২
রাত দশটা। জসু ঘুমিয়ে পড়েছে। সদর দরজা লাগাতে ভুলে গেছে। দরজা খোলা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। ‘বৃষ্টিকণিকা নিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসের আগমন’ এই বাক্যটা মিসির আলির মাথায় ঘুরছে। মাঝে মাঝে গানের কলি মাথায় ঢুকে যায়। সারাক্ষণ বাজতে থাকে। এই বাক্যটাও সেরকম। মিসির আলি বাক্যটা মাথা থেকে দূর করতে চাচ্ছেন। অ্যান্টিমেটারের জগৎ নিয়ে লেখা বইটা পড়বেন। মাথা ঠাণ্ডা রাখা প্রয়োজন। কোনো একটা বাক্য মাথার ভেতর ঘুরলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে কীভাবে?
মিসির আলি সাহেব, জেগে আছেন?
মল্লিক সাহেবের গলা। মিসির আলি বললেন, জেগে আছি।
আপনার দরজা খোলা। আমি ভাবলাম দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনি আজিব আদমি। আপনার পক্ষে সবই সম্ভব।
মল্লিক সাহেব! ভেতরে আসুন।
ভেতরে আসব না। দরজা বন্ধ করুন, আমি চলে যাব। দরজা খোলা রেখে ঘুমানো ঠিক না। চোর এসে সাফা করে দিয়ে যাবে। ভালো কথা, আপনার কাজের ছেলে জসু কি জেগে আছে?
জি-না। কেন বলুন তো?
একা ভয় ভয় লাগছে। সে জেগে থাকলে তাকে নিয়ে যেতাম।
বলতে বলতে মল্লিক সাহেব ঘরে ঢুকলেন। মিসির আলির বিছানার পাশে রাখা কাঠের চেয়ারে বসলেন।
মিসির আলি বললেন, চা খাবেন? একটু চা করি।
চা খাওয়া যায়।
মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন। মল্লিক সাহেব বললেন, আপনি কেন যাচ্ছেন? জসুকে পাঠান।
বেচারা আরাম করে ঘুমাচ্ছে।
মুনিবের প্রয়োজন আগে, তারপর নফরের ঘুম। পাছায় লাথি দিয়ে এর ঘুম ভাঙান।
মিসির আলি কিছু না বলে রান্নাঘরে ঢুকলেন। একবার ভাবলেন বলেন, মুনিব – নফরের বিষয়টা ঠিক না। অল্পদিনের জন্য আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি। এখানে আমরা সবাই নফর। মুনিব কেউ না। যদিও রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর ধারণা, আমরা সবাই রাজা। কিছুই বলা হল না। উচ্চমার্গের কথা মল্লিক সাহেবের সঙ্গে বলা অর্থহীন। মল্লিক সাহেবের অবস্থান নিম্নমার্গে।
মল্লিক সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, চা ভালো বানিয়েছেন। বাংলাদেশ চায়ের দেশ। এখানে কেউ চা বানাতে পারে না। সবাই বানায় পিশাব। দিনে আট- দশ কাপ পিশাব খাই।
আপনার নাতির খবর কী?
কোন নাতি? নাতি তো একটা না, এক হালি।
আমি তো জানতাম দুই ভাইয়ের দুই ছেলে।
ভুল জানতেন। এরা দুই ছেলে কোলে নিয়ে ঘুরে, মেয়ে দুইটা ঘরে থাকে। এখন বলেন কোনটার কথা জানতে চান?
যার নিউমোনিয়া হয়েছিল।
ও আচ্ছা, কিসমতের কথা জানতে চান? আমি কোনো খবর জানি না। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর আর খোঁজ নেই নাই।
ওরা টেলিফোন করে নাই?
আমাকে কি টেলিফোন করার সাহস এদের আছে? আমার গলার শব্দ শুনলে পিশাব করে দেয়, এমন অবস্থা
বলেন কী?
এইটা আমরা বংশপরম্পরায় পেয়েছি। আমার বাবার খড়মের শব্দ শুনলেও আমি দৌড়ে পালাতাম। দুই একবার প্যান্টে ‘ইয়েও’ করেছি।
মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে দুটা মনে হয় সেরকম হবে না। তারা সারাক্ষণই বাচ্চাদের কোলে নিয়ে থাকে।
এই দুই গাধার কথা তুলবেন না। এদের নাম শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায়।
মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে দুটার নাম কি আপনার দেওয়া?
আর কে দেবে? নাম ভালো দিয়েছি না? একজন ছক্কা আরেকজন বক্কা। ছক্কা বড়, বক্কা ছোট।
মিসির আলি বললেন, নাম দেওয়া থেকেই বোঝা যায় আপনার ছেলে দু’জনের জন্য মমতা নাই।
মল্লিক সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, ওদেরও নাই। নাই-এ নাই-এ কাটাকাটি। আরেক কাপ চা খাব, যদি আপনার তকলিফ না হয়।
আমার তকলিফ হবে না। আপনি আরাম করে চা খাচ্ছেন দেখে ভালো লাগছে।
মল্লিক সাহেব বললেন, আপনার বসার ঘরের সোফায় আমি যদি শুয়ে থাকি তা হলে সমস্যা হবে?
মিসির আলি বললেন, কোনো সমস্যা হবে না। তবে ভাই, আমার বসার ঘরে সোফা নাই।
সোফা আমি আনায়ে নিব।
মিসির আলি এখন বুঝতে পারছেন, মল্লিক সাহেব তাঁর এখানে থাকতে এসেছেন। ‘সদর দরজা খোলা’ এই সাবধান বাণী ঘরে ঢোকার অজুহাত।
মল্লিক সাহেবের তাঁর ঘরে রাত্রিযাপনের বিষয়টা মিসির আলির কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। একা ঘুমাতে ভয় পাচ্ছেন, তা ঠিক আছে। খালি বাড়িতে অনেকেই একা ঘুমাতে ভয় পায়। কিন্তু মল্লিক সাহেবের বাড়ি খালি না। পরিবারের লোকজন চলে গেলেও অনেকেই এখনো আছে। বাড়ির দারোয়ান আছে, কাজের লোক আছে।
দ্বিতীয় কাপ চা মল্লিক সাহেব আগের মতোই তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। এর মধ্যে তাঁর লোকজন বসার ঘরে সোফা নিয়ে এসেছে। বালিশ চাদর এনেছে। মল্লিক সাহেব সব ব্যবস্থা করেই এসেছেন।
মিসির আলি বললেন, আপনি কি বিশেষ কোনো কারণে বাড়িতে একা থাকতে ভয় পাচ্ছেন?
মল্লিক সাহেব হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
কারণটা বলতে চাইলে বলতে পারেন।
বলতে চাই না।
তা হলে চা শেষ করে শুয়ে পড়ুন। আপনার সকাল সকাল ঘুমানোর অভ্যাস। সবদিন সকাল সকাল ঘুমাই না। মাঝে মাঝে রাত জাগি। সারা রাতই জেগে থাকি।
আজ কি সারা রাত জাগবেন?
হুঁ। আপনি ঘুমায়ে পড়েন।
মিসির আলি বললেন, সময় কাটানোর জন্য আপনাকে বই দেব?
গল্প-উপন্যাস আমি পড়ি না। বানানো কিচ্ছাকাহিনী। কথায় কথায় প্রেম। গল্প— উপন্যাস পড়লে মনে হয় দেশে প্রেমের হাট বসে গেছে। স্কুলে প্রেম, কলেজে প্রেম, ইউনিভার্সিটিতে প্রেম, অফিসে প্রেম, আদালতে প্রেম। ফালতু বাত।
মিসির আলি বললেন, প্রেম ছাড়াও আমার কাছে বিজ্ঞানের কিছু সহজ বই আছে।
মল্লিক সাহেব বললেন, বিজ্ঞান তো আরো ফালতু। আমাকে বইপত্র কিছু দিতে হবে না। আপনি আপনার মতো ঘুমান। আপনাকে শুধু একটা কথা বলে রাখি, ছক্কা- বক্কা এই দুইয়ে মিলে আমাকে খুন করবে। যদি খুন হই পুলিশের কাছে এদের নামে মামলা দিবেন।
মিসির আলি বললেন, পুলিশ আমার কথায় তাদের আসামি করবে না।
টাকা খাওয়ালেই করবে। টাকা খাওয়াবেন। আমি চাই ছক্কা-বক্কা দুইটাই যেন ফাঁসিতে ঝুলে।
আপনি যে কোনো কারণেই হোক উত্তেজিত হয়েছেন। ঘুমিয়ে পড়ুন। ভালো ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এই দুই ভাই সাক্ষাৎ শয়তান। বুঝার উপায় নাই। নিজের মাকে মেরেছে। ধাক্কা দিয়ে কুয়াতে ফেলে মেরেছে। প্রথমে বুঝতে পারি নাই। মামলা মোকদ্দমা হয় নাই। কীভাবে হবে বলেন! দুই ভাই কেঁদে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলেছিল। কিছুক্ষণ পরপর ফিট মারে। উপায়ান্তর না দেখে দুইজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম, তখন তো জানি না দুই ভাই মিলে এই কীর্তি করেছে।
যখন জানলেন তখন পুলিশের কাছে গেলেন না কেন?
ছয় বছর পর জেনেছি। ছয় বছর আগের ঘটনা পুলিশ মুখের কথায় বিশ্বাস করবে কেন? তারপরও বলেছি। রমনা থানার ওসি বাড়িতে এসেছেন। দুই ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুই ভাই চিৎকার করে এমন কান্না শুরু করল, বাড়িতে কাজ- কাম থেমে গেল। কাঁদতে কাঁদতে দুই জনই ফিট। ওসি সাহেব তখন তাদের উল্টা সান্ত্বনা দেয়। বলে কী, তোমাদের বাবার বয়স হয়েছে। বয়সের কারণে মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা ঢুকে। তোমরা কিছু মনে নিয়ো না। আমাকে তিনি যখন বললেন তখনো বিশ্বাস করি নাই। ছেলের হাতে বাবা সম্পত্তির কারণে খুন হন। মা কখনো না।
মিসির আলি বললেন, আপনি কীভাবে জানলেন ছেলেরা মাকে খুন করেছে?
তাদের মা আমাকে বলেছে।
মৃত মা বলেছে?
জি। আমার একটা বিশেষ ক্ষমতার কথা আপনাকে বলা হয় নাই। আমি মাঝে মধ্যে মৃত মানুষ দেখতে পাই। তাদের সঙ্গে বাত-চিতও করি।
ও আচ্ছা।
আমার কথা মনে হয় এক ছটাকও বিশ্বাস করেন নাই।
মিসির আলি বললেন, শুরুতে আমি সবার কথাই বিশ্বাস করি। অবিশ্বাস পরের ব্যাপার।
মৃত মানুষদের সঙ্গে যে আমার কথাবার্তা হয়, এটা বিশ্বাস করেছেন?
জি বিশ্বাস করছি। এটা এক ধরনের ডিলিউশন।
ডিলিউশন জিনিসটা কী?
ভ্রান্ত ধারণা। যে ধারণার শিকার সে মানসিক রোগী। আমরা সাইকোলজিস্টেরা মনে করি তার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।
মল্লিক সাহেব ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, আমার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন?
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।
মল্লিক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি, এখন চলে যাব। দরজা বন্ধ করে দেন, আমি নিজের বাড়িতে থাকব।
আমার এখানে থাকবেন না?
না।
জসুকে কি তুলে দিব? আপনার সঙ্গে ঘুমাবে?
প্রয়োজন নাই। নবাবের বাচ্চা ঘুমাইতেছে ঘুমাক।
আপনি মনে হয় আমার ওপর রাগ করেই চলে যাচ্ছেন।
কিছুটা রাগ করেছি। এখন বিশ্বাস পরে অবিশ্বাস, এটা কেমন কথা? আমার দুই পুত্র যে আমাকে নিয়ে নানান কথা ছড়ায়, এটা নিশ্চয় জানেন?
জানি না।
আপনাকে কখনো কিছু বলে নাই?
জি-না। তাদের সঙ্গে আমার কখনো কথাবার্তা হয় না। এদের দূর থেকে দেখি।
এরা আমার বিষয়ে ছড়ায়েছে যে, আমাকে নাকি দুটা করে দেখে।
মিসির আলি বললেন, দুটা মানে বুঝলাম না।
মল্লিক বললেন, দুইজন আমি আমার ঘরে বসে আছি এই রকম। সত্য কখনো কেউ বিশ্বাস করে না। অসত্য কথা, ভুল কথা, বানোয়াট কথা সবাই বিশ্বাস করে। এই দুই কুপুত্রের কারণে সবাই বিশ্বাস করে দুইজন মল্লিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ও আচ্ছা।
এত বড় একটা কথা বললাম, আপনি ‘ও আচ্ছা’ বলে ছেড়ে দিলেন? আপনি কি আমার দুই কুপুত্রের কথা বিশ্বাস করেছেন?
না।
মল্লিক সাহেব বললেন, সব কথাই আপনি প্রথমে বিশ্বাস করেন, এই কথাটা কেন করলেন না?
মিসির আলি বললেন, বিশ্বাস করি নি, কারণ আমি দুইজন মল্লিককে দেখছি না। তা ছাড়া আপনার দুই পুত্রের কেউ আমাকে এ ধরনের কথা বলে নি।
তারা যদি বলত, আপনি বিশ্বাস করতেন?
প্রথমে অবশ্যই বিশ্বাস করতাম। তারপর চিন্তা-বিশ্লেষণে যেতাম। অ্যারিস্টটল একবার বললেন, মানুষের মস্তিষ্ক রক্ত পাম্প করার যন্ত্র। এক শ বছর মানুষ তা-ই বিশ্বাস করেছে। এক শ বছর পর অবিশ্বাস এসেছে।
অ্যারিস্টটল লোকটা কে?
একজন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী।
দার্শনিক, বিজ্ঞানী সবই ফালতু।
আপনার কাছে মনে হতে পারে।
মল্লিক সাহেব হঠাৎ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য ঝিম ধরে গেলেন।
মিসির আলি বললেন, একটা সিগারেট কি খাবেন?
মল্লিক সাহেব বললেন, না। নিজের ঘরে গিয়ে আরাম করে সিগারেট খাব। আপনার এখানে না। আপনাকে শেষ কথা বলি—আমি কিন্তু সত্যি মৃত মানুষ দেখতে পাই। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলি। আপনার ঘরেও একজন মৃত পুরুষ দেখি। হাবে-ভাবে মনে হয় সে আপনার পিতা।
ও আচ্ছা।
মল্লিক সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, এত বড় একটা কথা বললাম, আর আপনি ‘ও আচ্ছা’ বলে ছেড়ে দিলেন? আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসাই ভুল হয়েছে।
মল্লিক সাহেব ঘর থেকে বের হলেন। তিনি ছাতা নিয়ে এসেছিলেন, যাওয়ার সময় ছাতা ছাড়াই বৃষ্টিতে নেমে গেলেন।
মল্লিক সাহেবের আর কোনো খোঁজ-খবর পরের এক মাসে পাওয়া গেল না। জলজ্যান্ত একজন মানুষ পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছক্কা-বক্কা দুই ভাই পরিবার নিয়ে ফাঁকা বাড়িতে ফিরে এল। আবার তাদের দু’জনকে ছেলে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেল। বাবার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, এতে তাদের দুঃখিত বা চিন্তিত মনে হল না। মল্লিক পরিবারের সব কর্মকাণ্ড আগের মতোই চলতে লাগল। বক্কার ছোট ছেলের আকিকার অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হল। আকিকা হল। জসুকে আকিকার মাংস দেওয়া হল।
বক্কার ছোট ছেলের নাম রাখা হল, ‘সৈয়দ শাহ্ আমিনুর রহমান বখতিয়ার খিলজি’।
ওজনদার নাম রাখতে পারার আনন্দে বক্কাকে অভিভূত বলে মনে হল।