আগের অধ্যায়ে আমরা দেখলাম যে, সেপিয়েন্সরা আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় দেড় লাখ বছর ধরে বসবাস করে আসলেও, তারা আনুমানিক ৭০,০০০ বছর আগে থেকে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং মানব গোত্রের অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্ত করে ফেলে। এর মাঝামাঝি সময়টাতে, সেপিয়েন্সরা দেখতে আমাদের মতো হলেও এবং তাদের মস্তিষ্ক আমাদের মস্তিষ্কের সমান বড় হলেও, তারা তাদের জ্ঞাতিভাইদের থেকে খুব একটা এগোতে পারেনি। তারা এসময় তেমন কোনো সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করতে পারেনি কিংবা প্রাণিকুলের অন্যদের চেয়ে বিশেষ কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের নজিরও রাখতে পারেনি।
এমনকি সেপিয়েন্সদের সাথে তাদের আরেক সমগোত্রীয় নিয়ান্ডার্থালদের প্রথম যে লড়াইয়ের কথা জানা যায়, তাতে নিয়ান্ডার্থালরাই জয়লাভ করেছিলো। সে প্রায় ১ লক্ষ বছর আগের কথা। এই সময়ে কিছু সেপিয়েন্স আফ্রিকার উত্তরে নীল নদ ঘুরে সিনাই উপদ্বীপ পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পৌঁছায়। এই এলাকা তখন নিয়ান্ডার্থালদের দখলে ছিলো। সেপিয়েন্সরা এখানে পৌঁছাবার পর প্রাথমিকভাবে এখানে স্থায়ী বসতি গড়তে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় লোকজনের অসহযোগিতা, বৈরী জলবায়ু আর এ অঞ্চলের অচেনা রোগ-বালাই এই ব্যর্থতার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। যে কারণেই হোক, সেপিয়েন্সরা একসময় এই এলাকা থেকে পিছু হটে এবং নিয়ান্ডার্থালরাই মধ্য এশিয়া জুড়ে বসবাস করতে থাকে।
সেপিয়েন্সদের এই পরাজয়ের ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের এই ধারণা দেয় যে, সম্ভবত তাদের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ গঠন আমাদের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা ছিলো। তারা দেখতে আমাদের মতোই ছিলো – কিন্তু তাদের শেখার, মনে রাখবার বা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা ছিলো খুবই সীমিত। এই রকম একজন সেপিয়েন্স আমাদের আধুনিক কোনো ভাষা শিখবে, ধর্ম কর্মের কথা জানবে বা বিবর্তনের তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে এমনটা আশা করাই বোকামি। আবার, এরকম একজন সেপিয়েন্সের ভাষা শেখা বা তারা কীভাবে চিন্তা করত সেটা বোঝার চেষ্টা করা আমাদের বর্তমানের মানুষদের জন্যও বেশ কঠিন একটা কাজ।
এর পরের ইতিহাস কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। আনুমানিক ৭০,০০০ বছর আগে থেকে সেপিয়েন্সরা তাক লাগানোর মত কাজকর্ম শুরু করলো। এই সময়কালে সেপিয়েন্সরা দ্বিতীয় বারের মতো আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। তবে এইবার তারা নিয়ান্ডার্থাল এবং মানুষের অন্যান্য প্রজাতিকে মধ্য এশিয়া থেকে তো বটেই, এমনকি দুনিয়ার বুক থেকেই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়। খুব অল্প সময়ের মাঝেই তারা ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় পৌঁছে যায়। প্রায় ৪৫,০০০ বছর আগে তারা সাগর পাড়ি দিতে শেখে এবং অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে যায়। এর আগে এই মহাদেশে কোনো মানুষেরই পা পড়েনি। ৭০,০০০ বছর আগে থেকে ৩০,০০০ বছর আগের এই সময়টাতে সেপিয়েন্স নৌকা, তেলের প্রদীপ, তীর ধনুক এমনকি সুঁই-সুতা আবিষ্কার করে ফেলে। শীতের দেশে গরম কাপড় বোনার জন্য এই সুঁই-সুতা খুবই জরুরী ছিলো।
বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন যে, এতসব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পেছনে নিশ্চয়ই সেপিয়েন্সদের বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার কোনো পরিবর্তন দায়ী। তাদের দাবী- যে সেপিয়েন্সরা নিয়ান্ডার্থাল নামের পুরো একটি প্রজাতিকে দুনিয়া থেকে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিতে পারে, সাগর পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপন করতে পারে এবং জার্মানির স্টেডেল গুহায় কাল্পনিক সিংহ-মানবের মূর্তি বানাতে পারে তারা নিশ্চয়ই আমাদের মতোই বুদ্ধিমান, আমাদের মতোই সৃষ্টিশীল এবং আমাদের মতোই সংবেদনশীল ছিল। সুতরাং কোনোভাবে যদি স্টেডেল গুহায় কাজ করা সেইসব শিল্পীদের সাথে আমাদের দেখা হয়ে যায়, আমরা তাদেরকে আমাদের ভাষা বোঝাতে পারব এবং চেষ্টা করলে আমরাও তাদের ভাষা শিখতে পারব। আমরা তাদের শোনাতে পারব অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এর মতো কাহিনী বা বোঝাতে পারব কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব। একইভাবে তারাও আমাদের বলতে পারবে তাদের মানুষদের চোখে কেমন ছিলো আমাদের পৃথিবী।
৭০,০০০ বছর আগে থেকে ৩০,০০০ বছর আগের এই সময়টায় সেপিয়েন্সদের এই যে নতুন ভাবে চিন্তা করার এবং যোগাযোগ করার ক্ষমতার সূচনা হলো, সেটাকে আমরা বলছি – বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব। এই বিপ্লব কীভাবে সম্ভব হলো? আমরা এখনও সঠিকভাবে সেটা জানি না। এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে যে তত্ত্ব সবচেয়ে বেশী প্রচলিত সেটা জানবার জন্য আমাদের একটু বিজ্ঞানের আঙিনা থেকে ঘুরে আসতে হবে। বিজ্ঞান বলে – ‘জিন’ (gene) হলো জীবন্ত প্রাণের বংশগতির আণবিক একক। একটি জীবের বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য যা দায়ী, তা-ই জিন। এই জিনগুলোর বিভিন্নতার কারণে একটি জীবগোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে বংশগত বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এই ভিন্নতার কারণেই কেউ জন্মগতভাবে একটু রাগী, কেউ চুপচাপ। কেউ খেলাধুলায় চৌকস, কেউ লেখালেখিতে। জিনের অভ্যন্তরীণ গঠনের পরিবর্তনকে আমরা বলি জিনের ‘পরিব্যক্তি’ (Mutation)। জিনের পরিব্যক্তির মাধ্যমে জীবের নির্দিষ্ট কোনো বংশধরে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনও ঘটতে পারে।
এবারে আগের প্রশ্নে ফেরা যাক। সেপিয়েন্সদের ‘বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব’ এর কারণ হিসেবে সবচেয়ে প্রচলিত মতবাদে বলা হয় মোটামুটি ৭০,০০০ বছর আগে সেপিয়েন্সদের জিনের কোনো আকস্মিক পরিব্যক্তি তাদের মস্তিষ্কের নিউরনের মাঝে সংযোগের পদ্ধতি পাল্টে দেয়। এর ফলে তারা একে অপরের সাথে আরও সার্থকভাবে যোগাযোগ করার জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষা আয়ত্ব করতে পারে। আমরা এই রূপান্তরের নাম দিতে পারি – ‘জ্ঞান বৃক্ষের রূপান্তর’ (Tree of Knowledge mutation)। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে শুধু সেপিয়েন্সদের জিনেই কেন এই রূপান্তর হলো – নিয়ান্ডার্থাল বা মানুষের অন্যান্য প্রজাতির ক্ষেত্রে এই রূপান্তর হলো না কেন? এর উত্তরে বলা যায়, জিনের এই রূপান্তরের ব্যাপারটা পুরোপুরি আকস্মিক। ঘটনাক্রমে এটা সেপিয়েন্সদের ক্ষেত্রে ঘটেছে – এটা নিয়ান্ডার্থাল বা মানুষের অন্য কোনো প্রজাতির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত। কিন্তু এই রূপান্তরের কারণের চেয়ে এই ‘জ্ঞান বৃক্ষের রূপান্তর’ এর ফলে কী কী পরিবর্তন হলো সেটা জানা অনেক বেশি জরুরি। প্রশ্ন জাগে, সেপিয়েন্সদের এই নতুন ভাষায় এমন কী বিশেষত্ব ছিলো যা তাদেরকে পুরো দুনিয়া জয় করার ক্ষমতা দিয়ে দিলো?
প্রসঙ্গত বলে নেওয়া দরকার সেপিয়েন্সদের এই ভাষা কিন্তু দুনিয়ার প্রথম ভাষা নয়। যোগাযোগের জন্য প্রত্যেক প্রাণীর নিজেদের ভাষা আছে। প্রত্যেক পোকামাকড়, যেমন পিঁপড়া ও মৌমাছি ভালো মতোই জানে কীভাবে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ করতে হয়, কীভাবে খাবারের খবরাখবর অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। যদি শুধু মুখের ভাষা বিবেচনা করি, সেই হিসেবেও সেপিয়েন্সদের এই ভাষা প্রথম ভাষা নয়। অনেক প্রাণীর যেমন গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং বানরের অনেক প্রজাতির নিজস্ব মুখের ভাষা আছে। উদাহরণ হিসেবে সোনালী-সবুজ পশমওয়ালা এক জাতীয় বানরের নাম করা যায় (Green Monkey বা সবুজ বানর), যারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন মৌখিক ধ্বনি ব্যবহার করে। জীববিজ্ঞানীরা এরকম একটি ধ্বনি সংকেত সনাক্ত করেছেন যার অর্থ – ‘সাবধান! ঈগল আসছে’। একটু আলাদা একটা ধ্বনি সংকেত বোঝায় – ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। গবেষকরা যখন প্রথম ধ্বনি সংকেতটি রেকর্ড করে একদল সবুজ বানরকে শোনাচ্ছিলেন – হুট করে বানরগুলো থেমে গেল এবং ভয়ার্ত চোখ নিয়ে উপরের দিকে তাকাল। যখন একই বানরের দলকে দ্বিতীয় ধ্বনিসংকেতটি শোনানো হল – যেটা সিংহ আসার সংকেত – সাথে সাথে বানরগুলো লাফ দিয়ে গাছে চড়ে বসল। সেপিয়েন্স বানরের চেয়ে অনেক বেশি ধরনের ধ্বনি সংকেত তৈরি করতে পারে, তবে তিমি এবং হাতিরও এরকম অনেক ধরনের ধ্বনি তৈরির ক্ষমতা আছে। আইনস্টাইন ধ্বনি ব্যবহার করে যা বলতে পারেন, একটা তোতাপাখিও শুনে শুনে সেই কথাগুলোই বলতে পারে, এমনকি সে ফোন বাজার শব্দ, দরজা ধাক্কানোর শব্দ বা দমকলের সাইরেনের শব্দও নকল করতে পারে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, শুধু ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারাটাই আইনস্টাইনের বিশেষত্ব নয়। অনেক রকম ধ্বনি তৈরির ক্ষমতাকে বাদ দিলে, কী সেই বিশেষ বিষয় যার জন্য আমাদের ভাষা এতটা গুরুত্বপূর্ণ, এতটা কার্যকর?
এই প্রশ্নের বেশ সহজ এবং বহুল প্রচলিত একটি উত্তর আছে। সেটা হলো – আমরা মানুষেরা কিছু সীমিত সংখ্যক ধ্বনি এবং প্রতীককে বিভিন্নভাবে জোড়া লাগিয়ে অসীম সংখ্যক বাক্য তৈরি করতে পারি যেই বাক্যগুলো প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। এইভাবে আমরা পৃথিবী সম্পর্কে অনেক রকম তথ্য জানতে পারি, জমা করতে পারি এবং অন্যদের জানাতে পারি। একটা সবুজ বানর তার সঙ্গীদের চিৎকার করে জানান দিতে পারে – ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষ তার বন্ধুকে এভাবে বলতে পারে যে, আজ সকালে নদীর ধারে একটা সিংহ একটা বাইসনকে তাড়া করছিল। সে এটাও বলতে পারে ঠিক কোন জায়গায় সে ঘটনাটা ঘটতে দেখেছে, কোন কোন রাস্তা দিয়ে জায়গাটাতে পৌঁছানো যায়। এই তথ্যগুলো নিয়ে তার সঙ্গী-সাথীরা আলাপ আলোচনা করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে এ অবস্থায় বাইসনটাকে শিকার করতে যাওয়াটা উচিত কাজ হবে কি না।
এ ব্যাপারে আরেকটা তত্ত্ব যা বলে তা হলো – সেপিয়েন্সদের এই ভাষার উদ্ভব হয়েছে আমাদের চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কিত তথ্যাদি একে অন্যকে জানানোর জন্য। আর এটা তো জানা কথা যে, সিংহ আর বাইসনের মতো জীব-জন্তুর খবরের থেকে অন্যান্য মানুষ সম্পর্কিত তথ্য আমাদের অনেক বেশি আকর্ষণ করে। আমরা মানুষেরা গল্প শুনতে, মানুষকে নিয়ে গল্প করতে বেশি পছন্দ করি। তাই বলতে পারি, আমাদের ভাষার উদ্ভব হয়েছে মূলত নিজেদের নিয়ে গল্প করার, আড্ডাবাজি করার এমনকি নিন্দা করার উপায় হিসেবে। এই তত্ত্বানুযায়ী মানুষ জন্মগতভাবেই সামাজিক প্রাণী। সামাজিক সহযোগিতা আমাদের টিকে থাকা এবং বংশবিস্তারের জন্য অপরিহার্য। শুধু সিংহ বা বাইসনের সম্পর্কে জানাই কোনো মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। এর চেয়ে একই গোষ্ঠীর মানুষের মাঝে কে কাকে হিংসা করে, কার সাথে কার বিয়ে হলো, কে সৎ আর কে অসৎ এটা জানা মানুষের জন্য অনেক জরুরি।
মানুষের সাথে মানুষের এই নিয়ত পরিবর্তনশীল সম্পর্ক সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখতে গেলে যতখানি তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে তার পরিমাণ বিশাল (৫০ জনের একটি দলে, ১,২২৫ ভাবে এক জন মানুষের সাথে আরকেজন মানুষের সম্পর্ক হতে পারে। একজন মানুষের সাথে একাধিক মানুষের সম্পর্কের রকমফেরের হিসাব করাটাই প্রায় অসম্ভব মানুষের পক্ষে)। সকল নরবানর নিজেদের এইসব সামাজিক সম্পর্কের তথ্য সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী, কিন্তু ভাষা সুবিধাজনক না হবার কারণে তাদের পক্ষে এই সকল বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়া বা গল্প করা বেশ কঠিন ছিল। এমনকি নিয়ান্ডার্থাল বা একদম আদিম যুগের হোমো সেপিয়েন্সদেরও কথা বলার এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কিন্তু এই কথা বলার ব্যাপারটা অনেকজন একসাথে মিলেমিশে থাকতে গেলে নিতান্তই অপরিহার্য ছিল। নতুন ধরনের ভাষা – যেটা সেপিয়েন্সরা মোটামুটি ৭০,০০০ বছর আগে রপ্ত করতে পেরেছিল- এই ভাষা তাদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুনসুটি করার, গল্প করার এমনকি পরনিন্দা করার একটা সুযোগ করে দিল। কথা বলে মানুষ বুঝতে শিখল দলের কার উপর ভরসা রাখা যায়, আর কার থেকে সাবধানে থাকা ভালো। এই বুদ্ধি ছোট ছোট মানবগোষ্ঠীকে বড় বড় মানব গোষ্ঠীতে পরিণত হবার সুযোগ করে দিল। সেপিয়েন্স তার ফলে আরও সঠিকভাবে আরও জটিল সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হল।১
আড্ডা, খুনসুটি বা পরচর্চা করার জন্যই সেপিয়েন্সদের ভাষার বিকাশ ঘটেছে- এরকম একটি তত্ত্বকে আমরা ‘পরচর্চা তত্ত্ব’ (Gossip Theory) নামে ডাকতে পারি। যদিও পরচর্চার জন্যই ভাষার বিকাশ ঘটেছে- এই কথাটা শুনতে আপাতভাবে অনেক হাস্যকর মনে হয়, কিন্তু এ সংক্রান্ত অনেক গবেষণাই কিন্তু এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। এমনকি আজকের দুনিয়ার কথা যদি ভাবি – এখনও মানুষের সাথে মানুষের বেশিরভাগ আলাপ-আলোচনার বিষয় জুড়ে থাকে অপরে কী করল, কী খেল, কোথায় কোন মুখরোচক বা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল – এসব নিয়ে; হোক সে ই-মেইলে, ফোনে কিংবা সংবাদপত্রের পাতায়। পরচর্চা করার ব্যাপারটা আমাদের এতটাই মজ্জাগত যে মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়, বুঝিবা গল্প-গুজব আর পরনিন্দা-পরচর্চা করার জন্যই মানুষের ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ হয়েছে। আপনাদের কি মনে হয় একজন ইতিহাসের অধ্যাপক দুপুরের খাওয়া দাওয়া করার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে আলোচনা করেন বা একজন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কোয়ার্ক নিয়ে কোনো সম্মেলন এর ব্যাপারে আলোচনা করেন? হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে যে করেন না তা নয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই তাদের আলোচনা জুড়ে থাকে কোন অধ্যাপক পরকীয়া করতে গিয়ে বৌয়ের কাছে ধরা পড়ল, বিভাগীয় প্রধান কিভাবে ডিনের সাথে তুমুল ঝগড়া বাধাল কিংবা কোন অধ্যাপক গবেষণার টাকা মেরে বিলাসবহুল গাড়ি কিনল।
সম্ভবত ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের কারণ হিসেবে ‘পরচর্চা তত্ত্ব’ এবং ‘নদীর-পাড়ে-একটি-সিংহ-ছিল তত্ত্ব’ এ দুটোই সঠিক। যদিও মানুষের সম্পর্কে, সিংহের সম্পর্কে বা দৃশ্যমান পৃথিবী সম্পর্কে আশেপাশের মানুষকে জানানোর ক্ষমতাই মানুষের ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য নয়। বরং এ ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এই ভাষায় মানুষ কাল্পনিক ঘটনা বা বস্তু, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই তার গল্প অন্যদের কাছে করতে পারে। আমরা যতদূর জানি, সেপিয়েন্সই একমাত্র প্রাণী যারা যেসব জিনিস কখনো চোখে দেখেনি, স্পর্শ করেনি কিংবা ঘ্রাণ নেয়নি সেসব নিয়েও অন্যদের সাথে গল্প করতে পারে।
‘বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব’ এর সাথে সাথে প্রথমবারের মতো উপকথা, পুরাণ, ঈশ্বর এবং ধর্মের উদ্ভব হল। আগে অনেক প্রাণী, এমনকি সেপিয়েন্সও বলত- ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকেই মানুষ এরকম কথা বলার সুযোগ পেল- ‘সিংহ হলো আমাদের গোত্রের কুলদেবতা’। কাল্পনিক কথাবার্তা বলার এই ক্ষমতাই মানুষের ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ।
এই কথার সাথে সম্ভবত আমরা সবাই একমত হব যে, একমাত্র সেপিয়েন্সই এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে যেগুলোর বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই এবং একদিন সকালের নাস্তা করতে বসে তারা ছয়টা বানানো গল্প বিশ্বাস করে বসতে পারে যেগুলো বাস্তবে অসম্ভব। ধরা যাক, একটা বানরকে আপনি গল্পের ছলে বললেন আজকে যদি সে আপনাকে একটি কলা দেয়, পরকালে বানরের স্বর্গে সে দশ হাজার কলা পাবে। বানরকে অনেক কষ্ট করে আপনি এই প্রস্তাবটা বোঝানোর পরপরই সে আপনার হাত থেকে কলাটা নিয়ে নির্লিপ্তভাবে খাওয়া শুরু করবে। সে আপনার বানানো পরকালের গল্প মোটেই বিশ্বাস করবে না। অন্যদিকে, অনেক মানুষই কিন্তু এধরনের গল্প বিশ্বাস করে থাকে। কিন্তু, এতসব কথা বানিয়ে বলার প্রয়োজনীয়তা কি? কে না জানে, বানিয়ে বানিয়ে বলা মিথ্যে গল্প আমাদের ভুল পথে চালিত করতে পারে? কোন মানুষকে যদি পরীর মিথ্যে গল্প শোনানো হয় এবং সে পরীর খোঁজে বনের আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকে তাহলে তার নানারকম বিপদের আশঙ্কা থাকে। সে যদি বনে ফলমূল বা হরিণের সন্ধানে যেত, তাহলে তার বিপদের সম্ভাবনা কম থাকত- কারণ সে সহজেই ফলমূল বা খাবার সংগ্রহ করে ফেলতে পারত। ঠিক একই ভাবে কেউ যদি বনদেবতার বানানো গল্পে বিশ্বাস করে সারাদিন তার আরাধনায়ই ব্যস্ত থাকে, তাহলে সে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবে কখন, খাবার জোগাড় করবে কখন কিংবা বংশবিস্তারেরই বা সময় পাবে কখন?
আমরা যে কেবল বাস্তবের বাইরের জিনিস কল্পনা করতে পারি তা-ই নয়, আমরা অনেকে মিলেও একই জিনিস কল্পনা করতে পারি। আমরা সবাই মিলে একসাথে জগৎ কীভাবে সৃষ্টি হলো তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করি, এক একটা সৃষ্টিতত্ত্ব দাঁড়া করিয়ে তাতে বিশ্বাস করতে থাকি। আমরা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নিয়ে কল্পকাহিনী বানাই, আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য কল্পনা দিয়ে বানাই ‘জাতীয়তাবাদ’। এইসব কল্পনাজাত ধারণা মানুষকে অনেক বড় একটা দল বা গোষ্ঠী হয়ে জীবন ধারণ করার এক অসাধারণ সুযোগ করে দেয়। পিঁপড়া এবং মৌমাছিরাও একসাথে অনেক বড় দল হয়ে জীবনধারণ করে; কিন্তু তাদের কাজকর্মের পরিধি খুবই সীমিত এবং তাদের যোগাযোগ শুধু পরিচিতদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। নেকড়ে এবং শিম্পাঞ্জির কাজকর্মের পরিধি কিছুটা বেশি, কিন্তু তাদের দলগুলো খুব ছোট ছোট হয় এবং দলে শুধু তারাই থাকে যাদের মাঝে চেনাজানা অনেক বেশি। অপরদিকে সেপিয়েন্সরা অপরিচিত অসংখ্য লোকের সাথে খুব সাচ্ছন্দ্যে যোগাযোগ করতে পারে, একসাথে থাকতে পারে। এই কারণেই সেপিয়েন্স সারা দুনিয়ায় রাজত্ব করছে, আর ওদিকে পিঁপড়ারা আমাদের উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে, শিম্পাঞ্জিরা তালাবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের বানানো চিড়িয়াখানায় অথবা গবেষণাগারে।
পিউজো – একটি রূপকথা
আমাদের জ্ঞাতিভাই শিম্পাঞ্জিরা ছোট ছোট দল তৈরি করে বসবাস করে। প্রতিটা দলে কয়েক ডজনের মতো শিম্পাঞ্জি থাকে। তারা একে অপরের সাথে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করে, একসাথে শিকার করে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেবুন, চিতা বা শত্রুপক্ষের শিম্পাঞ্জির সাথে লড়াইও করে। এদের সমাজে এক ধরনের স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত পুরুষ শিম্পাঞ্জিরাই এসব দলের দলনেতা হয়। দলনেতাকে বলা হয় ‘আলফা পুরুষ’ (Alpha Male)। প্রজা যেমন রাজাকে মাথা নত করে কুর্ণিশ করে, অনেকটা তেমন করেই শিম্পাঞ্জি দলের বাকি সদস্যরা মাথা নিচু করে এবং ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে দলনেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ‘আলফা পুরুষ’ তার দলের মাঝে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করে। দলের দুইজনের মাঝে মারামারি লাগলে দলনেতা এগিয়ে যায় এবং মারামারি বন্ধ করে। একটু দুষ্টু প্রকৃতির দলনেতা হলে সে অধিকার খাটিয়ে বেশি খাবার খায় এবং নিচের স্তরের পুরুষদের নারী শিম্পাঞ্জিদের সাথে মিলিত হতে বাধা দেয়।
যখন দুইজন শিম্পাঞ্জি দলনেতা হবার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে, তারা তখন অন্যান্য শিম্পাঞ্জিদের নানা কৌশলে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। নিজের দলের লোকজনের সাথে নেতা পদপ্রার্থীর আন্তরিকতা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের উপর, যেমন- সে তাদের সাথে নিয়মিত আলিঙ্গন করছে কিনা, বাচ্চাদের চুমু খাচ্ছে কিনা, তরুণদের নানা জিনিস শেখাচ্ছে কিনা এবং বিপদে আপদে সাহায্য করছে কিনা। মানুষের সমাজের নেতারা যেমন ভোটের আগে সবার কাছে যান, হাত মেলান, বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, সেরকম শিম্পাঞ্জি দলের নেতা পদপ্রার্থীও এসময় জড়িয়ে ধরতে, পিঠ চাপড়ে দিতে এবং বাচ্চাদের আদর করতে অনেকটা সময় ব্যয় করে। মজার ব্যাপার হল, সবচেয়ে শক্তিশালী শিম্পাঞ্জি ‘আলফা পুরুষ’ হিসাবে নির্বাচিত হয় না, যার সমর্থক সংখ্যা বেশী এবং যার ধারাবাহিক সমর্থন আছে এমন শিম্পাঞ্জিই ‘আলফা পুরুষ’ হিসাবে নির্বাচিত হয়। এই সমর্থক শ্রেণী শুধু যে নেতা নির্বাচনে অবদান রাখে এমন নয়, দৈনন্দিন নানা কাজেও এরা সাহায্য করে থাকে। একই দলের লোকজন নিজেদের সাথে বেশি সময় কাটায়, নিজেদের খাবার ভাগাভাগি করে খায় এবং বিপদে একে অন্যকে সাহায্য সহযোগিতা করে।
কিন্তু সামনাসামনি যোগাযোগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই যে গোষ্ঠী বা দল, এর একটা সীমাবদ্ধতা হলো – এভাবে খুব বড় আকারের দল গঠন করা সম্ভব নয়। দুই জন শিম্পাঞ্জি যারা কখনো একে অপরকে দেখেনি, একসাথে লড়াই করেনি বা একসাথে শলা-পরামর্শ করেনি, তাদের পক্ষে একজন অন্যজনকে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। একজন অচেনা শিম্পাঞ্জি অন্যজনকে সাহায্য করবে কি করবে না, দুইজন অচেনা শিম্পাঞ্জির মাঝে কার সামাজিক মর্যাদা উঁচুতে, কার নিচুতে এসব তাদের পক্ষে বোঝা খুবই কঠিন।২
একই ধরনের জীবনাচরণ আমাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো। শিম্পাঞ্জির মতো মানুষের মাঝেও দলবদ্ধ হবার, একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর, সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরি করার, দলবেঁধে শিকার বা লড়াই করার একটা সহজাত প্রবণতা কাজ করত। স্বাভাবিকভাবেই, সহজাত প্রবৃত্তি থেকে গড়ে ওঠা এইসব গোষ্ঠী বা দলগুলো হতো শিম্পাঞ্জিদের দলগুলোর মতোই ছোট আকারের। যখনই দলগুলো বড় হতে শুরু করত, দলের মাঝে নানারকম বিশৃঙ্খলা দেখা দিত এবং দলগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত। এই যে বড় দল হিসাবে থাকতে না পারার ব্যাপার, এটা যে শুধু খাবারের সরবরাহ বা অন্যান্য সুবিধাদির উপর নির্ভর করতো এমন নয়। একটা উর্বর উপত্যকায় ৫০০ জন লোককে খাওয়ানোর মতো শস্য জন্মালেও তখনকার দিনে ৫০০ জন লোক একসাথে বসবাস করা অসম্ভব ছিলো। কারণ, তখনকার দিনের মানুষ এটা ঠিক করতে পারত না যে এতগুলো লোকের মাঝে কাকে তারা নেতা হিসাবে মানবে, কে কোন এলাকায় শিকার করবে এবং কে কার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করবে।
এ অবস্থার অবসান ঘটল বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর। মানুষ কথা বলতে শিখল। প্রতিবেশীর সমালোচনা বা পরচর্চা করতে শিখল এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এই পরচর্চাই মানুষকে বড় বড় এবং অপেক্ষাকৃত স্থায়ী দল বা গোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়তা করল। কিন্তু একজন মানুষ কতজনের ব্যাপারেই বা পরচর্চা বা আলোচনা করতে পারে? সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাগুলো থেকে দেখা যায়, এভাবে একে অন্যের সমালোচনা বা পরচর্চার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১৫০ জনের একটা দল গঠন করা যেতে পারে, এর বেশি নয়। বেশিরভাগ মানুষই ১৫০ জন মানুষকেও কাছ থেকে জানতে বা তাদের সবার সম্পর্কে মন্তব্য বা সমালোচনা করার ব্যাপারে অক্ষম।
আশ্চর্যজনকভাবে, সমাজতাত্ত্বিক এই গবেষণাটির বাস্তব প্রয়োগ কিন্তু আমরা আজকের সমাজেও অনেক দেখতে পাই। একটু খেয়াল করলে দেখব, অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সদস্য সংখ্যা এই ১৫০ সংখ্যাটির নিচে বা তার কাছাকাছি। এই সংখ্যাটির চেয়ে কম সদস্য সংখ্যা হলে কোনো দল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক মাধ্যম বা সেনাবাহিনী তেমন কোনো আইন কানুন ছাড়াই একে অপরকে সামনা-সামনি চেনার মাধ্যমে বা একে অন্যের সমালোচনা করার মাধ্যমে তাদের গোষ্ঠী বা দলটি পরিচালনা করতে পারে।৩ ত্রিশ জনের এক প্লাটুন সৈন্য বা ১০০ জনের এক কোম্পানি সৈন্য পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর মতো কোনো পদবী নির্ধারণ বা কঠোর আইন প্রণয়নের দরকার পড়ে না। সৈন্যদের নিজেদের মাঝে সুসম্পর্ক থাকলে এবং সবাই কিছুটা নিয়মানুবর্তিতা মেনে চললে সহজেই সেটা করা সম্ভব। এই আকারের একটি কোম্পানিতে একজন সম্মানিত সার্জেন্ট কখনো কখনো কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন তাদের শিরোমণি। একই কথা প্রযোজ্য পারিবারিক ব্যবসাগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে সাধারণত সদস্যসংখ্যা খুব একটা বেশি হয় না। এই ব্যবসাগুলো কোনো পরিচালনা পরিষদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা হিসাবরক্ষণ বিভাগ ছাড়াও সচ্ছন্দে চলতে পারে।
কিন্তু যখন গোষ্ঠী বা দলের সদস্যসংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়ে যায়, এভাবে নিয়ম কানুন ছাড়া নিজেদের মতো করে গোষ্ঠী পরিচালনা করা তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক প্লাটুন সৈন্য যত সহজে পরিচালনা করা যায়, হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত একটা ডিভিশন সেই একই উপায়ে পরিচালনা করা অসম্ভব। সফল পারিবারিক ব্যবসাগুলোও তখনই সংকটের সম্মুখীন হয় যখন তারা আকারে বড় হয়ে ওঠে এবং অনেক লোকজনকে তাদের ব্যবসায় নিযুক্ত করে। তারা যদি এই বাড়তি লোকজনকে সঠিকভাবে পরিচালনার কোনো কৌশল বের করতে না পারে, তাহলে তাদের ব্যবসা ভণ্ডুল হতে বাধ্য।
এই পর্যায়ে এসে অপরিহার্যভাবেই যে প্রশ্নটা মনে আসে সেটা হলো সেপিয়েন্সরা কীভাবে এই ১৫০ জনের সীমা অতিক্রম করে হাজার হাজার সদস্যের সমন্বয়ে গড়ে তুলল নগর বা লাখ লাখ সদস্যের সমন্বয়ে গড়ে তুলল সাম্রাজ্য? কল্পনা বা গল্পের উদ্ভবই সম্ভবত এই রহস্যের সমাধান। একটি লোককথা বা পুরাকাহিনীতে বিশ্বাস করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ লোক গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে।
যে কোনো বড় আকারের মানব সংগঠন- হোক সেটা আধুনিক রাষ্ট্র, মধ্যযুগের চার্চ, প্রাচীন কোন নগর বা কোন প্রাচীন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী – প্রতিটির মূলেই আছে কিছু সাধারণ বিশ্বাস, কিছু উপকথা; যার অস্তিত্ব শুধু ওই গোষ্ঠীর সামষ্টিক কল্পনায় বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, চার্চগুলোর মূলে রয়েছে সাধারণ ধর্মীয় বিশ্বাস। দুইজন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের লোক, যারা কেউ কাউকে কোনোদিন দেখেনি, তারাও বিনা যুক্তি-তর্কে একসাথে মুসলিম নিধনের জন্য ধর্মযুদ্ধে যেতে রাজি হতে পারে বা হাসপাতাল নির্মাণের জন্য একসাথে চাঁদা তুলতে পারে। কারণ, তারা দু’জনেই এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, স্রষ্টা মানুষের রূপ ধারণ করে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং আমাদের দুঃখ দূর করার জন্য স্বেচ্ছায় ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ‘রাষ্ট্র’ নামক প্রতিষ্ঠানটির মূলে রয়েছে সবার একই জাতীয়তাবাদের ধারণায় বিশ্বাস। দু’জন সার্বিয়ান যাদের একজনের সাথে অন্যজনের আগে কখনো পরিচয় হয়নি, তারাও কখনো কখনো একে অন্যকে বাঁচানোর জন্য জীবন বাজি রাখতে পারে। এটা সম্ভব হয় কারণ, তাদের দু’জনেই সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদ বিশ্বাস করে, সার্বিয়াকে তাদের মাতৃভূমি হিসেবে জানে এবং সার্বিয়ান পতাকাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। বিচার ব্যবস্থাগুলোর মূলে আছে ‘ন্যায়’ নামক ধারণাটির উপর বিশ্বাস। দুইজন অপরিচিত আইনজীবী একযোগে চেষ্টা করতে পারে তাদের সম্পূর্ণ অচেনা মক্কেলকে বাঁচানোর জন্য। কারণ তারা দুইজনই বিশ্বাস করে আইন, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারকে এবং এসবের রক্ষায় তাদেরকে পারশ্রমিক হিসেবে দেওয়া অর্থকে।
এই সবগুলো ধারণারই অস্তিত্ব শুধু মানুষের বানিয়ে তোলা কিছু গল্পে যেগুলো তারা বিশ্বাস করে এবং একে অপরের কাছে ছড়িয়ে দেয়। মানুষের এই সমষ্টিগত কল্পনার বাইরে সমগ্র মহাবিশ্বে কোনো ‘ঈশ্বর’ নেই, কোনো ‘রাষ্ট্র’ নেই, ‘টাকা’ বলে কিছু নেই, ‘মানবাধিকার’ নেই, ‘আইন’ নেই, নেই কোনো ‘ন্যায়বিচার’।
মানুষ এ কথাটা সহজেই বুঝতে পারে যে, ভূত-প্রেত কিংবা আত্মায় বিশ্বাস করার মধ্য দিয়ে প্রাচীন মানুষের মাঝে এক ধরনের সামাজিক বন্ধন, এক ধরনের সামাজিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল। এবং এই বিশ্বাসগুলোই তাদের দিয়েছিলো প্রতি পূর্ণিমার রাতে আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচার মতো রীতি বা আচার-অনুষ্ঠান। যেটা আমরা সহজে বুঝতে পারি না বা বুঝতে চাই না সেটা হল, আধুনিক সামাজিক সংগঠনগুলোও ঠিক একই নিয়মে গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যের দুনিয়ার কথাই ধরা যাক। আধুনিককালের ব্যবসায়ী এবং আইনজীবীরা একেকজন শক্তিশালী জাদুকর। প্রাচীনকালের মানবগোষ্ঠীগুলোতে যে ধরনের জাদুকর থাকত তাদের সাথে এদের একটাই পার্থক্য। সেটা হলো, তারা আগের জাদুকরদের থেকে অনেক বেশী চমকপ্রদ গল্প বলতে পারে। এ ধরনের চমকপ্রদ গল্পের একটা চমৎকার উদাহরণ হতে পারে ‘পিউজো’ (Peugeot) কোম্পানির ইতিহাস।
প্যারিস থেকে সিডনি পর্যন্ত বিভিন্ন শহরে যাতায়াত করা মোটরগাড়ি, ট্রাক এবং মোটরসাইকেলের গায়ে আধা-সিংহ আধা-মানুষের (Stadel lion-man) প্রতিকৃতি সম্বলিত একটা চিহ্ন প্রায়ই দেখা যায়। আধা-সিংহ আধা-মানুষের এই চিহ্নটা আসলে জার্মানির স্ট্যাডেল গুহায় পাওয়া যাওয়া অনেক প্রাচীন একটি মূর্তির প্রতিরূপ। এই চিহ্নটা পিউজো কোম্পানির তৈরি করা গাড়িগুলোর জন্য অপরিহার্য এক অলংকার। পিউজো ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন এবং বৃহদাকার গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে অন্যতম। পিউজো কোম্পানি ভ্যালেনটিগনি (Valentigney) নামের একটি গ্রামে পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে গাড়ি তৈরি করতে শুরু করে। এই গ্রামটি ছিলো স্ট্যাডেল গুহা থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। বর্তমানে এই কোম্পানিতে প্রায় দুই লাখ লোক কাজ করে যাদের বেশিরভাগই একে অপরকে চেনে না। কিন্তু এই অচেনা লোকগুলো পরস্পরের সাথে এত নিঁখুতভাবে কাজের সমন্বয় করে যে ২০০৮ সালে পিউজো কোম্পানি প্রায় ১৫ লাখ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি তৈরি করে এবং সেখান থেকে তাদের মুনাফা আসে ৫৫০ কোটি ইউরো।
এখন, কোন অর্থে আমরা বলতে পারি যে, পিউজো (Peugeot SA) কোম্পানিটির অস্তিত্ব আছে? পিউজো কোম্পানির বানানো অনেক গাড়ি আছে, কিন্তু গাড়িগুলোকে কি একটি কোম্পানি বলা যায়? যদি পিউজো কোম্পানির বানানো সবগুলো গাড়ি ভেঙে ফেলা হয় এবং লোহালক্কড়ের দোকানে সেই ভাঙা টুকরো-টাকরা গুলো বেচেও দেওয়া হয়, তারপরও কিন্তু পিউজো কোম্পানিটি থেকে যাবে। এটা আরও নতুন নতুন গাড়ি তৈরি করবে এবং বার্ষিক আয় ব্যয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। কোম্পানিটির গাড়ি বানাবার কারখানা আছে, আছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং বিক্রি করার জন্য দোকান। কোম্পানিতে কাজ করে অনেক শ্রমিক, হিসাবরক্ষক এবং কর্মকর্তা কিন্তু, এ সবকিছুর সমষ্টিকেও কিন্তু পিউজো কোম্পানি বলা যাবে না। কারণ, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোম্পানির সকল কর্মচারী মারা যেতে পারে, কোম্পানিটির সকল কারখানা, যন্ত্রপাতি এবং দোকান গুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। এরপরও কোম্পানিটি টাকা ধার করতে পারবে, নতুন কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারবে, নতুন করে কারখানা বানাতে পারবে এবং যন্ত্রপাতি কিনতে পারবে। সুতরাং এসবের সমষ্টিকেও পিউজো কোম্পানি বলা যাচ্ছে না। পিউজো কোম্পানিতে আছে অনেক ম্যানেজার এবং আছে অনেক শেয়ারমালিকও। কিন্তু তারাও কিন্তু কোম্পানির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য নয়। সবগুলো ম্যানেজারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও এবং কোম্পানির সবগুলো শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হলেও কোম্পানিটি বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে।
কিন্তু এতসব কথার মানে কিন্তু এই নয় যে, পিউজো কোম্পানি অমর বা কোনোকিছুতেই তার অস্তিত্ব বিলীন হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেই মুহূ্র্তে একজন বিচারক কোম্পানি ভেঙে দেবার ঘোষণা দেবেন, এর সকল কর্মচারী, কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষক, ম্যানেজার, শেয়ারমালিক সকলে অক্ষত থাকলেও সাথে সাথেই পিউজো কোম্পানির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এ থেকে বোঝা যায়, বাস্তব দুনিয়ার কোনো বস্তু বা ব্যক্তিই পিউজো কোম্পানির টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য নয় এবং পিউজো কোম্পানি বাস্তব জগতের কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সমষ্টি নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে বাস্তব দুনিয়ায় আদৌ কি ‘পিউজো’ বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে?
পিউজো হল আমাদের সমষ্টিগত কল্পনা দ্বারা সৃষ্ট একটি সত্তা। আইনজীবীরা একে বলেন ‘আইনসিদ্ধ গল্প’ (legal fiction)। আপনি আঙুল তুলে কখনোই একে দেখাতে পারবেন না, কারণ এর কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এটি একটি আইনসিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে সমাজে টিকে থাকে। আপনার আমার মতো এই অদৃশ্য, কল্পিত সত্ত্বাটিও নিজ দেশের প্রচলিত আইন কানুনের অধীন। এই কাল্পনিক সত্ত্বাটি আমাদের মানুষদের মতোই একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে, কিনতে পারে নিজের নামে জমি-জমা-সম্পত্তি। এবং মানুষের মতোই এই কোম্পানিতে যারা কাজ করে তারা কোম্পানিকে অভিযুক্ত এবং ধ্বংসও করতে পারে।
পিউজো হলো একটি বিশেষ ঘরানার আইনসিদ্ধ গল্পের নাম যাকে আমরা বলি- ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি (Limited Liability Company)’। এই ধরনের কোম্পানির উদ্ভব মানুষের অনন্য উদ্ভাবনী শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। লক্ষ লক্ষ বছর মানুষ এইসব কোম্পানি ছাড়াই কাটিয়েছে। ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে কেবল মানুষ নামের এই বড় মগজওয়ালা রক্তমাংসের দোপেয়ে প্রাণীটিকেই সম্পদের মালিক হতে দেখা গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ত্রয়োদশ শতকের ফ্রান্সে জিন নামের কেউ যদি একটা মালগাড়ি তৈরির কারখানা দিত, তাহলে জিন নিজেই সেখানে হতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জিনের বানানো একটি গাড়ি কেনার এক সপ্তাহ পর সেটাতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ক্রেতা সরাসরি জিনকে দোষারোপ করতে পারত। ধরা যাক, কারখানা স্থাপনের জন্য জিনকে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা ধার করতে হলো এবং শেষমেশ ব্যবসা দাঁড়ালো না। সেক্ষেত্রে জিনকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তার বাড়ি-ঘর, গবাদিপশু বেচে সেই ধার শোধ করতে হতো। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাকে বাধ্য হয়ে সন্তানদেরও দাস হিসেবে বিক্রি করতে হতে পারত। যদি এরপরেও ধার শোধ না হয়তো, তাহলে রাষ্ট্র তাকে নিক্ষেপ করত কারাগারে কিংবা সে হয়ে যেত ঋণদাতার দাস। তার কারখানার যে কোনো ঘটনা এবং পরিস্থিতির জন্য সে এককভাবে দায়ী থাকতো।
আপনি যদি সে সময়ের মানুষ হতেন, তাহলে আপনি নিজের একটা প্রতিষ্ঠান দেবার আগে আপনাকে বারবার এই ঝুঁকিগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হতো। তখনকার দিনে আইন এবং রাষ্ট্রও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছাকে নিরুৎসাহিত করত। মানুষ নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা বা অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিতে ভয় পেত। নিজের ও পরিবারের একেবারে নিঃস্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এরকম উদ্যোগ নেওয়ার কোনো মানে খুঁজে পেত না তারা।
এইসব কারণেই মানুষ সমষ্টিগতভাবে সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। এই ধরনের কোম্পানির মালিক, বিনিয়োগকারী অথবা ম্যানেজাররা আইনানুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে কোম্পানির ভালো মন্দের জন্য দায়ী থাকে না- সব দায় কোম্পানির উপর বর্তায়। কয়েক শতাব্দী হলো এই ধরনের কোম্পানিগুলোই অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে এবং আমরা এসব কোম্পানির ব্যাপারে এখন এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, আমরা ভুলেই গিয়েছি, এই কোম্পানিগুলোর অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের কল্পনায়। যুক্তরাষ্ট্রে ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’র একটা কেতাবি নাম আছে – সেটা হলো ‘করপোরেশন’ (Corporation)। নামটির উৎস অনুসন্ধান করা হলে নামটিকে একরকম প্রহসন বলেই মনে হয়। ইংরেজি ‘Corporation’ নামটি এসেছে ল্যাটিন ‘Corpus’ শব্দ থেকে। ‘Corpus’ এর অর্থ হলো যে কোনো কাঠামোর প্রধান অংশ বা শরীর। অথচ সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানিগুলোতে এই প্রধান কাঠামো বলে আসলে কিছুই নেই। যেহেতু কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ কোম্পানির কাঠামো গঠন করে না, আমেরিকার আইন কোম্পানিকেই এমনভাবে বিবেচনা করে যেন কোম্পানিটি একটি রক্ত-মাংসের মানুষ এবং কোম্পানির সব দায়-দায়িত্ব এই কল্পিত সত্ত্বার উপর বর্তায়।
পিউজো কোম্পানির ইতিহাস দেখলে পুরো ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। ১৮৯৬ সাল। আরমান্ড পিউজো (Armand Peugeot) পৈতৃকসূত্রে একটি ধাতব যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার মালিক। সে কারখানায় তখন স্প্রিং, করাত, বাইসাইকেল এসব তৈরি হতো। এরপর তিনি গাড়ি তৈরির ব্যবসায় নামার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। এই লক্ষ্যে তিনি একটি ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’ তৈরি করলেন। নিজের নামে তিনি কোম্পানির নামকরণ করলেন কিন্তু যেহেতু এটা ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’, তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে এর ভালো-মন্দের জন্য দায়ী থাকলেন না। সুতরাং, যদি এই কোম্পানির বানানো কোন গাড়ি ভেঙে যায় বা এতে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে ক্রেতা পিউজো কোম্পানিকে অভিযুক্ত করতে পারবেন, ব্যক্তি আরমান্ড পিউজোকে নয়। যদি কোম্পানি লক্ষ লক্ষ ফ্রাঙ্ক ধার করে এবং ব্যবসায় মার খেয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, তবু ‘আরমান্ড পিউজো’ ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগকারীদের এক ফ্রাঙ্কও শোধ করার দায় বহন করেন না। কারণ, ধারটা নিয়েছিলো পিউজো কোম্পানি, ব্যক্তি আরমান্ড পিউজো নন। মানুষ আরমান্ড পিউজো ১৯১৫ সালে মারা যান। কোম্পানি পিউজো এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে-বর্তে আছে।
কৌতূহল জাগতেই পারে, ঠিক কীভাবে মানুষ আরমান্ড পিউজো, ‘পিউজো’ কোম্পানি তৈরি করলেন? আসলে এই ধরনের ঘটনা কিন্তু অনেককাল আগে থেকেই চলে আসছে। এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করেই সাধু-সন্ত এবং যাদুকরেরা যুগ যুগ ধরে দেব-দেবী এবং শয়তান তৈরি করে আসছেন, একই পদ্ধতিতে হাজার হাজার ফরাসি যাজক প্রতি রবিবারে চার্চে কল্পনায় যিশু খ্রিস্টের শরীর তৈরি করেন। এই সবগুলো জিনিসেরই উৎপত্তি হয়েছে একটা গল্প বলা এবং মানুষের কাছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মাধ্যমে। ফরাসি যাজকদের ক্ষেত্রে গল্পটা ছিলো ক্যাথলিক চার্চের মারফতে বলা যিশু খ্রিস্টের জীবন ও মৃত্যুর করুণ কাহিনী। এই গল্প অনুযায়ী, যদি একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক আচার-নিষ্ঠা সহকারে পবিত্র পোশাক পরিধান করে তিথি অনুযায়ী সঠিক স্তোত্র পাঠ করেন, তাহলে সাধারণ রুটি এবং মদ হঠাৎ করে ঈশ্বরের মাংস আর রক্তে রূপান্তরিত হয়। ধর্মযাজক পাঠ করতে থাকেন – ‘Hoc est corpus meum!’ (ল্যাটিন ভাষায় ‘এই হলো আমার শরীর’) – ব্যস, রুটি যিশু খ্রিস্টের মাংসে পরিণত হলো! সবাই দেখে তাদের গুরু কত নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের সাথে স্তোত্রগুলো পাঠ এবং নিয়ম কানুনগুলো পালন করে। এইসব দেখে লক্ষ লক্ষ ফরাসি ক্যাথলিক বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ঈশ্বর সত্যি সত্যিই ওই উৎসর্গ করা রুটি এবং মদের মাঝে আছেন।
পিউজো কোম্পানির ক্ষেত্রে গল্পটা হলো ফ্রান্সের আইন-কানুন, যার রচয়িতা ফ্রান্সের আইনসভা। ফ্রান্সের আইন প্রণেতাদের মতে, যদি একজন সার্টিফিকেটধারী আইনজীবী সকল নিয়ম-নীতি পালন করে, সকল দরকারি শর্তাবলি এবং প্রতিজ্ঞা একটি সুন্দর কাগজে (দলিল) লিপিবদ্ধ করে এবং সেই কাগজের নিচে তার একটি মূল্যবান স্বাক্ষর দিয়ে কাগজটিকে মহিমান্বিত করে তোলে – ‘হোকাস পোকাস’ – একটি নতুন কোম্পানির জন্ম হয়ে গেলো। ১৮৯৬ সালে আরমান্ড পিউজো যখন কোম্পানি তৈরির পরিকল্পনা করেন, তখন তিনি আইনজীবীকে এইসব পবিত্র কাজের জন্য টাকা দিলেন। যখন আইনজীবী সঠিকভাবে তার আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন এবং সকল জাদুকরী মন্ত্র এবং শপথ পাঠ করলেন, লক্ষ লক্ষ ফরাসি নাগরিক বিশ্বাস করতে শুরু করলো ‘পিউজো’ নামে সত্যিই একটি কোম্পানি আছে!
অবশ্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্প বলাও সহজ নয়। গল্প বলাটা এমনিতে এমন কোন কঠিন কাজ নয়, সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কাজটাই কঠিন। ‘কীভাবে একজন মানুষ ঈশ্বর, জাতি বা সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি বিষয়ক এক একটা গল্প বানায় যা লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষ সত্য বলে বিশ্বাস করে?’ – ইতিহাসের একটা বড় অংশ কেবলমাত্র এই প্রশ্নের আলোচনা নিয়েই আবর্তিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো – কোনো সেপিয়েন্স যখন এই বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্প বলার কঠিন কাজটিতে সফল হয়, তখন তা সমস্ত সেপিয়েন্সদের এক অসাধারণ ক্ষমতা দেয়। তখন একই গল্পে বিশ্বাস করা লাখ লাখ অচেনা মানুষ একে অপরকে না চিনেও পরস্পরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে এবং এক ও অভিন্ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারে। ভেবে দেখুন, আমরা যদি শুধুমাত্র বাস্তবে আছে এমন জিনিস নিয়ে ভাবতাম (যেমন নদী, গাছ এবং সিংহ) এবং কোন কাল্পনিক গল্পে বিশ্বাস না করতাম তাহলে রাষ্ট্র, চার্চ এবং রাষ্ট্রের আইন গড়ে তোলা কতটা কঠিন হতো!
এভাবে বছরের পর বছর ধরে, মানুষ ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর গল্পের জাল বুনে চলেছে। এই বিশালকায় গল্পের জালে ‘পিউজো’ এর মতো গল্পগুলো শুধু টিকেই থাকে না বরং দিনের পর দিন আরো শক্তিশালী হয়। এই গল্পের জালের মধ্য দিয়ে মানুষ যেসব জিনিসের অস্তিত্ব তৈরি করে সেগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জগতে ‘কল্পিত গল্প’ (fictions), ‘সমাজকাঠামো’ (social construct) বা ‘কল্পিত বাস্তবতা’ (Imagined realities) নামে ডাকা হয়। সকল ‘কল্পিত বাস্তবতা’ই কিন্তু মিথ্যা নয়। এক্ষেত্রে ‘মিথ্যা’ কাকে বলব সেই বিষয়টা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। ধরা যাক, আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, নদীর পাড়ে কোনো সিংহ নেই। এ কথা জেনেও আমি সবাইকে এসে বললাম- ‘নদীর পাড়ে একটি সিংহ আছে’। এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। অবশ্য, মিথ্যা বলা এমন কোন আহামরি নতুন ব্যাপার নয়। সবুজ বানর এবং শিম্পাঞ্জিও মিথ্যা বলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – সবুজ বানর অনেক সময় ইচ্ছা করেই ‘সাবধান, সিংহ আসছে’ – এই কথার সংকেত দেয় যখন আশেপাশে আদপে কোনো সিংহই থাকে না। এই সংকেত শুনে আশেপাশের কোনো সবুজ বানর যে হয়তো এইমাত্র একটি কলার খোঁজ পেয়েছে, কলা ফেলে ভয়ে সেই জায়গা থেকে পালিয়ে যায়। এবং আমাদের মিথ্যাবাদী সবুজ বানর তখন কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই আরামে সেই কলাটি হস্তগত করে। এখানে মিথ্যাবাদী সবুজ বানর কিন্তু জানে কোনো বিপদ নেই কিন্তু অন্যরা ভাবে সামনে অনেক বিপদ।
এরকম ‘মিথ্যা’র সাথে ‘কল্পিত বাস্তব’তার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। ‘কল্পিত বাস্তবতা’ হলো এমন একটা ব্যাপার যেটা একই গোত্র বা দলভুক্ত সবাই বিশ্বাস করে। যতদিন এরকম একটা কল্পিত বাস্তবতায় সবাই বিশ্বাস করে, ততদিন সেই কল্পিত বাস্তবতা পৃথিবীতে একটি শক্তি হিসেবে কাজ করে। স্ট্যাডেল গুহায় যে শিল্পী কাজ করতেন তিনি হয়তো সত্যি সত্যি সিংহ-মানব নামে তাদের রক্ষাকারী কোনো দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। কিছু জাদুকর হয়তো ভন্ডামি করতে পারেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই হয়তো দেবতা এবং দৈত্যদের দৈব শক্তিতে বিশ্বাস করেন। অনেক কোটিপতি খুব জোরালোভাবে ‘টাকা-পয়সা’ এবং ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’র অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। বেশিরভাগ মানবাধিকার কর্মী ‘মানুষের অধিকার’ নামে একটি ব্যাপারের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। সুতরাং, ২০১১ সালে জাতিসংঘ যখন দাবি করে যে, লিবিয়ার সরকার তার নাগরিকদের অধিকারকে মর্যাদা দেয়- এরকম একটি বাক্য আসলে ‘মিথ্যা’ নয়। যদিও ‘জাতিসংঘ’, ‘লিবিয়া’, ‘মানবিক অধিকার’ এই প্রতিটি ব্যাপারই মানুষের উর্বর মস্তিকের কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
সুতরাং একটা ব্যাপার এখন বোঝা যাচ্ছে, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে মানুষ মূলত দু’রকম বাস্তবতায় বসবাস করছে। একটি বস্তুগত বাস্তবতা যেমন নদী, গাছপালা এবং সিংহ; আর অন্যদিকে কল্পিত বাস্তবতা যেমন দেব-দেবী, ঈশ্বর, জাতি, গোষ্ঠী, আইন-কানুন ইত্যাদি। যত দিন যাচ্ছে, এই কল্পিত বাস্তবতা, বস্তুগত বাস্তবতার থেকে বেশি শক্তিশালী, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মানুষের কাছে। সে কারণে বর্তমানে নদ-নদী, গাছপালা, পশু-পাখি এসবের টিকে থাকা আসলে নির্ভর করে দেব-দেবী, জাতি বা কোনো বড়সড় কোম্পানির ইচ্ছার উপর। অপরদিকে নদ-নদী, গাছপালা, পশু-পাখি এসবের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর মানুষের কল্পিত বাস্তবতার উপাদানগুলোর অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়।
জিনোমকে ল্যাং মেরে
শুধুমাত্র কথা দিয়ে কল্পিত বাস্তবতা তৈরির ক্ষমতা অনেকগুলো অচেনা মানুষকে একসাথে কাজ করার একটা অভাবনীয় ক্ষমতা এনে দিয়েছে মানুষের হাতে। কিন্তু এর আরও অনেক সুদূরপ্রসারী প্রভাবও আছে। যেহেতু বড় আকারের মানব সংগঠনগুলো কল্পিত গল্পের ভিত্তিতে চালিত হয়, গল্প পরিবর্তন করার মাধ্যমে মানুষের সাথে মানুষের আচরণের ধরনও পাল্টে ফেলা সম্ভব। কোনো কোনো সময়ে গল্পগুলো অনেক দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের জনগণ বলতে গেলে রাতারাতিই ‘রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী’ এরকম গল্পে বিশ্বাস হারিয়ে ‘জনগণ সর্বময় ক্ষমতার উৎস’ এরকম একটি গল্পে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে মানুষ ক্রমাগত তার চাহিদার পরিবর্তন অনুযায়ী তাদের নিজেদের পারস্পরিক যোগাযোগ বা আচার-আচরণের পদ্ধতি পালটে ফেলেছে। এভাবেই সূচনা হয়েছে সাংস্কৃতিক বিবর্তন নামের একটি দ্রুতগামী প্রক্রিয়ার যা জিনগত বিবর্তনের মতো অত ঢিমেতালের নয়। এই দ্রুতগামী সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ট্রেনে চড়ে সেপিয়েন্সরা খুব দ্রুত পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে সেপিয়েন্সদের অন্যান্য প্রজাতি এবং অন্যান্য প্রাণীদের থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেল।
অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আচরণের অনেকটাই জিনগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। তবে কেবলমাত্র ডিএনএ (DNA) প্রাণীদের আচরণগত বৈশিষ্ট্যের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য দেখায় এমনটা বলাও ঠিক হবে না। প্রাণীদের আচার-আচরণের পেছনে পরিবেশগত উপাদান এবং ব্যক্তিগত অভিব্যক্তিরও প্রভাব বিদ্যমান। কিন্তু, তা হলেও, একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে একটি প্রজাতির সকল প্রাণী মোটামুটি একই রকম আচরণ করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে জিনগত পরিব্যক্তি (Genetic mutation) ছাড়া বড় কোনো আচরণগত পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় না। যেমন, শিম্পাঞ্জির জিনগত স্বভাব হলো তারা একটি স্তরভিত্তিক গোত্র বা গোষ্ঠী আকারে থাকবে যার নেতৃত্ব দেবে ‘আলফা পুরুষ’। শিম্পাঞ্জিদের কাছাকাছি আরেকটি প্রজাতি হল বোনোবো (Bonobo)। এদের সমাজ অনেকটা সাম্যবাদী ও মাতৃতান্ত্রিক। নারী বোনোবোর একটি দল এদের নেতৃত্ব দেয়। সাধারণ বোনোবোরা কখনো প্রতিবেশীদের সাথে দল বেঁধে একটি নারীবাদী বিপ্লব গড়ে তোলে না। পুরুষ শিম্পাঞ্জিরা কখনো একটি সংসদ ভবনে একত্রিত হয়ে আলফা পুরুষের অফিস ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় না এবং ঘোষণা করে না – আজ থেকে সকল শিম্পাঞ্জি সমান। সকলের অধিকার সমান। এরকম কিছু কেবলমাত্র তখনই ঘটতে পারে যদি শিম্পাঞ্জির ডিএনএতে কোন পরিবর্তন হয়।
ঠিক একই কারণে অনেক প্রাচীন কালের সেপিয়েন্সদের মাঝেও বিপ্লবের কোনো ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায় না। আমরা যতদূর জানি, তাতে মনে হয়, প্রাচীন মানুষের সমাজকাঠামোর পরিবর্তন, নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং নতুন নতুন অভ্যাসের পেছনে সাংস্কৃতিক উদ্যোগের চেয়ে বেশি দায়ী ছিলো জিনগত পরিব্যক্তি এবং পারিপার্শ্বিক চাপ। এই কারণেই, এসব কাজ করতে মানুষের হাজার হাজার বছর লেগে গেছে। দুই মিলিয়ন বছর আগে, জিনগত পরিব্যক্তির কারণে ‘হোমো ইরেক্টাস’ নামে একটি প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিলো। এই প্রজাতির উদ্ভবের হাত ধরেই পৃথিবীতে এসেছিলো পাথরের হাতিয়ার তৈরির প্রযুক্তি। মূলত পাথরের তৈরি এইসব হাতিয়ার এবং সরঞ্জামকেই এই প্রজাতির সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য বলে ধরা হয়। যতদিন পর্যন্ত হোমো ইরেক্টাসের আর কোনো বড় ধরনের জিনগত পরিব্যক্তি না হলো, ততদিন পর্যন্ত এই পাথরের হাতিয়ারগুলোর প্রকৃতি এবং প্রযুক্তি মোটামুটি অপরিবর্তিত অবস্থায়ই ছিলো এবং এই অপরিবর্তিত থাকার সময়কাল ছিলো মোটামুটি ২০ লক্ষ বছর!
অপরদিকে, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে, সেপিয়েন্সরা খুব দ্রুত তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়; কোনো জিনগত বা পরিবেশগত পরিবর্তন ছাড়াই তারা পরিবর্তিত আচরণের বিধান পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয় তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এর একটা বড় উদাহরণ হতে পারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে কিছু সম্ভ্রান্ত মানুষের সন্তানহীন থাকবার প্রথা। ক্যাথলিক চার্চের পুরোহিত, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং বিধান অনুসারে নপুংসক হওয়া চীনের সম্ভ্রান্ত শাসকবর্গের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। প্রাকৃতিক বিবর্তনের মূলনীতি অনুসারে সমাজে এই ধরনের মানুষ যারা সন্তান উৎপাদন করে না তাদের যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবার কথা নয়। যেখানে শিম্পাঞ্জির ‘আলফা পুরুষ’ তার ক্ষমতা ব্যবহার করে যত বেশি সম্ভব নারী শিম্পাঞ্জির সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয় এবং নিজে দলের অনেক বাচ্চা শিম্পাঞ্জির বাবায় পরিণত হয়, সেখানে ক্যাথলিক ‘আলফা পুরুষ’ (ক্যাথলিক পুরোহিত বা যাজক) সম্পূর্ণরূপে যৌন সংসর্গ এবং সন্তান প্রতিপালনের মতো বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকেন। কোনো পরিবেশগত কারণে (যেমন খাদ্য সংকট) যে তিনি সন্তান উৎপাদন থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এমনটা নয়। এমনটাও নয় যে কোনো জিনগত তারতম্যের কারণে তিনি এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন। ক্যাথলিক চার্চ শত শত বছর হলো টিকে আছে- সেটা বন্ধ্যাত্বের জিন এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তর করে নয়, বরং টিকে আছে খ্রিস্ট ধর্মের নতুন নিয়ম (New Testament) এবং ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের আইন-কানুন (Catholic canon law) এর গল্প এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরের মাধ্যমে।
এইসব আলোচনা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে, যেখানে আদিম মানুষের আচরণ এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন হাজার হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত ছিল, সেখানে সেপিয়েন্সরা তাদের কল্পিত বাস্তবতার ধারণার সাহায্যে মাত্র এক কি দুই দশকের মাঝে তাদের সমাজ-কাঠামো, তাদের মধ্যকার সম্পর্কের ধরন, তাদের অর্থনৈতিক কার্যপ্রণালী এবং আরো অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আমূল বদলে দিতে পেরেছিল। বার্লিনের একজন অধিবাসীর কথা ধরা যাক। ধরি, তিনি ১৯০০ সালে জন্মগ্রহণ করে মোটামুটি ১০০ বছর বেঁচে ছিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি সম্রাট দ্বিতীয় উইলহেলম এর হোহেনজোলেরন রাজ্যে (Hohenzollern Empire of Wilhelm II) তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত করেছেন, তাঁর তারুণ্য এবং পরিণত বয়স কেটেছে উইমার প্রজাতন্ত্রে (Weimar Republic), হিটলারের শাসনাধীন জার্মান রাষ্ট্রে এবং পরে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানিতে। অবশেষে তিনি মারা গেলেন গণতান্ত্রিক এবং একীভূত জার্মানিতে। তিনি তাঁর জীবনকালে অনেকগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশীদার হলেন, পরিবর্তিত হলো তাঁর আচরণ ও সামাজিক সম্পর্কের ধরন, যদিও পুরো সময় ধরে তাঁর জিনগত পরিচয় ছিলো পুরোপুরি অপরিবর্তিত।
এই নতুন নতুন গল্প তৈরির মাধ্যমে দ্রুত বদলানোর ব্যাপারটিই ছিলো সেপিয়েন্সদের সফলতার মূলমন্ত্র। একজন সেপিয়েন্সের সাথে একজন নিয়ান্ডার্থালের সম্মুখ যুদ্ধে সম্ভবত সেপিয়েন্সই পরাজিত হবে। কিন্তু, শত শত নিয়ান্ডার্থালের সাথে শত শত সেপিয়েন্সের যুদ্ধ হলে সেখানে নিয়ান্ডার্থাল এর জয়ের কোন সম্ভাবনা নেই। নিয়ান্ডার্থালরা হয়তো সিংহ আসার সংকেত অন্যদেরকে জানাতে পারত, কিন্তু তাদের পক্ষে গোত্রের রক্ষাকারী দেবতার গল্প বলা এবং সে গল্প পরিবর্তন করে আবার বলা অসম্ভব ছিল। গল্প বানাতে না পারার কারণে, ‘কল্পিত বাস্তবতা’ তৈরি করতে না পারার কারণে নিয়ান্ডার্থালদের পক্ষে বড় গোষ্ঠী বা দল আকারে কাজ করা অসম্ভব ছিলো এবং একই কারণে তারা দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে তাদের নিজেদের সামাজিক আচরণ বদলে ফেলতেও অসমর্থ ছিলো।
যদিও কোন নিয়ান্ডার্থাল এর মাথার ভেতর ঢুকে বোঝা সম্ভব না যে তারা কীভাবে চিন্তা-ভাবনা করতো, তবু পরোক্ষ কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে সেপিয়েন্সদের তুলনায় তাদের বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা খানিকটা আঁচ করা যায়। কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে ৩০,০০০ বছর আগেকার সেপিয়েন্সদের বসতির জায়গাগুলোতে খননকাজ চালাবার সময় ঘটনাক্রমে ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের কিছু সামুদ্রিক ঝিনুক এর সন্ধান পান। খুব সম্ভবত এই সামুদ্রিক ঝিনুকগুলো বিভিন্ন সেপিয়েন্স গোষ্ঠীর মাঝে দূরপাল্লার বাণিজ্যের ফলেই ইউরোপে আসে। নিয়ান্ডার্থালদের মাঝে এরকম কোনো দূরপাল্লার ব্যবসা বাণিজ্যের নজির পাওয়া যায়নি। তাদের প্রতিটা গোষ্ঠী বা দল নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজেরাই তৈরি করে নিত হাতের কাছের উপকরণ দিয়ে।৪
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আরেকটি উদাহরণের কথা ধরা যাক। নিউ গিনির উত্তর দিকে, নিউ আয়ারল্যান্ডের একটি দ্বীপে সেপিয়েন্সদের একটি গোষ্ঠী বসবাস করতো। তারা আগ্নেয়গিরির ম্যাগমা শীতল হয়ে তৈরি হওয়া ‘অবসিডিয়ান’ (obsidian) নামের একপ্রকার আধা-স্ফটিক পদার্থ (volcanic glass) দিয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত এবং ধারালো যন্ত্রপাতি তৈরি করতে জানতো। নিউ আয়ারল্যান্ডে প্রাকৃতিকভাবে কোন অবসিডিয়ানের মজুদ থাকবার কথা না। ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় প্রমাণ মেলে যে তারা যেই ধরনের অবসিডিয়ান ব্যবহার করতো তা ৪০০ কিলোমিটার দূরে নিউ ব্রিটেনের একটি দ্বীপ থেকে আনা। তার অর্থ এই নিউ আয়ারল্যান্ডের দ্বীপের কিছু লোক অবশ্যই দক্ষ নাবিক ছিলো যারা সঠিকভাবে দিক নির্ণয় করে দূরের দ্বীপগুলোর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত।৫
ব্যবসা-বাণিজ্যকে একটি স্বাভাবিক দরকারি কাজ হিসেবেই মনে হতে পারে, যার জন্য কোন কল্পনা বা কল্পিত গল্পের দরকার নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইতিহাসে সেপিয়েন্স বাদে আর কোনো প্রাণীর ব্যবসা-বাণিজ্য করার কোনো নজির পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে বিস্তারিত সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলে যে, সেপিয়েন্সরা সেকালে এমন জিনিসেরই ব্যবসা করত যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য নয় বরং যেসব দ্রব্যের সাথে সম্পর্ক আছে কেবল বানিয়ে তোলা গল্পের। দুই জন লোকের মাঝে ব্যবসার জন্য দরকার পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। মানুষের স্বভাব হলো একজন অচেনা লোককে সে সহজেই বিশ্বাস করতে পারে না। সে কারণে দুইজন অচেনা লোকের মাঝে আস্থা তখনই গড়ে ওঠে যখন তারা দুজনই তৃতীয় কোনো কিছুর কল্পিত অস্তিত্বে বিশ্বাস করে অর্থাৎ একই ‘কল্পিত বাস্তবতা’র অংশীদার হয়। আজকের দিনে দুনিয়াজোড়া চেনা, অচেনা এতসব মানুষের মাঝে এত ধরনের ব্যবসার ভিত্তি হলো ‘ডলার’, ‘ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক’ এবং ‘সংস্থার পরিচয়বাহী ছবি বা লোগো’- এসবের কল্পিত অস্তিত্বে বিশ্বাস। আদিমকালেও ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই ছিলো। যখন দুটো আদিম গোষ্ঠী বা দলের দুইজন মানুষ একে অপরের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করতে চাইত তখন তাদের পারস্পরিক আস্থার ভিত্তি হতো একই ঈশ্বরে বা একই কল্পিত পূর্বপুরুষে, একই গোত্রদেবতায় বা একই পবিত্র প্রাণীতে স্থাপিত বিশ্বাস।
যদি প্রাচীনকালের সেপিয়েন্সরা একই গল্পে বিশ্বাসের মাধ্যমে ঝিনুক, অবসিডিয়ান এসব নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, তাহলে এটা কল্পনা করাও কঠিন নয় যে, তারা নানা রকম তথ্য বা কৌশলও একে অপরের সাথে বিনিময় করত। এভাবে সেপিয়েন্সদের মাঝে একটা নিবিড় এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো যেটা নিয়ান্ডার্থাল বা তৎকালীন অন্য কোন মানব প্রজাতির পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এ তো গেলো ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা। শিকার কৌশলের দিকে লক্ষ্য করলেও নিয়ান্ডার্থাল ও সেপিয়েন্সের মাঝে একটা মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নিয়ান্ডার্থালরা মূলত একজন বা একটি ছোট দল নিয়ে শিকার করতে বেরুতো। অন্যদিকে সেপিয়েন্সরা ডজন ডজন মানুষ একসাথে মিলে দল গঠন করে শিকার করত, এমনকি অনেক সময় তারা অন্য দলের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সাথে নিয়েও শিকারে বেরুতো। একটা শিকার কৌশল সেপিয়েন্সদের মাঝে বহুল প্রচলিত ছিলো। সেটা হলো – তারা সবাই মিলে গোল হয়ে একটি বড় আকারের পশুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তাড়া করত। তারপর তাড়া করতে করতে কৌশলে তাকে নিয়ে যেত কোন গিরিখাদে অথবা গর্তের কিনারায়। সেখানে নিরুপায় পশুকে তারা সবাই মিলে সহজেই শিকার করতে পারত। এভাবে সেপিয়েন্সরা বন্য ঘোড়ার মতো বড় বড় পশু শিকার করত। সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক চললে এক বিকেলের সমন্বিত প্রয়াসেই সেপিয়েন্সরা জমা করতে পারতো টনকে টন মাংস, চর্বি আর চামড়া। এই বিশাল সংগ্রহ নিয়ে হয় তারা একরাতে হৈ-হুল্লোড় করে একটি জম্পেশ ভোজের আয়োজন করতো অথবা শুকিয়ে, সেঁকে বা ঠাণ্ডা করে জমিয়ে রাখত সামনের দিনগুলোর জন্য। নৃতাত্ত্বিকেরা আবিষ্কার করেছেন যে, এভাবে প্রতি বছর তারা অনেক বড় বড় পশুর পুরো পালকেই হত্যা করতো। এমনও অনেক জায়গার সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে সব পশুগুলোকে তাড়িয়ে এনে হত্যার করার জন্য তারা কৃত্রিম বেড়া বা অন্য কোন ধরনের ফাঁদ তৈরি করেছিল।
আমরা এটা ধরেই নিতে পারি যে, নিয়ান্ডার্থালদের নিয়মিত শিকারের জায়গা সেপিয়েন্সরা কেড়ে নিয়ে যখন তাদের একচ্ছত্র কসাইখানায় পরিণত করলো তখন নিয়ান্ডার্থালরা তাতে মোটেই খুশি হয়নি। আর আগের আলোচনা থেকেই আমরা এটা বুঝতে পারি যে, সেপিয়েন্সদের সাথে নিয়ান্ডার্থালদের যুদ্ধ হলে সে যুদ্ধে নিয়ান্ডার্থালরা কার্যত বুনো ঘোড়ার থেকে শক্তিশালী কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না। ৫০ জন নিয়ান্ডার্থালের দলের সাথে ৫০০ জন সংঘবদ্ধ, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বুদ্ধিমান সেপিয়েন্সের লড়াইয়ে নিয়ান্ডার্থালদের টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। আর যদি দুর্ঘটনাক্রমে সেপিয়েন্সরা প্রথমবার হেরেও যেত, তারা আবার জোটবদ্ধ হয়ে নিয়ান্ডার্থালদের হারানোর জন্য বুদ্ধি খাটিয়ে ঠিকই নতুন নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে পারত।
কী দিলো এই বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব?
নতুন ক্ষমতা | দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব |
হোমো সেপিয়েন্সের নিজের চারপাশের জগত সম্পর্কে অনেক তথ্য অন্যকে জানাবার ক্ষমতা। | কঠিন কঠিন কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। উদাহরণ – সিংহের আক্রমণ থেকে বাঁচা, বাইসন শিকার করা। |
মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারে অন্যকে আরো বেশী করে জানাবার ক্ষমতা। | মানুষের বড় বড় গোষ্ঠী, যেসব গোষ্ঠীর আকার ছিল সর্বোচ্চ ১৫০ জনের। |
মানুষকে বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন কিছুর কল্পিত গল্প বলতে পারার ক্ষমতা। যেমন- গোত্রের জ্বীন-পরী-দেবতা-অপদেবতা, সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি এবং মানবাধিকার। | ১. চেনা-অচেনা মানুষের সমন্বয়ে অনেক বৃহদাকার মানব সংগঠনের উদ্ভব।২. নানারকম সামাজিক আচার-প্রথার উদ্ভব। |
ইতিহাস এবং জীববিজ্ঞান
এই অধ্যায়ে আমরা সেপিয়েন্সের তৈরি করা অনেক রকম ‘কল্পিত বাস্তবতা’র উদাহরণ দেখেছি। এইসব কল্পিত বাস্তবতায় বিশ্বাস করা, বিশ্বাস না করা বা কিছু কিছু কল্পিত বাস্তবতাকে বিশ্বাস এবং কিছু কিছুকে অবিশ্বাস করার প্রবণতা মানুষের মাঝে নানারকম আচরণগত বৈচিত্র্যের জন্ম দেয়। বিভিন্ন মানুষের মধ্যকার এই আচরণগত বৈচিত্র্যই ‘সংস্কৃতি’র মূল উপাদান। সংস্কৃতির সূচনা হবার পর থেকেই এর ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে, বাড়ছে উৎকর্ষ। সংস্কৃতির এই বিরতিহীন পরিবর্তনের আখ্যানই হলো ‘ইতিহাস’।
সুতরাং, এটা বলা যায়, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবই হলো সময়ের সেই বিন্দু যেই বিন্দুতে ইতিহাস জীববিজ্ঞানের গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের আগেকার সকল মানুষের আচরণের ব্যাখ্যা ছিলো কেবল জীববিজ্ঞানের আওতাভুক্ত, অনেকে এই সময়কালকে প্রাগৈতিহাসিক পর্বও বলে থাকেন (কিন্তু, আমার ‘প্রাগৈতিহাসিক’ কথাটার ব্যাপারে একটু আপত্তি আছে, এই কথাটা এরকম একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে যে, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের আগেও মানুষের একটি ইতিহাস ছিলো যা অন্যান্য প্রাণীদের থেকে স্বতন্ত্র)। এই বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে মানুষের আচরণগত পরিবর্তন ও বিকাশ ব্যাখ্যা করার জন্য জীববিজ্ঞানের তত্ত্বের থেকে মূলত ইতিহাসের বয়ানই বেশী ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খ্রিস্ট ধর্মের উত্থান বা ফরাসি বিপ্লবকে বোঝার জন্য কেবল জীববিজ্ঞানের আওতাধীন বিভিন্ন জিনের আন্তঃসম্পর্ক, হরমোন বা মানুষের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে জানাই যথেষ্ট নয়। বরং এসব বোঝার জন্য সে সময়কার মানুষের বিভিন্নরকম চিন্তা-চেতনা, পরিকল্পনা এবং তাদের কল্পিত আদর্শ সমাজ কেমন ছিলো সেসব সম্পর্কে ধারণা রাখা অত্যাবশ্যক।
এ কথার মানে এই নয় যে, হোমো সেপিয়েন্স এবং তাদের সংস্কৃতি জীববিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন মেনে চলে না। যতকিছুই হোক, দিনশেষে আমরাও কেবলমাত্র একপ্রকার প্রাণী ছাড়া আর কিছুই নই এবং আমাদের শারীরিক, মানবিক এবং বুদ্ধিভিত্তিক দক্ষতা অনেকাংশেই নির্ভর করে আমাদের ডিএনএর উপর। আমাদের সমাজের গঠনগত উপাদান এবং নিয়ান্ডার্থাল বা শিম্পাঞ্জিদের সমাজের গঠনগত উপাদানের মাঝে তেমন কোন পার্থক্যই নেই। যতই বেশি আমরা এসব গঠনগত উপাদান সম্পর্কে জানব, ততই একথা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে যে, অনুভূতি, আবেগ এবং পারিবারিক বন্ধনের কথা বিবেচনা করলে মানুষের সাথে অন্যান্য নরবানর (Ape) প্রজাতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
সে কারণে, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক গণ্ডিতে অন্যান্য নরবানরের প্রজাতির সাথে মানুষের পার্থক্য খুঁজতে যাওয়াটা একরকম বোকামি। যদি একজন মানুষের সাথে একজন শিম্পাঞ্জির তুলনা করা হয় বা দশ জন মানুষের সাথে দশজন শিম্পাঞ্জির তুলনা করা হয় তাহলে তাদের মাঝে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি চোখে পড়বে। বড় ধরনের পার্থক্য তখনই বোঝা যাবে যখন আমরা ১৫০ বা তার থেকে বেশি সংখ্যক একটি মানবগোষ্ঠীর সাথে সমসংখ্যক শিম্পাঞ্জি বা অন্য কোন নরবানর প্রজাতির তুলনা করব। যখন সংখ্যাটা ১০০০ থেকে ২০০০ এ গিয়ে দাঁড়াবে তখন পার্থক্যের পরিমাণটা হবে আকাশছোঁয়া। কয়েক হাজার শিম্পাঞ্জিকে যদি শাহবাগের মোড়ে, তিয়ানানমেন স্কয়ারে, ওয়াল স্ট্রীটে, ভ্যাটিক্যান নগরে বা জাতিসংঘের সদরদপ্তরে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের সম্মিলিত চিৎকার, চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি আর বিশৃঙ্খলায় সমস্ত এলাকাটা তছনছ হয়ে যাবে মুহূর্তেই। অথচ, হাজার হাজার মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রতিনিয়ত এসব জায়গায় জড়ো হয়। অনেকজন মিলে তারা সুশৃঙ্খল হয়ে থাকতে পারে, সবাই মিলে একটি এলাকাকে পরিণত করতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে, জাঁকজমক করে পালন করতে পারে কোনো উৎসব বা অংশ নিতে পারে কোন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে। একসাথে অনেকগুলো মানুষ একত্রিত হয়ে এমন অনেক কিছু করতে পারে যেগুলো একা একা তাদের পক্ষে করা কখনোই সম্ভব হতো না। সুতরাং, শিম্পাঞ্জিদের সাথে আমাদের সত্যিকার পার্থক্য হলো বানিয়ে বানিয়ে বলা সেইসব কল্পিত গল্পের এবং সেইসব কাল্পনিক বিশ্বাসের যা অনেকগুলো মানুষকে একসুতোয় বেঁধে রাখে- কখনো সেই সুতোটা হয় একটি জাতি, কখনো ধর্ম, কখনো পরিবার, কখনো অন্য কোন প্রতিষ্ঠান। এই কাল্পনিক বিশ্বাসের অদৃশ্য সুতোই মানুষকে দিয়েছে সকল সৃষ্টির উপর মানুষের অগাধ প্রভুত্ব।
অবশ্যই বানিয়ে বানিয়ে গল্প তৈরি করা ও তাতে বিশ্বাস করে বড় বড় দল গঠন করতে পারা ছাড়াও মানুষের আরো অনেক যোগ্যতা আছে; যেমন বুদ্ধি খাটিয়ে নানারকম যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি তৈরি করা এবং সেসব ব্যবহার করতে শেখা। কিন্তু, নানারকম যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি তৈরির বুদ্ধি তেমন কোনো ফল দিত না যদি অনেকগুলো মানুষ একসাথে কাজ করতে সক্ষম না হতো। যেখানে ৩০,০০০ বছর আগে মানুষের হাতে পাথরের তৈরি বর্শা ছাড়া আর তেমন কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিলো না, সেখানে এখন মানুষের হাতে আছে আন্তঃমহাদেশীয় নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র। শারীরিকভাবে গত ৩০,০০০ বছরে যন্ত্রপাতি তৈরির ব্যাপারে মানুষের দক্ষতা বা বুদ্ধির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের শারীরিক শক্তি একজন আদিম শিকারী মানুষের থেকে কমই হবার কথা। শারীরিক শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা একই রকম থাকলেও এই সময়কালের মধ্যে কিন্তু অনেকগুলো মানুষ এমনকি অচেনা অনেকগুলো মানুষ মিলেও একসাথে কাজ করার প্রবণতা বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। আদিমকালের একজন মানুষ কয়েক মিনিটে নিজে নিজেই একটি পাথরের বর্শা তৈরি করতো। হয়তো তৈরি করার সময় সে আশেপাশের দুই-একজন বন্ধুর সাথে পরামর্শ করতো। আর এখনকার একটি নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করা চেনা-অচেনা লক্ষ লক্ষ লোককে একসাথে কাজ করতে হয়। এদের মাঝে খনি থেকে ইউরেনিয়াম তোলা শ্রমিক থেকে শুরু করে পরমাণুর ভেতরের কণিকাগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কঠিন কঠিন গাণিতিক সমীকরণ লেখা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীও আছেন।
বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর জীববিজ্ঞান এবং ইতিহাসের মধ্যকার সম্পর্ককে আমরা সংক্ষেপে এভাবে বলতে পারি –
- জীববিজ্ঞান মানুষের আচরণ এবং ক্ষমতার মূল সূত্রগুলো নির্ধারণ করে দেয়। ইতিহাসের সমস্ত খেলা জীববিজ্ঞানের বেঁধে দেয়া এসব নিয়ম-কানুনের গণ্ডির মধ্যেই আবর্তিত হয়।
- যেহেতু, জীববিজ্ঞানের এই বেঁধে দেয়া গণ্ডির পরিসর বিশাল, মানুষ এখানে সহজেই নানা স্বাদের, বিচিত্র নিয়মের খেলা খেলতে পারে। মানুষের গল্প বানানোর ক্ষমতা আছে, মানুষ গল্প শুনতে এবং নানান লোক নানারকম গল্পে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। সে কারণে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গল্প বানানোর ও তা বলার এই প্রবণতা চলতে থাকে। কখনও একই গল্প নতুন করে নতুন সময়ে বলা হয়, কখনও তৈরি হয় নতুন গল্পের।
- সুতরাং, মানুষের আচরণের প্রকৃতি বুঝতে হলে, আমাদেরকে তাদের কার্যপ্রণালী অতীত থেকে কীভাবে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে সেই ইতিহাসটা জানতে হবে। শুধুমাত্র জীববিজ্ঞানের নিয়মকানুন থেকে মানুষের আচরণ বোঝার চেষ্টা হবে অনেকটা রেডিওতে ক্রিকেটের ধারা বর্ণনাকারীর মতো – যে মাঠে প্রতিটি খেলোয়াড় কখন কি করছে তা উহ্য রেখে প্রতি বলে কত রান হলো, কোথায় বলের অবস্থান এসব বলতে থাকে।
- আমাদের প্রস্তর যুগের পূর্বপুরুষেরা কী ধরনের খেলা খেলত? আমাদের জানামতে, যারা ৩০,০০০ বছর আগে স্ট্যাডেল গুহায় সিংহ-মানবের মূর্তি বানিয়েছিলো তাদের শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা মোটামুটি আমাদের মতোই ছিলো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে তারা কী করত? কী খেতো তারা সকালের নাস্তায় বা দুপুরের খাবারে? কেমন ছিলো তাদের সমাজ? তাদের সময় কি একটা বিয়ের চল ছিলো নাকি অনেকগুলো বিয়ের? তাদের কি উৎসব-পার্বণ ছিলো, ছিলো মানবিকতা-মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় রীতি-নীতি? তারা কি যুদ্ধ করত? তারা কি জানত, যুদ্ধ কাকে বলে?
পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সময়ের ধুলোপড়া পর্দার আড়ালে এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। বোঝার চেষ্টা করব বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে কৃষি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত কেমন ছিলো মানুষের জীবনযাপন।
* এখান থেকে শুরু করে পরবর্তী অংশগুলোতে আমরা সেপিয়েন্সের ভাষা বলতে তাদের সাধারণ ভাষাগত দক্ষতার কথা বুঝব, ভাষার কোন নির্দিষ্ট আঞ্চলিক রূপকে নয়। ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, চৈনিক এদের সবগুলোই সেপিয়েন্সের এই সাধারণ ভাষারই নানান রূপ। এমনকি, ধারণা করা হয়, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের সময়েও সেপিয়েন্সের নানা দল বা গোষ্ঠী ভাষার নানান রূপ ব্যবহার করতো।
————
তথ্যসূত্র
1 Robin Dunbar, Grooming, Gossip and the Evolution of Language (Cambridge, Mass.: Harvard University Press, 1998).
2 Frans de Waal, Chimpanzee Politics: Power and Sex among Apes (Baltimore: Johns Hopkins University Press, 2000); Frans de Waal, Our Inner Ape: A Leading Primatologist Explains Why We Are Who We Are (New York: Riverhead Books, 2005); Michael L. Wilson and Richard W. Wrangham, ‘Intergroup Relations in Chimpanzees’, Annual Review of Anthropology 32 (2003), 363–92; M. McFarland Symington, ‘Fission-Fusion Social Organization in Ateles and Pan, International Journal of Primatology 11:1 (1990), 49; Colin A. Chapman and Lauren J. Chapman, ‘Determinants of Groups Size in Primates: The Importance of Travel Costs’, in On the Move: How and Why Animals Travel in Groups, ed. Sue Boinsky and Paul A. Garber (Chicago: University of Chicago Press, 2000), 26.
3 Dunbar, Grooming, Gossip and the Evolution of Language, 69–79; Leslie C. Aiello and R. I. M. Dunbar, ‘Neocortex Size, Group Size, and the Evolution of Language’, Current Anthropology 34:2 (1993), 189. For criticism of this approach see: Christopher McCarthy et al., ‘Comparing Two Methods for Estimating Network Size’, Human Organization 60:1 (2001), 32; R. A. Hill and R. I. M. Dunbar, ‘Social Network Size in Humans’, Human Nature 14:1 (2003), 65.
4 Yvette Taborin, ‘Shells of the French Aurignacian and Perigordian’, in Before Lascaux: The Complete Record of the Early Upper Paleolithic, ed. Heidi Knecht, Anne Pike-Tay and Randall White (Boca Raton: CRC Press, 1993), 211–28.
5 G. R. Summerhayes, ‘Application of PIXE-PIGME to Archaeological Analysis of Changing Patterns of Obsidian Use in West New Britain, Papua New Guinea’, in Archaeological Obsidian Studies: Method and Theory, ed. Steven M. Shackley (New York: Plenum Press, 1998), 129–58.