০২. দবির মিয়া নীলগঞ্জের বাজারে

দবির মিয়া নীলগঞ্জের বাজারে দশ মণ ডাল কিনতে গিয়েছিল। ডাল কেনার কথা ছিল পনের মণ। কিন্তু টাকার যোগাড় হয় নি। টাকাটা দেবার কথা তার শ্বশুরের। শেষ মুহূর্তে তিনি খবর পাঠিয়েছেন-এখন কিছুই দিতে পারবেন না, হাত টান। বৈশাখ মাসের দিকে চেষ্টা করবেন। বৈশাখ মাসে টাকা দিয়ে সে কী করবে? দবির মিয়া ডালের আড়তে ঘুরতে ঘুরতে তার শ্বশুরকে কুৎসিত একটা গাল দিল। এই লোকের ওপর ভরসা করাটা মস্ত বোকামি হয়েছে। শালা মহা হারামী।

দবির মিয়া মুখ কালো করে ডালের বাজারে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। দুই দিনে বাজার চড়ে গেছে। সরসটা হয়েছে দু শ পঁচিশ। এত দাম দিয়ে ডাল কিনে রাখলে কয় পয়সা আর থাকবে? ডালের পাইকারও বেশি আসে নি। সেতাবগঞ্জের কোনো বেপারী নেই। সেখানে কত করে বিক্রি হচ্ছে কে জানে?

সে বিষণ্ণ মুখে এক চায়ের স্টলে ঢুকে পরপর দু কাপ চা খেয়ে ফেলল। পঞ্চাশ পয়সা করে কাপ। কোনো মানে আছে? কী আছে এর মধ্যে যে পঞ্চাশ পয়সা দাম হবে? তার মেজাজ ক্রমেই উষ্ণ হতে লাগল। এই অবস্থায় সে খবর পেল জহুর ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছে। খবরটা প্ৰথমে সে বিশ্বাস করতে পারল না। জহুরের মেয়াদ হয়েছেন বছরের। এখনোছ বছরও হয় নি। জেল ভেঙে পালিয়েছে নাকি? দবির মিয়া তৃতীয় কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরাল।

এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার, কিন্তু পরের হাটে দাম আরো চড়বে। এই বছর ডালের ফলন কম হয়েছে। কিনতে হলে এখনই কিনে ফেলা উচিত। সেতাবগঞ্জের খবরটা তার আগে জানা দরকার।

দবির মিয়া শেষ পর্যন্ত দু শ উনিশ টাকা দরে ন মণ ডাল কিনল। আগামীকাল ডালের বেপারী বস্তাগুলো পৌছে দেবে।

বাড়ি ফিরতে তার অনেক রাত হল। আজ সকাল সকাল ফেরা দরকার ছিল অথচ আজই দেরি হল। জুমাঘর পার হতেই দবির মিয়া দেখল সমস্ত অঞ্চলটা অন্ধকার। ঝড় নেই, বাদল নেই অথচ কারেন্ট চলে গেছে। এর মানে কী? সেই যদি রোজ হারিকেনই জ্বালাতে হয় তাহলে টাকাপয়সা খরচ করে লাইন আনার মানে কি? এই সব ফাজলামি না?

দবির মিয়ার বাড়ির সামনের বারান্দায় জহুর বসে ছিল। তার সামনের মোড়াতে যে বসে আছে সে খুব সম্ভব অ–অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না। দবির মিয়া বলল, কে? অঞ্জু উঠে ভেতরে চলে গেল। জহুর অস্পষ্টভাবে বলল, দুলাভাই, ভালো আছেন?

এ্যাঁ, কে?

আমি, আমি জহুর।

আরে জহুর তুমি, তুমি কোত্থেকে?

দবির মিয়া এমন ভঙ্গি করল যেন জহুর আসার খবর সে আগে পায় নি।

এ্যাঁ, কী সর্বনাশ, আমি তো কিছুই জানি না। থাক থাক, সালাম করতে হবে না। টুনী, এই টুনী, ঘর অন্ধকার–বিষয় কি? কারেন্ট নেই নাকি? এ্যা।

দবির মিয়া অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

চা-টা কিছু দিয়েছে? টুনী, এই টুনী। এরা কোন কাজের না। একটা বাতিটাতি তো দিতে পারে। হাত-মুখ ধুয়েছ জহুর?

জ্বি-না।

কোনো খোঁজখবর করে নাই। অপদার্থের গুষ্টি। যাও, গোসল করে ফেল। অল্প পানি দিয়ে গোসল করবে। টিউবওয়েলের পানি ঠাণ্ডা, ফস করে সর্দি লেগে যাবে। হা-হা-হা।

দবির মিয়া হাসিটা মাঝপথে গিলে ফেলল। টিউবওয়েলের পানি ঠাণ্ডা, এর মধ্যে হাসির কিছু নেই। খামাকা হাসছে কেন সে?

জহুর বলল, আপনারা সবাই ভালো ছিলেন তো?

আর ভালো থাকাথাকি। বলবসব। তুমি গোসল-টোসল সার–আমি বালতি–গামছা আনি। আগে বরং চা খাও।

চা খেয়েছি আমি।

আরেক কাপ খাও। চায়ে না নাই।

দবির মিয়া আবার হাসি গিলে ফেলল। হয়েছেটা কি তার? কথায় কথায় হেসে উঠছে কেন? টুনী হারিকেন হাতে ঢুকল। দবির মিয়া ধমকে উঠল, অন্ধকারে বসিয়ে রেখেছিস মামাকে, বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু আছে মাথায়?

টুনী মৃদুস্বরে বলল, একটা মাত্র হারিকেন। ছোট মা আবার ফিট হয়েছেন।

কুপি জ্বাললেই হয়। অন্ধকারে বসে থাকবে নাকি?

জহুর বলল, কোনো অসুবিধা হয় নাই দুলাভাই।

বললেই হল অসুবিধা হয় নাই। এদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই। সব কয়টা গরু।

দবির মিয়া ঘরে ঢুকে গেল। অনুফা এই গরমের মধ্যেও লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। তার চুল ভেজা। অর্থাৎ মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। যন্ত্রণা আর কাকে বলে। বার মাসের মধ্যে ন মাস বিছানায় পড়ে থাকলে সংসার চলে। দ্বিতীয় বার বিয়ে করাটা চরম বোকামি হয়েছে। অনুফা ক্ষীণ স্বরে বলল, বাজার এনেছ?

হুঁ।

মাছ-টাছ আছে?

আছে।

টুনীর কাছে দাও। তাড়াতাড়ি রান্না শুরু করুক।

দবির মিয়া বাজারের ব্যাগ টুনীর হাতে দিয়ে দিল।

আইড় মাছ আছে। কয়েক টুকা ভাজি করিস টুনী।

অনুফা ক্ষীণ স্বরে বলল, আইড় মাছের ভাজি হয় না।

দবির মিয়া ফোঁস করে উঠল, হবে না আবার কি, হওয়ালেই হয়। যত ফালতু কথা।

বাবলু আর বাহাদুর নিঃশব্দে একটা স্কেল নিয়ে টানাটানি করছিল। দবির মিয়া দুজনের কানে ধরে প্রচণ্ড শব্দে মাথা ঠুকে দিল। দু জনের কেউ টু শব্দ করল না। অঞ্জু মশারি খাটাচ্ছিল, দবির মিয়া তার গালেও একটা চড় কষাল।

পড়াশোনা নাই?

অন্ধকারে পড়ব কীভাবে?

আবার মুখে-মুখে কথা?

দবির মিয়া দ্বিতীয় একটি চড় কল। অনুফা মাথা উচু করে বলল, এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়।

তুই চুপ থাক।

তুইতোকারি করছ কেন?

বললাম চুপ।

অঞ্জুর গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে। সে এমনভাবে মশারি খাটাচ্ছে যেন কিছুই হয় নি। টুনী ভয়ে-ভয়ে বলল, মাছটা মনে হয় একটু নরম।

দবির মিয়ার মুখ তেতো হয়ে গেল। দেখেশুনে কেনা হয় নি। দেখেশুনে না কিনলে এই হয়। ঈমান বলে কোন জিনিস মাছওয়ালার মধ্যে নেই। অনুফা ক্লান্ত গলায় বলল, কয়েকটা লেবুর পাতা দিস তরকারিতে।

 

মামা, আপনার গোসলের পানি দিয়েছি।

জহুর দেখল এই মেয়েটি ঘুরেফিরে তার কাছে আসছে। কথা-টথা বলতে চেষ্টা করছে। অন্যরা সবাই দূরে-দূরে। এই মেয়েটির খুব কৌতূহল।

মামা, আমি কল টিপছি, আপনি পানি ঢালেন।

কল টিপতে হবে না। তুই যা।

অঞ্জু মামার কথায় কান দিল না।

তুই কোন ক্লাসে পড়িস?

ক্লাস নাইন, সায়েন্স গ্রুপ।

আর টুনী?

বড়োপা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। ম্যাট্রিক পাশ করতে পারে নাই। তাই বাবা বলল–আর পড়তে হবে না।

ও।

বড়আপার বিয়ের চেষ্টা হচ্ছে।

ও।

আগামী সোমবার দেখতে আসবে।

তাই নাকি?

জ্বি, বড়োআপার ইচ্ছা নাই বিয়ের।

ইচ্ছা নাই কেন?

কী জানি কেন। আমাকে কিছু বলে না। না বললে কি আর জানা যায় মামা?

জহুর জবাব দিল না। টিউবওয়েলের পানি সত্যি সত্যি ভীষণ ঠাণ্ডা। শরীর কাঁপছে। অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, মামা, তুমি এখন কী করবে?

কিছু ঠিক করি নাই।

তোমার কথা কিন্তু মামা আমার মনে ছিল। তুমি একটা গান গাইতে,–মাটিমে পৌরণ মাটিমে শ্রাবণ।

জহুর সারা মুখে সাবান মাখতে মাখতে হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল।

অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, তোমার মনে নাই, না?

না। কিছু মনে নাই।

আমার কথাও মনে নাই?

নাহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *