গোলাম মওলা এসেছেন রুস্তমের কাছে। গোলাম মওলা রুস্তমের প্রাক্তন শ্বশুর। তাঁর কন্যা দিনার সঙ্গে রুস্তমের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে তিন বছর টিকেছিল।
গোলাম মওলা সাদা লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি পরেছেন। গায়ে তসরের চাদর। কিছুদিন আগেও তার গালভর্তি দাড়ি ছিল, এখন নেই। মাথার চুলে মেন্দি দিয়েছেন। চুল টকটকে লাল। গোলাম মওলা জর্দা দিয়ে পান চিবুচ্ছেন বলে ঘরময় জর্দার গন্ধ। গন্ধটা কড়া না মিষ্টি। তিনি বসেছেন দোতলার বারান্দায়। তার কোলের কাছে বাঁকানো বেতের লাঠি। রুস্তম লাঠিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে, উনি লাঠিটা মেঝেতে ছেড়ে দিলেই এটা একটা সাপ হয়ে যাবে। রুস্তমের খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছে।
রুস্তম ভালো আছ?
জি।
প্রায়ই তোমার কথা মনে হয়। আসা হয় না। আজ ঠিক করে রেখেছি। যত কাজই থাকুক তোমার এখানে একবার আসব।
লাঠিটা কোত্থেকে কিনেছেন?
ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে কিনেছি। দিনা কিনে দিয়েছে। লাঠিটা কি তোমার পছন্দ হচ্ছে?
জি।
রেখে দাও।
রুস্তম আগ্রহ করে লাঠি নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। খাটের সঙ্গে লাঠি দাঁড়া করিয়ে ফিরে এলো।
গোলাম মওলা বললেন, তোমার চিকিৎসা ঠিকমতো চলছে তো?
জি চলছে।
চিকিৎসায় অবহেলা করবে না। রোজ খানিকক্ষণ হাঁটবে। যে কোনো রোগের জন্য হাঁটা এবং ঘুমানো হলো মহৌষধ। আমি এই বয়সেও ঘড়ি ধরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটি। ডাক্তার আধঘণ্টা হাঁটতে বলেছিলেন, আমি পনের মিনিট বেশি হাঁটি।
রুস্তম বলল, অধিকন্ত ন দোষায়।
কী বললে?
বললাম, অধিকন্তু ন দোষায়, অর্থাৎ বেশিতে দোষ হয় না।
এটা কোন ভাষা?
সংস্কৃত।
তুমি সংস্কৃত জানো নাকি?
জি না। কিছু শ্লোক জানি।
গোলাম মওলা বললেন, তোমাদের বাড়ির ছাদ তো অনেক বড়, ছাদে নিয়ম করে হাঁটবে। সম্ভব হলে রোজ কালিজিরার ভর্তা খাবে। নবি-একরিম বলেছেন কালিজিরা মৃত্যু রোগ ছাড়া অন্য সব রোগের মহৌষধ
জি আচ্ছা।
এই বাড়ি নিয়ে তোমার সুঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। গুরুত্বপূর্ণ কথা। আজই বলব নাকি অন্য একদিন আসব?
আজই বলুন।
ব্যবসায় তোমার বাবা ছিলেন, আমার পার্টনার। সমান সমান পার্টনার। ধানমণ্ডির এই বাড়ির সন্ধান আমি তোমার বাবাকে দেই। বাড়ির মালিক থাকত অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। হুন্ডির মাধ্যমে তাকে টাকা পাঠাই। তোমার বাবার হাতে তখন টাকা ছিল না, পুরো টাকাটা আমি দেই। এরপর আমি একটা পুলিশি ঝামেলায় পড়ি। দুই মাসের জন্য ইন্ডিয়া চলে যাই। ঝামেলা মেটার পর ফিরে এসে দেখি তোমার বাবা এই বাড়ি তোমার নামে কিনেছে। নামজারি পর্যন্ত করিয়ে ফেলেছে। তুমি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছ?
জি আংকেল।
তুমি তো অন্যদিকে তাকিয়ে আছ।
আমি খুব মন দিয়ে যখন কথা শুনি তখন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি।
এটা জানতাম না। যাই হোক, শোনো, তোমার বাবা ভেবেছিল বাকি জীবন আমি ইন্ডিয়াতেই থাকব। দেশে ফিরতে পারব না। আমাকে ফিরে আসতে দেখে তার টনক নড়ল। একটা ফয়সালা হলো–বাড়ি সিক্সটি ফোর্টি মালিকানা হবে। সিক্সটি আমার ফোর্টি তোমার বাবার। তখন তোমার মা খুন হলেন। তোমার বাবা চলে গেলেন পুলিশ কাস্টডিতে। কথা কী বলছি মন দিয়ে শুনছ তো?
জি।
এই বাড়ি কেনার ইতিহাস নিয়ে তোমার বাবা কি কখনো তোমার সঙ্গে আলোচনা করেছে?
জি না।
আমার বিষয়ে কিছু বলেছে?
আপনার কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকতে বলেছে।
বলো কী?
আর বলেছেন, আপনার অবস্থান ইবলিশ শয়তানের তিন ধাপ নিচে।
তোমাকে ঠাট্টা করে বলেছে, তুমি বোঝো নাই। তুমি তো আবার ঠাট্টাতামাশা বোঝে না। যাই হোক, এখন বললা বাড়ি নিয়ে তুমি কি আমার সঙ্গে ফয়সালায় আসবে? সিক্সটি মালিকানা আমাকে বুঝিয়ে দিবে?
জি আচ্ছা।
কী বললা?
বললাম জি আচ্ছা।
তাহলে আমি কি উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করব কিভাবে কাজটা করা যায়?
পরামর্শ করুন।
তোমার মনে আবার এমন সন্দেহ হচ্ছে না তো যে, আমি ভুলিয়েভালিয়ে তোমার বাড়ি নিয়ে নিচ্ছি?
জি না।
বরং একটা কাজ করি, ফিফটি-ফিফটিতে যাই। ঠিক আছে?
জি ঠিক আছে।
তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি খুবই আনন্দ পেলাম। উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি শিগগিরই একদিন আসব। এখন বলো তোমার কিছু লাগবে?
একজন ভাড়াটে খুনি লাগবে।
কী লাগবে?
একজন ভাড়াটে খুনি, যে টাকার বিনিময়ে খুন করবে।
তোমার ভাড়াটে খুনি লাগবে? এইসব কী বলছ?
আমার লাগবে না। দুলাভাইয়ের লাগবে। দুলাভাই একজনকে খুন করাবেন।
কাকে খুন করাবে?
আফতাব চৌধুরী নামের একজনকে। বুবু তার সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
কবে?
গত শুক্রবারে।
বলো কী, সামিনা এই কাজ করেছে। ভাড়াটে খুনি-ফুনি এইসব ফালতু কথা। কাউন্সেলিং করে সব ঠিক করে ফেলব। তুমি তোমার দুলাভাই এবং সামিনার টেলিফোন নাম্বার দাও। আমি কথা বলব।
তাদের টেলিফোন নাম্বার তো আমার কাছে নাই। তারা যখন টেলিফোন করে তখনি আমি কথা বলি।
তোমার দুলাভাইয়ের বাসার ঠিকানা দাও।
ঠিকানা তো জানি না। বাসা চিনি। কলাবাগানে বাসা।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে কিছুই দিতে হবে না। আমি বের করে ফেলব। তাহলে তোমার সঙ্গে এই কথা রইল–একজন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে সঙ্গে করে তোমার কাছে আসব।
জি আচ্ছা। একটা বই নিয়ে যান। আপনি আমাকে লাঠি দিয়েছেন। লাঠির বদলে বই।
কী বই।
কবিতার বই। আমি একটা কবিতার বই লিখেছি, নাম রু আদের সাইকেল।
রু আদের সাইকেল জিনিসটা কী?
কবিতার বইয়ের নাম।
আচ্ছা দাও তোমার কবিতার বই। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই, ভোমার সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, তা গোপন রাখবে।
জি আচ্ছা।
আমাদের উচিত সর্ববিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা। আল্লাহপাক নিজেও গোপনীয়তা পছন্দ করেন বলেই তার সবকিছুই বাতেনি। বাতেনি কি জানো?
না।
বাতেনি হলো গুপ্ত। আচ্ছা উঠি। লাঠিটা কি সত্যি তোমার পছন্দ হয়েছে? বয়সের কারণে আমি এখন লাঠি ছাড়া চলাফেরা করতে পারি না। তাছাড়া লাঠিটা আমার মেয়ে দিনা পছন্দ করে কিনেছে। আমি তার উপহার অন্যকে দিয়ে দিয়েছি জানলে মনে কষ্ট পাবে।
দিনা কি আপনার সঙ্গে থাকে?
না। সে আলাদা থাকে। তার বাড়িতে যখন-তখন যাওয়াও যায় না। আর গেলেও সে তার ছেলেকে আমার সামনে আনে না।
আনে না কেন?
জানি না কেন। জিজ্ঞেস করি নাই। লাঠিটা নিয়ে আসো।
লাঠিটা আমার পছন্দ হয়েছে।
পছন্দ হলে আর কথা নাই। আচ্ছা শোনো, আমি যদি আগামীকাল সন্ধ্যায় উকিল নিয়ে আসি তোমার অসুবিধা হবে?
না।
আগামীকাল আসতে পারব মনে হচ্ছে না। অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, দেখি যত তাড়াতাড়ি পারি আসব।
জি আচ্ছা।
সামিনা তার স্বামীকে ছেড়ে চলে গেল কেন?
সাতটা কারণ আছে আংকেল। দুলাভাই সাতের ঝামেলায় পড়েছেন। দুলাভাইয়ের গায়ে পাঁঠার মতো দুর্গন্ধ, দুলাভাই হাঁ করে ঘুমান, সবের সামনে নাকের লোম ছিঁড়েন, বাথরুমে ফ্ল্যাশ টানেন না…
বাদ দাও, এইসব শুনতে ভালো লাগছে না।
গোলাম মওলা লাঠি ছাড়াই রওনা হলেন।
রাত দশটা। রুস্তম ইজিচেয়ারে বসে আছে, তার কোলে মোটা বাঁধানো খাতা। উপন্যাসটা আজ শুরু করবে কি না তা নিয়ে গত চল্লিশ মিনিট ধরে চিন্তা করছে। একটা প্যারা লিখে ফেলা উচিত। সে চোখ বন্ধ করে উপন্যাসের প্রথম প্যারা মনে মনে সাজাল।
এক শ্রাবণ মাসের দুপুরে শলারাম বাথরুমে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাড়িতে কেউ ছিল না। তার স্ত্রী সীতা গাউছিয়াতে সবুজ কাচের চুড়ি কিনতে গিয়েছিল। তার সব রঙের চুড়ি আছে কিন্তু সবুজ রঙের চুড়ি নাই। গাউছিয়ার এক চুড়ির দোকানে সে সবুজ চুড়ির অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। দোকানদার বলেছে, আপা মঙ্গলবারে এসে নিয়ে যাবেন। আজ মঙ্গলবার।
আঠারটা সবুজ চুড়ি কিনে সীতা বাড়ি ফিরে দেখল স্বামী মৃত। এইসব ক্ষেত্রে স্ত্রীরা হাউমাউ করে কাঁদে। সীতা কাঁদল না। কারণ তার কান্না শোনার মতো ঘরে কেউ নাই। মেয়েরা একা একা কাঁদতে পারে না। সে তার আত্মীয়স্বজনদের খবর দিল। আত্মীয়স্বজন আসা, শুরু হওয়ার পরপর গলা ছেড়ে কাঁদতে বসল।
ডেডবডি রাতেই শ্মশানে দাহ করা হবে। মুখাগ্নি করবে শলারামের ছেলে প্রণব।
প্রণব ক্লাস সিক্সে পড়ে। সে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জ তার জেঠির বাড়িতে। তাকে গাড়ি পাঠিয়ে আনা হলো। তাকে বলা হলো না যে তার বাবা মারা গেছেন। প্রণব ঘরে ঢুকেই বলল, বাবা!
শলারাম বলল, কী?
তোমার চোখ বন্ধ কেন?
শলারাম বলল, আমি মারা গেছি এই জন্যে চোখ বন্ধ।
প্রণব বাবার চোখের পাতা খুলে বলল, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?
শলারাম বলল, পাচ্ছি। ছায়া ছায়াভাবে দেখছি। মনে হচ্ছে সব ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট।
চিন্তার এই পর্যায়ে মুনিয়া দরজা ধরে দাঁড়াল এবং মিষ্টি গলায় বলল, স্যার কিছু লাগবে? রুস্তম মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হকচকিয়ে গেল। মুনিয়া কালো রঙের গাউনের মতো একটা রাতপোশাক পরেছে। পোশাক পলিথিনের মতো স্বচ্ছ। মুনিয়ার নাভির ডান দিকের লাল তিলটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
রুস্তম চট করে চোখ ফিরিয়ে নিল। অস্বস্তির কারণে সে মুনিয়ার নাম ভুলে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, ময়ূরী। কিছু লাগবে না।
স্যার আমার নাম মুনিয়া।
ও আচ্ছা মুনিয়া। সরি নামটা ভুলে গেছি।
আমাকে ময়ূরী ডাকতে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে ময়ূরী ডাকবেন। আমার কোনো সমস্যা নেই।
আচ্ছা।
বিছানার চাদরটা কি পাল্টে দিব?
না না চাদর পাল্টাতে হবে না।
আপনার কাছে একটা কমপ্লেইন আছে। বলব?
বলো।
আপনার সামনে বসে বলি?
সামনে আসতে হবে না, যেখানে আছ সেখান থেকে বলো।
আপনার যে আর্টের টিচার, উনি আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। বলেছেন, এক ঘণ্টা করে নেংটো হয়ে তার সামনে বসে থাকতে। তিনি ছবি আঁকবেন। ঘণ্টায় পাঁচশ টাকা দিবেন।
রুস্তম বলল, এটা কোনো কুপ্রস্তাব না। আর্টিস্টরা ছবি আঁকার জন্য মডেল ব্যবহার করে।
মুনিয়া বলল, আপনি যদি মডেল হতে বলতেন সেটা ভিন্ন কথা। চিনি জানি না তার সামনে নেংটো হয়ে বসে থাকব?
তাকে না করে দাও।
জি আচ্ছা। স্যার আমি কি চলে যাব?
হ্যাঁ। গুড নাইট।
চা-কফি কিছু খাবেন?
না।
স্যার আপনি কি কোনো কারণে আমার ওপর নারাজ?
নারাজ হবো কেন?
আমার মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি দেখলে নিজের মুখে বলবেন। আমি শোধরাব।
আচ্ছা।
আর এখন থেকে আপনি আমাকে ময়ূরী নামে ডাকবেন। অন্য কোনো নামে ডাকলে আমি রাগ করব। সবাই ডাকরে মুনিয়া শুধু আপনি ডাকবেন ময়ূরী।
এখন যাও তো।
ধমক দিচ্ছেন কেন স্যার? মিষ্টি করে বলুন, ময়ূরী এখন যাও।
রুস্তম হতাশ গলায় বলল, ময়ূরী এখন যাও!
স্যার, আমি আমার ঘরের দরজা সবসময় খোলা রাখি। কোনো কিছুর দরকার হলে চলে আসবেন। দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকবেন স্যার। আমার শোয়া খুব খারাপ। কাপড়-চোপড় ঠিক থাকে না। এই জন্যে বললাম।
বলে ভালো করেছ। মুনিয়া এখন যাও। আমি জরুরি একটা কাজ করছি।
মুনিয়া বলবেন না স্যার। আমি ময়ূরী।
ময়ূরী এখন যাও। প্লিজ।
মুনিয়ার ওপর খানিকটা মেজাজ খারাপ করে রুস্তম ঘুমুতে গেল। মেজাজ খারাপের একমাত্র কারণ উপন্যাসের শুরুটা সে এলোমলো করে দিয়েছে। আবার নতুন করে মাথায় গোছাতে হবে। নতুন করে শুরু করা একদিক দিয়ে ভালো। কিছু কারেকশন করা হবে। বাথরুমে একা মরে পড়ে থাকাটা ভালো লাগছে না। মৃত্যু অনেকের সামনে হওয়া ভালো। ছুটির দিনে বাসার সবাই আছে। প্রণব তার বাবাকে গল্প শোনাচ্ছে, এই সময় হঠাৎ মাথা এলিয়ে শলারাম পড়ে গেল। শলারাম নামটাও এখন পছন্দ হচ্ছে না। প্রণব এবং সীতার সঙ্গে শলারাম যাচ্ছে না। এমন কোনো নাম খুঁজে বের করতে হবে যার অর্থ মৃত্যু। তার নাম প্রণাশ রাখা যেতে পারে। প্রণাশ শব্দের অর্থও মৃত্যু, বিনাশ। প্রণাশ চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে প্রণব চট্টোপাধ্যায়। স্ত্রীর নাম সীতা।
বালিশের কাছে রাখা টেলিফোন বাজছে। রুস্তম টেলিফোন ধরে বলল, হ্যালো।
ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ বলল, তোর খবর কী?
রুস্তম টেলিফোনে গলা চিনতে পারে না। টেলিফোনে তার কাছে সব মেয়ের গলা একরকম মনে হয় আবার সব ছেলের গলা একরকম মনে হয়। রুস্তম বলল, কে?
আরে গাধা, আমি তোর বুবু।
বুবু কেমন আছ?
ভালো। তুই কি ঘুমিয়ে পড়েছিলি?
প্রায়।
মাত্র এগারোটা বাজে এর মধ্যেই ঘুম? শরীর ভালো তো?
হুঁ।
তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে আমার বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে?
না।
আমি চলে যাওয়াতে সে কী পরিমাণ আপসেটঃ
বুঝতে পারছি না। তবে আফতাব চৌধুরীর উপর দুলাভাই মনে হয় রাগ করেছেন। আমাকে বলেছেন ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে খুন করাবেন।
সিরিয়াসলি বলেছে?
হুঁ।
ওর পক্ষে অসম্ভব কিছু না।
বুবু আমি রাখি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ইন্টারেস্টিং একটা কথা বলে টেলিফোন রাখ। হুট করে টেলিফোন রেখে দেওয়া ঠিক না।
তুমি বলো, আমার ইন্টারেস্টিং কিছু মনে আসছে না। বুবু একটা মিনিট ধরো, আমি লাঠিটা সরিয়ে আসি।
কী লাঠি?
আমার বিছানার কাছে একটা বেতের লাঠি। এখন মনে হচ্ছে লাঠিটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় ভয় লাগছে।
লাঠি তাকিয়ে থাকবে কিভাবে? লাঠির কি চোখ আছে?
তা জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তারের দেওয়া ওষুধগুলি কি তুই নিয়মিত খাচ্ছিস?
খাচ্ছি।
তুই এক কাজ কর। আমি সিঙ্গাপুরে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে চল। মাউন্ট এলিজাবেথে বড় ডাক্তার দেখাবি।
বুবু আমি লাঠিটা সরিয়ে তারপর কথা বলব। সাবধানে সরাতে হবে। হাত ফসকে লাঠি যদি মেঝেতে পড়ে তাহলে সেটা সাপ হয়ে যাবে।
Oh God. এইসব কী কথাবার্তা! লাঠি মেঝেতে পড়লে সাপ হবে pa?
মুসা আলায়েস সালামের লাঠি মেঝেতে পড়লে সাপ হয়ে যেত।
তুই কি মুসা আলায়েস সালাম?
তা না, তারপরেও কিছু বলা যায় না।
রুস্তম টেলিফোন রেখে লাঠি সরাতে গেল। ফিরে এসে টেলিফোন ধরল না। সামিনা অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে লাইন কেটে দিল।
কড়া ঘুমের ওষুধ খায় বলেই বিছানায় যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রুস্তম ঘুমিয়ে পড়ে। আজ ঘুম আসছে না। সাপের ভয়ের কারণেই মনে হয় ঘুম কেটে গেছে। লাঠিটা সে নিজে কাবার্ডে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদি পড়েও যায় কাবার্ড থেকে বের হতে পারবে না। তারপরেও ভয় যাচ্ছে না। কেন কে জানে!
রুস্তম উঠে বসল। বিছানার পাশের লাইট জ্বালাল। হাতের কাছে বেশ কিছু বই সাজানো। বেশিরভাগই ডিকশনারি। তার ডাক্তার বলেছেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরেও যদি ঘুম না নাসে তাহলে চোখের পাতা না ফেলে ডিকশনারি পড়বেন। চোখ ক্লান্ত হবে। ঘুম আসবে। রুস্তম ডিকশনারি খুলল, সাপের প্রতিশব্দ বের করে মুখস্থ করে ফেলাটা একটা কাজের কাজ হবে। একজন লেখকের শব্দভাণ্ডার ভালো হতে হয়।
সাপ, সর্প, অহি, ভুজঙ্গ, ফণী, নাগ, ভুজগ, ভুজঙ্গম, আশীবিষ, উরগ, চক্রী, কুণ্ডলী, বিষধর, অকর্ণ, পল্লগ, কাকাদর, দ্বিরসন, দ্বিজিন, ফণধর, ফলাকার, ফণভুৎ, ফণাভুৎ, বিলশয়, ছকশ্রুতি, বিলেশয়, কাদ্রবেয়, পবনাশন, পবনাশ, উরঞ্চম, ব্যাল, কষ্ণুকী, উরঙ্গ, ভেকভুজ, কম্ভীস্ম, সর্পী, নাগিনী, সর্পিনী, ভুজঙ্গী, ভুজঙ্গিনী, ভুজগী, অহীরণি…
সাপের প্রতিশব্দ একচল্লিশটা পাওয়া গেল। একচল্লিশটা প্রতিশব্দ মুখস্থ করতে করতে রাত চারটা বেজে গেল। এখন ঘুমের চেষ্টা করেও লাভ নেই। রুস্তম বিছানা থেকে নেমে হাত-মুখ ধুয়ে ছাদে হাঁটতে গেল। গোলাম মওলা সাহেব তাকে ছাদে হাঁটতে বলেছেন। হাঁটা এবং ঘুম শরীরের জন্য মহৌষধ। এক ওষুধ কাজে লাগানো গেল না। এখন দ্বিতীয় ওষুধে যদি কিছু হয়। রুস্তম সূর্য না ওঠা পর্যন্ত ছাদে হটল। সাপের প্রতিশব্দ মনে করতে করতে হাঁটা। সাপ, সর্প, অহি, ভুজঙ্গ, ফণী, নাগ, ভুজগ, ভুজঙ্গম…
নাস্তার টেবিলে আর্ট টিচার হোসেন মিয়া উপস্থিত হলো। বিস্মিত গলায় বলল, আপনার চোখ টকটকে লাল। ঘুম হয়নি?
রুস্তম বলল, না। ভয়ে ঘুমাতে পারিনি।
কিসের ভয়?
অহীরণির ভয়।
অহীরণি কী বস্তু?
সাপকে বলে অহীরণি।
সাপকে অহীরণি বলে এই প্রথম শুনলাম। সাপকে সর্প বলে, ভুজঙ্গ বলে, অহীরণি তো কেউ বলে না।
অহীরণি হলো সাপের প্রতিশব্দ। সাপের একচল্লিশটা প্রতিশব্দ আছে। 7615?
না, না। একচল্লিশটা প্রতিশব্দ শোনার কোনো প্রয়োজন নাই। সাপের মতো একটা তুচ্ছ প্রাণীর একচল্লিশটা প্রতিশব্দ থাকারও প্রয়োজন নাই। সাপ এবং সর্প দুটাই যথেষ্ট। গত রাতে আপনি যেমন ঘুমাতে পারেন নাই, আমিও পারি নাই। আপনাকে সাপ ডিসটার্ব করেছে আমাকে মুনিয়া মেয়েটা ডিসটার্ব করেছে। ঘটনা শুনবেন?
রুস্তম হা-না কিছু বলল না, নাস্তা খাওয়া শুরু করল। এই বাড়িতে ত্রিশ দিন একই নাস্তা–চালের আটার রুটি, সবজি, একটা ডিম পোচ।
হোসেন মিয়া বলল, রাত এগারোটার দিকে ঘুমাতে গেছি, দরজায় টোকা। দরজা খুলে দেখি মুনিয়া। একটা নাইট ড্রেস পরে এসেছে। এই ড্রেস থাকা না থাকা সমান। মুনিয়া বলল, সে মডেল হতে রাজি আছে। এক ঘণ্টা সময় দিবে।
আমি বললাম, মুনিয়া আমি দুপুররাতে কাজ করব না। সানলাইটে কাজ করব। সকাল এগারোটার দিকে আসো।
মুনিয়া বলল, আপনি আমাকে মুনিয়া ডাকবেন না। স্যার আমার নতুন নাম দিয়েছেন। ময়ূরী। এখন থেকে ময়ূরী ডাকবেন। একটি সাইকেল।
আমি বললাম, ঠিক আছে ময়ূরী ডাকব। এখন যাও, আমি সব রেডি করে রাখব। ঠিক এগারোটা থেকে বারোটা এই এক ঘণ্টা আমার সেশন। সাজগোজ কিছু করবে না, নো লিপস্টিক, নো মেকাপ।
মুনিয়া বলল, পাঁচশ টাকায় হবে না। ঘণ্টায় দুহাজার দিবেন।
চিন্তা করেছেন অবস্থা! ঘণ্টায় দুই হাজার চায়। মেয়েটা কে বলুন তো?
জানি না কে? কারোর আত্মীয় হবে।
খোঁজ নেবেন। আমার তো তাকে ডেনজারাস মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। কোনো একদিন সবাই ঘুমিয়ে থাকব, সে সবার গলা কেটে জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাবে।
আমি খোঁজ নেব।
হোসেন মিয়া বলল, আমি তাকে লাস্ট অফার দিয়েছি পার আওয়ার ওয়ান থাউজেন্ড। সে বলেছে চিন্তা করে দেখবে। যদি পুষে তাহলে আসবে। এখানে পুষপুষির কী তাই বুঝলাম না। চেয়ারে এক ঘণ্টা বসে এক হাজার টাকা নট এ মেটার অব জোক।
সকাল সাড়ে দশটা।
হোসেন মিয়া ক্যানভাস গ্লসো দিয়ে রেডি করেছে। চারকোলের পেনসিল কেটে অপেক্ষা করছে। ঘরের আলোর ব্যাপারটা ঠিক করেছে। লাইটের সোর্স পূর্বদিকের জানালা। যে চেয়ারে মুনিয়া বসবে, সেটা রাখা হয়েছে জানালার পাশে। আলো এবং জানালার শিকের ছায়া পড়বে মুনিয়ার গায়ে। লাইট অ্যান্ড শেডের একটা খেলা। এক ঘণ্টায় লাইট অ্যান্ড শেডের অবস্থান বদলাবে। সূর্য তার এক্সিসে আরও ধীরগতিতে ঘুরলে আর্টিস্টদের সুবিধা হতো।
ঠিক এগারোটায় মুনিয়া উপস্থিত হলো। হোসেন মিয়া বলল, দেরি করবে না। কাঠের চেয়ারে বসো। তোমার সামনে আমি একটা লাল বল ঝুলিয়ে দিয়েছি। তুমি তাকিয়ে থাকবে লাল বলটার দিকে।
মুনিয়া বলল, কাঠের চেয়ারে আমি বসব না। গদিওয়ালা চেয়ার ছাড়া আমি বসতে পারি না।
চেয়ারের ওপর কুশন দিয়ে দিচ্ছি, কুশনে বসো।
আজ বসব না।
আজ সমস্যা কী?
আজ সোমবার। সোমবার আমার জন্যে অশুভ। এক পামিস্ট আমার হাত দেখে বলেছেন, সোমবার আর বুধবার অশুভ। আপনি যে লাল বল ঝুলিয়েছেন, ওই বলের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারব না। লাল রঙও আমার জন্যে অশুভ এই জন্যে। আপনি অন্য কালারের বল ঝুলাবেন। নীল হলে ভালো হয়। নীল রঙ আমার জন্য শুভ। আচ্ছা যাই।
মুনিয়া চলে গেল। হোসেন মিয়া বিড়বিড় করে যেসব কথা বলল তা লেখা যাবে না। পাঠকদের রুচিতে আঘাত করা হবে। পাঠকরা এ ধরনের কথা সবসময় শোনেন, কিন্তু লিখিত ভাষ্য পছন্দ করেন না।
রুস্তম মুনিয়া মেয়েটির বিষয়ে খোঁজখবর করল। কেউ কিছু বলতে পারল না। বাবুর্চি মরিয়ম ঝাঁঝালো গলায় বলল, আমি এরে চিনব ক্যামনে? এ আমার কোনো আত্মীয় না, স্বজন না, আমার গেরামেরও না। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়, পাক কোরান আনেন। পাক কোরানে হাত দিয়া বলব। আমার অজু আছে।
মরিয়মের স্বভাব হচ্ছে, যে কোনো কথাই পাক কোরানে হাত দিয়ে বলতে চায় এবং সবসময় তার অজু থাকে। একবার গ্যাস লিক করে রান্নাঘর ভর্তি হয়ে গেল মিথেন গ্যাসে। মরিয়মকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, আমি নিজের হাতে গ্যাসের চুলা বন্ধ করছি। বন্ধ কইরাও আমার শান্তি হয় নাই। দুইবার চেক করছি। যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয় পাক কোরান আনেন। পাক কোরানে হাত দিয়া বলব। আমার অজু আছে।
ড্রাইভার এবং ড্রাইভারের সঙ্গী চশমাপরা ফুলবাবুও বলল, এই মেয়ে তাদের কেউ না।
চণ্ডিবাবু বললেন, মেয়ের নাম মুনিয়া। মুসলমান কন্যা। এর বেশি কিছু জানি না। তবে মেয়ের স্বভাব-চরিত্র ভালো। আমারে দাদু ডাকে। একদিন মাথায় তিলের তেল মালিশ করে দিয়েছে। এমন আরামের মালিশ। মালিশের মাঝখানে দ্ৰিায় চলে গেছিলাম।
বাড়ির দারোয়ান বলল, সে এই মেয়ে বিষয়ে কিছু জানে না। তার বাড়ি খুলনার বাগেরহাটে। এই তথ্য নাকি মেয়ে তাকে দিয়েছে।
একটা মেয়েকে কেউ চিনে না। অথচ চার-পাঁচ মাস ধরে সে এই বাড়িতে আছে। বিস্ময়কর ঘটনা। রুস্তমের উচিত এক্ষুনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করা। রুস্তম ঠিক করল তাড়াহুড়ার কিছু নাই। রাতে মুনিয়া এসে জিজ্ঞেস করবে, স্যার কিছু লাগবে? তখন জিজ্ঞেস করলেই হবে।
রুস্তমের মোবাইল ফোন অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। নিতান্ত অনিচ্ছায় সে টেলিফোন ধরল। টেলিফোন করেছেন তার দুলাভাই। তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ঘটনা কিছু শুনেছ? তোমার বোন শুধু যে চলে গেছে তা না, আমাকে পথের ফকির বানিয়ে গেছে।
রুস্তম বলল, বুবু চলে গেছে এইটুকু জানি। আপনাকে পথের ফকির বানিয়ে গেছে এটা জানি না।
আমার সমস্ত টাকা-পয়সা ছিল দুজনের নামে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে। তাকে খুশি রাখার জন্য জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করা। বেশিরভাগ চেক তাকে দিয়ে কাটাতাম। এতে সে খুশি হতো। ব্যাংকে আমার একাশি লাখ ত্রিশ হাজার টাকা ছিল। সে একাশি লাখ টাকা নিয়ে চলে গেছে। এখানেই শেষ না–
আর কী?
ব্যবসা সব ছিল তার নামে। আমার ধারণা সব সে আফতাব হারামজাদাটাকে লিখে দিয়েছে। আজ সকালে জুতার দোকানে গিয়েছি। সবাই দেখি কেমন কেমন করে তাকায়। ম্যানেজার ক্যাশ দেখছিল, সে আমাকে দেখে উঠে পর্যন্ত দাঁড়ায় নাই। মন এমন অস্থির কী করব বুঝতে পারছি না।
দুলাভাই সাইকেল চালালে মনের অস্থিরতা কমে। ব্যালেন্স রাখতে হয় তো এই জন্যে। ব্রেইনের যে অংশ অস্থিরতার জন্য দায়ী, সেই অংশ তখন ব্যালেন্স রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকে। আমার সাইকেলটা পাঠিয়ে দেব দুলাভাই? সাইকেল চালাবেন?
আমি সাইকেল চালাতে পারি না। সাইকেলের প্রসঙ্গ বাদ রাখো। তোমার বুবুর সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?
গত রাতে কথা হয়েছে।
কিছু বলেছে?
বলেছেন তারা সিঙ্গাপুর যাবেন।
হারামজাদা-হারামজাদি সিঙ্গাপুর যাচ্ছে? কবে যাচ্ছে?
সেটাই তো বলেন নাই।
তোমার সঙ্গে সামনা-সামনি কথা হওয়া দরকার। চলে আসো।
এখন আসতে পারব না দুলাভাই। কাল সারারাত আমার ঘুম হয় নাই। পদ্মগের ভয়ে জেগে ছিলাম।
পন্নগটা কী?
সাপের আরেক নাম পন্নগ।
বলো কী?
সাপের একচল্লিশটা নাম আছে। দুলাভাই বলব?
অবশ্যই বলবে। ডাক্তারের সঙ্গে তোমার নেক্সট অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে?
সতেরো তারিখ।
ওইদিন তুমি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
জি আচ্ছা। এখন কি সাপের প্রতিশব্দগুলো আপনাকে বলব।
রুস্তমের দুলাভাই হতাশ গলায় বললেন, বলো।
রুস্তম বলা শুরু করল–সাপ, সর্প, অহি, ভুজঙ্গ, ফণী, নাগ, ভুজক, ভুজঙ্গম, আশীবিষ, উরগ, চক্র, কুণ্ডলী…
থামো তো।
রুস্তম থামল।
তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। এক পীর সাহেবের কাছে। আগে হিন্দু ছিলেন। ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন। এখন বিরাট পীর। কামেলিয়াত হাসিল করেছেন। তাঁর কাছ থেকে তোমার জন্যে একটা তাবিজ আনব। আমিও একটা তাবিজ নেব।
আপনি তাবিজ নেবেন কেন?
বশীকরণ তাবিজ। তাবিজের গুণে সামিনা ফিরে আসবে।
ভাড়াটে গুণ্ডা লাগবে না? আমি গোলাম মওলা আংকেলকে বলে রেখেছি।
এইসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। পীর সাহেবের কাছে কখন যাবে?
আপনি বললে এখনই যেতে পারি। উনার নাম কী?
নাম কেউ জানে না, সবাই ভাই পীর ডাকে।
ভাই পীরের হুজরাখানা ভর্তি মানুষ। এক মহিলা তিন মাসের সন্তান নিয়ে এসেছেন। সে ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে। এক মধ্যবয়স্ককেও কাঁদতে দেখা গেল। তার কাঁধে গামছা। সে কাঁদছে আর গামছায় চোখ মুছছে। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সকাল নয়টার মধ্যে নাম রেজিস্ট্রি করতে হয়। আজকের মতে রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে গেছে। আমিন রুস্তমের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ঝিম ধরে বসে থাকো। আমি ব্যবস্থা করছি। খাদেমকে টাকা খাওয়ালেই ডাক পড়বে।
রুস্তম বলল, পীর সাহেবের ভিজিট কত?
আমিন বলল, উনি টাকা-পয়সা নেন না। দানবাক্স আছে। দানবাক্সে যার যা ইচ্ছা দেয়।
আমিন কি ব্যবস্থা করলেন বুঝা গেল না তবে দশ মিনিটের মাথায় তাদের ডাক পড়ল।
ভাই পীরের দরবার শরিফ যথেষ্টই আধুনিক। এসি চলছে। ঘর ঠাণ্ড। মেঝেতে টকটকে লাল রঙের কার্পেট। কার্পেটের এক কোনায় ভাই পীর খানিকটা কুঁজো হয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখে চশমা। হাতে সিগারেট। ছাই ফেলার জন্যে দামি অ্যাশট্রে আছে। সব পীর সাহেবদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক খাদেম জাতীয় লোকজন থাকে। ইনার সঙ্গে নেই।
ভাই পীর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আপনা দুজন ভালো আছেন? দয়া করে বসুন। বসতে বসতে একটা ফুলের নাম বলুন।
আমিন বললেন, পারুল ফুল।
ভাই পীর হাসতে হাসতে বললেন, পারুলের মাঝের অক্ষর কেটে দিলে হয় পাল। আপনার স্ত্রীর পালে হাওয়া লেগেছে। হাওয়া উঠেছে বলেই হাওয়া লেগেছে। হাওয়া যখন থেমে যাবে তখন পাল চুপসে যাবে।
আমিন বললেন, হাওয়া কখন থামবে?
ভাই পীর বললেন, সেটা আমি বলতে পারব না। আমি আবহাওয়া দপ্তরের কেউ না।
রুস্তম বলল, আমি কি একটা ফুলের নাম বলব?
বলুন।
বকুল।
ভাই পীর হাতের আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বললেন, বকুলের মাঝের অক্ষর ফেলে দিলে হয় বল। বল আপনার পায়ে। কিন্তু সবাই ধরে নিয়েছে আপনার পায়ে নেই। এটা একটা আফসোস।
আমিন ভীত গলায় বললেন, আমার স্ত্রী কি ফিরবে?
ভাই পীর বললেন, কনফুসিয়াস বলেছেন, যে বস্তু উপরে উঠে সেই বস্তু একসময় নিচে নেমে আসে। আপনার স্ত্রী যদি উপরে উঠে থাকেন তাহলে নেমে আসবেন।
তাকে নেমে আসার জন্যে আমি কি কিছু করতে পারি?
কিছুই করতে পারেন না। মানুষ জানে না সে নিয়তির সন্তান। সে ভাব করে যে তার Free will আছে। এটা ভেবে সে আনন্দ পায়। একটি পতঙ্গের যেমন ফ্রি উইল বলে কিছু নেই, মানুষেরও নেই।
রুস্তম বলল, আপনি বলছেন সবই নিয়তির খেলা।
আমি ক্ষুদ্র মানুষ, আমার বলায় কিছু যায় আসে না। রবীন্দ্রনাথের মতো বড় মানুষ বলেছেন মায়ার খেলা। মায়া আর নিয়তি তো একই।
আমিন বললেন, এটা তো একটা নৃত্যনাট্য।
ভাই পীর বললেন, নৃত্যনাট্যের ভেতরে আসল নৃত্য। কবিগুরুর একটা গান কি শুনবেন?
আমিন অবাক হয়ে বললেন, আপনি গান গাইবেন?
ভাই পীর বললেন, আমার গলায় সুর নেই, গান গাইতে পারব না। কবিতার মতো করে বলল–
যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে
তারা কথার বেড়া গাঁথে কেবল দলের পরে দলে।।
একের কথা আরে
বুঝতে নাহি পারে,
বোঝায় যত কথার বোঝা ততই বেড়ে চলে॥
যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর
তাদের সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর।
বোঝে কি নাই বোঝে
থাকে না তার খোঁজে
বেদন তাদের ঠেকে গিয়ে তোমার চরণতলে॥
আবৃত্তি শেষ করে ভাই পীর বললেন, কিছু বুঝেছেন?
আমিন বললেন, জি না।
ভাই পীর সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন, আপনারা এখন বিদায় হোন। অনেকেই বসে আছে, তাদের সবাইকে কিছু না কিছু বলে ভড়কে দিতে হবে। সবাই এসেছে ভড়কানোর জন্যে।
হুজরাখানা থেকে বের হয়ে আমিন বললেন, বিরাট ভণ্ড। থাবড়ানো দরকার।
রুস্তম বলল, থাবড়ালেন না কেন?
আমিন হতাশ গলায় বললেন, মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সমস্যা। যার করতে ইচ্ছা করে তা করা যায় না।