অধ্যায় ২. দরজাগুলো
ধরুন ১৩০০ বি.সি.ই. (খ্রিস্টপূর্বাব্দে) একদিন সকালে মিশরের সাইনাই মরুভূমিতে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন। আপনি হয়তো দাড়িওয়ালা একজন ব্যক্তির দেখা পেতে পারেন, যিনি নগ্নপায়ে একটি কাঁটাঝোঁপের সামনে নতজানু হয়ে আছেন। আপনি দেখবেন তিনি গভীর মনোযোগের সাথে ঝোঁপের কথা শুনছেন, তারপর তিনি ঝোঁপটার সাথে কথা বলছেন, তারপর তিনি আবার শুনতে শুরু করেন। অবশেষে উদ্দেশ্যমূলক একটি সংকল্প নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, এবং সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন। এই মানুষটির নাম হচ্ছে ‘মোজেস’। ধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত নবীদের একজন ও ইহুদি ধর্মের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। একদিন তাকে নিয়ে যে গল্প লেখা হবে সেটি বলবে, এইদিনে জ্বলন্ত একটি ঝোঁপ থেকে ঈশ্বর তার সাথে কথা বলেছিলেন, এবং তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ক্রীতদাসদের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে মিশর থেকে প্যালেস্টাইনে, তাদের প্রতিশ্রুত দেশে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যেতে।
আপনার কাছে, যিনি বিষয়টি দেখছেন, কাঁটার সেই ঝোঁপটি কোনো আগুনে প্রজ্বলিত ছিল না, যা কিনা এটিকে পুড়িয়ে দাহ করতে পারে। উজ্জ্বল লাল রঙের ক্ষুদ্রাকার ফল দিয়ে এটি পূর্ণ ছিল। এবং যখন আপনি লক্ষ করবেন, মোজেস ঠিক কতটা মনোযোগী যখন কিনা সে ঝোঁপের কথা শুনছিল, যদিও আপনি শুনতে পারবেন না তাকে যা-কিছু তখন বলা হচ্ছিল, কিন্তু আপনি তার প্রতিউত্তরগুলো বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু এইসব কিছু দেখে আপনি কিন্তু বিশেষভাবে বিস্মিত নন। আপনার ছোটবোনও তার পুতুলের সাথে এভাবে প্রাণবন্তভাবে কথা বলে। আর আপনার একজন অল্পবয়সি আত্মীয় আছেন, যিনি কাল্পনিক এক বন্ধুর সাথে কথা বলেন, যে বন্ধুটি তার কাছে তার বাবা-মার মতোই বাস্তব। আপনি হয়তো শুনেছেন যে, মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা অদৃশ্য শ্রোতাদের সাথে বেশ গভীরভাবেই কথোপকথন করতে পারেন। সুতরাং আপনি সেই ধারণাটির সাথে অভ্যস্ত, কিছু মানুষ আছেন যারা অন্যের কণ্ঠস্বর শুনতে পান, যা আর কেউই শুনতে পায় না।
কিন্তু আসুন, মোজেসের কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য আমরা অন্যদিকে তাকাই এবং সেই অদৃশ্য বক্তার কথা ভাবি, যিনি তাকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। আপনার মনের সেই ভাবনাটিকে স্থির করুন, সময় ও স্থানের বাইরে একটি অদৃশ্য বাস্তবতার ধারণা, যা সরাসরি মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। সেই চিন্তাটিকে বোঝার চেষ্টা করুন, তাহলে আপনি ধর্মের কেন্দ্রীয় ধারণাটিকে উপলব্ধি করতে পারবেন। এই মহাবিশ্বে আমাদের শারীরিক সব ইন্দ্রিয়ের কাছে যা-কিছু লভ্য এবং বোধগম্য, তার বাইরে একটি শক্তি আছে এবং এটি নিজেকে উন্মোচিত করে অথবা জানান দেয় সেইসব বিশেষ মানুষগুলোর কাছে, যারা সেই বার্তাগুলো অন্যদের কাছে ঘোষণা ও প্রচার করে। আপতত আমরা এই বক্তব্যটির সাথে একমত কিংবা ভিন্নমত, কোনোটাই পোষণ করছি না। আমরা শুধু মূল ভাবনাটি খোঁজার চেষ্টা করছি। একটি অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব আছে, যাকে আমরা ঈশ্বর বা গড বলছি এবং এটি আমাদের সাথে তার সম্পর্ক ধরে রেখেছেন!’ –এটাই হচ্ছে দাবি। আমরা যখন এই ইতিহাস অনুসন্ধানে আরো অগ্রসর হব, জানব যে ভিন্ন। ভিন্ন ধর্মগুলোর প্রত্যেকটিরই সেই দাবিটির ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ আছে, এবং আমাদেরকে সেগুলো সেটি বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কোনো প্রশ্ন ছাড়াই স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছেন, হ্যাঁ, এটি সেখানে আছে। আর তাদের বিশ্বাসের রূপটি এর অস্তিত্বের প্রতি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিউত্তর।
আসুন আবার মোজেসের গল্পে ফেরা যাক, এবং এই মরুভূমির অভিজ্ঞতাটির বিবরণে তার দিকটির প্রতি মনোযোগ দিই। আপনার দৃষ্টিতে ঝোঁপটি যেমন আগুনে জ্বলন্ত ছিল না, তেমনি আপনি সেখান থেকে বের হয়ে আসা ঈশ্বরের গম্ভীর গলার স্বরও শুনতে পারেননি। কিন্তু তাহলে মোজেস কীভাবে সেখান থেকে আগুনের শিখার তাপ অনুভব করেছিলেন এবং এত গভীর মনোযোগের সাথে তাকে কিছু করতে নির্দেশ দেওয়া সেই কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন, এবং সেই নির্দেশ তিনি মান্য করছিলেন? তাহলে কি এটি শুধুমাত্র তার মস্তিষ্কের মধ্যে ঘটেছিল, যে কারণে সেখানে কী ঘটছে সেটি আপনি দেখতে পারেননি? অথবা, তার মন কি অন্য কোনো মনের সংস্পর্শে এসেছে যা আপনার ইন্দ্রিয়গুলোর বোঝার সীমানার বাইরে? যদি ধর্মের সূচনা হয়ে থাকে সাধু ও নবীদের মনের অভিজ্ঞতাগুলো দিয়ে, আপনি যদি তাদেরকে নিরপেক্ষভাবে বিচার করেন এবং কল্পনা হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বাতিল করে না দেন, তাহলে আপনাকে বিবেচনা করতে হবে কিছু মানুষ কি সেই বাস্তবতাগুলোর প্রতি বেশি উন্মুক্ত কিনা, আমরা বাকিরা যার প্রতি অন্ধ এবং বধির।
একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমাদের মন দুটি ভিন্ন স্তরে কাজ করে, যেমন, একতলা কোনো বাড়ির মতো, যেখানে নিচে একটি বেসমেন্ট অথবা সেলার থাকবে। যখন স্বপ্ন দেখি, আমরা সেই পার্থক্যটির অভিজ্ঞতা অনুভব করি। দিনের বেলায় সচেতন মন উপরতলায় জেগে আছে, এটি তার পরিকল্পিত সুশৃঙ্খল জীবন কাটায়। কিন্তু যখনই আলো নিভিয়ে ফেলা হয় আর আমরা রাতে ঘুমাতে যাই, নিচের তলার সেলারের দরজা খুলে যায়, আমাদের স্বপ্ন-দেখা মনকে এলোমেলো অসংলগ্ন নানা অপ্রকাশিত কামনা আর ভুলে যাওয়া আতঙ্ক দিয়ে পূর্ণ করে। সুতরাং যদি আমরা আপাতত সেই প্রশ্নটি একপাশে সরিয়ে রাখি, আমরা যা-কিছু চোখে দেখি তারচেয়ে আরো অন্য কোনো মহাবিশ্ব আছে কিনা, আমরা অন্তত স্বীকার করব যে আমাদের জীবনে, নিয়মিত, জেগে-থাকা সময়গুলো ছাড়াও আরো কিছু আছে। মানবমনের মাটির নিচে একটি বেসমন্টের মতো আছে যাকে বলা হয় সাবকনশাস বা অবচেতন এবং যখন আমরা ঘুমাই, এর দরজা খুলে যায় এবং সেই দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে বহু চিত্র আর কণ্ঠস্বর, যাদের আমরা স্বপ্ন বলি।
ধর্মের ইতিহাসে আমরা সেই মানুষগুলোকে খুঁজে পাব, যারা জাগ্রত অবস্থায় এ-ধরনের সাক্ষাতের মুখোমুখি হয়ে থাকেন, যা বাকি আমরা শুধু স্বপ্নেই দেখতে পাই। আমরা তাদের নবী (প্রফেট) আর স্বপ্নদ্রষ্টা বলি। কিন্তু অন্য একটি উপায় হচ্ছে, সৃজনশীল শিল্পী হিসাবে তাদেরকে ভাবা, যারা চিত্রকর্ম উপন্যাসে তাদের সেই অভিজ্ঞতাগুলো ব্যক্ত না করে বরং বাধ্য হন সেগুলোকে বার্তায় অনুবাদ করতে, যা বহু মিলিয়ন মানুষকে তারা যা-কিছু দেখেছেন আর শুনেছেন সেটি বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করেন। আর এই রহস্যময় কার্যকলাপের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটি ছিলেন মোজেস। কোনোকিছু তার সংস্পর্শে এসেছিল কোনো-না-কোনো একটি জায়গা থেকে, আর ইতিহাসে সেই সাক্ষাতের ঘটনাটি ইহুদি জনগোষ্ঠীর জীবন চিরকালের জন্যে বদলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই কিছুটা কী ছিল আর সেটি কোথা থেকে এসেছিল? এটি কি তার ভিতরে ছিল? নাকি তার বাইরে ছিল? অথবা একই সাথে কি সেটি ঘটতে পারে?
সাইনাই মরুভূমিতে মোজেসের সাথে যা ঘটেছিল, সেটিকে একটি উদাহরণ হিসাবে নিয়ে এবং সচেতন আর অবচেতন মনের মধ্যে দরজার রূপকটি আমাদের বোঝার সুবিধার্থে ব্যবহার করে, আমি একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করছি, যা ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে চিন্তা করতে তিনটি ভিন্ন উপায় উপস্থাপন করে।
এই ধরনের কোনো ঘটনায়, অবচেতন আর সচেতন মনের মধ্যবর্তী দরজাটি খুলে যায়। এরপর যা ঘটে সেটি স্বপ্নের মতো। নবীরা বিশ্বাস করতেন এটি আসছে তাদের বাইরে থেকে, কিন্তু এটি আসলে তাদের নিজেদের অবচেতন মন থেকে এসেছিল। যে কণ্ঠস্বর তারা শোনেন, সেটি সত্য। এটি তাদের সাথে কথা বলে। কিন্তু এটি তাদের নিজেদেরই কণ্ঠ, যা তাদের নিজেদের মনের মধ্যে থেকে আসছে। আর সে-কারণে আর কেউ সেটি শুনতে পারে না।
অথবা এটি হতে পারে যে, দুটি দরজা উন্মুক্ত থাকে নবীদের এই ধরনের অভিজ্ঞতায়। অবচেতন অথবা স্বপ্নরত মন হয়তো অতিপ্রাকৃত সেই জগতে প্রবেশ করে, সেই জগৎটি তার জন্যে আরো অভিগম্য হয়ে ওঠে। যদি আসলেই অন্য একটি বাস্তবতা থেকে থাকে অথবা আমাদের মনে সীমানার বাইরে আরেকটি মনের অস্তি ত্ব থাকে, আমাদের সাথে সেটির সংযোগ করার চেষ্টা করাটা খুব অসম্ভাব্য নয়। নবীদের সাথে এই ঐশী প্রকাশ বা উন্মোচনে যা ঘটে সেটি হচ্ছে, তারা সেই অন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন এবং এর মন তাদের মনের সাথে কথা বলেছে। এবং তারা বাকি পৃথিবীর সবাইকে জানিয়েছিলেন যা তাদের বলা হয়েছে।
এই ‘এক দরজা’ তত্ত্ব আর ‘দুই দরজা’ তত্ত্বের মাঝখানে একটি মধ্যবর্তী অবস্থান আছে। হ্যাঁ, মানব-অবচেতনের হয়তো দুটি দরজা থাকতে পারে। আর মানবমনের হয়তো আসলেই এমন কিছুর সাথে সাক্ষাৎ হতে পারে। কিন্তু আমরা জানি অন্য একটি মন বোঝার ক্ষেত্রে ঠিক কতটা অনির্ভরযোগ্য হতে পারে মানুষ। সুতরাং স্বর্গীয় মনের সাথে সম্মিলন নিয়ে তাদের দাবিগুলোর ব্যাপারে আমাদের আসলে সতর্ক হতে হবে। আসলেই হয়তো অবচেতন মনের দুটি দরজা থাকতে পারে। কিন্তু যে-দরজাটি অন্য একটি জগতের দিকে উন্মুক্ত হয়, সেটির পুরোপুরি ভাবে খোলার সম্ভাবনা কম, সুতরাং নবীরা দেখেছেন বা শুনেছেন বলে দাবি করে থাকেন, সে-ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না।
মরুভূমিতে মোজেসের সাথে আসলে কী ঘটেছিল এবং ধর্মের প্রতি যে তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি যা এটি প্রস্তাব করছে, সেগুলো আবা। বুঝতে আসুন আমরা আবার দরজার রূপকটা ব্যবহার করি। আপনি যদি ‘এক দরজা’ দৃষ্টিভঙ্গি নেন, মোজেসের একটি স্বপ্ন ছিল যা মিশরে তার স্বজাতির মানুষদের পরিত্রাতা হতে তাকে শক্তি দিয়েছিল এবং সংকল্পবদ্ধ করেছিল। যে গল্পটি আমরা আরো বিস্তারিত দেখব আগামী অধ্যায়ে। এই অভিজ্ঞতাটি ছিল আন্তরিক। এটি ঘটেছিল, কিন্তু পুরোপুরিভাবে এটি তার অবচেতন মন থেকে এসেছিল। ধর্মের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির ভালো একটি সমরূপ উদাহরণ এসেছে পুরনো সিনেমাহল থেকে, যা আমি শৈশবে খুব ভালোবাসতাম। সেই দিনগুলোয় চলচ্চিত্রগুলো প্রস্ফুটিত করা হতো সেলুলয়েডের ফিতার উপর। সিনেমাহলের পেছনে ব্যালকনির উপরে একটি বুথ বা কক্ষ থাকত, যেখান থেকে ছবিটি বিপরীতদিকের দেয়ালে রুপালি একটি পর্দায় প্রক্ষেপ করা হতো। আমরা যেখানে বসে থাকতাম দর্শক হিসাবে, সেখান থেকে আমরা শুধুমাত্র আমাদের সামনের দিকটা দেখতাম, কিন্তু এটি আসলে আসছে আমাদের পেছনের একটি যন্ত্র থেকে। ধর্ম নিয়ে ভাবার একটি উপায় হচ্ছে, এটি জীবনের রুপালি পর্দার উপর অবচেতন মনের ভয় আর কামনাগুলোর একটি প্রক্ষেপণ। মনে হতে পারে যে, ধর্মের উপস্থিতি আছে আমাদের বাইরে এবং এর একটি নিজস্ব জীবন আছে। কিন্তু আসলে এটি আসছে সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিজেদের কল্পনার গভীর থেকে। এটি সম্পূর্ণভাবে মানুষেরই একটি উৎপাদন।
আপনি এখানে থামতে পারেন, এবং এখানে সেটি বাতিল করতে পারেন অথবা অধিকাংশ বিবরণ মেনে নিয়ে এবং দ্বিতীয় দরজার ধারণায় প্রবেশ করতে পারেন। ধর্মীয় অভিজ্ঞতার মানবিক দিকটি খুঁটিনাটি বিষয় পরিবর্তন না করেই, বিশ্বাস করা সম্ভব যে, এটিও ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে। আমরা সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পারি না যা মোজেস শুনতে পাচ্ছেন, এর কারণ হচ্ছে এটি সেই ঘটনা যেখানে ঈশ্বরের মন সরাসরি মোজেসের মনের সাথে সংযোগ করছে। আমাদের কাছে যা অদৃশ্য আর শ্রবণের সীমানার বাইরে, এটি ছিল আরেকটি বাস্তবতার সাথে সত্যিকারের একটি সাক্ষাৎকার। আমরা পুরোপুরিভাবে সেই ঘটনাটিকে বুঝতে পারি না, কিন্তু আমরা এর পরিণতিগুলো দেখেছি।
দ্বিতীয় দরজার ধারণাটিকে আরেকটি ভিন্ন রূপ দেওয়া যেতে পারে সেই বিষয়টি মনে রেখে যে, প্রতিদিন অন্যদের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় মানুষ প্রায়শই কত সহজে ভুল-বোঝাবুঝির স্বীকার হয়। ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাতের যে দাবিগুলো তারা করছেন, সেই সম্বন্ধে বিচার করার সময় তাদের সতর্ক হওয়া উচিত হবে এবং সংশয় আর পরিমিত সংযমের সাথেই তাদের বিবেচনা করা উচিত। এর মানে হচ্ছে ধর্মীয় দাবিগুলোর ব্যাপারে আমাদের সতর্ক পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করা উচিত, শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব আত্মবিশ্লেষণের ভিত্তিতে সেটি গ্রহণ করা উচিত নয়।
সুতরাং আপনি একজন অবিশ্বাসী, একজন সত্যিকার বিশ্বাসী অথবা সচেতন সমালোচনামূলক বিশ্বাসী হতে পারেন। যখন আপনি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাববেন হয়তো আবিষ্কার করবেন সময়ের সাথে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে আপনি জায়গা বদল করেছেন, যেমন অনেকেই করেন। এই বইতে যে গল্পগুলো আপনি পড়বেন সেগুলো ব্যাখ্যা করার সেরা উপায় কোটি, সেই বিষয়ে নিজের মনস্থির করার দায়িত্ব আমি আপনার ওপরেই ছেড়ে দেব, অথবা এই বিষয়টি অনির্ধারিত রাখুন যতক্ষণ-না শেষ পৃষ্ঠা অবধি পড়ছেন। আর এমনকি কোনো সিদ্ধান্ত না নেবারও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, একটি অবস্থান, যা পরিচিত ‘অ্যাগনস্টিসিজম’ বা অজ্ঞেয়বাদ নামে, এর উৎস একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘যা জানা সম্ভব নয়’ বা অজ্ঞেয়।
আপাতত আমরা ধর্মকে নিয়ে ভেবেছি সাধারণ একটি অর্থে। এবার সুনির্দিষ্টভাবে একক ধর্মগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করা হবে, সেটি বেশ কৌতূহলী একটি প্রশ্ন। যেমন, চামাদের কোন্ ক্রম অনুসরণ করা উচিত হবে? বিজ্ঞান বা দর্শনের ইতিহাসের ব্যতিক্রম, ধর্মের ব্যাপারে কঠোর সময়ানুক্রমিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেনা। ভিন্ন ভিন্ন জিনিস একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় একই সময়ে ঘটেছিল, সুতরাং আমরা কোনো নিরবচ্ছিন্ন। ক্রমবিকাশের ইতিহাস অনুসরণ করতে পারব না। আমাদের সময়ের ক্ষেত্রে এবং ভৌগোলিকভাবে আঁকাবাঁকা পথই বেছে নিতে হবে।
এই পদ্ধতির একটি সুবিধা হচ্ছে এটি আমাদের প্রদর্শন করে যে, একেবারে শুরু থেকে মানবতার বড় প্রশ্নগুলোর যে-সমস্ত উত্তর বিভিন্ন ধর্ম দিয়েছে, সেগুলো আসলেই কত বিচিত্র ছিল। প্রশ্ন হয়তো একই হতে পারে, ‘কেউ কি আমাদের উপরে আছেন?’ আর, ‘মৃত্যুর পর কী হয় আমাদের সাথে’? কিন্তু উত্তরগুলো পরস্পর থেকে খুবই ভিন্ন ছিল। আর সে-কারণে ধর্মের ইতিহাস এত বিস্ময়কর আর আকর্ষণীয়।
সৌভাগ্য যে, আমাদের যাত্রাপথের একটি সুস্পষ্ট সূচনাবিন্দু আছে। জীবন্ত সব ধর্মগুলোর মধ্যে এটি অবশ্যই সবচেয়ে প্রাচীনতম ধর্ম এবং বহুভাবেই বর্তমানে জীবিত কোনো ধর্মের চেয়ে অনেক বেশি জটিল — হিন্দুধর্ম। সুতরাং আমরা ভারত থেকেই শুরু করব।