1 of 2

০২. জয়িতার সঙ্গে কথা

জয়িতার সঙ্গে কথা বলে সুদীপ ব্যালকনিতে এল।

ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা বেশ চওড়া। যেহেতু রাত এখন বেশ তাই লোজন নেই বললেই চলে। ঠাকুরের পানের দোকানটা অবশ্য খোলা। আশেপাশের বাড়ির রাধুনেরা এখন ওখানে আড্ডা মারছে। ও-পাশের রকটায় দুজন দাবা খেলছে রাস্তার আলোয়। এ ছাড়া আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই। মাঝে মাঝেই হুস-হাস গাড়ি ছুটে যাচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। সুদীপ ভাল করে লক্ষ করল। না, কোনও অপরিচিত মুখ সে দেখতে পেল না। কেউ সন্দেহজনক ভঙ্গিতে এই বাড়ির দিকে তাকিয়ে বসে নেই।

অথচ তার খোঁজে নাকি দুবার লোকটা এসেছিল। কার্তিকদার বর্ণনা মত সে কোন চেনা লোকের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারছে না। কার্তিকদার বয়স হয়েছে, ওলট-পালট হয়ে যায় সব। কিন্তু দুবারে বলার সময় যে মিলগুলো পেয়েছে সেরকম কোনও মানুষকে চেনে না সুদীপ। তাছাড়া লোকটা এসেছিল তখন যখন বাড়িতে সে ছিল না, বাবাও নয়। দুবারই। অস্বস্তিটা লেগে আছে শোনার পর থেকেই। আনন্দর হোস্টেলেও একই কাণ্ড ঘটেছে। আনন্দ আজ রাস্তায় হাঁটার সময় বারংবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে। তার সন্দেহ ছিল কেউ বোধহয় অনুসরণ করছে। কিন্তু সুদীপ বলেছিল তারা এমন কোনও কাজ করেনি যে এমন কাণ্ড ঘটবে, অথচ বাড়িতে এসে কার্তিকদার কাছে শোনার পর আনন্দর কথা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। এত রাত্রে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন উপায় নেই। আনন্দর হোস্টেলে ফোন থাকলেও সুপার এত রাত্রে ঢেকে দেবে না। কল্যাণের বাড়িতে টেলিফোন নেই। জয়িতা তো নিজেই করল। সুদীপ আশঙ্কা করেছিল ওর ওখানেও বোধ হয় কেউ হানা দিয়েছে! জয়িতার যে সমস্যা সেটা ওর অনেকদিনের দেখা। এটা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি দরকার। তবে এটা খুব চমকপ্রদ ঘটনা মানতেই হবে। যে মহিলাটি জয়িতাকে ফোন করে বলেছেন তিনি আজ ওর বাবার সঙ্গে শুয়েছেন তিনি নমস্যা। ওঁকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। অবশ্য যদি ভদ্রমহিলা হন।

জয়িতার বাড়ির আবহাওয়াটা তো এখন কলকাতার ওপরমহলে উঠে যাওয়া বা উঠতে চাওয়া পরিবারের। ওখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে যখন জয়িতা তখন ওদের জন্যে এত আপসেট হয় কেন ও মাঝে মাঝেই কে জানে! একমাত্র ওই একটি ব্যাপার ছাড়া জয়িতার কোন ব্যাপারে জড়তা নেই। জড়তা? সুদীপ শব্দটা নিয়ে দুচারবার নাড়াচাড়া করল। জড়তা তার নিজের নেই? অজস্র ব্যাপারে অকারণ আড়ষ্টতা আসে কেন?

সুদীপ নিজের ঘরে ফিরে এল। কীটসব্যাগ নয়, ত্রিপলের একটা লম্বা ঝোলা আছে সুদীপের। দীপু মামা এনে দিয়েছিল জার্মানি থেকে। বেশ মজবুত, দেখতেও খারাপ নয়। এতকাল সেটা পড়ে থাকত চ্যাপটা হয়ে, এখন ফেঁপে ফুলে চমৎকার দেখাচ্ছে। বেশ কিছুকাল যাতে স্বচ্ছন্দে থাকা যায় এমন জিনিসপত্র ওতে ভরা হয়ে গেছে। যে কোনও সময় নোটিস এলেই বেরিয়ে পড়তে পারে সুদীপ। হাওয়া ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

এই বাড়িটা সুদীপের বাবা অবনী তালুকদারের। হাইকোর্টের নামজাদা উকিল। বিশাল বাড়িটায় তিনজন মানুষকে নিয়ে বেশ কয়েকজন ঝি-চাকর আরাম করে আছে। খাবার টেবিল ছাড়া সুদীপের সাহায্যে ওরা তেমন লাগে না। এই যে আজ একটা লোক দুবার এল, এরা তার নাম-ঠিকানা জেনে নেওয়ার বুদ্ধিটুকুও ধরে না। সুদীপের অস্বস্তি কিছুতেই কাটছিল না।

অবনী তালুকদার সুদীপের সঙ্গে কথা বলেন না। মাস ছয়েক হল বাক্যালাপ বন্ধ। সুদীপ আশঙ্কা করেছিল তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হবে কিন্তু অবনী তালুকদার সেটা বলেননি। তবে সমস্ত খরচ-খরচা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। সুদীপের অবশ্য এখন পর্যন্ত তাতে কিছু আটকাচ্ছে না। খরচ বলতে সিগারেট, বাসভাড়া, চায়ের দাম আর কলেজের মাইনে। জমানো টাকায় সেটা চলে যাচ্ছে আপাতত। তবে সে নিজে যেমন, তেমন অবনী তালুকদারও চেষ্টা করেন যাতে পরস্পরের মুখোমুখি না হন। ওকালতি যারা করেন তারা তো বুদ্ধিমান হবেনই। অবনী তালুকদার তার চেয়ে বেশ বেশি কিছু মাথায় ধরেন। এমন বিষয়াসক্ত মানুষ সুদীপ গল্প-উপন্যাসেও পড়েনি। আর সেই আসক্তিতে ভদ্রলোক একটার পর একটা একনম্বর দুনম্বর কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। তেজারতি কারবার তো আছেই, ভদ্রলোকের মনে দয়া-মায়া-ভালবাসা বলে কোন বস্তু নেই, ছিল কিনা তাতেও সন্দেহ। তবে কর্তব্যজ্ঞান ছিল। ছয় মাস আগের প্রতিটি সকালে তিনি সুদীপকে প্রশ্ন করতেন, সব ঠিক আছে? আমি চাই তুমি বড় হয়ে আমার প্র্যাকটিশে আসবে। তোমার জন্যে যে সোনার খনি রেখে যাচ্ছি তা কোনও বাপ তার ছেলের জন্যে রেখে গেলে ধন্য হত সেই ছেলে। যাও। একদম মালা জপার মত একই শব্দাবলী বোজ আওড়ে যাওয়া। কথাগুলো শোনার সময় শেষের দিকে হাসি পেত সুদীপের। ছয় মাস আগে সেটা চুকে গেল। চুকিয়ে দিল সুদীপ।

