দুই
ঠাস ঠাস করে ঘুমন্ত ছেলের গালে চড় মারল অনিমেষ। কথাটা কানে ঢোকা মাত্রই মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠেছিল, বুকের ভেতর দম আটকানো ভাব এবং সমস্ত শক্তি জড়ো হয়েছিল হাতের কবজিতে। অনিমেষের খেয়াল ছিল না তার হাঁটুর নিচে দুটো অকেজো পা, সে টলছিল রাগে এবং ঘেন্নায়।
আচমকা আঘাত খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠল অর্ক। বিস্ময় এবং ক্রোধ একই সঙ্গে তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল। তারপরই একটু ভয়ের ছায়া পড়ল সেখানে, গালে হাত রেখে পাথরের মত বসে রইল সে। প্রচণ্ড জ্বলুনি শুরু হয়েছে গালে। অনিমেষ চাপা গলায় বলল, ‘বল, আবার বল কথাটা!’
অর্ক আধাভাঙ্গা স্বরে বলল, ‘কি কথা?’
‘যে কথাটা একটু আগে বলেছিস—!’
এইবার হকচকিয়ে গেল অর্ক। ঠিক কি কথাটা মুখ থেকে বেরিয়েছে সে মনে করতে পারছিল না। আঙ সাঙ কিছু বলে ফেলেছে নাকি! নিশ্চয়ই, তা নইলে বাবা তাকে মারতে যাবে কেন? একটু ধাক্কা দিলেই তো চিৎ পটাং হবে কিন্তু তবু বাবাকে এখন আমজাদের মতন দেখাচ্ছে। সে খুব নিরীহ গলায় বলল, ‘মাইরি বলছি, কি বলেছি মনে পড়ছে না।’
অনিমেষের চোখে যে ক্রোধের ফণাটা উঁচিয়ে উঠেছিল তা বিস্ময়ে মাথা নোয়ালো। ছেলে কথাটা বলেছে ঘুমের ঘোরে, জেগে উঠে মনে না পড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওই ভঙ্গীতে বিশেষ শব্দগুলো ব্যবহার করার অভ্যেস না থাকলে অত স্বচ্ছন্দে ঘুমের মধ্যেও বলতে পারত না। অথচ সে ছেলের মুখে কোনদিন এইরকম কথাবার্তা শোনেনি। তার মানে ও যখন বাইরে থাকে তখন অনর্গল এইসব কথাবার্তা বলে, ঘরে ফিরলেই সচেতন হয়। ওদের সঙ্গে যখন কথা বলে তখন নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে বলে!
ছেলের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সরে এল খাটের কাছে। পায়া ধরে উঠে বসল ওপরে। তারপর চোখ বন্ধ করল। অর্ক মাদুরের ওপর বসে বাবাকে দেখল। তারপর সেখান থেকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কি খিস্তি করেছি?’
অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল। সে নিজে কি কখনও বাবার সামনে দাঁড়িয়ে খিস্তি শব্দটা উচ্চারণ করতে পারত? অথচ এই ঘরে বসে অনর্গল যখন সারাদিন ধরে অশ্লীল গালাগালি শুনে যেতে হচ্ছে ছেলে বউ-এর সামনেই তখন খিস্তি কথাটার ধারটাই ভোঁতা এবং নিরীহ হয়ে গেছে। অনিমেষের মনে পড়ল ছেলেবেলায় জলপাইগুড়িতে ওরা বড়দের সামনে শালা শব্দটা বলা মহাপাপ বলে মনে করত। পরে সেটাই কথার মাত্রা হয়ে দাঁড়াল। বাক্যকে জোরদার করতে শালা স্বাভাবিক হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল। এখন এই বস্তিতে বসে শালার বিকল্প হিসেবে আর একটি দু-অক্ষরের শব্দ শুনছে। অবলীলাক্রমে ছেলেরা এখন পুরুষাঙ্গের চলতি নামটিকে একটু ভেঙে শালার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করছে চেঁচিয়ে। কোন অপরাধবোধ নেই। অর্কও তাই করে কিনা কে জানে!
অর্ক তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ঘাড় নাড়ল, না।
‘তাহলে হাত চালালে কেন?’
‘যা বলেছিস তা আমি মরে গেলেও বলতে পারতাম না।’
‘কিন্তু কথাটা কি?’ ঘাড় শক্ত হচ্ছিল অর্কর।
‘ন্যাকড়াবাজি মানে কি?’
অর্ক যেন বিস্মিত হল। তারপর ওর হালকা গোঁফের তলায় হাসি খেলে গেল, ‘যা বাব্বা, ন্যাকড়াবাজি খারাপ কথা নাকি! ন্যাকড়াবাজি মানে বিলা করা।’
‘বিলা?’
‘ওফ্ বিলা—বিলা হল—।’ অর্ক মানেটা হাতড়াচ্ছিল।
‘ঠিক আছে।’ অনিমেষ তাকে থামিয়ে দিল, ‘আমি আর শুনতে চাই না।’
‘মা চলে গেছে?’ অর্ক হঠাৎ সজাগ হল।
‘হ্যাঁ।’
‘মা শুনেছে?’
‘না।’
‘তুমি মাকে এসব কথা বলে না।’
‘কেন? তুই তো খারাপ কথা বলিসনি বলছিস।’
‘তা হোক, মা বুঝতেই চাইবে না। বলবে না তো?’
অনিমেষ উত্তর দিল না। বিছানার ওপর উঠে এসে বালিশটা ঠিক করতে লাগল। তারপর তোশকের তলা থেকে একটা টাকা বের করে সামনে রাখল, ‘নিমুর দোকান থেকে চা নিয়ে আয়।’
‘কেন? মা চা করে যায় নি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘সে তোর জেনে কি হবে? যা বলছি তাই কর!’
অর্ক উঠে দাঁড়াল। মাথায় এখন ও অনিমেষের সমান। শুধু ডাল ভাত খেয়ে ছেলেটার স্বাস্থ্য বেশ চমৎকার হয়েছে। অনিমেষের নিজের কখনও অমন মাস্ল ছিল না। দেখে বোঝা যায় না ওর বয়স এখনও পনের হয়নি।
গামছা টেনে নিয়ে ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘দ্যাখো তো, গালে দাগ হয়ে গেছে কিনা?’
অনিমেষ তাকাল, তারপর মাথা নাড়ল।
‘হেভি জ্বলছে।’
একটু বাদেই অর্ক মুখ ধুয়ে এসে কেটলি আর টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। এত দ্রুত এই ভিড়ের মধ্যে জল পায় কি করে কে জানে! অনিমেষ বাবু হয়ে বসল। আজ সকালটাই বিশ্রী হয়ে গেল। না, তবু কিছু হল, অন্যদিন তো কিছুই হয় না। সে ঘরের মেঝের দিকে তাকাল। অর্ক মাদুরটা তোলেনি, চিটচিটে বালিশটা চেপ্টে রয়েছে। খাটের এপাশের মেঝেতে মাধবীলতা শোয়। সেই জায়গাটা পরিষ্কার। অনিমেষ ঠিক করল মাধবীলতাকে বলবে ঘটনাটা। ছেলেটা পাল্টে যাচ্ছে, খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। এখনই যদি কিছু না করা যায় তাহলে আর সামলানো যাবে না। এই বস্তির বেশীর ভাগ ছেলেই ক্লাস ফোরের পরই পড়াশুনা ছেড়ে দেয়। অর্ক যাদের সঙ্গে মেশে তারা কেউ স্কুলে যায় না। ফুটপাথে বসে তাস খেলে, কেউ কেউ মদ খাওয়া ধরেছে। এদের সঙ্গে অর্ককে মিশতে বারণ করেও সক্ষম হয়নি অনিমেষ। মাধবীলতাও হার মেনেছে।
একবার প্রমোশন হয়নি অর্কর। এবং এ খবরটা বেশ চেপে গিয়েছিল সে। মাধবীলতা জানতে পেরে ক্ষেপে আগুন হয়ে গিয়েছিল। অতবড় ছেলেকে বেধড়ক মেরেছিল সেদিন। কিন্তু সবই প্রায় নিঃশব্দে। ঘরের কথা বাইরের লোককে জানতে দিতে চায় না মাধবীলতা। তারপর ছেলেটা একটু পাল্টেছিল। নিয়ম করে বই নিয়ে বসত, প্রয়োজন হলে অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করত। কিন্তু আবার যে কে সেই। অনিমেষ লক্ষ্য করেছে সেই ঘটনার পর থেকেই মাধবীলতা ছেলের ব্যাপারে কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য না হলে সে অর্কর সঙ্গে কথা বলে না। টিউশুনি সেরে মাধবীলতা বাড়ি ফেরে রাত সাড়ে নটায়। এইসময় ঘরে থাকার কথা অর্কর। কিন্তু একটা না একটা ছুতোয় ঠিক বেরিয়ে যায় ও! কাঁহাতক রোজ রোজ মাধবীলতার কাছে নালিশ করা যায়। কিন্তু আজ বলা উচিত। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না অনিমেষ।
চা নিয়ে ঘরে ঢুকল অর্ক, ‘অনুর মা-টা মনে হয় টেঁসে যাবে!’
‘অনুর মা?’ টেঁসে যাওয়া শব্দটা কানে কট্ করে বাজল। আর বোধহয় সাজানো কথা বলছে না অর্ক।
‘তুমি মাইরি কাউকেই চেন না। আমাদের উল্টোদিকের ঘর। তুমি সারাদিন কান বন্ধ করে থাক নাকি?’ কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল অর্ক, তারপর কৌটো থেকে দুটো থিন এরারুট বিস্কুট।
অনিমেষের মনে পড়ল যাওয়ার আগে মাধবীলতাও এরকম খবর দিয়েছিল। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ করে হাঁফাচ্ছিল মাধবীলতা, কেন? মৃত্যু অবধারিত জেনে?
চায়ে চুমুক দিতে দিতে অর্ক বলল, ‘আজ স্কুলে যাওয়া হল না!’
‘কেন?’ ভ্রূ কুঁচকালো অনিমেষ।
‘সবাই হাসপাতালে যাচ্ছে, রক্তফক্ত দিতে হতে পারে!’
‘তুই যাচ্ছিস?’
‘বাঃ যাবো না! প্রেস্টিজ থাকবে পাড়ায়?’ অর্ক যেন খুব অবাক হয়েছে অনিমেষের কথায়। কাপটি মাটিতে রেখে আলনা থেকে রঙিন শার্টটা টেনে নিয়ে গায়ে চড়াল। তারপর হাফপ্যান্টের বোতামে হাত দিতেই অনিমেষ মুখ ফেরালো। এতবড় ছেলের কোন লজ্জাবোধ নেই। পেছন ফিরে স্বচ্ছন্দে প্যান্ট পাল্টায়। কেমন পশুর মত ব্যাপার।
‘আমি যাচ্ছি। চল্লিশটা পয়সা আমার কাছে থাকল।’ অর্ক বেরিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গেল অনিমেষ। ওকে পুরো টাকাটা দেওয়া উচিত হয়নি। কক্ষনো বাকি পয়সা ফেরত দেয় না।
একটু একটু করে নয়, হঠাৎই ছেলেটা পাল্টে গেল। অথচ আটবছর আগে প্রথম দিন যখন ওকে দেখেছিল তখন এক তাল নরম মাটি ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। এক তাল মাটি যা দিয়ে ইচ্ছে মতন মূর্তি গড়া যায়। তিল তিল করে মাধবীলতা ওকে নিজের মনের মত গড়ে তুলে তার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। প্রথম দিনেই চমৎকার ভাব হয়ে গিয়েছিল ওদের। যেন জন্মাবার পর সাতটি বছর ছেলে অপেক্ষা করেছিল তাকে দেখবার জন্যে। বলেছিল, ‘পুলিসদের আমি বড় হলে মারব, তুমি ভেবো না।’
অনিমেষের মজা লেগেছিল, ‘কেন?’
‘ওরা তোমার পা ভেঙে দিয়েছে, তোমাকে এতদিন আটকে রেখেছিল। আমি ওদের কিছুতেই ছাড়ব না।’ সেই কচি গলাটা এখনও কানে বাজে। এই অন্ধঘরে বাঁচার একমাত্র আনন্দ ছিল অর্ক। মাধবীলতা যেন একটা সূর্যকেই তার কোলে তুলে দিয়েছিল। কখন যে সেই সূর্যে গ্রহণের নোংরা ছায়া লাগল কে জানে! তার দুটো পা সারিয়ে তুলতে মাধবীলতা নিঃশেষ হয়ে গেল। পাগলের মত এ ডাক্তার সে ডাক্তার করেছে, অকাতরে পয়সা ঢেলেছে ধার করে। এখন কেমন শক্ত হয়ে গেছে ও, চট করে মনের কথা বলার মনটাই মরে গেছে। আর সেই ফাঁকে বদলে গেল অর্ক। অনিমেষ মাথা নাড়ল, সে-ই দায়ী। কাদার তালটা যে বাইরের আঁচে শক্ত হয়ে ঢেলা পাকিয়ে যাচ্ছে টের পায়নি সে। এখন মূর্তিগড়া হল না বলে আফসোস করে কি হবে। ‘ফোটো তো, ন্যাকড়াবাজি করো না!’ স্বরটা মনে পড়তেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল অনিমেষ। একা, ঘরে বসে।
টিফিনের ঘন্টা যেন কানে মধু ঢেলে দিল। খাতাপত্র গুটিয়ে মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল। আজ থার্ড পিরিয়ডের পর থেকেই মাথাটা ঘুরছে। পড়াতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। মেয়েদের পুরোনো পড়া লিখতে দিয়ে চুপচাপ বসেছিল। আজও যথারীতি দেরি হয়েছে স্কুলে আসতে। সকাল থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত পেটে পড়েনি। ক্লাস-কাপ্টেনকে বলে এল খাতাগুলো সংগ্রহ করে টিচার্সরুমে পৌঁছে দিতে। ঝিমুনি লাগছিল ওর, বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখল হেডমিসট্রেসের বেয়ারা সুদীপ তার দিকে এগিয়ে আসছে, ‘দিদি, আপনাকে ডাকছেন বড়দি।’
মাথা ঝাঁকালো মাধবীলতা। তারপর একটু এগিয়ে হেডমিসট্রেসের ঘরে ঢুকল। সৌদামিনী সেনগুপ্তার কে নামকরণ করেছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে। ওরকম বিশাল শরীর আর স্ফীত মুখের দিকে তাকালে নামটা কিছুতেই মনে পড়ে না। এই স্কুলটাকে গড়ে তোলার পেছনে ভদ্রমহিলার অবদান প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেটাই হয়েছে কাল, স্কুলটাকে তিনি নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন। বিয়ে করার সময় পর্যন্ত নাকি পাননি।
বসবার অনুরোধের জন্যে অপেক্ষা করল না মাধবীলতা, ‘ডেকেছেন?’
মুখ তুলে ঠোঁটটাকে ছুঁচোর মত করে চশমার ফাঁক দিয়ে কিছুক্ষণ দেখে সৌদামিনী বললেন, ‘অসুবিধেটা কি হচ্ছে?’
‘মানে?’
‘এখন তো আর মাইনেপত্র তিনচারমাস বাকি থাকে না। মাসের মাইনে মাসেই পেয়ে যাচ্ছ। তাহলে?’ মাধবীলতার মনে পড়ল ওদের সবচেয়ে জুনিয়ার টিচার নীপা ঠাট্টা করে বলে, ‘বড়দি দাঁড়কাকের গলা ছিনতাই করেছেন।’
‘কি বলছেন বুঝতে পারছি না।’
‘বোঝা উচিত ছিল। তুমি আজও পনের মিনিট লেট!’
‘পাশের বাড়িতে একটা অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছিল—।’
‘অজুহাত খুঁজে পেতে তোমাদের কষ্ট হয় না। তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি এ জিনিস বেশীদিন চলতে পারে না। সিনিয়র টিচাররা এরকম করলে জুনিয়াররা তো সাপের পাঁচ পা দেখবে। তাছাড়া পড়ানোর ব্যাপারেও তুমি খুব কেয়ারলেস হচ্ছ!’
‘আমি?’
‘ইয়েস।’ ড্রয়ার থেকে একটা খাতা বের করে সামনে ধরলেন সৌদামিনী, ‘এই মেয়েটিকে তুমি একশ তে পঞ্চাশ দিয়েছ। অথচ ওর পাওয়া উচিত চল্লিশ। গার্জেন এসে কমপ্লেন করে গেছে তুমি মেয়েটির ভুল ডিটেক্ট করোনি। স্কুলের বদনাম হয়ে যাচ্ছে!’ মাধবীলতা খাতাটা টেনে নিয়ে দেখল, বেশ কয়েকটা বানান ভুল নজরে এল। অত খাতা একসঙ্গে দেখতে গেলে কিছু কিছু গোলমাল হয়েই যায়। কিন্তু এ বিষয়ে সে নিজে খুব সজাগ। তাহলে এটা হল কি করে?
সৌদামিনী বললেন, ‘আমি এখনই কমিটির কানে কথাটা তুলতে চাই না। আমাকে যেন দ্বিতীয়বার না বলতে হয়। যাও।’
মাধবীলতা উঠে দরজার দিকে যেতেই সৌদামিনী বললেন, ‘তোমার শরীর কি অসুস্থ? মুখ চোখ ওরকম কেন?’
‘না, কই কিছু হয়নি তো!’
‘খাওয়া দাওয়া করছ!’
‘হ্যাঁ।’
‘স্বামী কি করছে?’
‘ওই আর কি, আছেন।’
সৌদামিনী মাথা নাড়লেন, ‘কতকাল আর স্যাক্রিফাইস করবে? ওই ব্যাটাছেলে জাতটার জন্যে নিজেকে শেষ করাটা গাধামি। নচ্ছার জাত একটা। শরীরের যত্ন নিও। ওইটেই আসল।’
টিচার্স রুমে এসে ধপ করে চেয়ারে বসল মাধবীলতা। খাতাপত্র টেবিলে রেখে শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করল। উল্টো দিকে বসেছিল নীপা, জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে লতাদি?’
চোখ বন্ধ করেই মাথা নাড়ল সে, কিছু না।
‘তোমাকে খুব সাদা দেখাচ্ছে!’
‘বুড়ো বয়সে ফরসা হচ্ছি বোধহয়।’
‘কি যে ঠাট্টা কর! একবার ডাক্তার দেখাও।’
‘ওমা কেন?’ মাধবীলতা চোখ খুলে হেসে ফেলল।
‘তোমার ওপর দুজন নির্ভর করে আছে। একটা কিছু হয়ে গেলে!’
‘দূর! আমাকে যমেও ছোঁবে না। চা দিয়েছে?’
‘দিচ্ছে! কি ব্যাপার? এরকম কথা কখনো বল না তুমি! আজ কিছু হয়েছে মনে হচ্ছে! ঝগড়া করেছ?’
‘ঝগড়া আবার কার সঙ্গে করব। এই জানিস, আমাদের পাশের ঘরের একটা বউ সেরেফ ঝগড়া করে অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে চলে গেল। বউটার শরীরে এক ফোঁটা মাংস নেই। আর একটা থুত্থুরে বুড়ি বলল, ওকে আমি খেলাম।’ শিউরে উঠল মাধবীলতা কথাগুলো বলতে বলতে। নিচের ঠোঁট দাঁতে চাপল সে।
নীপা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘ওই জায়গাটা তুমি ছাড়ো তো! আমাদের পাড়ায় একটা ফ্ল্যাট এখনও খালি আছে। তুমি নেবে?’
‘কে টাকা দেবে?’
‘বেশী ভাড়া না। তিনশ। দেড়খানা ঘর, সব সেপারেট। আমার বাবার বন্ধু। সেলামি নেবে না, তিনমাসের ভাড়া অ্যাডভান্স।’
মাধবীলতা ক্লান্ত চোখে তাকাল। ও কত মাইনে হাতে পায় তা নীপা জানে কিন্তু কত টাকা বাড়িতে নিয়ে যায় সে খবর জানলে এই প্রস্তাব দিত না। নীপা তাকিয়ে আছে দেখে বলল, ‘দুবছর পরে যদি বাড়িটা খালি থাকে তাহলে বলিস।’
নীপা একটু আহত হল। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাই বলো, তুমি বস্তিতে থাকবে এটা একদম মানায় না।’
মাধবীলতা হাসল, ‘আমাকে কিসে মানায় রে?’
নীপা বোধহয় রেগে গেল, ‘জানি না।’ তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘সুধাদি, চা দিয়ে যাও, জলদি।’
লম্বা টিচার্স রুম এখন ভরা। দু’তিনটে দলে সবাই গল্প করছে। একটা অলিখিত শ্রেণীভেদ আছে এখানে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাধবীলতা ভাবল বিস্কুট চাইবে কিনা! এখন দুটো বিস্কুট চল্লিশ পয়সা। না, থাক। শুকনো জিভে চা বেশ আরাম দিল। ঠিক তখুনি দরজায় সুপ্রিয়া কর দেখা দিল। এই স্কুলে মেয়েদের যেমন য়ুনিফর্ম আছে টিচারদেরও সাদা শাড়ি পরে আসতে হয়। সুপ্রিয়া করকেও মানতে হচ্ছে নিয়মটা, কিন্তু তার সাদা শাড়িতে যা জেল্লা বের হয় তাতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সবার। সুপ্রিয়ার চাকরি করতে আসা শখের, সময় কাটানোর জন্যে। স্বামী বিরাট চাকরি করেন, কোলকাতায় দুটো প্রকাণ্ড বাড়ি। এক ছেলে দার্জিলিং-এ পড়ে। গাড়ি ছাড়া এক পা হাঁটে না সুপ্রিয়া। ওকে দেখেই মুখ নামালো মাধবীলতা। সে নিজেও জানে এটা এক ধরনের কমপ্লেক্স কিন্তু কিছুতেই কাটাতে পারে না। বিনা সুদে তাকে আট হাজার টাকা ধার দিয়েছিল সুপ্রিয়া। কোনদিন তাগাদা করেনি, কাউকে জানায়নি, এমনকি ব্যবহারেও প্রকাশ করেনি। তবু ওকে দেখলেই অস্বস্তি হয় মাধবীলতার। অনিমেষের পায়ের জন্যে নেওয়া টাকাটা জলের মত খরচ হয়ে গেল। একদম উপকার হয়নি বলা যায় না। এক পায়ে কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়েছে শেষপর্যন্ত। অনেকদিন শোধ করতে পারেনি কিছু। এখন প্রতি মাসে চারশো করে দিচ্ছে। তিনশো টাকায় সংসার চালাতে হয়। প্রভিডেণ্ড ফাণ্ড কো-অপারেটিভ থেকে কাটাকুটির পর ওই অঙ্কটাই হাতে থাকে। অবশ্য সুপ্রিয়া কর হাতে হাতে টাকা নেয়নি। বলেছিল, ‘আমি বরং ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলছি নতুন করে। তুমি চারশো করে প্রতিমাসে জমা দিও, রেকারিং।’ মাধবীলতা তাই দেয়।
সুপ্রিয়া কর এসে নীপার পাশে বসতেই সে বলল, ‘নতুন শাড়ি মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ গো! জাপানী।’
‘তুমি বেশ আছ সুপ্রিয়াদি। সারা পৃথিবীকে গায়ে চাপাও।’
‘ওইটেই তো শখ। কেন নজর দিচ্ছ! তারপর ব্যাগ খুলে বড় প্যাকেট বের করল সুপ্রিয়া। ‘কাল তোমাদের দাদার জন্যে বানিয়েছিলাম। ও খুব খেতে ভালবাসে তো। খেয়ে দ্যাখো তো কেমন হয়েছে!’
এক খণ্ড বড় কেক তুলে দিল সুপ্রিয়া নীপার হাতে। তারপর একটা খণ্ড এগিয়ে ধরল মাধবীলতার দিকে।
মাধবীলতার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। নিত্যনতুন বাড়ি থেকে খাবার এনে সুপ্রিয়া টিচার্সদের খাওয়ায়। অথচ সে কোনদিন কিছু আনতে পারে না। কেকটা না নেওয়া অত্যন্ত অভদ্রতা হবে। মনে মনে ঠিক করল, টাকাটা শোধ হয়ে গেলে সে একদিন সবাইকে খাওয়াবে। কেকটা হাতে নিতেই খুব সুন্দর গন্ধ নাকে এল। কিসমিস কাজু চোখে পড়ল। মাধবীলতার মনে হল, অনিমেষ কিংবা অর্ক অনেকদিন এসব জিনিস খায়নি। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল ওর। টেবিলের তলায় হাতটা আপনা আপনি নেমে গেল। তারপর একটা ছোট্ট টুকরো গালে ফেলে বলল, ‘সুন্দর হয়েছে।’
সুপ্রিয়া খুশি হল। নীপা কিছু বলতেই সুপ্রিয়া ওর দিকে ঘুরে বসে কথা বলতে লাগল। মাধবীলতা সর্তকভঙ্গীতে সবার চোখ এড়িয়ে কেকটাকে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ নাড়তে লাগল এমন ভঙ্গীতে যেন সে খেয়ে যাচ্ছে। দাঁতের কোণে যে টুকরোটা পড়েছিল তার মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। কাপের তলানিটা গালে ঢেলে ব্যাগ নিয়ে মাধবীলতা টয়লেটে চলে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে কেকটাকে মুড়ে সযত্নে আবার রেখে দিল। মনটা এখন শান্ত হয়ে গেল ওর। বেশ ভাল লাগছে।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢুকল মাধবীলতা। ডাক্তারখানার সামনে আসতেই শক্ত হল শরীর। তারপর ধীরে ধীরে উঠে এল বারান্দায়। ভদ্রলোকের পসার বেশ ভাল। ওকে দেখে আর একজনের পেট টিপতে টিপতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি ব্যাপার?’
‘আজ সকালে আপনাকে বলেছিলাম—! মানে ওদের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। আপনি যদি সামনের মাস অবধি অপেক্ষা করেন তাহলে মাইনে পেয়ে আমি না হয় দিয়ে দেব।’ এক নিঃশ্বাসে বলে গেল মাধবীলতা।
‘দিতে হবে না। পিলে বড় হয়েছে তোমার।’ ডাক্তার রোগীকে বললেন।
‘দিতে হবে না?’
‘না। পেশেন্ট মারা গেলে আমি টাকা নিই না।’
চমকে উঠল মাধবীলতা। বউটা মরে গেছে? কোনদিন কথা বলেনি কিন্তু আজ সকালেই তো ওর হৃৎস্পন্দন শুনেছিল সে। মোক্ষবুড়ির কথাই সত্যি হল? টলতে টলতে রাস্তায় নেমে এল সে।
গলির মুখে বেশ ভিড়। সবাই উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে বউটি মোক্ষবুড়িকে ফোড়ন কেটেছিল তাকে দেখতে পেল মাধবীলতা। চোখাচোখি হতেই বউটি ঘোমটা টেনে বলল, ‘অনুর মা মরে গেছে। এখনই নিয়ে আসবে।’
মাধবীলতা মাথা নামাল। তারপর ভারী পায়ে গলির মধ্যে ঢুকল। অনুদের দরজা খোলা। আড়চোখে তাকিয়ে মোক্ষবুড়িকে দেখতে পেল সে। জবুথবু হয়ে বুড়ি বসে আছে দরজায়। তার ঠিক পাশে পাথরের মূর্তির মত বাচ্চাদুটো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে। ছেঁড়া হাফপ্যান্ট আর খালি গায়ে চোখ তুলে ওরা মাধবীলতাকে দেখল। সরল অবোধ দৃষ্টি। মোক্ষবুড়ি বলল, ‘কে যায়?’
মাধবীলতা বলল, ‘আমি।’
‘কে? অ, মাস্টারনি?’
‘হ্যাঁ।’
‘সে এল না আর, শুনেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘বড়ঘরের মেয়ে ছিল লা, মরে বেঁচে গেল।’
‘আমি যাচ্ছি।’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা, হাসপাতালের খাটে আজকাল গদি থাকে তো, নরম গদি, তুমি জানো?’
মাধবীলতা আর দাঁড়াল না। প্রায় দৌড়েই সে নিজের ঘরের সামনে পৌঁছে গেল। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল অনিমেষ শুয়ে আছে, অর্ক নেই। বোধহয় স্কুলে গেছে। ঘাড় বেঁকিয়ে সে দেখল রান্না হয়নি। মাধবীলতা চাল আলু আর ডিম বের করে রেখেছিল স্টোভের পাশে তেমনি রয়েছে। অনিমেষ আজকাল সকালে ওগুলো ফুটিয়ে রাখে।
খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘রাঁধো নি?’
মাথা নাড়ল অনিমেষ, না।
‘খোকা খেয়ে যায়নি স্কুলে?’
‘স্কুলে যায়নি। হাসপাতালে গেছে।’
চট করে মেজাজটা গরম হয়ে যাচ্ছিল মাধবীলতার, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো, ‘তুমি কেন যেতে দিলে?’
অনিমেষ স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
‘কিছু খেয়েছ?’
‘চা।’
‘আর কিছু?’
‘না।’
‘তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি।’
‘কি?’
‘কেক। খুব ভাল! অর্ধেকটা তুমি খাও, আর ওর জন্যে রেখে দাও।’
অনিমেষ উঠে বসল, ‘আমার শরীর খারাপ, খাব না।’
‘কি হয়েছে?’
‘পেট গোলমাল করছে।’
মাধবীলতা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল, ‘পেট গোলমাল করলে কি চোখ দিয়ে জল পড়ে?’
‘মানে?’
‘চোখের কোণে জলের দাগ শুকিয়ে আছে।’
‘আমি বলছি খাব না, ব্যাস।’ অনিমেষ সকালের ক্রোধটাকে টেনে তুলল, ‘তুমি খাও আর তোমার ছেলেকে দাও।’
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘তুমি এমন করো না, আমি তো আর কিছু চাই না, শুধু তুমি একটু বোঝ আমাকে।’
তারপর ধীরে ধীরে কেকটাকে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। অনুদের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মোক্ষবুড়ি বলল, ‘কে যায়?’
মাধবীলতা দেখল বাচ্চাদুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু খেয়েছিস?’
দুটো বাচ্চা পুতুলের মত মাথা নাড়ল, না।
মোক্ষবুড়ি বলল, ‘অ তুমি! তা কে খেতে দেবে বল ওদের?’
‘এই নে খা!’ কেকটাকে দুটো ভাগ করে বাচ্চাদুটোর হাতে তুলে দিতেই তারা চকচকে চোখে সেটাকে দেখেই মুখে পুরল।
মোক্ষবুড়ি জিজ্ঞাসা করল, ‘কি দিচ্ছ লা?’
‘কেক! ওমা, এতে তো ডিম আছে। অশুচের সময় ডিম খেতে নেই। ফেলে দে, ফেলে দে মুখ থেকে।’ হাত বাড়িয়ে বাচ্চাদুটোর মুখ ধরতে চাইল বুড়ি। মাধবীলতা স্তব্ধ হয়ে দেখল, বাচ্চাদুটো দ্রুত গিলে ফেলছে কেক দুটো, যত দ্রুত সম্ভব। ব্যর্থ মোক্ষবুড়ি মাথা চাপড়াতে লাগল, ‘এখনও মা পোড়েনি তোদের, ডিম খেয়ে নিলি? রাক্ষস, সব রাক্ষস!’