২. জড়ের অস্তিত্ব
এই অধ্যায়ে আমাদের জিজ্ঞাসা জড়ের কোন-না-কোনভাবে অস্তিত্ব আছে কিনা।
এরকম কোন টেবিল আছে কি যা অন্তর্নিহিত স্বভাব রয়েছে এবং আমি টেবিলের দিকে না তাকালেও যার অস্তিত্ব থাকবে, নাকি টেবিলটি শুধুই আমার কল্পনার বস্তু মাত্র, আমার এক দীর্ঘায়িত স্বপ্নের ভেতর একটি স্বপ্ন-টেবিল?
এই প্রশ্নটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা যদি আমরা বস্তুর স্বাধীন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারি তাহলে আমরা অন্যের দেহের অস্তিত্ব সম্পর্কেও নিশ্চিত হতে পারবো না, এবং সেক্ষেত্রে অন্যের মনের সম্পর্কে আরও কম নিশ্চিত হবো, কেননা তাদের মনের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস করার কোন ক্ষেত্রই থাকবে না আমাদের, শুধুমাত্র তাদের দেহ অবলোকন করা ছাড়া। এভাবে যদি আমরা বস্তুর স্বাধীনসত্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারি, তাহলে আমরা মরুভূমিতে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বো এরকম হয়তো হবে যে সমস্ত বাইরের পৃথিবী স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নস্ত্র এবং আমরা শুধুমাত্র রয়েছি। এটি একটি অসুবিধাজনক সম্ভাবনা, কিন্তু এই সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা বলে প্রমাণিত কব্রা না গেলেও একে সত্য মনে করারও কোন কারণ নেই। এই অধ্যায়ে এই রকম অবস্থা কেন হয়, তা আমরা পর্যালোচনা করবো।
সন্দেহজনক বিষয়ের অবতারণা করার আগে, আসুন আমরা কোন একটি অপেক্ষাকৃত নিশ্চিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুরু করি। টেবিলের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা সন্দিহান হলেও টেবিলের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত, যার মাধ্যমে আমরা টেবিলকে চিন্তা করি, সে সম্পর্কে আমরা কোন সন্দেহ করছি না। আমরা সন্দেহ করছি না যে যখন আমরা দেখি তখন কোন একটি বর্ণ বা আকার আমাদের সামনে আসে, যখন আমরা ধাক্কা মারি তখন কঠোর কোন কিছুর অস্তিত্ব আমাদের সকলের অনুভূত হয়। এই সমস্ত মানসিক বিষয় সম্পর্কে আমরা কোন প্রশ্ন তুলছি না। আসলে যা কিছুই সন্দেহজনক হোক না কেন, কোন কিছুকে অন্তত আমাদের তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতায় একেবারে নিশ্চিত বলে মনে হয়।
দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা, একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যা এখনও ফলপ্রদভাবে ব্যবহার করা যায় প্রণালীবদ্ধ সন্দেহ পদ্ধতি। তিনি ঠিক করেছিলেন যে তিনি এমন কিছুকে সত্য বলে বিশ্বাস করবেন না যা তিনি সম্পূর্ণ পরিস্কার এবং স্বচ্ছভাবে দেখতে পারছেন না।
যা কিছুকে সন্দেহ করা যায় তাকে তিনি সন্দেহ করবেন, যতক্ষণ না এই সন্দেহ না করার পেছনে যুক্তি প্রদর্শন করা যাচ্ছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে তিনি ক্রমশ নিশ্চিত হলেন যে শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায়। তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন এক প্রতারণাপূর্ণ দৈত্যকে যে তার ইন্দ্রিয়ের সামনে অসত্য বস্তুগুলোকে চির কল্পনার মত সাজিয়ে রেখেছে। এরকম দৈত্য থাকার সম্ভাবনা হয়তো নেই, কিন্তু তার এটা সম্ভব, সুতরাং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তু সম্পর্কে সন্দেহ সম্ভব।
কিন্তু নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করা সম্ভব নয়, কেননা যদি তিনি অস্তিত্বশীল না হন তাহলে কোন দৈত্যই তাকে প্রতারিত করতে পারবে না। যদি তিনি সন্দেহ করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই অস্তিত্ববান। যদি তার কোনরকম অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, তাহলে তিনি অবশ্যই অস্তিত্বশীল। সুতরাং তাঁর নিজের অস্তিত্ব তাঁর কাছে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তার প্রতীক। তিনি বলেছিলেন, আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি (Cogito, ergo sum) এবং এই নিশ্চয়তার উপর নির্ভর করেই তিনি তার জ্ঞানের জগৎ আবার গড়ে তুলেছিলেন যে জগৎ তার সন্দেহ ধ্বংস করে দিয়েছিল। সন্দেহের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই যে সবচেয়ে নিশ্চিত তা দেখিয়ে দেকার্ত দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছিলেন এবং এই অবদান এখনও দর্শনের সমস্ত শিক্ষার্থী স্মরণ করে থাকে।
কিন্তু দেকার্তের এই যুক্তি আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমিকে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা প্রয়োজন, কেননা এই যুক্তি নিশ্চিত সত্যতা ছাড়া আরও কিছু বলছে।
এটা মনে হতে পারে যে আমাদের এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে গতকালের আমরা এবং আজকের আমরা একই ব্যক্তি এবং এটা কোন অর্থে সত্য। কিন্তু প্রকৃত টেবিলের মত প্রকৃত আত্মায় উপনীত হওয়া কঠিন এবং সেই নিশ্চিত সত্যতা এতে থাকছে না যা বিশেষ অভিজ্ঞতায় থাকে। যখন আমি আমার টেবিলের দিকে তাকাই এবং কোন বিশেষ বাদামি রঙ দেখি, তখন তাৎক্ষণিকভাবে একটা নিশ্চিত নয় যে আমি বাদামি রঙ দেখছি, বরং, একটি বাদামি রঙ দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্যই কোন কিছু বা কেউ জড়িত রয়েছে, যা বা যে এই বাদমি রঙ দেখছে। কিন্তু এর মধ্যে কোনভাবেই স্থায়ী ব্যক্তি নেই যাকে আমরা আমি বলতে পারি। তাৎক্ষণিক নিশ্চয়তা অনুযায়ী এটা সম্ভব যে যা বাদামি রঙ দেখছে তা হয়তো মুহূর্তে স্থায়ী এবং তা সেই বস্তু নয় যার পরবর্তী মুহূর্তে অন্য অভিজ্ঞতা হচ্ছে।
এভাবে আমাদের বিশেষ চিন্তা ও অনুভূতিরই আদি নিশ্চয়তা রয়েছে এবং এটা স্বাভাবিকভাবে দেখা সব স্বপ্ন ও প্রমাদেও প্রয়োগ করা যায়। যখন আমরা স্বপ্ন বা ভূত দেখি, তখন আমাদের নিশ্চিতভাবে সেই অনুভূতি হয় যা আমরা চিন্তা করি আমাদের হচ্ছে, কিন্তু বিভিন্ন কারণবশত মনে করা হয় যে এসব ইন্দ্রিয়-অনুভূতির সঙ্গে বাস্তবিক বস্তুর কোন মিল নেই। সুতরাং আমাদের জ্ঞানের অভিজ্ঞতার নিশ্চয়তাকে কোন বিশেষ ঘটনার জন্য কোনভাবে বাধাপ্রাপ্ত করা উচিত নয়। এভাবে আমরা একটি দৃঢ় ভিত্তিতে উপনীত হয়েছি যেখান থেকে আমরা জ্ঞানের অন্বেষণ শুরু করতে পারি।
এই বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করতে হবে। ধরে নেয়া যাক আমরা ইন্দ্রিয় উপাত্ত সম্পর্কে নিশ্চিত। আমাদের কি কোনও কারণ আছে এই উপাত্তগুলোকে কোন কিছুর অস্তিত্বের প্রতীক বলে মনে করার, যাকে বলে আমরা বাহ্য বস্তু বলতে পারি? যখন আমরা সমস্ত ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সাজিয়ে দিই যা টেবিলের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে জড়িত, তখন আমরা কি টেবিলের সম্বন্ধে সব বলে দিই, নাকি আরও কিছু থাকে-আরও কিছু যা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত নয়, আরও কিছু যা তখনও থাকবে যখন আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবো? সাধারণ জ্ঞান বিন্দ্বিধায় বলবে কিছু একটা আছে। যাকে আনা যায়, বিক্রি করা যায়, ঠেলা যায়, উপরে কাপড় ঢাকা দেয়া যায় এবং আরও অনেক কিছু করা যায়, তা কখনই শুধুমাত্র কতকগুলো ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সমাবেশ হতে পারে না। যদি কাপড়টি টেবিলটিকে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে ফেলে, তাহলে আমরা টেবিল থেকে কোন ইন্দ্রিয়-উপাত্ত পাব না। সুতরাং টেবিলটি যদি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সমাহার হয় তাহলে টেবিলটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং কাপড়টি শূণ্যে ঝুলতে থাকবে, সেই জায়গায় কোনও এক অদৃশ্য শক্তির দ্বারা অবস্থান করবে যেখানে পূর্বে টেবিলটি ছিল। পুরো ব্যাপারটিই সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। কিন্তু যারা দার্শনিক হতে চান তাঁদের এই ধরনের অবিশ্বাস্যতায় ভয় পেয়ে চলবে না।
আমরা কেন ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়া একটি স্থায়ী বাহ্য বস্তু চাই তার স্বপক্ষে একটি বড় যুক্তি হল এই যে, আমরা একই বস্তু বিভিন্ন ব্যক্তিদের জন্য চাই। যখন দশজন ব্যাক্তি একটি ডিনার-টেবিলে বসে, তখন এটা বললে খুবই অদ্ভুত শোনাবে যে তারা একই টেবিল-ঢাকনা দেখছে না এবং একই ছুরি-কাঁচি এবং একই চামচ-গ্লাস দেখছে না। কিন্তু ইন্দ্রিয়-উপাত্তগুলো প্রত্যেক আলাদা ব্যক্তির কাছে ব্যক্তিগত, যা তাৎক্ষণিকভাবে একজনের কাছে দৃশ্যগোচর তা আরেকজনের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যগোচর নয়। প্রত্যকেই বিষয়গুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছে এবং ফলত বিষয়গুলোকে কিছুটা আলাদা দেখছে। এভাবে, যদি কোন নিরপেক্ষ সাধারণ বিষয় থাকতে হয় যা বিভিন্ন লোকের কাছে জানা, তাহলে ব্যক্তিগত এবং বিশেষ ইন্দ্রিয়-উপাত্তের বাইরে কিছু একটা থাকতে হবে যা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে দৃশ্যমান হয়। এটি বিশ্বাস করার স্বপক্ষে কি যুক্তি আছে যে এ রকম সাধারণ নিরপেক্ষ কোনও বস্তু রয়েছে?
এর প্রথম যে উত্তর একজনের কাছে স্বাভাবিকভাবে আসে তা হলো-যদিও বিভিন্ন ব্যক্তি টেবিলটিকে কিছুটা আলাদাভাবে দেখছে, তা সত্ত্বেও তারা কোন না কোনভাবে একই বিষয় দেখছে টেবিলের দিকে তাকানোর সময় এবং তাদের দেখার পার্থক্যটা স্থানগত ও আলোর প্রতিফলনের সূত্রের জন্য হচ্ছে আর সমস্ত ইন্দ্রিয়-উপাত্তের নিচে একটি স্থায়ী টেবিলে আসা সহজ হচ্ছে।
আমি আমার টেবিলটি এই ঘরের পূর্বের বাসিন্দার কাছ থেকে কিনেছি, কিন্তু আমি তার ইন্দ্রিয়-উপাত্ত কিনতে পারিনি, যা তার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হয়েছে, কিন্তু আমি কিনতে সক্ষম হয়েছি এবং কিনেছি প্রায় এই ধরনের ইন্দ্রিয় উপাত্ত। সুতরাং এটা সত্য যে বিভিন্ন ব্যক্তির একই ইন্দ্রিয়-উপাত্ত রয়েছে এবং কোন এক ব্যক্তি কোন এক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই ইন্দিয়-উপাত্তের অধিকারী যা আমাদের মনে করিতে সাহায্য করে যে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়াও স্থায়ী বাহ্য বস্তু রয়েছে যা সময়ের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের কারণ।
এখন উপরিউক্ত আলোচনাটি নির্ভর করছে এর উপর যে আমরা ছাড়াও অন্যান্য ব্যক্তি রয়েছে।
অন্যান্য ব্যক্তি আমার কাছে উপস্থাপিত হয় নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মাধ্যমে, যেমন তাদের দেখা বা তাদের গলার শব্দের দ্বারা এবং যদি আমার বিশ্বাস করার কোন কারণ না থাকে যে আমার ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়া স্বাধীনভাবে বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে, সেক্ষেত্রে আমার এও বিশ্বাস করার কারণ থাকছে না যে অন্য ব্যক্তিদেরও অস্তিত্ব রয়েছে শুধুমাত্র আমার স্বপ্নের গন্ডি ছাড়া।
এভাবে যখন আমরা দেখাবার চেষ্টা করি যে আমাদের নিজেদের ইন্দ্রিয় উপাত্ত ছাড়াও বাহ্য বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে, তখন আমরা অন্যের বিশ্বাসের সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করতে পারি না, যেহেতু এটিও ইন্দ্রিয় দ্বারা তৈরি এবং অন্যের অভিজ্ঞতাকে প্রকাশিত করতে পারছে না-যতক্ষণ পর্যন্ত এটা বলা না যাচ্ছে যে আমাদের নিজেরদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত স্বাধীন বাহ্য বস্তুর অস্তিত্বের প্রতিক মাত্র। সুতরাং সম্ভব হলে আমরা আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে সেই লক্ষণগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করবো যা দেখায় বা দেখানোর চেষ্টা করে যে জগতে আমরা এবং আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়াও বাহ্য বস্তু রয়েছে।
এটা অবশ্য স্বীকার্য যে এক অর্থে কখনই নিজেকে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার সাহায্য ছাড়া বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারবো না। কোন যৌক্তিক অসম্ভব এই প্রকল্প থেকে আসছে না যে এই জগৎ শুধু আমি এবং আমার চিন্তা, অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়-অনুভূতি দিয়ে তৈরি এবং বাদবাকী সবকিছুই হল স্রেফ কল্পনা। স্বপ্নে কোন এক জটিল জগৎ উপস্থাপিত করা সম্ভব, জাগার পর যা নিছক কল্পনায় পরিণত হতে পারে। আমরা দেখছি স্বপ্নের ইন্দ্রিয় উপাত্তের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর কোন মিল নেই, যা আমরা স্বাভাবিকভাকেই ইন্দ্রিয় উপাত্তের মাধ্যমে অনুমান করে থাকি (এটা সত্যি যে যখন বাহ্য জগৎ অনুমান করা হয়, তখন স্বপ্নের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের বাহ্য কারণ সংগ্রহ করা সম্ভব, যেমন দরজার আওয়াজ আমাদের নৌ-ঘটিত চুক্তির স্বপ্নের কারণ হতে পারে। যদিও এই ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের বাহ্য কারণ রয়েছে, কিন্তু সত্যিকারের নৌ-যুদ্ধের সঙ্গে মিল রয়েছে এ রকম কোন ইন্দ্রিয়-উপাত্তের বাহ্য বস্তু খুঁজে পাওয়া যাবে না)।
এই ধরনের অনুমানে কোন যৌক্তিক অসুবিধা নেই যে আমাদের সমস্ত জীবন হল একটি স্বপ্ন, যেখানে আমরা নিজেরা সমস্ত বস্তু তৈরি করি যেগুলো আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। এটা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব না হলেও একে সত্যি মনে করার কোন কারণ নেই এবং এটা অনেক সহজ প্রকল্প যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের জীবনের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারি সাধাণের মতের থেকে, যেখানে ব্যাক্তি ছাড়া বাহ বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় এবং যে বাহ্য বস্তু আমাদের ইন্দ্রিয়-অনুভূতির কারণ হয়।
বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব সত্যিই আছে বলে ধরে নিলে কিভাবে সহজতা আসে তা অনায়াসেই বোঝা যেতে পারে। যদি একটি বিড়াল ঘরের কোন এক অংশে কোন এক মুহূর্তে দেখা দেয় এবং অন্য মুহূর্তে অন্য অংশে, তাহলে এটা মনে করাই স্বাভাবিক যে বিড়ালটি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়েছে, বিভিন্ন অবস্থান পেরিয়ে। কিন্তু যদি এটি শুধুমাত্র ইন্দিয়-উপাত্তের সমষ্টি হয় তাহলে সে সেই জায়গায় থাকতে পারবে না যেখানে আমি তাকে দেখিনি। সেক্ষেত্রে আমাদের মনে করতে হবে যে আমি যখন দেখছি না তখন বিড়ালটির অস্তিত্ব নেই, বরং হঠাৎ কোন নতুন জায়গায় গজিয়ে উঠেছে সে। আমার দেখা বা না দেখার উপর যদি বিড়ালটির অস্তিত্ব নির্ভর না করে, তাহলে আমরা আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি একবার খাওয়া এবং তার পরের খাওয়ার মধ্যে কিভাবে সে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ছে, কিন্তু আমার না দেখার উপর যদি এর অস্তিত্ব নির্ভর করে তাহলে এটি অস্বাভাবিক যে তার অস্তিত্বশীল থাকার সময় মতোই দ্রুতগতিতে তার ক্ষুধা বেড়ে চলেছে। বিড়ালটি যদি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় উপাত্ত দ্বারা গঠিত হয় তাহলে সে ক্ষুধার্ত হতে পারে না, কেননা শুধুমাত্র আমার নিজের ক্ষুধা ছাড়া অন্য কোন ক্ষুধা আমার কাছে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হতে পারে না। সুতরাং যে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের ব্যবহার আমার কাছে বিড়ালটিকে উপস্থাপিত করছে, তাকে ক্ষুধার প্রকাশ হিসেবে দেখা হলে খুবই স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু যখন তাকে শুধুমাত্র বর্ণ পরিবর্তন ও নিছক নড়াচড়া বলে গ্রহণ করা হয় যা নাকি ক্ষুধা প্রকাশে অসমর্থ, তখন তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে ঠিক যে রকম একটি ত্রিভুজ ফুটবল খেলতে অসমর্থ।
কিন্তু বিড়ালটির ক্ষেত্রে এই অসুবিধা মানুষের ক্ষেত্রের অসুবিধার তুলনায় কিছুই নয়। যখন মানুষেরা কথা বলে অর্থাৎ যখন আমরা কোন শব্দ শুনি যা আমরা ধারণার সঙ্গে পাই এবং একই সঙ্গে যখন আমরা ঠোঁটের নড়াচড়া এবং মুখের পরিবর্তন দেখি, তখন এটা ভাবা খুবই কষ্টকর যে আমরা যা শুনছি তা কোন চিন্তার অভিব্যক্তি নয়, যা ওই একই কথা উচ্চারিত হলে হওয়া উচিত বলেই আমরা জানি। অবশ্য এই একই ঘটনা স্বপ্নেও ঘটে যেখানে আমরা ভ্রমবশত অন্য ব্যক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করি। কিন্তু স্বপ্ন সাধারণত জাগরিত অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কোন না কোনভাবে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব যদি আমরা মনে করি যে বাহ্য জগতে সত্য আছে। এভাবে সমস্ত সহজতার সূত্র আমাদের এই প্রাকৃতিক মত গ্রহণ করতে বলে যে আমরা এবং আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত ছাড়াও বাহ্য বস্তু সত্যই আছে এবং তাদের অস্তিত্ব আমাদের দেখার উপর নির্ভর করে না।
অবশ্য শুধুমাত্র যুক্তির দ্বারা আমরা স্বাধীন বাহ্য জগতে সত্য আছে এই বিশ্বাসে উপনীত হইনি। যখনই আমরা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করি, তখনই দেখি এই বিশ্বাস আমাদের ভিতরে রয়েছে। একে প্রবৃত্তিগত বিশ্বাস বলা যায়। আমরা এই বিশ্বাস সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তুলি না শুধুমাত্র তখনই, যখন দেখার ক্ষেত্রে মনে হয় যেন ইন্দ্রিয়-উপাত্তটি নিজেই স্বাধীন বস্তু হিসেবে প্রবৃত্তিগতভাবে বিশ্বাস জাগায়, কিন্তু যুক্তি প্রমাণ করে যে বস্তুটি কখনও ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হতে পারে না। এই আবিষ্কারটি, যেটি মোটেই স্বাদ, ঘ্রাণ এবং শব্দের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর নয়, শুধুমাত্র স্পর্শের ক্ষেত্রে সামান্য বিভ্রান্তিকর- আমাদের প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসকে কমিয়ে দেয় যে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে বাহ্য বস্তু রয়েছে। যেহেতু এই বিশ্বাস কোন অসুবিধার সৃষ্টি করে না বরং আমাদের অভিজ্ঞতার আরও সরলীকরণ করতে সাহায্য করে, তাই একে অস্বীকার কার কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং আমরা স্বীকার করতে পারি যদিও স্বপ্নের থেকে পাওয়া ক্ষীণ সন্দেহ সমেত-যে বাহ্য জগত সত্যিই রয়েছে এবং এটি সম্পূর্ণভাবে আমাদের অনুভূতির উপর নির্ভরশীল নয়।
যে যুক্তির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হয়েছি তা আমাদের কাঙ্কিত যুক্তির মতো ততটা জোরালো নয় ঠিকই, কিন্তু বহু দার্শনিক যুক্তির ক্ষেত্রেই তা সত্য এবং এ কারণে এটির সাধারণ চরিত্র ও সত্যতা সংক্ষেপে বিচার করা যায়। আমরা দেখেছি যে সমস্ত জ্ঞানকেই আমাদের প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসের উপর গড়ে তোলা উচিত এবং যদি এদের বাতিল করা হয় তাহলে কিছুই থাকে না। কিন্তু আমাদের এই প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসগুলোর মধ্যে কোনটি অন্যের থেকে বেশি শক্তিশালী, আবার কোনটি স্বভাব এবং সংযোগের জন্য অন্য বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত, যা প্রবৃত্তিগত নয়, কিন্তু যাকে ভ্রমবশত প্রবৃত্তিগত নয়, কিন্তু যাকে এমবশত প্রবৃত্তিতের অন্তর্গত বলে মনে করা হয়।
দর্শন আমাদের এই প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসের উচ্চ নীচ শেখায়, তার শুরু সেই বিশ্বাসগুলো দিয়ে যা আমরা কাঠোরভাবে বিশ্বাস করি এবং প্রত্যেকটি বিশ্বাসকে আলাদাভাবে উপস্থাপিত করে ও অপ্রাসঙ্গিকতা হাত থেকে রক্ষা করে। এটি দেখায় কিভাবে এগুলো চূড়ান্তভাবে রয়েছে, যা আমাদের প্রবৃত্তিগত বিশ্বাসে দ্বন্দ্ব জাগায় না বরং একটি সুসামঞ্জস্য প্রণালীতে পরিণত করে। কোন একটি প্রবৃত্তিগত বিশ্বাস পরিত্যাগ করার স্বপক্ষে এরকম কোন কারণ থাকতে পারে না, শুধুমাত্র তখনই যখন এটি অন্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে। এভাবে যদি এদের ঐক্যবদ্ধ দেখা যায় তাহলে সমস্ত প্রণালীটিই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
এটা অবশ্য সম্ভব যে সমস্ত বা কোন একটি বিশ্বাস ভুল হতে পারে, এবং এই কারণে সবকিছুকেই একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা উচিত। কিন্তু যতক্ষণ না অন্য একটি বিশ্বাস আসে ততক্ষণ আমাদের কোন একটি বিশ্বাস পরিত্যাগ করা উচিত নয়।
সুতরাং আমাদের প্রবৃত্তিগত বিশ্বাস ও তাদের ফলাফলকে সুসংগঠিত করে, এদের মধ্যে কোনটি বিশ্বাসযোগ্য তা দেখে, যদি দরকার হয় পরিবর্তিত বা পরিত্যাগ করে, আমরা এই প্রবৃত্তিগত ভিত্তিতে সুসংহত জ্ঞানে পৌঁছতে পারি,
যেখানে ভুল হবার সম্ভাবনা থেকে গেলেও তার সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যায় বিভিন্ন অংশের সংযোগের সাহায্যে এবং বিচারপূর্ণ আলোচনার সাহায্যে, নাকি পূর্বে ছিল। এই কাজটি অন্তত দর্শন করতে পারে। বেশির ভাগ দার্শনিক ঠিক বা ভুলভাবে বিশ্বাস করেন যে দর্শন এর থেকে বেশি কিছু করতে পারে, এটি আমাদের সামগ্রিকভাবে এই জগৎ সম্বন্ধে এবং সত্যের স্বভাব সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে পারে, যা অন্যভাবে পাওয়া যায় না। এটি সঠিক কিনা তা বলা না গেলেও দর্শনের কাজ সম্বন্ধে আমরা যা বলেছি তা অবশ্যই দর্শন করতে পারে এবং এটা তাদের কাছে যথেষ্ট যারা একবার সাধারণ জ্ঞানের যথার্থতা সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং দার্শনিক সমস্যাগুলো যে যথেষ্ট কঠিন তাও মনে করেন।