০২. টপ হ্যাট

০২. টপ হ্যাট

…ভালো দার্শনিক হওয়ার জন্যে একমাত্র যে-জিনিসটি আমাদের প্রয়োজন তা হলো বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা।…

সোফি নিশ্চিত অজ্ঞাত পরিচয় পত্রলেখকের কাছ থেকে আবার চিঠি আসবে। আপাতত এ-ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবে না বলে ঠিক করল সে।

স্কুলে শিক্ষকদের কথায় মনোযোগ দেয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়াল সোফির জন্যে। ওর মনে হলো তারা কেবল গুরুত্বহীন ব্যাপার নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। মানুষ কী বা পৃথিবী কী এবং সেটা কীভাবে সৃষ্টি হলে সে-ব্যাপারে তারা কিছু বলেন না কেন?

এই প্রথমবারের মতো সে এ-ব্যাপারে সচেতন হলো যে স্কুলে, কিংবা বলা চলে সব জায়গাতেই, লোকজন কেবল তুচ্ছ বিষয়েই মাথা ঘামাচ্ছে। অথচ এরচেয়ে গুরুতর অনেক সমস্য রয়েছে যেগুলোর সমাধান হওয়া দরকার।

কারো কি এ-সব প্রশ্নের উত্তর জানা আছে? সোফির কাছে মনে হলো ইরেগিউলার ভার্ব মুখস্ত করার চেয়ে এ-সব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোটা অনেক বেশি জরুরি।

শেষ ক্লাসের পরে ঘণ্টা পড়তেই সে এতো দ্রুত স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো যে দৌড়ে ওর নাগাল ধরতে হলে জোয়ানাকে। কিছুক্ষণ পর জোয়ানা জিগ্যেস করল, আজকে সন্ধ্যায় কার্ড খেলবি?

সোফি কাঁধ ঝাঁকাল।

কার্ড খেলার ব্যাপারে আমার আর উৎসাহ নেই

অবাক দেখাল জোয়ানাকে।

নেই? তাহলে চল, ব্যাডমিন্টন খেলি।

ফুটপাতের দিকে দৃষ্টি নামাল সোফি, তারপর মুখ তুলে তাকাল বন্ধুর দিকে।

ব্যাডমিন্টনের ব্যাপারেও আমার আর আগ্রহ নেই।

ফাজলামি করছিস তুই।

জোয়ানার গলায় ঝাঁঝ, টের পেল সোফি।

তোর বলতে অসুবিধে আছে হঠাৎ কী এত জরুরি হয়ে গেল?

সোফি ঘাড় নাড়ল শুধু। ব্যাপারটা … ব্যাপারটা একটু গোপনীয়

হু, বুঝেছি! তুই প্রেমে পড়েছিস!

কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে হাঁটল মেয়ে দুটো। ওরা ফুটবল মাঠের কাছে পৌঁছাতে জোয়ানা বলে উঠল, আমি মাঠটার ওপর দিয়ে যাবো।

মাঠের উপর দিয়ে। জোয়ানার অবশ্য ওদিক দিয়েই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি হয়, কিন্তু বাসায় মেহমান থাকলে বা দাঁতের ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে তবেই সে ও-পথটা ব্যবহার করে।

ওর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্যে খারাপ লাগল সোফির। কিন্তু আর কী-ই বা সে বলতে পারত? ও কি বলতে পারত যে সে কে আর পৃথিবীটা কোথা থেকে এলো, এই নিয়ে হঠাৎ করেই সে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে ব্যাডমিন্টন খেলার কোনো সময়-ই নেই তার জোয়ানা কি ব্যাপারটা বুঝতে পারত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর এক হিসেবে, সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রশ্ন নিয়ে চিন্তিত হওয়াটা এত কঠিন ব্যাপার কেন?

সোফি টের পেল, ডাক বাক্সটা খোলার সময় তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। প্রথমে, তার মায়ের কাছে ব্যাংক থেকে আসা একটা চিঠি আর কিছু বাদামি রঙের খাম পেল সে। যত্তসব! সোফি দেখতে এসেছে অজ্ঞাত প্রেরকের কাছ থেকে কোনো চিঠি এসেছে কিনা।

গেটটা বন্ধ করার সময় সে খেয়াল করল একটা বড় খামের ওপর তার নাম লেখা আছে। সেটা উল্টে সে দেখল ওটার ওপর লেখা রয়েছে: দর্শন বিষয়ক কোর্স। যত্নের সঙ্গে ব্যবহার করুন।

নুড়ি-বিছানো পথ ধরে ছুট লাগাল সোফি, স্কুল ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলল সিঁড়ির উপর। ডোেরম্যাটের নিচ দিয়ে অন্য চিঠিগুলো গুঁজে দিয়ে দৌড়ে পেছনের বাগানে চলে এসে গুহার ভেতর আশ্রয় নিল সে। বড় চিঠিটা খোলার এটাই একমাত্র স্থান।

শিয়াকান-ও ওর পিছু নিল লাফাতে লাফাতে এবং সোফিকে ব্যাপারটা মেনে নিতে হলো। সে জানে, বেড়ালটা নাছোড়বান্দা।

দেখা গেল, খামটার ভেতরে একটা পেপার ক্লিপ দিয়ে আটকান টাইপ করা তিনটে পৃষ্ঠা আছে। সোফি পড়তে শুরু করল।

দর্শন কী?

প্রিয় সোফি,

অনেক লোকেরই অনেক হবি থাকে। কেউ কেউ পুরনো মুদ্রা (কয়েন) বা বিদেশি ডাকটিকেট সংগ্রহ করে, কেউ সেলাই করে, অন্যরা আবার তাদের অবসরের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করে বিশেষ কোনো খেলার পেছনে।

অনেক মানুষ আছে যারা পড়তে ভালোবাসে। তবে পড়ার রুচি একেক জনের একেক রকম। কেউ শুধু খবরের কাগজ বা কমিক্স পড়ে, কেউ ভালোবাসে উপন্যাস পড়তে, আবার অন্যরা পছন্দ করে জ্যোতির্বিদ্যা, বন-জঙ্গল আর জন্তু-জানোয়ার বা প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের ওপর লেখা বই-পত্র।

ঘোড়া বা দামি পাথরের ব্যাপারে আমার উৎসাহ থাকলেই আমি আশা করতে পারি না যে প্রত্যেকেই ও-সব বিষয়ে আমারই মতো উৎসাহী হবে। আমি হয়ত খেলাধুলা বিষয়ক সমস্ত অনুষ্ঠান টিভিতে দেখতে খুবই আনন্দ পাই, কিন্তু সেই সঙ্গে আমাকে এ-ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে যে অন্যদের কাছে খেলাধুলা জিনিসটা রীতিমত একঘেয়ে একটা বিষয়।

এমন কিছু কি নেই যা সবাইকেই আকর্ষণ করে? এমন কিছু কি নেই যা সবাইকে উদ্বিগ্ন করে, তা তাদের পরিচয় যা-ই হোক না কেন বা তারা পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন? হ্যাঁ, প্রিয় সোফি, কিছু কিছু প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ আছে যে ব্যাপারে সবারই আসলে আগ্রহ বোধ করার কথা। ঠিক এইসব প্রশ্ন নিয়েই এই কোর্স।

জীবনের সবচেয়ে জরুরি জিনিসটি কী? যে-মানুষটি অনাহারের দ্বারপ্রান্তে বাস করে তাকে যদি প্রশ্নটি করা হয় সেক্ষেত্রে উত্তরটি হবে, খাদ্য। শীতে মরণাপন্ন লোকটিকে জিগ্যেস করলে জবাব আসবে, উষ্ণতা। এই একই প্রশ্ন যদি এমন কোনো মানুষকে করা যায় যে নিঃসঙ্গ বোধ করছে আর ভাবছে সে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, তাহলে সম্ভবত উত্তরটি হবে, অন্য মানুষের সাহচর্য।

কিন্তু এ-সব মৌলিক চাহিদার সমাধান যখন হয়ে যাবে, তখনো কি এমন কিছু রয়ে যাবে যা প্রত্যেকেরই দরকার? দার্শনিকরা সে-রকমই মনে করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন মানুষ কেবল অন্ননির্ভর নয়। এ-কথা অস্বীকার করার যো নেই যে সবারই খাদ্য দরকার এবং সবাই ভালোবাসা ও আদর-যত্ন চায়। কিন্তু এসবের বাইরেও কিছু রয়েছে যা সবারই দরকার আর তা হচ্ছে এটা জানা যে আমরা কে এবং আমরা কেন পৃথিবীতে রয়েছি।

আমরা কেন পৃথিবীতে রয়েছি তা জানার ব্যাপারে উৎসাহী হওয়াটা ডাকটিকেট সংগ্রহের মতো কোনো খেয়ালি বিষয় নয়। যারা এ-প্রশ্ন করছেন তারা এমন এক বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন যে-বিতর্ক মানুষ এই গ্রহে বসবাস শুরু করার পর থেকেই চলে আসছে।

সর্বশেষ অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি সোনার পদক কে পেয়েছে এই প্রশ্নের চেয়ে অনেক বড় আর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে এই মহাবিশ্ব, পৃথিবী এবং জীবন কী করে সৃষ্টি হলো।

.

দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে দর্শনবিষয়ক কয়েকটি প্রশ্ন করা:

পৃথিবী কী করে সৃষ্টি হয়েছে? যা ঘটে তার পেছনে কি কোনো ইচ্ছা বা অর্থ রয়েছে। মৃত্যুর পরে কি জীবন আসে? কী করে এ-সব প্রশ্নের জবাব দেব আমরা? আর সবচেয়ে যেটা জরুরি, কীভাবে জীবনযাপন করা উচিত আমাদের? অনাদি কাল ধরে এসব প্রশ্ন করে আসছে মানুষ। মানুষ কী এবং পৃথিবীটা কোথা থেকে এসেছে, এই প্রশ্ন দুটি নিয়ে মাথা ঘামায়নি এমন কোনো সংস্কৃতির কথা জানা যায় না।

আসলে কিন্তু খুব বেশি দার্শনিক প্রশ্ন করার নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর কয়েকটি আমরা এরিমধ্যে করে ফেলেছি। কিন্তু ইতিহাস আমাদেরকে প্রতিটি প্রশ্নেরই ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো উত্তর উপহার দিয়েছে। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, দার্শনিক প্রশ্ন করা সোজা, সেগুলোর উত্তর দেয়াই কঠিন।

এমনকী আজও প্রত্যেককেই এই প্রশ্নগুলোর নিজস্ব উত্তর নিজেকেই খুঁজে বের করে নিতে হয়। ঈশ্বর আছেন কিনা বা মৃত্যুর পরে জীবন আছে কিনা তা বিশ্বকোষের পাতা উল্টে জানা যাবে না। বিশ্বকোষ আমাদের এ-কথাও বলবে না। কীভাবে আমাদের জীবনযাপন করা উচিত। অবশ্য লোজন কী বিশ্বাস করত সে কথা পড়লে জীবন সম্পর্কে আমাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ব্যাপারে সাহায্য হতে পারে।

দার্শনিকের সত্যানুসন্ধান অনেকটা গোয়েন্দা-গল্পের মতোন। কেউ ভাবছে খুনটা করেছে অ্যান্ডারসন, অন্যেরা ভাবছে, না, এটা নিলসেন বা জেনসেনেরই কাজ। পুলিশ কখনো-সখনো সত্যিকারের কোনো অপরাধের সমাধান করে বটে। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটাও সম্ভব যে, কোথাও না কোথাও একটা সমাধান থাকা সত্ত্বেও তারা হয়ত ব্যাপারটার কোনো কিনারাই করতে পারল না। কাজেই কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন হলেও সে-প্রশ্নের হয়ত একটা এবং মাত্র একটাই উত্তর থাকে। হয় মৃত্যুর পরে কোনো ধরনের অস্তিত্ব রয়েছে, নয়ত নেই।

শতাব্দীপ্রাচীন বহু ধাঁধা বিজ্ঞানের কল্যাণে খোলাসা হয়ে গেছে। চাঁদের অন্ধকার দিকটা দেখতে কেমন সেটা অনেক দিন রহস্যে ঘেরা ছিল। এটা এমন একটা ব্যাপার যার সমাধান আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হওয়ার নয়, তাই যার যার কল্পনার হাতেই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল সেটাকে। কিন্তু আজ আমরা জানি চাঁদের অন্ধকার দিকটা দেখতে ঠিক কেমন এবং আজকাল আর কেউ এ-কথা বিশ্বাস করে না যে চাঁদের মানুষ বলে কিছু আছে বা সেটা সবুজ পনিরে তৈরি।

দুহাজার বছর আগের এক গ্রীক দার্শনিক বিশ্বাস করতেন দর্শনের জন্ম মানুষের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতার মধ্যে। বেঁচে থাকাটা এতো আশ্চর্য বলে বোধ হয়েছিল মানুষের কাছে যে আপনা থেকেই দার্শনিক প্রশ্নগুলো জেগে উঠেছিল তাদের মনে।

ব্যাপারটা অনেকটা একটা জাদুর খেলা দেখার মতোন, আমরা ঠিক বুঝতে পারি না কাজটা কীভাবে করা হলো। কাজেই আমরা জিগ্যেস করি: জাদুকর কী করে কয়েকটা সাদা সিল্কের স্কার্ফকে একটা জ্যান্ত খরগোশে রূপান্তরিত করতে পারেন?

একজন জাদুকর যখন হঠাৎ করে একটা খরগোশ বের করে আনেন একটা টুপির ভেতর থেকে– যে-টুপিটা কিনা একটু আগেই খালি হিসেবে দেখানো হয়েছে– তখন যেমন সবাই অবাক হয়ে যায়, অনেক মানুষই ঠিক সে-রকম অবিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীর বুকে জীবনযাপন করে।

খরগোশের বেলায় আমরা জানি যে জাদুকর আমাদের ধোকা দিয়েছেন। আমরা কেবল জানতে চাইবো কাজটা কীভাবে করা হলো। কিন্তু পৃথিবীর বেলায় ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। আমরা জানি পৃথিবীটা মোটেই হাত সাফাই আর ধোঁকার বিষয় নয়, তার কারণ আমরা এই পৃথিবীরই বাসিন্দা, আমরা এরই অংশ। আসলে আমরা হচ্ছিটুপির ভেতর থেকে টেনে বের করা সাদা সেই খরগোশ। সাদা খরগোশ আর আমাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে খরগোশটা উপলব্ধি করে না যে সে একটা জাদুর খেলায় অংশ নিচ্ছে। আমরা করি। আমরা অনুভব করি রহস্যময় একটা কিছুর আমরা অংশ এবং আমরা জানতে চাইব এগুলো সব কীভাবে কাজ করে।

পুনশ্চ: সাদা খরগোশটার ক্ষেত্রে সেটাকে গোটা মহাবিশ্বের সঙ্গে তুলনা করাই সঙ্গত হবে। আমরা যারা এখানে বাস করি তারা হচ্ছি খরগোশের গায়ের রোমের গভীরে বাস করা আণুবীক্ষণিক পোকামাকড়। কিন্তু দার্শনিকরা সব সময় চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেই মিহি রোম বেয়ে উপরে উঠে সরাসরি জাদুকরের চোখে চোখ রাখতে।

তুমি কি এখনো পড়ছ, সোফি? টু বি কন্টিনিউড..

.

সোফি একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়ে। এখনো পড়ছ? সে তো এমনকী মনেও করতে পারছে না পড়ার সময় সে শ্বাস নেবার ফুরসত পেয়েছিল কিনা।

কে নিয়ে এসেছিল চিঠিটা? হিল্ডা মোলার ন্যাগকে যে জন্মদিনের কার্ড পাঠিয়েছে সে নিশ্চয়ই নয়, তার কারণ কার্ডটাতে স্ট্যাম্প আর পোস্টমার্ক দুটোই আছে। বাদামি রঙের খামটা, ঠিক সাদা দুটো খামের মতোই, হাতে করে এনে রাখা হয়েছিল ডাকবাক্সে।

সোফি ঘড়ি দেখে। তিনটে বাজতে পনের মিনিট বাকি। কাজ থেকে বাসায় ফিরতে এখনো দুঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে তার মায়ের।

হামাগুড়ি দিয়ে আবার বাগানে বেরিয়ে আসে সোফি। ছুটে চলে যায় ডাকবাক্সের কাছে। হতে পারে আরেকটা চিঠি এসেছে।

নিজের নাম লেখা আরেকটা বাদামি রঙের খাম পায় সে ওখানে। এবারে সে চারদিকটায় ভালো করে নজর বুলায়, কিন্তু কাউকে দেখা যায় না। দৌড়ে বনের প্রান্তে চলে যায় সোফি, তাকায় রাস্তাটার দিকে।

কেউ নেই ওখানে। হঠাৎ তার মনে হয় বনের বেশ ভেতরে ডাল ভাঙার একটা শব্দ হলো। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে না সে আর তাছাড়া, পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাকে তাড়া করার কোনো মানেই হয় না।

বাড়িতে এসে ঢোকে সোফি। দৌড়ে চলে যায় সে ওপরতলায় নিজের ঘরে। সুন্দর সুন্দর পাথরভর্তি বড়সড় বিস্কিটের টিনটা নেয়। পাথরগুলো খালি করে ফেলে সে মেঝের ওপর, তারপর বড় খাম দুটো ভরে রাখে টিনের ভেতর। এরপর তাড়াতাড়ি শিয়াকানের জন্যে কিছু খাবার বের করে রাখে সে।

কিটি, কিটি, কিটি।

গুহায় ফিরে দ্বিতীয় বাদামি খামটার মুখ খোলে সে, বের করে আনে নতুন টাইপ করা পৃষ্ঠাগুলো। শুরু করে পড়তে।

.

একটি অদ্ভুত প্রাণী

আবারো শুভেচ্ছা। বুঝতেই পারছ, দর্শনবিষয়ক এই ছোট্ট কোর্সটি সুবিধেজনক কলেবরে হাজির হবে। এবারে আরো কিছু প্রাথমিক কথাবার্তা:

ভালো দার্শনিক হওয়ার জন্যে একমাত্র যে-জিনিসটি আমাদের প্রয়োজন তা হলো বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা– এ-কথা কি আমি বলেছি? যদি না বলে থাকি তাহলে এখন বলছিঃ ভালো দার্শনিক হওয়ার জন্যে একমাত্র যে-জিনিসটি আমাদের প্রয়োজন তা হলো বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা।

শিশুদের এই ক্ষমতাটি আছে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাতৃগর্ভে অল্প কটা মাস কাটিয়ে তারা একেবারে নতুন এক বাস্তবতার মধ্যে এসে পড়ে। কিন্তু তারা যখন বড় হয় তখন এই বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাটি যেন নষ্ট হয়ে যায়। কেন এমনটা হয়? তুমি কি জানো?

একটি সদ্যোজাত শিশু যদি কথা বলতে পারত তাহলে হয়ত যে অসাধারণ বিশ্বে সে এসে পড়েছে সেই বিশ্ব সম্পর্কে কিছু কথা জানাতে পারত। কীভাবে সে চারদিকে তাকায় আর যা কিছু দেখে সেদিকেই কীভাবে কৌতূহলের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দেয় সে তা তো আমরা প্রায়ই দেখে থাকি।

ধীরে ধীরে যখন তার শব্দ সঞ্চয় হতে থাকে তখন সে কুকুর দেখলেই মুখ তুলে বলে ওঠে, ভেউ-ভেউ! তার স্ট্রলারের ভেতর বসে সে লাফিয়ে ওঠে হাত নাচিয়ে, ভেউ-ভেউ ভেউ-ভেউ। বাচ্চাটির এই অতি-উৎসাহে ক্লান্তি বোধ করি আমরা, অর্থাৎ তারা যাদের বয়স আর জ্ঞানগম্যি বেশি। ঠিক আছে, ঠিক আছে, বাবা, ওটা একটা ভেউ, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমরা বলি তাকে। এবার চুপটি করে বসে থাকো।

আমরা মুগ্ধ হই না। কারণ, আগেই কুকুর দেখেছি আমরা।

অসংখ্যবার এই পরমানন্দপূর্ণ কাণ্ড করার পর তবেই হয়ত সে কুকুর দেখলেই আর অমন পাগল হয়ে উঠবে না। নির্লিপ্তভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। হাতি বা জলহস্তী দেখলেও অস্থির হবে না। কিন্তু শিশুটি ভালো করে কথা শেখার অনেক আগেই এবং দার্শনিকভাবে চিন্তা করতে শেখার অনেক আগেই পৃথিবীটা একটা অভ্যাসে পরিণত হবে তার।

আমার মতো যদি জানতে চাও তাহলে বলব, ব্যাপারটা রীতিমত দুঃখজনক।

প্রিয় সোফি, পৃথিবীর ব্যাপারে অতি অভ্যস্ততার কারণে এর সঠিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে যারা অক্ষম হয়ে পড়ে তুমিও যাতে তাদের মতো না হও সেটাই আমার চিন্তার বিষয়। কাজেই স্রেফ সে-ব্যাপারটা একটু যাচাই করে নিতে কোর্সটা শুরু করার আগে আমরা মনে মনে কয়েকটা পরীক্ষা করব:

মনে কর, একদিন তুমি বেড়াতে গিয়েছ। হঠাৎ করে তোমার সামনেই, পথের ওপর একটা মহাকাশযান দেখতে পেলে তুমি। মঙ্গল গ্রহের এক ক্ষুদে প্রাণী মহাকাশযানটা বেয়ে মাটিতে নেমে এসে সোজা তোমার দিকে মুখ তুলে তাকাল…

কী ভাববে তুমি? কিছু মনে করো না, এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কিন্তু কখনো কি তোমার মনে হয়েছে যে তুমি নিজেই মঙ্গল গ্রহের এক প্রাণী?

হঠাৎ করে একটি ভিনগ্রহের প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার সেরকম কোনো সম্ভবনাই তোমার নেই। আমরা এমনকী জানিও না যে অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কি না। তবে একদিন কিন্তু তুমি হঠাৎ করে নিজের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারো আর তখন হয়ত তুমি থমকে দাঁড়াবে এবং সম্পূর্ণ এক নতুন আলোতে নিজেকে দেখবে। বনের মধ্যে ঠিক এভাবেই একবার হেঁটে বেড়ানোর সময়।

তখন তুমি ভাববে, আমি এক আশ্চর্য সত্তা। আমি একটি রহস্যময় প্রাণী।

তোমার মনে হবে তুমি জাদুর ঘোর-লাগা প্রশান্তিভরা এক ঘুম থেকে জেগে উঠছে। তুমি জিগ্যেস করবে, কে আমি? তুমি জানো যে মহাবিশ্বের একটি গ্রহের ওপর তুমি টলমল পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু মহাবিশ্ব নামক জিনিসটি কী?

এভাবে তুমি যদি নিজেকে নিজে আবিষ্কার কর তাহলে বলা যাবে এই কিছুক্ষণ আগে আমরা মঙ্গল গ্রহের যে-প্রাণীটির কথা বললাম সে-রকমই রহস্যময় কিছু আবিষ্কার করবে তুমি। তুমি কেবল মহাশূন্য থেকে আসা একটি প্রাণীকে দেখবে না; তোমার মনের গহীন ভেতরে তুমি অনুভব করবে যে তুমি নিজেই একটি অসাধারণ প্রাণী। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ, সোফি? চলল, মনে মনে আরেকটা পরীক্ষা করা যাক।

একদিন সকালে মা, বাবা আর দুতিন বছর বয়েসী ছোট টমাস মিলে রান্নাঘরে বসে সকালের নাশতা করছে। খানিক পর মা টেবিল ছেড়ে সিংকের কাছে গেলেন আর বাবা –হ্যাঁ, বাবা– সিলিং-এর নিচে ভেসে বেড়াতে লাগলেন টমাসের চোখের সামনে। তো, এ-অবস্থায় টমাস কী বলবে বলে মনে হয় তোমার? হয়ত সে বাবার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে উঠবে, বাবা উড়ছে! টমাস অবশ্যই অবাক হবে, কিন্তু সে তো সে প্রায়ই হচ্ছে। বাবা এতোসব অবাক কাণ্ডকারখানা ঘটান সারাদিন যে নাশতার টেবিলের ওপর দিয়ে এই মামুলি ওড়াওড়ির ব্যাপারটা আলাদাভাবে নজরে পড়ে না টমাসের। প্রতিদিন একটা মজার যন্ত্র দিয়ে বাবা শেভ করেন। কখনো কখনো উঠে যান ছাদে টিভির এরিয়েলটা ঘোরাতে, বা কখনো হয়ত গাড়ির হুডের নিচে মাথাটা গলিয়ে দেন আর যখন সেটা বের করে আনেন, দেখা যায়, তার সারা মুখে কালি।

তো, এবার মা-র পালা। টমাসের কথা শুনতে পেয়ে ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। রান্নাঘরের টেবিলটার ওপর বাবা দিব্যি ভেসে বেড়াচ্ছেন, এই দৃশ্যটা দেখে মা-র কী প্রতিক্রিয়া হবে বলে মনে হয় তোমার, সোফি?

জ্যামের বয়ামটা তার হাত খসে পড়ে গেল আর সেই সঙ্গে তিনি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন। বাবা ভালোয় ভালোয় তার চেয়ারে ফিরে এলে এমনকী খানিকটা চিকিৎসারও দরকার হতে পারে মা-মণির। (এতোদিনে বাবার ভালোভাবে টেবিল ম্যানার্স শেখা উচিত ছিল, নাকি বলল!) সে যাই হোক, এখন বলল, টমাস আর মা একই ঘটনায় এমন ভিন্ন দু-ধরনের আচরণ কেন করল?

এটা আসলে অভ্যাসের ব্যাপার। (খেয়াল করো!) মা জানেন যে মানুষ উড়তে পারে না। টমাস সেটা জানে না। এখনো সে ঠিক নিশ্চিতভাবে জানে না এই পৃথিবীতে মানুষ কী করতে পারে বা পারে না।

কিন্তু খোদ পৃথিবীর ব্যাপারটা কী, সোফি? পৃথিবীটা করে, তোমার কি ধারণা তা সেটা করতে পারে? পৃথিবীটাও কিন্তু মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমরা যে শুধু মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ব্যাপারটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাই তা নয়। নিমেষের মধ্যে গোটা পৃথিবীর ব্যাপারেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা। মনে হয় যেন বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি চলার সময় আমরা বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাটি হারিয়ে ফেলি। আর তাতে করে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু হারিয়ে ফেলি– আর সেই হারিয়ে ফেলা জিনিসটিই ফের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন দার্শনিকেরা। কারণ, আমাদের ভেতরে কোথাও থেকে কিছু একটা বলে ওঠে যে, জীবন এক বিশাল রহস্য। আর ঠিক এই ব্যাপারটিই আমরা উপলব্ধি করেছিলাম অনেক আগে, যখন এই কথাটি আমরা ভাবতে শিখিনি।

.

আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে: দার্শনিক প্রশ্নগুলো আমাদের সবাইকেই ভাবিত করলেও আমরা সবাই কিন্তু দার্শনিক হই না। নানান কারণে বেশিরভাগ লোকই প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে এমনই বাঁধা পড়ে যায় যে বিশ্ব সম্পর্কে তাদের বিস্ময় এসবের আড়ালে চলে যায়। (তারা হামাগুড়ি দিয়ে সেই খরগোশটার রোমের গহীন ভেতরে ঢুকে পড়ে, গুটিসুটি মেরে থাকে আয়েশের সঙ্গে আর তারপর ওখানেই কাটিয়ে দেয় সারাটা জীবন।)

বাচ্চাদের কাছে এই বিশ্ব আর তার সমস্ত কিছুই নতুন; এমন একটা কিছু যা দেখে বিস্ময় জাগে। বড়দের কাছে ব্যাপারটা সে-রকম নয়। বিশ্বটাকে বড়োরা একটা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নেয়।

ঠিক এই জায়গাটাতেই দার্শনিকেরা এক বিরাট ব্যতিক্রম। একজন দার্শনিক কখনোই এই বিশ্বের ব্যাপারে ঠিক পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েন না। তিনি পুরুষ বা নারী যা-ই হোন না কেন, তাঁর কাছে বিশ্বটা খানিকটা অযৌক্তিক বলে ঠেকতে থাকে– মনে হতে থাকে হতবুদ্ধিকর, এমনকী হেঁয়ালিভরা। দার্শনিক আর ছোট্ট শিশুদের মধ্যে তাই একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় খুব মিল। তুমি বলতে পারো যে, সারা জীবন একজন দার্শনিক একটা শিশুর মতোই স্পর্শকাতর রয়ে যান। কাজেই এখন তোমাকে অবশ্যই বেছে নিতে হবে, সোফি। তুমি কি সেই বালিকা যে এখনো জীবন সম্পর্কে বীতস্পৃহ হয়ে পড়েনি? নাকি তুমি এক দার্শনিক যে প্রতিজ্ঞা করবে সে কখনোই তা হবে না?

নিজেকে একটি বালিকা বা একজন দার্শনিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তুমি যদি স্রেফ মাথা ঝাঁকাও, তাহলে বুঝতে হবে এই বিশ্বের ব্যাপারে তুমি এরিমধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ। সাবধান! তুমি কিন্তু পাতলা বরফের স্তরের ওপর দাঁড়িয়ে। রয়েছ। আর সেই কারণেই দর্শনের ওপর এই কোর্সটি তোমাকে দেয়া হচ্ছে, যাতে তোমার কোনো বিপদ না ঘটে। উদাসীন আর নিস্পৃহ মানুষের সারিতে অন্যরা। ভিড়লেও তোমাকে ভিড়তে দেবো না আমি। আমি চাই তুমি একটি অনুসন্ধানী মনের অধিকারী হও।

পুরো কোর্সটিই বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে তোমাকে, কাজেই যদি এটা সম্পূর্ণ না করো তাহলে কোনো টাকা ফেরত পাচ্ছো না তুমি। কোর্সটা মাঝপথে ছেড়ে দেবার ব্যাপারে তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে ডাকবাক্সে তুমি অবশ্যই একটি মেসেজ রেখে দেবে। জ্যান্ত একটা ব্যাঙ হলে খুব ভালো হয়। কিংবা অন্তত সবুজ রঙের কোনো কিছু, নইলে ডাকপিয়ন আবার ভয় পেয়ে যেতে পারে।

তো, সংক্ষেপে ব্যাপারটা হচ্ছে একটা টপ হ্যাঁটের ভেতর থেকে সাদা একটা খরগোশ বের করা হয়েছে। খরগোশটা যেহেতু বিশাল বড় তাই খেলাটা খেলতে বেশ কয়েক বিলিয়ন বছর লেগেছে। খরগোশটার মিহি-মসৃণ রোমের ডগায় জন্ম নিয়েছে সমস্ত মানুষ আর সেখানে বসে তারা ভাবছে কী করে অসম্ভব চাতুর্যপূর্ণ এই কাজটি সম্ভব হলো। কিন্তু তাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেই রোমের আরো গভীরে ঢুকে যেতে থাকে। তারপর সেখানেই থাকে তারা। এমন চমৎকারভাবে থিতু হয়ে যায় যে কখনোই আর সেই পলকা রোম বেয়ে ওপরে ওঠার ঝুঁকি নেয় না। দার্শনিকেরাই কেবল ভাষা ও অস্তিত্বের দূরতম প্রদেশে পৌঁছানোর বিপজ্জনক অভিযানে নেমে পড়েন। তাঁদের কেউ কেউ পিছু হটে যান। কিন্তু বাকিরা মরিয়া হয়ে লেগে থাকেন আর চেঁচাতে থাকেন আরামদায়ক কোমলতার গভীরে বাসরত লোকজনের উদ্দেশে, যারা তাদের উদরপূর্তি করছে মজাদার খাবার-দাবার আর পানীয় দিয়ে।

দার্শনিকরা চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ভদ্রমহিলা এবং দ্রমহোদয়গণ, আমরা মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। কিন্তু নিচের লোকজনের তাতে বয়েই গেল।

তারা বরং বলে ওঠে, যত্তসব আপদ! তারপর ফিরে যায় নিজেদের গালগল্পে: মাখনটা একটু এগিয়ে দেবে, দয়া করে? শেয়ারবাজার আজ কতটা চাঙ্গা হলো? টমেটোর দর কত এখন? শুনেছো, প্রিন্সেস ডায়ানা নাকি আবার মা হচ্ছেন?

সেদিন বিকেলবেলা যখন সোফির মা পরে বাড়ি ফিরলেন, সোফির অবস্থা তখন আসলেই শোচনীয়। রহস্যময় দার্শনিকের পাঠানো চিঠিগুলো টিনের যে-কৌটোর মধ্যে আছে সেটা খুব নিরাপদে গুহার মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সোফি হোমওয়ার্ক শুরু করার চেষ্টা করছে, কিন্তু খানিক আগেই পড়া জিনিসগুলো নিয়ে চিন্তা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি সে।

এর আগে কোনো কিছু নিয়ে এত মাথা ঘামায়নি সে। এখন আর সে ছোট্ট খুকিটি নেই ঠিকই, কিন্তু তাই বলে সে-অর্থে বড়-ও হয়নি সে। সোফি উপলব্ধি করল, মহাবিশ্বের টপ হ্যাটটার ভেতর থেকে যে-খরগোশটাকে বের করে আনা হয়েছিল সেটার আরামদায়ক রোম বেয়ে এরিমধ্যে সে গুঁড়ি মেরে নিচে নামতে শুরু করেছিল। কিন্তু দার্শনিক লোকটি তাকে থামিয়ে দিয়েছেন। উনি –তিনি কি পুরুষ না নারী?– তার ঘাড়ের পেছনে ধরে টেনে তাকে ফের তুলে এনেছেন রোমের ডগায়, যেখানে ছোটবেলায় সে খেলে বেড়িয়েছে। আর সেখান থেকে মিহি-মসৃণ রোমের সবচেয়ে ওপরের ডগা থেকে যেন প্রথমবারের মতো আবার জগৎটাকে দেখছে সে।

দার্শনিক তাকে বাঁচিয়েছেন। কোনো সন্দেহ নেই এ-ব্যাপারে। নিত্যদিনের পরিচিত জীবনযাত্রার নানান তুচ্ছতার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তাকে অজ্ঞাতপরিচয় লোকটি।

পাঁচটার সময় মা বাসায় ফিরতে সোফি তাকে লিভিংরুমে টেনে এনে একটা আর্মচেয়ারে বসিয়ে দিল ধাক্কা দিয়ে। তারপর সে শুরু করল, মা, তোমার কি মনে হয় না বেঁচে থাকাটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার?

সোফির মা এতই অবাক হলেন যে প্রথমে কোনো জবাবই দিলেন না। তিনি বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাঁর মেয়ে সচরাচর তার হোমওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

তিনি বললেন, তা হয় অবশ্য– কখনো, কখনো।

কখনো, কখনো? বুঝলাম, কিন্তু তোমার কি মনে হয় না, বিশ্বটা যে আদৌ টিকে আছে সেটাই একটা আশ্চর্য ব্যাপার?

দ্যাখ, সোফি, এ-সব কথাবার্তা বন্ধ কর।

কেন? তাহলে কি তোমার ধারণা পৃথিবীটা বেশ সহজ আর স্বাভাবিক অবস্থাতেই আছে?

আছেই তো, তাই না? কম-বেশি স্বাভাবিকই তো আছে।

সোফি দেখলো দার্শনিক লোকটার কথাই ঠিক। বড়রা পৃথিবীটাকে বিনা তর্কেই মেনে নিয়েছে। তাদের নীরস অস্তিত্বের মোহমুগ্ধ ঘুমের মধ্যে নিজেদেরকে পুরোপুরি সমর্পিত হতে দিয়েছে তারা।

এই বিশ্বের ব্যাপারে তুমি এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে কিছুই আর অবাক করে না তোমাকে।

এ-সব কী বলছিস তুই?

আমি বলছি তুমি সবকিছুর ব্যাপারেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, একেবারে ভোতা হয়ে গেছে।

আমার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলুক আমি তা চাই না, সোফি?

ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি ঘুরিয়ে বলছি। মহাবিশ্বের টপ হ্যাঁটের ভেতর থেকে যে সাদা খরগোশটা এই মুহূর্তে বের করে আনা হচ্ছে সেটার রোমের অনেক গভীরে তুমি আরাম করে বসে আছে। এক মিনিটের মধ্যেই তুমি চুলোয় আলুগুলো চড়িয়ে দেবে। তারপর খবরের কাগজটা পড়বে আর তারপর, আধঘণ্টার একটা ঘুম দিয়ে উঠে টিভিতে খবর দেখতে বসে যাবে।

উদ্বেগের একটা ছায়া নেমে এলো সোফির মায়ের মুখে। আসলেই তিনি রান্নাঘরে গিয়েছিলেন, আলুগুলো চুলোয় চড়িয়ে দিয়ে খানিক পর বসার ঘরে ফিরে এসেছেন। তো, এবার তিনিই সোফিকে ঠেলে একটা আর্মচেয়ারে বসিয়ে দিলেন।

বললেন, একটা ব্যাপারে তোর সঙ্গে কথা বলতেই হচ্ছে আমাকে। তাঁর গলা শুনেই সোফি বুঝে গেল জরুরি কোনো বিষয়ে কথা বলবেন মা।

তুই ড্রাগ-ট্রাগ নিতে শুরু করিসনি তো, মা?

সোফি প্রায় হেসে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু কেন প্রশ্নটা করা হচ্ছে সে বুঝতে পারল। সে বলল, তুমি কি পাগল হলে? প্রশ্নটা করে আরো বোকা-ইসাজলে।

ড্রাগ বা খরগোশ নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় আর কোনো কথা হলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *