সে স্থির করে, জীবনের আদেশ সে পালন করবে না আর। প্রতারক জীবনের আদেশ, লোভী জীবনের আদেশ আর মান্য করবে না সে। বরং এই ধরিত্রীর অববাহিকায়, যেখান দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আর সঙ্গে কোনও জলের বোতল নেই, খাদ্যসম্ভার নেই, সে হেঁটে যাচ্ছে নিজের আত্মাকে বহন করে, তরুণ ও নির্মেদ দেহবন্ধে, সেই অববাহিকায় সে হেঁটে যাচ্ছে আর রেখে চলেছে পদচ্ছাপ, আর সেই পদচ্ছাপে মৃত্যুর আলো ফুটে উঠছে, তার অন্তরে লালন করা আলো। মৃত্যুর আলো। অন্ধকার নয়, আলো। কোনও গ্লানি নেই, আশা নেই, উদ্বেগ নেই, যন্ত্রণা নেই, ক্ষয় নেই, ক্ষতি নেই শুধু আলো। শুধু এক অনির্বাণ অস্তিত্বের বিস্তার। আদি-অন্তহীন বিস্তার। জীবন অন্ধকার আর মৃত্যু আলো। এতকাল মৃত্যুই ছিল অন্ধকার। মৃত্যুই ছিল রজনী। অন্ধের দৃষ্টিহীনতা। কিন্তু আজ, সে, শুভদীপ, জেনেছে–পৃথিবীর অন্তত একজন মানুষ জেনেছে, মৃত্যু আলো। এবং মৃত্যু স্থির। মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যু বিশ্বস্ত। মৃত্যুর থেকে মুখ ফিরিয়ে জীবনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলে উপলব্ধি করা যায়–জীবন আসলে কী অস্থির, কী অনিশ্চিত, কত গভীর ষড়যন্ত্রময়, প্রতারণাময়। জীবন কী গভীর অন্ধকার!
অতএব সে চলে যাচ্ছে প্রতি পদচ্ছাপে আলোর ফুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে। আকাশ উপুড় হয়ে আপন সাজিতে ভরে নিচ্ছে সেই সব ফুল আর তারা মিটমিট করছে। যেন সব সুনয়নী, সব সুনেত্রা ঘুম থেকে জেগে উঠল এইমাত্র আর অপেক্ষা করছে, ব্রাশ-পেস্ট-বিস্কিট-বর্ণপরিচয় মেশানো এক সকালের জন্য।
কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এই আলোর ফুল, ফুটে থাকা এইসব মৃত্যুর কোনও প্রত্যাশা নেই। এক বিশাল, অসীম, সর্বব্যাপ্ত, সর্বত্রগামী মৃত্যুর থেকে খান-খান হয়ে বেরিয়ে আসা অসংখ্য-অসংখ্য মৃত্যুর কোনও প্রত্যাশা নেই। অপেক্ষা নেই। টান নেই। বড় নির্মোহ, নির্বাক তারা।
সে জানে না। সে বোঝে না। সে এক নির্মোহের প্রতি মোহগ্রস্ত ইদানীং। অকারণ সে হেঁটে চলে। তার যেখানে যাবার কথা, যেদিকে যাবার কথা, না গিয়ে সে হেঁটে চলে অন্য রাস্তায়। আর এভাবে, জীবনকেও কিছুটা মান্য করা হয়ে যাচ্ছে তার, সে জানে না। যে-পথে যাবার কথা, না গিয়ে, অন্য পথে চলে যাবার এই চিরকালীন বাঁধাকে সে প্রতিপন্ন করছে মৃত্যুর উদ্দেশে, কিন্তু জীবনের পরিণামেই। সে জানে না, সে হেঁটে যায়। এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মসৃণ রাস্তায় হোঁচট খায় একবার। হোঁচট খায় বলে থামে। কাঁধের ব্যাগ অকারণে ঠিকঠাক করে নিতে চায়। একটি পা তুলে, যেনবা পদক্ষেপ নিতে চলেছে এমন, কিন্তু নিচ্ছে না, সে একখানি কাল্পনিক টেবিল গড়ে নেয়। নড়বড়ে টেবিল। তার ওপর রাখে ব্যাগ। চেন খোলে। ব্যাগে প্রচুর কাগজ। দুটি ফাইল। কলম। প্যাড। আর কিছু চিঠির বান্ডিল।
সে দেখে, নির্মোহে দেখে এবং নড়বড় করতে করতে, ভারসাম্য রাখতে রাখতে ব্যাগের ভেতরটা ঠিক করে নেয় একবার। চেন বন্ধ করে এবং লক্ষ করে তার জুতোর ডগায় হাঁ-মুখ। সে, নাক গড়িয়ে নেমে আসা চশমাটা ঠেলে দেয় একবার ওপরের দিকে আর ভাবে। ভাববার সময় তার ঠোঁটজোড়া অল্প ফাঁক হয়ে থাকে। সেই সময় তার মুখে কোনও খুশিভাব থাকে না। মাথাজোড়া মণ্ডলে লেগে যায় বিষণ্ণতার দাগ। আর সেই দাগ রুমালে মুছলেও যায় না। কেন-না সমস্ত বিষণ্ণতা অপসৃত হওয়ার জন্য হাস্য অপেক্ষা করে। এখন হাসি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে দেখা যাচ্ছে অসমান দাঁতের সারি। সে হাসলে এই এবড়োখেবড়ো পঙক্তিতেই আলোক প্রতিফলিত হয় এবং তাকে করে ঝলমলে, আকর্ষণীয়, প্রাণবন্ত।
এখন সে চলতে চলতে এমনই শ্লথ যেন তিমিত দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে হাসিখুশি এক খতনামার জৌলুস। সে নজর করছে না। ভাবছে। এই যে বড় শহর, যার পথ-ঘাট দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে এখন, তার কতইনা বাজার, আর সেইসব বাজারে কতইনা জুতোর দোকান। সার-সার জুতো। বিচিত্র রং ও আকৃতি। সে এই জুতোজোড়া কিনেছিল এই শহরেরই একটি সুসজ্জিত দোকান থেকে। তার সঙ্গে তখন চন্দ্রাবলী ছিল। জুতোর দামও সে-ই দিয়েছিল। বারবার উপরোধ করেছিল একজোড়া ভাল জুতো কেনার জন্য। সে ব্যয়ের কথা ভেবে সবচেয়ে সস্তা জুতোজাড়াই খুঁজছিল। চন্দ্রাবলী মনে করিয়ে দিয়েছিল চলাফেরাই তার কাজ। সুতরাং জুতোজোড়া মজবুত হওয়া দরকার। মজবুত এবং আরামদায়ক। কেন-না পা দুটিকে যত্ন ও সম্মান করা উচিত–শরীরের একজোড়া অপরিহার্য ও কর্মঠ অঙ্গ হিসেবে। কিন্তু ভাল জুতোর চূড়ান্ত পর্যায় চন্দ্রাবলীরও ব্যয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল না। সে তখন একটু মাঝামাঝি জায়গায় রফা করে। দাম দেয়।
আজ ছিঁড়ে যাচ্ছে। ফেটে যাচ্ছে। চন্দ্রাবলীর কেলা জুতো। চন্দ্রাবলীর উপহার দেওয়া জুতো। শুভদীপ নিজের শার্টের দিকে তাকায়। চন্দ্রাবলীর উপহার। প্যান্টের প্রতি দৃকপাত করে। বিখ্যাত তকমা, রেমন্ডস। গত পুজোয় চন্দ্রাবলীর দেওয়া। নিজের অজান্তে তার হাত চলে যায় চশমায়। এই দৃষ্টিযন্ত্র চন্দ্রাবলীর দেওয়া প্রথম বস্তু। একটি ডাঁটিভাঙা চশমা সে পরে চালিয়ে দিচ্ছিল দিনের পর দিন। চন্দ্রাবলী, দেখে ফেলার পরই তাকে জোর করে দোকানে নিয়ে যায়। এবং সে বছরই তার জন্মদিনে তাকে উপহার দেয় এই ব্যাগ। ডাকব্যাক। কলহংসের পিঠের মতো মসৃণ ও জলরোধক।
উপহার। উপহার দিয়ে তাকে ভরে দিতে চাইত চন্দ্রাবলী। গান শেখানোর আয় থেকে নিজের খরচ সামলে এইসব উপহার সহজ নয় সে জানে। কিন্তু চন্দ্রাবলী আশ্চর্য ইচ্ছার কথা বলত। ইচ্ছার অপরিমেয়শক্তির কথা বলত। বলত, শুভদীপ তার জীবনে আসার পর সে পেয়ে গিয়েছে এক অতি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন। রুপোর ছাতের তলায় সোনার থালায়, হিরেকুচির ভাত খাবার কোনও লেশই ছিল না সেই স্বপ্নে। দু’কামরার ছোট বাড়ি, শুভদীপের বাজারের থলে থেকে একটা একটা মাছ, সবজি নামিয়ে দোপাট্টায় ঘাম মুছে রান্না চাপানো আটপৌরে জীবনের হুবহু প্রতিচ্ছবি। সে বলত আর শুভদীপ অসহিষ্ণু ক্রোধে তলায় তলায় ছটফট করত। এইসব আটপৌরে জীবনকে সে ঘৃণা করত, যেমন করত চন্দ্রাবলীকে…।
ইচ্ছা। ইচ্ছা। চন্দ্রাবলী ইচ্ছার কথা বলত। ইচ্ছার শক্তির কথা। সে মনে করত, স্বপ্ন আসলে ইচ্ছা। ইচ্ছাই নিজেকে লক্ষ্য বা স্বপ্ন হিসেবে স্থাপন করে, ইচ্ছাই নিজের মাধ্যমে জীবনকে লক্ষ্য বা স্বপ্নের নিকটতমে পৌঁছে দেয়।
সে, শুভদীপ, এইসব কথাকে গুরুত্ব দেয়নি কখনও। বরং শুনতে শুনতে সে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে কালাতিপাত করত। কিংবা, ঘন গাছের তলায়, জলাশয়ের ধারে, জোড়া জোড়া মানব-মানবীর মাঝে তারাও। সন্ধে নেমে এলে হাত ধরাধরি করত। তখন, জলের তলা থেকে উঠে আসত চাঁদ। বড়সড় চাঁদ। গোল চাঁদের উত্থান। সেই উত্থানের মুখোমুখি বসে গোল চন্দ্রাবলী বলে যেত তার ইচ্ছের কথা, অথবা রবি তরফদারের গৃহে থাকাকালীন তার প্রাপ্ত অবহেলা ও নির্যাতনের কথা। বলে যেত না থেমে। একটানা। ওই নির্যাতনের কবল থেকে সে যে বেরিয়ে আসার সাহস শেষ পর্যন্ত অর্জন করতে পেরেছে–আর পেরেছে শুভদীপের সান্নিধ্যের প্রভাবেই—এ কথাও বলত বার বার। শুভদীপ তখন তার নরম বঙুলে হাত রাখত। চাপ দিত। নিষ্পেষণ করত। তার সারা শরীরের ক্ষুধা, ওই মুহূর্তে, ওই নিষ্পেষণের মাধ্যমে মিটিয়ে নিতে চাইত সে।
এক বয়স্ক মহিলার বাড়িতে আরও তিনটি মেয়ের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে আতিথ্য নিয়ে থাকত চন্দ্রাবলী। সেই মহিলা, ক্ষ্যামাঙ্গিনী নাম এবং সহবাসিনী তিনজন সম্পর্কেও তার অভিযোগ কম ছিল না। ইচ্ছাশক্তি দ্বারা এই অপছন্দের অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন সে দেখত আর বলত সেসব ‘শুভদীপকে। সে শুধু অপেক্ষা করছিল, কবে রবি তরফদারের কাছ থেকে সে আইনত বিচ্ছেদ লাভ করে।
শুধুমাত্র এইসব উপহার ও স্বপ্নের মধ্যেই চন্দ্রাবলী থেমে থাকেনি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে একটি পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাকউন্ট খোলে এবং তার উত্তরাধিকারী করে দেয় শুভদীপ ভট্টাচার্যকে। জুতো কিনে দেবার দিনই তাকে পাসবই খুলে দেখায় চন্দ্রাবলী এবং দেখানোর সময় তার মুখে তৃপ্তির অভিব্যক্তি টসটস করে। শুভদীপ সেদিকে মন দেয়নি কেন-না, চন্দ্রাবলীর মৃত্যু পর্যন্ত জড়িয়ে থাকবে এমন সম্ভাবনা সে স্বপ্নেও কবুল করেনি কখনও। সে, অতএব, জুতোর দোকান খোঁজার দিকে মন দিয়েছিল তখন। এবং চন্দ্রাবলীর উপহার দেওয়া জুতো নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল।
সেই জুতো আজ ছিঁড়ে যাচ্ছে। ফেটে যাচ্ছে। চন্দ্রাবলীর উপহার দেওয়া জুতো। জুতো কি কেউ কারওকে উপহার দেয়? শুভদীপ আকাশের দিকে তাকায়। জুতো কেউ কারওকে উপহার দেয় না। জুতো চন্দ্রাবলী উপহার দেয়নি। জুতো কেউ কারওকে কিনে দেয়। তারা যখন ছোট ছিল–সে, দীপান্বিতা, বিশ্বদীপ–তাদের বাবা পুজোর আগে আগে তাদের সামনে বিছিয়ে দিত একটি বিশাল খবরের কাগজ। বিশাল কাগজ। খুব বড়। যেন আকাশের মতো। সেই আকাশ নানা ঢঙের জুতোয় ভর্তি। তারা তিনজন প্রায় চড়ে বসত সেই কাগজে। আর কাগজটা মন্ত্রপূত কার্পেট হয়ে যেত তখন। শোঁ-শোঁ করে উড়তে উড়তে, হাওয়ায় উড়তে উড়তে, তারা তিন ভাইবোন জুতোপছন্দ করত। এইটা না এইটা না এইটা। কোনটা? কোনটা? ওইটা। সে যেটা দেখাত, বিশ্বদীপও দেখাত সেটাই। আর দীপান্বিতা শুচু হয়ে বেছে নিত মেয়েদের জুতো। বাবা, ওই জাদু কার্পেট গুটিয়ে তাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তারা তখন কলরব করতে করতে জুতোর দোকানে চলল। একদিন জুতোর জন্য বেরুনো, একদিন পোশাকের জন্য। আর সেই দুদিন রেস্তোরাঁয় খাওয়া মায়ের জন্য বাক্সয় পুরে নিয়ে আসা। সব কিছুই।
বাড়ি থেকে তারা বাবার সঙ্গে বেরোয় অপরূপ শৃঙ্খলায়। বাবার হাত ধরে শুচু, বাবার হাত ধরে বিশ্বদীপ। আর সে বিশ্বদীপের হাত ধরে। মা দাঁড়িয়ে দরজায়। পুরনো বাড়িটার ইটগুলি অতখানি বিবর্ণ ছিল না তখন। অতখানি বিষণ্ণতা ছিল না খাঁজে খাঁজে। মায়ের কানের লতি কেটে দুলজোড়া পতনোম্মুখ হয়নি তখনও। মা দরজায় দাঁড়িয়ে সাধারণ করে শাড়ি পরা। মাথায় ঘোমটা। ফর্সা, ছোটখাটো মা। বড় বড় চোখ। হাসিহাসি মুখ। প্রসাধন নেই, তবু কী সুন্দর!
মা যাবে না। মা থাকবে। তাদের জন্য সুজি করে রাখবে। জলখাবার। তারা বাড়ি ফিরে সমস্বরে বলবে কী কী খেল, আর দেখল কী কী। মা হাসিমুখে সব শুনতে থাকবে। শুচু কেনা বস্তুসম্ভারের মোড়ক খুলে খুলে সাজিয়ে রাখবে বিছানায়। মা দেখার জন্য এগিয়ে আসবে আর বলতে থাকবে কত কী সে করে রেখেছিল ছেলেমেয়েদের জন্য। বাবা তখন খাবারের বাক্স মায়ের হাতে ধরিয়ে দেবে। মা সলজ্জ হেসে, ঘোমটা একটু টেনে, জানিয়ে দেবে, ছেলেমেয়েদের খাওয়ালেই হত। তার জন্য আনার আর এমন কিছু দরকার ছিল না। বাবা কোনও জবাব দিল না তখন। বরং বসল খবরের কাগজ নিয়ে।
এমনই ঘটে, ঘটে তাকে প্রত্যেকবার। এমনই বলে মা, আর বাবা এমনই কাগজ পড়ে বছরের পর বছর। আর মায়ের পায়ের মানচিত্র নিয়ে গিয়ে পছন্দমতো জুতা কেনে। একটা সাদা কাগজ বাবা পেতে দেয় আর মা লজ্জা-লজ্জা মুখ করে তার ওপর বাঁ পা রাখে। আর বাবা বাঁ পা তুলে কাগজে ডান পা রাখতে বলে মাকে। মা পা বদলায়। বাবা তখন যত্ন করে এঁকে নেয় মায়ের পায়ের মানচিত্র। তারা তিনজন, তিন ভাইবোন, মাবাবাকে ঘিরে ধরে দৃশ্যটা দেখে। গম্ভীর থাকে তখন তারা। কিছুটা উদ্বিগ্নও। যেন কী এক মহাকাণ্ড হয়ে চলেছে।
বাবার আঁকা হয়ে যাবার পর মা বাবার পায়ের ধুলো নেয়। আর এই পর্যন্তই তারা শান্ত দাঁড়িয়ে থেকে পুরো কাণ্ডটি ঘটাতে সাহায্য করেছে বরাবর। এমনকী মায়ের জুতো কেনার সময়ও বাবাকে তারা দেখেছে গভীর মনোযোগী। প্রকৃতপক্ষে জুতো নয়। চটি। মায়েরা জুতো পরে না কখনও-ই। পরে চটি। বাবা সেই চটি কিনে দেয়। তাদের জুতো কিনে দেয়। উপহার দেয় না। আর কবে যেন, এরকমই চলতে চলতে সব থেমে, গেল একদিন। কবে থেমে গেল! কোন বছর! ক্যালেন্ডারে কেউ লিখে রাখেনি দিনক্ষণ।
চন্দ্রাবলীও কিনে দিয়েছিল। জুতো কিনে দিয়েছিল। তার দেবার কোনও শেষ ছিল না। বস্তুগত আর বস্তুর অতীত সবই সে পরম উপাদেয় করে তুলে ধরতে চাইত তার জন্য। সে চন্দ্রাবলীকে মুখে পুরত আর কুলকুচি করার মতো ছুড়ে দিত পরক্ষণে। এ রকমই চলতে চলতে সব থেমে গেল একদিন। কবে থেমে গেল! কোন বছর! এই তো, এক বছরও পেরোয়নি। কোন দিন! কোন মাস! সে ক্যালেন্ডারে লিখে রাখেনি দিনক্ষণ।
কী দিত তাকে চন্দ্রাবলী? কী কী দিতংজার গা গুলিয়ে ওঠে। কেন, সে জানে না। তবে চন্দ্রাবলী সম্পর্কে তার এই অনুভূতি নতুন নয়। এই বিবমিষা নতুন নয়। ঘৃণায় পেট মোচড় দেয় তার। সে দাঁড়ায়। দু’ হাতে পেট চেপে ধরে এবং ওয়াক তোলে। নিজের সম্পর্কে কিছুটা সম্বিৎ ফেরাবার চেষ্টা করে সে। কখন খেয়েছিল শেষ? পেট খালি? অম্বল হয়ে গেল? চৈনিক খাবারের স্বাদ-গন্ধ তার মনে পড়ে। আর মনে পড়ে চন্দ্রাবলীর কোমর। চওড়া ভারী কোমর। এক অসংবৃত পশ্চাৎ। বহু অপ্রয়োজনীয় মাংসে বিসদৃশ। কালো রং। কোমরের ওপর থাক থাক মাংসল ভাঁজ। সালোয়ার কামিজের ওপর দিয়ে সেইসব চূড়ান্তভাবে পরিস্ফুট থাকে। আর শাড়ি পরলে কিংবা পোশাক উন্মোচিত যখন—ওই পরতের পর পরত মাংসল খাঁজে জমে থাকে গাঢ়তর অন্ধকার। কিংবা প্রকৃতপক্ষে কালো তার ত্বকের বাহার আসলে জমে থাকে রজনী সদৃশ। আর সেই তমস পেরিয়ে চওড়া পুরু পিঠ। প্রস্থই অধিক হয়েছে ক্রমশ। দৈর্ঘ্য ছাপিয়ে। কায়িক স্ফীতিকেই যেন সে বরেণ্য ধরেছে। এই প্রস্থেরই, স্ফীত প্রস্থেরই উল্টো পিঠে কণ্ঠ হতে নেমে আসা উত্তাল স্তনদ্বয়। ভারী ও তুমুল। বুকে কোনও উপত্যকা রাখেনি তার পেশির অপরিমিত, অযোগ্য বিস্তার। ভারী-ভারী-ভারী স্তন। শাসরুদ্ধকারী স্তন—যা সে প্রথমবার স্পর্শ করেছিল, তার সরু, কোমল, সাদাটে আঙুল দ্বারা স্পর্শ করেছিল না-দেখেই। কাম ছাড়া, তীব্র খিদে ছাড়া, এতটুকু মায়া ছিল না তার আঙুলের শীর্ষদেশে।
বুকের ওপর যে গলা, তার সঙ্গে বুকের টানাটানি, আর গলার ওপর যে বড় গোলাটে মুখ—সেই মুখের সঙ্গে টানাটানি এই মহাবিশ্বের ত্রিমাত্রিক শূন্যতার–যার অনেকটাই সে দখল করে নেয়। আর মহাবিশ্বের আরও বহু বস্তুর প্রতিযোগী হয়ে ওঠা মুখমণ্ডলে তারও আছে একজোড়পুরু ঠোঁট ও চাপা নাক। নাকের ওপর একজোড়া বড় বড় চোখ, চোখের ওপর কৃশ, দীর্ঘাঙ্গি ভুরু। ভ্র ছাড়িয়ে ছোট কপালের ওপর এসে পড়া অলকচূর্ণ, তার রাশিকৃত, ঘন, দীর্ঘ চুল থেকে এসে পড়া।
শুভদীপ যেদিন প্রথম তার সঙ্গে রাত্রিবাস করে, হঠাৎ ঘটে-যাওয়া ঘটনাবশত রাত্রিবাস করে, সেদিন স্নান-শেষেঅতিথি-নিবাসের জোড়া বিছানার একটিতে সে শুয়ে ছিল চুল এলায়িত করে। দেহ তার দেহবল্লরী নয়। বরং দেহগাছা। বা দেহবৃক্ষ। সেই দেহবৃক্ষ মেলে, চুল এলিয়ে, চোখ বন্ধ করে সে শুয়েছিল সেদিন। তারা চলেছিল রায়মাটাং বনে। সেখানে রবিদা আগেই একটি দল নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারা সেই দলে যোগ দিতে যাচ্ছিল। পথে রেলগাড়ির লাইনচ্যুতি হয়, তারা একটি বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পায়। কিষাণগঞ্জ ইস্টিশান থেকে তারা শিলিগুড়িগামী একটি ছোট রেলে চাপে। এবং শিলিগুড়ি পৌঁছয় সন্ধে নাগাদ। দূরপাল্লার সমস্ত বাস তখন চলে গিয়েছে। ইন্টার সিটি নামের রেলগাড়িটিও ত্যাগ করেছে ইস্টিশান। অতএব তারা তখন একটি অতিথি নিবাসে যায় এবং একটিমাত্রই ঘর নিয়ে ফেলে। সেই ঘরে চন্দ্রাবলী স্নান সেরে, চুল এলায়িত করে, দেহবৃক্ষ টান-টান, চোখ বন্ধ চোখ, চক্ষু, নয়ন, লোচন, আঁখি, দৃকপাত যন্ত্র-চন্দ্রাবলীর শরীরের একমাত্র সুন্দর অঙ্গ। যদিও সে লক্ষ করেনি। জানেনি কখনও। দেখেনি কোনও দিন। দেখেনি আলাদা ভাবে, দেখার মতো করে। তারও যে শরীরের কোথাও, কোনও এক অঙ্গে সৌন্দর্য মাখা ছিল। সেই অঙ্গ চোখ। সেই চোখ বড় কিন্তু হরিণচঞ্চল নয়। অতলস্পর্শী গভীর। গভীর চোখের মতো বেদনার করুণ ভাষাসংবলিত স্থির ও শান্ত মূক ও ভীত। দেখেনি সে প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিন। এমনকী শেষ দিনও। চন্দ্রাবলীর কোনও কিছুই সে দেখেনি, খোঁজেনি, বুঝতে চায়নি। চন্দ্রাবলীর জন্য সে এতটুকু ক্লেশ সইবার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। বস্তুতপক্ষে চন্দ্রাবলী ছিল তার কাছে যেচে-আসা, ডানা-মুচড়ানো পাখি। সে ছিল স্বয়মাগতা। সে ছিল বাধ্য। আত্মনিবেদিত। শুভদীপ তাকে চায়নি। কখনও চায়নি। বরং ঘৃণা করেছে ওই পুরু ঠোঁট, চাপা নাক, কালো রং এবং থাক থাক চর্বি। তার নিজের ছিপছিপে ঋজু নির্মেদ শরীবর পাশে ওই পৃথুল শরীরকে সে ঘৃণাই করেছে বারবার।
একটি গোরস্থানের সামনে এসে দাঁড়াল সে। শহরের বড় বড় গোরস্থানের একটি। ইসলামে দীক্ষিত মানুষদের এখানে গোর দেওয়া হয়। গোর দেওয়া হয় কখন? মৃত্যুর পর। মরে গেলে। প্রাণহীন দেহফিরিয়ে দেওয়া হয় মাটির কাছে। মাটির বস্তু মাটিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর এই প্রত্যর্পণের মধ্যে জেগে থাকে মৃত্যু।
সেই জাগ্রত মৃত্যুকে স্পর্শ করার বাসনায়, সে শুভদীপ, গোরস্থানের প্রাচীর স্পর্শ করল একবার। তাকাল ওপরের দিকে। উঁচু প্রাচীরের সীমানা ছাড়িয়ে বড় বড় গাছের উদাত্ত ডালপালা। সবুজ পাতায় ভরা। এখন যে যথেষ্ট বিকেল তার আলো এসে ভরে আছে বৃক্ষশীর্ষে। তবু, তার মনে হয়, ওই সবুজে লেগে আছে কিছু অন্ধকার, কিছু কিছু গাম্ভীর্য। বিষণ্ণতা নয়, বরং অনিবার্য পরিণতির বিষয়ে জ্ঞানগম্ভীর ঔদাস্য।
সে নিজের অশান্ত বুকে হাত রাখে। অস্থির মস্তিষ্কের ওপরকার খুলিতে হাত বোলায়। তারপর, শান্তির সন্ধানে, কিংবা মৃত্যুর সন্ধানে, কিংবা মৃত্যুর উদাস নিরপেক্ষ গাম্ভীর্যকে আত্মস্থ করার অভিপ্রায়ে সে এগোয়। খুঁজতে থাকে প্রবেশদ্বার।
তার যাবার কথা ছিল একটি ভ্রমণ সংস্থায়। সেখানে গেলে কিছু বিজ্ঞাপন পাওয়া যেত। বিজ্ঞাপনের মূল্য থেকে দুই শতাংশ তার মাসিক আয়ে যোগ হতে পারত। যোগ হলে, সংসারের হাঁ-মুখ চুল্লিতে, কিছু জ্বালানি যোগানো যেত। যোগালে মায়ের অভিযোগ কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকত।
মায়ের অভিযোগ। মা। সে একবার থমকে দাঁড়ায়। তার কিছু মনে পড়ার কথা, অথচ মনে পড়ে না। পরিবর্তে মায়ের মুখ। ক্লান্ত, হতাশ, স্থিতিশীল বিরক্তি-ভরা মুখ। এ-মুখে সেই প্রসন্নতা আর নেই যা সে দেখেছে ছোটবেলায় আর নিরন্তর অধিকার করেছে বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বড় হয়েছে সে। আর বড় হতে-হতে, বড় হতে-হতে প্রাক ত্রিশে পৌঁছবার পর চোখ খুললেই দেখতে পাচ্ছে মায়ের প্রসন্নতার ওপর কাল ও পরিস্থিতির সমুচ্চ প্রলেপ। মা এখন সংসারের হাঁ-মুখ অন্ধকার ছাড়া জানে না কিছুই। ইনিয়ে-বিনিয়ে দুঃখ কষ্ট সমুদ্ধার ছাড়া, অভাবের দৈনন্দিন অভিযোগ এবং জীবনে কিছুই না পাবার উচ্চকিত ঘোষণা ছাড়া আর কিছু জানে না। আর কিছু আছে কি? শুভদীপ ভাবে একবার। দুঃখের নিবিড় বসতি ছাড়া আর কিছু আছে কি সংসারে?
সহসা তার মনে পড়ে যায় যা-কিছু মনে পড়ার কথা। দরজা। গোরস্থানের দরজা। যা সে খুঁজছিল এতক্ষণ এবং তৎক্ষণাৎ মা অন্তর্হিত হয়ে যায় মন থেকে। বরং বেশি করে মনে পড়ে চন্দ্রাবলী। চন্দ্রাবলী আর মৃত্যুর ঔদাস্য। মৃত্যুর ঔদাস্য আর এই বিকেল। বিকেলের আলো বৃক্ষশীর্ষ থেকে গড়িয়ে পড়েছে প্রবেশদ্বারে আর বিছিয়ে গিয়েছে ভূমিতেও। যেন এই আলো এক ভূমিসূতা। যখন সে জলে নামে আর হয়ে যায় জলকন্যা, তার থেকে এখন রকম আলাদা। সে এখন অপেক্ষা করে আছে কখন এসে যায় এক মৃতদেহ আর তাকে মাড়িয়ে শববাহকেরা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বন্ধ দ্বার খুলে যাবে তখন। আর সে তৃপ্ত হবে। ভূমিসূতা, ভূমিশায়িতা আলোর টুকরো।
বন্ধ দ্বার। সবুজ রং করা। আর এই সবুজে কোনও ঔজ্জ্বল্য নেই। মরে যাওয়া ফ্যাকাশে সবুজ। মৃতদের জন্য মরে যাওয়া রং।
সে রং সম্পর্কে কোথাও কোনও অভিযোগের কথা ভাবে না। বরং একবার প্রাচীরের ওপর মাথা তুলে থাকা বৃক্ষশীর্ষদের দেখে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে থাকা অন্ধকার দেখে। এবং প্রবেশদ্বারের দিকে পিঠ করে অবশিষ্ট পৃথিবীর দিকে মুখ করে তাকায়। বহুতল বাড়িগুলির উচ্চতা চোখে পড়ে তার। চাকচিক্য চোখে পড়ে। জানালায় রকমারি পর্দা আর লৌহজালিকার বারান্দা। একটি বাড়ির সঙ্গে আরেকটি বাড়ির আয়তনের পার্থক্য ছাড়া আকৃতিগত বৈসাদৃশ্য কিছু নেই। প্রত্যেক বাড়িই যেন একজন স্থপতিরই পরিকল্পিত। অথবা স্থপতি বহু, কিন্তু তাদের শিল্পভাবনায় বৈচিত্র নেই, নতুনত্ব নেই। কোনও অদৃশ্য কারিগর তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে একই ছাঁচে ছাঁদে রকমে ঢালাঢলি করে থিতু হয়েছে। একেক বাড়িতে বসবাসকারী দশাধিক পরিবারের বসনকলা পৃথক করা যায় না। একেবারে ন্যাড়া ডালে কাকের বাসার মতো। তফাত শুধু বাড়িঘেরা চাকচিক্যে। বিজ্ঞাপনের রকমে ও বাহুল্যের তারতম্যে। বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়ে। সে নিজে বিজ্ঞাপনের ব্যাপারি। ছোটখাটো বিজ্ঞাপন। পাঁচশো, হাজার, দু’হাজার, পাঁচ হাজার—সর্বোচ্চ দশ দশের শিকে ছিঁড়লে তার নিখুঁত প্রাপ্তি দুশো। অতএব তাকে বলা যেতে পারে বিজ্ঞাপনের ফিরিওলা। ব্যাপারি হল তারা যারা এইসব মেয়েদের বিজ্ঞাপনে নিয়ে আসে।
সে দেখে। বিজ্ঞাপনের মেয়েদের অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব ও অর্ধনগ্নতা দেখে। কিছুক্ষণ দ্রব চোখে তাকায়। মুহূর্তে তিনটি শরীর তার চোখে ভেসে ওঠে। তিনটি নারীদেহ। এই দেহসমূহের সঙ্গে এই আঠাশ বছর বয়স পর্যন্ত সে যৌনভাবে সম্পর্কিত।
বিজ্ঞাপনের নারীটি আর সাত কিলো মেদসমৃদ্ধ হলে তার প্রথম নারী হতে পারে। প্রথম নারী—যে তাকে ভালবাসেনি এবং যে তাকে প্রথম যৌনতার স্বাদ দিয়েছিল। যে তাকে বেঁধেছিল মোহে এবং মোহভঙ্গে। এবং শেষ পর্যন্ত সেই নারী হয়ে দাঁড়ায় প্রতারক।
এরপর দ্বিতীয় নারী। তার প্রতি ছিল তীব্র টান। কী টান সে জানে না। কায়িক না বৌদ্ধিক সে জানে না। শুধু টান জানে। অলৌকিক অপ্রতিরোধ্য টান জানে। তার সঙ্গে খোলাখুলি পরিপূর্ণ যৌনতা সম্ভব হয়নি কখনও। হয়েছিল আংশিক। কর্মদপ্তরের একাকী নির্জনতায় কিংবা ফ্ল্যাটের নিষিদ্ধ অভিনিবেশে। সে বড় কৃপণ ছিল এইবেলা। কিংবা গভীর ছলনাময়ী। শুভদীপকে একদিন না দেখলে তার চলত না। একদিন স্পর্শ করতে না পারলে সে মধ্য রাত্রে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদত। অথচ এই স্পর্শমাধ্যমে সে কেবল উসকে দিত তাকে যেমন দখিনা বাতাস উসকে দেয় ধিকিধিকি দাবানল। উসকে দেয় আর আগুন প্রজ্বলিত হয়। প্রজ্বলিত হয় আর লেলিহান উন্মাদ আগুন ধ্বংস করে, গ্রাস করে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় স্নিগ্ধ, শ্যামল, নির্বিরোধী, পরহিতব্রতী, জ্ঞানী বনাঞ্চল। এবং এই জ্বালামুখী টান, এই উসকে দেওয়া টান একদিনে, মাত্র একদিনে, মাত্র এক মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে—যেমন গিয়েছিল তার ও মহুলির।
এমন আংশিক প্রাপ্তি ঘটত বলেই প্রজ্বলিত অগ্নি তাকে উন্মত্ত করে দিত। তাকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না, ত্বকের গভীরে কতখানি দাহ নিয়ে সে চলে, ফেরে। এই দাহ এই উন্মাদনা সমেত সে পাগল-পাগল শেষ পর্যন্ত উপগত হয়, ঘৃণা নিয়ে নিরাবেগ উপগত হয় চন্দ্রাবলীতে। আর চন্দ্রাবলী খুলে খুলে দেয় নিজেকে। বার বার। নির্দ্বিধায়। আপন স্বপ্নে আপনি মশগুল হয়ে। ভাবে না। হিসেব কষে না। শুধু স্বপ্নের তীর ধরে গান গেয়ে-গেয়ে ফেরে। চন্দ্রাবলী। চন্দ্রাবলী মোটা। গোল। কালো। বেঁটে। সাধারণের চেয়েও সাধারণ অনাকর্ষণীয় চন্দ্রাবলী।
সেই অগ্নি সঞ্চার করা নারী, তাকে কি প্রতারুক বলা যায়? যায় না? যায় না? তা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়।
আবার বমি পায় তার। আর বিবমিষা থেকে বাঁচতে সে বিজ্ঞাপনের নারীশরীর থেকে চোখ সরায়। অনুভব করে, রাস্তার এই পারে গোরস্থানের কাছটায় যে মৃত্যুর নৈঃশব্দ্য, অন্য পারে ভেঙে খানখান হয়ে আছে। জনগণের স্বৈর শব্দে, বিপণনের ছড়িয়ে পড়া রঙে, উদাত্ত গৃহগুলির অহংকারী গৃহস্থালিতে ছাপিয়ে বেড়াচ্ছে জীবন। যেন এই পথ পেরুলেই সে পৌঁছে যাবে মৃত্যু থেকে জীবনে।
কিন্তু জীবনবিমুখ সে। পথটুকু পেরিয়ে গেল না। শুধু অনুভব করল, ও-পারের আটতলা বাড়িটিও তার জীবনে ঢুকে বসে আছে। ওই বাড়ির মধ্যেকার সমস্ত অজানা সমেত তার এই বেঁচে থাকা। যেমন একজন মানুষের মনের ভিতরকার গাঢ় অজানা জড়িয়ে তৈরি হয় সম্পর্ক, বছরের পর বছর, আর ওইসব অজানা অজ্ঞাত রাশি নিয়ে মানুষে মানুষে শোয় পাশাপাশি, গলা জড়াজড়ি ঘুম দেয়, ভালবাসে, একজন হয়তো খুন করেছে সেদিন, একজন গোপনে গমন করেছিল অন্যজনে, দপ্তরে তহবিল তছরুপ করে ফিরে এল হয়তো কেউ, আর ভালবাসল ফিরে এসে, জানাল না এ ওকে কিছু আর ভালবাসল, ভালবাসে কিংবা ভালবাসা মাখিয়ে নিয়ে ঘৃণা করে প্রকৃতই, ঘৃণা করে আর বালিশের তলায়, তোশকের তলায় লুকিয়ে রাখে মিথ্যা। মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে পরস্পরের ঠোঁটে তুলে দেয় পবিত্র চুম্বন, ভানের ভিতর নারীর স্তনবৃন্তে মুখ রাখে পুরুষ আর উরুর ভাঁজে কৃতকর্ম সংগোপনে রেখে নারী দুই উরু উন্মোচিত করে দেয়।
যেমন সে নিজে, যেমন সে ঘৃণা করে চন্দ্রাবলী আর প্রত্যেকবার তার বিবাহপ্রস্তাব নাকচ করে দেয় অর্থনৈতিক অক্ষমতার কারণে। প্রকৃতপক্ষকে সে আবডালে রাখে। সন্তর্পণে গোপন করে সত্যকে এবং জানতে দেয় না ঘৃণা। জানতে দেয় না অপছন্দ। বলে না যে একমাত্র চন্দ্রাবলীকেই সে বিবাহ করতে পারে না।
একটি গাড়ি ধোঁয়া ছড়িয়ে চলে যায়। ধোঁয়া লাগে শুভদীপের গায়ে। সে অপস্রিয়মাণ গাড়িটিকে দেখে ও ভাবে এই গাড়িও তার জীবন কি না। এবং সে ঘুরে দাঁড়ায়। নিশ্চিত হয়। যা কিছুই ঘটছিল চারপাশে, সবই ছিল তার জীবন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অজ্ঞাত মানুষের ঠিকানাও তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্মাবধি। পৃথিবীর সব মানুষই আসলে নিজের জীবনের সঙ্গে যাপন করছে কোটি কোটি জীবন। সে একজন মানুষ, সে যদি স্থির হয়, তাকে ঘিরে আবর্তিত জগতের প্রতি বিন্দু তারই জীবন। শুধু মৃত্যু আলাদা। মৃত্যু তার একার। মৃত্যু যার-যার তার-তার। একজনের মৃত্যুতে থেমে যায় না অন্য কোনও জীবন।
সহসা সে হাত মুঠো করে। মনে মনে পদাঘাত করে নিজেকে। জীবনকে ভাবছে সে! কেন! তার আর জীবনকে প্রয়োজন নেই! সে মৃত্যুকে জানতে চায়। মৃত হয়ে উঠবার আগে মৃত্যুর অসামান্য নিরপেক্ষতার স্বাদ ও সন্ধান সে পেতে চায়।
গোরস্থানের প্রবেশদ্বারে ধাক্কা দেয় সে। একটি পাল্লার মাঝবরাবর একটি ছোট দরজা, দরজার মধ্যে দরজা, নিঃশব্দে খুলে যায়। সে নিচু হয়ে প্রবেশ করে ভিতরে আর তার সামনে থরে থরে সাজানো দেখতে পায় হিমেল জীবন।
ডিসেম্বরের বিকেলে এই শহরেরই মধ্যবর্তী এক উঁচু প্রাচীর পেরোলেই শীত এসে জাপটে ধরে জানত না সে। তার হাত দুটি শীতল হয়ে যায়। বাম থেকে ডানে ক্রমান্বয়ে দৃষ্টি ফেরাতে থাকে সে। তখন মানুষটি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকেন। পীরের দরগার জন্য যে ঘেরা জায়গা, তার বাইরে একটি বেঞ্চে তিনি বসে আছেন। শুভদীপের জন্য দরজা খুলে দিয়ে ফিরে গেছেন সেখানে। ডাকছেন এখন। শুভদীপ এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। বয়স্ক ছোটখাটো মানুষ। সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরা। সাদা চুল। সাদা দাড়ি। মাথায় গোল টুপি। মুখে দৃঢ়তা। চোখে সারল্য। কিন্তু কপালের মাঝ বরাবর সমান্তরাল সরলরেখা হয়ে ফুটে আছে জিজ্ঞাসা। কেন এসেছে সে। সে উত্তর দিচ্ছে, তার শান্তির জিজ্ঞাসা। শান্তির সন্ধান। মৃত্যু বলছে না সে। এই বিদগ্ধ মানুষটির কাছে এসে আর মৃত্যু বলছে না। শান্তি বলছে। এই মৃত মানুষদের সান্নিধ্যে, এই গাছপালার ছায়ায়, পাশাপাশি শুয়ে থাকা নিবিড়তার মধ্যবর্তী এই শৈথিল্যে, মানুষের অন্তিম পরিণতির এই মহাস্থানে তার শান্তির খোঁজ।
মানুষটির মুখ সম্রান্ত হাসিতে ভরে যায়। তারপর তাতে প্রসন্নতার স্পর্শ লাগে। তাঁর প্রসন্ন হাসি মুখমণ্ডলে বিস্তারিত হতে হতে গাল বেয়ে, কাঁধ বেয়ে, মাটিতে বকুলফুলের মতো ঝরে পড়ে টুপটা তিনি ইঙ্গিতে মাথা ঢেকে নিতে বলেন। শুভদীপ মাথায় রুমাল জড়িয়ে নেয়। সন্ধে নামলেই যেন সে বেরিয়ে যায়। বৃদ্ধ মানুষ বকুল ঝরিয়েই বলেন। সে সম্মত হয় এবং পাখ-পাখালির ডাকে সন্ধ্যার সমাগত স্বরের ইশারা পায়। এখানে এই ঘেরা জায়গায়, ঘন গাছের গা ঘেঁষাঘেষি অবস্থানে সন্ধ্যা দ্রুত নামে। ছায়া জমে জমে হয়ে যায় ঢিপি-ঢিপি অন্ধকার।
সারি-সারি কবরের মধ্যবর্তী পথ বেয়ে হেঁটে যায় সে। বৃদ্ধ মানুষটি তার পাশাপাশি। এইখানে শায়িত মানুষেরা শান্তিতে আছেন—ঘোষণা করেন তিনি। তৃপ্তি ও শান্তি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত ব্যাখ্যা করে যান। সেই মতামত ধ্রুব। সমস্ত জীবন অসংখ্য উপলব্ধির মাধ্যমে এই ধ্রুবত্বে তিনি পৌঁছেছেন। তাঁর ছেলে মারা গিয়েছে যক্ষ্মায়। একমাত্র সন্তান। সেই মৃত্যুশোক হরণ করেছে তাঁর স্ত্রীকে। এ জগতে আপনার বলতে টিকে ছিল একটিমাত্র ন্যালাখ্যাপা ভাই। পাঁচ বছর আগে রেলের তলায় সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। রেলব্রিজের ওপর দিয়ে সে সংক্ষিপ্ত সময়ে পার হয়ে যেতে চেয়েছিল। পারেনি। সে যখন ব্রিজের মাঝবরাবর, তখন রেলগাড়ি এসে পড়ে। প্রাণভয়ে সে দৌড়েছিল, চালকও গতি রোধক যন্ত্রে দিয়েছিল টান। কিন্তু যা হবার তা হল। তার দেহের টুকরো-টাকরা কিছু ব্রিজে রইল, কিছু পড়ল নীচের রাস্তায়।
অপরূপ হাসি তাঁর মুখে বিস্তার পায় এবার। আর বিস্তার পেতে পেতে অনন্তে মেশে। অপরূপ এই হাসি। অপূর্ব। কেন-না, তিনি স্মরণ করেন, ভাইয়ের শরীরের প্রতিটি টুকরোই, যা নীচে পড়েছিল ও যা ছিল ওপরে, তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। সহজ ছিল না সেই কাজ, কিন্তু তিনি সম্ভব করেছিলেন। রেলের আরক্ষাকর্মীরা তাঁকে সাহায্য করেছিল। নিশ্চয়ই করেছিল।
ন্যালব্যাপা ভাই তাঁর। সংক্ষেপে পথ পেরোতে চেয়েছিল। পারেনি। তার সেই অপারঙ্গমতায় এই মানুষটি একা। নিশ্চিতই একা।
পাকা চুল ও দাড়ি সমেত নিশ্চয়তার মাথা নাড়েন তিনি আর তৃপ্তির কথা, শান্তির কথা বলেন। এই যে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন তিনি, গোটা গোরস্থানের দেখ-ভাল—এই নিয়ে তিনি তৃপ্ত। তাঁর কোনও অভিযোগ নেই, আক্ষেপ নেই। তাঁর এখন একটিমাত্র চাওয়া—একবার ঘুরে আসবেন ফুরফুরা শরিফ। তাহলেই শান্তিতে ভরে যাবে তাঁর মনু। আর আল্লার ডাক পেলেই তিনিও শুয়ে পড়বেন স্ত্রী-পুত্র-ভাইয়ের কবরের কাছাকাছি।
কথা শেষ হয়। তিনি থমকে দাঁড়ান। শুভদীপও দাঁড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। এবং বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে বৃদ্ধের আত্মস্থ রূপ। কোন অসীমে মিলেছে তাঁর দৃষ্টি। যেন তাঁর স্ত্রী, ছেলে আর ভাইয়ের অস্তিত্বকে স্পর্শ করে ফিরে আসছে।
আত্মস্থ ভাব থেকে তন্ময় হলেন তিনি। মুখে ফিরে এল হাসি। নিচু স্বরগ্রামে তিনি কথা বলে চললেন। একই কথা। হতে পারে, আর কোনও কথা নেই, ফুরিয়ে গিয়েছে সব। রয়ে গেছে এইটুকু। বার বার বলার। শোনানোর অন্যকে। শোনানোর নিজেকে। একা নন। একা নন। একা তিনি নন। এইসব কবরে শায়িত অসংখ্য মানুষকে তাঁর সঙ্গী মনে হয়। এইখানে শুয়ে আছে স্ত্রী, ছেলে, ভাই। তিনিও শুয়ে পড়বেন পাশাপাশি একফালি জায়গায়। বাজে, বেজে চলে আত্মগত স্বর। শুয়ে পড়বেন তিনিও। আর ভাবনা কী! শান্তি শান্তি। সব শান্তি। হারানোর বুকফাটা হাহাকার বেজেছিল একদিন। এখন শান্তি। সব শান্তি।
শুভদীপ দেখল, মানুষটির মুখ থেকে তন্ময় হাসি ছড়িয়ে পড়ল টুপটাপ, বকুল ফুলেরই মতো। আর তিনি, শুভদীপকে একা হতে দিয়ে, দু’হাত পেছনে জড়ো করে ফিরে চললেন আগের জায়গায়।
এই মানুষ, গোরস্থান আগলে রাখা মানুষ, মৃত লোকেরাই হয়ে উঠেছে তার জীবন। শুভদীপ মাথা নিচু করে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যায়।
অগুনতি কবরের সারি। ছোট, বড়, মাঝারি। নতুন ও পুরনো। জীবিতের সামর্থ্য অনুযায়ী মৃতের সমাধিফলকের কারুকাজ। মৃতের গুরুত্ব অনুযায়ী জীবিতের শ্রদ্ধা-ফলক। সে একটি বর্ণও পড়তে পারে না সেইসব ফলক থেকে। বরং একটি সুদৃশ্য শ্বেতপাথরের সমাধির কাছে দাঁড়ায়। টের পায়, এই জায়গাটিতে গাঢ়তর শীত ও সন্ধ্যার ইশারা ত্বক ভেদ করে ঢুকে পড়ছে। কুয়াশার দল এসে জমে যাচ্ছে সামনে কেন-না ওখানে আছে পাড়-বাঁধানো জলাশয়। বাইরের রাস্তা থেকে ভেসে আসা গাড়ির শব্দ ডুবে যাচ্ছে জলে। সে গিয়ে বসছে জলাশয়ের কিনার ঘেঁষে। একটি অজানা গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে সুগন্ধ নয়। দুর্গন্ধও নয়। নয় মাদকতাময়। নতুন ও গভীর এই ঘ্রাণ। হেতে পারে মৃত্যুর গন্ধ এই। হতে পারে সেই নিরপেক্ষ, নির্লোভ, শান্ত নারী যখন বেশবাস পরিবর্তন করে, তখন এমনই গন্ধ আসে গা থেকে তার।
সে শুয়ে পড়ল এবার। জলাশয়ের বাঁধানো পাড়ে শুয়ে পা ছড়িয়ে দিল। একটি-দুটি শুকনো পাতা খসে পড়ল গায়ে। তার হাতের সঙ্গে, পায়ের সঙ্গে, মাথার সঙ্গে, ব্যাগের সঙ্গে সংযুক্ত মহাবিশ্ব আবর্তিত হয়ে চলল আপন ইচ্ছায়। সে চোখ বন্ধ করল আর কুয়াশা এসে ঢেকে ফেলল অতীত আর বর্তমানের মধ্যবর্তী সীমারেখা।
তখন মাতলা নদীতে নৌকা ভাসাল মাঝিরা। বড় যন্ত্রচালিত নৌকা। পাটাতনে ছাউনি দেওয়া। রীতিমতো শয্যা পেতে দু’দিনের জীবন-যাপন। নৌকাতেই রান্না খাওয়া প্রাতঃকৃত্য শয়ন। কিছু অংশ খোলা। নদীর হাওয়ার জলসম্ভব ঝাপটা লাগছে সেখানে। সেই ঝাপটা মেখে, মদ্যপান করতে করতে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভাগের আয়োজন করছে অন্য যাত্রীরা। রবিদাও আছেন দলে। রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। রবিদা রান্নার ব্যবস্থাপনায়। তাঁকে একটু ব্যস্ত দেখাচ্ছে তাই। সে এসেছে রবিদার অতিথি হয়েই। আর রবিদার সঙ্গে আছে তাঁর স্ত্রী। কালো, মোটা, বেঁটে, গাভীর মতো ভাষাহীন অথবা শুধু বেদনার অভিব্যক্তিময় চোখ। সাধারণের চেয়েও সাধারণ, অনাকর্ষণীয় চন্দ্রাবলী। এক অপরূপা মহিলা রবিদার পাশে পাশে। তিনি চন্দ্রাবলীর দিকে ফিরেও দেখছেন না। এ দৃশ্য নতুন নয় তার চোখে। এই রবিদা ও অপরূপা মহিলারা। সুন্দরী মহিলাদের প্রতি রবিদার প্রসক্তি প্রবল। সে জানে এবং এই প্রসক্তিকে লাম্পট্য ভাবে। শুধু রূপ দ্বারা পুরুষ নারীকে জয় করতে পারে। শুধু গুণ দ্বারাও পারে আর রূপ বা গুণ না থাকলেও অর্থ ও সাহসের সঙ্গতি দ্বারা যুগ-যুগান্তর ধরেই সে পেয়ে যায় অগুনতি অপরূপা নারী।
রবিদা চন্দ্রাবলীর দিকে ফিরেও দেখছেন না। আর চন্দ্রাবলী তার সঙ্গে সঙ্গে আছে। সেও মদ্যপান করে না বলেই চন্দ্রাবলীকে সঙ্গী করে সরে আছে এইদিকে। চন্দ্রাবলী নানা কথা বলছে। সে-ও বলছে। আর দেখছে মাতলা নদী বেয়ে নৌকা ক্রমে ঢুকে পড়ছে খাঁড়িতে। নৌকার যন্ত্রের শব্দে নদী আর জঙ্গলের স্তব্ধতা ভেঙে খানখান।
দু’পাশে ম্যানগ্রোভ বন। উষ্ণ মণ্ডলের বৃক্ষরাজি ঝুঁকে আছে জলে। যেন এখুনি ডালপালা ডুবিয়ে গা ধোবে বসন্তের নীরে। কেন-না সেদিন পূর্ণ বসন্ত। সেদিন ছিল দোলের পূর্ণিমা।
সুন্দরবন ঘন ও গভীর হচ্ছে। সে আর চন্দ্রাবলী বসেছে পাশাপাশি আর একগুচ্ছ বক জল ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে পারে। আর এভাবেই ত্রস্ত হরিণেরা সন্ধ্যা শেষের খবর দিল রাত্রিকে আর বনে রাত্রি নামল। জলে রাত্রি নামল। পাড় ঘেঁষে ঘাটে নোঙর করল নৌকা। যন্ত্র থেমে গেল। প্রকৃতি বিরুদ্ধতা থেকে প্রত্যাবর্তন করল প্রাকৃতিক স্তব্ধতায়।
জোয়ারের সময় এল তখন। পরতে পরতে জল এসে ঢেকে দিল ঢালু পাড়। নৌকা ক্রমশ উঠছে। উঁচু পাড় বরাবর হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন মদ খেয়ে গড়িয়ে পড়েছেন রবিদা। সঙ্গে আরও কেউ কেউ। ঘাটের ধাপ একটি একটি করে ডুবে যাচ্ছে। আর চাঁদ উঠছে। অন্নপ্রাশনের থালার মতো চাঁদ। একটু পুরনো কাঁসার। হতে পারে ঠাকুরমার দান। কারণ মস্ত চাঁদের গায়ে হলুদে সোনার আভায় লালের আবেশ। ঝকমকে নয়। বরং পোড়া পোড়া। বরং অনেক বড়। বরং অনেক কাছাকাছি। শুভদীপ স্তব্ধ হয়ে দেখছে। চাঁদ দেখছে। তার ঋজু হালকা শরীর। দীর্ঘ শরীর। বাবলা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে এই শরীর দীর্ঘ-দীর্ঘ-দীর্ঘতর হয়ে আকাশের গায়ে প্রায় চাঁদ ছুঁই-ছুঁই। জ্যোৎস্নার আভায় কী অপরূপ সে। কী অসামান্য সুন্দর হয়ে ওঠা।
এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিল চন্দ্রাবলী একা। পরে বহুবার সে এই প্রায় অলৌকিক সৌন্দর্যের স্মৃতিচারণ করেছিল। তার বর্ণনা থেকে এমনকী শুভদীপ নিজেও প্রত্যক্ষ করেছিল নিজস্ব অলৌকিক সুন্দর রূপারোপ। মোটা বেঁটে, গোল, কালো চন্দ্রাবলীর হলুদ সালোয়ার কামিজে জ্যোৎস্না লেগে তখন মায়াবী রং। দোপাট্টা উড়ছে হাওয়ায়। আর চাঁদের গা থেকে ফোঁটা ফোঁটা আলো পড়ে শুভদীপের চশমার কাচ, সাধারণ পরকলাদ্বয়, কীরকম স্বপ্নিল হয়ে যাচ্ছে তার প্রতি মৌহুর্তিক বর্ণনা জানতে পারছে সেই। আর তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে সুর। শুধু সুর। সেই সুরের ভিতর কোনও ভাষা নেই। কোনও বাণী নেই। ধ্বনি নেই কোনও। এক শব্দতরঙ্গ সম্বল। সেই তরঙ্গ আশ্রয় করে সুর ভেসে যাচ্ছে জলে। মিশে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। শুভদীপ দেখছে। শুনছে। ভাবছো রবিদার বাড়িতে বার কয়েক গিয়েছে সে। চন্দ্রাবলীকে দেখেনি। চন্দ্রাবলী একটি গানের স্কুল চালায়। আর চন্দ্রাবলী চোখ বন্ধ করে সুর তুলছে এমন–তার দু’গালে সরু জলের ধারা। হাওয়া সেই সুর বয়ে নিয়ে চলেছে নৌকায় আর নৌকা পেরিয়ে অসীমে। ওই হাওয়া, ওই নদীর জোয়ার, জলে ছলাৎছল, ওই জ্যোৎস্নায় চাঁদ আর ছলাৎছলে মিশে যাওয়া চাঁদের প্রতিবিম্ব, ওই সুর আর কালো মাংসল গালে লেগে থাকা নোজল-সব মিলে শুভদীপের হাত প্রসারিত করে দেয় আর সে স্থাপন করে, আলতো স্থাপন করে চন্দ্রাবলীর মাথায়। স্পষ্ট টের পায়—চন্দ্রাবলী কাঁপল। কেঁপে উঠল। বন্ধ করল গান। জানাল, এ চন্দ্রকোশ। মালকোশের খুব কাছাকাছি চন্দ্রকোশ। কিন্তু নরম। বড় নরম। শুনতে থাকলে, গাইতে থাকলে কান্না পেয়ে যায়।
আজ, এই কবরস্থানে, দিঘির এই শীতার্ত পারে, শুভদীপ সেই চন্দ্রকোশের সুরকে স্পর্শ করল স্পষ্ট।
কেন-না, জ্যোৎস্না নেমে এসেছে জলে। আর লেগেছে হাওয়া। ঘোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় আলোর চিকচিক। সে ছটফট করছে। মুঠোয় ধরছে। চন্দ্রাবলীর স্তন। বড় ভারী স্তন। মেদবহুল পেটের মধ্যে হাঁটু চেপে রাখছে। এখন, এই প্রক্রিয়ার আগে তার শীত চলে যাচ্ছে। এক কামভাবে কানের লতিতে আগুন। সে তার শিশ্ন সম্পর্কে অতি বিচলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এলেন। মনে করিয়ে দিলেন, সন্ধে পেরিয়ে গেছে, এবার যেতে হবে। সে উঠে দাঁড়াল তখন। তিনি কোনও প্রশ্ন করলেন না। অন্ধকারে কবরগুলি অসংখ্য ছোট ছোট স্তৃপ। গাছপালা ভেদ করে জ্যোৎস্না নামেনি। পোঁছয়নি আলো। সে হেঁটে চলল বৃদ্ধের পেছন পেছন। এবং টের পেল, সেই আশ্চর্য গন্ধ তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে এবার। মনে পড়ল তার। মৃত্যুকে উপলব্ধি করার পরিবর্তে এতক্ষণ অনর্থক ভেবে গিয়েছে সে। এর জন্য চন্দ্রাবলীকেই সে দায়ী করে বসে মনে মনে এবং ঘৃণা ওগড়ায়।
কবরস্থানের গেট পেরিয়ে বাইরে আসতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় তার। আধুনিক আলোক প্রক্ষেপণ কৌশলে। বিজ্ঞাপনের মেয়েটি এখন অনেক বেশি আবেদনপূর্ণ। প্রায় ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠেছে তার অবয়ব। সে মেয়েটির চোখ দেখে। বুকের খাঁজ। উরুর মসৃণতা দেখে আর ঠোঁটের আকর্ষণ। তার মেয়েটিকে ছুঁতে ইচ্ছা করে আর সেই মেয়ে বিজ্ঞাপনের ছবি থেকে নেমে তার গা ঘেঁষে চলে যায়। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় ঘাড় ফেরানো চাউনির মধ্যে আকর্ষণ। সে আকর্ষণ অনুসরণ করে এবং বুঝে পায় না বিজ্ঞাপনের মেয়েটি ছোট পোশাক খুলে সালোয়ার-কামিজ পরে নিল কখন। ছোট চুলে কখন বসিয়ে নিল সুদীর্ঘ বিনুনি। সাদা ত্বক কোন জাদুবলে হয়ে গেল মাজা-মাজা। শুধু আবেদন এক। দৃষ্টি ও দেহের আবেদন সদৃশ। সে মৃত্যুর সংকল্প বিস্মৃত হয় তখন। কবর বিস্মৃত হয়। ভুলে যায় সমাহিত বৃদ্ধকে আর অদ্ভুত ঘ্রাণ। সে হেঁড়া জুতো বিস্মৃত হয়। এমনকী চন্দ্রাবলী সম্পর্কে ঘৃণাও টের পায় না। এক আগুনের বৃত্ত তাকে ঘিরে ফেলে ক্রমশ এবং পোশাক ও ত্বক অবিকৃত রেখে শরীরে ঢুকে যায়। আর মেয়েটি কবরখানা থেকে অল্প দূরে একটি বাতিস্তম্ভের নীচে দাঁড়িয়ে অনুচ্চে কথা বলে। জানায়, পাঁচশো। জানতে চায়, হতে পারে কিনা।
শুভদীপ থমকে দাঁড়ায়। শীত-পরাস্ত কপালে বড় বড় স্বেদবিন্দু জমে। আঠাশ বছর বয়সে এই প্রথম সে কোনও শরীর বিকিকিনির মুখোমুখি। কানের লতি থেকে ফুলকি ঝরে তার। আর দাহ্য শরীরকে তৎক্ষণাৎ আগুন বেষ্টন করে। হাড় জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে যায়। ত্বক ভেদ করে ফুটে বেয়োয় লালচে গনগনে আঁচ। গলা অবধি শুকনো। স্বর ফোটে না যথাযথ। আড়ষ্ট জিভে বাক্য উচ্চারিত হয় না যথাযথ। তবু সে সেই আধফোটা খসখসে স্বর দ্বারা জানায় তিনশো। তিনশোই সে দিতে পারে সর্বোচ্চ দাম। বিজ্ঞাপনের মেয়ে নিজেকে বার কয়েক নিলাম করে। অতঃপর তিনশোতেই রাজি হয়ে যায়। শুভদীপকে সঙ্গে আসতে বলে। শুভদীপ সঙ্গে-সঙ্গে যায়। সম্মোহিত। অথবা স্বগোথিত। কিংবা আবেশদীর্ণ। মেয়েটি শরীরে শরীর ঘষটে চলে। বুক ছুঁইয়ে দেয় গায়ে। একসময় জানায়, শুভদীপ মদ খেতে চাইলে তিনশোয় হবে না। আরও পঞ্চাশ লাগবে। সে মদ খাবার অনিচ্ছে জানিয়ে হিসেব করে এবং আশ্চর্য হয়ে যায়। সে মেয়েটিকে দর বলতে প্রস্তুত ছিল না। অথচ প্রস্তুতি ছাড়াই সে বলে ফেলল সঠিক। তার কাছে সাড়ে তিনশো টাকাই আছে। দু’শো বিজ্ঞাপনের বকেয়া সংগ্রহ। একশো মা দিয়েছিল বাবার জন্য কিছু ওষুধ কিনতে। পঞ্চাশ তার পথ খরচ। ঘুরে-ঘুরে কাজ করে বলে তার সংস্থা তাকে দৈনিক ত্রিশ টাকা পথখরচ দেয়। সে বেঁটে মেরে দেয় দীর্ঘ পথ আর পয়সা বাঁচায়। বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে তার কাছে এখন কুড়ি টাকা বাড়তি।
তার বাবার এই ওষুধ তাদের এলাকায় পাওয়া যায়নি। দুদিন এমনিতেই কেটে গেছে তাই। সে ভেবেছিল একশো টাকার সঙ্গে বাড়তি কুড়ি টাকা যোগ করে মোট ছ’টি ওষুধ কিনে নিয়ে যাবে। কারণ একএকটি ট্যাবলেটের দাম আঠারো টাকা উনিশ পয়সা।
হবে না। ওষুধ কেনা হবে না আজ। সে মনে-মনে কথা সাজায়। একশো টাকার হিসেব তৈরি করে নিতে চায়। মাকে বলতে হবে। যদিও, যত যুক্তিসঙ্গতই হোক, মা গ্রাহ্য করবে না। অভিযোগ করবে। অভিযোগ, অভিযোগ, অভিযোগ।
মেয়েটি আলো-আঁধারি পেরিয়ে যাচ্ছে। সেও যাচ্ছে। আর পেরিয়ে যেতে যেতে জেনে যাচ্ছে মেয়েটির নাম মালবিকা।
মালবিকা? সে চমকে উঠছে। তার জীবনের প্রথম নারীর নাম মালবিকা। মালবিকা সিনহা। সে ডাকত মালবিকাদি। কারণ সে ছিল অন্তত বারো বছরের বড়। অপার সৌন্দর্যের ওপর মেদের প্রলেপ পড়ছিল তার তখন। অল্প পরিচিতি ছিল আগে। স্কাউটের সমাবেশে সেই পরিচয়ে গাঢ়ত্ব জমে। এবং একদিন মধ্যরাতে তাঁবু থেকে তাকে ডেকে নেয় মালবিকাদি। এবং তাঁবুগুলির পেছন দিকে, অল্প দুরে, একটি পাইনাসের তলায় তার ঠোঁট পুড়িয়ে দেয়।
সেদিন সে শরীরের স্বাদ জেনেছিল প্রথম। ভরাট স্তনের ওপর হাত রাখার অসম্ভব উত্তেজ সে অনুভব করেছিল প্রথম। মালবিকাদি ঘাসের ওপর শুয়ে, অভিজ্ঞ হাতে তাকে শরীরে নিয়েছিল। একুশ বছর বয়স তখন তার। সে তীব্র আকাঙ্ক্ষায়, উন্মাদনায়, উত্তেজনা ও উদ্বেগে, প্রথম নারীভেদের পুলকে ও সীমাহীন অনভিজ্ঞতায় ঘটিয়ে যাচ্ছিলসংঘর্ষ। সে টের পাচ্ছিল, ঘাস ও মাটির ঘর্ষণে তার হাঁটু ছড়ে যাচ্ছে। দুই হাঁটু ছড়ে যাচ্ছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না শুভদীপ এই প্রথমবার।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু পরের রাত্রে আবার জেগে উঠেছিল আহ্বানের প্রত্যাশায়। প্রথম বিদীর্ণ করার কারণে তার ব্যথা জমেছিল। এমনকী মূত্রত্যাগ করার সময় জ্বালা। সুখমিশ্রিত সেই ব্যথাবেদনাকে, জ্বালাপোড়াকে সে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছিল বারবার।
মোট দশদিনের সমাবেশে সে মালাবিকাদির সঙ্গে মিলিত হয়েছিল তিনরাত্রি। এবং তাকেই নির্বাচন করার জন্য অসহ পুলকে ও গর্বে সে আপ্লুত ছিল সারাক্ষণ।
সমাবেশ থেকে ফিরে আসার পর এমনই এক প্রাক্ শীতের বিকেলে শ্যামলিম তাকে একটি গল্প শোনায়। মধ্যরাতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে অভিসারের গল্প। আর সেই গল্প শোনাতে শোনাতে শ্যামলিমের মুখ গনগনে হয়ে যায়। কানে আগুন ধরে। চোখ থেকে হীরকদ্যুতি ছিটকোয়। জিভ হয়ে যায় আদ্যন্ত লালাসিক্ত। আর সেই সিক্ত জিভ অবিকৃত বর্ণনা দেয় যে শরীরের তার নাম মালাবিকাদি।
কথা বলতে বলতে শ্যামলিম একসময় মোট চার রাত্রি অভিসারের স্মৃতিবন্ধে ডুবে যায়। সে বোঝে। বুঝতে পারে। কারণ শ্যামলিমও তারই মতো একুশ। তারই মতো প্রথম। কৌমার্যের ডিম ফুটে বেরিয়ে আসা পুরুষছানা। কিন্তু সে নিজের তরফ থেকে একটি বর্ণও শ্যামলিমকে বলে না। বলতে পারে না। শ্যামলিম আহত হবে বলে নয়। সে প্রকৃতপক্ষে গোপন করতে চায় আপন রক্তক্ষরণ। চোখে জল এসে গিয়েছিল তার। প্রথম প্রতিক্রিয়ায়। যেন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে। যেন কথা, রাখেনি মালবিকাদি তার।
এরপর প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরে তার গা রি-রি করে। রাগে। অপমানো কিছু বা ঈর্ষায়। কারণ শ্যামলিম গিয়েছিল চারদিন। সে তিনদিন। নির্বাচিত হওয়ার শ্লাঘা থেকে চ্যুত হয়েছিল সে। এবং ছটফট করতে করতে পরদিন ছুটে গিয়েছিল মালবিকাদির ইস্কুলে।
মালবিকাদি বিরক্ত। অপ্রস্তুত। তাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। শুভদীপের চোখে পড়েছিল, সমাবেশে থাকাকালীন ছিল না, কিন্তু এখন মালবিকাদির সরু সিথি বরাবর সিঁদুর আঁকা। তার হঠাৎ চোখে জল এসে যায়। সে তেমনই অকস্মাৎ মালবিকাদির হাত ধরে স্থানকাল রির্বেচনা না করেই এবং শ্যামলিম প্রসঙ্গ টেনে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকার কৈফিয়ত চায়।
মালবিকাদিকে তখন দেখাছিল কুদ্ধ ও বিপন্ন। একটানে হাত হিচড়ে ছাড়িয়ে নিয়েছিল সে। হিসহিস স্বরে তাকে বদমায়েশি করার চেষ্টা করতে বারণ করেছিল। তারপর স্থির তাকিয়েছিল তার দিকে। মুখের রেখায় বা দৃষ্টিতে একবিন্দু প্রশ্রয় ছিল না। বরং তার কাঠিন্যের অভিব্যক্তিতে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিল শুভদীপ। আর মালবিকাদি কেটে কেটে তার বক্তব্য পেশ করছিল। বুঝিয়ে দিচ্ছিল, পারস্পরিক সম্মতিতে রচিত কিছু উপভোগ্যতা ছাড়া এই সংযোগের কোথাও কোনও প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, প্রতিশ্রুতি বা দায়বদ্ধতা ছিল না। তারা কেউ কারওকে কোনও কথা দেয়নি। ওই তেরাত্রির ঘনিষ্ঠতার মধ্যে, কামাদির মধ্যে কোনও বিশ্বাসঅবিশ্বাস, ন্যায়-অন্যায় ছিল না। এমনকী শুভদীপ নিজেও কোনও মেয়ের সঙ্গে ব্যাপৃত হলে মালবিকাদির কিছু যেত আসত না। এতটুকু বিচলিত হত না সে। এইসব সম্পর্ক যেখানে শুরু হয়, সেখানেই শেষ হয়ে আসে। সাময়িক জীবনের সাময়িকতর লীলাখেলা। খুচরো পয়সার মতো। ছোটখাটো ক্রয়ে মাত্র কাজে লাগে। কিংবা প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজন ইত্যাদির বাইরে পাঁচ টাকার ফুচকা খাবার মতো। পুষ্টির পরোয়া নেই। শুধু স্বাদ।
সম্পর্ক মানেই এক বিশ্বাস ও দীর্ঘস্থায়ী ন্যায়পরায়ণতা–এমনই বোধ ছিল শুভদীপের। কেউ কারওকে শরীরীভাবে আহ্বান করেছে মানে সে মানসিক অভিষেক ঘটিয়ে দিয়েছে। যে আহ্বান করেছে তার মনের মধ্যে, যাকে আহ্বান করা হয়েছে তার আসন অবিচলিত। এমত ধারণা ও বিশ্বাস সমূহে তাড়িত সে ন্যায়বান হয়ে উঠতে চেয়েছিল তর্ক দ্বারা। মালবিকাদি তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। সে তখন প্রভূত আবেগে, প্রভূত বেদনাবোধ ও অপমানে সরাসরি কেঁদে ফেলে রাস্তায়। চোখ থেকে নেমে আসা জল কান্নার দমকসহ মুছে নেয় হাতের উল্টোপিঠে। এবং ধাক্কা সামলাতে সামলাতে রাস্তা পার হয়।
প্রাথমিকভাবে তার মনে হয়েছিল, এই আঘাত মৃত্যুর মতো। সাময়িকতার এই কষায় স্বাদ ক্ষণিক উপভোগ্যতার সঙ্গে মিশে বিশ্রী ও কটু হয়ে উঠেছিল। সব মিলে, সত্যি, মরে যাচ্ছে এমন যন্ত্রণা। তার সেই মুহূর্তে অভিলাষ ছিল, ইস্কুলের সামনেই, পথ পেরুতে সে গাড়িচাপা পড়ুক আর তার দলাপাকানো বা ছিন্নভিন্ন মাংসাদি দেখে সারাজীবন অনুশোচনায় দন্ধে মরুক মালবিকাদি।
কিন্তু বাস্তবিক সে গাড়িঘোড়া দেখে, সামলে, অত্যন্ত সাবধানেই রাস্তা পার হয় এবং নিজেকে অক্ষত আবিষ্কার করে।
সে চলে আসবার আগে শুনতে পেয়েছিল, মালবিকাদি তাকে সব ভুলে মন দিয়ে পড়াশুনো করার উপদেশ দিচ্ছে। মনে মনে সে ‘খানকি’ কথাটি উচ্চারণ করেছিল তখন এবং সাময়িকতার এই দাহে বহুদিন তাড়িত হয়েছিল। তৃতীয় বর্ষের শেষ পরীক্ষায় তার ফল খারাপ হয়। কিন্তু শ্যামলিম বিপদাপন্নতার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় ঠিক।
মালবিকাদিকে তার মনে হয়েছিল প্রতারক। এই প্রতারণা যখন সে নিজেই অভ্যাস করে তখনও এমনকী মালবিকাদিকে সে ক্ষমা করেনি। এবং আর কখনও যায়নি সে মালবিকাদির কাছে। কিন্তু কোনও কোনও রাত্রে মালবিকাদিকে সে রমণ করেছে দীর্ঘ-দীর্ঘ সময় ধরে। শরীর জাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া নারীকে সে প্রায় ধর্ষণ করেছে এবং নিজেকে মুক্ত করেছে একাকী। ঠিক যেমন এখন সে চন্দ্রাবলীকে ভাবে আর বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত হয় আর ছটফট করে। ছটফট করে আর… না। এই মুহূর্তে চন্দ্রাবলীকে ভাবতে চায় না সে। বরং মালবিকাকে অনুগমন করে।
মালবিকা। মালবিকার পর মালবিকা। আজকের মালবিকার পর আরও কোনও মালবিকা আসবে কি তার জীবনে? সে জানে না। প্রথম মালবিকার সঙ্গে সে গহ্বরে নেমেছিল। আজ অতলে যাবে। সেই অতলকে সে এখন দারুণ ভাবে কামনা করছে। আলো-ছায়া পেরিয়ে, যানবাহন টপকে, সে মালবিকার সঙ্গে সঙ্গে পোঁছচ্ছে এক সরু গলির ভেতরকার পুরনো বাড়ির একতলায়। এ বাড়ির অবস্থা তাদের বাড়ির চেয়েও খারাপ। পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। ইটের গায়েও লেগে গিয়েছে ক্ষয়। জানালা কজা থেকে ছুটে কাত হয়ে আছে। ভারী কাঠের ভার আর বইতে পারছে না পুরনো লোহার জংধরা টুকরো।
প্রবেশপথে টিমটিমে বাতি। দরজায় জানালার মতোই ভারী, কাঠের পুরনো পাল্লা। সেই দরজার আবেদন এত গম্ভীর যেন ভীমপ্রতিন্দ্রায় প্রবেশ ও প্রস্থান সম্পর্কে রক্ষণশীল।
মালবিকা দরজায় আলতো টোকা মারে আর দরজা খুলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন দ্রুত পায়ে চলে যায়। শুভদীপ দেখতে পায় কেবল এক অপস্রিয়মাণ প্রলম্বিত ছায়া। সে থমকে দাঁড়ায়।মালবিকা তার হাত ধরে একটি ঘরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। বন্ধ করে দেয় দরজা। বাতি জ্বালে এবং শুভদীপ কিছু বোঝার আগেই এক টানে কামিজ অপসারিত করে। শুভদীপের দু’হাতে নিজেকে জড়িয়ে পিঠের দিকে নিতে নিতে অন্তর্বাস খুলে দেবার তাগিদ দেয়। শুভদীপের গলা শুকিয়ে কাঠ। সে কোনওক্রমে, কেবল বলতে পারে, তার জল চাই। সবার আগে এক গেলাস বিশুদ্ধ পানীয় জল।
টেবিলে জলভর্তি প্লাস্টিকের বোতল রাখা ছিল। বাঁ হাতে এগিয়ে দেয় মালবিকা। ডান হাত পেতে দেয় প্রাপ্য অর্থের জন্য।