২ দোয়েল ও অনন্ত প্রস্রাবধারা
ভাঁড়রা এলে প্রথম যে-খসখসে বিরক্তিটা সহ্য করতে হয়, ইচ্ছে হয় সুস্থ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে, তা আবদ্ধতার বিরক্তি; অন্ধকারের দেবতারা দিনের জন্যে জারি করে দেয় সান্ধ্য আইন। অন্ধকার তাদের খুব প্রিয় ও প্রয়োজনীয়, আইনটাকে সান্ধ্য বলা হলেও এটা নৈশ বা বর্বর আইন। সান্ধ্য আইন অন্যদের কেমন লাগে, তা জানে না রাশেদ, তার হয় দশ তলায় লিফটে আটকে থাকার অনুভূতি, আর তলপেটে একটি গর্জনশীল বদ্ধ প্রপাত নিয়ে লিফটে আবদ্ধ থাকা সুখকর নয়। একটা টেলিফোন থাকলেও কিছুটা মুক্তির স্বাদ সে পেতে পারতো, আহা মুক্তি; বা তখন। হয়তো আবদ্ধতাটা হতো আরো কর্কশ, টেলিফোন হয়তো সামরিক নির্দেশে কয়েক দিনের জন্যে লাশ হয়ে পড়ে থাকতো, আর জীবিত থাকলেও কেমন আছো, ভালো আছি’র অতিরিক্ত কোনো কথা কেউ তার সাথে বলতে রাজি হতো না; তার বন্ধুদের কেউ কেউ, যদি তাদের টেলিফোন থাকতো, হয়তো টেলিফোনই তুলতো না। একটা মিথ্যা পরিবেশে তাকেও মিথ্যার অভিনয় করতে হতো; মিথ্যা খুবই প্রজননশীল, একটি আরেকটি, না আরো অনেকগুলোকে জন্ম দেয়। তার টেলিভিশনটা রঙিন হলেও বেশ। হতো; ভাঁড়গুলোর পোশাকগুলো আরো উজ্জ্বল আকর্ষণীয় দেখাতো, তারাগুলো আরো জ্বলজ্বল করতো, চোখ ভালো থাকতো, ঘোষণাগুলো আরো রঙিন শোনাতো, আর যে-ঘোষিকাটির ঠোঁট দুটি ওষ্ঠ না বৃহদোষ্ঠ বোঝা যাচ্ছে না, তাকে আরো প্রবলভাবে। উপভোগ করা যেতো। এক বস্তাপচা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ, কোনো মৌলিকতা খুঁজে পাচ্ছে না রাশেদ,-প্রতিক্রিয়াশীলতায়ও কিছুটা মৌলিকতা থাকা বাঞ্ছনীয়; সব। বিধিবিধান আগের বিধিবিধানের রঙচটা প্রতিলিপি, ঘোষকঘোষিকাগুলো মনের আনন্দে বমি করার মতো সেগুলো মুখস্থ ঢেলে দিচ্ছে। মুখস্থ রাশেদেরও; সেও মুখস্থ ব’লে দিতে পারে : ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী বেআইনি অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য প্রভৃতি রাখার। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে; ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী অবৈধ উপায়ে সম্পত্তি। সংগ্রহের জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে; ১৪ নম্বর ধারায় যে-কোনো লোকের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কোনো রাজনীতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণের জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে; ১৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী সামরিক আইনকে সমালোচনা করার জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে। এর মাঝে ওরা হয়তো ৫টা মন্ত্রী, ৩টা আমলা, আর গোটা ২ চোরাচালানিকেও ধরেছে। ভাঁড়টা প্রথম ধরেছে বা ধরবে কাকে? নিশ্চয়ই সেই অবাঙালি চোরাচালানিটিকে, যার চোরাচালান ও ধর্মে সমান মতি, তবে চোরাচালানের জন্যে নয়, মালের জন্যে; যেখানেই হাত দাও সেখানেই আধমণ মাংস, এমন একটা। ওপরতলার পতিতাকে নিয়ে কয়েক দিন আগে চোরাচালানিটার সাথে খুব একচোট হয়ে গেছে ভাঁড়টার, চোরাচালানিটা ট্রাউজারের জিপ খুলে দেখিয়েছে, বলেছে তার মতো কয়েকটা জেনারেল সে পাছপকেটে রাখতে পারে। সেটাকে নিশ্চয়ই ধরা হয়ে গেছে, যদি সেটা আগেই বিদেশে পালিয়ে না গিয়ে থাকে। এসব ধরাধরি ওদের আবির্ভাবের অবিচ্ছেদ্য অভিনয়-অংশ, দানবদের দেবতা করে তোলার চেষ্টা; এখন মাঠের রাখাল আর রাস্তার পতিতাও ধরাধরির পরিণাম জানে, কয়েক দিন পর ওরা দিনরাত ঘুষ খাবে, বন্দরে বন্দরে চোরাচালানে লিপ্ত হবে, অন্যের সুন্দরী বউকে পত্নী বা উপপত্নী করে। তুলবে, যেগুলোকে সবার আগে ধরবে কয়েক মাস পর সেগুলোই হবে ওদের প্রধান। ইয়ার।
একটা আস্ত উলুক দেখার সুখ পাওয়া গেলো। একটা আস্ত উল্লুককে, আমুণ্ডু উল্লুকের মতোই দেখাচ্ছে ওটাকে–আচ্ছা, উলুক কাকে বলে?–না একটা অবসরগ্রস্ত অবসাদগ্রস্ত উল্লুককে চাকর হিশেবে পেয়ে গেছে ভাঁড়টা, বাঙলায় কী যেনো একটা গান আছে, তোমার বিচার করবে যারা। পাবেই তো, কেনো পাবে না, চাইলে সে দশটা পেতে পারতো, কিন্তু দশটা চাইতে পারছে না এ-মুহূর্তে, তার একটাই লাগবে এখন,-উল্লুকের অভাব নেই উলুকমুলুকে, আপাতত তার একটা উল্লুকই দরকার, যে তার জুতো সাফ। করবে, তাকে জুতো পরিয়ে দেবে, আন্ডারওঅ্যার খুলে দেবে, পা টিপে দেবে, তাকে, এবং বাঙালিকে, তামাসা দেখাবে। বাঙালি বড়োই তামাসা পছন্দ করে। উলুকটা শপথ নিচ্ছে, কঁধজোড়া ঝুঁটিপরা আরেকটা তাকে পবিত্র কাজের মতো শপথ করাচ্ছে, আহা, ওরা পবিত্রতা-অপবিত্রতার পার্থক্য বোঝে না। ওরা না শপথ করেছিলো সংবিধান না কী যেনো রক্ষা করার, এখন ওরা কী করছে তা কি বুঝতে পারছে ওরা? ওদের হাতের কাগজে বাঙলায় যা লেখা, আর ওরা যা পড়ছে, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন; ওরা বলছে আমি শপথ করছি যে ভাঁড় আমাকে পা টিপতে বললে আমি পরম ভক্তিতে পা টিপবো, যদি আমাকে আন্ডারওঅ্যার ধুয়ে দিতে বলেন, আমি তা পবিত্র কাজ বলে সম্পন্ন করবো, যদি আমার প্যান্ট খুলতে বলেন, আমি তা পরম সন্তোষের সাথে সম্পাদন করবো। উল্লুক দুটি কি আন্ডারওঅ্যার পরেছে? দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে রাশেদের মনে হলো ওদের আন্ডারওঅ্যার খুব ঢিলে হয়ে গেছে, দুটিরই হোল আন্ডারওঅ্যারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে ঢলঢল করে ঝুলছে, বারবার রানে পেন্ডুলামের মতো ঘা দিচ্ছে; ঢুশটুশ আওয়াজ হচ্ছে। ভাঁড়টা শপথের দৃশ্য দেখে হাসছে তৃপ্তির সাথে, একটা উপযুক্ত চাকর পাওয়ার দৃশ্যটা তার খুবই উপভোগ্য লাগছে, হয়তো ভাবছে ভবিষ্যতে এমন আরো কতো চাকর শপথ নেবে তার আন্ডারওঅ্যার পরিষ্কার করার। চাকর বানানোর উৎসবে অনেকেই, দুটি বাতিল রাষ্ট্রপতিও, এসেছে, একটা গোলগাল কচ্ছপ আরেকটা লিকলিকে শুকনো, তেঁতুল, দেখে মনে হচ্ছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির গৌরবে তারা ঝলমল করছে। এ-দৃশ্য দেখে অন্যান্য উন্মুকদের কেমন লাগছে, ভাবতে চাইলো রাশেদ, নিশ্চয়ই তাদের কলজে। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষে উলুকটা খুব একটা ভাব করে বেরোনোর। ভঙ্গি করার চেষ্টা করছে, তবে আণ্ডারওঅ্যার-পেরোনো ঢলঢলে হোল নিয়ে খুব অস্বস্তি বোধ করছে, সম্ভবত ঢুশদুশ শব্দটা তাকে কাতর করে ফেলেছে। রাষ্ট্রপতির হোল থাকা অত্যন্ত অস্বস্তিকর। এখন ওটা যাবে কোন নরকে? প্রথমে ভাঁড়টার পা টিপবে; তারপর কয়েকটি মাজারের উদ্দেশে বেরোবে, গিয়ে ইটসিমেন্টকংক্রিটকে বলবে দেখো, আমি কী চমৎকার চাকর হয়েছি, তোমাদের জন্যে ফুল নিয়ে এসেছি, যদিও ফুলটুলের অর্থ আমি বুঝি না, তোমরাও বুঝতে না।
বাঙলাদেশ, তুমি কেমন আছো, সুখে আছো না কষ্টে, নাকি তুমি এসবের বাইরে চলে গেছো, তোমার ভূমিকা শুধু চিৎ হয়ে থাকা, কে চড়লো তাতে তোমার কিছু যায় আসে না, সরাসরি বাঙলাদেশের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে রাশেদের। বাঙলাদেশ কোনো উত্তর দিচ্ছে না, সে কি বলাৎকারে বলাকারে অচেতন হয়ে আছে, তার রান। বেয়ে রক্ত ঝরছে; রাশেদ শুধু তার তলপেটে মরা জলপ্রপাত নিয়ে স্তব্ধতার স্বর শুনছে। খুব কি আহত হয়েছে বাঙলাদেশ, তার বুক কি কুমড়োর মতো ফালি ফালি হয়ে গেছে, গণতন্ত্র হারিয়ে চঁচামেচি করছে কি তার কলজে; না খুশিতে বারবার মুড়ি ভাজছে, আদার কুঁচি আর কাঁচা মরিচ ছিটোচ্ছে, আর কড়া চা খাচ্ছে? একটা সন্দেহ জেগে উঠলো রাশেদের মনে, নিজেরই সম্পর্কে, পিতার সম্পর্কে, যে-গোত্রের সে-অংশ, সে-বাঙালি মুসলমান নামের হনুমানদের সম্পর্কে। ক-গেলাস গণতন্ত্র আর স্বাধীনতা সহ্য করতে পারো, বাঙালি মুসলমান, জিজ্ঞেস করলো রাশেদ, তোমার শেকড়টা কোথায়, কতোদূর শেকড় তুমি ছড়িয়েছে মাটির ভেতরে, মানুষের ভেতরে, সভ্যতার ভেতরে? বাঙালি মুসলমান, তুমি কি সভ্য, যদি তাই হও তাহলে তুমি এতোদিন। পাকিস্থানে রইলে কেমন করে? দোজগে থাকাও অস্বাভাবিক মনে হয় না রাশেদের কাছে, শুধু অস্বাভাবিক পাকিস্থানে থাকা। রাশেদ অনেকবার বমি করেছে দুটি গান গাওয়ার পর; ইস্কুলে ‘পূরব বাঙলার শ্যামলিমায় পঞ্চনদীর তীরে অরুণিমায়’ গাওয়ার পর তার বমি পেয়েছিলো, তারপর ‘পাক সরজমিন সাদবাদ’ গেয়ে বমিই করে। ফেলেছিলো। আসলেই কি বমি করেছিলো সে, নাকি ওই গান গাওয়ার সময় তার যে বমি পায় নি, এতে এখন তার বমি পাচ্ছে? রাশেদ জিজ্ঞেস করতে থাকে, যারা। পাকিস্থানের সাথে থাকতে পারে, ওই গান গাইতে পারে, তারা যুদ্ধ করলেও স্বাধীন হয়ে গেলেও দেশ সৃষ্টি করলেও তাদের সম্বন্ধে সন্দেহ থেকেই যায়। বাঙালি মুসলমান আমি তোমার সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করি, চিরকাল পোষণ করবো। রাশেদ জিজ্ঞেস করতে থাকে, মার্চের শেষরাত্রে ভাঁড়গুলো কি হঠাৎ এসেছে, বাঙালি মুসলমান, তুমি কি এদের জন্ম দাও নি, আসার পথ বানাও নি? রাশেদ জিজ্ঞেস করতে থাকে, তুমি বাঙালি মুসলমান নও, বাঙালি? হা, হা করে হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো রাশেদের; হিন্দুগুলোও যেখানে মুসলমান হয়ে উঠেছে, কী চমকার সালামালাইকুম দেয়, পাঁচকলমাও মুখস্থ বলতে পারে, আর সেখানে মুসলমান, যে লুঙ্গির নিচে হাত দিয়ে খোঁজে আত্মপরিচয়, সে হয়েছে বাঙালি! যেগুলোকে খোয়াড়ে ভরে ভাড়েরা এলো, সেগুলো কি গণতন্ত্র দিয়ে দেশ বাঁধাই করে দিয়েছিলো, স্বাধীনতায় গোলা ভরে দিয়েছিলো? ওদের প্রত্যেকের কি ফাঁসির দড়ি প্রাপ্য নয়? রাশেদের তলপেটে খুব চাপ পড়ছে, সে বারবার বাথরুমে যাচ্ছে তার যেটা মাননিঃসরণ তাও ঘটাচ্ছে, কিন্তু চাপটা অটল থাকছে।
ভাঁড়রা যে আসবে, অনেকখানি এসে গেছে, এটা অজানা ছিলো কার, এর জন্যে অপ্রস্তুত ছিলো কে? কয়েক দিন আগেও যেখানেই গেছে রাশেদ, যার সাথেই কথা বলেছে, সে-ই কি সব কথার মধ্যে মাঝেমাঝে বলে নি দেশের যে-অবস্থা তাতে মিলিটারি আসাই ভালো? যে-আমলা ঘুষ খেতে খেতে চর্বির জন্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেও যেমন বলেছে কুত্তারবাচ্চাদের অর্থাৎ ওই একপাল মন্ত্রীর থেকে মিলিটারি অনেক ভালো, ঘুষ যে-জীবনে চোখে দেখে নি বলে স্বপ্নেও দেখে নি, সে-শিক্ষকও বলেছে শুয়োরগুলোর থেকে মিলিটারিই ভালো। রাশেদ রিকশাঅলাদের সাথে কথা বলে দেখেছে, সে মাঝেমাঝেই রিকশাঅলাদের সাথে কথা বলে ক্লান্তি কমিয়ে আনে বা সে যে সাধারণ মানুষের দরদী এটা নিজেকে বোঝাতে চায়, তারাও বলেছে মিলিটারিই ভালো। কয়েক দিন আগে এক বন্ধুর উপপত্নীর বাসায় সন্ধ্যা কাটাতে গিয়েছিলো, তাদের সামনে বসে সারাক্ষণ ঝিমোচ্ছিলো কালোবাজারি স্বামীটা, বন্ধুটি টেলিফোন করতে যাওয়ার ছুঁতোয় পুব কোণার শয্যাকক্ষে গিয়ে মৃদু মৃদু চুমো খেয়ে আসছিলো তার অধ্যাপিকা উপপত্নীকে, যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাশেদকে বলছিলো, রাশেদ ভাই, আপনার কতো সুখ, হাঁটতে হাঁটতে আপনি কতো কথা ভাবতে পারেন; আমি যেখানে যাই গাড়িতে যাই কোনো কথা ভাবার সময়ই পাই না, বহুদিন আমি কিছুই ভাবি না, সেই পঞ্চাশী তন্বীও বলেছিলো, এর চেয়ে মিলিটারিই ভালো। তার স্বামীটি–কার। থেকে, আমার থেকে?–ব’লে রসিকতা করতে গিয়ে খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিলো, কেননা মহিলা মুহূর্ত দেরি না করে বন্ধুটির নাম করে বলেছিলো, তোমার থেকে তো রফিক সাহেবও উত্তম। পতির থেকে উপপতি সব সময়ই উত্তম, পত্নীর থেকে উপপত্নী যেমন আবহমান কাল ধরে উত্তম। যেগুলোকে তাড়িয়ে ওরা এসেছে, রাশেদ তাদের প্রায় প্রত্যেকটিকেই চেনে, কারো কারো সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল তার, যদিও অনেক দিন যোগাযোগ নেই, ওইগুলো যে একেকটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা বাঙলার মূর্খ জনগণেরও তাতে সন্দেহ ছিলো না। যদি চাষী, রিকশাঅলা, মাঝি, জেলে, শ্রমিকের কোনো ক্ষমতা থাকতো, তাহলে তো তারা ওগুলোকে ধরে ফাঁসিতে ঝুলোতে অনেক আগেই; ক্ষমতা ছিলো না বলে, তারা যেহেতু শুধুই ক্ষমতার উৎস, হারামজাদারা ক্ষমতার পরিণতি, তারা ওগুলোর জন্যে তোরণ বানিয়েছে, ওদের নামে ভিড় করে শ্লোগান দিয়েছে। বুড়ো আলুর বস্তাটিও ছিলো অস্থিতে অস্থিতে গিঠে গিঁঠে বদমাশ, কোনো-না-কোনো প্রভুর পা চেটেছে সারাজীবন, এবং উঠতে উঠতে সকলের মাথার ওপর উঠে গিয়েছিলো। এখন আলুর বস্তার মতো নিজের ঘরে পড়ে আছে, সেটা মরলে একটা লাশ ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতো না। লাশ এখানে অত্যন্ত মূল্যবান, কিন্তু ওর লাশের মূল্য একটা কুকুরের লাশের থেকে একপয়সাও বেশি নয়।
সামরিক ভাঁড়রা যদি পারতো, তাহলে সান্ধ্য আইনেই ঢেকে রাখতে আকাশ-মাটি-জল চিরকালের জন্যে, অন্তত ওরা যতোদিন থাকবে ততোদিন ধ’রে, কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে দু-তিন দিনে যাকে ধরার, ধরে, যাকে মারার, মেরে, এবং যাকে চাকর বানানোর, তাকে চাকর বানিয়ে সান্ধ্য আইন তুলে নেয়। রাশেদের প্রস্রাব এখনো জমে আছে তলপেটে, রাশেদ এর নাম দিয়েছে শাশ্বতপ্রস্রাব, তা নিয়ে বাইরে বেরোয়। সবাই বলবে সে একা বেরোচ্ছে, রাশেদ জানে একা বেরোচ্ছে না, তার সাথে বেরোচ্ছে তার ওই অদ্ভুত স্তব্ধ প্রপাতটি, যা সে প্রচণ্ড চেপেও বের করে দিতে পারছে না। একটু অচেনা লাগছে সব কিছু যদিও কিছুই অচেনা নয়, রাস্তাগুলো যেনো তাকে দেখে একটু লজ্জা পাচ্ছে, সেও লজ্জা পাচ্ছে রাস্তার মুখের দিকে তাকাতে; মনে হচ্ছে–সান্ধ্য আইনের আড়ালে চোখের আবডালে ওরা সম ও বিষম সব ধরনের মৈথুন করে করে জীর্ণ হয়ে পড়েছে। বেরিয়েই রাস্তায় চোখে পড়লো ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, তবে ওরা খুব বীরের মতো দাঁড়িয়ে নেই, দেশকে উদ্ধার করে ফেলেছে এমন ভাব হেলমেটে ও গোঁফে কিছুতেই দানা বাঁধাতে পারছে না, অপরাধের চিহ্নই স্পষ্ট লেগে আছে ওদেরউর্দিতে। মুদি দোকানদারটা আগের মতোই হাসছে, তবে একটু বিব্রত ও কথায় একটু পরিহাসের ঝাঁজ; রিকশাঅলাটা পা চালাচ্ছে, আর বাঁকা হয়ে মিলিটারি ট্রাকের দিকে তাকিয়ে হাসছে। রাশেদ যাবে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে রাশেদ পড়ায়; অন্যরা সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে করে, নামও বিশ্ববিদ্যালয়; রাশেদের কাছে ওটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ই। সে ওটাকে কেননা মনে করে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভালোবেসে, না ঘেন্নায়, তা ভালো করে সেও জানে না; তবে বিদ্যালয়ের কথা মনে হলেই তার মনে পড়ে যায় বাল্যকালের কবরঘেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে, যেখানে গিয়ে তার আবার ভর্তি হতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে এটাকেই মনে করে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়। কেনো যেনো তার মনে হয় মুসলমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানায় না, মানায় মাদ্রাসায়, যেখানে দেড় হাজার বছর ধরে সব কিছু মুখস্থ করে ফেললেও জ্ঞানের জ-ও জন্মে না। রাশেদ আশা করেছিলো দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছে শহর, চোখ মেলে তাকাতে পারছে না, কাঁদতে কাঁদতে ব্লাউজ উপচে তার প্রকাণ্ড স্তন বেরিয়ে পড়েছে, এমন ভাব দেখবে শহরের শরীরে; কিন্তু শহরের দেহের সহ্যশক্তি দেখে মুগ্ধ হলো রাশেদ। লোকজনের মুখে একটু বিনীত বিনীত ভদ্র ভদ্র ভাব চোখে পড়লো রাশেদের, চৌরাস্তার ভিখারিটাও একটু বিনয়ের সাথে ভিক্ষা চাইছে, সবাইকে একটু ক্লান্ত সুন্দর লাগছে, হয়তো দু-তিন দিনের সান্ধ্য আইনের সুযোগে পেট ভরে সঙ্গম করে তারা নতুন বরের মতো শ্রান্ত। সুন্দর হয়ে উঠেছে। মাস দশেক পর দলে দলে জন্ম নেবে সামরিক শিশুরা। সামরিক আইন এলে বাঙালি মুসলমান প্রথমে খুব শান্তশিষ্টসুন্দর হয়ে ওঠে, এবারও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। রিকশার পাশ কেটে একটা লাল গাড়িতে একটা গোলগাল রাজনীতিবিদকে যেতে দেখলো রাশেদ, তার মুখও শান্তসুন্দর; হয়তো সে ভড়দের। সাথে দেখা করে ফিরলো, বা দেখা করতে যাচ্ছে, বা দেখা করার সুযোগ না পেয়ে বিষণ্ণতায় সুন্দর হয়ে উঠেছে।
রাশেদ যে-রিকশাটায় বসে আছে, যে-রিকশাঅলা তাকে টানছে, তার পাশ দিয়ে যে-গাড়িগুলো যাচ্ছে, দোকানে দোকানে ঝুলছে যে-সাইনবোর্ডগুলো, আর যে-বাঙালি মুসলমান দু-দিন পর রাস্তায় বেরোনোর অধিকার পেয়েছে, তারা বেগম হাওয়ার জরায়ু থেকে বেরোনোর পর থেকেই অধিকারহীনতায় অভ্যস্ত বলে মনে হচ্ছে রাশেদের। তাদের পিঠে চাবুকের দাগ, দাগ তাদের চোখে সুন্দর অলঙ্কারের মতো, চাবুক তাদের কাছে সুখকর। রিকশাঅলাটিকেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে রাশেদের যে সে মুক্তি বা স্বাধীনতার কথা জানে কিনা, সে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের কথা জানে বা শুনেছে, কিন্তু মুক্তির কথা জানে না; টয়োটায় সামরিক বিধিনিষেধ মেনে চলে গেলো যে-লোকটি, তার মুখ দেখে তো মনে হলো না কয়েক দিন আগে তার একটা বড়ো সম্পদ ছিলো, এখন সে তা হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হয়ে গেছে। কারো মুখ দেখেই তা মনে হচ্ছে না। সে যখন। তার প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে গিয়ে পৌঁছোবে, রাশেদের ভয় হতে লাগলো, সেখানে। সবার এতো উল্লাস দেখবে যে সেও উল্লসিত হয়ে উঠবে, সে ভুলে যাবে তার জন্মজন্মান্তরের পিঠের দাগটিকে; ওই বিদ্যালয়ের সামনে অতিকায় যে-মূর্তিগুলো রয়েছে, রাশেদের আরো বেশি ভয় করতে লাগলো যে সেগুলোর মুখেও সে কোনো কষ্ট দেখতে পাবে না, দেখতে পাবে উল্লাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের চা-ঘরটিতে খুব ভিড়, উল্লাসে ফেটে না পড়লেও কাঁপছে ঘরটি, কালো যে-ছেলেটা অন্যান্য দিন বিকলাঙ্গের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চা আর শুকনো বিস্কুট পরিবেশন করে, যাকে চা নিয়ে আসতে বলাটাকে অপরাধ বলে মনে হয় রাশেদের, সেও খুব উৎপর হয়ে উঠেছে, মনে। হয় তার আরেকটা পা গজিয়েছে; অধ্যাপকেরা হিশেব নিচ্ছে কে কে উপদেষ্টা হয়েছে, কে কার আত্মীয়, কে কার সাথে ইস্কুলে পড়তো। খুব মূল্য পাচ্ছে এক বুড়ো সহকারী অধ্যাপক, যে দশ বছর ধরেই খুব বিমর্ষ ছিলো পদোন্নতি না পেয়ে, আজ সে খুব উল্লসিত, সবাই তাকে ঘিরে ধরেছে, সেও গৌরবে গোশল করে নিচ্ছে এজনো যে তার একটা ভাগ্নে জেনারেল, এবং এখন খুব শক্তিশালী পুরুষ, দু বা তিন নম্বরেই আছে, বলা যায় না এক নম্বরেও উঠে যেতে পারে। মামা ভাগ্নের গুণ কীর্তন করে চলেছে শুনে মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে অধ্যাপকদের, আর রাশেদ খুব বিস্মিত হচ্ছে যে জেনারেলেরও। কীর্তনযোগ্য গুণ থাকতে পারে। ম্যাকআর্থার নামের একটা জেনারেলের নাম মনে পড়লো, যাকে বরখাস্ত করার কারণ হিশেবে তার দেশের রাষ্ট্রপতি বলেছিলো, সে একটা নির্বোধ কুত্তারবাচ্চা বলে তাকে আমি বরখাস্ত করি নি, যদিও সে তা-ই, তবে নির্বোধ কুত্তারবাচ্চা হওয়া জেনারেলদের জন্যে কোনো অযোগ্যতা নয়; তাকে বরখাস্ত করেছি, কেননা সে রাষ্ট্রপতিকে মানছে না। একটা ঝড়দার, অর্থাৎ একটা প্রাক্তন ভাড়ের। উঠোনটুঠোন পরিষ্কার করার কাজ করেছিলো যে-অধ্যাপকটি, তাকে খুব প্রফুল্ল দেখাচ্ছে; সে হয়তো আবার ঝাড়দারের বা জুতোশেলাইয়ের কোনো কাজ পাবে, হয়তো সে এরই মাঝে ভাঁড়দের পায়ে সেজদা করে এসেছে; মুখ থেকে তার ঝিলিক। বেরোচ্ছে।
কারো চোখেমুখে কোনো উদ্বেগ নেই, সবাই যার প্রতীক্ষায় ছিলো তার আগমনে স্বস্তি পাচ্ছে, স্নায়ু থেকে ভার নেমে গেছে। পতন দেখতে বাঙালি মুসলমানের খুবই ভালো লাগে, রাশেদ ভাবলো, একটাকে ঠেলে ফেলে, শুধু ঠেলে ফেলে নয় কবরে। ঢুকিয়ে দিয়ে, আরেকটা আসে, এবং যে আসে আর যেতে চায় না, মনে করে সে-ই মালিক, তখন আরেকটা আসে আগেরটাকে ঠেলে ফেলে, কবরে ঢুকিয়ে দিয়ে। আগেরটাও যে সরল পথ দিয়ে এসেছিলো, তা নয়; এখানে কেউ সরল পথে আসে না, সরল পথে আসার উপায় নেই, আসতে হয় পতন ঘটিয়ে। আমরা, রাশেদ ভাবলো, বাঙালি মুসলমানেরা কারো উত্থানে সুখ পাই না, অন্যের উত্থান হচ্ছে নিজের পতন, আমরা সুখ পাই কারো পতনে, শক্তিমানের পতনে। শক্তিমানগুলো এখানে নিখাদ শয়তান, একটা শয়তানকে ধংস করে আরেকটার প্রাদুর্ভাব ঘটে, আরেকটা এসে তার গর্ত খোড়ে, এমনই দেখে আসছে এ-জাতি, মনস্তাত্ত্বিকভাবে এরই জন্যে তৈরি বাঙালি মুসলমান। চা চলছে খুব আর চলছে কোলাহল, পতিত শয়তানদের একেকটির কেলেঙ্কারির রগরগে বর্ণনায় মুখর সবাই। কাকে কাকে ধরা হয়েছে পেশ করা হচ্ছে। সে-তালিকা, কে কত কোটি টাকা মেরেছে তারও হিশেব দেয়া হচ্ছে। কাম আর টাকা, টাকা আর কাম হচ্ছে প্রধান বিষয়, টাকা আর কামের কথা বলার সময় তাদের সারা শরীর উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, তারপর স্খলিত হওয়ার মতো শিথিলতার ভাব। জাগছে; রাশেদ জানে এ-দুটি ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের ক্ষুধা মেটে নি। কেউ যে নতুন ভাঁড়রা এসেছে বলে উৎসব করছে, এমন নয়, তবে পুরোনোগুলো যে ধ্বংস হয়েছে, তাতেই স্বস্তি বয়ে যাচ্ছে রক্তনালি দিয়ে, যদিও অচিরেই তাদের রক্তে অস্বস্তি ডিম, ছাড়তে শুরু করবে। বাঙালি মুসলমান পতনসম্ভোগী জাতি, পতনই তাদের বেঁচে থাকার খাদ্য; এদের যখন পতন ঘটবে, তখনও সুখ পাবে এ-জাতি। পতন প্রচুর দেখা হয়েছে, পতন এখানে নারকীয় বিভীষিকার মধ্যে দিয়েও আসে, মুসলমানের ইতিহাসে যা নতুন নয়, শোচনীয়ও নয়; এ-জাতির রক্তের মধ্যে রয়েছে বিভীষিকার জন্যে মোহ।
যখন বেরোচ্ছে রাশেদ, রিকশা খুঁজছে, রিকশাঅলারা আগের মতোই তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না; কোনো-না-কোনো ছাত্রীকে তুলে খুশিতে চলে যাচ্ছে; একটা রিকশা গেলো তারই পাড়ায়, তার ডাক শুনতেই পেলো না রিকশাঅলা, শুনলেও আর সে আট টাকা ভাড়া দিতে চাইলেও রিকশাঅলাটা এমনভাবে মুখ ফেরাতো যেনো সে একটা। পচা জন্তু, যাকে ওই পবিত্র রিকশায় তোলা যায় না, কিন্তু পাঁচ টাকায় মেয়েটিকে নিয়ে সে খুশিতে চলে গেলো-এতো খুশি যে ট্রাকের নিচে পড়বে মনে হচ্ছে, তবে নতুন সামরিক যুগের প্রথম সপ্তাহে হয়তো বাঙালি মুসলমান ট্রাকড্রাইভারও আইন মেনে চলছে; পরিত্যক্ত হলেও রাশেদের ভালো লাগলো যে সৌন্দর্যের ডাকে আজো এ-ভূখণ্ডের মানুষ সাড়া দেয়। তখন গাড়িটা এসে থামলো রাশেদের পাশে, বেরিয়ে এলো লিলি। বিলেত থেকে লিলি কখন ফিরেছে রাশেদ জানে না, লিলিকে দেখলে রাশেদ বুঝে ফেলে তার জীবনের কয়েক ঘণ্টা অপচয় হয়ে গেলো। কোনো নারীর পাশে ব’সে জীবন অপচয়ের বোধ যে জাগতে পারে, এটা রাশেদ আগে বিশ্বাস করতো না, কিন্তু লিলির সাথে পরিচয়ের পর তার মনে এ-মৌলিক বোধটি জন্ম নিয়েছে, যদিও লিলিকে সে পছন্দ করে। দেখা হলেই লিলি প্রথমে তার জীবনপাঁচালির কিছু স্তবক ধীরে ধীরে শোনায়, অনেকগুলো পরিকল্পনার কথা বলে, যেগুলো সে কখনোই বাস্তবায়িত করবে না, যা আধঘণ্টায় করে ফেলার কথা তা কয়েক ঘণ্টা ধরে সে করে বা করে না, এবং রাশেদকে ছাড়ে না। পাঁচ-ছ বছরের বড়ো লিলি এবং পাঁচ-ছ বছর আগে লিলির সাথে পরিচয় হয়েছে রাশেদের; এক সময় যে লিলি রূপসী ছিলো, তা তার শরীর আজো স্থানে স্থানে অকুণ্ঠভাবে প্রকাশ করে। লিলি আজো পুরুষ পছন্দ করে, সব সময় কোনো-না-কোনো পুরুষ পাশে রাখতে তার ভালো লাগে, হয়তো আজ কাউকে সংগ্রহ করতে না পেরে রাশেদের খোঁজে এসেছে বা এসেছে যে-কোনো একটা পুরুষের খোঁজে, এবং রাশেদকে পেয়ে গাড়ি থামিয়েছে। লিলি ডাক দিলে সচিবালয়। থেকে গোটা দশেক, মতিঝিল থেকে গোটা পনেরো, রাজনীতিক দলগুলো থেকে গোটা পাঁচেক ভাইয়ের উন্নয়নপ্রকল্প, আমদানিরপ্তানি, চোরাচালান, আর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র। ফেলে ছুটে আসার কথা, কিন্তু আজ সেগুলো হয়তো নিজেদের লুকিয়েছে বা নিষ্ঠার সাথে মেনে চলছে সামরিক আদেশ, তাই লিলি একটিও পুরুষ পায় নি। সামরিক আইন এলে প্রথমে পুরুষের আকাল দেখা দেয়। লিলি তাকে টেনে গাড়িতে তুলে জানালো যে শহীদ ভাইকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে; সে যাচ্ছে শহীদ ভাইয়ের বাসায়, রাশেদকেও যেতে হবে। শহীদ একটা পাকা আমলা, আস্ত হারামজাদা, সেটার পাছায় দুটো বন্দুক ঢুকিয়ে দেয়া হলেও রাশেদের পক্ষে সামান্য দুঃখ পাওয়া অসম্ভব, বরং রাশেদ অনেকের মতোই সুখ পাবে; ওটা মারা গেলেও রাশেদের কিছু আসে যায় না, এমনকি ওটার জানাজায় গিয়ে পুণ্য কামানোরও কোনো ইচ্ছে তার হবে না, কিন্তু লিলিকে এড়ানো অসম্ভব। লিলিও ওটাকে দেবতা মনে করে না, শয়তানই মনে করে; অনেক বছর ধরে দেখাও নেই, কিন্তু কাতরতা তার স্বভাব, শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী দুঃখের। মধ্যেও লিলিকে দেখলে ক্ষেপে উঠতে পারেন, কেননা তার বিশ্বাস শহীদ যেমন লিলিকে ছাড়ে নি তেমনি লিলিও শহীদকে ছাড়ে নি, তবু আজ লিলি কেমন কেমন বোধ করছে শহীদ ভাইয়ের জন্যে, তাই শহীদ ভাইয়ের বাড়ি তাকে যেতেই হবে। রাশেদের জন্যে। বিব্রতকর হচ্ছে একটা হারামজাদার বাসায় যাওয়া, যা ওই হারামজাদাটা কোনোদিন। জানবেও না। ওর বাসায় গিয়ে দেখা গেলো খুব কষ্ট পাওয়ার চেষ্টা করছে শহীদের। বউটি, ক্যান্সারে যার মরে যাওয়ার কথা ছিলো বছর দুয়েক আগে, কিন্তু কষ্ট খুব পাচ্ছে না, পঞ্চাশ বছর বয়সে স্বামীর জন্যে কষ্ট পাওয়া খুবই কঠিন দায়িত্ব। হারামজাদাদের বউগুলো দুঃখকষ্টের চমৎকার ফ্যাশন আয়ত্ত করেছে দু-দশকে, ওরা দুঃখে গলে পড়ে, ওদের শাড়ি খসে পড়ে, ওদের স্তনবৃত্ত দিগ্বলয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে, নিরাসক্ত দর্শকদের কাছে দৃশ্যটা হয়ে ওঠে এক্সএক্স ছবি দেখার মতোই উপভোগ্য। রাশেদ সামরিক আইনের কল্যাণে একটু দূরে বসে একটি এক্সএক্স ছবি উপভোগ করতে লাগলো।
হারামজাদার বউটাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো আরেকটা হারামজাদার বউ। সে হারামজাদাটাকে অবশ্য এখনো মিলিটারিরা ধরে নি, হয়তো ধরবে না; সেটা আমলাগিরি ছেড়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে কোটিপতি হয়েছে, এবং দেশেও নেই, সাধারণত থাকে না। লিলি যখন তার স্বামীর অর্থাৎ কলিম ভাইয়ের সংবাদ জানতে চাইলো, তখন কলিম ভাইয়ের বউ বললো, খানকিমাগিটা আবার দেশে এলো কবে? তার কাছে লিলির দেশে ফেরা দেশ মিলিটারিদের দখলে চলে যাওয়ার থেকে অনেক বিপজ্জনক, লিলির বিদেশে থাকাও কম বিপজ্জনক নয়, তার হারামজাদাটা বিদেশে গেলেই লিলির সাথে গড়িয়ে আসে বলে তার বিশ্বাস। আমলাগুলোর বউরা, যৌবন যাদের এখন মাংসের বদলে প্রসাধনের করুণার ওপর নির্ভরশীল, বিপন্ন এটা জানে। রাশেদ; সুযোগ পেলেই ওরা ছোটো আমলাদের বউগুলোকে রেস্টহাউজে তোলে, শরীরটা সুস্বাদু হ’লে একদিন যার জন্যে আত্মহত্যা করতে চাইতো সেটাকে তালাক দিয়ে ছোটো আমলার বউটাকে ঘরে তোলে, ছোটো আমলাটা আরো ছোটোটার বউ ভাগায়। কলিমের বউটাও কলিমের ভাগানো বউ, সলিম না কার বউ ছিলো বছর দশেক, কলিম তাকে ভাগিয়ে এনেছে, আর লিলি কলিমকে একবার প্রায় ভাগিয়ে নিয়েই গিয়েছিলো, আরেকটুকু হলেই কলিম, তার কলিম আর তার কাছে ফিরতো না, সে-দাগটা বেশ তাজা রয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তার ভাষা; কয়েকবারই লিলিকে। সে খানকি, বেশ্যা বলে পরোক্ষ সম্বোধন করলো, কিন্তু লিলি, এ-সতীদের থেকে অনেক মার্জিত ও মানবিক, শুধু বললো, আপনার ভাষা আজকের জন্যে শোভন নয়। কলিমের স্ত্রীর ভাষা তাতে আরো সাধ্বী হয়ে উঠলো, লিলির গোপনতম প্রত্যঙ্গের নাম ধরে। জানালো যে তার ওই প্রত্যঙ্গটির ক্ষুধা মিটবে না। শহীদের স্ত্রী তখনো কষ্ট পাওয়ার জন্যে অধ্যবসায় করে চলেছে, কষ্টের এক ফাঁকে জানালো ওরা শহীদকে একটা মাঠের মধ্যে ফেলে রেখেছে, একটা বালিশও নেই, মশার কামড়ে সে কালো হয়ে যাচ্ছে, এমনকি তাকে একটা বদনাও দেয়া হয় নি। বালিশ, মশারি, বদনার মতো বস্তুর কথা শুনে রাশেদ বিস্মিত হলো; রাশেদের ধারণা ছিলো ওই হারামজাদাদের জীবনে এসবের কোনো ভূমিকা নেই, ওরা এসব চেনে না, চেনে শীততাপ, গাড়ি, লন্ডনপ্যারিস, হুইস্কি, সুন্দর সুন্দর নারী। সামরিক শাসনের সূচনায় এগুলোই হয়ে উঠেছে শহীদের মতো একটা আমলার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? এক বোতল ব্ল্যাকলেবেল না চেয়ে সে চেয়েছে একটা বদনা, এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে? বউটি বলে চলছে, একটা মশারি কেনা দরকার, একটা বালিশ আর একটা বদলা কেনা দরকার, কিন্তু সে এখন উঠতে পারছে না, বাজারে গিয়ে সে এসব কিনবে, সে-শক্তি তার নেই। কলিমের বউটা এতে কান দিচ্ছে না, সে এসব শুনতেই পাচ্ছে না; তার জীবনে এখনো বালিশ-মশারি-বদনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নি, বরং এসব শব্দ শুনতে খুবই ঘিনঘিনে লাগছিলো তার। রাশেদ বুঝতে পারছিলো সামরিক শাসন তার জীবনে এক কৌতুককর শোকনাটক হয়ে দেখা দিতে যাচ্ছে, বউটি বদনাবালিশ বলার সময় বারবার তাকাচ্ছে। রাশেদের দিকে, অর্থাৎ সামরিক আইনে ধরা-পড়া একটা বদমাশের জন্যে বদনা কেনাই হয়ে উঠতে যাচ্ছে তার নিয়তি। কিন্তু বউটা কোনো টাকাপয়সা বের করছে না, রাশেদকে কি বদনাবালিশ নিজের পয়সায়ই কিনে আনতে হবে? আমলাদের বউগুলোও বেশ পাকা আমলা, রাশেদকে দিয়ে রাশেদের পয়সায় বদনা কিনিয়ে ছাড়বে একটা হারামজাদার জন্যে, হারামজাদাটা যখন মাঠের ঝোপে বসে বিড়ি টানতে টানতে পাছায় পানি ঢালবে, তখন জানবেও না বদনাটা রাশেদের পয়সায় রাশেদের কেনা। সমাজ, রাজনীতি, উত্থান, পতন সত্যিই জটিল ব্যাপার, কার বদনার পানি কে কোথায় ঢালে। রাশেদ অবশ্য জানে লিলি ব্যাগ খুলবে, সে আন্তরিক হতে জানে, এবং তাই হলো। রাশেদ বেরোলো বদনা, মশারি, বালিশ কিনতে; কিন্তু সে কি জানে কোথায় মেলে। এসব, অনেক বছর ধরে এসব তো তারও অভিজ্ঞতার বাইরে। ছাত্রজীবনে সে মশারি কিনতে গিয়েছিলো সদরঘাটে, আজো সেখানে যাবে নাকি? তার মনে পড়লো। নিউমার্কেটের কথা, লিলির গাড়িতে চেপে সে বদনা কিনতে বেরোলো, বুঝতে পারলো রাশেদ যে সামরিক আইনের হাত বেশ দীর্ঘ, ওই হাত ছেলেবেলায় তাকে দিয়ে জঙ্গল সাফ করিয়েছে, আজ তাকে দিয়ে বদনা কিনোচ্ছে একটা বদমাশের জন্যে, কালকে হয়তো একটা বেশ্যার ট্যাম্পুন কিনোবে। তার তলপেটে যে-প্রপাত জমে আছে, বদনা কিনতে কিনতে মনে হলো, ওই প্রপাত কংক্রিটের মতো জমে যাচ্ছে, কোনোদিন বেরোবে না, কিন্তু চাপ দিতে থাকবে অনবরত।
তখন বিকেল, একটি চৌরাস্তায় সে গাড়ি থেকে নামলো। সারাদিন বাসায় যায় নি, সবাই হয়তো তাকে নিয়ে ভয় পেতে শুরু করেছে, সে আরেকটুকু গুরুত্বপূর্ণ হলে খোঁজাখোজি পড়ে যেতো এরই মাঝে; সে নিশ্চিত তাকে নিয়ে তেমন কিছু শুরু হয় নি। হয়তো মৃদু আর বাবা তার কথা একটু বেশি বলছে। আরো কিছু সময় বাইরে থাকার তার ইচ্ছে হলো, সামরিক আইন উপভোগের, বাইরে হেঁটে হেঁটে, সাধ জাগলো তার। পথে পথে ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, কোনো কোনো ট্রাকে ভয় দেখানোর মতো অস্ত্রপাতি সাজিয়ে ওরা বীরের মতো যাচ্ছে, বিদেশি বিদেশি দেখাচ্ছে ওদের; আর রিকশায় বা হেঁটে, এমনকি গাড়িতে যাচ্ছে যারা, তাদের লাগছে শূদ্রের মতো, যেনো তারা নগরে অধিকারহীন ঢুকেছে। লিলি তাকে এ-চৌরাস্তায় নামিয়ে দেয়ার পর রাশেদ একটিও নারী দেখে নি, সে দাঁড়িয়ে রিকশাগুলোতে নারীর মুখ খোঁজার চেষ্টা করলো, কিন্তু একটিও নারী দেখতে পেলো না। শহর থেকে কি পালিয়ে গেছে নারীরা, রাস্তা কি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তাদের জন্যে? একাত্তরেও রাস্তায় তাদের দেখা যেতো না, বারান্দায়ও না; তাদের শাড়িও শুকোতে হতো ঘরের ভেতরে, তেমনি হয়ে গেছে আজ? এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি, রাশেদ ভাবলো, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, নারী দেখার চেষ্টা করছি, জলপাইরঙের ট্রাকের দিকে তাকাচ্ছি, এটা কি সিদ্ধ, এটা কি কোনো নির্দেশের মধ্যে পড়ে না? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার ভেতরে নিশ্চয়ই অভিসন্ধি থাকে, মানুষ শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, কোনো অভিসন্ধি থাকলেই মানুষ একা একা কোনো চৌরাস্তায়, বাজারের গেইটে, বা কোনো গাছের নিচে দাঁড়ায়, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। একবার সে একটি মেয়ের জন্যে বোশেখের দুপুরে একটি গাছের নিচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, মেয়েটি আসছিলো না, আর রাশেদের মনে হচ্ছিলো প্রত্যেকটি গাড়ি আর রিকশা তার। মনের অভিসন্ধি জেনে ফেলছে, এখনি কেউ এসে তাকে ধমক দিয়ে বলবে, মেয়েটিকে। আজ তুমি চুমো খাবে না। দাঁড়িয়ে থাকলেই মাথায় চক্রান্ত আসে, এই যেমন রাশেদের মাথায় নানা চক্রান্ত আসছে। এখন যদি ট্রাক থেকে ওই বিদেশি বিদেশি জলপাইরঙটি নেমে তাকে বলে সে চক্রান্ত আটছে, উত্তর দিকে একটা আপত্তিকর আবেগ চালনা। করছে, তাহলে কি সে অস্বীকার করতে পারবে? বোঝাতে পারবে সে চক্রান্ত করছে না, শুধু ঘৃণা করছে, আর ঘৃণা এমন আবেগ যা চালনা করা যায় না, যা অক্রিয়? ঘৃণা করা কি সিদ্ধ সামরিক আইনে? রাশেদ হাঁটতে শুরু করলো, এবং তাকে দেখলো; প্রথম খুব অচেনা অদ্ভুত লাগলো, জলপাইরঙের শহরে তাকে দেখার আশা করে নি রাশেদ। সে। একটি পাখি। অনেক দিন রাশেদ পাখি দেখে নি, দেখার কথা ভাবেও নি; কিন্তু ছোটো একমুঠো পাখিটার বুকের শাদারঙ দেখে বুকে কাঁপন বোধ করলো রাশেদ। এটা নিশ্চয়ই দোয়েল, সে ভাবলো। দোয়েলটির জন্যে এখানে একটা আমগাছ থাকা উচিত। ছিলো, তাতে সবুজ পাতা থাকা উচিত ছিলো; কিন্তু নেই, দোয়েল দেয়ালের ভাঙা হঁটের ওপর বসে আছে। দোয়েলটির জন্যে আম গাছ নেই, এটা বেশ স্বাভাবিক; দোয়েলটিরই তো থাকার কথা নয় এখানে। তবু সে এখানে কেনো? এই শহরে কেনো? সামরিক আইনের মধ্যে শহরের এই চৌরাস্তার পাশের দেয়ালে কেনো? রাশেদ দেয়ালটির আরেকটুকু কাছে আসতেই দোয়েল উড়ে একটু দূরে সরে গিয়ে আবার বসলো, হয়তো। বসতো না, বসেছে ভালোভাবে উড়তে পারছে না বলে। ওর ডান ডানাটি কি ভাঙা, কয়েকটা পালক খসে গেছে ডানা থেকে? রাশেদ আবার এগোতেই আবার উড়তে চেষ্টা করলো দোয়েল, রাশেদ দেখলে খুব কষ্ট হচ্ছে তার উড়তে।
তার দিকে তাকিয়ে আছে দোয়েল, তবে দোয়েলের চোখ অতোটা দূর থেকে রাশেদ দেখতে পাচ্ছে না; এটা যদি তার ছেলেবেলা হতো তাহলে হয়তো দোয়েলের চোখ দেখতে পেতো, ওই চোখে কিসের ছায়া পড়েছে, তাও হয়তো দেখতে পেতো। দোয়েল। নিশ্চয়ই দেখছে রাশেদকে, এবং দূরে দাঁড়ানো ট্রাকটিকে। দোয়েল কি বুঝতে পারছে রাশেদের সাথে ট্রাকের কোনো সম্পর্ক নেই, রাশেদ ট্রাক থেকে নেমে আসে নি? দোয়েলের ডানা ভাঙলো কী করে? একেবারে ভাঙে নি, ভাঙলে একেবারেই উড়তে। পারতো না; কিন্তু ভেঙেছে কোথাও। রাশেদের দেখতে ইচ্ছে হলো কোথায় ডানা ভেঙেছে দোয়েলের। এদেশে কি পাখির ডানার চিকিৎসা হয়? সে যদি পাখিটিকে নিয়ে হাসপাতালে যায়, কোনো ক্লিনিকে ঢেকে চিকিৎসার জন্যে, তাহলে কেউ কি তাকে। মানবিক ভাববে, সবাই কি তাকে পাগল ভাববে না? রাশেদ আবার এগোলো দোয়েলের দিকে, দোয়েল উড়ে উড়ে ঢুকে পড়লো আঠারোতলা দালানটির ভেতর। রাশেদও দরোজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে দোয়েল কোথায় গেলো দেখার চেষ্টা করলো, দেখলো দোয়েল বসে আছে সিঁড়ির হাতলে। সিঁড়ির হাতল কি দোয়েলের বসার জন্যে উপযুক্ত? ওটা কচি আম গাছের ডাল হলে ভালো হতো। রাশেদ দোয়েলের দিকে যেতেই দোয়েল উড়ে দোতলায় গিয়ে বসলো। কোথাও কেউ নেই, সবাই চলে গেছে, প্রত্যেকটি ঘর মসৃণভাবে বন্ধ; শুধু আছে দোয়েল আর সে। রাশেদ যতোই দোয়েলের দিকে যায়, ভাঙা ডানার দোয়েল ততোই উড়ে তেতলা থেকে চারতলার সিঁড়িতে ওঠে, চারতলা থেকে পাঁচতলার সিঁড়িতে ওঠে; হাতলে বসে একটু জিরোয়, বিষণ্ণ চোখে তার দিকে তাকায়। দোয়েল ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, রাশেদও কি ক্লান্ত হয় নি? দোয়েলের তবু ভাঙা ডানা রয়েছে, রাশেদের তাও নেই; দশতলার সিঁড়িতে এসে রাশেদের পা। কংক্রিটের মতো শক্ত হয়ে গেলো, যে বসে পড়লো ক্লান্ত মূর্তির মতো। দোয়েলের দিকে তাকাতে গিয়ে রাশেদ দেখলো সামনে পুকুর, পাড়ে বাঁশঝাড়, হিজলের সারি; পুকুরের জল তিরতির করে কাঁপছে। একপাশে কচুরিপানার ঘন সবুজ। পুকুরের জলে এক কিশোরী ডুব দিচ্ছে, ডুব দিতে দিতে কিশোরী এক কিশোরের দিকে এগিয়ে। আসছে। তারা দুজনেই ডুব দিলো, ডুব দিয়ে তারা একে অন্যকে ছুঁলো, গালে গাল ছোঁয়ালো, তারপর দূরে গিয়ে ভেসে উঠলো। রাশেদ তাকিয়ে দেখে দোয়েলটি নেই। কোথায় গেলো ভাঙা ডানার পাখি? রাশেদ সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে ওপরে উঠতে লাগলো, কিন্তু কোথাও দোয়েল নেই। রাশেদ উঠতে উঠতে ছাদে গিয়ে পৌঁছোলো, মাথার ওপরে আকাশ কিন্তু কোনো দোয়েল নেই। ছাদ থেকে সে সারিসারি ট্রাক। দেখতে পেলো, যেগুলোকে জঙ্গল বলেই মনে হলো তার। তার তলপেটের প্রপাতটি উষ্ণ হয়ে উঠেছে, গর্জন করতে শুরু করেছে, যেনো তার তলপেট ছিদ্র করে সহস্র জলপ্রপাত হয়ে বেরিয়ে পড়বে। আশ্চর্য, এতোদিনের জমাট প্রপাত গলগল করে। বেরিয়ে পড়ার জন্যে ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। রাশেদ কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না, ভেতরে বরফফাটার শব্দ হচ্ছে অনবরত। রাশেদ উত্তর দিক করে দাঁড়ালো, তার জিন্সের জিপ খুলে প্রপাতের মুখ বাড়িয়ে ধরলো, এবং প্রবল গর্জন করে তার ভেতর থেকে প্রস্রাব না অনন্ত ঘৃণাধারা যেনো নির্গত হতে লাগলো।