০২. দরজার পাশে কলিংবেল আছে

দরজার পাশে কলিংবেল আছে। কলিংবেলের নিচে স্কচ টেপ দিয়ে সাঁটা নোটিশ–

হাত দিলে শক খাইবেন
বেল নষ্ট

আমি দরজার কড়া নাড়লাম। ঢাকা শহর থেকে কড়া বসানো দরজা উঠে গেছে বলেই জানতাম— এখানে আছে। চিপা ধরনের লিফট ছাড়া ফ্ল্যাট বাড়ি। গরিবদের জন্যে আজকাল এক বেডরুমের কিছু ফ্ল্যাট বানানো হচ্ছে। এটাও নিশ্চয়ই এরকম কিছু। সিঁড়িতে রেলিং বসানো শেষ হয় নি, এর মধ্যেই লোকজন উঠে গেছে।

ফ্ল্যাট নাম্বার আটের খ। দরজায় প্লাস্টিকের অক্ষরে বাড়িওয়ালা কিংবা ভাড়াটের নাম—

আবুল কালাম মিয়া
অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট

সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেটদের এমন দৈন্যদশা জানতাম না। আমি খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেছি। ভাইয়া এই ঠিকানা কাগজে লিখে দিয়েছে। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে ঠিকানাটা ভুল। দরজার কড়া নাড়লেই অ্যাডভোকেট সাহেব বের হবেন এবং থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করবেন, কী চাই?

ভুল ঠিকানা নিয়ে এসেছি বললেও যে অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছ থেকে পার পাওয়া যাবে তা মনে হয় না। তিনি অবশ্যই নানান প্রশ্ন করবেন—

ভুল ঠিকানাটা কে দিয়েছে? তার নাম, তার পরিচয়? তোমার নাম? তোমার পরিচয়? ঠিকানা কী?

আমি কড়া নাড়লাম। কলিংবেল টিপতে হয় একবার, কড়া নাড়তে হয় থেমে থেমে তিনবার। আমাকে তিনবার নাড়তে হলো না। দ্বিতীয় বারেই দরজা খুলে গেল। দরজার ওপাশে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে হলুদ লুঙ্গি। গায়ে স্যান্ডাে গেঞ্জি। মুখ হাসি হাসি। যেন তিনি আমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন।

আরে বাবলু তুই? আয়, ভেতরে আয়।

বাবা ভেতরের দিকে মুখ করে আনন্দিত গলায় বললেন, এই দেখ বেএসেছে।

বসার ঘরের মেঝেতে তিন সাড়ে তিন বছরের একটা মেয়ে বসে আছে। তার চারদিকে সস্তার খেলনা ছড়ানো। সামনে একটা টেবিল ফ্যান। মেয়েটির স্বভাব মনে হয় প্রতিধ্বনির মতো যা শুনছে তাই নিজের মতো করে বলা। সে খেলনা থেকে চোখ না সরিয়ে রিনরিনে গলায় বলল, এই দেখ কে এসেছে।

বাবা আমার হাত ধরে ঘরের ভেতর টানতে টানতে বললেন, বাবলু এসেছে। বাবুল।

ছোট মেয়েটা বলল, বাবলু এসেছে, বাবলু।

বাবা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, বাবলু কী রে? নাম ধরে ডাকা বেয়াদব মেয়ে। তোর ভাই হয়। ভাইয়া ডাকবি।

মেয়েটা বিড়বিড় করে বলল, ভাইয়া।

রান্নাঘর থেকে অল্পবয়স্ক, আঠারো-উনিশ কিংবা তারচেয়ে কমও হতে পারে, একজন মহিলা উঁকি দিলেন। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।

বাবা বললেন, হা করৈ তাকিয়ে আছ কেন? এই হলো বাবলু, My son. দেখেছ কী সুন্দর চেহারা!

মহিলা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিলেন। বাবা বললেন, তুই যে একদিন না একদিন আসবি আমি জানতাম। তুই আরাম করে বস তো। যূথী মা, ভাইয়ার দিকে ফ্যানটা দিয়ে দাও।

যূথী ফ্যান আমার দিকে ঘুরিয়ে দিল, আর তখনি মঞ্চে যার আবির্ভাব হলো তাকে আমি চিনি— আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জিতুর মা। গোশতের শুঁটকির টিন নিয়ে সে এই বাসায় উঠেছে, এখন বুঝতে পারছি। জিতুর মা আহ্লাদী গলায় বলল, ও আল্লা, ভাইজান! কেমন আছেন? বাসার সবেই ভালো? আম্মাজানের আধ কপালী মাথাব্যথা এখনো হয়?

বাবা বললেন, জিতুর মা, ফালতু বাত বন্ধ কর। বাবলু রাতে খাবে, এই ব্যবস্থা দেখ। টাকা নিয়ে যাও, হাফ কেজি খাসির মাংস নিয়ে আস। আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি–তোমার যেতে হবে না। মাংস চিন না কিছু না। ভেড়ার মাংস নিয়ে আসবে, বোটকা গন্ধের জন্যে মুখে দেয়া যাবে না। বাবলু, তুই দশ মিনিট বসে থাকতে পারবি না?

পারব।

যূথীর সঙ্গে বসে গল্প কর। আমি রিকশা নিয়ে যাব, রিকশা নিয়ে ফিরব। দশ মিনিটও লাগবে না। তুই বসে বসে চা খা। তোর চা শেষ হবার আগেই আমি চলে আসব।

আমিও যাই তোমার সঙ্গে?

কোনো দরকার নেই, তুই যূথীর সঙ্গে গল্প কর।

 

আমি এবং যূথী বসে আছি। মেয়েটার চেহারা যে এত মায়াকাড়া আগে বুঝতে পারি নি। গোলগাল রোগা মুখে বড় বড় চোখ। চোখের মণি ঝলমল করছে। গায়ের রঙ একটু ময়লা। তাকে এই রঙটাই মানিয়েছে। এই মেয়েটা ফর্সা হলেও মানাতো না। কালো হলেও মানাতো না। তার মাথার চুল বেণি করা। দুদিকে দুটা বেণি ছিল। একটা খুলে গেছে, এতেই মেয়েটাকে ভালো লাগছে। দুই বেণিতে একে মানাতো না। আমি বললাম, যূথী, তুমি কেমন আছ?

যূথী বলল, ভালো না। আমার জ্বর। কপালে হাত দিয়ে দেখ।

সে মাথা আমার দিকে এগিয়ে দিল। নিতান্ত অপরিচিত একজনের সঙ্গে কী সহজ স্বাভাবিক আচরণ! আমি কপালে হাত দিলাম। যূথী ভুল বলে নি। তার সত্যিই জ্বর। একশর ওপর তো হবেই। এই জ্বর নিয়ে মেয়েটা নিজের মনে খেলছে। নিশ্চয়ই খুব লক্ষ্মী মেয়ে।

যূথী, তোমার কি অনেক খেলনা?

হুঁ। আমার একশ কোটি খেলনা।

কোন খেলনাটা তোমার সবচে প্রিয়?

আমার একটা তুলার হাতি আছে— সবচে প্রিয়।

দেখি হাতিটা।

কীভাবে দেখবে! হারিয়ে গেছে তো।

তুমি খেলনা দিয়ে খেলা ছাড়া আর কী কর?

আর কিছু করি না।

কেন, টিভি দেখ না?

আমাদের টিভি নেই। বাবা গরিব তো, এই জন্যে টিভি নেই। গরিবদের টিভি থাকে না।

গরিবদের আর কী থাকে না?

ফ্রিজ থাকে না। কিন্তু আমাদের ফ্রিজ আছে। তুমি ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খাবে?

খাব।

আচ্ছা আমি এনে দেব। আমার ঠাণ্ডা পানি খাওয়া নিষেধ। ঠাণ্ডা পানি খেলে আমার গলা ব্যথা হয়, এই জন্যে নিষেধ।

যূথী উঠে চলে গেল এবং গ্লাস ভর্তি করে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এলো। যূথীর মা তখন ঢুকছেন চা নিয়ে। চায়ের কাপ আমার সামনে রাখতে রাখতে চাপা গলায় বললেন, বাবা, চা খাও।

তার মুখে বাবা ডাক শুনতে অস্বস্তি লাগছে। তারও মনে হয় অস্বস্তি লাগছে। তিনি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। আমি বললাম, ঘরে কি থার্মোমিটার আছে? যূথীর জ্বর কত দেখতাম।

ভদ্রমহিলা উঠে গেলেন এবং আমাকে থার্মোমিটার এনে দিলেন। তার চোখে কৌতূহল। তিনি থেমে থেমে বললেন (এখনো আমার দিকে তাকাচ্ছেন না), মেয়েটার প্রায়ই জ্বর হয়। তোমার বাবাকে প্রায়ই বলি, ভালো একজন ডাক্তার দেখাতে। সে সময় পায় না।

আমি যূথীর জ্বর দেখলাম, একশ এক। যূথীর মা যূথীকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। বসার ঘরে আমি একা বসে আছি। বাবা দশ মিনিটের কথা বলে গেছেন। আধাঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে যূথীর মা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে অস্বস্তি, লজ্জা এবং কিছুটা ভয়। আমি বললাম, কিছু বলবেন?

