০২. তিরিশ লক্ষ টাকার উত্তেজনা

০২.

তিরিশ লক্ষ টাকার উত্তেজনা কমতে অন্তত তিরিশ দিন লাগার কথা ছিল, কিন্তু ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত সপ্তাহখানেকের মাঝে নিজেদের সামলে নিলেন। পরের শনিবারের মাঝে তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতে লাগল লটারি জেতা বুঝি নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। পরিচিত মানুষজন অবিশ্যি ব্যাপারটা এত সহজে নিতে পারল না, বেশির ভাগই হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। আবার অনেকে যারা আগে কোনোদিন ফরাসত আলি আর ফারুখ বখতকে মানুষ হিসেবে গণ্য করেনি হঠাৎ করে তারা ফরাভাই এবং ফারুভাই বলতে অজ্ঞান হয়ে যেতে শুরু করল। ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত একদিন তাঁদের এই পরিচিত মানুষজনকে লুকিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসলেন টাকাটা কীভাবে খরচ করা যায় সেটা ভেবেচিন্তে বের করতে। তাদের সামনে দুই কাপ চা, একটা সোলার পাওয়ার ক্যালকুলেটর, এক রিম কাগজ আর দুইটা বলপয়েন্ট কলম। ফরাসত আলি গোলাপি রঙের একটা চিরুনি দিয়ে তাঁর দাড়ি পাট করতে করতে চিন্তা করতে লাগলেন, যে-দাড়ি কামানোর জন্যে রেজর কিনতে গিয়ে তিনি এতগুলি টাকা পেয়ে গেছেন হঠাৎ করে তাঁর সেই দাড়ির জন্যে একটু মায়া পড়ে গেছে, দিনরাত সেটা কুটকুট করলেও তিনি আর সেটা কেটে ফেলছেন না। খানিকক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ করে বললেন, “আমার বড় রেলগাড়ির শখ। একটা রেলগাড়ি কিনলে কেমন হয়?”

ফারুখ বখত চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেয়ে বললেন, “রেলগাড়ি?”

“হ্যাঁ, মনে কর পার্সোনাল একটা রেললাইন বসানো হল, তার মাঝে একটা ট্রেন। বেশি বড় দরকার নেই, ছোটখাটো একটা ট্রেন। যাবে আর আসবে।”

ফারুক বখত ক্যালকুলেটরে খানিকক্ষণ হিসাব করে বললেন, “তোর যদি সত্যি ট্রেন ভালো লাগে তা হলে তিরিশ লাখ টাকার ট্রেনের টিকেট কিনে টানা কুড়ি বছর ট্রেনে চড়তে পারবি। খামোখা ট্রেন কিনে কী করবি? আর ট্রেন কি কোরবানির খাসি নাকি যে গাবতলি বাজার থেকে কিনে আনবি?”

ধমক খেয়ে ফরাসত আলি একটু দুর্বল হয়ে মিনমিন করে বললেন, “তা হলে একটা হেলিকপ্টার? হেলিকপ্টারের আমার অনেকদিনের শখ, কী সুন্দর আকাশে ওড়ে!”

ফারুখ বখত ভুরু কুঁচকে বললেন, “হেলিকপ্টার?”

ফরাসত আলি মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, তা হলে সেটা মানুষের কাজেও ব্যবহার করা যাবে। মনে কর কোনো গ্রামে কারও অসুখ হল, তাকে হাসপাতালে নিতে হবে, সাথে সাথে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে

“সেটাই যদি করতে চাস, তা হলে সোজাসুজি একটা হাসপাতাল তৈরি করতে দোষ কি?”

হাসপাতাল’ ফরাসত আলি কেমন যেন একটু ভয় পেয়ে গেলেন, আমতা আমতা করে বললেন, “হাসপাতাল আমার কেমন জানি ভয় ভয় করে। ওষুধ আর ফিনাইলের কী বোটকা গন্ধ! চারিদিকে রাগী-রাগী চেহারার ডাক্তার, তার মাঝে এখানে-সেখানে পা-ভাঙা মাথা-ভাঙা মানুষ চিৎকার করছে!” ফরাসত আলি একটু শিউরে উঠে বললেন, “হাসপাতাল থেকে শিশুপার্ক ভালো! ছোট বাচ্চারা খেলবে, দেখতেও ভালো লাগবে।”

ফারুখ বখত মাথা নাড়লেন, “আইডিয়াটা খারাপ না, তিরিশ লাখ টাকা দিয়ে মনে হয় ভালো একটা শিশুপার্ক তৈরি করা যাবে। একটা-দুইটা রোলার কোস্টার, বড় দেখে একটা নাগর দোলা, কয়েকটা মেরি-গো-রাউন্ড”

ফরাসত আলি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “কিন্তু বাচ্চাদের বাবা মায়েরা ধরে আমাদের মার লাগাবে না তো? এমনিতেই ছেলেপিলেরা পড়াশোনা

করে না, এখন তার উপর যদি তাদের খেলাধুলার জন্যে লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফেলি-আর কি কখনো বই নিয়ে বসবে?”

ফারুখ বখত হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, “ঠিক বলেছিস!”

“পড়াশোনা।”

“কী পড়াশোনা?”

“বাচ্চাদের পড়াশোনা। শিশুপার্ক তৈরি না করে তৈরি করতে হবে স্কুল।”

“স্কুল?”

“হ্যাঁ, আজেবাজে স্কুল না, একেবারে একনম্বর স্কুল। খেলতে খেলতে বাচ্চারা পড়বে–কিছু বোঝার আগে একেকজন শিখে যাবে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ক্যালকুলাস” ফারুখ বখত উৎসাহে হাতে একটা কিল দিলেন।

ফরাসত আলি ভয়ে ভয়ে বললেন, “বাচ্চাদের পড়াবে কে?”

“তুই পড়াবি আমি পড়াব। বেছেবেছে সারাদেশ খুঁজে মাস্টার নিয়ে আসব আমরা। বইপত্র দেখে একেবারে আধুনিক পদ্ধতিতে পড়াশোনা। হাসতে হাসতে পড়াশোনা। খেলতে খেলতে পড়াশোনা!” ফারুখ বখত উৎসাহে দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁটতে শুরু করেন।

ফরাসত আলি মাথা চুলকে বললেন, “বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা আমাদের স্কুলে দেবে তাদের বাচ্চাদের?”

“কেন দেবে না? একশোবার দেবে! কোথায় পাবে এরকম স্কুল? ক্লাস ওয়ানে আমরা শেখাব ক্যালকুলাস। ক্লাস টুতে ফিজিক্স কেমেস্ট্রি। ক্লাস থ্রি থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। ক্লাস ফোরে ইলেক্ট্রনিক্স, বিপ্লব শুরু করে দেব আমরা। সবার চোখ খুলে যাবে একেবারে। আমাদের দেখাদেখি সবাই শুরু করবে–দেশের চেহারা পালটে যাবে দেখতে দেখতে–”

ফরাসত আলি কোন কথা না বলে তার দাড়ি এবং চুল চুলকাতে লাগলেন। ফারুখ বখত বললেন, “তুই কোন কথা বলছিস না কেন? পছন্দ হয়নি আইডিয়াটা?”

ফরাসত আলি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন, “হয়েছে হয়েছে। পছন্দ হয়েছে।”

“পছন্দ না হলে এখনই বল। এটা তো আর কাপড়ের দোকান তৈরি করছি, তৈরি করছি স্কুল, যেখানে বাচ্চাদের মন নিয়ে কাজ করা হবে। হেলাখেলা করার কোনো ব্যাপারই না।”

ফরাসত আলি মাথা নেড়ে বললেন, “আমি হেলাখেলা করছি না, মোটেও হেলাখেলা করছি না।”

“ভেরি গুড! স্কুলের জন্যে জমি কিনতে হবে, বিল্ডিং তুলতে হবে, মাস্টারদের জন্যে বিজ্ঞাপন দিতে হবে, তাদের ট্রেনিং দিতে হবে, বাচ্চাদের ভর্তি করতে হবে–অনেক কাজ।”

ফরাসত আলি মাথা নেড়ে বললেন, “অনেক কাজ।

.

যখন কাউকে অল্পকিছু কাজ করতে হয় সেটি শুরু করতে বেশি অসুবিধে হয় না, কিন্তু যখন অনেক কাজ করা বাকি থাকে তখন কোনখান থেকে শুরু করা হবে সেটা ঠিক করতেই সবার মাথা-খারাপ হয়ে যায়। ফরাসত আলি ও ফারুখ বখতের বেলাতেও তা-ই হল, তারা প্রত্যেকদিন সকালে দুপুরে এবং বিকালে এক রিম কাগজ আর দুইটা বলপয়েন্ট কলম নিয়ে বসতে লাগলেন আর কাগজে লম্বা লম্বা লিস্ট করতে লাগলেন, কিন্তু এর বেশি আর কাজ এগুল না। ব্যাপারটা হয়তো এভাবেই চলতে থাকত কিন্তু তার মাঝে একটা ছোট ঘটনা ঘটে গেল।

ফরাসত আলি ভোরবেলা ঘুম থেকে দেরি করে উঠে তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। লটারিতে তিরিশ লক্ষ টাকা জিতে যাওয়ার পর নানাধরনের মানুষ তাঁকে দিনরাত উৎপাত করে তাই তিনি একটু খোঁজখবর না নিয়ে দরজা খোলেন না। ফরাসত আলি দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলেন, মাথায় এলোমেলো চুল, চোখে ভারী চশমা একজন মানুষ হাতে একটা কাপড়ের ঝোলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম চেহারার মানুষেরা সাধারণত সাহায্যের জন্যে আসে-ফরাসত আলি একবার ভাবলেন দরজা খুলবেন না, কিন্তু চোখের ভারী চশমাটা দেখে তার কী মনে হল তিনি দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে চান?”

লোকটি মাথা চুলকে বলল, “সেটা তো ঠিক জানি না।”

“তাহলে দরজায় ধাক্কা দিলেন যে–”

”ইয়ে মানে যাকে খুঁজছি সেই মানুষটার নাম-”

“কী নাম?”

ভারী চশমা চোখের মানুষটা আবার খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, “মনে হয় নাম ওরাফত।”

“ওরাফত? ওরাফত আবার কোন দেশি নাম?”

“জানি না কোন দেশি। তবে মানুষটা মনে হয় মেয়েমানুষ।”

“মেয়েমানুষ?” ফরাসত আলি তখন মাথা নেড়ে বললেন, “না ভাই, এই বাসায় কোনো মেয়েমানুষ থাকে না।”

ভারী চশমা চোখের মানুষটার তখন খুব আশাভঙ্গ হল বলে মনে হল, খানিকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আপনি হয়তো বলতে পারবেন কোথায় থাকে সেই মহিলা।

ফরাসত আলি মাথা চুলকে বললেন, “আমি আসলে খুব বেশি মহিলাকে চিনি।”

“এই মহিলাকে হয়তো চিনবেন। মনে হয় খুব দজ্জাল মহিলা।”

“দজ্জাল মহিলা?”

“হ্যাঁ। কারণ–” ভারী চশমা চোখের মানুষটি মাথা চুলকে বলল, “সবাই দেখি মহিলাটিকে একটা গালি না দিয়ে কথা বলে না।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। মহিলার নাম ওরাফত, সবাই ডাকে ওরাফত শালী।”

ফরাসত আলি খুব অবাক হলেন, একজন মহিলা সে যত দজ্জালই হোক তাকে লোকজন শালী বলে ডাকবে তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “মহিলা দেখতে কেমন?”

মানুষটি আবার তার মাথা চুলকে বলল, “সেটাও খুব অবাক ব্যাপার। তার মুখে নাকি দাড়ি-গোঁফ?”

“মহিলার মুখে দাড়ি-গোঁফ?”

”হ্যাঁ। লটারিতে কয়েকদিন আগে তিরিশ লক্ষ টাকা পেয়েছে।”

ফরাসত আলি চমকে উঠলেন, “লটারিতে তিরিশ লক্ষ টাকা পেয়েছে, মুখে দাড়ি-গোঁফ, নাম ওরাফত শালী?”

“হ্যাঁ।”

ফরাসত আলি হঠাৎ করে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “বুঝেছি।”

“কি বুঝেছেন?”

“নাম বলেছেন ওরাফত শালী–আসলে সেটা ফরাসত আলি। ফরাসত আলি মোটেও দজ্জাল মহিলা না, পুরুষ মানুষ।”

“চেনেন আপনি?”

“চিনি। আমিই ফরাসত আলি।”

শুনে ভারী চশমা চোখের মানুষটি দাঁত বের করে আনন্দে হেসে ফেলল, হাত বের করে তার সাথে কয়েকবার জোরে জোরে হাত মিলিয়ে বলল, “আমার নাম হারুন ইঞ্জিনিয়ার। আমি আপনাকে কয়েকদিন থেকে খুঁজছি।”

“কেন?”

“আপনি যে স্কুল তৈরি করবেন তার বিল্ডিং তৈরি করার জন্য।”

ফরাসত আলি অবাক হয়ে হারুন ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকালেন, “আপনি কেমন করে জানেন আমি স্কুল তৈরি করব? কাউকে তো বলিনি আমরা!”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার আবার দাঁত বের করে হাসলেন।”কাউকে বলতে হয় নাকি, সবাই তো জানে।”

“সবাই জানে?”

“না জানার কী আছে? বড়লোকেরা লটারি জিতলে টাকাগুলি যক্ষের মতো আগলে রাখে। আর আমার আপনার মতো মানুষেরা লটারি জিতলে টাকাটা ভালো কাজে খরচ করে। স্কুল-কলেজ হাসপাতাল দেয়। গরিব আত্মীয়স্বজনের ছেলেপুলের পড়ার খরচ দেয়। দেয় না?”

ফরাসত আলি একটু হতচকিত হয়ে মাথা নাড়লেন। হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার ভারী চশমাটা খুলে ভালো করে মুছে বললেন, “আপনি কী দেবেন? স্কুল-কলেজ হাসপাতাল?”

“স্কুল।”

“স্কুলটাই ভালো। দেশের কাজ হয়। বাচ্চাদের না বড়দের?”

“বাচ্চাদের।”

“সেটা আরও ভালো। হারুন ইঞ্জিনিয়ার এবারে ঘরের ভিতরে ঢুকে নিজেই একটা চেয়ারে আরাম করে বসে বললেন, “এবারে আমি বলি আমি কী জন্যে এসেছি।”

ফরাসত আলি কাছাকাছি আরেকটা চেয়ারে বসে নিজের চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে বললেন, “বলেন।”

“বাড়িঘর কিভাবে তৈরি হয় তা আপনি জানেন?”

ফরাসত আলি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “ঠিক জানি না।”

“প্রথমে ফাউন্ডেশান তৈরি করতে হয়, তারপর পিলার লোহর রড দিয়ে শক্ত করতে হয়, কংক্রিট ঢেলে দিতে হয়। তারপর ছাদ ঢালাই, দেয়াল, তারপর দরজা-জানালা!”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন।

“মনে করেন আপনি এভাবে একটা বাসা তৈরি করলেন। বাসা তৈরি শেষ হল, কয়েক বছর থাকলেন তখন আপনার মনে হল, নাহ্ এই ঘরটা এখানে না হয়ে ওখানে হলে ভালো হত। তখন আপনি কী করবেন?”

ফরাসত আলি কী করবেন বুঝতে না পেরে আবার দাড়ি চুলকালেন। হারুন ইঞ্জিনিয়ার খানিকক্ষণ তাঁর দাড়ি চুলকানো দেখে একগাল হেসে বললেন, “হ্যাঁ, আপনি দাড়ি চুলকাবেন। আর দাড়ি যদি না থাকে তা হলে আঙুল চুষবেন। কারণ একবার বাসা তৈরি হয়ে গেলে আর কিছুই করার নেই। কিন্তু আমি-হারুন ইঞ্জিনিয়ার নতুন একটা প্রসেস দাঁড় করিয়েছি, আমেরিকা জার্মানি আর জাপানে এর পেটেন্ট রয়েছে, এইভাবে বাসা তৈরি করা হলে, যখন খুশি খুলে সেটা নতুন করে লাগানো যায়। দরকার হলে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। শীতের সময় সূর্যের আলো ঢুকতে দিলেন, গরমের সময় বাসা ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে পিছনে করে দিলেন। একতলা বাসা তৈরি করলেন, হঠাৎ খেলার জন্যে ব্যাডমিন্টন কোর্ট দরকার একটা ঘরের উপর আরেকটা ঘর তৈরি করে বাসাটাকে দোতলা করে বাসার সামনে খোলা মাঠ বের করে দিলেন।”

ফরাসত আলি চোখ বড় বড় করে হারুন ইঞ্জিনিয়ারের কথা শুনছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কী দিয়ে তৈরি করেন এই বাসা?”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার টেবিলে একটা ছোট থাবা দিয়ে বললেন, “সেটাই হচ্ছে সিক্রেট, কিন্তু আপনাকে আমি বলব। আপনার কাছে কোনো সিক্রেট নাই। বাসা তৈরি হয় পাস্টিক দিয়ে।”

“প্লা-প্লা-পাস্টিকের বাসা?”

“হ্যাঁ। কিন্তু মনে করবেন না যেই প্লাস্টিক দিয়ে চিরুনি তৈরি হয় সেই পাস্টিক। এই দেখেন একটা স্যাম্পল!”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার কাপড়ের ঝোলার মাঝে হাত দিয়ে কালোমতন একটা টুকরো বের করে নিয়ে এসে ফরাসত আলির হাতে দিলেন। ফরাসত আলি সেটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। জিনিসটা পাতলা কাঠের মতো হালকা কিন্তু পাথরের মতো শক্ত। চকচকে একটা ভাব রয়েছে দেখে মনে হয় লোহা বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার জিনিসটা হাতে নিয়ে বক্তৃতা দেয়ার মতো করে বললেন, “এর হিট কনডাক্টিভিটি সিরামিকের, স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি কাগজের কিন্তু টেনসিল স্ট্রেংথ ইস্পাতের।”

ফরাসত আলি কিছু না বুঝে মাথা নাড়লেন। হারুন ইঞ্জিনিয়ার গলার স্বর আরো উঁচু করে বললেন, “এটা করাত দিয়ে কাটা যায়, ড্রিল দিয়ে ফুটো করা যায়, কিন্তু পানি দূরে থাকুক অ্যাসিড দিয়েও গলানো যায় না। বৃষ্টিতে ভিজবে না, আগুনে পুড়বে না।”

ফরাসত আলি চমৎকৃত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “জিনিসটা আপনি তৈরি করছেন?”

“অবশ্যি! আমার দশ বছরের সাধনা! দশ বছর আগে আমি একদিন মগবাজার থেকে হেঁটে আসছি, দেখি রাস্তার কাছে তূপ হয়ে আছে আবর্জনা, দুর্গন্ধে নাড়ি উলটে আসে! আমি ভাবলাম এই যদি আবর্জনার নমুনা হয় একদিন এই দেশ আবর্জনায় তলিয়ে যাবে। দেশের জন্যে যদি কিছু করতে হয় এই আবর্জনার একটা গতি করতে হবে। সেই থেকে আমি আবর্জনা নিয়ে গবেষণা করছি।”

“আবর্জনা নিয়ে?”

“হ্যাঁ। লোকজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। আবর্জনা নিয়ে কাজ করতাম বলে আমার শরীর থেকে সব-সময় দুর্গন্ধ বের হত। একদিন আমার বউ আমাকে ছেড়ে চলে গেল। রেস্টুরেন্টে গেলে তোকজন উঠে যেত, বাসে উঠলে বাসের লোকজন নেমে যেত, কিন্তু আমি ছেড়ে দিইনি। দশ বছরের গবেষণার ফল এই পাস্টিজনা!”

“প্লাস্টিজনা?”

“হ্যাঁ, পাস্টিক এবং আবর্জনা। প্রস্টিজনা। নামটা ভালো হয়নি?”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “ভালো হয়েছে।”

“সারা পৃথিবীতে আবর্জনা নিয়ে সমস্যা, আর আবর্জনার বেশির ভাগ হচ্ছে পাস্টিক। এক ঢিলে মানুষ দুই পাখি মারে, আমি তিন পাখি মেরেছি, আবর্জনার গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছেড়েছি পাস্টিকটা ব্যবহার করেছি আর সেটা দিয়ে তৈরি করেছি প্লাস্টিজনা! ঠিক কি না?”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “ঠিক।”

“এবার তা হলে কাজের কথায় আসি।”

“কাজের কথা? ফরাসত আলি মনে-মনে ভাবলেন, এতক্ষণ তা হলে কি অকাজের কথা হচ্ছিল?

“হ্যাঁ, আমি এখন বলি আমি কেন এসেছি। আমি আমার প্লাস্টিজনা দিয়ে আপনার পুরো স্কুল তৈরি করে দেব। শুধু স্কুল না–স্কুলের দরজা জানালা চেয়ার টেবিল বেঞ্চ ব্ল্যাকবোর্ড সবকিছু। ছয় মাসের ভিতরে।”

“ছয় মাসের ভিতরে?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু আমাদের স্কুলের জমি এখনে কেনা হয়নি!

হারুন ইঞ্জিনিয়ার একগাল হেসে বললেন, “আমার স্কুল তৈরি করতে জমি লাগে না। আপনি ধীরেসুস্থে জমি কেনেন।”

ফরাসত আলি দাড়ি চুলকে বললেন, “খরচ পড়বে কত?”

“খরচের কথা ভাববেন না। দরকার হলে আমি ফ্রি তৈরি করে দেব।”

“ফ্রি? ফ্রি কেন করে দেবেন?”

ভারী চশমার আড়ালে হারুন ইঞ্জিনিয়ারের চোখ হঠাৎ ভাবগম্ভীর হয়ে ওঠে, তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “কারণ আমি পৃথিবীকে দেখাতে চাই আমার পাস্টিজনা দিয়ে পৃথিবীতে বিপ্লব করে দেয়া যায়!”

ফরাসত আলি জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, বললেন, “অবশ্যি! অবশ্যি!”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার বললেন, “পৃথিবীকে চমৎকৃত করার এই হচ্ছে সুযোগ। এখন বলেন আপনি রাজি কি না।”

ফরাসত আলি চুল এবং দাড়ি একসাথে চুলকে বললেন, “আমার তো মনে হচ্ছে আইডিয়াটা খুবই ভালো কিন্তু আমার বন্ধু ফারুখ বখতের সাথে কথা না বলে আমি তো কথা দিতে পারছি না!”

“কোনো চিন্তা নেই, আপনি তার সাথে কথা বলেন।”

“আপনাকে আমি কোথায় পাব?”

“এইখানে।”

“এইখানে?”

“হ্যাঁ। হারুন ইঞ্জিনিয়ার অমায়িকভাবে হেসে বললেন, “নতুন জায়গা, কিছু চিনি না, কোথায় উঠে কোন ঝামেলায় পড়ব, তাই আপনার বাসাতেই উঠে গেলাম। আমার খাওয়া নিয়ে কিছু চিন্তা করবেন না, আমি সবকিছু খাই। শুনেছি এখানকার পাবদা মাছ নাকি জগদ্বিখ্যাত?”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, সত্যি সত্যি এখানকার পাবদা মাছ জগদ্বিখ্যাত।

.

ফারুখ বখত সবকিছু শুনে আরও অনেক বেশি উৎসাহিত হলেন। প্রাস্টিজনার টুকরাটি দেখে আবেগে তাঁর চোখে পানি এসে গেল। তিনি হারুন ইঞ্জিনিয়ারকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভাই হারু, তোমার মতো আর কয়েকজন মানুষ হলেই এই দেশের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত।”

ফারুখ বখতের কথা শুনে হারুন ইঞ্জিনিয়ারের ভারী চশমার কাঁচও ঝাঁপসা হয়ে এল। তিনি সেটা খুলে শার্টের হাতায় মুছতে মুছতে বললেন, “ভাই ফারু এবং ভাই ফরা, তোমরা দুইজন হলে প্রথম মানুষ যারা আমার এই আবিষ্কারের প্রকৃত মর্ম বুঝতে পারলে।”

ফরাসত আলি সাধারণত আবেগে কাতর হয়ে যান না, কিন্তু এই মুহূর্তে দুইজন মানুষকে এইভাবে কাঁদোকাঁদো হয়ে যেতে দেখে তিনিও একটু দুর্বল হয়ে গেলেন। ধরা গলায় বললেন, “ভাই হারু, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। দরকার হলে আমাদের তিরিশ লক্ষ টাকার শেষ পাই পয়সা খরচ করে এই প্লাস্টিজনাকে আমরা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেব।”

কয়েকদিনের মাঝেই মহা উৎসাহে প্রাস্টিজনার কাজ শুরু হল। শহরের বাইরে অনেকটুকু জায়গা নেয়া হল, পৌরসভার ট্রাক সেখানে শহরের আবর্জনা ফেলতে লাগল। নাকে রুমাল বেঁধে হারুন ইঞ্জিনিয়ার সেগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলেন। বড় বড় ড্রামের নিচে আগুন জ্বলতে লাগল। তিনি সেখানে নানারকম ওষুধপত্র ঢালতে লাগলেন। হারুন ইঞ্জিনিয়ার আরও কিছু লোক নিয়েছেন, তারাও নাকে রুমাল বেঁধে প্লাস্টিকের বালতি করে কালচে একধরনের তরল এক ড্রাম থেকে অন্য ড্রামে ঢালাচালি করতে লাগল। মাটি দিয়ে একধরনের ছাঁচ তৈরি করা হয়েছে সেখানে মণ্ড ঢেলে দেয়া হল, সেগুলিকে চাপা দিয়ে চৌকোণা পাস্টিজনার টুকরো বের হতে লাগল। এক পাশে ছোট একটা ছাউনি করা হয়েছে–সেখানে কিছু যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, প্রাস্টিজনার টুকরোগুলি সেখানে পরীক্ষা করা হয়, মেপে দেয়া হয়, কেটেকুটে ঠিক করা হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ চলছে, তিন ঘণ্টা পরপর চা খাওয়ার অবসর। বিরাট বড় কেতলিতে চায়ের পানি গরম। হচ্ছে, ছোট একটা ছেলে ছোট ছোট কাপে চা ঢেলে দিচ্ছে এবং হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার দলবল নিয়ে চা খাচ্ছেন–এই দৃশ্যটিতে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেল।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার পরিশ্রমী মানুষ। সারাদিন খেটেখুটে কাজ করে রাতে বাসায় ফিরে এসেও বিশ্রাম নেন না। পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে এক গামলা ভাত খেয়ে স্কুলঘর ডিজাইন করতে শুরু করেন। একটা মাঝারি কম্পিউটার কেনা হয়েছে–সেখানে তিনি স্কুলঘরের নকশা করতে থাকেন। চারিদিকে বড় বড় জানালা, ছাত্রদের জন্যে বেঞ্চ, মাস্টারদের জন্যে চেয়ার-টেবিল, দেয়ালে ব্ল্যাকবোর্ড। ছোট ক্লাসের জন্যে ক্লাসঘরের মাঝে নানারকম খেলাধুলার ব্যবস্থা।

হারুন ইঞ্জিনিয়ারের কাজ দেখে ফারুখ বখত আর ফরাসত আলিও উৎসাহ পেয়েছেন। তাঁরা ঘোরাঘুরি করে স্কুলের জন্যে জায়গা খুঁজতে লাগলেন। শহরের মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গা পাওয়া এত সহজ নয়, শহরের বেশি বাইরেও তারা যেতে চান না। জায়গা পছন্দ হবার পরেও নানারকম যন্ত্রণা। সেটি দলিল করতে হয়, তার দখল নিতে হয়। তবুও কাজকর্ম মোটামুটি এগিয়ে যেতে থাকল।

প্লাস্টিজনার টুকরো দিয়ে স্কুলঘর তৈরি শুরু হয়েছে। ছোট ছোট টুকরো একসাথে জুড়ে বড় দেয়াল তৈরি হচ্ছে, চার দেয়াল লাগিয়ে ঘর। উপরে ছাদ নিচে মেঝে। দিনরাত লোকজন কাজ করছে, ড্রিল দিয়ে ফুটো করা হচ্ছে, দিয়ে লাগানো হচ্ছে, ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কাটা হচ্ছে, হাতুড়ির শব্দ, জিনিসপত্র টানাটানির হৈহুল্লোড়, সব মিলিয়ে একটা আনন্দোৎসবের মতো অবস্থা।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার বলেছিলেন ছয় মাসের মাঝে স্কুলঘর দাঁড় করিয়ে দেবেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার–সত্যি সত্যি ছয় মাসের আগেই সবগুলি স্কুলঘর দাঁড়িয়ে গেল। দরজা-জানালা, ব্ল্যাকবোর্ড, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল সবকিছু একসাথে। উজ্জ্বল রং দিয়ে সবকিছু রং করা হয়েছে, এত সুন্দর রং দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। সবারই কাজকর্মে খুব উৎসাহ। ছয় মাসের আগেই সব শেষ হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কাজকর্ম মোটামুটি শেষ, এখন সেগুলি স্কুলের জায়গায় নিয়ে লাগিয়ে দেয়া-সেটা নাকি একেবারে সহজ একটা কাজ, হারুন ইঞ্জিনিয়ারের ভাষায় একেবারে পাবদা মাছের ঝোল!

ঠিক তখন হঠাৎ রাতের খবরে শোনা গেল সমুদ্রে একটা নিম্নচাপ দেখা দিয়েছে, একটা ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসছে। এখনও সেটা সমুদ্রের গভীরে, কিন্তু দুদিনের মাঝে এসে এখানে ঝাঁপটা দেবে। হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা চুলকে বললেন, “অবস্থা গুরুতর।”

ফারুক বখত জিজ্ঞেস করলেন, “কেন কী হয়েছে?”

“প্লস্টিজনার এক নম্বর গুণ হচ্ছে এটা হালকা। আস্ত একটা স্কুলঘর দুইজন মানুষ মিলে টেনে নিয়ে যেতে পারে! তার মানে বুঝেছ?”

ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “না, বুঝিনি।”

“তার মানে ঘরগুলি যদি ঠিক করে বেঁধেহেঁদে রাখা না হয় তাহলে ঝড়ে সেগুলি উড়ে একেবারে গারো পাহাড়ে গিয়ে পড়বে!”

“তা হলে, বেঁধেহেঁদে রাখলেই হয়।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার তাঁর ভারী চশমা খুলে শার্টের হাতায় মুছতে মুছতে বললেন, “আমি অন্য একটা জিনিস ভাবছি।”

“কী জিনিস?”

“সবগুলি স্কুলঘর তৈরি হয়ে গেছে, এগুলিকে এখন শক্ত করে বাঁধাছাদা করতে যত সময় লাগবে সবগুলিকে স্কুলের মাঠে নিয়ে পাকাঁপাকিভাবে বসিয়ে দিতে মোটামুটি একই সময় লাগবে।”

“সত্যি?”

“সত্যি। আমি তাই ভাবছি এক কাজ করলে কেমন হয়?”

“কী কাজ?”

“ঘূর্ণিঝড় আসার আগেই স্কুলঘরগুলিকে স্কুলের মাঠে নিয়ে পাকাঁপাকিভাবে বসিয়ে দিলে কেমন হয়?”

“এখনই?”

“হ্যাঁ।”

ফরাসত আলি আর ফারুখ বখত দুজনেই এতদিনে এর মাঝে টের পেয়েছেন হারুন ইঞ্জিনিয়ারের মাথায় একটা-কিছু ঢুকে গেলে সেটা সেখান থেকে বের করা খুব সহজ না। প্রথম প্রথম চেষ্টা করেছিলেন, আজকাল আর চেষ্টা করেন না। ফারুখ বখত বললেন, “ঠিক আছে তা হলে কাজ শুরু করে দেয়া যাক!”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার ভারী চশমার কাঁচ শার্টের হাতা দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, “কাজ খুব সহজ, একেবারে পাবদা মাছের ঝোল! সবকিছুতে নাম্বার দেয়া আছে। এক নম্বরের সাথে এক নম্বর, দুই নম্বরের সাথে দুই নম্বর, তিন নম্বরের সাথে তিন নম্বর এইভাবে লাগিয়ে যাবে দেখতে দেখতে কাজ শেষ হয়ে যাবে।”

ফরাসত আলি তার দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “তা হলে আর দেরি করে কাজ নেই, লোকজন ডেকে কাজ শুরু করে দিই।”

বাইরে আকাশে তখন মেঘ করেছে, একটু একটু ঠাণ্ডা বাতাস এবং খুব সূক্ষ্ম বোঝা যায় না এরকম বৃষ্টি। কিন্তু তাতে কেউ পিছপা হল না এবং তার মাঝে কাজ শুরু হয়ে গেল। একটা ট্রাক, কয়েকটা গোরুর গাড়ি এবং বেশকিছু রিকশা দিয়ে স্কুলঘরগুলি তুলে নেয়া হল। মাঠের মাঝে আগে থেকে দাগ কাটা ছিল সেখানে বসিয়ে সেগুলিকে মোটা মোটা ক্রু দিয়ে গেঁথে দেয়া আরম্ভ হল। কাজ শুরু করার কিছুক্ষণের মাঝেই আকাশ ধীরে ধীরে একেবারে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। দমকা বাতাসটাও মনে হয় বেড়ে গেল কয়েকগুণ। কিন্তু একবার কাজ শুরু করে দেয়া হয়েছে, এখন থামার উপায় নেই। দিনের বেলাতেই মোটামুটি অন্ধকার, বড় বড় কয়েকটা টর্চলাইট হাতে সবাই কাজ করতে থাকে। সবার গায়েই একটা করে রেনকোট রয়েছে কিন্তু তবু সবাই ভিজে একেবারে চুপসে গেল।

এরকম ঝড়বৃষ্টিতে আদৌ এ ধরনের কাজ করা সম্ভব সেটা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু হারুন ইঞ্জিনিয়ারের কাজ মোটামুটি নিখুঁত। সবকিছুর মাঝে বড় বড় উজ্জ্বল রঙের নাম্বার দেয়া রয়েছে, নাম্বারগুলি মিলিয়ে একটার মাঝে আরেকটা শুধু ক্রু দিয়ে এঁটে দেয়া। টর্চলাইট জ্বালিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে সবাই কাজ করতে থাকে এবং দেখতে দেখতে স্কুলঘর দাঁড়িয়ে যেতে থাকে।

দিনের আলো নিভে আরও অন্ধকার হয়ে এল, চারিদিকে মোটামুটি ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। তার মাঝে সবাই হৈচৈ করে কাজ করতে থাকে। দমকা হাওয়া আরও বেড়েছে, মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু উড়িয়ে নেবে, কিন্তু সবাই মিলে শক্ত করে ধরে রেখে ক্রু এঁটে দিতে থাকে। ঝড়বৃষ্টি না হলে এই কাজটি আরও অনেক সহজে করা যেত, দিনের আলো হলে ঠিক কীভাবে পুরো জিনিসটি দাঁড় হচ্ছে দেখা যেত। কিন্তু এখন তার কোনো উপায় নেই। হারুন ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে সবাই কাজ করে যেতে থাকে।

ভোররাতের দিকে শেষ শ্রুটি লাগিয়ে হারুন ইঞ্জিনিয়ার একটা জয়ধ্বনির মতো শব্দ করলেন। উপস্থিত যারা ছিল তারাও সবাই আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। পুরো কাজটুকু শেষ হয়েছে। কেউ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেনি যে এই কাজটি সত্যি কখনো শেষ হবে।

বাসায় যখন সবাই ফিরে এসেছে তখন আর কারও গায়ে তিল পরিমাণ জোর অবশিষ্ট নেই। ভিজে কাপড় পালটে শুকনো কাপড় পরে যে যেখানে ছিল সেখানেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

সারারাত ঝড়ের বেগ বাড়তে থাকে, সবাই সন্দেহ করতে থাকে যে হয়তো আবার একটা ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় আসছে। কিন্তু দেখা গেল শেষ মুহূর্তে ঘুর্ণিঝড়টা তার দিক পালটে জনবিরল একটা অংশের দিকে গিয়ে হাজির হয়েছে। সকালবেলা ঝড় কমে গিয়ে মোটামুটি শান্ত আবহাওয়া ফিরে এল। ফরাসত আলি, ফারুখ বখত আর হারুন ইঞ্জিনিয়ার টানা ঘুমে দিন কাবার করে দিতে পারতেন, কিন্তু একটু বেলা হতেই অনেক মানুষের হৈচৈ শুনে তাদের উঠে পড়তে হল। দরজা খুলে দেখেন অনেক মানুষজন তাদের বাসার সামনে, সবাই একসাথে তাদেরকে কিছু-একটা বলতে চাইছে বলে কিছুই আর শুনতে পাচ্ছেন না। তারা গতরাতে যে স্কুলটা দাঁড় করিয়েছেন সেটা নিয়ে কিছু-একটা বলছে। লোকজনের কথা শুনে কিছু বুঝতে না পেরে তারা তাদের স্কুলের দিকে রওনা দিলেন, তাঁদের বাসার খুব কাছে, হেঁটে যেতে দশ মিনিট।

মোড়টা ঘুরতেই তাদের স্কুলটা চোখে পড়ল। উজ্জ্বল রং, গতরাত্রে বৃষ্টিতে ধুয়ে এখন একেবারে ঝকমক করছে। সবুজ মাঠের উপর দাঁড়িয়ে আছে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। গাঢ় লাল রঙের ছাদ, হালকা নীল রঙের দেয়াল, জানালা আর দরজায় কচুপাতা সবুজ রং। কাঁচের জানালা দিয়ে ভিতরের উজ্জ্বল ধবধবে সাদা দেয়াল দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে ব্ল্যাকবোর্ড, মেঝেতে পাকাঁপাকিভাবে লাগানো চেয়ার টেবিল বেঞ্চ। কী সুন্দর উজ্জ্বল তাদের রং দেখলেই মনের মাঝে আনন্দ হতে শুরু করে। পুরো স্কুলটিতে কোনো ত্রুটি নেই, এক কথায় অপূর্ব। শুধু একটিমাত্র সমস্যা–

পুরো স্কুলটি দাঁড়িয়ে আছে কাত হয়ে। রাতের অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করে লাগানোর সময় কেউ লক্ষ করেনি যে অংশটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিল সেটা নিচে থেকে উপরে বিস্তৃত হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক বিশাল দৈত্য বুঝি স্কুলটিকে মাটি থেকে তুলে কাত করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার ভারী কাঁচের চশমা খুলে শার্টের হাতা দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, “শালার এক নম্বর অংশটা ডাইনে বামে রাখার কথা ছিল, রেখেছি উপরে নিচে-পুরোটাই এখন উপর নিচু হয়ে গেছে!”

ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত হা করে মাটি থেকে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া কাত হয়ে থাকা স্কুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *