০২. চার বান্ধবী

কাল রাতে চার বান্ধবী জরীকে নিয়ে একখাটে ঘুমিয়েছিল। এরা অনেক দিন পর একসঙ্গে হয়েছে। লায়লার সঙ্গে জরীর দেখা হয়েছে প্ৰায় চার বছর পর। আভা ও কনক ময়মনসিংহ থাকলেও দেখাসাক্ষাৎ প্রায় হয় না বললেই চলে। রুনু জরীর দূরসম্পর্কের বোন। স্কুলের পড়া শেষ হবার পর একমাত্র তার সঙ্গেই জরীর রোজ রোজ দেখা হত। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে শেলী ও ইয়াসমীন আসে নি।

অনেক দিন পর মেয়ে বন্ধুরা একত্রিত হলে একটা দারুণ ব্যাপার হয়। আচমকা সবার বয়স কমে যায়। প্রতিনিয়ত মনে হয় বেঁচে থাকাটা কী দারুণ সুখের ব্যাপার!

জরীর বন্ধুরা গত পরশু থেকে ক্লান্তিহীন হৈচৈ করে যাচ্ছে। গুজগুজ করে খানিকক্ষণ গল্প, পরমুহুর্তেই উচ্ছ্বসিত হাসি। আবার খানিকক্ষণ গল্প, আবার হাসি। এক জনকে হয়তো দেখা গেল। হঠাৎ কী কারণে দল ছেড়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। তার পিছনে পিছনে ছুটছে বাকি সবাই। খিলখিল হাসির শব্দে সচকিত হয়ে উঠছে। বাড়ির লোকজন।

গতরাতটা তাদের জেগেই কেটেছে। আভা তার প্রেমের গল্প বলেছে। রাত একটা পর্যন্ত। তার প্রেমিকটি এক জন অধ্যাপক। আভার বর্ণনানুসারে দারুণ স্মার্ট ও খানিকটা বোকা। সে তার স্মার্ট প্রেমিকটির দুটি চিঠিও নিয়ে এসেছিল বন্ধুদের দেখাতে। কাড়াকড়ি করে দেখতে গিয়ে সে চিঠির একটি ছিঁড়ে কুটিকুটি। অন্যটি থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবাই বানান ভুল বের করতে লাগল। এক-একটি ভুল বের হয়, আর আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সবাই।

মাঝরাতে লায়লার হঠাৎ চা খাবার ইচ্ছে হল। কনক বলল, চমৎকার, চল সবাই–ছাদে বসে চা খাই।

রুনুরাজি হল না। তার নাকি ঘুম পাচ্ছে। সে বলল, এই শীতে ছাদে কেন? এখানেই তো বেশ গল্পগুজব করছিস।

কনক বলল, ছাদে আমি গান শোনাব। সঙ্গে সঙ্গে দলটি চেঁচিয়ে উঠল। গত দু দিন ধরেই কনককে গাইবার জন্যে সাধাসাধি করা হচ্ছে। লাভ হয় নি। কনক কিছুতেই গাইবে না। লায়লা এক বার বলেই ফেলল, একটু নাম হয়েছে, এতেই এত তেল? টাকা না পেলে আজকাল তুই আর গাস না?

কনক কিছু বলে নি, শুধু হেসেছে।

ধুপধাপ শব্দ করে সবাই যখন ছাদে উঠল, তখন নিশীথ রাত। চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। জরী বলল, দুর ছাই, জোছনা নেই। আমি ভেবেছিলাম জোছনা আছে।

আভা বলল, আমার ভয় করছে ভাই, গাছের ওপর ওটা কি?

ওটা হচ্ছে তোর অধ্যাপক প্রেমিকের এঞ্জেল বডি। তোকে দেখতে এসেছে।

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। এই হাসির মধ্যেই গান শুরু করল কনক, সঘন গহন রাত্রি–

গান শুরু হতেই সবাই চুপ করে গেল। আভা চাপা গলায় বলল, কী সুন্দর গায়। বড়ো হিংসা লাগে।

কনকের গলা খুব ভালো। ছোটবেলায় কিন্তু কেউ বুঝতে পারে নি, অল্প সময়ে কনকের এত নাম-ডাক হয়ে যাবে। রেডিওতে প্রথম যখন গায় তখন সে কলেজে পড়ে। তার পরপরই তার গানের প্রথম ডিস্ক বের হয়–যার এক পিঠে আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই অন্য পিঠে ওগো শেফালী বনের মনের কমিশন।

কনক পরপর চারটি গান গাইল। গানের মাঝখানে জরীর মা চায়ের পট নিয়ে মৃদু অনুযোগের সুরে বললেন, নাও তোমাদের চা! এত রাত্রে ছাদে গান-বাজনা কি ভালো? চা খেয়ে ঘুমুতে যাও সবাই।

কেউ নড়ল না। রুনু বলল, কনক, আজ সারা রাত তোমাকে গাইতে হবে।

জরীর মা-ও এক পাশে বসে পড়লেন। জরীর বড়োচাচাও উঠে এলেন ছাদে। আসর যখন ভাঙল তখন রাত দুটো। জরীর বড়োচাচা বললেন, বড়ো ভালো লাগল মা, বড়ো মিঠা গলা। জরীর গলাও ভালো ছিল। কিন্তু সে তো আর শিখল না।

আভা বলল, এখন শিখবে।

সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল। কনক বলল, আপনার একটা গান শুনি?

অন্য দিন, আজ অনেক রাত হয়েছে। তোমরা ঘুমুতে যাও।

সে-রাতে করোরই ভালো ঘুম হল না। জরীর বড্ড মন কেমন করতে লাগল। তার ইচ্ছে করল মার কাছে গিয়ে ঘুমোয়। কিন্ত সে মড়ার মতো পড়ে রইল। আভা একবার ডাকল, জরী, ঘুমিয়েছিস? জারী তার জবাব দিল না। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। শুধু জরী জেগে রইল। বিয়ের আগের রাতে কোনো মেয়ে কি আর ঘুমুতে পারে?

ইনিয়ে বিনিয়ে ভৈরবীর সুরে সানাই বাজছে। যে-সুরটি ওঠানামা করছে সেটি যেন একটি শোকাহত রমণীর বিলাপ। অন্য যে-সুরটি ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে সেটি যেন বলছে–কেন্দো না মেয়ে, শোন, তোমাকে কী চমৎকার গান শোনাচ্ছি।

জরীর বন্ধুদের ঘুম ভেঙেছে। জারী ঘরে নেই। লায়লা গাঢ় স্বরে ডাকল, ও কনক, কনক।

কি?

সানাই শুনছিস?

শুনছি।

ভালো লাগছে তোর?

না। খুব মন খারাপ করা সুর।

তারা সবাই ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। আভা গলা উঁচিয়ে ডাকলে, জরী, জরী : জর ছাদ থেকে আসতেই সবাই দেখল, তার চোখ ঈষৎ রক্তাভ ও ফোলা ফোলা। রুনু বলল, রাতে তোর ঘুম হয় নি, না রে?

খুব হয়েছে।

এখন তোর কেমন লাগছে। জারী?

কেমন আর লাগবে। ভালোই। আয়, বাগানে বেড়াতে যাই।

তারা বাগানে নেমে গেল। এ-বাড়ির বাগানটি পুরনো। জরীর দাদার খুব ফুলের শখ ছিল। মালী রেখে চমৎকার বাগান করেছিলেন। বসরাই গোলাপের প্রকাণ্ড একটি ঝাড় ছাড়া এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বাড়ির সর্ব-দক্ষিণে বেশ কিছু হানুহেনাগাছ আছে। সেখানে হাঁটু উঁচু বড়ো বড়ো ঘাস গজিয়েছে। ওদিকটায় কেউ যায় না।

আভা বলল, এত সুন্দর বাগান, কেউ যত্ন করে না কেন রে?

জরী বলল, বাগানের শখ নেই কারো। এক পরী আপার ছিল, সে তো আর থাকে না এখানে।

লায়লা বলল, পরী। আপা কি আগের মতো সুন্দর আছে?

এলেই দেখবি।

কখন আসবেন?

সকাল সাড়ে আটটায়, ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসে।

কনক বলল, এত বড়ো গোলাপ হয় নাকি, আশ্চর্য জরী, গোলাপ তুলব একটা?

তোল না।

চার জন অলস ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সবাই কিছু পরিমাণে গভীর। লায়লা ঘনঘন কাশছে। কাল রাতে তার ঠাণ্ডা লেগেছে। কনকের দেখাদেখি সবাই গোলাপ ছিঁড়ে খোঁপায় গুজেছে। আভা। হঠাৎ করে বলল, তোদের এখানে বকুলগাছ নেই, না?

উঁহু।

আমার হঠাৎ বকুলফুলের কথা মনে পড়ছে। আমাদের স্কুলের বকুলগাছটার কথা মনে আছে তোদের?

সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। স্কুলের বকুলগাছটা নিয়ে অনেক মজার মজার ব্যাপার আছে।–

জরীর মা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের দেখছিলেন। তিনি সেখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলেন, ও জরী, জারী।

কী মা?

কী করছিস তোরা?

কনক বলল, বেড়াচ্ছি–আপনিও আসুন না খালাম্মা।

জরীর মা হাসিমুখে নেমে এলেন। মনে হল মেয়েদের দলে এসে তাঁর বয়স যেন হঠাৎ করে কমে গিয়েছে। তিনি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, গত রাতে একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, জরী যেন খুব ছোট হয়ে গিয়েছে। ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাগানে। আর জেগে দেখি সত্যি তাই।

বললেই হল। আমি বুঝি ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি?

জরীর মা হাসতে লাগলেন। হালকা গলায় বললেন, আমার যখন বিয়ে হয়, তখন এ বাগানটা আরো বড়ো ছিল। আমি রোজ সকালে এখানে এসে একটা করে ফুল খোপায় গুজতাম।

বলেই তিনি হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেলেন। লায়লা বলল, আসুন খালা, আজ আপনার খোঁপায় ফুল দিয়ে দি।

কী যে বল মা, ছিঃ ছিঃ!

কিন্তু ততক্ষণে কনক একটি ফুল ছিঁড়ে এনেছে। জরীর মা আপত্তি করবার আগেই তারা সেটি খোঁপায় পরিয়ে দিল। তিনি বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমি তোমাদের চায়ের যোগাড় করি। আর দেখ, হাস্নুহেনা-ঝাড়ের দিকে যেয়ো না। খুব সাপের আড্ডা ঐদিকে।

শীতকালে সাপ কোথায় খালা?

না থাক, তবুও যাবে না।

জরীর মা চলে যেতেই আভা বলল, খালা এখনো যা সুন্দর, দেখলে হিংসা লাগে।

পরী আপাও ভীষণ সুন্দর। তাই না জরী?

হ্যাঁ। আর আমি কেমন?

পরী আপা ফার্স্ট ক্লাস হলে তুই ইন্টার ক্লাস, আর আমাদের কনক হচ্ছে এয়ারকণ্ডিশণ্ড ফার্স্ট ক্লাস।

কনক একটু গম্ভীর হয়ে পড়ল। জরীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোর খুব মায়াবী চেহারা জরুরী। রূপবতী হওয়া খুব বাজে ব্যাপার।

বাজে হলেও আমি রূপবতী হতে রাজি।

সবাই হেসে উঠলেও কনক হাসল না। অসাধারণ সুন্দরী হয়ে জন্মানীয় সে অনেক বার বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে। অনেক বার তার মনে হয়েছে, সাধারণ একটি বাঙালী মেয়ে হয়ে সে যদি জন্মাত! শ্যামলা রঙ, একটু বোকারোকা ধৰ্মনের মায়াবী চেহারা। কিন্তু তা হয় নি। পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টির নিচে অনেক যন্ত্রণার মধ্যে তাকে বড়ো হতে হয়েছে। অথচ ছোটবেলায় কেউ যখন বলত, কনকের মতো সুন্দর একটি মেয়ে দেখেছি আজ। তখন কী ভালোই না লাগত।

কুয়াশা কেটে রোদ উঠেছে। ধানী রঙের নরম রোদ। শিশিরভেজা মাটি থেকে আএ এক ধরনের গন্ধ আসছে। মেয়েদের দলটি গোল হয়ে বসে আছে শিউলিগাছের নিচে। এই গাছটি এক সময়ে প্রচুর ফুল ফোটাত। আজ তার আর সে-ক্ষমতা নেই। কয়েকটি সাদা সাদা ফুল পড়ে আছে। শীতের বাগানে যখন ধানী রঙের রোদ ওঠে এবং সেখানে যদি কয়েকটি মেয়ে চুপচাপ গোল হয়ে বসে থাকে, তাহলে বাগানের চেহারাই পাল্টে যায়। বড়োচাচা অবাক হয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *