দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মহাশ্বেতার নিজের কথাতেই, তার ‘দুঃখের ভরা পরিপূন্ন হ’লে’ তবে সে মায়ের কাছে ছুটে আসে। কিন্তু শ্যামার আর ভাল লাগে না এ সব, তাঁর নিজেরই যথেষ্ট জ্বালা, যথেষ্ট দুর্ভাবনা। সে তুলনায় মহাশ্বেতা তো রাজরাণী। শুধু শুধু বাতাসের সঙ্গে ঝগড়া বৈ তো নয়। এক এক দিন নিতান্ত অসহ্য হ’লে বলেই ফেলতেন মুখের ওপর, ‘নে বাপু তোর ঐ একঘেয়ে থগ-বগানি আর নাকিকান্না থামা দিকি। সেই বলে না– মারবার না লোক থাকলে চালতাতলায় বাস–তা তোর হয়েছে তাই। নিজের ভাতার, নিজের ছেলেমেয়ে- তাদের তুই সামলাতে পারিস না– পরকে দোষ দিস কেন? হাতে পেলে আর কে কবে ছেড়ে দেয়! সবাই চায় নিজের দিন কিনে নিতে। তোর বুদ্ধি নেই, তুই পারিস না–ওদের আছে ওরা পারে। তোর ভাগ্যের দোষ দে, ওদের কি অপরাধ!’
এর পর–বলাবাহুল্য– এক অবর্ণনীয় কাণ্ড হ’ত। মহাশ্বেতা রেগে কেঁদে মাথা খুঁড়ে চিৎকার করে বুক চাপড়ে পাড়ার লোক জড়ো করত। আগে সত্যিই এদিক ওদিক থেকে লোক ছুটে আসত– এখন সবাই জেনে গেছে ‘নতুন বামুনদের বড় মেয়ের মাথাটায় বাপু বেশ ছিট আছে। বদ্ধ পাগল।’ এখন আর বড় একটা কেউ আসে না।
এই সব দিনে যাবার সময় বারবার প্রতিজ্ঞা করে যেত মহাশ্বেতা যে, সে আর কখনও বাপের বাড়ি আসবে না। বাপের বাড়ি তার ঘুচে গেছে– সপুরী এক-গাড়ে গেছে, তা সে জানে। তাই সে ধরে নেবে। আর কখনও এ-মুখো হবে না। ফের যদি কখনও এ-মুখো হয় তো তার নামে সবাই যেন কুকুর পোষে, গুয়ের জল গায়ে ছেটায়… ইত্যাদি ইত্যাদি
কিন্তু আবারও আসতে হয় তাকে ঠিকই। না এসে থাকতে পারে না। অন্য কোনও খবর থাকলে, মজাদার বা চটকদার কোন ঘটনা ঘটলে তার পরের দিন ছুটে আসতেও তার বাধা নেই। শ্যামা তা জানেন, তাই তিনি ওর চেঁচামেচি কান্নাকাটিতেও বিচলিত হন না, শাপমনি দিব্যি-দিলেশাতেও না। শ্যামার পুত্রবধূ কনকেরই অসহ্য লাগত প্রথম প্রথম, সে মৃদু অনুযোগ করে বলত, ‘কেন মা জেনেশুনে ও পাগলকে ঘাঁটান। চুপ করে শুনে গেলেই হয়!
‘আমার আর সহ্যি হয় না মা। একে আমার জ্বালাতনের শরীর, নিজের ভাবনাচিন্তেয় বলে আমার নিজের ঘুম হয় না, তার উপর কানের কাছে যদি নিত্যি ঐ সব মিথ্যে নাকেকান্না কাঁদে আর হা-হুঁতাশ করে তো কার ভালো লাগে বল তো! হ্যাঁ, মা যদ্দিন ছিলেন আমিও মার কাছে গিয়ে পড়তুম কিন্তু সে যে কত দুঃখে, কত দুঃখ বুকে চেপে চেপে রেখে, সে কেউ জানে না। বুক যখন ফাটবার মতো হ’ত, যখন প্রাণ আসত ঠোঁটের ডগায়, তখনই ছুটে যেতুম! তাই কী সব কথা তাঁকে বলেছি? নিজের ভাতার-পুতের কেচ্ছা নিজের শ্বশুরবাড়ির খিটকেল কখনও বাপ-মায়ের কাছেও করতে নেই। আকাশের গায়ে থুতু দিলে সে থুতু নিজের গায়েই এসে পড়ে। বলে আহাম্মুক নম্বর চার, ঘরের কথা করে বার। ঐ তো ওরই ছোট জা, দাঁতে দাঁত চেপে কী দুঃখটাই না সহ্য করলে, কৈ একদিন ওকে কেউ বাপের বাড়িতে এমনিও যাওয়াতে পেরেছিল? ছেলে পেটে আসতে একেবারে সাধ খেতে প্রথম বাপের বাড়ি গেল– মাথা উঁচু করে!’
আবার কোন দিন বলতেন, ‘ওর ঐ মিথ্যে কথাগুলো আমার সহ্য হয় না বাপু, তা তুমি যতই বলো কোনদিনই অসৈরণ কথা আমার ভাল লাগে না। এতটি তো সাত ঝুড়ি নিন্দে করে শ্বশুরবাড়ির– তুমি একটা কথা বলো দিকি, তখনই ফোঁস করে উঠবে। মায় ঐ মেজকর্তা মেজগিন্নী, নিত্যি যাকে গাল না দিয়ে জল খায় না, তারাও দেখবে তখন কত জ্ঞানবান বিচক্ষণ কত বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। তখন ওদের বিবেচনাই ধন্যি ধন্যি হবে। ওর ও রোগ, মধ্যে মধ্যে খানিকটা কান্নাকাটি চেঁচামেচি না করে থাকতে পারে না। বায়ু রোগ ওটা।…. ছেলেগুলোকে নিজে ইচ্ছে করে অমানুষ করছে। কী সমাচার না ওর বাপ কাকারা কে কত লেখাপড়া শিখেছে, তারা করে খাচ্ছে না? দিন কতক হেসে-খেলে বেড়াক না। নিহাৎ যখন দেওরকে জাকে গাল দেবার দরকার হয় তখনই ছেলেদের পড়াশুনোর কথাটা মনে পড়ে। ওসব নাকে-কান্না আমার ভাল লাগে না।’…
কিন্তু সেদিন বলতে গেলে একটা অঘটনই ঘটল। মহাশ্বেতা এল প্রায় লাফাতে লাফাতে, খুশিতে ডগোমগো হয়ে, আহ্লাদে ফেটে পড়তে পড়তে। দূর থেকেই তার এ ভাবান্তর লক্ষ করেছিলেন শ্যামা, মেয়ে এসে বাড়ি ঢুকতে তাই অন্য দিনের মতো নিরাসক্ত ভাব বজায় রাখতে পারলেন না, একটু উৎসুক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতেই মুখ তুলে চাইলেন।
‘নাঃ, তা যাই বলো বাপু, ছেলেটার পয় আছে! মাওড়া অনাথা হ’লে কি হবে, আমার সংসারে এসে পয় ফলিয়েছে তা মানতেই হবে।’
‘কে ঠাকুরঝি, কার কথা বলছে?’ কনক জিজ্ঞাসা করল।
প্রশ্নটা মার কাছ থেকে এলে মহাশ্বেতা আরও খুশি হ’ত ঈষৎএকটু ভ্রুটা কুঞ্চিত হ’ল কনকের ব্যস্ততায়। তবু হাসি-হাসি মুখেই হাত পা নেড়ে বলল, ‘ঐ মেজ-বৌয়ের বোনপোটার কথা বলছি। ঐ অরুণটার কথা। যাই হোক, ও আসবার পরেই তো তোমার নন্দায়ের সুবুদ্ধি হ’ল তবু, বিষয়ের কথা কইতে এল আমার সঙ্গে। কোনদিন তো এর আগে আমাকে মানুষের মধ্যেই গণ্যি করে নি, টাকা-পয়সার কথা আমার সঙ্গে যে কইতে হয় এ কখনও জানত না।…আর এ শুধু বলাই নয়, আমার একটা আয়ের পথও তো হ’ল। ছেলেটার পয় ছাড়া কি বলব বলো, নইলে এমন অকালে সকাল, আমার হঠাৎ এমন বরাত খুলবেই বা কেন?’
এবার শ্যামাও আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারেন না।’আয়’ এবং ‘বরাত খোলা’ শব্দ দুটো তাঁর কাছে কোনমতেই উপেক্ষণীয় নয়। আজকাল মেয়েকে দূর থেকে দেখলেই কপালে যে বিরক্তির রেখাটা পড়ে সেটা মুছে গিয়ে প্রসন্ন হয়ে উঠল তাঁর মুখ। বললেন, ‘কী রকম, কী রকম। হঠাৎ বরাতটা কী খুলে গেল শুনি? জামাই তোর নামে সম্পত্তি কিনেছে?
‘তবেই হয়েছে! সেদিন পূবের সূয্যু পশ্চিমে উঠবে। তা নয়– অত আশা আমার নেইও। আমার কাছে দু পয়সা আয়ের পথ হ’লেই ঢের। দাঁড়াও আগে বসি একটু দম নিই। বলছি তারপর!
অর্থাৎ বেশ ঘটা করেই বলবার মতো কথাটা।
শ্যামা তখন রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে নারকেল পাতা চেঁচে খ্যাংরা কাটি বার করছিলেন, তিনি পাতাগুলো এক দিকে সরিয়ে একটু জায়গা করে দিলেন। কনক তাড়া- তাড়ি ছুটে গিয়ে একটা পিঁড়ি পেতে দিল। চেপেচুপে বসে কিছুক্ষণ স্মিত কৌতুকোজ্জ্বল মুখে মা আর বৌদির দিকে চেয়ে রইল চুপ করে। যেন খুব মজার কোন কথা বলে তার ফলাফলটা দেখছে এখন।
শ্যামা ওর ভাবগতিক দেখে অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘নাও, তোমার দম নেওয়া হ’ল? এখন কী মতলবে এসেছ কথাটা খুলে বলো দিকি, অমন থিয়েটার য়্যাটো করতে হবে না!’
মনের পাত্রে তৃপ্তি আর বিজয়গর্ব তখন উছলে উঠেছে মহাশ্বেতার, তাই এসব তুচ্ছ খোঁচা গায়ে মাখল না। হাসি হাসি মুখে বলল, ‘বলি মাথার ওপর ভগবান আছেন তো গা! দিনকে রাত বলে কতকাল চালানো যায়? একদিন না একদিন ভগবান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন না?…চেরকাল মোটা মোটা টাকা এনে ঐ দুই রাজারাণীর শ্রীপাদপদ্মে ঢেলেছেন, যত কিছু উপাজ্জন গোদাপদে সমপ্পন। কী না আমার ভাই-ভাজ খুব ভাল। লক্ষ্মণ ভাই! ও-ই সবাইকে দেখবে।… তা এবার চোখটা একটু খুলল তো? মানুষটা বেঁচে থাকতেই এই, চোখ বুঝলে কী মূর্তি ধরবে তা বুঝছে না এবার? হাড়ে হাড়েই বুঝছে। তবে ঐ, ভাঙ্গে তো মচকায় না। তেমন ঝাড়ের বাঁশ নয় কেউ। ওরা মরে তবু ময্যেদা হারায় না। সব সব, বুঝলেও সব সমান। ছেলেগুলো পজ্জন্ত দ্যাখো না– লেখাপড়া করে না কিছু না, কথা কইতে যাও দিকি, মুখে তুবড়ি ছুটিয়ে দেবে একেবারে। কত এম-এ লোক থ হয়ে যায় ওদের মুখের সামনে!’
এবার শ্যামার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। বঁটিখানা দেওয়ালের খাঁজে উপুড় ক’রে রেখে পাতারই একটা ফালি বার ক’রে নিয়ে ঝ্যাটার কাটিগুলো বাঁধতে বাঁধতে বললেন, ‘তুমি দেওয়ালের সামনে বসে বক্তিমে করো মা, আমি উঠলুম, আমার কাজ আছে!’
‘রোস রোস। আমার আসল কাজটাই যে বাকী গো। বাবা, তুমি যে একেবারে সব্বক্ষণ ঘোড়ায় জীন কষে আছ দেখতে পাই!…তবে কাজের কথাই সেরে নিই। অ বৌদি, তুই একটু ওধারে যা ভাই, মার সঙ্গে দুটো পেরাইভেট কথা আছে!’
তারপর গলাটা নামিয়ে ও ঘর থেকে কনকের শুনতে কোন রকম বাধা না হয় এমন পর্দাতেই ফ্যাস ফ্যাস ক’রে বললে, ‘দুশোটা টাকা দিতে হবে আমাকে এখুনি জামাইয়ের দরকার!‘
এইবার শ্যামার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। অন্ধকারও হয়ে উঠল বলা যায়। আর যাই হোক, ঠিক এ আক্রমণটা আশঙ্কা করেন নি তিনি। মেয়ের খুশির তালটা যে তাঁর ওপর এসে পড়বে তা একবারও ভাবেন নি।
প্রায় মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন, ‘হঠাও জামাইয়ের কী এমন দরকার পড়ল? আমার কাছে তোর টাকা থাকে জামাই জানলেন বা কী করে?’
‘না, মানে তোমার জামাইয়ের দরকারও বলতে পারো, আমার দরকারও বলতে পারো!’
‘ঘোরপ্যাঁচ ছেড়ে একটু খোলসা করেই বলো না কথাটা বাছা!’
‘ঘোরপ্যাঁচের আর আছে কি! আমিই বলেছি তাকে টাকাটা দেব। এখানে টাকা আছে তাও আমিই বলেছি।’
মেয়ের কণ্ঠে তাপের আভাস পেতেই শ্যামার কণ্ঠের তাপটা কমে আসে। এ তাপ মালিকানার তাপ, এর চেহারাটা শ্যামার চেনা আছে। যার টাকা সে চাইচে, এর মধ্যে কোন অনুরোধ কি অনুনয় নেই। এর ওপর কোন কথাও চলবে না।
বেশ একটু নরম গলায় প্রশ্ন করেন তিনি, ‘তা হঠাৎ জামাই-এর হঠাৎ টাকার দরকার হ’ল যে। সম্পত্তি কিনবেন নাকি কোথাও
‘তবে বাপু খোলসা করেই বলি কথাটা। কাউকে যেন ব’লো নি। শোন। ওদের আপিসে নাকি দু-তিনটে নতুন সায়েব এসেছে– তাদের খুব জুয়োর বাই। শনিবারে শনিবারে রসার মাঠে কী ঘোড়দৌড় না কি হয়, সেখানে গিয়ে মড়-মড় টাকা ঢেলে আসে। এর জন্যে নাকি দুচোকের-ব্রত দেনা করে যেখানে পায়। আর মোটা মোটা টাকা সুদ গোনে। একশ’ টাকায় এক মাসে পঁচিশ টাকা তিরিশ টাকা সুদ। অফিসের বেয়ারা দারোয়ানগুলো সব লাল হয়ে গেল সুদ খেয়ে খেয়ে। তাই দেখে ওর মাথায় ঢুকেছে কথাটা যে খোট্টা দারোয়ানগুলো এত পয়সা কামাচ্ছে– তবু ওদের কিছু নেই আর আমরা এত টাকা নিয়ে বসে আছি, আমরা কামাতে পারব না! তা পেরথম পেরথম কাউকে বলে নি, নিজেই দু-চার টাকা যা নিজের হাতে ছিল দিয়েছে। মাস কাবারে পেয়েওছে সুদে আসলে সব টাকা। বলি টাকা তো হাতের মুঠোয় গো, মাইনে তো নিতে হবে, ঐখানে তো টিকি বাঁধা সব।’
এই পর্যন্ত বলে, বোধ করি দম নেবার জন্যেই একটু থামে মহাশ্বেতা। কথাগুলো বেশ গুছিয়ে বুদ্ধিমানের মতো বলতে পেরেছে, এর জন্যে একটু আত্মপ্রসাদের হাসিও হাসে।
শ্যামা স্তব্ধ হয়ে শুনছিলেন। কথাটা এত সহজ নয়, এর মধ্যে কোথাও একটা বড় রকম গোলমাল আছে। সেই গোলমালটাই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন মনে মনে।
মহাশ্বেতাই আবার শুরু করল। পূর্ব প্রসঙ্গের খেই ধরে বলল, ‘তা কথাটা তাই কাল হাটি-পাটি পেড়ে লক্ষ্মণ ভাইকে বলতে গেছল। আমি তো আজকাল সেয়ানা হয়ে গেছি কিনা যখনই দেখি আপিস থেকে ফিরে বড় ভাই গিয়ে মেজ ভায়ের ঘরে সেঁদিয়ে দোর দিলে, তখনই বুঝি যে এবার বিষয়-কম্মের ব্যাপার কিছু হবে। আমিও আজকাল সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে আড়ি পাতি। তাতেই তো সব শুনলুম, নইলে কি আর আমাকে এ সব কথা ও নিজে থেকে বলবে? তবেই হয়েছে! সেই লোকই কিনা!’
কথাটা আবার সোজা রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছে দেখে অসহিষ্ণু শ্যামা প্রশ্ন করলেন, ‘তা মেজকর্তা কি বললে?’
‘সব বিত্তান্ত খুলে বলে বড়কত্তা বললেন, আমাকে তুমি বেশি না, শ’তিন-চার টাকা দাও, ছ মাসে আমি ডবল ক’রে দিচ্ছি। তা মেজকত্তার মত হ’ল না। তিনি বললেন, না দাদা এসব কাজ ভাল না। এইভাবে ধার করতে করতে একদিন এমন হবে যখন আর মাইনের টাকায় কুলোবে না। তাছাড়া এর কোন লেখাপড়া নেই। সুদ নিচ্ছ তুমি কাবুলিওয়ালার বাড়া, কোম্পানিকে বলতে গেলে কোম্পানিও শুনবে না। লেখাপড়া যদি ক’রেও দেয় তবু কোম্পানী তার টাকা কেটে তোমাকে দেবে না। বলবে যেমন লোভ করতে গেছেলে তেমনি তার ফল ভোগ করো গে।….তোমার জামাই কত বুঝিয়ে বললে; বললে দিনরাত এখেনে পড়ে আছি, এ তো মোট কিছু নয়, আমি যদি অল্প দিনে আসলটাকে ডবল করে নিতে পারি শেষ পর্যন্ত না হয় কিছু টাকা ডুবলই। তাতে তো আর লোকসান নেই। তা মেজকত্তার বুদ্ধি বেশি– বললেন, না, লোভ মানুষের বেড়েই যায়, দেখো তুমি ও সুদের টাকাও সরিয়ে রাখতে পারবে না, সবসুদ্দু খাটাবে, যাবে যখন সবসুদ্দুই যাবে। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, বেশি লোভ ভাল না! তার চেয়ে যেমন আছি তেমনি থাকি।’
‘অম্বিক ঠিকই বলেছে। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু–এ সবও জুয়া খেলা। তাছাড়া ওরা, সায়েব জাত, হঠাৎ রাতারাতি সরে পড়লে আর কোথায় তাদের পাত্তা পাবি যে টাকা আদায় করবি? না বাপু, দরকার নেই তোরও ওসবে গিয়ে, ঐ তো কটা টাকা। গেলে আর দুঃসময়ের সম্বল বলতে কিছু থাকবে না।’
‘দ্যাখো’, অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে মহাশ্বেতার কণ্ঠ, ‘তোমার জামাইয়ের চেয়ে টাকাটা বেশি বোঝে– এমন মানুষ তো আমি কই আর দেখলূম না। বলি আজ যে মেজকত্তা সোনার খাটে গা রূপোর খাটে পা দিয়ে বসে আছেন সে টাকাটা করলে কে? সে কি ওঁর রোজগারের টাকা? আজ যদি আমি হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গি? যুদ্ধের সময় চোরাই লোহা চালান করে শয়ে শয়ে টাকাটা কে রোজগার করেছিল? তাতে ঝুঁকি ছিল না? ধরা পড়লে যে একেবারে পুলিপোলাও দেখিয়ে দিত। তখন এসব ধৰ্ম্মের বুলি কোথায় ছিল! তা তো নয়, এখন টাকাটা গুদোমজাত করে বসে আছি, নাড়ছি চাড়ছি হাত বুলোচ্ছি সোনার বাটে– এখন বার করতে বড় মায়া লাগছে আর কি! হাত্তোর বেইমানের জাত রে? যার ধন তার ধন নয়– নেপোয় মারে দই!’
এর পর আর টাকাটা না দেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এ লোককে বোঝাতে যাওয়াও বৃথা হিতে বিপরীত হবে। হয়ত এর চেয়েও কটুকথা শুনতে হবে নিজেকেই। শ্যামা আর কথা বাড়ালেন না। পাতা চাঁচবার জণ্যে একটা খাটো কাপড় পরে ছিলেন, সেটা ছেড়ে ভিজে গামছা পরে গিয়ে ঘরের দোর দিয়ে কোথা থেকে হাতড়ে হাতড়ে দুশোটি টাকা বার করে এনে নিঃশব্দেই মেয়ের সামনে ফেলে দিলেন।
মহাশ্বেতা টাকাগুলো নিয়ে পেট-কাপড়ে বাঁধতে বাঁধতে বললে, ‘আমিও তেমন বাপের বেটি নই বাপু। যেমন মেজকত্তার ঘর থেকে বেরলো অমনি আমি ইশারা ক’রে ডেকে নে এসে আচ্ছা ক’রে শুনিয়ে দিলুম। তা মানুষ তো নয়, পাথর– ওকে শোনানোও যা দ্যালটাকে শোনানোও তা। তবু মনের ঝালটা তো মিটিয়ে নিলুম। আর মুখে না মানুক, ভেতরে ভেতরে তো বুঝল।…. ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিয়ে বললুম, আমাকে তো কোনদিন বিশ্বাস করো না, আমার হাতে ভরসা করে কখনও টাকাও দিলে না। তবু আমিই তোমার মান রাখব। আমি তোমাকে এনে দেব দুশো টাকা। তখন একটু অবাক হ’ল, মুখটা একটু ওজ্জ্বলও হ’ল। বললে, তুমি কোথায় পাবে? আমি তা বলে অত বোকা নই যে সব টাকার সন্ধান দেব। আমি বললুম, সে আমি এনে দেব যেখান থেকে পাই। মোদ্দা সুদটা ঠিক ঠিক আমাকে এনে বুঝ ক’রে দিও, সেটা আবার যেন নিয়ে গিয়ে ঐ শ্রীপাদপদ্মে ঢেলো নি। তা বলে, না না– পাগল। তোমার টাকার সুদ তুমিই পাবে।…তাই এই ছুটে এলুম।’
এতক্ষণে আনুপূর্বিক ইতিহাস শেষ করে উঠে পড়ল সে।
‘যাই; আবার এতটা পথ এক কাঁড়ি টাকা নিয়ে যাওয়া তো, ভয় করে। ভেবেছিলুম দুপুরবেলা আসব, তা ও বিনি-মাইনের চাকরির কি ছুটি আছে! খোকাটা কোথায় গেল, এগিয়ে দিয়ে আসত একটু?’
‘ঐ বাগানে কী করছে বোধ হয়। যাবার সময় ডেকে নিয়ে যা। সাবধানে যাস একটু। দুগ্গা দুগ্গা।’
শুষ্ক বিরস কণ্ঠে কর্তব্য পালন করেন শ্যামা। তাঁর মুখের অপ্রসন্নতাও ঢাকা থাকে না। কিন্তু মহাশ্বেতার তা লক্ষ করবার কথা নয়, করলও না– খুশী মনেই বৌদিকে ডেকে বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হ’ল।
এ গাঁ ও গাঁ বটে, এপাড়া ওপাড়াও বলা যায়। সবসুদ্ধ তিন-পোর বেশি নয়, এটুকু পথ হাঁটতে এখানে কারুরই গায়ে লাগে না।
॥২॥
শ্যামার এ বিরসতার কারণ আছে বৈকি। টাকাটা যদিও মহাশ্বেতার, এবং সে জমাই রাখতে দিয়েছে মাকে, তবু এইটেই এখন শ্যামার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে। সব টাকাই অভয়পদ এনে ভাইকে ধরে দিত–এখনও দেয়। মাইনের টাকাই শুধু নয়– উপরি টাকাও, সৎ অসৎ সর্ববিধ উপার্জনের টাকাই। এই নিয়ে মহাশ্বেতার অশান্তির অন্ত ছিল না। সে অশান্তি অবশ্য মুখ ফুটে অভয়পদকে জানাবার বা এই নিয়ে তার সঙ্গে কলহ-কাজিয়া করার সাহস কোনদিনই তার হ’ত না, যদি না পিছনে থেকে শ্যামা তাকে নিরন্তর উত্তেজিত করতেন। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়েই নিজের দাবি জানিয়েছিল মহাশ্বেতা এবং তার ফলে অভয়পদ দু-চার টাকা মধ্যে মধ্যে দিতে শুরু করেছিল। চেয়ে নেওয়া ছাড়াও, ইদানীং সাহস বেড়ে যেতে, পকেট থেকেও দু-এক টাকা ক’রে সরাতে শুরু করেছিল। অভয়পদ তা টের পেত আর টের যে পেত সে কথাটাও সে মহাশ্বেতাকে জানিয়ে দিয়েছিল– কিন্তু তা নিয়ে রাগারাগি করে নি। মহাশ্বেতা তাতেও কতকটা প্রশ্রয় পেয়েছিল।
তবু সে কতই বা! বেশি টাকা না-বলে নেবার সাহস মহাশ্বেতার আজও হয় নি। সুযোগও কম। তেমন বাড়তি টাকা ওর পকেটে পড়ে থাকে কদাচিৎ। সুতরাং সব জড়িয়ে মহাশ্বেতার জমানো টাকার পরিমাণ ছ-সাতশ’র বেশি ওঠে নি এখনও পর্যন্ত।
টাকাটা যতই হোক– শ্যামার কাছে অনেক। জামাইয়ের কাছে তাঁর কিছু ঋণ আছে, এই বাড়িখানা করার দরুন। সে টাকাটা আজও শোধ দিতে পারেন নি। কিছু কিছু যে দিতে পারতেন তা নয়– কিন্তু ইতিমধ্যে উপার্জনের একটা নতুন এবং অভিনব পথ আবিষ্কার করেছেন, তা হচ্ছে সুদে টাকা খাটানো। এ পাড়ায় থালা বাটি গেলাস রুপোর বাসন– দৈবাৎ কখনও সোনার গহনা রেখেও টাকা ধার করতে আসে অনেকে। বেশি টাকায় শ্যামার উৎসাহ কম। চার আট আনা ধার দেওয়াতে সুদ বেশি আদায় হয়। টাকায় এক পয়সা সুদ, আট আনা চার আনাতেও এক পয়সা। কারণ, পয়সা ভেঙ্গে সুদ দেওয়া নিয়ম নেই।
এ পথটা একদিন অকস্মাৎ আপনিই খুলে গিয়েছিল। শ্যামাও সুযোগটা বুঝতে ও তার সদ্ব্যবহার করতে ইতস্তত করেন নি কিছুমাত্র! সেই থেকে জামাইকে টাকা দেওয়া বন্ধ করেছেন। জামাইও তাগাদা দেয় না অবশ্য, হয়ত সে ফেরত পাবার আশাতে ঠিক দেয়ও নি; তবে শ্যামা দেবেন ঠিকই। আপাতত যা হাতে আসে সুদে খাটান, এই সুদ বা সুদের সুদ থেকেই একদিন ও ঋণটা শোধ হয়ে যাবে– এ ভরসা তাঁর আছে।
মেয়ের টাকাও এই কারবারে খাটে তাঁর। অবশ্য টাকাটা সুদে খাটাবার জন্য মেয়ে রাখে নি তাঁর কাছে। পাছে আর কেউ বাটপাড়ি করে সেই ভয়েই রেখেছে। তবে মেয়েকেও তিনি এই লাভ বা সুদের কিছু অংশ দেবেন, অন্তত এখনও মনে মনে এ রকম শুভ ইচ্ছা আছে। মেয়েকেও সে কথা শুনিয়ে রেখেছেন। তবে সে হিসেব নেইও তাঁর। মেয়েকে যখন টাকাটা বুঝ দেবার সময় হবে তখন একটা আন্দাজী আয় ধরে ঠাওকো থোক কিছু ধরে দিলেই চলবে। সে পরের কথা। এখন যদি আসলই বেরিয়ে যায় এইভাবে হাত থেকে।
ভাবতেই খারাপ লাগছে শ্যামার। একদিন এমনিই, বলতে গেলে খেলার ছলে এ কারবার আরম্ভ করেছিলেন, সেটা যে এমনভাবে তাঁর সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তা আজকের আগে তিনিও বুঝি এমনভাবে অনুভব করেন নি। অবশ্য সব টাকাটা খাটছে না এটা ঠিক– নইলে চাইবা মাত্র বার করেই বা দিলেন কি করে– তবু মহাজনের হাতে টাকাটা সব সময় থাকা দরকার। নইলে এ কারবারের ইজ্জৎ থাকে না। মক্কেলও হাতছাড়া হয়ে যায়।’নেই নেই’ শোনাতে হয়, খুব অনিচ্ছাতে দিচ্ছেন এমন ভাবও দেখাতে হয়– তবু শ্যামা ফেরান না প্রায় কাউকেই। কারণ তিনি জানেন যার এমন ঠেকা, বাসন কি গয়না রেখে ধার নিতে এসেছে, সে নেবেই– তিনি ফেরৎ দিলে অপর জায়গা থেকে নেবে– মাঝখান থেকে তিনি সুদটা খোয়াবেন কেন? তা ছাড়া নতুন পথ পেলে পরেও হয়ত সেই পথেই চেষ্টা দেখবে, অর্থাৎ ঘরটাই নষ্ট হয়ে যাবে চিরকালের মতো।
অথচ এখন কীই বা করা যায়?
এ টাকাটা গেছে যাক, কিন্তু এখানেই যে ওরা থামতে পারবে না তা শ্যামা বুঝতে পারছেন। এ বড় সাংঘাতিক লোভ, প্রায় জুয়ার নেশার মতোই। আবারও আসবে, আবারও চাইবে। এক উপায়– হাতে নেই, সুদে খাটছে বলা, কিন্তু তা হলেই অনুমানের ঘরে সুদের অঙ্কটা বাড়তে থাকবে মেয়ের মনে– আশাটা বেড়ে যাবে। তখন আয়ের হিসাব চাইবে সে।
নাঃ, সেও কোন কাজের কথা নয়।
তবে?
এই তবেটাই ঠিক করতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বহুক্ষণ স্তব্ধভাবে বসে রইলেন শ্যামা। তাঁর ভাবগতিক দেখে কনকেরও বিস্ময়ের সীমা রইল না। এখনও আকাশে আলোর আভাস আছে, এখনও পুরোপুরি অন্ধকার নামে নি ওদের উঠোনের কাঁঠালগাছ কলাগাছের ছায়ায়– এখনই এমনভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকা স্থির হয়ে– এ শ্যামার পক্ষে একেবারেই অভিনব। কনকের অভিজ্ঞতায় অন্তত এমন ঘটনা আর কখনও ঘটে নি
কারণটা শুনলেও অবশ্য কনক বুঝত না। বরং আরও হাস্যকর মনে হ’ত। পরের টাকা ওঁর কাছে খাটত, না হয় আর খাটবে না। এটা তো একটা বাড়তি আয়, এর ওপর ভরসা করে কিছু ওঁর সংসার চলছে না, তাছাড়া মেয়ের টাকাটা সব বেরিয়ে গেলেও ওঁর কারবার অচল হবে না— তবে?
কনক বুঝতে পারত না, কারণ সে অনেক পরে এ বাড়িতে এসেছে। আভাসে ইঙ্গিতে, মেজো ঠাকুরঝির কথা থেকে, মহাশ্বেতার কদাচিৎ কোন বেফাঁশ কথাতে– সে কিছু কিছু পূর্ব ইতিহাসের আঁচ পেয়েছে ‘ কিছু বুঝেছে সে তার শ্বশুরের মৃত্যুর সময়– তাঁকে দেখে ও তাঁর কথা শুনে– কিন্তু তবু সবটা সে জানে না, সে ইতিহাস তার কল্পনার অতীত।
শ্যামার শ্বশুররা ছিলেন খুব নামকরা গুরু-বংশ। বাড়িঘর শিষ্য-যজমান বিষয়সম্পত্তি সব দিকেই প্রাচুর্য দেখে শ্যামার মা রাসমণি মূর্খ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। ঠিক অত সহজে, অত অল্পদিনে যথাসর্বস্ব উড়িয়ে দিয়ে সত্যি-সত্যিই তাঁর মেয়েকে পথের ভিখিরী করবে সে ছেলে, তা তিনি তখন স্বপ্নেও ভাবেন নি। যা ছিল, তাতে বসে খেলেও দু’পুরুষ কেটে যেতে পারত। আর রাসমণিও অসহায় বিধবা মেয়েছেলে– অভিভাবকহীন, সহায় সঙ্গতিহীন– তিনিই বা করবেন কি। ঘটক-ঘটকীর ওপর নির্ভর করা ছাড়া তাঁর তো উপায় ছিল না। ছেলে মূৰ্খ এটা জেনেছিলেন কিন্তু সে যে অমানুষ এটা জানতে পারেন নি।
শ্যামার স্বামী নরেন আর ভাসুর দেবেন– সেদিক দিয়ে দুজনের কেউই কম কৃতী নন। ওঁদের বাড়ি বাগান প্রভৃতি সব যখন খিদিরপুর ডক পড়ল তখন নতুন বাড়ি খোঁজার অছিলায় ওঁদের গুপ্তিপাড়ায় এক শিষ্যের খালি বাড়িতে রেখে এসে দুই ভাই-ই প্রাণ খুলে উড়তে শুরু করলেন। বাড়ির টাকা, সরকার থেকে পাওয়া–সে আর কদিন, তারপর অন্য বিষয়ও ভাগ ক’রে নিয়ে দুজনেই জলের দামে বেচে দিলেন, ওড়ার ব্যবস্থাটা রইল অব্যাহত। তারপর একদিন অবশ্য আবার মাটিতে পা দিতে হ’ল কিন্তু তখন সে সমস্ত টাকাই উড়ে চলে গেছে– রেখে গেছে দুজনের শরীরে কিছু কুৎসিত ব্যাধি। দেবেন তবু নিজেকে সামলে নিলেন, সামান্য কিছু ওষুধ সংগ্রহ ক’রে আরাতে গিয়ে ‘ডাগদারি’ শুরু করলেন (ওদেশে ডাক্তারি করার জন্য তখন নাকি চিকিৎসা শাস্ত্র জানবার দরকার ছিল না! ) এবং স্ত্রীপুত্রকে ভরণপোষণ করার মতো আর্থিক অবস্থা ক’রে নিলেন। কিন্তু স্বভাবকে বা অভ্যাসকে কিছুতেই সংযত করতে পারলেন না নরেন। তার ফলে বহু দুর্গতির মধ্য দিয়ে এসে অবশেষে আশ্রয় যোগাড় করলেন পদ্মগ্রামের সরকারদের বাড়ি, পূজারী ব্রাহ্মণ হিসাবে। তবে সেটুকু আশ্রয়ই সেদিন শ্যামার কাছে স্বর্গের চেয়ে দুর্লভ ছিল, কারণ তার আগে নিঃসঙ্গ নিঃসহায় এবং নিঃসম্বল অবস্থায় একটি শিশু এবং বৃদ্ধা শাশুড়ীকে নিয়ে যেভাবে দিন কেটেছে, তা একমাত্র তাঁর অন্তর্যামীই জানেন।
এই পূজারীর কাজটাও যদি মন দিয়ে করতেন নরেন তো হয়ত সংসারটা দাঁড়াতে পারত। কিন্তু একেবারেই ভবঘুরে স্বভাব হয়ে গিয়েছিল– তাঁর মন কিছুতেই এক জায়গায় বাসা বাঁধতে পারত না। তাছাড়া কুসংসর্গ অভ্যাস থেকে স্বভাবের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল– সে লোভেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হ’ত তাঁকে। দু’মাস, ছ’মাস কখনও বা এক বছর দেড় বছর অন্তর হুতাশনের মতো এসে পড়তেন কোথা থেকে, কখনও কিছু– চাল ডাল ময়দা বা পুরোপুরি একটা সিধা– সঙ্গে আনতেন, কখনও বা দুর্ভিক্ষক্লিষ্টের মতো এসে এদের ভিক্ষান্নে ভাগ বসিয়ে কিছুদিন পরে শ্যামার হতদরিদ্র সংসার থেকেই কিছু চুরি ক’রে আবার সরে পড়তেন নিজের অজ্ঞাতবাসে। এ প্রায়ই হ’ত। কী ক’রে যে এই একেবারে অচল অবস্থা সচল রেখেছিলেন শ্যামা, একান্ত প্রতিকূল ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, আর ক’রে– টিকেছিলেন শুধু নয়– দাঁড়িয়েও ছিলেন শেষ পর্যন্ত মাথা উঁচু ক’রে– মেয়েদের বিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ি ক’রে ভবঘুরে স্বামীকে শেষ-নিঃশ্বাস ফেলবার নিজস্ব আশ্রয়টুকু দিতে পেরেছিলেন– সে ইতিহাস, কনক তার চিন্তাশক্তিকে যত উচ্চপ্রসারী পাখা মেলে কল্পনার সুদূর দিগন্ত পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনুক– সেই সত্য ইতিহাসকে কোনদিন স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারবে না।
হ্যাঁ, বড়জামাই অভয়পদ অবশ্য অনেক সাহায্য করেছেন– যদিচ ঠিক কতটা করেছেন তা শ্যামা ছাড়া কোন দ্বিতীয় প্রাণী জানেন না; এমন কি মহাশ্বেতাও নয়। (মুখপোড়া মিসে কি কোন কালে কোনকথা খুলে বললে ওকে! ওরই বাপের বাড়ির কথা চেরকাল ওর কাছে ঢেকে ঢেকে ম’ল। মুয়ে আগুন বুদ্ধির!) –তবু এ দাঁড়ানো যে কী দাঁড়ানো, কী অমানুষিক চেষ্টা, কী অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তি এবং কী উত্তুঙ্গ উচ্চাশা থাকলে যে এই পুনরুত্থান সম্ভব– তা কনক কেন আর কেউই কোনদিন ধারণা করতে পারবে না। আর তা না থাকলে সহস্র অভয়পদ পাশে এসে দাঁড়ালেও এভাবে দাঁড়ানো সম্ভব হ’ত না। হয়ত বড়জামাইও সেটা বুঝেছিল, নইলে সে-ও এমনক’রে পাশে এসে দাঁড়াত না। তাকেও প্রায় বাল্যকাল থেকেই জীবনের সঙ্গে লড়াই করে, একটি পয়সা বাঁচাবার জন্যও একান্ত সাধনা ও প্রাণপাত পরিশ্রম ক’রে, একদা শিশু ভাইবোনদের মানুষ করতে হয়েছিল। সেই দুর্লভ অথবা দুর্লভতর শক্তি শাশুড়ীর মধ্যে প্রত্যক্ষ ক’রেই সে সম্ভবত নিজে থেকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল।
সুতরাং আজ যদি পয়সা সম্বন্ধে একটা মোহই পেয়ে বসে থাকে তাঁকে, উপার্জন করাটা যদি নেশায় পর্যবসিত হয়ে থাকে তো শ্যামাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। আজ তাঁকে সারা দিন-রাত পাতা কুড়িয়ে জড়ো করতে বা নারকেল পাতা চেঁচে ঝাঁটার কাঠি সঞ্চয় করতে দেখে যারা হাসে, তারা এ ইতিহাস জানে না বলেই হাসে, আর হাসবেও চিরকাল, কারণ আর কেউই জানবে না। কোনদিনই না। সেদিনের যারা প্রধান সাক্ষী — হেম আর মহাশ্বেতা– তাদের স্মৃতিতেও কি বর্তমানের সূক্ষ্ম সাদা পর্দা পড়ে যাচ্ছে না? অতীতের কথা আর বুঝি তাদেরও তেমন ক’রে স্মরণ করা বা অনুভব করা সম্ভব নয়! হয়ত তারাও এমনই হাসে মনে মনে অথবা বিরক্ত হয়।
॥৩॥
এরই মধ্যে একদিন– একেবারে বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো– তরু এসে হাজির।
ভোরবেলা, সবে শ্যামা কাপড় কেচে এসে পাতার জ্বালে ছেলের ভাত চড়িয়েছেন, কনক উঠে ছড়া-ঝাঁট দিচ্ছে, অশ্রুমুখী মেয়ে এক কাপড়ে এসে দাঁড়াল।
বুকটা ছাঁৎ করে উঠল শ্যামার।
জন্মের পর মোট নটি বছর নিশ্চিন্ত ছিলেন শ্যামা, যতদিন না বিবাহ হয়েছিল। তারপর দশ বছর বয়সে সেই বিবাহের পর থেকে সারা জীবনই তাঁকে দুর্ভাগ্যের সঙ্গে এইতেই অভ্যস্ত তিনি। আকস্মিক, ঘর করতে হয়েছে। দুঃসংবাদ শুনতে হয়েছে শুধু। অভাবনীয় কোন ঘটনা ঘটলেই তিনি জানেন একটা বড়রকম দুর্ঘটনার সামনে দাঁড়াতে হবে এবার।
আজও সেই রকমেরই একটা বড় কিছু শোনাবার জন্য প্রস্তুত হলেন।
এখনও খুব বেশিদিন হয় নি, এমনি ভোরবেলা এমনি কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে এসে পড়েছিল ঐন্দ্রিলা, স্বামীর কালব্যাধির সংবাদ নিয়ে। এও সেই ভোরবেলা। এরও চোখে জল।
আড়ষ্ট হয়ে গেলেন শ্যামা, কোন প্রশ্ন পর্যন্ত মুখ দিয়ে বেরলো না।
কনকই গোবরজলের বালতি নামিয়ে ছুটে এসে হাত ধরল, ‘এ কী ঠাকুরঝি! এ কী অলক্ষণ! ভোরবেলা এমনভাবে– কী হবে মা! এসো এসো, বসো এসে। কী হয়েছে কি?’
হাতধরে নিয়ে এসে বসাল সে রান্নাঘরের দাওয়াতেই।
‘কী হয়েছে রে? জামাই, জামাই ভাল আছেন তো?’
এতক্ষণে স্বর বেরোয় শ্যামার কণ্ঠ দিয়ে। স্বাভাবিকতা বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে গিয়ে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ ও বিকৃত একটা স্বরই বেরিয়ে আসে গলা দিয়ে
‘সে ভাল আছে।’ কোনমতে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে তরু।
‘তবে? তুই একা, এ ভাবে?’
হেম রান্নাঘরেই শোয়, সে এতক্ষণ আধো-ঘুম আধো-জাগরণের মধ্যে একটু আলস্য করছিল, ভাতের ফ্যান উথলে উঠলেই মা ডাকবেন, তখন উঠে স্নান প্রাতঃকৃত্য সারতে যাবে। মায়ের তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে সেও ছুটে বেরিয়ে এল, সেও আড়ষ্ট হয়ে গেল প্রথমটা।
এভাবে প্রশ্ন করলে তরুর পক্ষে কিছুতেই সব কথা খুলে বলা সহজ হবে না তা বুঝে কনক একেবারে ওর পাশে বসে ওর হাতদুটি কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, ‘ঠাকুর- জামাইয়ের সঙ্গে রাগারাগি করে চলে এসেছ বুঝি?’
মাথা হেঁট ক’রে আরও অস্পষ্ট অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে উত্তর দিল তবু ‘সে জানে না। আমি যখন এসেছি তখনও ঘুমোচ্ছে।’
যাক। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল এতক্ষণে শ্যামার। তবু ভাল, জমাইয়ের কিছু হয় নি। চরম বিপদ অন্তত নয়।
হেমই এবার তাড়া দিয়ে উঠল, ‘সে জানে না, তবু তুই এমনভাবে এলি কেন? কি হয়েছে কি?’
‘আমি– আমি আর ওখানে ঘর করতে পারব না। আমি তা হ’লে মরে যাব। ও বুড়ি আমাকে মেরে ফেলবে!’
কোনমতে প্রাণপণ চেষ্টায় কথা বলে ডুকরে কেঁদে উঠল তবু।
স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল সকলে, বেশ কিছুক্ষণ। ওকে সান্ত্বনা দেবার কি আশ্বাস দেবার চেষ্টামাত্র কেউ করতে পারল না। এমন কি কনকও না। কিছুক্ষণের জন্য যেন অসাড় নিস্পন্দ হয়ে গেল সকলের চেতনা। ঠিক কি শুনছে, ঠিকমতো শুনছে কিনা, এ থেকে কতটা খারাপ অনুমান করতে হবে– তা বোঝবার মতো শক্তি রইলো না কারুর।
সম্বিৎ শ্যামারই ফিরে এল সকলের আগে। কিন্তু তিনিও কথা কইতে পারলেন না, শুধু পাগলের মতো সজোরে নিজের ললাটে করাঘাত করতে লাগলেন। যেন এই কপালটা সত্যিই ভেঙ্গে ফেলতে পারলে তিনি বাঁচেন, অব্যাহতি পান।
সেই কোন্ সুদূর অতীতে শুরু হয়েছে তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত, আজও কি শেষ হ’ল না? আজও কি ক্লান্ত হলেন না সে অদৃশ্য দণ্ডদাতা? কী এত পাপ করেছিলেন আগের জন্ম- জন্মান্তর ধরে নিভৃতে বসে– কেউ কি বাধা দেবার ছিল না, কেউ ছিল না নিষেধ করবার
তাঁর সঙ্গে তাঁর মেয়েরাও?
তারাও কি বসে বসে তাঁর সঙ্গে শুধু পাপই ক’রে এসেছে আগের জন্ম-ভোর?
না, এ তাঁরই পাপ। তাঁরই অন্যায় হয়েছে ওদের পৃথিবীতে আনা। তাঁরই বোঝা উচিত ছিল যে তাঁর রক্ত যেখানে এক ফোঁটাও আছে, কেউ সুখী হবে না। কেউ না।
একমাত্র অন্যথা হচ্ছে তাঁর বড় মেয়ে– অন্ততঃ এখনও পর্যন্ত। তাও তার অদৃষ্টে কী আছে এর পরে, তা কে বলতে পারে?
বড় মেয়েরও বিয়েটা দিয়েছিলেন শ্যামা অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে; বিয়ে দেবার সময় আর তার পরেও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত নানা উদ্বেগ আর আশঙ্কায় কণ্টকিত ছিলেন। জীবনে এমনিতেই বিবাহ সম্বন্ধে যা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল, তাঁর আর তাঁর যমজ বোন উমার বিবাহ নিয়ে– তাতে বিবাহ সম্বন্ধে আতঙ্কের ভাব থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু মহাশ্বেতার বিয়েটাই সবচেয়ে ভাল দাঁড়িয়ে গেছে। জামাইয়ের তো কথাই নেই, অমন জামাই লোকে তপস্যা করে পায় না– শাশুড়ী জা শ্বশুরবাড়ির অপরাপর লোকজন সম্বন্ধেও শ্যামার অন্তত কোন নালিশ নেই। এমন নির্বিবাদী ও নির্ঝঞ্ঝাট কুটুম-বাড়ি লোকে কদাচিৎ পায়। মহাশ্বেতা যা-ই বলুক, শ্যামা তাঁর জীবনে অনেক দেখলেন, তিনি জানেন বহু ভাগ্যেই এমন শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে তাঁর বড় মেয়ে।
মেজ মেয়ে ঐন্দ্রিলার বিয়ে দিয়েই সবচেয়ে সুখী আর নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন শ্যামা। মাধব ঘোষাল দৈবাৎ মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হয়ে যেচে সেধে নিয়ে গিয়েছিলেন পুত্রবধূ ক’রে। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন কোন রকম অযত্নও হ’তে দেন নি সে বধূর। আর জামাই হরিনাথ তো ছিল স্ত্রী-অন্ত প্রাণ। ওদের স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা পাড়া ঘরে একটা গল্পের বস্তু হয়ে উঠেছিল। এমন মিল কখনও-সখনও চোখে পড়ে। কদাচ কখনও শোনা যায়। অন্তত শ্যামা তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে কখনও শোনেন নি এটা ঠিক।
কিন্তু মেয়ের কপাল। বোধ হয় ওর জন্মলগ্নে সবগুলি কুগ্রহ একসঙ্গে বাসা বেঁধেছিল নইলে এমন হবে কেন? দুদিনের জ্বরে বলতে গেলে ধড়ফড়িয়ে মারা গেল শ্বশুর, স্বামীর ধরল রাজযক্ষ্মা। যেন গ্রামসুদ্ধ দুর্ভাগিনীর ঈর্ষার নিঃশ্বাসেই স্বামী-সৌভাগ্য জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। সদ্যোজাত শিশু সন্তান নিয়ে এসে উঠল তাঁর বাড়ি–শুধু বিধবা হয়েই নয়, একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে। জামাইয়ের ঐ সাংঘাতিক অসুখের সময় দিশেহারা মেয়ে চিকিৎসার খরচের জন্য যথাসর্বস্ব লিখিয়ে দিয়েছে ওদের নাম– অর্থাৎ দেওরদের নামে। চিরদিনের গর্বিতা মেয়ে তাঁর, রূপসী, স্বামী-সৌভাগ্যবতী– আজ এক মুষ্টি অন্নের জন্য পরমুখাপেক্ষী। ওর যে কী জ্বালা তা শ্যামা বোঝেন, অহর্নিশ সেই জ্বালায় নিজে জ্বলছে আর ওর চারিদিকে যারা আছে তাদের জ্বালাচ্ছে। সে জ্বালায় শ্যামাও দগ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু উপায়ই বা কি।
তবু ছোট মেয়ে তরুর বিয়ে দিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন শ্যামা। অবশ্য সতীনের ওপর বিয়ে দেওয়া– কিন্তু তরুর বুড়ি দিদিশাশুড়ী অনেক জমি জায়গা দিয়ে সে বৌয়ের কাছ থেকে না দাবিনামা লিখিয়ে রেজেস্ট্রি করিয়ে একেবারে পাকা ক’রে নিয়েছেন। সে দলিল শ্যামা দেখেছেন, অক্ষয় সরকার উকিল দিয়ে দেখিয়ে নিয়েছেন সুতরাং সেদিক দিয়ে কোন ভয় নেই। বিষয়-সম্পত্তি যথেষ্ট, ছেলেও চাকরি করে। যাকে বলে আল সোল নেই, তাই। এক বুড়ি ঠাকুমা, সে যে কোন দিন চোখ বুজবে। তারপর একেবারেই নিষ্কন্টক। মেয়ে-জামাইয়ের ভাবও হয়েছে বেশ, তাও তিনি টের পেয়েছেন ওদের কথা- বার্তায়, ভাবে-ভঙ্গিতে
কিন্তু সে সব আশাভরসা ধূলিসাৎ ক’রে দিয়ে এ কী হ’ল?
অকস্মাৎ কী এমন ঘটল যে তরুকে পালিয়ে চলে আসতে হ’ল?
শ্যামা ওকে কোন প্রশ্নও করতে পারলেন না। ললাটে আঘাত ক’রে ক’রে অবসন্ন হয়ে দেওয়ালে ঠেস দিলেন।
প্রশ্ন করল কনকই, আস্তে আস্তে সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন ক’রে ক’রে– কিছুটা বা ওকেই বলবার অবকাশ দিয়ে আদ্যোপান্ত ইতিহাসটা বার ক’রে নিল।
বুড়ি যে পরিমাণ ভালবাসে হারানকে, সেই পরিমাণই ওর সম্বন্ধে তার আশঙ্কা। বৌ এসে পর ক’রে নেবে– বাংলাদেশের চিরকালীন আশঙ্কা শাশুড়ীদের, কিন্তু এ আরও উগ্র, আও ভয়ঙ্কর। যদিও এ দিদিশাশুড়ী– তবু সাধারণ শাশুড়ীর চেয়েও যেন বেশি। কারণ সব হারিয়ে ওর এই হারান। হারানও যদি পর হয়ে যায় তো তাকে দেখবে কে? এই কারণে এ দিকটা সম্বন্ধে সে সদা-সতর্ক, সদা-জাগ্রত।
শুধু হারানকে হারাবারই ভয় নয়– আরও একটা অদ্ভুত ভয় ইদানীং পেয়ে বসেছে বুড়িকে। বিষয়-সম্পত্তি হারানের পৈতৃক নয়, বুড়ির নিজস্ব। বুড়ি হারানের বাবার জেঠাইমা। সম্পত্তি সেই পিতামহের স্ব-ক্রীত। একটা উড়ে-এসে জুড়ে-বসা পরের মেয়ে তাঁর এই সমস্ত সম্পত্তিতে মালিক হয়ে বসবে- হয়ত বা উড়িয়ে দেবে নষ্ট করবে– এই ভেবে ভেবেই বুড়ি প্রায় পাগল হ’তে বসেছে। সম্পত্তি এমন কিছু নয়, ন’বিঘে বাগান ভদ্রাসন এবং বারো বিঘে আন্দাজ ধান-জমি। আরও কিছু ছিল, সে বৌকে দিয়ে হাতছাড়া হয়েছে। এছাড়া আছে বুড়ির কিছু গহনা এবং সম্ভবতঃ কিছু নগদ টাকা। তবে সেটা আছে কি না এবং থাকলেও ঠিক কত তা হারানও জানে না। পোস্ট অফিসে শ’পাঁচেক টাকা পড়ে আছে– কিন্তু সে টাকা বুড়িকে কখনও তুলতে হয় না, অথচ কিছু কিছু খরচ সে নিজেও করে– তাইতেই হারানের ধারণা যে বেশ কিছু তার হাতে আছে।
তবু এই সম্পত্তির ভাবনা ভাবতে ভাবতেই তার এমন মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে শেষ পর্যন্ত হাওড়ার কাছ থেকে কোন্ এক তান্ত্রিককে আনিয়েছিল ‘যক’ দেবে বলে। সে সম্পত্তির পরিমাণ এবং বিবরণ শুনে হেসে চলে গেছে, তিরস্কারও করে গেছে খুব–তার সময় নষ্ট করবার জন্যে, বলে গেছে পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকা খরচ না করলে এ ধরনের তান্ত্রিক ক্রিয়া হয় না। একটি ব্রাহ্মণ বালক চাই, তাকে খুনের দায়– এ কি সোজা কথা নাকি?
তার পর থেকেই বুড়ি নাকি আরও ক্ষেপে গেছে।
অবশ্য তার আগেও, সে-বৌয়ের ওপরও অত্যাচার নাকি কম করে নি। সে বাপ- মায়ের আদুরে মেয়ে, সহ্য করতে না পেরেই নাকি বাপের বাড়ি চিঠি লিখে পালিয়ে যায়। এসব কথা পুকুরে স্নান করতে বা বাসন মাজতে গিয়ে পাড়ার অন্য মেয়েদের কাছে শুনেছে তরু। অনেকেই বলেছে… এক কথা। সুতরাং খানিকটা সত্য আছেই।
আর তা-ছাড়া, সে সম্বন্ধে হারানও সচেতন। এর আগে এ ধরনের ঘটনা না ঘটলে সে-ই বা এত সতর্ক হবে কেন? সে যতদিন সতর্ক ছিল ততদিন এতটা বাড়াবাড়ি তো হ’তে পারে নি।
কী সতর্কতা? কনকের প্রশ্নের উত্তরে লজ্জায় রাঙা হয়ে মাথা নামিয়ে সেকথাও বললে তরু। সেও যেমন বিচিত্র, তেমনি হাস্যকর।
বিয়ের পর প্রথম হারান বৌ সম্বন্ধে খুব উদাসীন নিরাসক্ত ভাব দেখিয়েছিল। তরুকে ঠাকুমার কাছে শোওয়াবার প্রস্তাব করেছিল। অন্যথায় তিনজনই একসঙ্গে শোবে, এমন প্রস্তাবও করেছিল। বুড়ি ভারি খুশী, সে-ই তখন জোর ক’রে বৌকে হারানের ঘরে পাঠিয়ে দিত প্রতি রাত্রে। তবু তখনও হারান বৌয়ের সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা কইত না। তবু প্রথমটা ওর ব্যবহারে একটু ভয় পেয়েই গিয়েছিল। ছোট মাসীর কাহিনী সে মা’র মুখে, মেজদির মুখে অনেকবার শুনেছে। বিয়ে করেছিল মেসোমশাই নাকি শুধু তার মার সংসারে খাটবার জন্যে, নিজে একরাত্রের জন্যেও গ্রহণ করে নি স্ত্রীকে। সুন্দরী উমা অনাঘ্রাতা থেকেই ধীরে ধীরে বুড়ো হয়ে শুকিয়ে গেল। স্বামী-পুত্র নিয়ে সংসার করা আর হ’ল না। অথচ এমনিতে সে মেসোমশাই নাকি খুব ভদ্র, ওদের বাবার মতো নয়!
সে যাই হোক– হারান শিগিরই তার ভয় ভেঙ্গে দিল। একদিন একটা চিঠি লিখে ওকে জানিয়ে দিলে যে এতে ভয় পাবার কিছু নেই। শুধু এখন কয়েকটা দিন ওদের প্রেম এবং প্রেমালাপটা একটু সংযত হয়ে যতটা সম্ভব সন্তর্পণে ও নিঃশব্দে করতে হবে এই মাত্র। বুড়ির ভীমরতি হয়ে মাথাটা একটু খারাপ মতো হয়েছে, সুতরাং সাবধান থাকাই ভাল। বুড়ি আর কদিন? এই কটা দিন তরু যেন মানিয়ে নেয়, আর কিছু মনে না করে!
তবু তখনও হারানের আচরণের পুরো অর্থটা ওর বোধগম্য হয় নি। হারানও পরিষ্কার করে বলে নি যে বুড়ির ভীমরতির সঙ্গে ওদের নিঃশব্দে ও সন্তর্পণে প্রেমালাপ করার কী সম্পর্ক। বোধ হয় লজ্জায় বেধেছিল, কেলেঙ্কারিটা পুরোপুরি নববধূকে খুলে বলতে। কিন্তু পরে তরুই আবিষ্কার করেছিল কারণটা। বুড়ি প্রত্যহ ওদের ঘরে আড়ি পাতত। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা কতদূর ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ হচ্ছে সেটার খবর রাখত।
সবই জানত হারান কিন্তু মানুষের সহ্যেরও একটা সীমা আছে। স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতাটা সম্পূর্ণ ঢাকা সম্ভব নয়। ইদানীং ওরা একটু অসতর্ক হয়ে পড়েছিল। একটু চালাকিও করতে গিয়েছিল। প্রথম রাত্রে দু’একটা শুষ্ক প্রয়োজনীয় কথা বলে দুজনেই কাঠ হয়ে শুয়ে থাকত। মধ্যে মধ্যে হারান নাক ডাকাবারও চেষ্টা করত, তারপর ঘাটে যাবার অছিলায় কেউ দেখে আসত বুড়ি জেগে আছে কি না– বুড়ি ঘুমিয়েই পড়ত ততক্ষণে– তখন নিশ্চিন্ত হয়ে দুজনে গল্প করত।
কিন্তু বুড়ি আরও চালাক। সে তরুর চোখের দিকে চেয়ে সন্দেহ করত ব্যাপারটা। তার বয়স হয়েছে ঢের। মনের খুশি যে চোখের চাহনিতে অকারণেই উপচে পড়ে এটা সে জানে। তাছাড়া রাত্রি জাগরণের কালিও চোখের কোণে ঢাকা কঠিন। বুড়িও তাই ইদানীং প্রথম রাতটা মটকা মেরে পড়ে থেকে গভীর রাত্রে উঠে এসে আড়ি পাতত। তার পরেই অত্যাচার চরমে উঠল। এবং সর্বশেষে– শ্যামারাও খবরটা এই প্রথম জানল–তরু গর্ভবর্তী হয়েছে টের পেয়ে যেন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেল। হারান ভেবেছিল বুড়ি বংশরক্ষা হচ্ছে ভেবে, খুশী না হোক– একটু চেপে থাকবে, কারণ তারও জল-পিণ্ডির ব্যবস্থা আর নেই। সে কথাটা স্মরণ করিয়ে দেবারও চেষ্টা করেছিল পরোক্ষভাবে– তাতে হিতে বিপরীত হল। তা’হলে সবাই তার মরণের কথাই চিন্তা করছে, ‘মরণ টাকছে’ ভেবে ক্ষেপে উঠল। আগে গায়ে হাত তুলত না, এইবার মারধোর শুরু করল। গালাগাল তো অষ্টপ্রহর। এমন অকথা কুকথা নেই যা বলে না। দিনেরাতে সদাসর্বদা তরুর পিতৃমাতৃকুল উদ্ধার করছে।
এও সয়েছিল তরু কিন্তু গত সাত-আটদিন খাওয়ায় হাত দিয়েছে বুড়ি। ভাত বেড়ে খেতে বসেছে দেখলেই হয় ভাতের থালা টান মেরে উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, নয়ত পুকুরে দিয়ে আসে। হাঁড়িসুদ্ধ ভাত গোরুর ডাবায় ঢেলে দেয়। একদিন ভাতের থালা জোর করে চেপে ধরেছিল– নড়াতে পারে নি– ছাই এনে পাতে ফেলে দিয়েছে। কদিনই বলতে গেলে এর খাওয়া নেই।
‘তা ঠাকুরজামাই কি এসব টের পান না?’ কনক কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকার পর অতিকষ্টে প্রশ্ন করে। তার চোখেও তখন জল এসে গিয়েছে এইসব শুনতে শুনতে। আরও, নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা ক’রেই হয়ত।
‘কেন পাবে না! আমি তাকে কাগজে লিখে লিখে সব জানিয়েছি। সে শুধু বলে– আর একটু। দুটো দিন ধৈর্য ধরে থাকো। এবার পুরো ভীমরতি ধরেছে, শিগগিরই মরবে বুড়ি।….. আসলে সেও বুড়িকে ভয় করে। তারও ঐ বিষয়ের ভয়। এতদিন এত কষ্ট সহ্য করল, দুদিনের জন্যে যদি সবসুদ্ধ যায়– বুড়ি যদি ছনুমতি হয়ে আর কাউকে লিখে দিয়ে যায়! এই ভয়েই গেল। আমি তাও বলেছি, চল আমরা চলে যাই, কোথাও একখানা ঘর ভাড়া ক’রে থাকব, তুমি যা আনবে তাইতেই চালাব। তাতে শিউরে ওঠে, বলে, বাপরে, এতটা সম্পত্তি দুটো দিনের জন্যে হাতছাড়া হয়ে যাবে!’
‘তারপর? আজ কী হ’ল তাই বল না!’ অসহিষ্ণু হেম প্রশ্ন করে।
ওদিকে মুখ ফিরিয়ে তরু বলে, ‘পর পর দু’দিন খাওয়া হয় নি শুনে পরশু রাত্তিরে পকেটে ক’রে দুটো সন্দেশ এনেছিল। রাত্রে সেই সন্দেশ খেয়ে দালানে জল খেতে বেরিয়েছি, বুড়ি নিজের ঘর অন্ধকার ক’রে জানলায় বসে ছিল, সব দেখেছে। কাল ভোরবেলা যে-ই আমি ঘাটে গিয়েছি বুড়ি ঘরে ঢুকেই ওর পকেটে হাত দিয়েছে। এসব দিকে আশ্চর্য মাথা এখনও বুড়ির। সকালে বাজার করার সময় বেরিয়ে পাঁদাড়ে ফেলে দেবে বলে শালপাতার ঠোঙ্গাটা পকেটেই রেখেছিল– বুড়ি টেনে বার করল। তখন সটেপটে চেপে ধরতে ওকেও মানতে হ’ল কথাটা। তখন তো ছড়া বেঁধে গালাগাল দিলেই– তারপর ও বেরিয়ে যেতে একটা ছুতো করে বললে, আমি পুলিশে যাব, তোরা আমাকে বিষ দিয়ে মারছিস। এর মধ্যে একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেছল– সেই থেকে মধ্যে মধ্যে ধুয়ো তোলে, তোরা আমাকে বিষ খাওয়াচ্ছিস। তা আমি পুলিশে যাবার কথায় আর থাকতে পারি নি, বলেছিলুম যান না পুলিশে, কত ধানে কত চাল একবার দেখুন না। যা নির্যাতন করছেন আমায় তা পাড়াঘরের সবাই জানে, দেখবেন আপনার হাতেই তখন দড়ি পড়বে।… তাতে বলে, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! তোর ঐ জিভ আমি আজ টেনে বার করব। এই বলে সাঁড়াশি টকটকে করে পুড়িয়ে এনেছিল জিভ টানবে বলে, আমি কোনমতে হাত এড়িয়ে ছুটে বাইরে চলে এসেছিলুম, কিন্তু সেই সাঁড়াশি আমার বুকে লেগে কী কাণ্ড হয়েছে দ্যাখো–’
বলতে বলতে আবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল তরু। তারপর দাদার দিকে পেছন ফিরে বুকের জামা সরিয়ে বৌদিকে দেখাল– এতবড় একটা ফোস্কা পড়ে আছে তখনও বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে।
দেখেছিলেন শ্যামাও, তিনি আর্তনাদ ক’রে উঠলেন আর একবার। শুধু কনকই রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করল, ‘তারপর? তা তখনই চলে এলে না কেন?’
সে কথাও বলল তরু, কোনমতে– থেমে থেমে, কান্নার ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে। সে সময় আর তার কোন জ্ঞান ছিল না। ভয়ে যন্ত্রণায় দিশাহারা হয়ে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এসে পাশের দত্তদের বাড়ি আছড়ে পড়েছিল সে। দত্তগিন্নী পোড়া জায়গাটায় নারকেল তেল লাগিয়ে বাতাস ক’রে একটু সুস্থ ক’রে তুলেছিলেন। তৃষ্ণায় তখন সমস্ত ভেতরটা ওর শুকিয়ে গেছে বুঝে একঘটি বাতাসার সরবতও ক’রে দিয়েছিলেন। তাঁকেই বলেছিল তরু এখানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে, কিন্তু দত্তগিন্নী তা শোনেন নি। ওকেও ছাড়েন নি। আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘তোমার সোয়ামী আসুক, এমন কেলেঙ্কারি শুনলে কি আর একটা বিহিত করবে না? ফট্ ক’রে অমন এক কথায় শ্বশুরঘর ছেড়ে যেতে নেই মা!
তরুও তাই আশা করেছিল। ভেবেছিল এবার অবস্থা চরমে উঠেছে জানলে এমন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলে– নিশ্চয়ই তার চৈতন্য হবে। হারান অফিস থেকে ফিরছে দেখে, দত্তগিন্নীই সঙ্গে ক’রে এনে সব বলে দিয়ে গেলেন তরুকে। সে কিন্তু সব কথা শুনে মন্তব্য করল, ‘তা তুমিই বা জেনেশুনে ও পাগলকে ঘাঁটাতে গেলে কেন? সত্যিই কি আর কিছু ও পুলিশে যেত!’
এই পর্যন্ত।
একটা সান্ত্বনার কথা উচ্চারণ করেনি হারান কিম্বা পোড়া জায়গাটাও একবার দেখতে চায় নি। বুড়ি ভাত বেড়ে খেতে ডাকলে মুখ-হাত ধুয়ে এসে খেতে বসেছে, খেয়েই গিয়ে শুয়ে পড়েছে। বুড়িকেই রাঁধতে হয়েছিল, কারণ তরু তো ছিল না- নইলে না খেয়েও তরুই রান্না করেছে কদিন, আর যতই বিষ দেবার কথা বলুক মুখে, বুড়ি খেয়েছেও এতটি– যেমন খায়। বুড়ি কাল কী মনে ক’রে তরুর মতোও রান্না করেছিল, হয়ত সকালের অতটা বাড়াবাড়িতে নিজেই ভয় পেয়ে থাকবে– হারানের পাতেই ভাত বেড়ে দিয়ে হেঁকে বলেছিল, ‘ও ডাইনীকে দয়া ক’রে খেয়ে আমার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতে বল্ হারান, আমার শরীর খারাপ, বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারব না!’
তরু খেতে যায় নি, ঘরে ঢুকে মেঝেতে পড়ে ছিল, সেখান থেকেও ওঠে নি। হারান কিন্তু নির্বিকার ওকে খেতে অনুরোধ করা কিম্বা ডেকে বিছানায় শোয়ানো, কিছুই করে নি। তরুর বিশ্বাস একটু পরে সহজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বরং।
তাই সারারাত জেগে পড়ে থেকে মনের ঘেন্নায় শেষরাত্রে উঠে চলে এসেছে ও।…
এখন যদি এরা আশ্রয় না দেয় তো– সামনেই পুকুর আছে,– কিম্বা স্টেশনে গিয়ে রেলেও গলা দিতে পারে। মোট কথা, ওকে যদি যেতেই হয়– পিতৃকুল, শ্বশুরকুল সকলের মুখে কালি দিয়ে সে যাবে। এই তার স্পষ্ট কথা।
কিছুক্ষণ সকলেই চুপ ক’রে রইল। যেন নিথর নিস্পন্দ হয়ে গেছে সবাই।
হেমের অফিসের বেলা পার হয়ে গেছে। এরপর আর স্নানাহার করে গিয়ে ছটা চল্লিশের ট্রেন ধরা সম্ভব নয়। সেদিকে খেয়ালও নেই হেমের। কোলের বোন তরু– বোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আর শান্ত বলেই বোধ হয় ওর প্রতি তার স্নেহ একটু বেশি চিরদিনই।
শ্যামা যেন আরও কাঠ হয়ে গেছেন। উনুনে ভাত ফুটে গলে গেছে। আঁচ ঠেলে দেওয়া বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণই কিন্তু ভেতরের তাপে তা এখনও ফুটছে। একটু পরেই হয়ত অখাদ্য পাক হয়ে যাবে, এতখানি খাদ্য-বস্তু নষ্ট হবে। তবু সেদিকেও শ্যামার ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি ভাবছিলেন তাঁদের রক্তের কথা। তাঁর মা’র রক্ত যেখানে এক ফোঁটাও আছে, কেউ সুখী হবে না। মনের মধ্যে এই আঘাতের মধ্যেও বিচিত্র হাসি একটা পাচ্ছিল তাঁর। তিনি ভেবেছিলেন যে মেজমেয়ের বৈধব্য এবং তাঁর স্বামী নরেনের মৃত্যুতেই বুঝি এ প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়ে গেল। হায় রে! এতই সহজে ভাগ্যকে ফাঁকি দেবেন তিনি!
সম্বিৎ ফিরল বুঝি কনকেরই প্রথম।
সে উঠে দাঁড়িযে তরুর হাত ধরে টেনে বললে, ‘তুমি ঘাটে চল ঠাকুরঝি মুখহাত ধুয়ে কাপড়টা কেচে নাও, আমার একটা শাড়ি আছে আলনায়, ঐটেই পরো। মুখে একটু জল দাও। অমন করে বসে থেকে তো লাভ নেই!’
এই টুকু সহানুভূতির স্পর্শেই এতদিনের নিরুদ্ধ বেদনা আবার প্রবল হয়ে ওঠে তরুর। সে হু হু ক’রে কেঁদে বৌদির কাঁধে মুখ গুঁজে বলে, ‘আমার কি হবে বৌদি, আমি কোথায় দাঁড়াব!’
এইবার হেমও খানিকটা প্রকৃতিস্থ হয়।
তার কণ্ঠস্বরও সম্ভবত খানিকটা বাষ্পার্দ্র হয়ে এসেছিল। জোর করে সে কণ্ঠকে সহজ করতে গিয়ে কেমন যেন অস্বাভাবিক রকমের কঠোর শোনাল।
সে বলে উঠল, ‘হবে আবার কি? আমরা তোকে দুটো ভাত দিতে পারব না? একটা বোন পুষছি, না হয় আর একটাকেও মনে করব তেমনি হয়ে এসে উঠেছে!’
শিউরে উঠল কনক
‘ও মা, ছি ছি! ও কী অলুক্ষণে কথা! অর্ধস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে কনক, ‘দুদিনের ব্যাপার দুদিনেই মিটে যাবে ঠাকুরঝি, তোমার ঘর-বর তুমি ঠিকই পাবে। নাও এখন ঘাটের দিকে চল দিকি!’
শিউরে ওঠেন শ্যামাও অস্ফুট কণ্ঠে ‘ষাট। ষাট!’ ক’রে ওঠেন 1
তেমন ক’রে আর কাউকে না এসে উঠতে হয়।
ছেলেটা যেন কি!
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তিনি তাড়াতাড়ি ভাতের হাঁড়িতে খানিকটা ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে ফ্যান গালতে বসেন। যদি কিছুটাও আদায় হয়। হয়ত সবটা এখনও পাঁক হয়ে যায় নি।
কনক একরকম জোর ক’রেই তরুকে ঘাটে পাঠিয়ে দিয়ে ফিরে এসে অনুচ্চকণ্ঠে বলে, ‘মা, ওঁর তো অফিসে যাওয়া হ’লই না আজ, যা দেখতে পাচ্ছি– তা ওঁকে একবার বলুন না নিবড়েয় যেতে!’
হেম কথাগুলো বলে উঠোন পেরিয়ে ওধারে সিঁড়িতে গিয়ে বসেছিল। সে তীক্ষ্ণকণ্ঠ মন্তব্য করে উঠল, ‘কিসের জন্যে ঐ ছোটলোকদের কাছে যাব শুনি!… এই ব্যবহারের পর পায়ে ধরে বোনকে ফিরিয়ে দিতে যাব? ওরা তো আরও পেয়ে বসবে। এবার তো সোজাসুজি খুন ক’রে ফেলবে তাহলে। না, সে আমি পারব না। ও থাক এখানেই– নিজেরা যদি খেতে পাই তো বোন ভাগ্নেও একমুঠো খেতে পাবে।’
অগত্যা চুপ ক’রে যায় কনক। কিন্তু কথাটা তার আদৌ ভাল লাগে না। অথচ তার আর কীই বা বলার আছে, স্বামীর ওপরই বা তার কতটুকু অধিকার।
সে শুধু নীরব জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে চায় শাশুড়ীর মুখের দিকে।
কিন্তু শ্যামা কিছুতেই বলতে পারে না। কিছুই ভেবে পান না যেন। বহু আঘাত সহ্য করেছেন জীবনে কিন্তু তখন নিশ্চিন্ত ভাবটা ছিল না, আঘাতের জন্যেই যেন সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকতেন তিনি। এখন, এই বছর-কতকের নিশ্চিন্ততার পর, আকস্মিক এই আঘাতে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনিও। তাঁর অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিও যেন আজ আর কোন কাজ করছে না।