অবনী তালুকদার আর একটি কর্তব্য নিয়মিত করে থাকেন। হাইকোর্টের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পর প্রথমেই চলে যান স্ত্রীর দরজায়। ঘরে ঢোকেন না, যেখানে দাঁড়ান সেখান থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। বেশির ভাগ দিনই নার্স জবাব দেয়। সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান তিনি নিজের ঘরে। হ্যাঁ, স্ত্রীর জন্যে অবনী তালুকদার নার্স রেখেছেন। আয়া রাখলে অনেক কম খরচ হত। প্রত্যেক সপ্তাহে ডাক্তার আসেন। ডাক্তারের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করেন। স্ত্রীর শরীরের জন্যে পয়সা খরচ করতে কোনদিন কার্পণ্য করেননি। এসবই তার কর্তব্যপালনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত হবে।

আজ রাত্রে অবনী তালুকদার ফিরবেন না। খবরটা জেনেছে সুদীপ কার্তিকদার কাছ থেকে। সচরাচর অত্যন্ত লাভজনক মামলা না পেলে কলকাতা ছেড়ে নড়েন না অবনী তালুকদার। আজ নিশ্চয়ই শিকারটা বড় মাপের, না হলে পাটনায় যাবেন কেন? অতএব সেই দিক দিয়ে বাড়িটা খালি। অবনী তালুকদার থাকলেও কোন অস্তিত্ব বোঝা যেত না। বরং ঝি-চাকরদের ওপর হুকুমজারি আছে কেউ যেন গলা তুলে কথা না বলে। সব সময় একটা শান্ত পরিবেশ বাড়িতে পেতে চান অবনী তালুকদার। ঠিক দশটায় সদর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। সুদীপের অবশ্য ইদানীং তাতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। সদর বন্ধ হয়ে গেলে সুদীপ পেছনের পাঁচিল টপকে ভেতরে চলে আসে। কার্তিকদার দরজা খোলাই থাকে। সেইটে দিয়ে দোতলায় উঠে আসতে কোন অসুবিধে নেই। অবনী তালুকদার যে ব্যাপারটা জানেন না, তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এই বাড়ির প্রতিটি ইট কাঠ যে কিভাবে আছে সে হিসেব তিনি নিত্য রাখেন।

সুদীপ দোতলার হলঘরে এল। ঝি-চাকররা এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়েছে। মাঝে মাঝে সামনে রাস্তায় ছুটে যাওয়া গাড়ির শব্দ ছাড়া এই বাড়ি এখন একদম চুপচাপ।

মায়ের ঘরটা একদম কোণায়। দরজায় এসে দাঁড়াতেই হালকা নীল আলোয় ঘরটাকে দেখতে পেল। মা শুয়ে আছেন খাটে। একটা হালকা চাদর তার গলা পর্যন্ত ঢাকা দেওয়া। যেহেতু এখন মায়ের শরীর ওপাশ-ফেরানো তাই এখান থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না।

সুদীপ কয়েক পা এগিয়ে এসেই থমকে দাঁড়াল। মায়ের বিছানার ওপাশে একটা লম্বা ডেক-চেয়ারে শুয়ে আছেন একজন মহিলা। মাথাটা এক পাশে হেলানো, চোখ বন্ধ। কোলের ওপর একটি রঙিন সিনেমা পত্রিকা খুলে উপুড় করে রাখা। সেখানে বোম্বের একজন সুন্দরী শরীর আধখোলা করে মদির হাসছে। সুদীপ বুঝল এই নার্সটি নতুন। বাবার নির্দেশে মায়ের নার্স প্রতি মাসেই বদলে যায়। এ ব্যাপারে অবনী তালুকদারের থিয়োরি হল, অসুস্থ মানুষের সেবা কেউ দীর্ঘকাল করলে একঘেয়েমি আসতে বাধ্য এবং সেটা এলে সেবায় গাফিলতি দেখা দেবে। অতএব নতুন নতুন নার্স চাই। এই মহিলাটিকে সুদীপ আগে দ্যাখেনি। শেষবার এই ঘরে এসেছিল সে তিনদিন আগে! মা অসুস্থ হওয়ার পর নিত্য দুবেলা আসত সে। কিন্তু এখন! সুদীপ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। নিজের এই পরিবর্তনের পেছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পায়নি। হয়তো দীর্ঘকালীন অসুস্থতা এক ধরনের বিরক্তি উৎপাদন করে কিংবা প্রতিনিয়ত একই যন্ত্রণার প্রকাশ দেখে দেখে তার গুরুত্ব কমে যায়। আর যে কারণটা সেটা তো ছয় মাস আগেই ঘটেছিল। মা কখনও প্রতিবাদ করতে শেখেননি। তিনি যতই অত্যাচার করুন, স্বামীর সামনে চোখ তুলে রূঢ় কথা বলা ধৃষ্টতা, মায়ের এই টিপিক্যাল দাসসুলভ মনোভাব সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। মায়ের সঙ্গে একসময় এই ব্যাপারে অনেক কথা বলেও সে একটি জবাব পেয়েছে, কি হবে, আমার তো যা হবার তা হয়েই গেছে, মিছি মিছি ওই মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে কি হবে! শুরুতেই যখন সব মেনে নিয়েছি–।

মাকে কখনও শ্রদ্ধা করেনি সুদীপ। মাকে সে ভালবাসত একটা নরম স্নেহপ্রবণ অনুভূতির জন্যে। অসহায় মানুষটি জানেন না তার গণ্ডি কি, নিজেকে উজাড় করে দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়ান, দেওয়াটা ঠিক হল কিনা, যদি সে রাগ করে। এমন মানুষের প্রতি মায়া জন্মায়, মায়া থেকে ভালবাসাও আসে কিন্তু শ্রদ্ধা যদি তার সঙ্গে না মেশে তাহলে সেই ভালবাসা একসময় ফিকে হয়ে যেতে বাধ্য। মায়া আর করুণা কি এক? সুদীপ জানে না। কিন্তু মায়ের জন্যে তার কষ্ট হত। অবনী তালুকদারের বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে মা কেন এমন কুঁকড়ে থাকবেন?

কিন্তু এ তো গেল ভেতরের ব্যাপার। মায়ের শরীর নিয়ে প্রাথমিক দুশ্চিন্তা এবং কষ্টের সময়টুকু পার হয়ে গেলে সে যখন জেনেছিল আর কখনও সুস্থ হবার সম্ভাবনা নেই তখন থেকেই নিজের অজান্তে মনের রাশ ঢিলে হতে শুরু করেছিল। ঠিকঠাক চিকিৎসার নামে তদারকি চলছে, নার্স আছে, ব্যাস! মায়ের যন্ত্রণাগুলো, শরীরের বিভিন্ন উপসর্গগুলো বারংবার একই চেহারা নিয়ে আসছে ফিরে যাচ্ছে। এ থেকে যখন আর কোন পরিত্রাণের আশা নেই তখন অনুভূতির চামড়া একটু একটু করে মোটা হয়ে গেল। একমাত্র মৃত্যু-সংবাদ ছাড়া মা আর কোন আলোড়ন তুলতে পারবেন না এবং সেটাও একটা মুক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ার মত। সত্যি বড় কষ্ট পাচ্ছিল। এভাবে বেঁচে মরে থাকার চাইতে অনেক আগেই চলে গেলে ঢের বেশি বেঁচে যেত।

অতএব, ব্যাপারটা এমনভাবে ভেবেছে সুদীপ। প্রিয়জন সে যতই প্রিয় হোক না কেন, অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং সে অসুখে জীবনহানির সম্ভাবনা থাকলে তো বটেই, মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিকারের জন্যে। হয়তো শেষ সম্বল ব্যয় করতেও কার্পণ্য করে না। কিন্তু যদি সেই অসুস্থতা দীর্ঘকালীন হয়, যদি কোনদিন সুস্থ হবার সম্ভাবনা না থাকে তখন একসময় দায় বলে মনে হতে বাধ্য। কেউ মুখে বলেন, কেউ ব্যবহারে প্রকাশ করে ফেলেন, কেউ বলেন না বোঝেন না কিন্তু মনে মনে জানেন মুক্তি পেলে ভাল হত।

সুদীপ খাটের এ-পাশে চলে এল। যত দিন যাচ্ছে তত মায়ের শরীর ছোট হয়ে আসছে। মুখ বসে গিয়েছে, চোখ কোটরে। কিন্তু চুলগুলো প্রায় একইরকম আছে। হয়তো নিয়মিত স্নান হয় না বা তেল মাখানো সম্ভব হয়নি বলে ফুলে-ফেঁপে একাকার। একটা মানুষের চেহারা পালটাতে পালটাতেও তো কিছুটা থেকে যায়। সেই থেকে যাওয়া শরীর নিয়ে মা এখন শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। মাঝে মাঝে শরীরটা কাঁপছে।

বসুন।

সুদীপ চমকে ফিরে তাকাল। মহিলার মুখে একটু বিব্রত হাসি, হাত বাড়িয়ে ডেক-চেয়ার দেখিয়ে দিলেন তিনি। সুদীপ মাথা নাড়ল, কেমন আছেন এখন?

আছেন এই পর্যন্ত। সমস্ত শরীরে বেডসোর হয়ে গেছে। আমি পাউডার দিচ্ছি কিন্তু আসলে উনি যদি বসতেও পারতেন তাহলে।

বেডসোর! সে তো সেরে গিয়েছিল।

প্রথমবার হয়ে সেরে যায়। কিন্তু আবার হলে সামলানো মুশকিল। সেইটেই হয়েছে। দেখবেন? সুদীপ কিছু বলার আগেই মহিলা এগিয়ে গিয়ে মায়ের শরীর থেকে চাদর সরিয়ে নিল খানিকটা। আর চমকে উঠল সুদীপ। হাঁটুর ওপর থেকে কোমর পর্যন্ত চাপ চাপ শাল ঘা বীভৎস হয়ে আছে।

মহিলা চাদর নামিয়ে দিলেন। এ-পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রেখেছি কারণ ওদিকটায় সামান্য কম। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে রাখাও যাবে না। ওঁর যে কি যন্ত্রণা হচ্ছে কি বলব।

ডাক্তারবাবুকে বলেছেন?

আমি আসার পর একবারই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দিনে যিনি থাকেন তিনি বললেন, ডাক্তারবাবু বলেছেন ওষুধ দিতে। বিশেষ কিছু করার নেই। আপনি বসুন না। এবার মহিলা আর একটা চেয়ার এনে কাছে রাখলেন।

সুদীপ বসল। নার্স মহিলা বোধহয় অনেকক্ষণ কথা না বলে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন এবং কথা বেশি বলাই বোধহয় স্বভাব, খুব যন্ত্রণা পাচ্ছেন। এরকম কেস তো আমি আগে দেখেছি। কেউ কেউ বছরের পর বছর কষ্ট পেয়ে পেয়ে তবে যেতে পারেন।

উনি আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন?

হ্যাঁ। তবে স্পষ্ট বলতে পারেন না তো। খনখনে হয়ে গেছে গলার স্বর। আর কথা বলতেও কষ্ট হয়। তবে এর মধ্যে মজার কথাও বলেছেন।

কিরকম? সুদীপ অবাক হল।

এই তো আজ বিকেলে এলে বললেন, তুমি এলে ভাল লাগে। বেশ দেখতে ভাল তুমি। আমি মনে মনে হেসে বাঁচি না। আমাকেও নাকি ভাল দেখতে।

সুদীপ ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। একটু লাজুক অভিব্যক্তি, চোখে চোখ পড়তে মুখ নামালেন। মধ্যতিরিশে শরীর যথেষ্ট যৌবনবতী। সে বলল, মাকে কি ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ। না হলে যে ঘুমুতেই পারেন না। এত যন্ত্রণা নিয়ে বিনা ওষুধে কি ঘুমানো যায়?

ও! সুদীপ বুঝল এখন এই ঘরে বসে কোনও লাভ নেই। নিশ্চয়ই ঘুমের ওষুধের পরিমাণটা বেশি না হলে অমন নিঃসাড়ে পড়ে থাকতে পারে না কেউ। মানুষের জীবনীশক্তি কখনও কখনও বিস্ময় ছাড়িয়ে যায়। তিনবার সিরিয়াস অ্যাটাক হয়ে গেছে। একসময় ব্রেন কাজ করছিল না, সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছিল, ম্যাসেজ করে চিকিৎসায় থেকে থেকে শরীরে সামান্য সাড় এল, মুখে আবার কথা ফুটল। কিন্তু প্রেসার নিয়ত এমন কম বেশি হতে লাগল যে চতুর্থ অ্যাটাকের জন্যে তৈরি ছিল ওরা। এবং সেটাই শেষবার একথা সবাই জানত। তার বদলে ব্লাড ইউরিয়া বাড়ল। যাবতীয় রোগ একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখন সব ছেড়ে শুধু বেডসোর নিয়ে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এক একটা রাত আগে এমন কেটেছে যে ভোর হবার আগেই মা চলে যাবেন বলে মনে হত। অথচ এইভাবে বেঁচে মরে থাকতে হচ্ছে।

সুদীপ উঠল, আপনি খাওয়া-দাওয়া করেছেন?

হ্যাঁ। ফ্ল্যাক্সে চা রেখেছি, খাবেন?

না। আপনি আর বসে থেকে কি করবেন! উনি যখন উঠবেন না তখন শুয়ে পড়ুন।

আমাদের কি শুলে চলে। পেসেন্ট ঘুমের ঘোরে পেচ্ছাপ পায়খানা করে ফেলতে পারে। জেগে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। মহিলা হাসলেন।

সুদীপ মনে মনে বলল, সে তো দেখতেই পেয়েছি ঘরে ঢোকার সময়। সে যাওয়ার সময় বলল, ঠিক আছে। কাল সকালে এসে মায়ের সঙ্গে কথা বলব।

মহিলা বললেন, যদি কোনও কারণে রাত্রে ঘুম ভাঙে তাহলে খবর দেব?

কোন জরুরি ব্যাপার নয় তবু সুদীপ না বলতে পারল না।

বাইরে বেরিয়ে এসে সুদীপের দৃষ্টি গেল অবনী তালুকদারের ঘরের দিকে। দরজাটি বন্ধ। পর্দা ঝুলছে। দরজায় তালা না দিয়ে কি অবনী তালুকদার পাটনায় যাবেন? বিশ্বাস হয় না। সুদীপ এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা সরাল। তার অনুমানে ভুল হয়নি। পিতৃদেব এত বড় ভুল করবেন না। অভিজ্ঞতা থেকেই তো মানুষ শিক্ষা নেয়।

অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষালাভ? সুদীপের ঠোঁটে হাসি ফুটল। অসম্ভব। কোনদিন কি কেউ নেয়? নেওয়ার চেষ্টা করে মাত্র। নিতে গেলে অনেক কাজ পৃথিবীতে কেউ কোনদিন শেষ করতে পারত না। সাতষট্টি থেকে একাত্তরে এদেশে যে উদ্যোগের জন্ম এবং মৃত্যু হয়েছিল তা থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে এদেশে কেউ কখনও বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষের চেহারা পালটাতে চাইবে না। কিন্তু–।

সুদীপের খুব ইচ্ছে করছিল তালাটা ভাঙতে। অবশ্য তালা ভাঙলেই কিছু পাওয়া যাবে? কিছুদিন আগে একদিন সকালে অনী তালুকদার যখন কোর্টে বেরুবেন, সুদীপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ, ঠিক তখনই বাড়িটা ঘিরে ফেলেছিল পুলিশের সাহায্যে আয়কর বিভাগের লোকজন। খুব কৌতুক বোধ করছিল সুদীপ যখন আয়কর অফিসার বলেছিলেন বাড়ির সবাইকে একটি ঘরে অপেক্ষা করতে যতক্ষণ অনুসন্ধান শেষ না হয়। সেই সময় তদন্তকারী অফিসার জানতেন না, একজনের পক্ষে বিছানা ছেড়ে ওঠাই সম্ভব নয়। অবনী তালুকদার খুব চেঁচামেচি করেছিলেন। ব্যাপারটা আদালতে তুলবেন বলে হুমকিও দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা এত নির্দিষ্ট আইনী যে তাকে সব হজম করতে হয়েছিল। বাড়ি ঘেরাও হচ্ছে দেখে প্রথমে সুদীপ নিজেও ঘাবড়ে গিয়েছিল। যদিও ওই সময় সে এমন কিছু করেনি যে তার ওপর পুলিশের নজর পড়বে। কিন্তু যোগাযোগ থাকার অভিযোগ তো থাকতেই পারে। একাত্তরের অনেক গল্প শোনা এবং পড়া ছিল। চকিতে মনে হয়েছিল পেছনের পথ দিয়ে পালাবে কিনা? সেইসময় উত্তেজিত হয়ে অবনী তালুকদারকে ছুটে আসতে দেখেছিল সে। কপালে ঘাম জমেছে। মুখের রঙ একেবারে কালো। তাকে দেখে ঘন ঘন নিঃশাস ফেলতে ফেলতে বললেন, খোকা, আমাকে তুই বাঁচা–সেভ-মি! ইনকামট্যাক্স রেইড করেছে।

এইরকম চেহারায় অবনী তালুকদারকে দেখে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না সুদীপ। তবু জি। করেছিল শক্ত হয়ে, আমি কি করব?

এই ব্যাগটাকে সরিয়ে ফেল। ওরা যেন টের না পায়। কুইক!

কি আছে ওতে?

যাই থাক, তোমার তাতে কি? ব্যাগটাকে লুকিয়ে রাখ, ওরা চলে গেলে ফেরত চাই। ছেলের হাতে সেটাকে ধরিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে গেলেন অবনী তালুকদার। নিচে তখন হৈচৈ হচ্ছে। অবনী তালুকদার অফিসারদের ওপর তড়পাতে শুরু করেছেন। সুদীপ ব্যাগটা খুলতে গিয়েও খুলল না। কিভাবে ব্যাগ পাচার করবে সেটা অবনী বলেননি। পেছনের দরজায় তো পুলিশ থাকতে পারে। সে ব্যাগটাকে তুলে হলঘরের টেবিলের উপর রেখে দিল। এবং তারপরেই অফিসাররা উঠে এলেন। একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি?

আমি সুদীপ।

অবনীবাবুর ছেলে?

নীরবে মাথা নেড়েছিল সুদীপ। এখন হলে কি করত সে জানে না।

অফিসার বললেন, আপনাদের বাড়িটা সার্চ করব। মিস্টার তালুকদারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করলে খুশি হব। তারপর সহকারীকে বললেন, এই ঘরটা তত বেশ ফাঁকা। বাড়ির সবাইকে এখানেই আসতে বলুন। দেখবেন কেউ যেন এই ঘর ছেড়ে না যায়!

সুদীপ চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তারপর নিচ থেকে ঠাকুর চাকর সমেত অবনী তালুকদার উঠে এলেন, দিস ইজ টুমাচ বাক্যটি উচ্চারণ করতে করতে। দ্বিতীয় অফিসার তাকে হুকুম শোনাতেই তিনি সুদীপের পাশের চেয়ারে বসে রুমালে মুখ মুছলেন। খুবই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। কাজের লোকেরা ঘরের অন্য কোণে জড়ো হয়েছিল চুপচাপ। রুমালটা পকেটে পুরে সামনে তাকাতেই স্থির হয়ে গেলেন এক মুহূর্তে অবনী তালুকদার। তার চোখ একবার ছেলে আর একবার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ব্যাগটার মধ্যে ঘুরল। সুদীপ দেখল উনি উঠতে গিয়েও সামলে নিলেন। সমস্ত মুখ মড়ার মত সাদা হয়ে গেছে। সেই অবস্থায় চাপা গলায় গর্জন করলেন যেন, ওটা ওখানে রেখেছ কেন?

রাখার জায়গা পাইনি। ঠোঁট না নেড়ে শব্দ তিনটে উচ্চারণ করল সুদীপ।

স্কাউন্ড্রেল! ইউ ওয়ান্ট টু কিল মি? ব্যাগটাকে সরাও-ওঃ ভগবান।

সুদীপ দেখল অফিসাররা টেবিলটার পাশেই দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা সেরে নিচ্ছেন কি ভাবে কাজ শুরু করবেন। ওরা কেউ ব্যাগটার কথা খেয়াল করছেন না। অবনী তালুকদারের চোখের দৃষ্টি আঠার মত ব্যাগটার গায়ে লেগে আছে। সুদীপ চাপা গলায় বলল, ওইভাবে দেখলে ওরা বুঝতে পারবে।

অবনী সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফেরালেন। তারপর বললেন, আমার বুকে ব্যথা করছে।

সুদীপ বাবার দিকে তাকাল। তারপর গলা তুলে অফিসারকে খবরটা জানাল। ভদ্রলোক দ্রুত ছুটে এলেন, হোয়াটস দ্য ট্রাবল? আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?

হ্যাঁ বলতে গিয়ে না বললেন অবনী, বোঝা গেল। তারপর বললেন, ঠিক আছে।

অফিসার জানালেন, আপনার মেডিক্যাল হেলপ দরকার হলে বলবেন।

ওঁরা সরে গেলে অবনী চাপা গলায় বললেন, সোয়াইন!

সুদীপ নীরবেব মাথা নাড়ল, অবশ্যই।

ধুন্দুমার কাণ্ড চলল। অনুসন্ধানকারীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেল। অবনী তালুকদারের ঘর থেকে সত্তর হাজার টাকার নোট পাওয়া গেল। এবং প্রচুর কাগজপত্র। সুদীপ লক্ষ্য করল অফিসাররা এই মুহূর্তে প্রশ্ন করছেন না কিছু। তারা প্রাপ্ত জিনিসগুলোর একটা তালিকা তৈরি করছেন মাত্র। এইসময় অবনী তালুকদার চিৎকার করে উঠলেন, ওহ নো। ওগুলো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনারা সবার সামনে টেনে আনতে পারেন না!

অফিসার নির্লিপ্ত গলায় বললেন, আপনার যেসব ব্যক্তিগত জিনিসের সঙ্গে গোপন সম্পদের কোন যোগাযোগ নেই সেগুলোয় আমরা হাত দিচ্ছি না মিস্টার তালুকদার। কিন্তু খুজতে হলে তো এগুলোতে হাত দিতেই হবে।

তিনটে অ্যালবাম পড়ে আছে মাটিতে। একবার তাকিয়ে সুদীপ মাথা নামিয়ে নিল। মেয়েটাকে সে চেনে। এই বাড়িতেই কাজ করত। জন্মদিনের পোশাকে অবনী তলুকদার ওর ছবি কবে তুললেন কে জানে! কিন্তু এই মেয়েটিকে নিয়ে তো কোন গোলমাল হয়নি। যাকে নিয়ে গোলমাল হয়েছিল, তারপর এই বাড়িতে আর কোনও অল্পবয়সী মেয়েকে কাজে রাখা হয়নি। তার আগে প্রায় প্রতি মাসে একটা করে ঝি আসত আর যেত। ঘটনার কথা মনে পড়তেই শরীর গুলিয়ে উঠল সুদীপের। অবনী তালুকদারের পাশে বসতে প্রবৃত্তি হচ্ছিল না।

 

বাড়িতে এসেই শুনেছিল মা খুব অসুস্থ। পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। নার্সিং হোম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন বেশ রাত। অন্তত নার্সিং হোমে ঢোকার অনুমতি পাওয়ার মত সময় নয়। গিয়ে শুনল মাকে আই সি ইউনিটে রাখা হয়েছে। অবনী তালুকদার ভিজিটার্স রুমে বসেছিলেন, সে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক মুখ নিচু করেছিলেন। সুদীপ জিজ্ঞাসা করেছিল, কি হয়েছে মায়ের?

সেরিব্রাল। বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে বলা যাবে না।

কেন? সেরিব্রাল হল কেন?

খেঁকিয়ে উঠেছিলেন অবনী তালুকদার ওই সময়েও, সেরিব্রাল হয় কেন জানো না? গো অ্যান্ড আস্ক দ্য ডক্টর। অশিক্ষিত!

সুদীপ হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপর সরে এসেছিল। বাবার সঙ্গে তার কোনদিনই ভাবভালবাসা তৈরি হয়নি। একটা সময় পর্যন্ত সে মায়ের সঙ্গেই শুতে। তারপর তাদের তিনজনের তিনটে আলাদা ঘর হয়েছে। মায়ের সঙ্গে বাবারও কথাবার্তা যতটা সম্ভব না হলেই নয়। তাও বাবা প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মা জবাব দিতেন। সেই রাত্রে মায়ের সঙ্গে ওরা দেখা করতে দেবে না জানার পর সুদীপ বাড়ি ফিরে এসেছিল। অদ্ভুত একটা কান্না সমস্ত শরীরে পাক খাচ্ছিল সে-সময়। জ্ঞান হবার পর ওরকম অনুভূতি তার সেই প্রথম। মায়ের কেন সেরিব্রাল হল? মা তো কখনই উত্তেজিত হতেন না। মানুষের ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে, দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলে, দুশ্চিন্তা থাকলে অথবা উত্তেজনার কারণ ঘটলে এই ব্যাপারটা হয়ে থাকে বলে জেনেছে সে। ওরকম ঠাণ্ডা নিরীহ এবং ব্যক্তিত্বহীনা মহিলার সঙ্গে ব্যাপারটা মিলছে না কিছুতেই।

সেই রাত্রে বাড়িটাও ছিল থমথমে। দরজা খুলে কার্তিকদা শুকনো মুখে প্রশ্ন করেছিল, মা কেমন আছেন?

সুদীপ কার্তিকদার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, কি হয়েছিল?

কার্তিকদার মাথাটা নিচু হয়েছিল, আমি জানি না!

তুমি জানো। কার্তিকদা কিছু চেপে যাচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হল না সুদীপের।

না আমি কিছু জানি না। সামনে থেকে দ্রুত সরে গেল কার্তিকা।

দোতলায় উঠে মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরটা খালি। এমন কিছু চোখে পড়ল না যা সন্দেহজনক। বাবার ঘরে ঢুকল সে। এবং সেখানেই মেয়েটিকে দেখতে পেয়েছিল সে। অবনী তালুকদারের খাটের পাশে মোজায়েক মেঝেতে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। দোতলার ফাইফরমাশ খাটার জন্যে মেয়েটিকে রাখা হয়েছিল। চেহারায় সৌন্দর্য শব্দটির কোন ছায়া নেই। যৌবনও কখনো কখনো কুৎসিত হয়, এই মেয়েটিকে না দেখলে সে জানত না। ব্যাপারটা সত্যি অত। এই বাড়ির দোতলায় যারা এতকাল কাজ করে গেছে তাদের বয়স যোলো থেকে তিরিশের মধ্যে এবং কেউ দেখতে সামান্য ভালও নয়। এই মেয়েটি তার ঘরে যেত ঝাট দিতে এবং ঘর মুছতে। কোনদিন কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি সে। একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, এত খারাপ দেখতে মেয়ে এই বাড়িতে আসে কেন মা? মা উত্তর দেননি। অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতেন না।

কি হয়েছিল এই মেয়েটা জানতে পারে। সুদীপ একটু গলা তুলে মেয়েটিকে ডাকল, এই, শুনছ? এই যে!

ডাক শুনে মেয়েটি ধড়মড়িয়ে উঠল। তারপরে বোবা চোখে সুদীপের দিকে তাকাল। এবং তখনই সুদীপ দেখল মেয়েটির কালো গালে চোখের জলের দাগ শুকিয়ে আছে এখনও। এবং আচম্বিতে মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ল সুদীপের পায়ের ওপর, আমি কোন দোষ করিনি, আমি আমি, আমাকে, আমার এখন কি হবে?

হতভম্ব হয়ে পড়েছিল সুদীপ, কি হল? কি হয়েছে তোমার?

মেয়েটি বারংবার কথা বলতে যাচ্ছে কিন্তু কান্নার দমক তাকে থামিয়ে দিচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, মায়ের কি হয়েছিল?

বাবা আমাকে–, মা তখন এসে পড়েছিল।

সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ, সুদীপ বুঝতে পারছিল না সে কি করবে! ঠিক সেই সময় পেছন থেকে অবনী তালুকদার বলে উঠেছিলেন, এখানে কি হচ্ছে?

সুদীপ অবশ হয়ে তাকিয়ে ছিল। তারপরই একটা ক্রোধ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার সমস্ত সত্তায়। চিক্কার করে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই মেয়েটা যা বলছে তা সত্যি?

এই বাড়িতে কোনটে সত্যি কোটে মিথ্যে তা বিচার করব আমি। নিজের ঘরে যাও।

ছিঃ, আপনি এত নোংরা! ইউ কিল্ড মাই মাদার!

নো। ডাক্তার বলেছে সে মরবে না। আর আমি নোংরা না ফরসা সে বিচারও আমি করব।

আপনার সঙ্গে কথা বলতেও প্রবৃত্তি হচ্ছে না। মা মরে গেলে আমি, আমি আপনাকে–।

গেট আউট, গেট আউট অফ মাই সাইট! বীভৎস গলায় চিৎকার করে উঠেছিলেন অবনী তালুকদার। এক ছুটে নিজের ঘরে চলে এসেছিল সুদীপ। বিছানায় উপুড় হয়ে নিজেকে কি ভীষণ প্রতারিত বলে মনে হয়েছিল। অবনী তালুকদারের কথাবার্তা ব্যবহার সে পছন্দ করত না, কিন্তু সেটা ছিল এক ধরনের খারাপ লাগা, এখন সমস্ত শরীরে কিলবিলে ঘেন্না। এমন কি মায়ের জন্যে জমে ওঠা উদ্বেগ এবং কষ্টটা মনচাপা পড়ে গেছে। একটা মনের ওপর আর একটা মন। এই দ্বিতীয় মনটা রাগে ঘেন্নায় নিজেকেই ছিড়তে চাইছে। এক মুহূর্ত নয়, এই বাড়ি ছেড়ে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে তাকে। অবনী তালুকদারের বাড়িতে সে আর থাকতে পারে না। কোথায় যাবে সে চিন্তা না করেই সুদীপ সুটকেস নামাল এবং তখনই তার মনে হল, কেন যাবে? সে এখান থেকে চলে গেলে কারও কোনও ক্ষতি হচ্ছে না, অভিমান করে অথবা ঘেন্নায় এই বাড়ি থেকে চলে গেলে কোন প্রতিক্রিয়া হবে না কারো ওপর। আর ক্ষতি যদি হয় তো তারই। বরং মাকে ফিরিয়ে আনা পর্যন্ত তার থাকা উচিত। অবনী তালুকদারের ওপর কোন বিশ্বাস নেই। আর যদি মা না ফিরে আসে তাহলে সে নিজের হাতে অবনী তালুকদারকে খুন করবে। কোন দয়া মায়া ক্ষমা নেই। আর সামনে থেকে প্রতি মুহূর্তে লোকটাকে যদি সে বোঝাতে পারে ঘেন্নার মাত্রাটা, তার চেয়ে আর স্বস্তি কিসে আছে? চলে যাওয়াটা তো সেন্টিমেন্টাল হঠকারিতার শামিল। সুদীপ বাড়ি হাড়েনি। অবনী তালুকদার সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তবে মেয়েটা চলে গিয়েছিল। দোতলায় আর কোন কাজের মেয়ে আসেনি। মা ফিরে এলে, যখন নার্সিং হোমে রেখেও কোন কাজ হবে না জানা গেল, তখন বাড়িতে ফিরিয়ে আনার পর নার্স রাখা হল।

প্রথম প্রথম সুদীপ নজর রেখেছিল। না, অবনী তালুকদার কোনদিনই ওই সব সেবিকাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেননি। এবং তখনই একটা সত্য সে আবিষ্কার করেছিল, অবনী তালুকদার ফর্সা সুন্দরী কিংবা সাধারণ মহিলার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করেন না। সুদীপ নার্সদের সেন্টারে ফোন করে বলেছিল, পেসেন্ট চাইছেন তাকে নার্স করতে যারা আসবেন তারা যেন ফর্সা হয়। সেন্টার যেন সেটা খেয়ালে রাখেন।

আয়কর বিভাগের একজন কর্মী অ্যালবামটা তুলে বললেন, কি আগলি। তারপর অবনী তালুকদারের দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকালেন। এবং এই সময় অবনী তালুকদারের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কিছুই শুনছেন না, কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। এসবে যেন কিছুই যায় আসে না তার। এই সময় একজন অফিসার সুদীপকে ডাকলেন, ওই ঘরে আপনি থাকেন? আসুন।

যেতে যেতে সুদীপ বলল, আমার ঘরে কোন লুকনো সম্পদ নেই।

তবু আপনি দরজায় দাঁড়ান, আমরা দেখছি।

কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু কিছু লিফলেট, আনন্দর দেওয়া বই হাতে নিয়ে ভদ্রলোক ওর দিকে কয়েকবার তাকালেন। তারপর হেসে বললেন, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ!

একটা কড়া জবাব দিতে গিয়েও সামলে নিল সুদীপ। রাজনীতি নিশ্চয়ই এঁদের আওতায় পড়ে না কিন্তু খবর পৌঁছে দিতে তো পারেন। কারণ ওই সব কাগজের কিছুটা সরকারের ভাল না লাগারই কথা।

মায়ের ঘর থেকে কিছুই পাওয়া গেল না। সরু গায় মা বারংবার প্রশ্ন করছিলেন, কি হয়েছে? এরা কারা? জড়ানো শব্দগুলো খ্যানখেনে এবং দুর্বোধ্য।

শেষ পর্যন্ত সব দেখা হয়ে গেলে অফিসার বললেন, মাকে খাট থেকে নামাতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে অবনী তালুকদার হুঙ্কার দিলেন, খবরদার! সেরিব্রাল কেস। বেড়সোর বেরিয়ে গেছে। ওই পেসেন্টকে নড়ালে আবার অ্যাটাক হতে পারে। তাই যদি হয় আমি ছাড়ব না বলে দিচ্ছি।

অফিসার বললেন, আমরা দুঃখিত। কিন্তু ওঁকে আমরা যত্ন করেই নামিয়ে নিচ্ছি। ব্যাপারটাকে হয়তো হার্টলেস বলে মনে হচ্ছে, বাট ইটস মাই ডিউটি।

অবনী তালুকদারের কোন আপত্তি টিকল না। আর সেই সময় সুদীপ আর একটা ব্যাপার আবিষ্কাব করল। যে মা সুস্থ অবস্থায় কোনদিন গলা তুলে কথা বলেননি, স্বামীর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে প্রতিবাদ করেননি সেই মা হঠাৎ তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন। সেই চিৎকারে স্বামীর পক্ষ সমর্থন এবং আগন্তুকদেব ওপর বিদ্বেষ স্পষ্ট।

আটা কুড়ি ভরি ওজনের সোনার সাপ পাওয়া গেল হোশকের তলা থেকে। তোশকের ওপরটা বেড়োরের রসে ভিজে আছে, দাগ হয়ে গেছে কিন্তু তার তলায় সোনার সাপগুলো চুপচাপ শুয়ে ছিল। যে নার্সটি মায়ের সেবায় ছিল তার চোখ বিস্ফারিত। আর মা অদ্ভুত স্বরে কাঁদতে লাগলেন যখন সাপগুলোকে তুলে নেওয়া হচ্ছিল।

সমস্ত জিনিসের লিস্ট করে সইসাবুদ হবার পর ওরা চলে গেলে অবনী তালুকদার ছুটে এলেন এই ঘরে। সুদীপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। টেবিলের ওপর ব্যাগটা তখনও পড়ে আছে। জিনিসটার কথা। খেয়ালই ছিল না সুদীপের। আয়কর অফিসাররা সমস্ত বাড়ি তন্নতন্ন করে দেখেছেন, কিন্তু চোখের সামনে টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগটার কথা কারও খেয়ালে আসেনি। অবনী তালুকদার ছুটে গিয়েছিলেন ব্যাগটার কাছে। পরমতৃপ্তি ফুটে উঠেছিল তার মুখে। সেখানে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলেছিলেন, থ্যাঙ্ক ইউ!

সুদীপ উঠে এসেছিল একটিও কথা না বলে।

মাঝে মাঝে খুব আপসোস হয়। নিজের হাতে সে ব্যাগটা আয়কর বিভাগের কর্মীদের হাতে তুলে দিতে পারেনি। কিন্তু সে এমন জায়গায় রেখেছিল যেখানে সকলের নজর আগে পড়বে। শেষে তালগোলে নিজেরও খেয়াল ছিল না কিন্তু ব্যাপারটা এমন হবে কে জানত! কি ছিল ওই ব্যাগটায় তা কোনদিন জানা যাবে না। আজ সুদীপের খুব ইচ্ছে করছিল তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ব্যাগটার খোঁজ নিতে।

অবনী তালুকদার সেই ঘটনার পর নরম ব্যবহার করেননি ঠিক কিন্তু বিরক্তও করেননি। তবু এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় যে কোন মুহূর্তেই আসতে পারে। তাতে নিশ্চয়ই অবনী তালুকদার তৃপ্ত হবেন। সুদীপ আর একবার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। নিস্তব্ধ কলকাতা। গাড়ির সংখ্যাও কমে এসেছে। কেউ নেই পথে, রাত্রের মতন যে যার বাড়িতে ফিরে গেছে। হঠাৎ সামনের রাস্তাটাকে অতিরিক্ত নির্জন বলে মনে হচ্ছিল তার।

 

যেন কোন নদীর ওপর থেকে কেউ তাকে ডাকছে অথবা ঝরনার শব্দের সঙ্গে পরিচিত কোন কণ্ঠ মিশে গেছে এইরকম একটা বোধ হওয়া মাত্র সুদীপের ঘুম ভাঙল। এবং তখনই স্পষ্ট একটি নারীকণ্ঠ শোনা গেল। তার নাম নয়, খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে কেউ বলল, শুনছেন, এই যে!

সুদীপ চোখ মেলতেই নার্স-মহিলাটিকে দেখতে পেল। তার এই ঘরে এখন পর্যন্ত কোন মহিলা আসেননি। অতএব ঘোর কাটতে দুটো মুহূর্ত লাগল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সে। নার্স বললেন, আপনার মা জেগেছেন। আমি আবার ঘুমের ওষুধ দেব, যদি কথা বলতে চান তাহলে আসতে পারেন।

সুদীপ বিছানা থেকে নেমে ভদ্রমহিলাকে অনুসরণ করল।

মায়ের ঘরে ঢোকামাত্র শব্দটা কানে বাজল। খনখনে স্বরে মা কাতরাচ্ছেন। এখন তাকে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ সুদীপ আবিষ্কার করল তার নিজস্ব কোন কথা বলার নেই। মাকে দেখতে এসেছিল আজ, নার্স বলেছিলেন, সেও মাথা নেড়েছিল মাত্র। এখনও ভোর হয়নি। ঘরে আলো জ্বলছে। সুদীপ মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। মায়ের চোখ সিলিংয়ের দিকে। কাতরানিটা সমানে চলছে। নার্স মায়ের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বোলাতে বোলাতে মুখ নামিয়ে বেশ জোরে কথা বললেন, আপনার ছেলে এসেছে, দেখুন।

যন্ত্রণায় কাতর মুখে প্রথমে অন্য কোন অভিব্যক্তি ফুটল না। কিন্তু নার্স কয়েকবার শব্দগুলো উচ্চারণ করার পর মা মুখ তুললেন। নার্স আবার বললেন, ওই দিকে, আপনার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

এবার মুখ নামল। চোখের তারা দুটো ঘুরে ঘুরে সুদীপের মুখের ওপর স্থির হল। কোনও শব্দ নেই। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা চট করে সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করল। সুদীপের শরীরে হঠাৎ কঁপুনি এল। ওই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সে পাচ্ছিল না। প্রায় পরিত্রাণের চেষ্টায় সুদীপ উচ্চারণ করল, মা!

একটা শব্দ ছিটকে এল মায়ের মুখ থেকে। অস্পষ্ট উচ্চারণে বিকৃত হল শব্দ, কিছুই বোঝা গেল না। সুদীপ আর একটু এগিয়ে এসে মায়ের পাশে বসল। সঙ্গে সঙ্গে সে একটা ঘিনঘিনে গন্ধ টের পেল। পচা মাংসের গন্ধ। নার্স বললেন, গায়ে হাত দেবেন না।

তখনও চোখের দৃষ্টি সরেনি। সুদীপ মুখ নামিয়ে করুণ স্বরে প্রশ্ন করল, খুব কষ্ট হচ্ছে?

কিছু কথা বলার চেষ্টা চলছিল তখন, অথচ শব্দগুলো কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছিল না। মায়ের মুখ উত্তেজনায় কাঁপছিল। সুদীপ চেষ্টা করছিল কথাগুলোর একটা মানে বুঝে নিতে। শেষ পর্যন্ত নার্স বাধা দিলেন, আর ওঁর উত্তেজিত হওয়া উচিত হবে না। আজ সন্ধ্যাবেলায় কথা এত জড়ানো ছিল না। আপনি এবার যান আমি ওষুধ দেব।

একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে সুদীপ উঠে দাঁড়াল। তারপর দরজার দিকে এগোতেই মা গোঙাতে লাগলেন। হঠাৎ সে স্থির হয়ে গেল। ওই গোঙানির মধ্যে যে শব্দদুটো সে শুনতে পেয়েছে তা কি সঠিক? সে ফিরে তাকাতেই মা শান্ত হয়ে গেলেন। ঠোঁট বন্ধ। চোখে আকূতি। এবং তখনই দুচোখ বেয়ে জল নামল। মনের কথাটা ছেলের কাছে পৌঁছে দিয়ে চোখের জলে তৃপ্ত হওয়া।

সুদীপ এক দৌড়ে ব্যালকনিতে চলে এল। ভোর হচ্ছে। কলকাতার মাথায় এখনও অন্ধকার সরেনি। অদ্ভুত শীতল বাতাস বইছে পৃথিবীতে। এখনও পথে মানুষজন নামেনি। সবে ফরসা হচ্ছে আকাশ। সুদীপ চোখ বন্ধ করল। তার সমস্ত শরীরে আবার কাঁপুনিটা ফিরে এল। কানের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি রক্তবিন্দুতে মিশে গেছে শব্দগুলো, কখন মরব খোকা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *