তোমার চিঠি পেলাম। তুমি যে এত তাড়াতাড়ি আমার চিঠির জবাব দেবে, তা ভাবতে পারিনি। মনে হয়, তুমি আমার চিঠি পড়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছ এবং সেজন্য আমার চিঠি পাবার পরদিনই জবাব দিয়েছ। তুমি যে আমাকে কত ভালোবাস, তা তোমার চিঠি পড়তে পড়তে বার বার উপলব্ধি করেছি। তোমাকে ভালোবেসে আমি যে ভুল করিনি, তা আরেকবার বুঝতে পারলাম।
তোমার চিঠিটা অনেকবার পড়েছি। পড়তে পড়তে আমার প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। তারপর অনেক ভেবেছি। দুতিন দিন শুধু তোমার কথাই ভেবেছি। মনে মনে বিচার করেছি তোমার পরামর্শ। হয়তো পুরনো দিনের দুঃখের স্মৃতি রোমন্থন করার কোনো সার্থকতা নেই, কিন্তু ভাই, অতীতকে তো একেবারে মুছে ফেলা যায় না। তাছাড়া অতীতের ওপরই তো বর্তমান গড়ে উঠেছে। আবার আজকের এই বর্তমানের ভিতর থেকেই জন্ম নেবে ভবিষ্যত। সুতরাং অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত অবিচ্ছিন্ন।
বাইরের কাজকর্ম বা আচারে-ব্যবহারে আমরা অনেক সময় এই অবিচ্ছিন্নতার ধারাকে স্বীকৃতি দিই না। দিতে চাই না; হয়তো দিতে পারি না। কিন্তু মন? তাকে তো ফাঁকি দেওয়া যায় না। আমি তোমাকে সেই মনের কথাই বলব। আজ অনেক বছর ধরে নিজের মনের সঙ্গে নিজেই লুকোচুরি খেলছি। খেলতে খেলতে অনেকদিন আগেই হাঁপিয়ে গেছি কিন্তু এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য মানুষ পাইনি, যার কাছে ধরা দিতে পারি। তোমর কাছে আমি ধরা দেবই। দিতেই হবে। না দিয়ে আর যেন নিশ্বাস নিতে পারছি না। তোমার কাছে ধরা না দিলে আমি বোধহয় আর বাচব না।
অন্য কেউ জানে না কিন্তু আজ আমি তোমার কাছে স্বীকার করছি, মনের মধ্যে দ্বন্দের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আমি দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করি। দুবারই অদ্ভুতভাবে বেঁচে গেছি। সেবার লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক আসার সময় বিষ নিয়ে প্লেনের টয়লেটে ঢুকেছিলাম। বিষ খাবার আগে কি যেন ভাবছিলাম। নানা চিন্তায় টয়লেটের দরজা লক করতে ভুলে যাই। কিছুক্ষণ পরে একজন মহিলা যাত্রী হঠাৎ দরজা খুলে টয়লেটে ঢুকতেই আমি চমকে উঠি এবং কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসি।
.
এই পৃথিবীতে একলা থাকার অনেক আনন্দ, অনেক সুবিধা, কিন্তু দুঃখও কম নয়। নিঃসঙ্গ মানুষ কোনো আনন্দই পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে পারে না ঠিকই, কিন্তু একা একা দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা সবারই সীমিত। কোনো আদর্শ বা কোনো প্রিয়পাত্রের জন্য অনেক দুঃখ সহ্য করা যায়, কিন্তু নিজের জন্য তার একাংশও অসহ্য। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জ্বালা কম নয়। তাইতো আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, একার জন্য কেন এই জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করি? যে মানুষ চির বিদায় নিলেও এই পৃথিবীর কোনো মানুষের চোখের জল পড়বে না, তখন তার বেঁচে থাকার কি সার্থকতা?
এইসব আলতু ফালতু হাজার রকমের চিন্তা করতে করতে আবার একদিন ঠিক করলাম, না, আর নয়। এবার এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়াই ভালো।
ভালো বা মন্দ, কোনো বিষয়েই উৎসাহ বা বাধা দেবার মতো কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষ আমার নেই। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেবার পর আর দেরি করলাম না কিন্তু সেবারও পারলাম না। প্রায় অন্তিম মুহূর্তে ওয়াশিংটন থেকে সুদীপ্ত আর মহুয়া তুতুলকে নিয়ে হাজির। ওয়াশিংটনে ওদের সঙ্গে কি তোমার আলাপ হয়েছে? বোধহয় হয়নি; মনে হয় ওদের সঙ্গে আলাপ হলে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে বলতে।
আমি নিউইয়র্কে আসার বছর দুই আগেই সুদীপ্ত এদেশে এসেছে। কিন্তু মাত্র বছর পাঁচেক আগে এক বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে ওর সঙ্গে আমার আলাপ।
ঘরে ঢুকেই দেখি সুদীপ্ত অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আমার বন্ধু মায়াকে বলছে, দেখ ছোড়দি, এই সংসারে সমস্ত স্নেহ ভালোবাসায় সঙ্গেই কোনো না কোনো স্বার্থ জড়িয়ে আছে। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এ সংসারে দুর্লভ।
মায়া ওকে বকুনি দিয়ে বলল, দেখ খোকন, তুই বড্ড সিনিক হয়ে গেছিস। স্নেহ-ভালোবাসা না থাকলে সমাজ সংসার চলছে কি ভাবে?
সুদীপ্ত হেসে বলল, কেন চলবে না? পারস্পরিক স্বার্থে আমরা সবাই জড়িয়ে পড়েছি। বলেই সমাজ সংসার গড় গড় করে এগিয়ে চলছে।
মায়ার স্বামী ডক্টর সরকার এবার হাসতে হাসতে ওর স্ত্রীকে বললেন, তোমরা কি এবার চুপ করবে নাকি আমি আমার বান্ধবীকে নিয়ে দু-এক ঘণ্টার জন্য ব্যাটারি পার্ক ঘুরে আসব?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আপনার মতো স্ত্রৈণ পুরুষের সঙ্গে ব্যাটারি পার্ক তো দূরের কথা, হাওয়াই আইল্যান্ডে যেতেও আমি ইন্টারেস্টেড নই।
মায়া একটু গম্ভীর হয়েই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক বলেছিস। বিয়ের আগে জানলে আমিই এ বিয়েতে আপত্তি করতাম।
ডক্টর সরকার স্বল্পভাষী। আত্মকেন্দ্রিক। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেও একখানা বই নিয়ে সারা সন্ধে কাটিয়ে দেন। তবে রসিক লোক। বললেন, দেখুন মিস চৌধুরী, আর্টিফিসিয়্যাল জুয়েলারি ব্যবহার করে করে আসল সোনার গহনা আর আপনাদের ভালো লাগে না।
আমরা কিছু বলার আগেই সুদীপ্ত বলল, ঠিক বলেছেন কমলদা।
মায়া কৃষ্ণনগরের মেয়ে। সুদীপ্তদের বাড়িও ওখানেই। সুদীপ্তর ছোড়দি আর মায়া স্কুলে একসঙ্গে পড়ত। সেই সূত্রেই এ বাড়িতে সুদীপ্তর যাতায়াত। সেদিন থেকেই যাতায়াত।
সেদিন থেকেই সুদীপ্তকে আমার বেশ লাগে। আশে পাশে যাদের দেখি, তাদের থেকে ও একটু স্বতন্ত্র। হঠাৎ ওর কথাবার্তা শুনলে মনে হবে ও যেন এই পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যই এই পৃথিবীতে এসেছে। সব মানুষের বিরুদ্ধেই যেন ওর অভিযোগ। বাবা-মা, ভাই-বোন। কাউকেই ও ভালোবাসে না অথচ ওদের প্রতি কর্তব্যে ত্রুটি নেই। প্রতি মাসে ফার্স্ট ন্যাশনাল সিটি ব্যাঙ্ক মারফত দেশে টাকা পাঠাবেই।
পৃথিবীর বিরুদ্ধে সুদীপ্তর অভিযোগের কারণ আছে। রেলের স্টেশন মাস্টারের ঘরে জন্মেছে। শৈশব বা কৈশোরে দারিদ্রের সঙ্গে পরিচয় হবার কোনো সুযোগ হয়নি কিন্তু যৌবনের সিংহদ্বার পেরুতে না পেরুতেই ওর বাবা রিটায়ার করলেন। এক নিমেষে সুখের সংসার কোথায় ভেসে গেল। দারিদ্রের হাহাকার উঠল চারদিক থেকে। সুদীপ্ত জানল, তার বাবার অসৎ আয়ের দৌলতেই তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি মধুময় হয়েছিল। কি একটা বিচ্ছিরি বিস্বাদে ওর সারা মন ভরে গেল।
.
আমার অ্যাপার্টমেন্টে দু-একদিন আসা যাওয়ার পর সুদীপ্ত একদিন কথায় কথায় বলল, দেখ কবিতাদি, একটা চরম সত্য আমি মর্মে মর্মে বুঝেছি।
কী সেই চরম সত্য?
এই পৃথিবীতে টাকা ছড়াতে পারলে সবার ভালোবাসা পাওয়া যায় আর না ছড়াতে পারলে বাবা-মার স্নেহও পাওয়া যায় না।
আমি আর প্রশ্ন করি না। একটু হাসি।
না, না, কবিতাদি, হাসির কথা নয়, আমি আমার বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে দেখেছি বলেই বলছি।
আমি কোনো মন্তব্য করি না, শুধু শুনি।
সুদীপ্ত একটু উত্তেজিত হয়েই বলল, আমার বাবার অসৎ উপায়ের টাকা উপভোগ করতে মার ভালো লাগত কিন্তু বাবার দুঃখের দিনে মার ব্যবহার দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। আমার দাদা আর দুই দিদির কীর্তি শুনলে স্তম্ভিত হয়ে যাবে।
.
বিচিত্র ছেলে এই সুদীপ্ত! বাবা-মা ভাই-বোনের উপর রাগ করে এ দেশে আসার চার বছর পর কলম্বিয়া থেকে ডক্টরেট হয়। তারপর বছর দুই কানাডায় চাকরি করার পর হঠাৎ একদিন মায়ার কাছে হাজির হয়ে বলল, ছোড়দি, এখানে আর একা একা থাকতে পারছি না। তুমি আমার বিয়ে দাও।
মায়া জিজ্ঞাসা করল, বিয়ে দাও মানে? মেয়ে পছন্দ করেছিস?
মেয়ে পছন্দ হয়ে গেলে তোমার কাছে আসব কেন?
মায়া প্রতিশ্রুতি দিল, সামনের জুনে দেশে ফিরে গিয়েই বিয়ের ব্যবস্থা করছি।
মায়া না থাকায় সুদীপ্ত মহুয়াকে নিয়ে আমার কাছেই প্রথম উঠেছিল। ওরা দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসে। সময় পেলেই ওয়াশিংটন থেকে চলে আসে। আমাকেও যেতে হয়। আগে বিশেষ না গেলেও তুতুল হবার পর থেকে বেশিদিন ওকে না দেখে থাকতে পারি না। তুমি তো জান, এখানে অনেক কিছু পাওয়া যায় কিন্তু ছোট্ট সংসারের নিবিড় শান্তি এখানে প্রায় স্বপ্ন। ওদের ওই তিনটি প্রাণীর ছোট্ট সংসারে গেলে আমি যেন আমার সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাই।
সেদিন আমি নিশ্চয়ই একটু অস্বাভাবিক ছিলাম। মহুয়া সন্দেহ করেছিল আমার শরীর ঠিক নেই কিন্তু সুদীপ্ত আমার অস্বাভাবিক মনের অবস্থা ঠিকই ধরতে পেরেছিল। মহুয়াকে কিছু বুঝতে দিয়ে ও আমাকে বলল, কবিতাদি, মহুয়া আর তুতুল তোমার কাছে সপ্তাহখানেক থাকবে।
ওরা এখানে থাকলে তোর অসুবিধা হবে না?
আমার আবার কি অসুবিধে? অফিস থেকে ফিরে এসে দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে দু-এক রাউন্ড ড্রিঙ্ক করতে না করতেই সন্ধেটা বেশ কেটে যাবে।
সুদীপ্তর কথা শুনে মহুয়া আর তুতুল খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর তুতুল দুহাত দিয়ে আমার মখখানা ধরে বলল, তুমি এত গম্ভীর কেন পিসিমণি? আমার ওপর রাগ করেছ?
আমি ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললাম, আমি কি তোমার ওপর রাগ করতে পারি?
রাগ না করলে কেউ এত গম্ভীর হয়?
আমি ওর মুখের উপর মুখ রেখে বললাম, না বাবা, আমি আর গম্ভীর হব না।
.
জানো ভাই, সেদিন সেই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করলাম, আত্মহত্যা করে এই পৃথিবী থেকে পালিয়ে যাব না। আর কারুর জন্যে না হোক এই ছোট্ট অবোধ শিশুটির ভালোবাসার জন্য আমাকে বাঁচতেই হবে।
এখন তো ওসব কল্পনার বাইরে। এখন আমার জীবনের ভালো-মন্দর সঙ্গে তুমি এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছ যে তোমাকে দুঃখ দিয়ে আমি মৃত্যুর পরও শান্তি পাব না। তাছাড়া তুমিও তো একা না। তোমার জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আরও একটি মেয়ের স্বপ্ন ও সাধনা জড়িয়ে আছে। তার স্বপ্ন ভেঙে দেবার অধিকার বা সাহস আমার নেই।
আমার মনের মধ্যে অনেক তিক্ততা, অনেক দুঃখ, বেদনার ইতিহাস, অনেক ব্যর্থতার গ্লানি চাপা থাকলেও এই পৃথিবীকে আমার নতুন করে ভালো লাগছে। বুঝতে পারছি, এই পৃথিবীর সব মানুষের মন এখনও বিষাক্ত হয়নি; ঔদার্য ও ভালোবাসার অমৃতধারা ক্ষীণ হয়ে এলেও সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায়নি।
ভাই রিপোর্টার, যে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার জন্য একদিন পাগল হয়ে উঠেছিলাম, তোমার জন্য সেই পৃথিবীকে আমার আবার ভালো লাগছে। আমি বাঁচতে চাই, আমি ভালোবাসা চাই, আমি ভালোবাসতে চাই। তাইতো পুরনো দিনের সব ইতিহাস তোমাকে জানিয়ে আমি গ্লানিমুক্ত হতে চাই। একদিন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য সমুদ্র মন্থনে উখিত সমস্ত বিষ ধারণ করে মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন আর তুমি তোমার দিদির জন্য সামান্য এইটুকু বোঝা বহন করতে পারবে না?
তোমার সুখ ও সাফল্যের জন্য যে কালো মেয়েটি তার জীবনের সবকিছু পণ করেছে, তার একটা ছবি আমাকে পাঠাবে।
তোমরা দুজনে আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।