ওপরে, তিনটে শোবার ঘরের সবচেয়ে ছোট ঘরখানা বড় মেয়ের, মানে ইয়াসমিনের। মাঝারি ঘরে থাকে মাহজাবীন আর নাসরিন। আলিদের শোবার ঘরটা বড়, কেউ এলে
সেখানেই বসবার ব্যবস্থা। নাহার গিয়ে ইয়াসমিনের দরোজায় টোকা দেয়।
এই অভ্যাসটি বহু কষ্টে মাকে শিখিয়েছে ইয়াসমিন। আগে তো হুট করে ঢুকে পড়ত নাহার, প্রতিবারই ইয়াসমিন এমন করে উঠত যেন তার গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তিড়িং বিড়িং করে লাফাত আর চাচাত। নাহার বুঝতেই পারত না, মেয়ের ঘরে মা ঢুকবে তার আবার নোটিশ কীসের? মেয়ে কি পর? না, মা পেটে ধরে নি তাকে? শেষে মেয়ের জেদে পড়ে অভ্যাসটা করে নিয়েছে সে। তাও মাঝে মধ্যে ভুল হতো। সেটা একেবারেই শুধরে যায়, যখন ইয়াসমিন তার এক জন্মদিনে ক্লাশের একগুচ্ছ বান্ধবীর সমুখে বলে বসল, তারা এখন নিজেদের ভেতরে গল্প করবে, মা যেন জানান না দিয়ে ঘরে না আসে, যেমন তার অভ্যেস।
দরোজায় আবার টোকা দেয় নাহার।
ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
কাল কত রাতে ফিরেছে? কাল ওর এক বান্ধবীর জন্মদিন ছিল। কয়েকজন মিলে সিনেমা দেখবে, তারপর চাইনিজ টেক-অ্যাওয়ে খাবার এনে বান্ধবীর বাসায় খাবে, একটু হৈ-চৈ করবে, ফিরে আসবে। কতই বা রাত হতে পারে? সাড়ে বারোটা পর্যন্ত নাহার নিজেই জেগেছিল। ইয়াসমিনের দেরি দেখে একটু ভাবনা হয়েছিল তার, কিন্তু প্রকাশ করলে স্বামী তুলকালাম করে ছাড়তেন। তাই সে ঘুমন্ত আলিকে আর জাগায় নি। তারপর নিজেও সে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। এর আগেও কয়েকবার এ রকম দেরি করেছে, চাবি দিয়ে দরোজা খুলে পা টিপে টিপে ওপরে এসেছে। নাহার কিছু বললেই বলেছে, তাকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে, তার সব বান্ধবীই এ স্বাধীনতা পায়, তাছাড়া বয়স ষোল হয়ে যাবার পর মানুষের স্বাধীনতা আছে যতক্ষণ খুশি বাইরে থাকবার, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এবং ব্যক্তিগত ব্যাপারে মা কিম্বা যেই হোক মাথা গলানোটা অশালীন।
নাহার এবার নাম ধরেই ডাকে।
মিনা।
তবু সাড়া পাওয়া যায় না।
মেয়ের কাছে তিরস্কৃত হবার আশংকার চেয়ে উদ্বেগটাই লাফ দিয়ে প্রকাণ্ড হয়ে যায়।
হাতল ঘোরাতেই দরোজা খুলে যায়, দরোজা খুলে দেখা যায়, ইয়াসমিন বিছানায় নেই। নেই, তবু বিশ্বাস হয় না। চোখের ভুল বলে মনে হয়। ছোট্ট এতটুকু ঘর–একবারেই চোখে সবটা মেপে নেয়া যায়। ঘর শূন্য। বিছানা অগোছালো। হয়তো রাতে কেউ ঘুমিয়েছিল, হয়তো কেউ ঘুমোয় নি, বোঝা যায় না। ইয়াসমিন বিছানা করতে বড় আলসে। যেমন ঘুম থেকে উঠে যায়, তেমনি রাতে এসে বাসি বিছানায় শুয়ে পড়ে। নাহার কিছু বললে খেপে ওঠে। বলে, সে কি হলওয়েল কারাগারে বন্দি যে রোজ ভোরে ওয়ার্ডেনের রোদে বেরুবার আগেই তাকে বিছানা করে রাখতে হবে, রেখে বিছানার পাশে নিষ্পাপ। সন্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?
ইয়াসমিন কি তাহলে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেছে, নাহার টের পায় নি?
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বাথরুম দ্যাখে। কেউ নেই ভেতরে।
তখন মাঝের ঘর, অন্য দু মেয়ের যৌথ শোবার ঘৱৈ আসে নাহার। ছোট মেয়ে নাসরিন শুয়ে শুয়ে চার্লি ব্রাউন কমিক বই পড়ছে। আর মাহজাবীন জানালার কাছে টেবিলের ওপর বসে, জানালার বাইরে মুখ করে নোখের রঙ ওঠাচ্ছে। ঘরে আর কেউ নেই। নাহারের পায়ের শব্দে দু মেয়ের কেউ ফিরে তাকায় না। ইয়াসমিনকে এখানেও না দেখে তার বুক হিম হয়ে যায়।
কিছুতেই সত্যি বলে মনে হয় না, ইয়াসমিন গত রাতে ফেরে নি।
মাথাটা ঘুরে উঠে একবার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নাহার। শূন্য দৃষ্টিতে ইয়াসমিনের পিঠোপিঠি মেয়ে মাহজাবীনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর মাহজাবীন নোখের রঙ তুলতে তুলতেই বলে, মাম, আজ প্রাতরাশ খাইতে চাহি না। প্লিজ।
প্রায় ছুটির দিনেই মাহজাবীন ভোরে নাশতা করতে আপত্তি করে।
সপ্তাহের পাঁচদিন ভোরে ইস্কুলে যাবার আগে মায়ের কড়াচোখের নিচে বাটি ভর্তি দুধ সিরিয়েল গিলতে হয়, ছুটির দিনে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা দেখায় সে। এটা নতুন নয়। তবু, নাহারের মনে হয়, আজ এর বিশেষ একটা অর্থ আছে।
সে মেয়েকে বলে, কখন উঠেছিস ঘুম থেকে?
মাহজাবীন আপন কাজে ব্যস্ত থাকে। নোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে। জবাব দেয় না।
নাহার কিছুটা কঠিনম্বরে জিগ্যেস করে এবার–উঠেছিস কখন?
ছোট মেয়ে নাসরিন চার্লি ব্রাউনের বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে, আহ তোমরা কী শুরু করিলে বল তো? আমাকে পড়িতে দাও।
নাসরিনকে পড়বার অখণ্ড নীরবতা দেবার জন্য নয়, ভিন্ন কারণে নাহার মাহজাবীনকে বলে, বীনা, এদিকে শুনে যাও।
মাহজাবীন ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকায়।
প্রাতরাশ নয়, প্লিজ।
এসো এদিকে।
নাহারের গলায় কী ছিল, মাহজাবীন টেবিল থেকে নেমে আসে।
পাশেই ইয়াসমিনের ঘর, দরোজা খোলা, ভেতরে ঢুকে দরোজাটা বন্ধ করে নাহার সরাসরি প্রশ্ন করে, মিনা কোথায়?
ঘরের চারদিকে ধীর চোখে মাহজাবীন তাকায়। নাহার রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে। পিঠোপিঠি বোন, হয়তো ছোটটি বড়-র গতিবিধি জানে। তার এক প্রকার বিশ্বাসও হয়, মাহজাবীন নিশ্চয়ই জানে।
গুডনেস, সে কি ফিরিয়া আসে নাই?
তাহলে আর তোমাকে জিগ্যেস করছি কেন?
মাহজাবীন বড় বড় চোখে মায়ের দিকে তাকায়।
আমি জানিব কী প্রকারে?
তুমি জানবে না তো কে জানবে? রাতদিন তোমাদের কথাবার্তা, হাসাহাসি।
তাহাতে কী? তাহার গোপনীয়তা তাহার কাছে।
কাল কার জন্মদিন ছিল?
আমি জানি না?
কিছু বলে নি?
আমার স্মরণ হয় না।
কোথায় যেতে পারে জানিস?
তাহার বন্ধুরা আমার নহে। অমি সংবাদ রাখি না।
নাহার গুম হয়ে যায়। একবার মনের ভেতরে চমক দিয়ে যায়, মাহজাবীন জেনেও গোপন করছে না তো? কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে নিষ্পাপ মনে হয়। চোখের ওপর। নোখ তুলে ধরে সে এখন নিরিখ করে দেখছে, রঙ ঠিকমতো উঠেছে কিনা।
ইয়াসমিনের শূন্য বিছানার ওপর বসে পড়ে নাহার।
বীনা।
মাহজাবীন মায়ের আতংকিত কণ্ঠস্বরে চোখ ফেরায়। রক্তশূন্য মুখটার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্যে আন্দোলিত হয় সে। তারপর, আবার সে স্থিরতর হয়।
মাম, এমনও কি সম্ভব নহে ফিরিয়াছিল সত্য, প্রভাতে আবার বাহিরে গিয়াছে।
অনুমানটি লোভনীয় মনে হয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। বিশ্বাস করে নাহার, কিন্তু পর মুহূর্তেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
না, আমি খুব ভোরে উঠেছিলাম। বেরিয়ে গেলে টের পেতাম।
তবে আমি আর জানি না।
তোর বাবাকে এখন কী বলব?
বলিবে, প্রভাতে বাহির যায়। তোমাকে বলিয়া যায়। অথবা তুমি সাড়া পাইয়াছিলে।
মাথা নাড়ে নাহার।
না, তাকে আমি বলেছি, মিনা ঘরে আছে।
ভ্রূ কুঁচকে মায়ের দিকে তাকায় মাহজাবীন।
ড্যাডি সহসা কেন সন্ধান করিলেন?
আজ সেই ডাক্তার আসবে, বিকেলের দিকে। মিনা তোকে কিছুই বলে নি? তুই একটুও টের পাস নি?
সত্য, মাম।
কিছু যদি বলে থাকে, আমাকে বল।
জানিলে বলিতাম।
বোন ঘরে ফেরে নি, শুনে এত ঠাণ্ডা আছ কী করে?
নাহার তিরস্কার করে মেয়েকে।
মাহজাবীন ঘর ছেড়ে যেতে যেতে বলে, তাহার জীবন তাহার।