০২. দার্শনিকের নাম নান্টু

২. দার্শনিকের নাম নান্টু

বল্টু কারও নাম হওয়ার কথা না, কিন্তু কীভাবে কীভাবে সেটা বল্টুর নাম হয়ে গেছে কেউ তা পরিষ্কার করে মনে করতে পারে না। রাজুর ধারণা, বল্টুর জন্মের পর অন্য দশটা ছোট বাচ্চার মতো তার কোনো ঘাড়-গর্দান ছিল না, ছোট শরীরটার ওপর একটা বড় মাথা দেখে তাকে একটা বল্টুর মতো লাগছিল বলে তাকে ডাকা হতো বল্টু। রিতু মনে করে, সেটা সত্যি নয়, বল্টুর জন্ম হওয়ার পর যখন সে তার ছোট ছোট হাত-পা আঁকুপাঁকু করে নাড়ত, তখন সে তার উদোম পেটে মুখ লাগিয়ে কাতুকুতু দিতে দিতে অন্টু মল্ট ফন্টু ভট্ কন্টু চন্টু বল্টু-এজাতীয় দুর্বোধ্য শব্দ করত। এসব শব্দ করতে করতে কীভাবে কীভাবে জানি বল্টু নামটা তার ওপর গেঁথে গেছে। রাজুর কাহিনীটা সত্যি, নাকি রিতুর কাহিনীটা সত্যি–সেটা কেউ ঠিক করে জানে না। তবে ঘটনা হচ্ছে, বর নাম এখন আসলেই বল্টু। এ ঘটনার সঙ্গে আরেকটা ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটা হচ্ছে বল্টুর সব সময়ের সঙ্গী নান্টুকে কেউ আর নান্টু ডাকতে চায় না–বল্টুর সঙ্গে মিলিয়ে তার একটা নতুন নাম দিয়েছে। যখন নান্টু আর বল্টু কোথাও যায়, আশপাশে যারা থাকে তারা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, “ওই দেখ, নাট-বল্টু যাচ্ছে, নাট-বল্টু যাচ্ছে।”

অন্য যেকোনো মানুষ হলে নিশ্চয়ই রেগে উঠত, কিন্তু নান্টু কখনো রাগে না। তার ভেতর রাগ ক্রোধ-হিংসা এসব কিছু নেই। ছয় বছরের এই ছোটখাটো মানুষটা পুরোপুরি একজন দার্শনিক। যদি ছোট বাচ্চাদের দাড়ি গজানোর উপায় থাকত, তাহলে দেখা যেত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নান্টুর লম্বা লম্বা পাকা দাড়ি। নান্টুর পাকা দাড়ি নেই সত্যি, কিন্তু তার কথাবার্তা-ভাবভঙ্গি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কোনো অংশে কম নয়। যেমন ধরা যাক, নান্টু হয়তো গভীর কোনো ভাব নিয়ে ঘরে পায়চারি করছে, তখন হয়তো তার বড় বোন মুনিয়া বলল, “নান্টু, টেবিলের ওপর থেকে বইটা আমাকে একটু দিবি?”

নান্টু তখন বলবে, “কেন দেব না, আপু। নিশ্চয়ই দেব। তুমি আমাকে একটা বই দিতে বলেছ, আমি সেটা দেব না, এটা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই দেব। একশবার দেব।”

তারপর দেখা যাবে নান্টু গভীর একটা ভাব নিয়ে দুই হাত পিছনে রেখে ঘরে পায়চারি করেই যাচ্ছে। মুনিয়া তখন অধৈর্য হয়ে বলবে, “কী হলো? তোকে না বইটা দিতে বললাম?”

নান্টু তখন চমকে উঠে বলবে, “আপু! আমি বুঝতে পারি নাই তুমি বইটা দিতে বলেছ! আমি ভেবেছি তুমি জিজ্ঞেস করেছ আমি বইটা দেব কি না!”

“ব্যস! অনেক হয়েছে। এখন বকরবকর না করে বইটা দে।”

নান্টু তখন প্রায় ছুটে বইটা নিয়ে মুনিয়াকে দিয়ে বলবে, “আপু, তোমাকে আর কিছু এনে দেব?”

“না, আর কিছু লাগবে না।”

“এক গ্লাস পানি?”

“না, লাগবে না।”

“তাহলে একটা কলম, না হলে পেনসিল এনে দেই?”

“না।”

“আজকের পেপারটা এনে দেব?”

এ রকম সময় মুনিয়ার মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, “বললাম তো আর কিছু লাগবে না।”

মুনিয়াকে দাঁত কিড়মিড় করতে দেখে নান্টুর চোখ ছলছল করে ওঠে। সে নরম গলায় বলে, “আপু! তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?”

“না। রাগ করি নাই।”

“তাহলে তুমি এ রকম করে কেন কথা বলছ?”

“কী রকম করে কথা বলছি?”

“রাগ-রাগ হয়ে!”

“আমি রাগ-রাগ হয়ে কথা বলছি না।”

নান্টু কিছুক্ষণ মুনিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তাহলে তোমার মুখটা এ রকম রাগ-রাগ কেন?”

মুনিয়া তখন রেগেমেগে বলে, “আমার মুখটা মোটেও রাগ-রাগ না।”

নান্টু তখন খুব শান্ত গলায় বলে, “আমি একটা আয়না এনে দেই? তুমি নিজেই দেখো, তোমার মুখটা কি রাগ-রাগ না হাসি-হাসি।”

মুনিয়া বলে, “না, আয়না আনতে হবে না।”

“তাহলে কী আনব?”

“কিছুই আনতে হবে না।”

তখন নান্টু ছলছল চোখে বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপু, তুমি নিশ্চয়ই আমার ওপর রাগ করেছ।”

মুনিয়া তখন দুই হাত-পা ছুঁড়ে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে চিৎকার করে বলে, “করি নাই! করি নাই! কর নাই!”

নান্টু তখনো বিচলিত হয় না। বড় বড় চোখে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে হতাশভাবে মাথা নাড়ে। ছোট বাচ্চাদের অর্থহীন কাজ করতে দেখলে বড়রা যেভাবে মাথা নাড়ে অনেকটা সে রকম। এই হচ্ছে না। তার মতো শান্তশিষ্ট, ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ আর একজনও নেই, কিন্তু যারা তাকে চেনে তারা তাকে ঘাটায় না।

.

একদিন এই নান্টুর সঙ্গে আমাদের বল্টুর পরিচয় হলো। সেই পরিচয়ের ঘটনাটা মোটামুটি অন্যরকম। নান্টুর বাবা-মা এসেছেন রিতু-রাজুদের পাশের বাসায়। নান্টুর মা খুব মিশুক ধরনের মানুষ, নতুন জায়গায় এসেই আশেপাশে সবার বাসায় গিয়ে আলাপ-পরিচয় করতে শুরু করে দিয়েছেন। একদিন তাই নান্টু আর মুনিয়াকে নিয়ে এলেন বন্দুদের বাসায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলেন, ভেতরে তুমুল হইচই। এ রকম অবস্থায় ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে কি না নান্টুর আম্মু বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু ততক্ষণে নান্টু বেল টিপে দিয়েছে। বেলের শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরকার হইচই হঠাৎ করে থেমে গেল। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর খুট করে দরজা খুলে রিতু বাইরে উঁকি দিল।

নান্টুর আম্মু খুব অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আমরা আসলে পাশের বাসায় এসেছি, ভাবলাম আশেপাশে যারা বসে আছে তাদের সঙ্গে পরিচয় করি, তাই আমার ছেলে আর মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলাম …”

এ রকম সময় ভেতর থেকে বল্টুর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “আম্মু, ভালো হবে না কিন্তু বলে রাখলাম …”

নান্টুর আম্মু বললেন, “আজকে মনে হয় আপনি ব্যস্ত আছেন, আমি অন্য একদিন আসি?”

রিতু দরজা খুলে বললেন, “অন্য একদিন আরও একবার আসবেন, আজকে যখন এসেছেন, ভেতরে আসেন।”

নান্টুর আম্মু এবং তাদের পিছনে পিছনে নান্টু আর মুনিয়া ভেতরে ঢুকে একটা বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পেল। তারা দেখল, সাত-আট বছরের একটা বাচ্চা মাথা নিচে এবং পা ওপরে তুলে দিয়ে খাড়া হয়ে আছে। মাথার নিচে কয়েকটা বালিশ, যেন পড়ে না যায় সে জন্য পা দুটো ডাইনিং টেবিলের ওপর ভাজ করে রাখা। সামনে কয়েকটা গ্লাস ও বাটি, সেখানে কয়েক ধরনের খাবার। বল্টু সেই অবস্থায় চিৎকার করে বলল, “আম্মু, তুমি কিন্তু শুধু শুধু দেরি করছ।”

রিতু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি যদি অন্য সময় আসেন তখনো ঠিক এ রকম কিছু একটা ঘটতে থাকবে। এখনকার ঘটনাটা তবু সহজ ঘটনা। এর চাইতে অনেক জটিল ঘটনা ঘটে।”

জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না নান্টুর আম্মু বুঝতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে ফেললেন, “ঠিক কী হয়েছে?”

রিতু বলল, “আমি আপনাকে বললেও আপনি বুঝবেন না! আমি নিজেই বুঝি না, আপনাকে কী বোঝাব?”

রিতু নান্টুর আম্মুর হাত ধরে বসার ঘরের দিকে নিতে নিতে বলল, “আসেন, ওখানে বসি। একটু কথা বলি। এই ছেলের যন্ত্রণায় আমার মাথা ধরে গেছে।”

ডাইনিং টেবিলে পা রেখে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা অবস্থায় বল্টু আবার চিৎকার করে বলল, “আম্মু, তুমি দেরি করছ। ভালো হবে না কিন্তু।”

নান্টুর আম্মু ব্যস্ত হয়ে বললেন, “প্লিজ, আপনি দেখে আসেন কী চায় …”

রিতু হাত নেড়ে বলল, “দেখার কিছু নাই। উল্টা হয়ে এভাবে ঝুলে থাকুক।”

এ রকম সময় নান্টু উঠে দাঁড়াল, বলল, “আমি দেখি আসি।”

না অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে দুই হাত পিছনে নিয়ে বল্টুর দিকে এগিয়ে গেল, পুরো ডাইনিং টেবিলটা এক পাক ঘুরে সে বল্টুর সামনে গালে হাত দিয়ে বসে যায়। কোনো কথা না বলে খুব মনোযোগ দিয়ে বল্টুকে দেখতে থাকে। বল্টু মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী দেখো?”

নান্টু উদাস মুখে বলল, “এখানে দেখার আর কী আছে? তোমাকেই দেখি!”

“কেন?”

“দেখতে আমার খুবই ভালো লাগছে।” বল্টু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, নান্টু তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি খিদে লেগেছে?”

“না।”

নান্টু তার সামনে রাখা খাবারগুলো দেখিয়ে বলল, “তাহলে এই খাবারগুলো এখানে কেন?”

“আমি খাব, তাই।” উত্তরটা নান্টু মেনে নিয়ে বলল, “ও।”

বল্টু তখন রেগে গিয়ে বলল, “ও মানে আবার কী। আমার খিদে লাগে নাই তবু কেন খাব জিজ্ঞেস করবে না?”

নান্টুকে এবার একটু অবাক হতে দেখা যায়, সে মাথা চুলকে বলল, “তোমার যদি খিদে নাই তাহলে খাবে কেন?”

বল্টু মুখ আরও শক্ত করে বলল, “কারণ এটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা।”

নান্টু বলল, “ও।”

বল্টু বলল, “তুমি বৈজ্ঞানিক গবেষণা কী সেটা জান?”

নান্টু এবার আরও কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলল, “জানি না?”

বল্টু রাগ-রাগ মুখে বলল, “তুমি বৈজ্ঞানিক গবেষণা জানো না?”

নান্টু মাথা নাড়ল, “নাহ্।”

বল্টু উল্টো অবস্থাতেই মাথা ঘুরিয়ে ভালো করে নান্টুকে দেখল, বলল, “তুমি এত বড় হয়েছ, এখনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা জানো না?”

নান্টু বলল, “আমি আসলে বেশি বড় হই নাই।”

“তাহলে তোমাকে এত বড় দেখা যাচ্ছে কেন?”

নান্টু বলল, “তুমি উল্টা হয়ে আছ বলে মনে হয় আমাকে বড় দেখা যাচ্ছে।”

উত্তরটা বল্টুর পছন্দ হলো; বলল, “সেটা মনে হয় ঠিক। এটাও আমার গবেষণা করতে হবে।”

নান্টু বলল, “গবেষণা কী?”

বল্টু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “যখন কোনো একটা জিনিস কেউ জানে না তখন সেটা বার করার নাম হচ্ছে গবেষণা।”

নান্টু মাথা নাড়ল, বলল, “অ।” তারপর খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “এগুলো খেতে কেমন কেউ জানে না?”

বল্টু বিরক্ত হয়ে বলল, “সেটা জানবে না কেন? সেটা সবাই জানে।”

“তাহলে গবেষণা করছ কেন?”

“আমি কি খেতে কী রকম সেটা গবেষণা করছি?”

“তাহলে কী গবেষণা করছ?”

“মানুষ যখন খায় তখন সেটা পেটে কেমন করে যায় সেটা গবেষণা করছি।”

নান্টু বুঝতে না পেরে মাথা চুলকাতে থাকে। “বুঝলে না?”

নান্টু মাথা নাড়ল “নাহ।”

“আমরা যখন খাই তখন খাবারটা মুখ থেকে যাবে পেটে–নিচের দিকে। ঠিক কি না?”

“হ্যাঁ।”

“এখন আমি উল্টা হয়ে আছি, এখন কিছু খেলে খাবারটা পেটে যেতে হলে কোন দিকে যেতে হবে? নিচে না ওপরে?”

নান্টু মাথা চুলকে বলল, “ওপরে।”

“আমি সেটাই গবেষণা করতে চাই। সবকিছু নিচের দিকে পড়ে। কিছু খেলে সেটাও পেটের ভেতর নিচের দিকে পড়ে। কিন্তু উল্টা হয়ে খেলে কী হয়? এটা কী ওপর দিকে উঠবে নাকি নীচের দিকে বের হয়ে যাবে।”

নান্টু মাথা নাড়ল, বলল, “এখন বুঝেছি।”

বল্টু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু আম্মুর জন্যে গবেষণা করতে পারছি না।”

“কেন?”

বল্টু মুখ শক্ত করে বলল, “আম্মু খাওয়াতে রাজি হচ্ছে না।”

নান্টু খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাকে খাইয়ে দেব?”

বল্টু সন্দেহের চোখে নান্টুর দিকে একবার তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি পারবে?”

“মনে হয় পারব।”

“ঠিক আছে খাওয়াও।”

নান্টু খাবারগুলোর দিকে তাকাল, একটা বাটিতে কিছু মুড়ি। একটা খোলা বিস্কুটের প্যাকেট। একটা প্লেটে একটা কলা। একটা গ্লাসে আধগ্লাস দুধ। নান্টু জিজ্ঞেস করল, “আগে কোনটা দেব?”

বল্টু বলল, “বিস্কুট।”

বল্টুর মুখে নান্টু একটা বিস্কুটি ধরিয়ে দিল। বল্টু সেটা চিবিয়ে খেয়ে ঢোক গিলল। নান্টু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে বলল, “পেটে কি যাচ্ছে? ওপরে উঠছে?”

বল্টু বলল, “মনে হয় উঠছে।

“আরেকটা বিস্কুট দেব?”

“না। কলাটা দাও।”

নান্টু কলাটা ছিলে বল্টুর মুখের কাছে ধরে। বল্টু এক কামড় খেয়ে গেলার চেষ্টা করল। নান্টু খুব মনোযোগ দিয়ে বল্টুর দিকে তাকিয়ে রইল। খাওয়া শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করল, “পেটে গেছে।”

বল্টু বলল, “গেছে।”

“তার মানে খাবারটা ওপরের দিকে উঠেছে।”

“হ্যাঁ, উঠেছে।”

“তাহলে গবেষণা শেষ?”

বল্টু বলল, “উঁহু। শেষ না।”

“কেন?”

“এখনো মুড়ি আর দুধ খাওয়া বাকি আছে।”

“সবগুলো খেতে হবে?”

“হ্যাঁ।” বল্টু মুখ গম্ভীর করে বলল, “বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে হলে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়।”

নান্টু বলল, “অ।”

“এবার মুড়ি দাও।”

নান্টু একমুঠি মুড়ি দিয়ে বল্টুর মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। নিজের মুখে খাবার দেওয়া এত সহজ, কিন্তু আরেকজনের মুখে দেওয়া এত কঠিন কে জানত! সেই মানুষটা উল্টো হয়ে থাকলে তো মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। তার পরও শেষ পর্যন্ত বল্টুর মুখে একমুঠি মুড়ি ঢুকিয়ে দেওয়া গেল। বল্টু চিবিয়ে চিবিয়ে সেটা খেয়ে খুশি-খুশি মুখে বলল, “গুড গবেষণা।

নান্টু ভয়ে ভয়ে বলল, “গবেষণা শেষ?”

“না, এখনো শেষ হয় নাই। আমি তিন রকম খাবার খেয়েছিল, কিন্তু সবগুলো হচ্ছে কঠিন পদার্থ। এখন খাব দুধ। সেটা হচ্ছে তরল।”

নান্টু মাথা নাড়ল; বলল, “অ।”

বল্টু বলল, “দাও দুধ।”

নান্টু দুধের গ্লাসটা নিয়ে নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কোনোভাবেই সুবিধে করতে পারে না। একজন মানুষ উল্টো হয়ে থাকলে তাকে দুধ খাওয়ানো অসম্ভব একটা ব্যাপার।

বল্টু বলল, “কী হলো? দাও দুধ।”

“দিচ্ছি।” বলে নান্টু আবার চেষ্টা করে কিন্তু বল্টুকে খাওয়াতে পারে না।

বল্টু অধৈর্য হয়ে বলল, “কী হলো তোমার, একটু দুধও খাওয়াতে পারো না?”

না কোনো উপায় না দেখে দুধটা ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং এ রকম অবস্থায় যা হওয়ার কথা তা-ই হলো–কিছু মুখে এবং বাকিটা নাকের ওপর পড়ল। উল্টো হয়ে থাকা মানুষের নাকে দুধ ঢেলে দিলে যা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয় সেটা বলার মতো না। বল্টু হাঁচি দিতে দিতে কাশতে কাশতে মুহূর্তে সোজা হয়ে লাফিয়ে-কুঁদিয়ে সারা ঘরে ছোটাছুটি করতে থাকে।

বসার ঘরে নান্টুর আম্মু রিতুর সঙ্গে কথা বলছিলেন, হঠাৎ করে বল্টুকে এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁচি দিতে দিতে কাশতে দেখে চমকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! কী হয়েছে?”

রিতু হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ও কিছু না। বৈজ্ঞানিক গবেষণ!”

“বৈজ্ঞানিক গবেষণা?”

“হ্যাঁ। প্রতিদিনই এ রকম কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়, তারপর এ রকম লাফঝাঁপ, চিৎকার হতে থাকে।”

নান্টুর আম্মু বললেন, “কোনো রকম সমস্যা হয় নাই তো?”

রিতু বলল, “হলে হবে। আপনি চিন্তা করবেন না।”

রিতুর কথা ঠিক বের হলো, কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল, বল্টু হাসিমুখে বসার ঘরে এসে হাজির হয়েছে। হাতে কিল দিয়ে সে বলল, “আম্মু, ফাটাফাটি এক্সপেরিমেন্ট করেছি।”

রিতু চোখ সরু করে বলল, “এখন সবকিছু তুলে রাখ।”

“কী এক্সপিরিমেন্ট করেছি, শুনবে না?”

“পরে শুনব।”

“না আম্মু, এখনই শোনো।”

রিতু হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, বল।”

“মানুষ উল্টো হয়ে খেলে খাবারটা ওপরের দিকে উঠে যায়।”

নান্টু কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল, এবার কাছে এগিয়ে এসে বলল, “হ্যাঁ। উল্টো হয়ে থেকে মুখে দিলে খাবারটা ওঠে ওপরে। আর নাকে দিলে যায় নিচে। তাই না?”

বল্টুর মুখ একশ ওয়াট লাইটের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নান্টুর পিঠে থাবা দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছ। একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে আমরা দুইটা এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলেছি! মুখের ভেতর খাবার, নাকের ভেতর খাবার?”

নান্টু জ্বলজ্বল চোখে বলল, “এখন খালি বাকি আছে কান। কানের ভেতরে খাবার দিলে তিনটা এক্সপেরিমেন্ট হবে, তাই না?”

নান্টুর আম্মু আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! কানের ভেতর কোনো কিছু দেবে না। নেভার।”

“কেন?”

“কানের পর্দা খুব ডেলিকেট। কিছু একটা হলে পর্দা ফেটে যাবে। আর কিছু শুনতে পাবে না!”

নান্টু মনমরা হয়ে বলল, “তাহলে কানের এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে না?”

“না।”

নান্টুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বল্টু বলল, “তোমার কোনো চিন্তা নাই। কানে না করলেও এক্সপেরিমেন্ট করার আরও জায়গা আছে। আসো।”

.

এভাবে নান্টুর সঙ্গে বল্টুর পরিচয় হয়ে বিখ্যাত নাট-বল্টু জুটি তৈরি হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *