০২. তিন দিনের দিন সবাই খালাস পেয়ে গেল

তিন দিনের দিন সবাই খালাস পেয়ে গেল। শুধু মোরক আটকা রইল। সে ছাড়া পেল সপ্তম দিনে। তবে যে মোবারক ছাড়া পেল সেই মোবারককে কেউ চেনে না। শুকিয়ে চটিজুতা হয়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নিশ্চয়ই বেকায়দা জায়গায় পুলিশের রুলের গুঁতা লেগেছে। কিছু খেলেই বমি করে ফেলে। সেই বমির সঙ্গে রক্ত উঠে আসে।

মালবাবু তাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, আহা কী অবস্থা করেছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করা নয়ত মারা পড়বি।

সিগন্যাল বাবু বললেন, এরা এত সহজে মরে না। দুএক দিন যাক দেখবেন ঠিক আগের অবস্থা।

সিগন্যাল বাবুর কথা ঠিক হল না। সাত দিনেও মোবারকের অবস্থা উনিশ-বিশ হল না। আরও যেন কাহিল হল।

নূতন কুলি সর্দার হল হাশেম। মোরকের ঘনিষ্ঠ সাগরেদ। এই হাশেমের দলই মোবারককে খুন করল।

ইঞ্জিন শান্টিং করছিল। নির্জন জায়গা, লোকজন নেই। হঠাৎ সেই ইঞ্জিনের সামনে মোবারককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হল।

হাশেম দৌড়ে এসে স্টেশন মাস্টারকে খবর দিল, কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, বিরাট একসিডেন্ট হইছে। মোরক কাটা পড়ছে। শান্টিং ইঞ্জিনের নিচে পড়ছে। দক্ষিণের সিগন্যাল পয়েন্টের দশ পনেরো হাত পিছনে।

বলিস কী?

নিজের চউক্ষ্যে দেখা মাস্টার সাব।

মোবারক তো নড়তেই পারে না সে এতদূর গেল কীভাবে?

মউতে টানছে কী করবেন কন। মউতে টানলে না গিয়া উপায় নাই। বড়ই দুঃখের সংবাদ।

হাশেম চোখে গামছা দিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদল। কান্নার ফাঁকে যা বলল, তার অর্থ হচ্ছে মোরক ভাই একটা মানুষের মতো মানুষ ছিল। তার মৃত্যুতে দুনিয়ার যা ক্ষতি হল তা পূরণ হবার নয়।

তবে হাশেম সেই ক্ষতি দ্রুত পূরণ করার চেষ্টা করল। মোরকের তৃতীয় বউ রেশমা নামের বালিকাটিকে বিয়ে করল। রেল ওয়াগনগুলোর কর্তৃত্ব নিয়ে নিল। কেউ বাধা দিল না। হাশেম মোরকের মতো মূর্খ ছিল না। সে একের পর এক ক্ষমতা দখল করল খুব সাবধানে। সেই সঙ্গে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধিও করল। মোরক নম্বরী কুলির সংখ্যা বৃদ্ধিতে কখনো রাজি ছিল না। হাশেম সেই কাজটিই করল। কুলির সংখ্যা বাড়ুক। যত সংখ্যা বাড়বে ততই ভালো। সংখ্যা বাড়া মানে শক্তি বৃদ্ধি। একদিন জয়নালের কাছেও এল, জয়নাল ভাই নম্বরী কুলির দরখাস্ত করেন। সবে করতেছে।

জয়নাল বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, কি-যে কন। আমার কি এই ক্ষমতা আছে? একটা বালিশ হাতে নিলে মনে হয় গারো পাহাড় হাতে নিলাম। দেহেন পাওডার অবস্থা। আমার মিত্যু সন্নিকট।

আইজ পাও খারাপ কাইল ভালো হইব। অসুবিধা কি? দরখাস্ত দেন। ফরমের দাম দুই টেকা।

গুণ্ডা-পাণ্ডাদের সঙ্গে বিবাদ করে লাভ নেই। দরখাস্ত করে দিয়ে জয়নাল হল একচল্লিশ নম্বর কুলি। লাল শার্ট বানাতে হবে নিজের খরচায়। শার্টের বুক পকেটে নম্বর লেখা থাকবে। আরো নিয়ম-কানুন আছে। সেই সব নিয়ম-কানুন কাগজেকলমে লেখা।

১। যাত্রীগণের সহিত সদা-সর্বদা ভদ্র ব্যবহার করিতে হইবে।

২। মাল পরিবহনে মণ প্রতি দুই টাকা হিসাব মানিয়া চলিতে হইবে। মালের ওজন প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন উঠিলে রেলওয়ে কর্মচারীদের সাহায্য নেওয়া যাইবে।

৩। অবৈধ মালামাল পারাপার করা যাইবে না। কোনো মালের ব্যাপারে সন্দেহ হওয়া মাত্র রেলওয়ে পুলিশকে অবহিত করিতে হইবে। টাকার অভাবে জয়নাল আল জামাটা বানাতে পারে নি। লাল জামা থাকুক বা না থাকুক সে একজন নম্বরী কুলি এটা কম কথা না।

 

গৌরীপুর রেল স্টেশনে ভোর হয়েছে।

চারদিকে ঘন কুয়াশা।

টু ডাউন মোহনগঞ্জ-ময়মনসিংহ প্যাসেঞ্জার স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রিতে ট্রেন ঠাসা। হৈ চৈ কলরবের সীমা নেই। বজলু এখনো ঘুমুচ্ছে। জয়নাল বজলুকে রেখে ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস, ট্রেন দেখলেই কাছে যেতে ইচ্ছা করে। আজ পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে না। ব্যাপারটা কি? সেরে যাচ্ছে? মাদারীগঞ্জের পীর সাহেব মনে হচ্ছে সহজ পাত্র না।

এই বুড়ো এই?

তাকেই কি ডাকছে? তার বয়স চল্লিশও হয় নি এখনি তাকে বুড়ো ডাকছে? মাথার চুলগুলোর জন্যে এরকম হয়েছে। কোমরে ব্যথা পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সব চুল পেকে গেল। আল্লাহর কি লীলা। সে ব্যথা পেল কোমরে। তার ফলে এক দিকে মাথার চুল পেকে গেল অন্য দিকে পা হল অচল। কোমরের কিছুই হল না। আল্লাহতায়ালার এটা কেমন বিচার?

এই বুড়ো এই।

জয়নাল এগিয়ে গেল। জানালার পাশে কচি-কচি মুখের একটা মেয়ে বসে আছে। তার কোলে একটি শিশু। শিশুটি তারস্বরে চেচাচ্ছে। মেয়েটির পাশে তার স্বামী। সেই বেচারার কোলেও একটি শিশু। সেই শিশুটিও কাঁদছে। মনে হচ্ছে যমজ। যমজ বাচ্চারাই এক সঙ্গে কাঁদে হাসে। জয়নাল বলল, কী বিষয় আম্মা?

একটু পানি এনে দিতে পারবে? খাবার পানি।

টিউবওয়েলের পানি আছে। ভালো পানি। এক চুমুকে শইল ঠাণ্ডা।

আর গরম পানি দিতে পারবে?

আল্লাহ ভরসা। চায়ের দোকানে একটা টেকা দিলেই গরম পানি দিব।

এই নাও। এই ফ্লাটাতে গরম পানি। আর এইটাতে রেগুলার পানি, মানে ঠাণ্ডা পানি।

গরম পানির জইন্যে দুইটা টেকা দেন আহ্ম।

মেয়েটি টাকা খুঁজছে। তার বিশাল কাল ব্যাগে সম্ভবত এক টাকার কোনো নোট নেই। মেয়েটির স্বামী বিরক্ত গলায় বলল, তুমি পানি আনার জন্যে এসব পাত্ৰ দিচ্ছ কেন?

এ ছাড়া আর কী দেব? আর কী আছে?

মেয়েটির স্বামী ইংরেজিতে কি-সব বলল, যার মানে খুব সম্ভব—এই লোক পাত্রগুলো নিয়ে পালিয়ে যাবে।

জয়নাল ইংরেজি বোঝ না কিন্তু মানুষের ভাবভঙ্গি বুঝতে পারে। সে মেয়েটির স্বামীর দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল, মানুষকে এত অবিশ্বাস করা ঠিক না।

লোকটি মনে হচ্ছে এই কথায় লজ্জা পেল। পাক, মাঝে-মাঝে লজ্জা পাওয়া ভালো। ভদ্রলোক লজ্জা পেলে দেখতে ভালো লাগে। চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। কথা ঠিক মতো বলতে পারে না। তোতলাতে থাকে।

মেয়েটা তার কালো ব্যাগে টাকা খুঁজে পেয়েছে। সে স্বামীর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দামী একটা ফ্লাস্ক এবং পানি রাখার চমৎকার একটি পাত্র বাড়িয়ে বলল, ধুয়ে নিও কেমন?

আচ্ছা, আম্মা।

তাড়াতাড়ি আসবে। আমি পাঁচ টাকা বকশিশ দেব। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হবে।

জয়নাল তার খোঁড়া পা নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত এগুতে লাগল। ঠাণ্ডা এবং গরম পানি নিয়ে ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। সে লাইন টপকে বাজারে চলে গেল। জিনিস দুটির জন্যে আশাতীত দাম পাওয়া গেল। দুশ কুড়ি টাকা। চাপাচাপি করলে আড়াই শ পাওয়া যেত। যাক যা পাওয়া গেছে তাই বা মন্দ কী? দুশ কুড়ি টাকা খেলা কথা না। হাত এখন একেবারে খালি।।

বাচ্চা দুটোর জন্যে খারাপ লাগছে। আহা অবোধ শিশু। পেটের ক্রিধেয় কাঁদছে। তবে ওরা কিছু একটা ব্যবস্থা করবেই। তাছাড়া শিশু হচ্ছে ফেরেশতা। আল্লাহতালা নিজেই এদের উপর লক্ষ রাখেন। ক্ষিধের চোটে এরী কিছুক্ষণ কাঁদবে—এরও ভালো দিক আছে। চিৎকার করে কাঁদলে ফুসফুস পরিষ্কার থাকে। ক্ষয় কাশ, হাঁপানি এইসব কখনো হয় না। সব মন্দ জিনিসের একটা ভালো দিকও আছে।

 

ঘন্টাখানেক পর জয়নাল স্টেশনে ফিরল। ট্রেন চলে গেছে। স্টেশন ফাঁকা।

বজলু কম্বল ভাঁজ করে বগলে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। ঠোঙ্গায় করে জয়নাল। পরটা ভাজি নিয়ে এসেছে। বজলুকে ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দিয়ে দরাজ গলায় বলল, আরাম কইরা খা বজলু আগ্রহ করে খাচ্ছে। বার-বার তাকাচ্ছে জয়নালের দিকে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় সে অভিভূত। জয়নাল বলল, কেউ কি আমারে খুজছে? বজলু না সূচক মাথা নাড়ল।

জয়নাল রেলওয়ে হিন্দু টি স্টলের সামনে বেজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দু টি স্টল চালায় পরিমল। তার ব্যবহার খুবই খারাপ, তবে চা বানায় ভালো। অন্য জায়গায় আধাকাপ চা দিয়ে এক টাকা রেখে দেয়, পরিমল তা করে না।

জয়নাল বলল, পরিমলদা এক কাপ চা দেহি, গরম হয় যেন।

পরিমল মুখ বিকৃত করে বলল, কাছে আয়। হা কর, মুখের মধ্যে চা বানায়ে দেই। গরম চা।

জয়নাল পরিমলের কথা শুনেও না শোনার ভান করল। সকাল বেলায় ঝগড়া করে লাভ নেই। পকেটে এতগুলো টাকা নিয়ে ঝগড়া করতেও মন চায় না। মানুষের যাবতীয় ক্ষুদ্র ও তুচ্ছতা ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখতে ইচ্ছা করে।

পরিমলদা আমার এই পুলাডারে এককাপ মালাই চা দেও। সর যেন থাকে।

পরিমল চোখের কোণে বজলুকে এক ঝলক দেখল। শুকনো গলায় বলল, আগে টেকা দেপাঁচ টেকা।

পাঁচ টেকা? কি কও তুমি?

মালাইচা দুই টাকা কাপ। আর তোর কাছে আগের পাওনা দুই টেকা।

জয়নাল নিতান্ত অবহেলায় এক শ টাকার একটা নোট বের করল। যেন এরকম বড় নোট সে প্রতিদিন বের করে। এটা কিছুই না। সে উদাস গলায় বলল, ভাংতি না থাকলে নোট রাইখ্যা দেও। যখন ভাংতি হয় দিবা।

টেহা পাইচস কই?

এইটা দিয়া তো তোমার দরকার নাই পরিমলদা। তুমি হইলা দোকানদার মানুষ। কাস্টমার তোমারে হুকুম দিব সেই হুকুমে তুমি জিনিস দিবা, পয়সা নিবা। তুমি হইলা হুকুমের গোলাম।

কথাটা বলে জয়নাল খুব তৃপ্তি পেল। উচিত কথা বলা হয়েছে। শালা মালাউনের এখন আর মুখে কথা নাই।।

পরিমলের দোকানের চা আজ অন্য দিনের চেয়ে ভালো লাগল। চায়ের মধ্যে তেজপাতা দেয়ায় কেমন পায়েস-পায়েস গন্ধ। জয়নাল দরাজ গলায় বলল, দেখি পরিমলদা আরেক কাপ। চিনি বেশি কইরা দিবা।

পরিমল আরেক কাপ চা বাড়িয়ে দিল। বজলু আগের কাপই এখনো শেষ করতে পারে নি। ফুঁ দিয়ে-দিয়ে খাচ্ছে। একেকটা চুমুক দিচ্ছে আর জয়নালের দিকে তাকাচ্ছে। জয়নাল মনে-মনে ভাবল, এই ছেলেটার একেবারে কুকুর স্বভাব। কুকুরকে খেতে দিলে সে মালিকের দিকে একটু পর-পর তাকায় আর লেজ নাড়ে। এই হারামজাদাও তাই করছে। লেজ নেই বলে লেজটা নাড়তে পারছে না।

জয়নালের হঠাৎ মনে হল আল্লাহতালা সব জন্তকে লেজ দিয়ে পাঠাল মানুষকে কেন দিল না? কুকুর, বিড়াল, বাঘ, সিংহ সবারই লেজ আছে। মানুষের থাকলে তো কোনো ক্ষতি হত না। আসলেই চিন্তার বিষয়। কাউকে জিজ্ঞেস করে জিনিসটা জানা দরকার। জয়নালের মনে মাঝেমাঝে উচ্চ শ্রেণীর কিছু চিন্তা ভাবনা আসে, তখন কেন জানি বড় ভালো লাগে। নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা বলে মনে হয়। বেশিরভাগ মানুষই তো এক পদেরখাও আর ঘুমাও। এর বাইরে কোনো চিন্তা নেই। আল্লাহতালা মানুষকে চিন্তা করার যে ক্ষেমতা দিয়েছে সেই ক্ষেমতা কয়জন আর কাজে লাগায়?

যাই পরিমল দা। চা ভালো বানাইছ। একটা টেকা বেশি রাখ। বকশিশ। তোমারে বকশিশ করলাম। হিহিহি।

হারামজাদা বকশিশ দেখায়। লাথি খাবি।

জয়নাল দাঁত বের করে হাসল। জায়গা মত অপমান করা হয়েছে। অনেকদিন মনে রাখবে।

ভাংতি টাকা সবই ফেরত দিয়েছে। মালাউন জাতের এই এক গুণ, টাকা পয়সার ব্যাপারে খুব সাবধান। মুসলমান হলে বলত, টাকা থাকুক আমার কাছে। এখন ভাংতি নাই। ভাংতি হলে নিবি। তারপর আজ দিব কাল দিব করে খালি ঘুরাত।

বজলু পেছনে পেছনে আসছে। আসুক। অসুবিধা কী। ভাঁজ করা কম্বল বগলে ধরে আছে। জয়নালের জন্যে সুবিধাই হল—ঝাড়া হাত পা। সাথে আছে চৌকিদার।

ক্ষিদা লাগছে নাকি রে, ঐ বজলু?

হুঁ।

হুঁ কিরে ব্যাটা? পরটা ভাজি তো খাইলি একটু আগে। এখন খাইলি মালাই চা। এক মালাই চা খাইয়া এক দিন থাকা যায়। ক্ষিদা সহ্য করার অভ্যাস কর। পরে কমে লাগব। এইসব অভ্যাস ছোড বেলায় করা লাগে। বুঝছস?

হুঁ।

পান বিড়ির দোকান থেকে জয়নাল এক প্যাকেট স্টার সিগারেট কিনল। সিগারেট ধরাল না। আস্ত একটা প্যাকেট তার পকেটে এই আনন্দটা সে ভোগ করতে চায়। সে হাঁটছে স্টেশনের শেষ মাথার দিকে। ঐ দিকে সিগন্যাল ঘর। সিগন্যালম্যান পাগলা রমজানের সঙ্গে তার মোটামুটি খাতির আছে। রমজানকে সে ডাকে রমজান ভাই এবং বেশ ভক্তিশ্রদ্ধা করে। কারণ ঐ লোকটা আর দশটা লোকের মতো না। চিন্তা ভাবনা করে। কিছু কিছু চিন্তা বড়ই জটিল চিন্তা। যা জয়নালের মাথাতেও ঢােকে না। আবার কিছু কিছু চিন্তা পানির মতো। বুঝতে অসুবিধা হয় না।

গত বর্ষায় এরকম একটা চিন্তা শুনে সে বড় অভিভূত হয়েছে। সেদিন ঘোর বর্ষা। রমজান ভাই চাবির গোছা নিয়ে লাইন বদলাতে যাচ্ছে। কাজটা দেখতে সহজ হলেও আসলে সহজ না। একটা ভারী লোহার দণ্ড একদিক থেকে অন্য দিকে নিতে হয়। তখন ঘটাং করে লাইন বদল হয়। ট্রেন এলে আগের লাইনে না গিয়ে তখন যাবে অন্য লাইনে।

রমজান বলল, ও জয়নাল, আমার সাথে আয় ছাতা ধরবি। হাঁটতে পারিস তো?

পারি। চলেন যাই।

যেতে-যেতে রমজান বলল, একজন কেউ সাথে থাকলে সুবিধা। পয়েন্টার তুলতে কষ্ট হয়। বয়স হইছে রিটায়ারের টাইম।

জয়নাল বলল, যখন দরকার হইব খবর দিয়েন। আমি আছি।

ঝুম বৃষ্টির মধ্যে ছপ-ছপ করে দুজন যাচ্ছে। তখন রমজান একটা ভাবনার কথা বলল।

ও জয়নাল, একটা কথা বলি শোন।

বলেন রমজান ভাই।

আমার বেতন হইল চাইর শ ত্রিশ এর সাথে মেডিকেল দশ–চাইর শ চল্লিশ। আমি মানুষটা ছোড পদের কিনা ক দেখি। চাইর শ চল্লিশ টেকায় কি হয়? একটা ঘোড়ারও খাওন হয় না। ঠিক কি-না?

ঠিক।

এই আমার হাতে কী ক্ষমতা চিন্তা করছ? একবার যদি লাইন উল্টা পাল্টা কইরা দেই তাইলে যে একসিডেন হইব সেই একসিডেনে মানুষ মরব কম হইলেও এক হাজার।

কি সব্বনাশ।

এক হাজার মানুষের জান হাতের মুঠোয় নিয়া কাম করি। বুক ধড়ফড় করে। বুঝলি জয়নাল?

আমারো বুক ধড়ফড় করতাছে রমজান ভাই।

তোরে গোপনে একটা কথা কইমন দিয়া শোন, এক দিন দিমু একসিডেন,। বাজাইয়া।

কী কইলেন?

আমি এক কথা একবার কই, দশবার কই না।

একসিডেন বাজাইবেন?

হুঁ।

কোনদিন?

যে কোনোদিন হইতে পারে। আইজও হইতে পারে।

কি সৰ্বনাশের কথা!

হুঁ হুঁ সব্বনাশ বলে সব্বনাশ। এর নাম সাড়ে সব্বনাশ। কথা কিন্তু গোপন রাখবি। কাক-পক্ষীও যেন না জানে।

কাক-পক্ষী না জানার মত গোপন সংবাদ এটা না। স্টেশনে সবাই জানে। পাগলা রমজান নাম তো শুধু-শুধু হয় নি। এইসব কথাবার্তার জন্যই হয়েছে। তবে লোকটার মাথায় চিন্তা খুব ভালো খেলে। এই জন্যই তাকে খুব ভালো লাগে। লেজ বিষয়ক যে চিন্তাটা জয়নালের মাথায় এসেছে এর সহজ ব্যাখ্যা একমাত্র রমজান ভাই-ই দিতে পারেন।

রমজানকে পাওয়া গেল ঘুমটি ঘরে। জয়নালকে দেখেই বলল, কিরে জয়নাল আছস কেমন?

ভালা।

সাথে এই পুলা কে?

ইস্টিশনের পুলা, আছে আমার সাথে। সিগারেট খাইবেন রমজান ভাই?

নিজের পয়সার ছাড়া অন্যের জিনিস খাই না।

জয়নাল এটা জানে। তবু ভদ্রতা করল। তার সঙ্গে স্টার সিগারেটের প্যাকেটটা আছে। রমজান ভাই রাজি থাকলে পুরো প্যাকেটটা দিয়ে দিত। বড় ভালো লোক। ভালো লোকের জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করে।

রমজান ভাই।

কি?

একটা চিন্তা আসছে মাথার মধ্যে। চিন্তাটা হইল লেজ নিয়া। সব জন্তুর লেজ আছে। এই যে ধরেন একটা টিকটিকি এরও লেজ আছে। মানুষও তো ধরতে গেলে একটা জন্তু, এর লেজ নাই। এর কারণটা কি?

রমজানকে এই তথ্য মনে হল খুব নাড়া দিয়েছে। সে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মাঝে-মাঝে মাথা নাড়ছে।

জয়নাল?

জ্বি।

ভাবনার খোরাক আছে এর মইদ্যে। দেখি চিন্তা কইরা কিছু পাই কিনা।

আজ তা হইলে যাই রমজান ভাই?

রমজান হ্যাঁ না কিছুই বলল না। আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। জয়নাল তাকে ভালো চিন্তার খোরাক দিয়ে গেছে। সব জাতির লেজ আছে মানব জাতির লেজ নাই-বিষয়টা কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *