ক.
আমার জন্মের আগে দুটো ছেলে জন্মেছিল মা’র। ছেলে জন্মেছিল বলে রক্ষে। তা নইলে বংশের বাতি কে জ্বালাতো! মেয়েরা তো আর বংশের বাতি জ্বালানোর জন্য নয়। মেয়েরা ঘরের শোভা বাড়ানোর জন্য, সংসারের কাজে মা’কে সাহায্য করার জন্য, ঘরদোর সাফ রেখে ঘরের পুরুষের মনোতুষ্টি করার জন্য।
দুটো ছেলে হবার পর বাবা বললেন এবার মেয়ে চাই। ব্যস মেয়ে হল। মেয়ে হল উল্টো। ঠ্যাং আগে, মাথা পরে।
মা’র আঁতুড় ঘর ছিল এঁদো গলির ভেতর খলসে মাছে ভরা পুকুর পাড়ে নানির চৌচালা ঘরের পাশে ছোট্ট একটি চালা ঘর, যে ঘর মা’র জন্য বরাদ্দ হয়েছিল পাঁচশ টাকা দেনমোহরে রজব আলীর সঙ্গে বিয়ের পর। রজব আলী মোক্তার বাড়িতে জায়গির থেকে ডাক্তারি পড়তেন, ঈদুল ওয়ারা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুর বাড়িতে উঠেছেন, কথা ছিল পাশ দিয়ে আলাদা বাড়িতে উঠে যাবেন। রজব আলীর পাশ হয়, চাকরি হয়, চালা ঘরেই দুই ছেলে হয়, রজব আলীর বউ পোয়াতি হন আবার, তবু চালা ঘর ছেড়ে কোথাও আর যাওয়া হয় না। পড়শিরা বলে ঈদুনের জামাই দেখি ঘরজামাই হইয়াই রইল। অপমানে মা’র মুখ বেগুনি হয়ে ওঠে। মা স্বামীকে ফাঁক পেলেই বলেন ডাক্তার হইছ, টেকা কামাই কর, বউ পোলাপান লইয়া আলদা থাকার জো নাই? আর কতদিন শ্বশুরের বাড়িত থাকবা? মাইনষে ভালা কয় না।
সরোজিনি ধাত্রী মা’র পেটের ওপর ত্যানা বিছিয়ে তার ওপর আংড়ার হাঁড়ি রেখে সারা পেট বোলান। মা ব্যথায় খামচে ধরেন ধাত্রীর হাত। মা’র হাতে পিয়াঁজের গন্ধ, নখের তলে হলুদ। খাচ্ছিলেন পাকঘরে বসে, খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ব্যথা ওঠে, থাল ঠেলে পিঁড়ি ডিঙিয়ে চলে এসেছেন শোবার ঘরে, বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে শুরু হয় কাতরানো। নানি তাঁর কাতরানো মেয়ের মাথায় বাতাস করতে করতে বলছিলেন সহ্য কর,সহ্য কর। মেয়ে মাইনষের সহ্যশক্তি না থাকলে চলে না। নানা হনহনিয়ে হেঁটে গেছেন সরোজিনি ধাত্রীকে ডেকে আনতে। তিন মাস আগেও সরোজিনি ধাত্রী এ বাড়ি এসেছেন, নানি যেদিন জন্ম দিলেন ফেলুর। নানি নিঃশব্দে বিয়োন। পাড়া পড়শি কেন, বাড়ির লোকও টের পায় না। ব্যথা উঠলে পাকঘরে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়েন। সরোজিনি ধাত্রী এসে চুলো থেকে মাটির হাঁড়িতে আংড়া তুলে পেটে আলতো করে বোলান। নানিকে আজকাল আর সরোজিনি ধাত্রীর বলতে হয় না সহ্য করেন মাসি। নানি নিজেই সহ্য করেন। দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকেন পাটিতে। ষোল বাচ্চার জন্ম দিয়ে বাচ্চা হওয়া তাঁর কাছে এখন ডাল ভাত। ডাল ভাত হলেও এই বয়সে বিয়োতে তাঁর আর ভাল লাগে না। নাতি নাতনি বড় হচ্ছে, সংসার লোক বাড়ছে কচুরিপানার মত। এ সময়, সধবা কন্যারা পোঁয়াতি হবে, ছেলের বউ পোয়াতি হবে, তা না, নিজে ফি বছর আঁতুড় ঘরে ঢুকছেন। সরোজিনি ধাত্রী মা’কে বলেন, আগুনের তাপটা লাগলে বেদনা কমে, বাইচ্চা নিচের দিকে নামে। আরও একটু সহ্য কর ঈদুন। এইতো হইয়া গেল।
বাবা বাড়ি ফিরে চামড়ার বাক্স খুলে ছুরি কাঁচি বের করেন। বাবার হাতেই মা’র দুটো ছেলে হয়েছে। এবার মেয়ে হবে, বাবা মেয়ে চেয়েছেন। সরোজিনি ধাত্রী হাত গুটিয়ে বসে থাকেন মা’র শিথানের কাছে। বাবা হাত ঢুকিয়ে দেন মা’র দু’উরু ফাঁক করে, ভেতরে। কলকল করে বেরিয়ে আসে ঘোলা পানি। সরোজিনি বলেন, এই তো জল ভাঙছে, আর দেরি নাই।
বাবা হাত ঠেলেন আরও ভেতরে, একেবারে থলের ভেতর। ঘাম জমে কপালে তাঁর। হাত কাঁপে। কাঁপা হাত বের করে কুয়োর পাড়ে যান। বালতি টেনে পানি তোলেন। হাত ধুয়ে ফেলেন পানিতে। নানি তাজ্জব, রজব আলী হাত ধোয় কেন অসময়ে।
বাবা বলেন, আম্মা, ঈদুনরে হাসপাতালে নিতে অইব। বাচ্চা বাড়িতে হইব না। নানি স্বর চেপে বলেন, এ কি কন! দুই বাচ্চা হইল বাড়িতে!
এই বাচ্চা পেটের মধ্যে উল্টা হইয়া বসা। অপারেশন ছাড়া বাচ্চা হওয়ানো সম্ভব না। হাসপাতালে না নিলে বিপদ। শার্টের হাতায় কপালের ঘাম বাবা মুছে বলেন।
পানি ভাঙার পর গলা কাটা গরুর মত চেঁচান মা, বাড়ির লোক জাগছে, পড়শি জাগছে, নানির তিন মাস বয়সী ছেলে ফেলু জাগছে।
কুয়োর পাড় থেকে আঁতুড় ঘরে ফিরে বাবা দেখেন পা একখানা বেরিয়ে এসেছে আগন্তুকের। হাসপাতালে নিতে নিতে যদি বাচ্চা পথেই মইরা যায়! সরোজিনি ধাত্রী বলেন, কপালে ভাঁজ ফেলে। শুনে বাবার কপালেও ভাঁজ পড়ে, সংক্রামক ভাঁজ। কালো বিচ্ছু ভুরুদুটো গায়ে গায়ে রেগে থাকে যমজ ভাইএর মত। কানে নল লাগিয়ে বাচ্চার হৃদপিন্ডের শব্দ শোনেন লাব ডা…ব লা..ব ডাব লা–ব ডা–ব লাব ডা—-ব লা—-ব ডাব লা——ব ডা——। ভিজে পিঠের সঙ্গে রেগে থাকে পরনের শাদা শার্ট। এনাটমির ডাক্তার তিনি, লিটন মেডিকেল ইস্কুলে হাড়গোড় পড়ান ছাত্রদের, লাশ কাটা ঘরে মরা মানুষ কেটে মাংসের শিরার-ধমনির- স্নায়ুর পথঘাট চেনান। ফরামালিনে ডুবিয়ে রাখা হৃদপিন্ড, যকৃত, জরায়ু ট্রেতে করে এনে যেন চা বিস্কুট, শেখান নাড়িনক্ষত্র। প্রসূতি আর ধাত্রীবিদ্যায় বাবা দক্ষ নন তেমন। কিন্তু ঝুঁকি তাঁকে নিতেই হবে, হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন তিনি। আবার ঢুকিয়ে দেন হাত, থরথর দ্বিধার আঙুল, ভেতর থেকে হাঁটু মোড়া পা খানি বের করে আনেন। দুটো পা ঝুলে থাকে বাইরে। এই আঁতুড় ঘরে, যেখানে একটি ছোট কাঁচি, দুটো ছুরি আর কিছু সুঁই সুতো ছাড়া অন্য কোনও যন্ত্র নেই, কি করে সম্ভব প্রসব করানো! বাবা তাঁর ঘামে ভেজা শার্ট খুলে রেখে উদ্বিগ্ন তাকিয়ে থাকেন বেরিয়ে থাকা পা দুটোর দিকে, আর মা’র ত্রাহি চিৎকারের দিকে, সরোজিনির গুটিয়ে রাখা হাতের দিকে। গলায় যদি নাভির নল পেঁচিয়ে থাকে, বাবা ভাবেন, শ্বাস বন্ধ হয়ে মরবে আগন্তুক। তিনি নিজের হৃদপিন্ডের শব্দ শোনেন ঢিপঢিপ, আগন্তুকের হৃদপিন্ডের খবর নিতে তাঁর সাহস হয় না। সরোজিনি ধাত্রী মা’র শিথান থেকে সরে পৈথানে বসে বলেন, পা দুইটা ধইরা টান দেন ডাকতার সাব। টানাটানি করলে আবার কি না কি কান্ড ঘটে! বইয়ে পড়েছেন, বাচ্চা হয় মাথায় আঘাত খেয়ে, নয় গলায় নাভির ফাঁস লেগে মরে। ঝুঁকি না নিয়ে অপরাশেন কর, ফরসেপ নয় সিজারিয়ান। দ্রুত তিনি আঁতুড় ঘর খেকে বেরিয়ে নানিকে ডেকে বলেন–রিক্সা আনতে পাঠান কাউরে, হাসপাতালে নিতে হইব।
আবার ঘরে ফিরে তিনি অস্থির হাঁটেন। ঘামে ভিজে হাতকাটা গেঞ্জি সপসপ করছে। মাথায় তাঁর বই পড়া বিদ্যে, তিনি জানেন পা দুটো ধরে সামনে টানলে বেরিয়ে আসবে পিঠ। তাই করেন, পিঠ বেরোতে শুরু করে।
নিচের দিকে চাপ দেও। মুখ বন্ধ কইরা শরীলের সমস্ত শক্তি দিয়া চাপ দেও।
বাবা দাঁত খিঁচে মা’কে বলেন। এবার আগন্তুকের গলা আটকে শরীর ঝুলে থাকে নিচে।
সরোজিনি বলেন, মেয়ে হইছে। আপনে মেয়ে চাইছিলেন, পাইছেন।
কিন্তু মেয়ের চাঁদমুখখানা তো আর জগতের আলো দেখে না। ডাক্তারি বিদ্যার ভাল ছাত্রের মাথায় গিজগিজ করা বিদ্যে। এনাটমির নামি শিক্ষক ঘরের বউএর ওপর তাঁর বিদ্যে খাটান। আগন্তুকের বুকের ওপর নল চেপে বেঁচে আছে কি না পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন, এখনও বেঁচে। দু’হাত ঢুকিয়ে মেয়ের মাথার দু’দিকে, আঙুল ঘি তোলে যেমন, তেমন করে ঢিলে করে সরাতে থাকেন গলায় পেঁচানো নাভি। সরোজিনি ধাত্রী মাকে বলেন–ভগবানের নাম লও ঈদুন।
দরজার ওপাশ থেকে নানি বলেন–আল্লাহরে ডাক। আল্লাহরে ডাক ঈদুন।
মা চিৎকার জুড়ে দেন ও আল্লাহ ও আল্লাহ বলে।
শেষ অবদি জগতে অবতরণ করি বটে, শ্বাসকষ্টে ভুগে, যায় যায় হৃদপিন্ড নিয়ে। আমার চিৎকারের তলে মা’র ও আল্লাহ, ও আল্লাহ ডাক ম্লান হয়ে যায়। গামলায় কুসুম গরম জলে আমাকে ভেজান সরোজিনি, গা সাফ করেন।
আঁতুড় ঘর থেকে ছোঁ মেরে আমাকে নিয়ে যান রুনু খালা। রুনু খালার হাত থেকে ঝুনু খালা, ঝুনু খালার হাত থেকে বড় মামা, বড় মামা বলেন–এ তো দেখি আস্ত একটা রাজকন্যা। এই বাড়িতে রাজকন্যা হইছে।
তখন সুবেহ সাদিক, আকাশ ফর্সা হচ্ছে। উঠোনে খুশির ধুম পড়ে যায়। দু’ছেলের পর এক মেয়ে। রাজকন্যার মুখ দেখতে ভিড় করেন হাশেম মামা, টুটু মামা, শরাফ মামা। ফজলি খালা রাজকন্যার মুখ দেখার আগে আতুঁড় ঘরে ঢুকে বলেন–বড়বু, কী ভাল দিনে তোমার মেয়ে জন্মেছে গো! বারোই রবিউল আওয়াল, নবীজি এ দিনে জন্মেছিলেন। এ মেয়ে খুব পরহেজগার হবে। তোমার কপাল ভাল বড়বু।
সকালে খাঁচা ভরে মিষ্টি কিনে আনেন নানা, আশে পাশের বাড়ি থেকে দল বেঁধে লোক আসে রবিউল আওয়াল মাসের বারো তারিখে জন্মানো মেয়ে দেখতে, রাজকন্যা দেখতে।
বড় হয়ে মা’র মুখে গপ্প শুনতে চাইলে মা গপ্প কিচ্ছা না বলে প্রায়ই বলতেন তরে পেডো লইয়া কলপারে পিছলা খাইয়া পইড়া গেছিলাম। ভিতরে লইড়া গেছিলি, উল্টা হইছস। গোল টেবিলটার উপরে তরে শোয়াইয়া রাখছিল, এত বড় যে গোল টেবিল, তার অর্ধেক হইলি তুই। এরম বড় বাচ্চা আর কেউ দেখে নাই। মা কইত বাচ্চারে কাপড় চোপড়ে মুইড়া রাখ, কপালে নজর ফোঁটা দে। মাইনষের চোখ লাগব। দুই দিনের বাচ্চা দেইখা সোহেলির মা চোখ কপালে তুইলা কয়, কয় মাসের বাচ্চা এইটা? মনুর মা তর গুল মাথাডা দেইখ্যা কইল, বেলেরও ত এট্টু এবাডেবা আছে, এর কিচ্ছু নাই।
শুয়ে থাকা মা’র পেটের ওপর থুতনি রেখে বলেছিলাম–বাচ্চা কেমনে হয় মা?
মা শাড়ি সরিয়ে এঁটেল কাদার মত নরম পেট দেখিয়ে বলেছেন–এইখানটায়, তুমার বাবা, ডাকতার তো, ব্লেড দিয়া কাইটা বাচ্চা বার করছে।
তলপেটের শাদা দাগগুলো, একটি একটি করে দেখিয়ে বলেন, এইটা হইল নোমান হওয়ার, এইটা কামালের, এইটা তোমার আর এইটা ইয়াসমিনের।
করুণ চোখে তাকিয়ে থাকি শাদা দাগের দিকে। আলতো আঙুল বুলোই। মা’র জন্য বড় মায়া হয় আমার। বলি–ইস, রক্ত বার হয় নাই?
মা হেসে আমার চিবুকে টোকা দিয়ে বললেন–তা হইছে। পরে সেলাই কইরা দিলে আবার ভালা হইয়া গেছি।
খানিক পর আমাকে টেনে বুকে শুইয়ে মা বললেন–আমি মইরা গেলে তুমি কানবা, মা?
আমি ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলাম–তুমি মরবা না। তুমি মইরা গেলে আমিও মইরা যাব।
মা তাঁর উল্টো-মেয়েকে কোলে নিয়ে আনাজপাতি কোটেন, চুলোয় খড়ি গোঁজেন, ধোঁয়ায় জল জমে চোখে তাঁর। কোলের মধ্যে শুয়ে মেয়ে তাঁর ঘুমোয়, আবার জেগে ওঠে হলুদের, মরিচের, পিঁয়াজের আর তার মা’র ঘামের গন্ধে, কাকের কুকুরের শব্দে। মা কলঘরে গোসলে গেলে উঠোনে হিসির ওপর, ধুলোর ওপর একা বসে মুখে পুরতে থাকে ইটের টুকরো, বালু, কড়ইপাতা। দাদারা ইস্কুল থেকে ফিরে কাঁখে নিয়ে উঠোনে হাঁটেন। ছ’মাসের মেয়েকে কুয়োর ওপর বসিয়ে হাফপ্যান্টের ফিতে বাঁধেন ছোটদা। খানিকটা হেললেই কুয়োর জলে ডুবে টুপ করে মরে যেতে পারে কিন্তু পড়ে না, যে মেয়ে অমন ঝুঁকি নিয়েও জন্মেছে সে কেন কুয়োর জলে মরবে! আদরে, আহলাদে, হেলায় ফেলায় বড় হতে থাকে রাজকন্যা।
হ্যাঁ রাজকন্যা বড় হতে থাকে। বড় হতে হতে বয়স যখন এগারো, মা সেলাই মেশিনে ঘড়ঘড় শব্দ তুলে আমাকে পাজামা বানিয়ে দিলেন দু’জোড়া, বললেন এখন থেকে আমার আর হাফপ্যান্ট পরা চলবে না।, আমি বড় হয়ে গেছি। উতল দুটো চোখ জানালার বাইরে পাঠিয়ে মন খারাপ করা দুপুরে মা আমাকে বলেন–তহন আমার মাথা খারাপ, সারাদিন কান্দি। তর বাপে রাজিয়া বেগমের প্রেমে পড়ছে। তার শার্ট ধুইতে গিয়া প্রায় দিনই বুক পকেটে চিঠি পাই, ওই বেটির লেখা। তুই খাটের ওপর থেইকা ধপাস ধপাস পড়স মাটিতে। মাথা ফাটে। তরে যত্ন করার মন নাই তহন আমার। কুনো কিছুতে মন বসাইতে পারি না। রাত কইরা বাড়ি ফিরে তর বাপ।
রাজিয়া বেগম দেখতে সুন্দরী, সুন্দরী মানে হচ্ছে, মা’র সংজ্ঞায়, গায়ের রং ফর্সা। রাজিয়া বেগমের ফর্সা মুখে গরুর চোখের মত কালো ডাগর চোখ, ঠোঁট কমলার কোয়ার মত ঝুলে থাকে, কোমর অবদি ঘন কালো চুল, খোঁপা করলে মনে হয় মাথায় ডালি নিয়েছেন, স্তনদু’খানা এত বড় যে মনে হয় বইতে কষ্ট হচ্ছে, সিন্ধি গাভিদেরও কষ্ট হয় বড় ওলান নিয়ে হাঁটতে। রাজিয়া বেগমকে কখনও না দেখে কেবল অনুমান করেই আমার মনে হয়েছিল যে দোয়ালে ঠিক দু’বালতি দুধ বের হবে ওর বুক থেকে। শরীর তো নয়, যেন ছোটখাট একটি পাহাড়। হাঁটলে মাটি কাঁপে। মা’র কালো রং, নারকেলের আর্চির মত এতটুকুন মাথায় ফিনফিনে চুল, ছোট ছোট চোখ, ভোঁতা নাক, ফড়িংএর ঠ্যাঙের মত টিঙটিঙে শরীর থেকে, মা ভাবেন, বাবার মন উঠেছে। মা হাতের কাছে যাকে পান তাকেই বলেন, সব্বনাশ হইছে, আমার সব্বনাশ হইছে। নোমানের বাপ তো এহন চাকলাদারের বউরে বিয়া করব। আমি পোলাপান নিয়া কই যাই!
মা’র সেই সব্বনাশের কালে, হেলা ফেলায় আমার মাথার গোল গেল ডেবে, বাসি দুধে, সাগুতে বার্লিতে, দাদার কণে আঙুল চুষে চুষে আমি যখন এগারো মাসে পড়ি, বাবা বদলি হলেন। যেন জাহান্নামের আগুনে পুড়ছিলেন, ফেরেসতা এসে জানালেন মা’কে জান্নাতুল ফেরদাউসে পাঠানো হবে, বদলির খবর শুনে মা’র তাই মনে হয়, ফূর্তিতে নাচেন মা। আলাদা একটি সংসারের স্বপ্ন মা’র বহুদিনের। দুর্মুখের মুখে ঝাঁটা মেরে, বাবার ঘরজামাই দুর্নাম ঘুচিয়ে, এঁদো গলির ভেতর খলসে মাছে ভরা পুকুর পাড়ের ছোট্ট ঘুপসি ঘর ফেলে, রাজিয়া বেগম নামের এক দুঃস্বপ্ন নর্দমায় ছুঁড়ে দূরের একটি শহরের দিকে রওনা হলেন মা।
জেলখানার ভেতর একটি চমৎকার বাড়ি জুটেছিল মা’র। কয়েদিরা জেলের ডাক্তারের বাড়িতে ফুট ফরমাশ খাটে সকাল বিকেল, মেয়ে কোলে নিয়ে বাগানে বেড়াতে বেরোয়, চোর ডাকাতের কোলে চড়েও মেয়ের গলার সোনার মালা গলাতেই থাকে। অবসরে মা চুল বাঁধেন, চোখে কাজল পরেন, মুখে পাউডার মাখেন, কুঁচি কেটে রঙিন শাড়ি পরেন। পাবনায় রাজিয়া বেগম নেই, বাবার রাতে রাতে বাড়ি ফেরা নেই, শার্টের পকেট থেকে টুপ করে কোনও প্রেমের চিঠি পড়া নেই। পড়শিদের সঙ্গে খাতির জমে ওঠে মা’র, বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে বেড়ান। সুখের চৌবাচ্চায় ডুবে থাকেন ডাক্তারের বউ। সুখ বেঁধে রাখেন চাবির সঙ্গে আঁচলের গিঁটে। তবুও বুকের খুব ভেতরে মা’র অসুখ জমে। সম্মোহের নিচে সংশয়, হর্ষের বাগানে হতাশা। স্বামী তাঁর অসম্ভব সুদর্শন পুরুষ, লাখে একজন, তায় ডাক্তার, আর নিজে তিনি সাত ক্লাস অবদি পড়া কালো কুচ্ছিত মেয়ে। তের বছর বয়সে ইস্কুল বন্ধ করে তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। বড় ছেলে যখন ইস্কুলে যায়, বায়না ধরলেন তিনিও যাবেন। বাবা তাঁকে হারকিউলাস সাইকেলে বসিয়ে ইস্কুলে দিয়ে আসতেন। আপত্তি তুললেন নানা, সাফ সাফ বলে দিলেন, ঘরে বইসা পুলপান মানুষ কর। স্বামীর যত্ন নেও। মাইয়া মানষের অত নেকাপড়া করার দরকার নাই। ব্যস, ইস্কুল বন্ধ করতে হল আবার। বাবা সাই সাই করে ওপরে ওঠেন, মা যে তিমিরে, সে তিমিরেই, সাত ক্লাসের জ্ঞানে, বুদ্ধিতে। বাবার মোটা মোটা ডাক্তারি বই মা খুলে খুলে দেখেন, ঝেড়ে মুছে গুছিয়ে রাখেন, বোঝেন স্বামীর তুলনায় অতি নগণ্য, অতি তুচ্ছ এক মানুষ তিনি। তাঁর আশংকা হয় বাবা তাঁকে হঠাৎ একদিন ছেড়ে কোথাও চলে যাবেন। আশংকার নীল মুখে মা শাদা পাউডার মাখেন, ছোট চোখজোড়া কাজলে কালো করে রাখেন যেন ডাগর লাগে দেখতে, যেন নিতান্ত কদাকার বলে কিছু না মনে হয় তাঁকে।
বছর পার হলে জান্নাতুল ফিরদাউসের পাট চুকোতে হয় মা’র। যেন চুল টেনে কেউ তাঁকে সুখের চৌবাচ্চা থেকে ওঠালো, আঁচলের গিঁট থেকে খুলে নিল স্বপ্নময় সংসার। রাজিয়া বেগম থেকে দূরে থেকে আলাদা সংসার করা মা’র আর হয়ে ওঠে না, বাবা আপিসে দরখাস্ত করে আবার চাকরির বদলি করিয়েছেন, ময়মনসিংহে। বাক্স পেটরা নিয়ে তাই রওনা হতে হয় পুরোনো শহরে, পুরোনো বাড়িতে। আচমকা ধুলোঝড় এসে উড়িয়ে নেয় একটি তুচ্ছ ক্ষুদ্র মেয়ের নিভৃত স্বপ্ন। এবার আর নানির বাড়িতে মাগনা থাকা নয়, এক চুলোয় রান্না হওয়া নয়, আলাদা উঠোন, আলাদা চুলো। সবচেয়ে পুবের উঠোনে বাবা নগদ টাকা দিয়ে নানির কাছ থেকে দুটো ঘর কিনে নিলেন। মা, বাবাকে ঘরজামাই বলে কেউ ডাকবে না জেনেও খুশিতে উচ্ছল হন না। যেন তিনি সত্যিকার জেলখানায় ঢুকেছেন ফিরে এসে। পাবনার জেলকেই তাঁর মনে হয়েছিল খোলা একটি জগত। বাড়িতে পা দিয়ে হু হু করে কেঁদেছিলেন মা। মামা খালারা ভেবেছেন এ আনন্দাশ্রু। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে, নানা হাঁফ ছেড়েছেন। রুনু আর ঝুনু খালার শুরু হল আমাকে নিয়ে লোফালুফি খেলা। আমি হাঁটছি কথা বলছি দৌড়োচ্ছি–এ যেন অদ্ভুত মজার ব্যাপার। যেন আমার ফিরে আসার কথা ছিল, যেমন গিয়েছিলাম তেমন। বাবা শহরে পা দিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন, মা’র একাকিত্ব বাবার পক্ষে অনুমান করা শক্ত। তাঁর সম্ভবত সময়ও নেই। তিনি মেডিকেল কলেজে ছাত্র পড়ানোর চাকরি শেষ করে বিকেলে তাজ ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকানের ভেতরে ছোট্ট একটি কোঠায় বসে রাত নটা অবদি রোগী দেখেন। ডাক্তার লেখা পর্দা সরিয়ে কোঠায় ঢুকতে হয়। ছ’বছর বয়সে আমাকে বেশ অনেকদিন যেতে হয়েছে বাবার ফার্মেসিতে, পেটে ইনজেকশন নিতে। ইস্কুল থেকে ফিরে বাঘা কুকুরটি আমাদের উঠোনে শুয়ে আছে দেখে আধলা ইট তুলে কুকুরটিকে ছুঁড়েছিলাম। বাঘাটি এমন চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে যেন ছিঁড়ে খাবে, সারা গা ঘাএ ভরা, লোম ওঠা, পাড়ার ছেলেরা কুকুরটিকে দেখলেই ঢিল ছোঁড়ে, তাই আমিও সেদিন। ঢিল ছুঁড়ে হাতের ধুলো ঝেড়ে যেই না সিঁড়িতে পা দেব, বাঘা উড়ে এসে আমার উরু কামড়ে ধরে। ধার-দাঁতে ছিঁড়ে নেয় শাদা মাংস। কুকুরের কামড় খাওয়া আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাবার ডাক্তারখানায়। প্রথমদিন দু’হাতে দুটো আর নাভির কিনারে একটি ইনজেকশন দিয়ে দেন বাবা, এরপর প্রতিদিন একটি করে চৌদ্দটি। ইনজেকশন দেওয়ার পর বাবা আমাকে শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে রসগোল্লা কিনে খাওয়াতেন। চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে পিরিচ থেকে রসগোল্লা চামচে তুলে খেতাম। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় রিক্সায় চড়ে বাবার কাছে যাওয়ায় আমার বিষম আনন্দ হত। সুইঁ ফোঁড়ানোর ব্যথাও মনে হত নিতান্ত পিঁপড়ের কামড়। স্বদেশী বাজারে ওষুধের গন্ধঅলা দোকানটিতে বসে বাবার অপেক্ষায় রোগিদের বসে থাকা দেখতাম, বাবাকে দেখতাম রোগির নাড়ি টিপতে, রোগীকে শুইয়ে কানে নল লাগিয়ে রোগির বুক পেট পরীক্ষা করতে, কাগজে খচখচ করে ওষুধ লিখতে। বাবার অন্য এক রূপ আমার দেখা হয় তখন, রাতে ঘরে ফেরা ক্লান্ত বিরক্ত অস্পষ্ট অচেনা মানুষ নন তিনি আর। বাবাকে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তাঁকে ভালবাসা আমাদের কারও জন্য সহজ ছিল না।
বাবা হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসেন খোলস ছেড়ে। আলাদা বাড়িতে সংসার সাজানোর জিনিসপত্র কিনে গুছিয়ে বসার পর মা’কে বললেন কী এখন খুশি হইছ ত? এখন ত আর তুমার জামাইরে কেউ ঘরজামাই কইত না।
মা সস্তা লিপস্টিক মাখা ঠোঁটজোড়া ফুলিয়ে রঙিন কাচের চুড়িতে রিনিঝিনি শব্দ তুলে বলেন–হ, কইত না। তাতে আমার কি! আমারে ত কইবই কালা পচা। লেখাপড়া নাই। বিদ্যাবুদ্ধি নাই।
— তুমি হইলা তিনজনের মা। মায়ের দায়িত্ব ছেলেমেয়ে মানুষ করা। এদেরে ভাল কইরা লেখাপড়া করাও, এতেই শান্তি পাইবা। তুমি কালাপচা হইলেও বিয়া ত আমি তুমারে করছি, করি নাই? মা’র খোলা কোমর আঙুলে টিপে টিপে বাবা বলেন।
বাবার কথায় আর আদরে মা’র মন ভরে না। মা’র আবারও ভয় হতে থাকে রাজিয়া বেগম এই বুঝি বাবার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন। বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় রাত জেগে বসে থাকেন মা। বাইরে ঝিঁ ঝি ডাকে। কুকুর কাঁদে। রাত বাড়তে থাকে হু হু করে। দরজায় কড়া নড়ার শব্দ আবার নিজের শ্বাসের শব্দে হারিয়ে যাবে ভয়ে তিনি শ্বাস আটকে রাখেন। এক অমাবস্যার রাতে বাবা ফেরেন না, দু’উঠোন পেরিয়ে এসে নানিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মা বলেন–ও মা, নোমানের বাবা ত এহনও ফিরতাছে না। এগারোডা বাইজা গেছে। না জানি কই গেল। না জানি ওই বেডির বাসাত রাইত কাটাইতাছে।
নানি ধমকে থামান মা’কে–যা ঘুমা গা। জামাইএর লাইগা ত কাইন্দা মরলি। নিজের স্বার্থডা দেখ। নিজের কথা ভাব। কানলে তর লাভ কি! তুই কি কাইন্দা বেডাইনরে ফিরাইতে পারবি?
মা’র মনে পড়ে নানি কী মরা কান্না কেঁদেছিলেন যেদিন এক মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে নানা বাড়ি এলেন। দিব্যি বউএর সঙ্গে বিছানা পেতে শুতে শুরু করলেন, আর নানি পাশের বিছানায় শুয়ে সারারাত না ঘুমিয়ে কেঁদে বালিশ ভেজাতেন। মা জিজ্ঞেস করেছিলেন এত কান্দো ক্যান মা? নানি বলেছিলেন বড় হ, বুঝবি। বুঝবি বেডাইনরে কুনো বিশ্বাস নাই। এগোর জাতটা বড় খারাপ।
সে রাতে বাবা বাড়ি ফেরেন রাত দুটোয়। মা জেগেই ছিলেন। বাবা বললেন এক রোগির বাড়িতে দেরি হইয়া গেল। রোগীর শ্বাস যায় যায় অবস্থা। তারে নিয়া আবার হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি।
পরের রাতও ঘন হতে থাকে। বাবা বাড়ি ফেরেন না। মা ছোটদাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন চল। যেমনে আছস, চল।
ছোটদার হাত ধরে টর্চ জ্বেলে অন্ধকার পুকুরঘাটের দিকে হনহন করে হাঁটেন মা। বড় রাস্তায় একটি রিক্সা জোটে, সেটি করেই পনেরো নম্বর পচা পুকুর পাড়ের বাড়িতে মাঝরাতে এসে থামেন। এক বুড়ো, খালি গা, লুঙ্গি পরা, বারান্দার চেয়ারে বসে হাওয়া খাচ্ছিলেন বাইরের, খনখনে গলায় বললেন–এত রাইতে কেডা?
— এইডা কি চাকলাদারের বাড়ি? মা জিজ্ঞেস করেন।
— আমিই চাকলাদার। আপনে কেডা? খনখনে গলা আবারও।
মা বারান্দায় উঠে এসে বলেন–ভাইসাব, আপনের বাড়িতে কি আমার স্বামী আইছে? ডাক্তার রজব আলী?
চাকলাদারের বুকের বেরিয়ে হয়ে থাকা হাড়গুলো নড়ে। তিনি দরজা আগলে বলেন — না আসে নাই।
চাকলাদারের কঙ্কাল এক ধাক্কায় সরিয়ে ভেতরে ঢোকেন মা। বসার ঘর পেরোলেই শোবার। ঘরের বাতি নেবানো, জানালা গলে আসা ল্যাম্পোস্টের আবছা আলোয় দেখেন বিছানায় মশারি টাঙানো। মশারি তুলে মা টর্চ জ্বাললেন হাতের। শুয়ে আছেন বাবা, সঙ্গে রাজিয়া বেগম। রাজিয়া বেগমের বুকের জাম্বুরা দুটো খোলা। বাবা ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠেন। কোনও কথা না বলে দ্রুত কাপড় চোপড় পরলেন, জুতো পরলেন। মা বললেন–চল।
মা আর ছোটদার পেছন পেছন হেঁটে বাবা রিক্সায় উঠলেন। কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা বলেননি সারা পথ। সারা পথ রিক্সায় মা’র কোলে বসে ছোটদা কেবল হাতের টর্চটিকে একবার জ্বালাতে লাগলেন, একবার নেবাতে।
বাড়িতে আমি তখন ঘুম থেকে জেগে মা মা করে কাঁদছি। কান্না থামাতে দাদা তাঁর বাঁ হাতের কণে আঙুল ঢুকিয়ে রাখেন আমার মুখে, সেটি চুষতে চুষতে আমার কান্না থামে। ছোটদার হাতে তখনও টর্চ, জ্বলছে নিবছে।
খ.
নান্দাইল থানার পাঁচরুখি বাজারের দক্ষিণে মাদারিনগর নামের অজপাঁড়াগাঁয়ে জনাব আলী কৃষকের ঘরে বাবার জন্ম। কৃষকের কিছু ধানি জমি ছিল, কিছু গরু ছিল। আমার কৃষক বড়দাদা, খাটুরে জোয়ান, বলদ জুড়ে ক্ষেতে লাঙল দিতেন, বাবাকে সঙ্গে যেতে হত ফুট ফরমাশ খাটতে, বাবাও লাঙল দেবেন, কৃষকের ছেলে কৃষক হবেন, ক্ষেতে বীজ ছড়াবেন, বীজ থেকে চারা হবে, চারা বড় হয়ে ধান হবে, ধান পাকবে, ধান কেটে গোলায় তুলবেন কিন্তু এক রাতে বাড়ির দাওয়ায় হুঁকো টানতে টানতে জাফর আলী সরকার, বড়দাদারও বাবা, বলেন–ও জনাব আলী, ছেড়ারে পাঠশালায় দেও।
পাঠশালায় দিতাম কেরে, বাড়িত কাম নাই! খাটুরে জোয়ান গামছায় পিঠের মশা তাড়াতে তাড়াতে বলেন।
পাঠশালায় গেলে বিদ্বান অইব। দশটা লুকের খাতির পাইব। লেকাপড়া শিইখা চাকরিবাকরি করব। দেহ না, খুশির বাপ লেহাপড়া করছে, শহরে চাকরি করে, গেরামের বেবাক জমি কিইনা লইতাছে। জাফর আলী সরকার, মাদারিনগর পাঠশালার মাস্টার, ছেলের কাছে নরম স্বরে কথাটি পাড়েন।
— আছিলাম বর্গা চাষী। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুড়াইত। দিন রাইত খাইটা আইজ নিজের কিছু জমি করছি। রজব আলী কাইম কাজ শিখতাছে। এই তো আর কয়দিন পরে নিজেই লাঙল ধরব। বাপ বেটায় মিইলা কাম করলে আরও কিছু জমি কিনন যাইব। জনাব আলী ছাউনি খসে পড়া গোয়াল ঘরের দিকে চেয়ে বলেন।
— জনাব আলী, দিন বদলাইতাছে। গেরামের শশীকান্ত, রজনীকান্ত, নীরদ, জোতির্ময় কইলকাতা গেল লেকাপড়া করতে। লেকাপড়া জানা মানুষরে লুকে মান্য গইন্য করে। ছেড়া তুমার লেকাপড়া জানলে লুকে তুমারেও মান্য করব। রজব আলী পাঠশালা থেইকা দুফুরে ফিইরা গরু চড়াইল, ফুট ফরমাইস খাটল।ওরে তো আর কইলকাতা দিতাছ না।
জাফর আলী হুঁকো দিয়ে জনাব আলীর হাতে, পিঠে হাত বোলান ছেলের — জনাব আলী, দুইডা দিন চিন্তা কর।
ফকফকে জ্যোৎস্না উঠোনে। রজব আলী গরুর গামলায় নুন পানি ঢালেন আর আড়ে আড়ে দেখেন বাপ দাদাকে। খুশিতে মন নাচে তাঁর।
জাফর আলী হাঁক ছাড়েন–কইরে, রজব আলী কই!
রজব আলী দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ান, নুন মাথা হাত লুঙ্গিতে মুছে।
–কি রে, পাঠশালায় পড়বি?
সজোরে মাথা নেড়ে রজব আলী বলেন–হ।
জনাব আলীর হুঁকো টানার শব্দ হয়, ফরৎ ফরৎ।
পাঁচরুখি বাজার থেকে শাদা জামা, নতুন একখানা ধুতি, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় কিনে আনেন জাফর আলী নাতির জন্য। নাতি পরদিন সকালে পেট ভরে পান্তা খেয়ে, গাভির দুধ দুইয়ে, খড় কেটে গামলায় ভরে, পুকুরে নেয়ে এসে নতুন ধুতি জামা পরে হাতে কলাপাতা আর বাঁশের কলম নিয়ে ক্ষেতের আল বেয়ে খালি পায়ে পাঠশালায় যান। মাস্টার বলেন একে এক এক, ছাত্ররা তারস্বরে বলে একে একে এক। দুইয়ে একে দুই, তিনে একে তিন। রাতে চাটাই পেতে বসে বর্ণপরিচয় বইয়ের পাতা ওল্টান রজব আলী, তাঁর একদমে পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে পুরো বই। কাঠাঁল পাতার ওপর সর্ষের তেল ঢেলে কুপির ওপর ধরে রাখেন, কুপির কালো ধোঁয়া বেরিয়ে তেল জমাট করে, সেই জমাট তেলকালি পানিতে গুলে রজব আলী কালি বানান, বাঁশের কলম ওই কালিতে ডুবিয়ে কলাপাতায় অ আ লেখেন। পরদিন কখন সকাল হবে, কখন আবার পাঠশালায় যাবেন, এই উত্তেজনায় তিনি ছটফট করেন। জনাব আলী ধমক লাগান–কুপি নিভা রজব আলী, তেল খরচা অইব।
মাসিক পাঁচ টাকা বেতনের মাস্টারি জাফর আলীর। পাচরুখি বাজার থেকে এক শিশি কেরোসিন তেল কিনে বাজারের তাবৎ লোককে বলে আসেন, নাতিরে পাঠশালায় দিলাম, নাতি লেকাপড়া করে রাইতে, কুপ্পিতে বাড়তি তেল লাগে। রজব আলী দেখবা বড় হইয়া ইংরেজের অপিসে কেরানি হইব।
জাফর আলীর আশকারায় রজব আলীর পড়া দ্রুত এগোয়, চাটাইয়ের ওপর পা ছড়িয়ে বসে রজব আলী বর্ণপরিচয় শেষ করে বাল্যশিক্ষা পড়েন, গোপাল বড় সুবোধ ছেলে, তাহাকে যাহা দেওয়া যায়, সে তাহাই খায়। জাফর আলী উঠোনে বসে হুঁকো টানেন আর নাতির পড়ার শব্দ শোনেন। তাঁর ইচ্ছে করে পাঠশালা শেষ করিয়ে রজব আলীকে চন্ডিপাশা ইস্কুলে পড়াতে।
তিন মাইল হেঁটে রজব আলী চন্ডিপাশা ইস্কুলেও যান। ইস্কুলে কালিচরণ, বলরাম, নিশিকান্তকে ছাড়িয়ে যান। মেট্রিকের ফল হাতে দিয়ে পন্ডিতমশাই বলেন রজব আলী, লেখাপড়া চালাইয়া যা, ছাড়িস না।
রজব আলী লেখাপড়া ছাড়েননি। শহরে যাওয়ার অনুমতি মেলে না, পন্ডিতমশাই নিজে বাড়ি এসে জনাব আলী সরকারকে বলে যান–ছেলে আপনের জজ ব্যারিস্টার হইব। গুষ্ঠির ভাগ্য ফিরব। ছেলেরে যাইতে দেন।
সেই রজব আলী হাতে দুটো জামা, একখানা পাজামা, আর এক জোড়া কালো রাবারের জুতো, এক শিশি সর্ষের তেল ভরা পুঁটলি নিয়ে আসেন ময়মনসিংহ শহরে। পকেটে চার আনা পয়সা সম্বল। বাড়ি খোঁজেন জায়গির থাকার, চেনা এক লোক এক মোক্তারের বাড়িতে জায়গির থাকার কাজ দেন। ভাল ফল দেখিয়ে লিটন মেডিকেল ইস্কুলে ভর্তি হন। আত্মীয় বন্ধুহীন শহরে জায়গির বাড়ি থেকে লেখাপড়া করতে করতে শহরের নতুন বাজারে মনিরুদ্দিন মুন্সির সঙ্গে দেখা হয় বাবার একদিন। দরাজ দিল মুন্সির, দোকানের গদিতে বসে রাস্তার ফকির খাওয়ান বিনে পয়সায়। দেখে বাবার চোখ চকচক করে কি? মা বলেন হ চকচক করে। বড় টাকার লোভ মানুষটার। একটা পুইল্যা খেঁতা লইয়া শহরে আইছিল, আমার বাপে তারে ডাক্তারি পড়াইছে। আমার বাপের টেকা দিয়া ডাক্তারি পইড়া হে ডাক্তার হইছে। এহন পুরানা কথা বেবাক ভুইলা গেছে। এহন আমারে শাতায়। বাবা কি ভেবেছিলেন মনিরুদ্দিন মুন্সির করুণা জুটলে গ্রাম থেকে ধান বেচা টাকা এনে মেডিকেল ইস্কুলের খরচ পোষাতে হবে না, সে কারণেই তিনি পিছু নিয়েছিলেন মনিরুদ্দিন মুন্সির?
আরে না, মা বলেন, বাড়ি থেইকা তর বাপে কিছুই আনে নাই। বরং টেকা আরও বাড়িত পাডাইছে। তর বাপের আর খরচ কি ছিল, বিড়ি সিগারেট খায় নাই, পান জরদা খায় নাই। মেডিকেলে বৃত্তি পাইছে, লেখাপড়ার অত খরচ লাগে নাই।
তাহলে বৃত্তির টাকায় লেখাপড়ার খরচা চলেছে বাবার, আর জায়গির বাড়িতে চলেছে থাকা খাওয়া। ব্যস। কারও কাছে হাত পাতার দরকার পড়েনি!
হাতখরচ আছে না? আমার বাজানে তারে কত খাওয়াইছে। বাজান একটা নাপিতের দুকান কিনছিল, হেইডার ভাড়াডা তর বাপেই নিত। বিয়ার পরে বাজান তারে ঢাকা লইয়া গিয়া স্যুটের কাপড় কিইনা দিছে। নাস্তা পানি খাওয়ার টেকা বাজানে তারে কম দিছে! বৃত্তির টেকা হে দেশের বাড়িতেই পাডাইছে। বইখাতা যা লাগে আমার বাজানই তারে কিইনা দিছে।
আমার বাজানরে দুইবেলা কদমবুসি কইরা তর বাপে কইত–আপন বলতে আমার কেউ নাই। দূর গেরামে বাবা থাকেন, বড় গরিব। যদি কিছু না মনে করেন, আপনেরেই আমি বাবা ডাকব।
মনিরুদ্দিন মুন্সি অনুমতি দেন তাঁকে বাবা ডাকার। রজব আলীকে বাড়িতে এনে মাছ ভাত খাওয়ান, খাইয়ে দাইয়ে পকেটে টাকা গুঁজে দিয়ে বলেন–ভাল মন্দ খাইও। সম্পর্ক গড়াতে গড়াতে এমন হয় যে, মুন্সির বাড়িতে রজব আলীর আনাগোণা বেড়ে যায়। ঈদুল ওয়ারা সন্ধেয় যখন গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন, রজব আলী জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখেন তাঁকে। হারিকেনের চিমনির ওপর কাগজ আটকে রাখেন গৃহশিক্ষক, যেন অন্ধকারে জানালায় দাঁড়িয়ে রজব আলী মুখে আলো পড়া ঈদুল ওয়ারাকে মনের আশ মিটিয়ে দেখতে পারেন। রজব আলী দেখেনও। ঈদুল ওয়ারার লেখাপড়া করার বিষম শখ, গড়গড়িয়ে পড়েন, গোটা গোটা অক্ষরে মুখস্ত করা ইতিহাস-বিদ্যা লেখেন খাতায়।
লিকলিকে মেয়েটিকে বিয়ে করার প্রস্তাব রজব আলীই পাড়েন সরাসরি মুন্সির কাছে। ছেলে দেখতে শুনতে ভাল, আদব কায়দা জানেন, ডাক্তারি পড়েন, মনিরুদ্দিন মুন্সি রজব আলীর আবেদনে সাড়া দেন। মেয়েকে লাল সিল্কের শাড়ি পরিয়ে কিছু পড়শিকে পোলাও মাংস খাইয়ে, বিয়ে পড়িয়ে দেন। নাক ভোঁতা কালো মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় এক নাক খাড়া ফর্সা ছেলের সঙ্গে।
মোক্তার বাড়ির পাট চুকিয়ে রজব আলী এসে ওঠেন মুন্সির বাড়িতে। মুন্সি তাঁর মেয়ে আর ঘর জামাইর জন্য চালা ঘর, যে ঘরটিতে জায়গির ছেলেরা থাকতেন, গুছিয়ে দেন। ঈদুল ওয়ারাকে পড়াতেন ওঁরা, বিয়ে হওয়ার পর পড়ালেখার পাট চুকেছে, ওঁরাও বিদেয় হয়েছেন। রজব আলীর এ বাড়িতে এসে একধরনের স্বস্তি হয়, জায়গির বাড়ির আর এ বাড়ির খাওয়া দাওয়ায় আদর যত্নে বিস্তর তফাৎ। ও বাড়িতে ছেলে পড়িয়ে থাকা খাওয়া মিলত। ক্ষিদে কমত বটে, তৃপ্তি হত না। এ বাড়িতে শাশুড়ি কোরমা, কালিয়া, দোপিঁয়াজা পাতে দিয়ে নিজে হাতপাখায় বাতাস করেন। শ্বশুর শাশুড়ি আর বাড়ি ভর্তি শালা শালির আদর পেলে, বউ যেমনই হোক, চলে। শহরে এক ঘর আত্মীয়ের দরকার ছিল রজব আলীর। শরীর ভাল থাকে, মনও। যে চালা ঘরটি ছেড়ে দিয়েছিলেন মনিরুদ্দিন মুন্সি একদা তাঁর মেয়ে জামাই হবু ডাকতার খাঁড়া নাকের রজব আলীকে, সে ঘরেই জন্ম হয় আমার দাদার, ছোটদার, আমার। দাদারা জন্মালে ঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আল্লাহুআকবর বলে পাড়া শুনিয়ে আযান দিয়েছেন নানা। আমার বেলায় আযানের দরকার পড়েনি, মেয়ে জন্মালে আযান দিতে হয় না। সাত দিনের দিন জাঁক করে হাইট্টারা হল আমার। দাদারা দেয়ালে মোমবাতি জ্বেলে বাড়ি আলো করেছিলেন। বাবার বন্ধুরা নানা রকম উপহার নিয়ে এসে আয়না বাবুর্চির হাতের চমৎকার খাবার খেয়ে গেলেন। হাইট্যারার দিন আঁতুড় ভাঙেন মা, ঘরদোর কাপড় চোপড় ধোয়া হয়, গোসল টোসল করে পয় পরিষ্কার হয়ে আগের জীবনে ফেরেন।
হাইট্যারার পর আকিকাও হবে। দাদাদের আকিকা হয়েছিল গরু জবাই করে, আমার হল একটি খাসিতে। মেয়ের বেলায় খাসি, ছেলের বেলায় একটি গরু নয়ত দুটো খাসি, এরকমই নিয়ম। আকিকার আগে আগে আমার নাম রাখা হবে কি এই নিয়ে বাড়িতে বৈঠক বসেছিল। বড়মামা বলেন নাম রাখ উষা। রুনু খালা বলেন শোভা, ঝুনু খালা পাপড়ি। দরজায় দাঁড়িয়ে দাদা বুড়ো আঙুল খোঁটেন চৌকাঠে। কোনও নামই তাঁর পছন্দ হয় না। ঘর ভরা মানুষের সামনে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থেকে দাদার ঘাড়ের রোম ফুলছে তা কারও নজরে পড়েনি। না পড়ারই কথা, নাম রাখার দায়িত্ব বড়দের, ছোটরা নামের বোঝে কী! তো বাদাম চিবুচ্ছিলেন দাদা, হঠাৎ হাঁ করলেন সারস পাখির মত, জিভ নড়তে লাগল যেন ঝড়ে কাঁপা বাঁশপাতা, ছিটকে বেরোতে লাগল বাদাম মুখ থেকে, বাদামের সঙ্গে শব্দও। বাড়ির কুকুর বেড়ালের ডাক, কাকের ডাক, বাচ্চার ট্যাঁ ট্যাঁ, উঠোনে এর ওর তারস্বরে চিৎকার, খেলার মাঠে ছেলেদের চেঁচামেচি সবকিছুর সঙ্গে দাদার বাদাম ভরা মুখের শব্দ ঠিক ঠাহর করা যায় না, এটি ওসব শব্দেরই একটি নাকি আলাদা। রুনু খালা অনুমান করেন চিকন চিৎকারটি দরজার কাছ থেকেই আসছে।
খপ করে দাদার কাঁধ ধরে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা রুনুখালা দাদাকে ঘরের মাঝখানে কাঠের থামের কাছে দাঁড় করান। বড় মামার, ঝুনুখালার, নানির, মা’র, হাশেম মামার চোখ তখন দাদার আলজিভ বের হয়ে থাকা মুখে, মুখের বাদামে। কান শব্দে।
কী কান্দস ক্যান? কেডা মারছে? রুনুখালা দাদার চিবুক উঁচু করে ধরে জিজ্ঞেস করেন।
দাদার গাল বেয়ে যে পানি ঝরছে তা হাতের তেলোয় মুছে, কান্নার দমক থামিয়ে বললেন–আমার বইনের নাম রাখতে হইব নাসরিন।
মামা খালারা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘর কাঁপিয়ে হাসেন। যেন সার্কাসের ক্লাউন মঞ্চে এসে লোক হাসাচ্ছে।
এবার দাদাকে বৃত্তের ভেতরে নিয়ে আসা হল। বৃত্তটি রচনা করলেন বড়মামা, হাশেম মামা, রুনু আর ঝুনু খালা।
নাসরিন নাম রাখবি ক্যান? কোত্থেকা শুনলি এই নাম? কে কইছে এই নাম রাখতে? প্রশ্নের বাণের সঙ্গে দাদার হাতে এক ঠোঙা বাদামও দেওয়া হল। তিনি দাঁতে বাদাম ভাঙতে ভাঙতে বলেন, বাদামের দিকে তাকিয়ে, আমার ইস্কুলে একটা খুব সুন্দর মেয়ে আছে। নাসরিন নাম।
এবার বৃত্তে হাসি চেপে রাখা হল যার যার পেটের ভেতর আরও তথ্যের আশায়। নাসরিন কই থাকে? বাড়ি কই? হাশেম মামা জিজ্ঞেস করেন।
দাদা উত্তর দেওয়ার আগেই বড় মামা বলেন–তর ওই নাসরিন নাম টাম চলব না। নাম রাখা হইব উষা।
দাদা বাদামের ঠোঙা দূরে ছুঁড়ে ফেলে, ঠোঙা গিয়ে ঠেকল বাঁশের ব্যাংকে, বৃত্ত থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। ঘর থেকে নিজের জামা কাপড়ের এক পুঁটলি বেঁধে নিয়ে বলেন তিনি, গেলাম।
এই কই যাস, থাম। মা পেছন থেকে বলেন।
যেই দিকে দুই চোখ যায়। দাদা যেতে যেতে বলেন।
কাঁধে পুঁটলি নিয়ে ঠিকই তিনি বেরিয়ে যান বাড়ির বাইরে। পুকুর ঘাট থেকেই দাদা ফেরত আসবেন ভেবে বৃত্ত ভেঙে মামা খালারা বসে থাকেন খাটে পা ঝুলিয়ে কিন্তু ফেরেন না দাদা।
সন্ধে শেষ হয়ে রাত ঘন হলে মা বিলাপ শুরু করেন। বড়মামা আর হাশেম মামা বেরিয়ে যান দাদাকে ধরে আনতে। খবর পেয়ে নানাও।
রাত দশটায় হাশেম মামা হাজিবাড়ির জঙ্গল থেকে পাগল ছেলেকে ধরে এনে বাড়িতে হাজির করেন। দাদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে মা বলেন– যে নাম রাখতে চাও তুমি, সেইটাই হইব বাবা।
ছেলে যা বলেছে তাই হবে, বাবা পরদিন সকালে জানিয়ে দেন বাড়িতে, নাম নাসরিনই। মামা খালারা বিষণ্ণ মুখে বসে থাকেন। রাজকন্যার এমন গেঁয়ো নাম রাখার কোনও মানে হয় না, যে নামের কোনও অর্থ নেই।
দাদা পরদিন ইস্কুল থেকে ফিরে উঠোনে দাঁড়িয়ে বৃত্তের মানুষদের দিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে মিটমিট হাসেন।
–তর বইনের পুরা নাম কি দিবি রে হাগড়া গাড়ি? ঝুনুখালা কুটা দিয়ে কলপাড়ের দক্ষিণের গাছ থেকে আম পাড়তে পাড়তে বললেন।
–নাসরিন জাহান তসলিমা। দাদা বুড়ো আঙুল বের করে আকর্ণ হেসে বলেন। ফক করে হেসে ওঠেন ঝুনু খালা।
রুনু খালা উঠোনে বসে বটিতে কুচি কুচি করে আম কাটছিলেন ভর্তা বানাবেন, বলেন তর যে ইস্কুলের মেয়ে নাসরিন, তারে তর পছন্দ হয়?
দাদা দাঁত ছড়িয়ে হেসে বলেন–হয়।
–তারে বিয়া করবি?
দাদা বুড়ো আঙুল মুখে পুরে শরমের হাসি হেসে মাথা কাত করে রাখেন ডানে। তাঁর হাফপ্যান্টের দড়ি ঝুলে থাকে হাঁটু অবদি।
ঝুনু খালা কুটা ফেলে দাদার মাথায় ঠোনা মেরে বলেন–তরে তো বিয়া করব না ওই মেয়ে। তুই যে ইস্কুরে হাইগা দিতি প্যান্টের মধ্যে, এই খবর তো তর সুন্দরী মেয়ে নাসরিন পাইয়া গেছে।
দাদা দৌড়ে ঘরে ঢুকে মা’র আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখে টলটল করে জল।
–কী হইছে, কান্দ কেন? মা জিজ্ঞেস করেন দাদার মাথায় হাত বুলিয়ে।
–ঝুনু খালা আমারে হাগড়া গাড়ি ডাকছে।
মা উঠোনে নেমে কপট ধমক লাগান ঝুনু খালাকে।
–বেচারারে কান্দাইছ না তো। জন্মের পর থেইকা এর পেট খারাপ। কত ওষুধ খাওয়াইলাম, পেট আর ভাল হয় না। সেই যে শুরু হইছে, আইজও পাতলা হাগে।
আকিকা হবে বলে নাম ঠিক হল আমার, আকিকার দিন পিছিয়ে দিলেন বাবা। কেন, মাদারিনগরে সে বছর ধান হয়নি ভাল, বাবার মন খারাপ। মাস কয় পর ধান হল ভাল কিন্তু বদলির কাগজ এল বাবার, পাবনায়। বাবার আবার মন খারাপ, পিছোতে হল আকিকার দিন। পাবনা থেকে ফিরে এসে আবার আকিকার প্রসঙ্গ। সে হতে হতে আরও দু’বছর গেল। আকিকার উৎসবে সকাল থেকে খালারা ঘরের মেঝেয় শাদা রঙের আল্পনা আঁকেন, রঙিন কাগজে মালা বানান, কাগজের শেকল বানিয়ে এক থাম থেকে আরেক থামে ঝুলিয়ে দেন। আকিকায় লোক আসে সোনার মালা, আংটি, পিতলের কলসি, সবুজ সাথী বই, জামা জুতো, কোরান শরিফ, থাল বাটি, সুটকেস উপহার নিয়ে। আয়না বাবুর্চি মাঠে গর্ত করে চুলো বানিয়ে খড়ি জ্বেলে বড় বড় ডেকচিতে পোলাও কোরমা রান্না করেন। সুগন্ধে বাড়ি ম ম করে। পাতিল পাতিল দই মিষ্টি কিনে আনেন নানা। আকিকার দিন দাদা ছিলেন সবচেয়ে ব্যস্ত। ধোয়া জামা কাপড় পরে নতুন জুতো পায়ে দিয়ে চুলে টেরি কেটে অতিথিদের সামনে ঘুরঘুর করতে করতে যাঁকেই দেখেছেন তাঁর দিকে প্রশ্রয়ের হাসি হাসতে, তাঁর কাছেই রহস্য ফাঁস করেছেন এই বলে যে বোনের নামটি রেখেছেন একা তিনিই, বাড়ির অন্যরা নানারকম নামের প্রস্তাব করেছিল, মন্দ বলে বাদ দেওয়া হয়েছে।
আকিকায় পাওয়া চারটে ছোট সুটকেস মা তুলে রাখলেন আলমারির ওপর। পিতলের কলসি চলে গেল রান্নাঘরের কাজে। আলমারির ভেতর জামা জুতো, থাল বাটি আর কোরান শরিফ। সোনার আংটি, মালা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে রাখলেন মা, চাবি বাঁধা আঁচলের কোণায়। আমার নাগালের ভেতর পড়ে থাকে কেবল বইখানা। আমার মাস্টার তখন বাড়িসুদ্ধ সবাই। বইয়ের ওপর ঝুঁকে আছি দেখলে ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত আমাকে উচ্চারণ করিয়ে ছাড়েন।
তাঁরা যা বলতে বলেন, বলি। পড়ে শ্লেটে পেনসিল ঠেসে অক্ষর আঁকার আগেই বলেন পড়, ময়আকার মা।
আমি বলি ময়আকার মা।
–ক ল ম কলম।
–ক ল ম কলম।
উঠোনের খাঁচায় বাঁধা ময়না পাখিকেও যা বলতে বলা হয়, বলে। শরাফ কিম্বা ফেলু মামা তখনও হাতে বই ধরেননি, আর আমার সবুজ সাথী শেষ।
আকিকার উৎসবের পর পরই কাউকে না জানিয়ে বসিরুদ্দিন নামের এক লোকের কাছে পুরো বাড়ি বিক্রি করে দেন নানা। বসিরুদ্দিন এসে বাড়ির দখল চাইলেই নানির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম আকাশ আকাশের জায়গায় আছে। অত বড় আকাশ ভেঙে নানির মাথায় পড়লে নানি কি আর বাঁচতেন! যা হোক, নানা টাকা কি করেছেন, কাকে দিয়েছেন এর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। নানি বসিরুদ্দিনকে বাড়ির ভাল চেয়ারটিতে বসিয়ে চা নাস্তা সামনে দিয়ে নরম গলায় বললেন –ভাইজান, একজনে পাগলামি কইরা সংসারের সবাইরে ভুগাইব, এইডা কি সইয্য হয়! আমার এতগুলা ছেলেমেয়ে। সবাইরে নিয়া আমারে পথে বইতে হইব। আপনেরে আমি টেকা শোধ কইরা দিয়াম। আপনে এই বাড়ি আমার কাছে বিক্রি কইরা দেন। আমি টেকা কিস্তিতে শোধ করাম।
বসিরুদ্দিন গলা কেশে বললেন–কিস্তিতে পুষাইব না। আমি, ঠিক আছে, আপনে যহন কইতাছুইন, আমি বাড়ি বিক্রি করাম, কিন্তু কিস্তিতে না। টেকা আমারে একবারে দিতে হইব।
নানি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বলেন–এত টেকা একবারে আমি পাই কই! আমার দিকটা দেহেন। আমি অসহায় মেয়েছেলে! কয়ডা দিন তাইলে সময় দেন আমারে।
চায়ে চুমুক দিয়ে বসিরুদ্দিন বলেন–না না না। সময় আমি কেমনে দেই! সময় কি বানানো যায়! আল্লাহ মাইপা যে সময় দেন আমাগো হাতে, সেইডাই খরচা করি। আমারে টেকা কাইল পরশুর মধ্যে দিলে আমি বাড়ি বেচাম, নাইলে আমারে মাপ করুইন।
শরাফ মামার হাতে ভেতর ঘর থেকে পানের খিলি পাঠিয়ে দেন বসিরুদ্দিনকে, চা খেয়ে মুখে পান পুরে আঙুলে চুন তুলে বসিরুদ্দিন উঠোনের হাঁসমুরগির দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তাইলে কাইল বিকালে আসতাছি।
বসিরুদ্দিন চলে গেলে নানি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। বাঁশের ব্যাংক ভেঙে, আনাচে কানাচে যেখানে যত টাকা ছিল, বার করে দেখলেন মাত্র পাঁচশ।
বোরখা চড়িয়ে চলে গেলেন বাড়ির বাইরে। সুলেখার মার বাড়ি, মনুর মা, সাহাবউদ্দিনের বাড়ি ঘুরে এসে রাতে এসে আমাদের ঘরে উঠলেন। বাবা তখন ডাকতারখানা থেকে সবে রোগি দেখে ফিরেছেন।
–খবর পাইছুইন? এহন কি করি কন। নানি ব্যাকুল কণ্ঠে বলেন।
খবর বাবা পেয়েছিলেন, বাবা বাড়ি ফিরতেই মা বলেছেন–বাজান বাড়ি বেইচা দিছে বসিরুদ্দিন নামের এক লোকের কাছে। বাড়ির দখল লইতে আইছিল লোকে। মা কইল বাড়ি কিইনা লইব তার কাছ থেইকা। কিন্তু কেমনে কিনব কে জানে। এত টেকা মা পাইব কই। বসিরুদ্দিন একবারে টেকা চায়। কাইল পরশুর মধ্যে দিতে হইব। কিন্তু খবর না জানা স্বরে বাবা বললেন–কি খবর! কি হইছে কি!
দু’জন খাটের দু’কিনারে বসলেন। নানি বললেন–বাড়ি ত বেইচা দিছে সিদ্দিকের বাপে।
বাবার পরনে লুঙ্গি। লুঙ্গির নিচে পা দুলতে থাকে বাবার, বললেন–কোন বাড়ি? কার বাড়ি?
–কোন বাড়ি আবার, এই বাড়ি! নানি বিরক্ত গলায় বলেন।
–ক্যান, বেচছে ক্যান? বাবা প্রশ্ন করেন।
–এইডা কি আর আমি জানি! আমারে ত কিচ্ছু কয় নাই। মানুষটা আস্তা পাগল। বুদ্ধি সুদ্ধি নাই। টেকাগুলা কি করছে তাও কয় না।
বাবার পা দুলতে থাকে লুঙ্গির নিচে।
–বসিরুদ্দিনরে কইলাম তার কাছ থেইকা বাড়ি আমি কিইনা …
নানির কথায় ঠোকর দেন বাবা, — বসিরুদ্দিন কেডা?
— যে বেডার কাছে সিদ্দিকের বাপে বাড়ি বেচছে। নানি বলেন।
–বসিরুদ্দিন থাহে কই? বাবা জিজ্ঞেস করেন দোলা হাঁটু চুলকোতে চুলকোতে।
–নতুন বাজার নাকি কই জানি। নানি হাতের রুমাল খুলে পানের একটি খিলি মুখে পুরে বলেন।
–বসিরুদ্দিন করে কি? বাবা জিজ্ঞেস করেন।
–সেইডা জানি না। বসিরুদ্দিন বাড়িতে আইছিল। টেকা চাইল। আমি কইলাম টেকা কিস্তিতে দিয়াম। বাড়ি আমার কাছে বেইচা দেন। নানি থেমে থেমে বলেন।
–ভাল কথা। কিস্তিতে টেকা তাইলে দিয়া দেন। বাবা নিরুত্তাপ স্বরে বলেন।
–কিন্তু বসিরুদ্দিন মানে না। কয় একবারে তারে টেকা দিতে। নানির স্বরে উদ্বেগ।
–তাইলে একবারেই দিয়া দেন। বাবা মধুর হেসে বলেন।
–টেকা কি গাছে ধরে? ছয় হাজার টেকা আমি পাই কই!
নানি অসহায় চোখে ফেলেন বাবার চোখে। পা দোলানো বন্ধ করে বলেন বাবা –ঈদুন চা টা কিছু দেও। আম্মা চা খাইয়া যাইন।
নানি মাথা নাড়েন, চা খাবেন না তিনি।
–তাইলে কি খাইবাইন? কিছু একটা খাইন? বাবা বলেন।
–না না আমি কিছু খাইতাইম না। নানির স্বরে বিরক্তি।
–এই বিস্কুট চানাচুর কিছু দেও ত। বাবা মা’কে তাড়া দেন।
–না। না। না। নানি হাত উঁচিয়ে মা’কে থামান।
বাবা আর নানি বসে থাকেন খাটের দু’কিনারে। মা আর আমি আরেক খাটের মধ্যিখানে। কেউ কারও সঙ্গে আর কথা বলছেন না।
–আপনে কি আমারে অন্তত পাঁচ হাজার টেকা কর্জ দিতে পারবাইন নুমানের বাপ? বাড়িঘর না থাকলে পুলাপান লইয়া থাকবাম কই? নানি ভাঙা স্বরে বলেন।
বাবা কোনও উত্তর দেন না।
নানি কাতর স্বরে বলেন–আমি আপনেরে যেমনেই হোক মাসে মাসে টেকা শোধ কইরা দিয়াম।
বাবার নীরবতায় মা ছটফট করেন, বলেন–বাজান কি এই সংসারের লাইগা কম করছে? এহন মা’র এই বিপদের দিনে সাহায্য করার কেউ নাই। রাজশাহি পড়তে গেল গা, বাচ্চাগোর দুধ ছিল না। বাজান বড় বড় দুধের টিন কিইনা দিছে। বিয়ার পর থেইকা ত বাপের বাড়িতই থাকলাম।
নানি শাড়ির আঁচলে চশমার কাচ মুছে নিয়ে আবার পরেন। আবার ব্যাকুল কণ্ঠে বলেন–একটা কিছু উত্তর দেইন নুমানের বাপ। বসিরুদ্দিন কাইলকা আইব।
বাবা সে রাতে কোনও উত্তর দেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নানি যখন দরজার বাইরে চলে গেলেন, বাবা ঘাড়ে হাত ঘসতে ঘসতে বললেন আম্মা, কাইল রাইতে আপনের সাথে কথা কইয়াম নে।
বাবা টাকা দিয়েছিলেন। নানি মাসে মাসে তিন বছরে সে টাকা শোধ করেছিলেন। নানা শুনে একগাল হেসে বলেছেন–খায়রুন্নেসা ফুঁ দিলে তুষের আগুনও ঠান্ডা।
নানা বেহিসেবি লোক। আমুদে লোকও। খেয়ে এবং খাইয়ে তাঁর যত আনন্দ। নানি সংসারের হাল না ধরলে অবশ্য আমোদ আহলাদ সব ভেস্তে যেত নানার। বিক্রমপুরের বাউন্ডুলে ছেলে নানা। বাপের সিন্দুক ভেঙে জমানো টাকা পয়সা চুরি করে তের বছর বয়সে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। এ শহর সে শহর ঘুরে ময়মনসিংহে এসে একসময় ফতুর হয়ে পড়েন। মসজিদে মসজিদে বিনে পয়সায় ঘুমোন, খান আর রাস্তার পাগল ফকির জড়ো করে আরব দেশের কিচ্ছা শোনান। মসজিদের লোকেরা নানাকে এক পয়সা দু’পয়সা দেয়। পয়সা পকেটে নিয়ে বাবর বাদশাহর মত নিজেকে মনে হয় তাঁর। রাস্তায় কাউকে ভিক্ষে করতে দেখলেই নানা জিজ্ঞেস করেন–বাড়ি কই? পেটে দানা পানি পড়ছে? ভিখিরির ক্ষিধে যায় না, ভিখিরির অভাবের গল্প শুনে নানা আহা আহা করেন, চোখ বেয়ে বর্ষার জলের মত জল ঝরে। পকেটের কানাকড়ি যা আছে, ভিখিরির হাতে দিয়ে বলেন–ভাল মন্দ কিছু খাইও।
জিলাইস্কুল মোড়ের চানতারা মসজিদের নতুন ইমাম প্রায়ই লক্ষ করেন নানা জুম্মার নামাজ পড়তে একপাল ভিখিরি নিয়ে মসজিদে আসেন। ওদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন নানা। একদিন ডাকলেন –এই মিয়া তুমার নাম কি?
নানা একগাল হেসে বলেন–নাম আমার মনিরুদ্দিন।
–বাড়ি কই?
–বাড়ি নাই।
–বাপের নাম কি?
–ভুইলা গেছি।
–থাকো কই?
–এত বড় দুনিয়ায় থাকনের কি অভাব!
–লেখাপড়া জানো?
মনিরুদ্দিনের ফর্সা মুখে শাদা হাসি। কোনও উত্তর নেই।
বাউন্ডুলে ছেলেকে সংসারি করার ইচ্ছে জাগে ইমামের। ঘরে তাঁর বারো বছরের এক মেয়ে আছে বিয়ের বয়সী। ইমাম তক্কে তক্কে থাকেন মনিরুদ্দিনকে খপ করে ধরবেন একদিন। মসজিদের ভেতর এক শীতের রাতে কম্বলকাঁথা ছাড়া হাত পা গুটিয়ে মনিরুদ্দিনকে ঠান্ডা মেঝেয় শুয়ে থাকতে দেখে ইমাম বললেন –চল মনিরুদ্দিন, আমার বাড়িত লেপ আছে বিছনা আছে, ঘুমাইবা।
মনিরুদ্দিন নড়েন না।
–চল মনিরুদ্দিন, গরম ভাত খাইবা গুসতের ছালুন দিয়া।
মনিরুদ্দিন উঠে বসেন।
–তা বাড়ি আপনের কতদূর ইমাম সাইব? মনিরুদ্দিন জিজ্ঞেস করেন আড়মোড়া ভেঙে।
মনিরুদ্দিনকে সে রাতে বাড়ি নিয়ে গুসতের ছালুন দিয়ে গরম ভাত খাইয়ে বারবাড়ির বিছানায় গরম লেপের তলে শুইয়ে দিলেন। মনিরুদ্দিন ঘুমোলেন পরদিন দুপুর অবদি টানা। এমন আরাম তিনি বহু বছর পাননি। সৎ মায়ের যন্ত্রণায় ঘর ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। তাঁর মনে পড়ে নিজের মা বেঁচে থাকতে দুধভাত খাইয়ে তাঁকে এমন শুইয়ে রাখতেন। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে মনিরুদ্দিন দেখেন উঠোনে বদনির পানিতে অযু করছেন ইমাম। তাঁর বাবাও এমন বদনি কাত করে পানি ঢালতেন পায়ে। বদনিখানা ইমামের হাত থেকে নিয়ে নিজে তিনি পানি ঢালতে লাগলেন, যেন তাঁর বহু বছর না দেখা বাবার পায়ে ঢালছেন পানি। পানি ঢালতে ঢালতে মনিরুদ্দিন হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
–কান্দো ক্যান, মনিরুদ্দিন? কান্দো ক্যান?
ইমাম অবাক হয়ে বললেন।
মনিরুদ্দিন কোনও উত্তর না দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় একমাস পর এক খাঁচা মিষ্টি নিয়ে ইমামের বাড়ি এসে হাসতে হাসতে বললেন– ইমাম সাইব, খুব ভাল মিষ্টি, খাইয়া দেখেন। গরম গরম রসগোল্লা। কলিকাতা থেইকা আনা।
মিষ্টি ইমামের বাড়ির সবাই খেলেন। খেয়ে দেয়ে ইমাম বাইরের ঘরে বসা মনিরুদ্দিনকে বললেন আমার মেয়ে খায়রুন্নেসারে তুমি বিয়া কর।
— বিয়া? মনিরুদ্দিন আঁতকে ওঠেন। বিয়া কইরা বউ তুলমু কই। মসজিদে?
— সেই চিন্তা কইর না। আমার জাগা জমির অভাব নাই। একটা কিছু ব্যবস্থা হইব। ইমাম কাঁধে হাত রেখে বললেন তাঁর।
মনিরুদ্দিন মন সেদিন ফুরফুরে। রাজি হতে বেশি সময় নিলেন না। রাত ঘন হওয়ার আগেই কাজি ডেকে বিয়ে পড়িয়ে ভাত গোসত রান্না করে খাইয়ে দাইয়ে লেপের তলে শুইয়ে দেওয়া হল মনিরুদ্দিনকে। খায়রুননেসা জানলেন না মনিরুদ্দিন দেখতে কেমন, তাঁর স্বভাব চরিত্র কেমন। লেখাপড়া জানা মেয়ে খায়রুনন্নেসা, সূর করে পুঁথিও পড়তে জানেন অথচ দিব্যি এক ক অক্ষর গোমাংসের সঙ্গে হুট করে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল, গোমাংসের রসগোল্লা পেটে হজম হওয়ার আগেই। খায়রুননেসার আরও ভাল জামাই জুটতে পারত। কিন্তু ইমামের বদ্ধ ধারণা, মনিরুদ্দিনের বাড়ি ঘর টাকা পয়সা না থাক, বড় একখানা হৃদয় আছে। আর সারা জীবনে এই অভিজ্ঞতাই তিনি অর্জন করেছেন যে হৃদয়ের চেয়ে বড় কিছু জগতে নেই।
ইমামের এক ছেলে আছে, নামে মাত্র। সে ছেলের জঙ্গলের নেশা। ভারতবর্ষের সব জঙ্গল চষে শিকার করে বেড়ান। বাড়ি ফেরেন বছরে একবার, মাস দু’মাস থেকে আবার উধাও। ছেলের ওপর ভরসা হারিয়ে মনিরুদ্দিনের হাতে সম্পত্তির সব ভার দিয়ে শয্যা নেওয়ার পর ইমাম বলেছিলেন তুমি হইলা আমার ছেলে। মনিরুদ্দিন ছেলে বনতে পারেন, কিন্তু স্বভাব ফেরাবেন কি করে! বছর না যেতেই ইমামের আধেক জমিজিরেত বিক্রি করে ভিখিরিদের বিলিয়ে সারা। বাকি যেটুকু রইল, কিছুটা সরকার নিয়ে নিল ইস্কুলের বোর্ডিং করবে বলে আর কিছুটাতে এসে খায়রুননেসা টিনের ক’টি ঘর তুলে গাছগাছালি লাগিয়ে নিজের শেকড় গাড়লেন, অনেকটা মাটি কামড়ে পড়ে থাকার মত। বড় হৃদয়ে পোষায় না আর খায়রুনেনসার। বছর বছর ছেলে পিলে হয়, ক্ষিধেয় সারস পাখির বাচ্চার মত ওরা হাঁ করে থাকে। বাড়ি ঘর করে না হয় মাথা গোঁজার ঠাঁই হল, কিন্তু সংসারের খরচ যোগাবে কে! মনিরুদ্দিনের সেদিকে মোটে নজর নেই, তিনি ফূর্তিতে শহর বন্দর ঘুরে বেড়ান। টাকা ফুরিয়ে গেলে অবশ্য বাড়ি ফেরেন। ফিরে কই খায়রুননেসা খাওন দেও। এই পুলপান কে কই আছ, সব আসো, খাইতে বও বলে ঝিমিয়ে থাকা বাড়িকে কিলঘুসি মেরে জাগান। খায়রুননেসা মুখ বুজে মনিরুদ্দিন আর ছেলেমেয়েদের খাওয়ান। কিন্তু একবারই বলেছিলেন না খাওন নাই। মা’র তখন তিন কি চার বছর বয়স। নানা চমকে উঠলেন কি কইলা? খাওন নাই?
খায়রুননেসা ঠান্ডা চুলোর পাশে ঠান্ডা পিঁড়িতে বসে ঠান্ডা গলায় বললেন নাই। চাইল ডাইল কিচ্ছু নাই। পুলাপানরে পুস্কুনি থেইকা শাপলা তুইলা সিদ্ধ কইরা দিছি কয়দিন।
মনিরুদ্দিন শুনে মন বিষ করে ঘরে শুয়ে পড়লেন। দু’দিন শুয়ে থাকলেন।
খায়রুননেসা গাছের নারকেল কুড়িয়ে তকতি বানিয়ে মনিরুদ্দিনকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বললেন–যাইন বাজারে নিয়া এইগুলান বেইচা চাইল ডাইল কিইনা আনেন। নারকেলের তকতি ভরা কাঠের বাক্সে মাথায় করে নানা দিব্যি কাচারির সামনে নাড়ু বেচতে গেলেন।
প্রতিদিন খায়রুননেসা তকতি বানিয়ে বাক্স ভরে রাখেন। তকতি বেচার টাকা কিছুটা রেখে কিছুটা বউএর হাতে দেন মনিরুদ্দিন। প্রতিদিন এক সিকি দু’সিকি গোপনে জমিয়ে, ঈদুল ওয়ারার যখন বয়স পাঁচ, বাঁশের ব্যাংক ভেঙে এক পুঁটলি টাকা মনিরুদ্দিনের হাতে দিয়ে খায়রুননেসা বলেন–একটা দুকান কিনুইন। দুকানে ভাত মাছ বেচবেন।
মনিরুদ্দিন বাধ্য ছেলের মত দোকান কেনেন। চেয়ার টেবিল বসান। বাবুর্চি রাখেন। নতুন বাজারের মধ্যিখানে দোকান তখন হু হু করে চলছে। ইংরেজের আমল তখন। ইংরেজের ওপর লোকের রাগ অনেক। মনিরুদ্দিনের কারও ওপর রাগ হয় না। জগতের সবাইকে তাঁর বড় ভাল মানুষ বলে মনে হয়। এমন কি তাঁর সৎ মা’কেও। দোকানে যেই খেতে আসে, তাকেই গদিতে বসিয়ে গপ্প করেন তিনি। চোর ছ্যাঁচোরও মনিরুদ্দিনের ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে। রাস্তার কুকুর বেড়ালও এসে দোকানে ভিড় করে, ক্ষিধে লাগলে রান্নাঘরে ঢুকে এঁটোকাঁটা খেয়ে নেয়। পাগল ভিখিরি ডেকে দোকানে খাইয়ে দেন, কারও কষ্টের কথা শুনলে ক্যাশবাক্স খুলে মুঠো ভরে টাকাও দিয়ে দেন, ঘাম ঝরা কোনও হাটুরেকে রাস্তায় দেখলে চেঁচিয়ে ডাকেন, ও ভাইসাব, দৌড়ান কই, আহেন আহেন, এট্টু জিড়াইয়া যাইন। হাটুরেরা জিরিয়ে এক গ্লাস শরবতও মাগনা খেয়ে যান। মন্যা মুন্সির এইডা ত আর ব্যবসা না, মুসাফিরখানা–লোকে মন্তব্য করে। খায়রুননেসা ঈদুল ওয়ারাকে পাঠাতেন দোকান ঝাড়ু দিতে, টেবিল চেয়ার সাফ করতে। সিদ্দিকের পেছন পেছন ঈদুল ওয়ারা দোকানে পৌঁছে যখন দোকান ঝাড়ু দিতেন, মনিরুদ্দিনের সঙ্গে গদিতে বসে গরম জিলিপি খেতেন সিদ্দিক। সন্ধের আগে ছেলে মেয়ে দু’টিকে মাছ ভাত খাইয়ে মনিরুদ্দিন পাঠিয়ে দিতেন বাড়িতে। তাঁর নিজের বাড়ি ফিরতে রাত হত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে হারিকেনের আলো টিমটিম করে রেখে খায়রুননেসা বসে থাকতেন অপেক্ষায়। মনিরুদ্দিন ফিরলে তাঁর অবাধ কামের তলে আত্মাহুতি দিতেন, চাইতেন বুনো পাখিটি আটকা পড়ুক সমৃদ্ধি, সন্তান আর সম্ভোগের এই সংসারখাঁচায়। নিজে তিনি মেয়েমানুষ বলে সম্ভব ছিল না বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ব্যবসায় নজর করা। ঘরে বাঁশ পুতে সে বাঁশে ছিদ্র করে পয়সা ফেলতেন খায়রুননেসা। রাতে রাতে মনিরুদ্দিনের তৃপ্ত শরীরের পাশে কালো ঘন চুল ছড়িয়ে শুয়ে তাঁকে হিশেবি হতে পরামর্শ দেন। মনিরুদ্দিনের টাকা গোণার অভ্যেস নেই, টাকার হিশেব করেন তিনি মুঠো ধরে, গুনে নয়। তাঁর জন্য আর যা কিছু হওয়াই সম্ভব, হিশেবি হওয়া নয়।
পঞ্চাশ সনে আকাল নামল। আকালে চোখের সামনে মরতে লাগল মানুষ না খেয়ে। এক বাটি ফ্যান চাইতে দুয়োরে দাঁড়ায় মানুষ! মনিরুদ্দিন দোকানে বিক্রিবাটা বন্ধ করে লঙ্গরখানা খুললেন, নিজে হাতে চালে ডালে সবজিতে লাবড়া রেঁধে খাবার বিলোতে লাগলেন না খেতে পাওয়া মানুষদের। পকেটে টাকা নিয়ে সারা শহরের বাজার ঘুরে লঙ্গরখানা চালাতে চাল খুঁজেছেন কিনতে, বাজারে চাল নেই। দিশেহারা হয়ে মসজিদে মসজিদে দৌড়োলেন, মোনাজাতের হাত তুলে আল্লাহর দরবারে–তুমি ছাড়া কোনও মাবুদ নাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তুমি ছাড়া কোনও আপন নাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, বলে হাউমাউ করে কাঁদলেন, চোখের পানিতে ভেসে গেল মনিুরুদ্দিনের বুক। পুরো আকালের বছর তিনি কেঁদে পার করেছেন, উড়োজাহাজ থেকে চাল আর বিলাতি দুধ ফেলা শুরু হলে হাসি ফুটেছিল মুখে।
খায়রুননেসা আকাল বুঝতে দেননি, মাচায় কিছু চাল জমিয়ে রেখেছিলেন অভাবে অনটনে কাজে লাগবে বলে, তাই মেপে রাঁধতেন। কোলের বাচ্চা বেঁচেছিল কেবল বুকের দুধেই। খায়রুননেসা হাল না ধরলে সংসার ঝড়ে উড়ে যেত অনেক আগে। মনিরুদ্দিনকে সবটুকু না পারলেও সংসারে যেমন তেমন টিকে থাকার মত মায়ায় জড়িয়েছিলেন খায়রুননেসা। ভয় ছিল, কখন না আবার উড়ে যায় পাখি।
আকিকার উৎসবে মেতে ছিল সবাই, কেউ লক্ষ করেনি রান্নাঘরে চুপচাপ মরে গেছেন নানির মা। নানির বাবা মরে যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন এ বাড়িতে নানি। শিকারি ছেলের চেয়ে খায়রুননেসার কাছেই তিনি থাকতে পছন্দ করতেন। সমাজের নিয়মে অবশ্য শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী, বয়সকালে পুত্রের আশ্রয়ে থাকতে হয় মেয়েমানুষের। নানির মা’কে কাঠ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে মেঝেয় লুটিয়ে কেঁদেছিলেন নানা, যেন নিজের মা’কে হারিয়েছেন সেদিন।
সংসারে দুঃখ আছে, অভাব আছে, কিন্তু সুখও আছে নানা রকম। দাহে বেশিদিন কারও পোড়া হয় না, বর্ষার জল এসে সব ধুয়ে নেয়। জানলায় দাঁড়িয়ে পুকুরের পানিতে টুপটুপ করে ঝরা পানির খেলা দেখেন ঝুনু খালা। টিনের চালে রিমঝিম শব্দ হয় বৃষ্টির। জলের ভেতর জলের খেলা, রিমঝিম সুর সবার মন ভাল করে দেয়। মনের ভেতর পেখম মেলে ময়ূর নাচে। সেই শব্দের সঙ্গে গান করেন রুনু খালা। উঠোনের বৃষ্টিতে ভিজে দৌড়োদৌড়ি খেলেন টুটুমামা, শরাফমামা, ফেলুমামা। চৌচালা ঘরের থামে হেলান দিয়ে, আল্পনা আঁকা ঘরের মেঝেয় পাতা জলচৌকিতে বসে থাকেন মা’র মৃত্যশোক ঝেড়ে ওঠে কানা মামু।
কানা মামু, দেখে মনে হয় উঠোনের রোদের দিকে তাকিয়ে, বলেন–খালি গান গাইলে হইব রুনু? নাচো।
ঝুনু খালা প্রায় বলতে চান আপনি তো অন্ধ কানামামু, নাচ দেখবেন কেমনে? বলেন না। রুনু খালা কোমরে আঁচল গুঁজে পায়ে ঘুঙুর পরে নাচেন–নীল পাহাড়ের ধারে আর মহুয়া বনের ধারে, মন ভোলানো বংশী কে গো, বাজায় বারে বারে ও মহুয়া বনের ধারে, বনের ধারে ডাকছে পাখি, ব্যথায় আমার ভিজল আঁখি।
কানা মামু মেঝেয় লাঠি ঠুকে তাল দেন।
কেবল বাবাকে দেখি কোনও সুখের দোলনায় দোলেন না। তিনি ক্লান্ত বিরক্ত। তাঁর কাছে খরা বর্ষা সব এক। খরায় ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যায়, ফসল ফলে না, বর্ষায় ক্ষেত ডুবে ফসল নষ্ট হয়। বাবা বেতনের টাকা পুরোটাই মাদারিনগর পাঠিয়ে বড়দাদাকে চিঠি লেখেন–বাজান, দক্ষিণের জমিটা খুশির বাপের কাছ হইতে কিনিয়া লইতে দেরি করিবেন না। আগামী মাসে অধিক টাকা পাঠাইব। বাবার তখন উপার্জন অনেক। ছিলেন এল এম এফ ডাক্তার, হয়েছেন এম বি বি এস। জাতে উঠেছেন। নামের একটি নতুন রাবারস্ট্যাম্প বানিয়েছেন ডাঃ মোঃ রজব আলী, এম বি বি এস। নানিকে বাড়ি কেনার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিলেন, নিজেও মাঝের উঠোন জুড়ে পাঁচটি ঘর ভাড়া নিলেন সে বাড়িতে, একটি বৈঠক ঘর, একটি শোবার, একটি পাকঘর, একটি খড়ি রাখার, একটি এমনি পড়ে থাকার। ঘরগুলোয় পাকা মেঝে, টিনের চাল, টালির চাল, ইটের দেয়াল। কোনওটি আবার আগপাশতলা টিনের। আগের কেনা ঘরটি দাদা আর ছোটদাকে গুছিয়ে দেওয়া হল।
বাবার কাছে নাচ, গান, খেলা এসব অনর্থক হল্লা। বৃষ্টিতে ভিজে খেলতে দেখলে ঘাড় ধরে টেনে আমাকে ঘরে ঢোকান তিনি। সারা গা আমার কাঠ হয়ে থাকে ভয়ে। মা’কে যেমন রূপকথার গল্প শোনাতে বলি, বাবাকে কখনও পারি না, মুখের কাছে শব্দ এলেও ঢোঁকের সঙ্গে পেটে ঢুকে যায় আবার। বাবার চোখের দিকে তাকানো হয় না আমার, ভয়ে। যোজন দূরত্ব তাঁর সঙ্গে আমার।
এত দূরত্ব শুনেছি বাবার সঙ্গে আমার ছিল না। রাজশাহীতে বাবা পড়তে যাওয়ার আগে আমাদের বিষম ভাব ছিল। পাবনার জেলখানা থেকে সবে ফিরেছি। বাবা বাড়ি এলে বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতাম–বাবা আমালে বেলাইতে নিয়া দাও নদিল পালে।
নদীর পাড়ে আজ নেবেন কাল নেবেন বলে বলে বাবা আমাকে কোনওদিনই নেন না। বাবার কোলে ওঠা আমার গাল টিপে আদর করে দিয়ে মা বলেন–নদিল পালে যাইতে হয় না বাচ্চাদের। ছেলেধরা ধইলা নিয়া যাবে তুমালে।
— ছেলেধলা আমালে ধলবে না। আমি ত মেয়ে। বাবার কোলের ওপর জেঁকে বসে মা’কে বলি।
বাবা শুনে হো হো করে হাসেন।
–নদিল পালে ফটিং টিং থাকে। তিন মানুষের মাথা কাটা, পায়ে কথা কয়। যেন বাবাকেই ভয় দেখাচ্ছি, অমন করে ফটিং টিংএর শোনা গল্পটি একদিন বলি।
ফটিং টিং প্রসঙ্গে না গিয়ে আমার মাথায় কপালে গালে চুমু খেয়ে বাবা বললেন –কও তো তুমি আমার কি হও মা?
–আমি তুমাল মা।
এ বাবার শেখানো। গালে আবারও চকাশ করে চুমু খান বাবা। এলোচুলগুলো আঙুলে আচড়ে কানের পেছনে ঠেলে দেন। আমি তখন বাবা বলতে দুহাত পা ছোঁড়া এক পাগল মেয়ে। বাবা দু’ছেলের পর মেয়ে চেয়েছিলেন। সেই মেয়ে আমি, টুকটুকে মেয়ে, ফুটফুটে মেয়ে, আমার বাবার মা। অথচ সেই আমিই, দু’বছর পর যখন রাজশাহি থেকে কনডেন্সড পরীক্ষা দিয়ে এম বি বি এস পাশ করে ফেরেন বাবা, তাঁকে আর বাবা বলে চিনিনি, যেন এক অচেনা অদ্ভুত লোক আমাদের ঘরে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। বাবা আমাকে কোলে নিতে ডাকেন, আমি দৌড়ে পালাই। বাবাকে আর বাবা বলে ডাকি না। তুমি না, আপনি না। বাবাকে আজও আমি বাবা বলি না, তুমি না, আপনি না। বাবা আমার কাছে তখন সম্পূর্ণ বাইরের লোক, কিম্ভুত। নানি, রুনু খালা, ঝুনু খালা, হাশেম মামা, শরাফ মামা, ফেলু মামা, এমন কি বাউন্ডুলে নানাকেও আমার আপন বলে হয়, বাবাকে নয়। যেন বাবা এ বাড়িতে না এলেই ভাল ছিল, আমার, মা’র আর দাদা- ছোটদার সংসার চমৎকার চলছিল। যেন শান্ত একটি পুকুরে হঠাৎ এক ঢিল পড়েছে। যেন এক হিংস্র ফটিংটিং এসে আমাদের খেলাঘর ভেঙে দিয়েছে। বাবার সঙ্গে সেই যে আমার এক দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তা থেকেই গেছে। বাবা আমাকে ও মা, মা গো বলে কাছে ডাকেন, আমি পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়াই সামনে। আমাদের মাঝখানে অদৃশ্য এক দেয়াল থাকেই, এমনকি তিনি যখন আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেন।
এটা কোন গল্পের মধ্য পরে ,,আলতু ফালতু কাহিণী । কথার বা লেখার কোন শেষ নাই ।।
এটা কোন গল্পের মধ্য পরে ,,আলতু ফালতু কাহিণী । কথার বা লেখার কোন পঙ্গপ্তির সাথে কোন কথা সামঞ্জ্যতা নাই ।।