তিনিই ঈশ্বরার্পিত হইলে ঈশ্বরসমীপে লইয়া যাইতে পারে। Thought ঈশ্বরমুখ হইলে জ্ঞানযোগ; Action, ঈশ্বরমুখ হইলে কর্ম্মযোগ; Feeling ঈশ্বরমুখ হইলে ভক্তিযোগ। ভক্তিযোগের কথা এখন থাক। ৩৪ শ্লোক পর্য্যন্ত জ্ঞানের কথা ভগবান্ অর্জ্জুনকে বুঝাইলেন; এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের নামই “সাংখ্যযোগ।”51 জ্ঞানে অর্জ্জুনকে উপদিষ্ট করিয়া ভগবান্ এক্ষণে ৩৯ শ্লোক52 হইতে কর্ম্মে উপদিষ্ট করিতেছেন। কি বলিতেছেন, এক্ষণে তাহাই শুন।
ভাষ্যকারেরা বলেন, এই কর্ম্ম, জ্ঞানের সাধন (শ্রীধর) বা প্রাপ্তির উপায় (শঙ্কর)। অর্থাৎ প্রথমে তত্ত্বজ্ঞান কি, তাহা অর্জ্জুনকে বুঝাইয়া, “যদি অর্জ্জুনের তত্ত্বজ্ঞান অপরোক্ষ না হইয়া থাকে, তবে চিত্তশুদ্ধি দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান জন্মিবার নিমিত্ত এই “কর্ম্মযোগ” কহিতেছেন (হিতলাল মিশ্র)। বলা বাহুল্য, এরূপ কথা মূলে এখানে নাই। তবে স্থানান্তরে এরূপ কথা আছে বটে, যথা-
আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম্ম কারণমুচ্যতে। ৩।৬
কিন্তু আবার স্থানবিশেষে অন্য প্রকার কথাও পাওয়া যাইবে, যথা-
যৎ সাংখৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্যোগৈরপি গম্যতে।
ইত্যাদি।৫।৬।৫
এ সকল কথার মর্ম্ম পশ্চাৎ বুঝা যাইবে।
এই শ্লোকে কর্ম্মযোগের ফলও কথিত হইতেছে। এই ফল “কর্ম্মবন্ধ” হইতে মোচন। কর্ম্মবন্ধ কি? কর্ম্ম করিলেই তাহার ফলভোগ করিতে হয়। জন্মান্তরবাদীরা বলেন, এ জন্মে যাহা করা যায়, জন্মান্তরে তাহার ফলভোগ করিতে হয়। যদি আর পুনর্জ্জন্ম না হয়, তবেই আর কর্ম্মফল ভোগ করিতে হইল না। তাহা হইলেই কর্ম্মবন্ধ হইতে মুক্তি হইল। অতএব মোক্ষপ্রাপ্তই কর্ম্মবন্ধ হইতে মুক্তি।
কিন্তু যে জন্মান্তর না জানে, সেও কর্ম্মবন্ধ হইতে মুক্তি এ জীবনের চরমোদ্দেশ্য বলিয়া মানিতে পারে। পরকালে বা জন্মান্তরে কি হইবে, তাহা জানি না, কিন্তু আমরা সকলেই জানি যে, ইহজন্মেই আমরা সকল কর্ম্মের ফল ভোগ করিয়া থাকি। আমরা সকলেই জানি যে, হিম লাগাইলে ইহজন্মেই সর্দ্দি হয়। আমরা সকলেই জানি যে, রোগের চিকিৎসা করিলে রোগ আরাম হয়। সকলেই জানি যে, আমরা যদি কাহারও শত্রুতা করি, তবে সেও ইহজীবনেই আমাদের শত্রুতা করে, এবং আমরা যদি কাহারও উপকার করি, তবে তাহার ইহজীবনেই আমাদের প্রত্যুপকার করার সম্ভাবনা। সকলেই জানে, ধনসঞ্চয় করিলেই ইহজন্মেই “বড়মানুষী” করা যায়; এবং পরিশ্রম করিয়া অধ্যয়ন করিলেই ইহজন্মেই বিদ্যালাভ করা যায়। সকল প্রকার কর্ম্মের ফল ইহজন্মেই এইরূপ পাওয়া গিয়া থাকে।
তবে কতকগুলি কর্ম্ম আছে, তাহার বিশেষ প্রকার ফলের প্রত্যাশা করিতে আমরা শিক্ষিত হইয়াছি। এই কর্ম্মগুলিকে সচরাচর পাপ পুণ্য বলিয়া থাকে। তাহার যে সকল ফল প্রাপ্ত হইবার প্রত্যাশা করিতে আমরা শিখিয়াছি, তাহা ইহজন্মে পাই না বটে। আমরা শিখিয়াছি যে, দান করিলে স্বর্গলাভ হয়, কিন্তু ইহজীবনে কাহারও স্বর্গলাভ হয় না।কেহ বা মনে করেন, একগুণ দিলে দশগুণ পাওয়া যায়, কিন্তু ইহজীবনে একগুণ দিলে অর্দ্ধগুণও পাওয়া যায় না। শুনা আছে, চুরি করিলে একটা ঘোরতর পাপ হয়। কিন্তু ইহজীবনে চুরি করিয়া সকলে রাজদণ্ডে পড়ে না-সকলে সে পাপের কোন প্রকার দণ্ড দেখিতে পায় না। সকলে দেখিতে পায় না বলিয়া ইহজীবনে চুরির কোন প্রকার দণ্ড নাই-কর্ম্মফলভোগ নাই, এমন নহে; এবং দানের যে কোন পুরস্কার নাই, তাহাও নহে। চিত্তপ্রসাদ আছে-পুনঃ পুনঃ দানে আপনার চিত্তের উন্নতি এবং মাহাত্ম্য বৃদ্ধি আছে। পাপ পুণ্যে ইহজীবনে কিরূপ সমুচিত কর্ম্মফল পাওয়া যায়, তাহা আমি গ্রন্থান্তরে বুঝাইয়াছি,53 পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই। যাঁহাদের ইচ্ছা করিবে, সেই গ্রন্থে দৃষ্টি করিবেন।
সেই গ্রন্থে ইহাও বুঝাইয়াছি যে, সম্পূর্ণ ধর্ম্মাচরণের দ্বারা ইহজীবনেই মুক্তিলাভ করা যায়। সেই মুক্তি কি প্রকার এবং কিরূপেই লাভ হয়, তাহাও সেই গ্রন্থে বুঝাইয়াছি। সে সকল কথা আর এখানে পুনরুক্ত করিব না। ফলে জীবন্মুক্তি হিন্দুধর্ম্মের বহির্ভূত তত্ত্ব নহে। এই গীতাতেই উক্ত হইয়াছে যে জীবন্মুক্তি লাভ করা যায়। আমরা ক্রমশঃ তাহা বুঝিব। যেরূপ অনুষ্ঠানের দ্বারা তাহা লাভ করা যাইতে পারে, তাহাই কর্ম্মযোগ। ইহাও দেখিব। সুতরাং যাঁহারা জন্মান্তর মানেন না, তাঁহারাও কর্ম্মযোগের দ্বারা মুক্তিলাভ করিতে পারেন। গীতোক্ত ধর্ম্ম বিশ্বলৌকিক, ইহা পূর্ব্বে বলা গিয়াছে।
উপসংহারে বলা কর্ত্তব্য যে, আর এক কর্ম্মফলের কথা আছে। হিন্দুরা যাগযজ্ঞ ব্রতানুষ্ঠান করিয়া থাকেন-কর্ম্মফল পাইবার জন্য। এই সকলের ইহলোকে যে কোন প্রকার ফল পাওয়া যায় না, এমন কথা বলি না। একাদশীব্রত করিলে শারীরিক স্বাস্থ্য লাভ করা যায় এবং অন্যান্য যাগযজ্ঞের ও ব্রতাদির কোন কোন প্রকার শারীরিক বা মানসিক ফল পাওয়া যাইতে পারে। তবে হিন্দুরা সচরাচর যে সকল ফল কামনা করিয়া এই সকল অনুষ্ঠান করেন, তাহা এ জন্মে পাওয়া যায় না বটে। ভরসা করি, এ টীকার এমন কোন পাঠক উপস্থিত হইবেন না, যিনি এ প্রশ্নের কোন উত্তর প্রত্যাশা করিবেন।
=============================
47 প্রবন্ধ-পুস্তক হইতে উদ্ধৃত।
48 “It was if my soul were thinking separately from the body; she looked upon the body as a foreign substance, as we look upon a garment.” Wilhelm Meister, Carlyle’s Translation, Book VI.
যে কয়টা কথা ইটালিক অক্ষরে লিখিলাম, পাঠক তৎপ্রতি অনুধাবন করিবেন, গীতার কথাটা বেশ বুঝা যাইবে।
49 “নৈবং” পাঠান্তর
50 যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ:।
51 চতুর্থাধ্যায়ের নাম “জ্ঞানযোগ”। প্রভেদ কি, পশ্চাৎ জানা যাইবে।
52 মধ্যের চারিটি শ্লোক তবে কি প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বোধ হয় না?
53 ধর্ম্মতত্ত্ব।