উনি বললেন, তোমাদের বাসায় কি সব জানাজানি হয়ে গেছে?

আমি বললাম, জি।

আল্লাগো, এখন কী জানি হয়!

এই ফ্ল্যাট বাড়িটা কি আপনাদের?

না। এক অ্যাডভোকেট সাহেবের বাড়ি। তোমার বাবা ভাড়া নিয়েছেন।

ভাড়া কত?

সবকিছু নিয়ে চার হাজার টাকা। তুমি কি আরেক কাপ চা খাবে? বানিয়ে দিব?

না। আমি ঘনঘন চা খাই না।

এই ফ্ল্যাটের বারান্দা আছে। বারান্দাটা সুন্দর। বারান্দায় বসবে?

না।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগবে। বারান্দায় বসো, আমি আরেক কাপ চা বানিয়ে দেই, চা খাও। তোমার বাবার আসতে অনেক দেরি হবে। বাজার করতে উনার খুব দেরি হয়।

ভদ্রমহিলার আগ্রহের কারণেই বারান্দায় বসলাম। ছোট্ট বারান্দা। পাশাপাশি দুটা মোড়া পাতা। বেশ কিছু টব। একটা টবে নীল অপরাজিতার লতানো গাছ। গাছ অনেক বড় হয়েছে। আরেকটা টবে সাদা সাদা ছোট ফুল। নাম জানি না কিন্তু সুন্দর গন্ধ।

বারান্দা সুন্দর না?

হুঁ।

যূথীকে এই বারান্দায় আসতে দেই না।

কেন?

আমাদের ঠিক উপরের তলার বারান্দা থেকে একটা ছেলে নিচে পড়ে গেছে। চারতলা থেকে পড়েছে, কিন্তু কিছুই হয় নি। নিচে কনস্ট্রাকশানের জন্যে বালি রাখা হয়েছিল। ছেলেটা পড়েছে বালিতে, এই জন্যে কিছু হয় নি।

আমি বারান্দার মোড়ায় বসে আছি—ভদ্রমহিলা ঠিক আমার পেছনে দরজা ধরে দাঁড়ানো। তাঁর দ্বিধা এবং সংকোচ মনে হয় সামান্য কমেছে।

ঐ ছেলেটার নাম টগর। খুব দুরন্ত ছেলে। আমাদের বাসায় প্রায়ই আসে। যূথীর সঙ্গে খেলে।

আমি ও আচ্ছা বলে চুপ করে গেলাম। ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগছে।

তোমার বাবাকে অনেকদিন বলেছি তোমার মার কাছে সব স্বীকার করতে। সে রাজি না। তাঁর এক পীর সাহেব আছে, সেই পীর সাহেব বলেছে সব আপনা আপনি মিটমাট হবে।

ও আচ্ছা।

উনার মন দুর্বল তো, এই জন্যে শুধু পীর-ফকির করে। প্রায়ই শুনি অমুক পীরের কাছে গেছে, তমুক পীরের কাছে গেছে। আপনি পীর-ফকির বিশ্বাস করেন না?

না। এখন উনার এক পীর জুটেছে, সেই পীরের কাজ না-কি শুধু হাঁটা। পীর সাহেব হাঁটেন, পীর সাহেবের সঙ্গে তাঁর লোকজন হাঁটে। তোমার বাবা। উনার কাছে যখন যান তখন বিরাট ঝামেলা হয়।

কী ঝামেলা?

ছয়-সাত মাইল হেঁটে আসেন তো। পা ফুলে যায়। পায়ে সঁক দিতে হয়। পা টিপে দিতে হয়। তোমার মার রান্না না-কি খুব ভালো?

জি ভালো।

তোমার বাবা আমাকে বলেছেন। আমি রাধতে পারি না। কখনোই আমার লবণের আন্দাজ হয় না। হয় বেশি হবে নয় কম হবে।

ও আচ্ছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *