গরম লাগছে
গরম লাগছে?
হাসান বলতে যাচ্ছিল, জ্বি না। স্যার। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলাল। গরম লাগছে। না বললে বোকার মতো কথা বলা হবে। বোকার মতো কথা সে প্রায়ই বলে কিন্তু এই লোকের সঙ্গে বোকার মতো কথা বলা যাবে না। যা বলার ভেবেচিন্তে বলতে হবে। গরমে সে অস্থির বোধ করছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঁঠালপাকা গরম। হাসান যদি কাঁঠাল হতো এর অর্ধেক গরমে পেকে যেত। এখন ভরদুপুর। জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে মাটির তল থেকে গরম ভাপ বের হয়। সেই ভাপে পচা ঘাসের গন্ধ থাকে। হাসান গন্ধ পাচ্ছে।
সে বসেছে মাঝারি সাইজের একটা ঘরে। ঘরের প্রধান বৈশিষ্ট্য বিরাট জানালা। জানালায় ভারি পর্যাদা টানা বলে ঘর আবছা অন্ধকার। মেঝেতে কাপেট বিছানো। কার্পেটের ওপর শীতল পাটি। হাসানের ঠিক সামনেই বসেছেন হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের হিশামুদিন সাহেব। গরম তাঁকে মনে হয় তেমন কাবু করতে পারছে না। তিনি বেশ আয়েশ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছেন। খালি গা। পরনে লুঙ্গি। হাসান লক্ষ করছে লুঙ্গির গিট খুলে গেছে। হিশামুদ্দিন সাহেব ব্যাপারটা জানেন কিনা কে জানে! হয়তো জানেন না। যদি না জানেন তাহলে যে-কোনো সময় একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। কথাবার্তা শেষ করে হিশামুদিন সাহেব দাঁড়ালেন এবং লুঙ্গি পা বেয়ে নেমে এল। সর্বনাশ!
হিশামুদ্দিন সাহেব পান চিবোচ্ছেন। তার হাতের কাছে ধবধবে সাদা রুমাল। তিনি মাঝে মাঝে রুমালে ঠোঁট মুছছেন। সাদা রুমালে পানের রসের লাল দাগ ভরে যাচ্ছে। হিশামুদিন সাহেবের বয়স কত? হাসান জানে না। ঠিক অনুমানও করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু মানুষের বয়স ধরা যায় না। হাসানের ধারণা হিশামুদ্দিন সাহেবের বয়স চল্লিশও হতে পারে। আবার ষাটের কাছাকাছিও হতে পারে। তবে চল্লিশ হবার সম্ভাবনা কম। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কেউ কোটি কোটি টাকা রোজগার করতে পারে না।
হিশামুদিন ঘরের সিলিঙের দিকে তাকালেন। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। ফুল স্পিড়ে ঘুরছে না, ধীরে সুস্থে ঘুরছে। গরম বাতাস গায়ে এসে লাগছে। হিশামুদ্দিন সাহেব প্রথম প্রশ্নটি আবারো করলেন–নিচু গলায় বললেন, হাসান তোমার গরম লাগছে?
হাসান লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি স্যার।
বলতে গিয়ে কথা খানিকটা আটকেও গেল। যেন গরম লাগাটা ঠিক না। যেন সে একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
হিশামুদ্দিন বললেন, আজকের টেম্পারেচার কিন্তু গতকালের চেয়ে কম। গতকাল ছিল থাটি ফাইভ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আজ থাটি ফোর। এক ডিগ্রি কম। তারপরেও গরম বেশি লাগছে। কারণটা হিউমিডিটি। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকলে গরম বেশি। লাগে। আজ বাতাসে জলীয় বাম্পের পরিমাণ বেশি। এর মানে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। আমার ধারণা রাত নটা-দশটার দিকে বৃষ্টি শুরু হবে।
হাসান চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। তার কাজই হচ্ছে কথা শুনে যাওয়া। আলোচনায় অংশগ্ৰহণ না করা। কথা শোনার জন্যে সে টাকা পায়। ঘণ্টা হিসেবে রেট। প্রতি ঘণ্টায় ছয় শ’ টাকা। শুরুতে হাসানের মনে হয়েছিল অনেক টাকা। এখন সে জানে টাকাটা আসলে খুবই কম। হিশামুদ্দিন সাহেব কখনোই তাকে বিশ-পঁচিশ মিনিটের বেশি সময় দেন না। এত সময় তার কোথায়? বিশ-পাঁচিশ মিনিটে যা বলেন হাসানকে তা মন দিয়ে শুনতে হয়। তার দায়িত্ব শোনা কথাগুলো গুছিয়ে লেখা। যেন কোনো ভুলভ্রান্তি না হয়। হাসানের ধারণা এই কাজটা একটা টেপরেকর্ডারে খুব ভালো করা যায়। হিশামুদ্দিন সাহেব যা বলার বলবেন। টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করা থাকবে। কথাবার্তা শেষ হবার পর সে ক্যাসেট বাসায় নিয়ে যাবে। ক্যাসেট শুনে শুনে লিখে ফেলবে। কোনোরকম ভুলভ্রান্তি হবে না। হাসান ভয়ে ভয়ে হিশামুদ্দিন সাহেবকে টেপরেকর্ডারে কথাটা বলেছিল। তিনি মন দিয়ে তার কথা শুনেছেন। ভদ্রলোকের এই ব্যাপারটা আছে। কেউ যখন কথা বলে তিনি খুব মন দিয়ে শোনেন। এমনও হয় যে চোখের পলক ফেলেন না। যে কথা বলে সে পলকহীন চোখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভড়কে যায়।
হাসানের কথা শেষ হওয়ার মাত্র হিশামুদ্দিন সাহেব বললেন, যন্ত্রের সঙ্গে কি কথা বলা যায় হাসান? আমি যখন কথা বলি তোমার সঙ্গে কথা বলি, একটা মানুষের সঙ্গে কথা বলি। তাই না?
জ্বি স্যার।
শোনা কথা লিখতে তোমার ভুলভ্রান্তি হচ্ছে হোক না, পরে ঠিক করা যাবে। ঠিক না করলেও অসুবিধা নেই। আমি তো আমার জীবনী লিখে বই করে ছাপাচ্ছি না। আমি আমার ইন্টারেষ্টিং জীবনীটা লিখতে চাচ্ছি। আমার নিজের জন্যে। যখন কাজকর্ম করার ক্ষমতা থাকবে না-বিছানায় শুয়ে শুয়ে, কিংবা হুইল চেয়ারে বসে বসে পড়ব।
জ্বি স্যার।
তুমি যাতে তালগোল পাকিয়ে না ফেল এই জন্যেই আমি অল্প অল্প করে বলি।
হাসান মনে মনে বলছে-স্যার, আপনি যদি একসঙ্গে অনেকখানি করে বলতেন তাহলে আমার কিছু লাভ হতো। দুটা টাকা বেশি পেতাম।
হিশামুদ্দিন সপ্তাহে একদিন হাসানের সঙ্গে বসেন। বুধবার দুপুর দুটা থেকে তিনটা। এক ঘণ্টা কখনো কথা বলেন না। পনের-বিশ মিনিট পার হবার পরই বলেন–‘আজ এই পর্যন্তই।’ হাসান ঘর থেকে বের হয়ে নিচে আসে। হিশামুদিন সাহেবের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রহমতউল্লাহ দাঁত বের করে বলে, কী, কাজ শেষ?
জ্বি।
পাঁচিশ মিনিট পার হয়েছে। যাই হোক তিরিশ করে দিচ্ছি। রাউন্ড ফিগার। পেমেন্ট নিয়ে যান।
থাক জমুক। পরে একসঙ্গে নেব।
ওরে সর্বনাশ, তা হবে না। স্যারের নির্দেশ আছে সব পেমেন্ট আপটুডেট থাকবে। আসুন ভাই খাতায় সই করে টাকা নিন।
হাসানকে শুকনো মুখে খাতায় সই করে টাকা নিতে হয়। মাঝে মাঝে ভাবে বলবেআমাকে চাকরি দেবার সময় বলা হয়েছিল বুধবারে এক ঘণ্টা করে সিটিং হবে। এক ঘণ্টা হিসেবে আমাকে টাকা দিতে হবে। পাঁচ মিনিট কথা বললেও এক ঘণ্টার পেমেন্ট বলা হয় নি। হাসানের ধারণা কথাটা বলামাত্রই তা বড় সাহেবের কানে চলে যাবে। তিনি বিরক্ত হয়ে ভাববেন–ছেলেটা তো লোভী! হাসান চাচ্ছে না হিশামুদিন সাহেব তাকে লোভী ভাবুন। কারণ প্রথমত সে লোভী না, দ্বিতীয়ত এই মানুষটাকে সে পছন্দ করে।
হাসান।
জ্বি স্যার।
আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। আজ থাক।
জ্বি আচ্ছা! হাসান মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আজ কোনো কথাই হয় নি। তার হাতে ঘড়ি নেই। ঘড়ি থাকলে বলে দিতে পারত দশ মিনিটের বেশি সময় পার হয় নি। মাত্র এক শ টাকা। হাসান উঠে দাঁড়াতে গোল-হিশামুদিন বললেন, বোস একটু। হাসান বসল। হিশামুদ্দিন রুমাল দিয়ে আবার ঠোঁট মুছলেন। মাথার ওপরের ফ্যানটার দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের তাকানোর ভঙ্গি এমন যেন তিনি ফ্যানের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। তার চোখে পলক পড়ছে না।
হাসান। জ্বি স্যার। আমি যখন ছোট ছিলাম। তখন দেখেছি প্ৰচণ্ড গরমের সময় বুড়ো ধরনের মানুষরা গামছা ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে বসে থাকত। তুমি কি এ রকম দৃশ্য দেখেছ?
জ্বি না স্যার।
গরমের সময় ভিজিয়ে, গায়ে রাখার জন্যে আলাদা গামছাই পাওয়া যেত। মোটা মোটা সুতা–গামছাগুলোকে বলত জলগামছা।
হাসান মনে মনে কয়েকবার বলল, জলগামছা। জলগামছা। জলগামছার ব্যাপারটা লিখে ফেলতে হবে। কোনো এক ফাঁকে এই তথ্য ঢুকিয়ে দিতে হবে। শুধু জলগামছা আওড়ালে মনে নাও থাকতে পারে। কাছাকাছি আরো কয়েকটা শব্দ বলা দরকার–
জলগামছা
পানিগামছা
ওয়াটারগামছা
হাসান।
জ্বি স্যার। সবচে’ কষ্টের গরম কোন মাসে পড়ে জান?
জ্বি না স্যার।
ভাদ্র মাসে। ভাদ্র মাসের গরমকে বলে তালপাকা গরম। তখন বাতাসে জলীয় বাষ্প খুব বেশি থাকে। গরমটা বেশি লাগে এই কারণে। একবার ভাদ্রমাসে কী হয়েছে শোন–আমি তখন ক্লাস খ্রিতে পড়ি। আমাদের বাসা নেত্রকোনার উঁকিলপাড়ায়। দু কামরার ঘর। সাধারণ নাম হলো হাফ বিল্ডিং। করোগেটেড টিনের ছাদ। টিনের ছাদের বাড়ি রাতে ঠাণ্ডা হবার কথা। আমাদের বাসা কখনোই ঠাণ্ডা হতো না। আমরা সাত ভাইবোন গরমে ছটফট করতাম।
স্যার আপনি একবার বলেছিলেন। আপনারা আট ভাইবোন।
যখনকার কথা বলছি তখন আমরা সাত জন। আমার মেজো ভাই রাগ করে বাসা থেকে চলে গিয়েছিল। অত্যন্ত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে রাগ করেছিল। তার কেডসের জুতার ফিতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। সেই ফিতা কিনে দেয়া হচ্ছিল না। একটা জুতায় ফিতা ছিল, আরেকটায় ছিল না। সেই জুতাটা খুলে খুলে আসত। ক্লাসের বন্ধুরা তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করত। বাবা প্রতিদিন বলতেন, আজ ঠিক নিয়ে আসব। আসতেন না। একদিন স্কুল থেকে বাসায় না ফিরে সে বাড়ি চলে গেল, সেদিন বিকেলে বাবা ফিতা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ নেই।
স্যার আপনার ভাইটার নাম কী?
ভাইয়ের গল্প তো এখন করছি না। এখন তোমাকে বলছি অন্য গল্প। মেজো ভাইয়ের গল্প যখন বলব। তখন নাম বলব।
জ্বি আচ্ছা।
আমি কী বলছিলাম যেন?
আপনার সাত ভাইবোন গরমে ছটফট করতেন।
ও হ্যাঁ, আমরা গরমে ছটফট করতাম। বাবা অনেক রাত পর্যন্ত তালপাখা দিয়ে আমাদের হাওয়া করতেন। সেই পাখা পানিতে ভিজিয়ে নেয়া হতো। ভেজা পাখার হাওয়া নাকি ঠাণ্ডা।
একদিনের কথা–বাবা বাসায় ফিরলেন অনেক দেরিতে। তার হাতে বাজার করার চটের একটা ব্যাগ, মুখ হাসি হাসি। তিনি রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন–কোথায় আমার সৈন্যসামন্ত। আমরা ছুটে এলাম। বাবা চটের ব্যাগ খুললেন। ব্যাগের ভেতর খবরের কাগজে মোড়া চকচকে নতুন সিলিং ফ্যান। আমরা হতভম্ব! সেই রাতেই ফ্যান লাগানো হলো। বাবা নিজেই মিস্ত্রি। রাবারের জুতা পরে তিনি ইলেকট্রিসিটির কানেকশন দিলেন। ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। কী বাতাস, মনে হচ্ছে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তিনি গভীর গলায় বললেন, এখন থেকে এক ঘুমে রাত কাবার করে দিবি। হা করে ঘুমোবি যাতে পেটের ভেতরেও ফ্যানের হাওয়া চলে যায়।
সেই ফ্যান সর্বমোট আমরা তিনদিন ব্যবহার করি। চতুর্থ দিনে বাড়িতে পুলিশ এসে উপস্থিত। আমরা বিস্মিত হয়ে জানলাম বাবা যে দোকোনে কাজ করতেন সেই দোকানের একটা ফ্যান তিনি খুলে নিয়ে চলে এসেছেন।
আমাদের চোখের সামনেই সিলিং থেকে ফ্যান খোলা হলো। বাবা সবার দিকে তাকিয়ে সারাক্ষণই অমায়িক ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। যেন বেশ মজাদার একটা ঘটনা ঘটেছে। তিনি এই ঘটনা প্ৰত্যক্ষ করতে পেরে আনন্দিত।
দোকানের মালমাল চুরির অভিযোগে বাবার বিরুদ্ধে মামলা হয়। বাবার দু মাসের জেল হয়ে যায়। কোর্টে আমরা কেউ ছিলাম না। শুধু আমার বড় বোন ছিলেন। মামলার রায় হবার পরে বাবা তাকে বলেন, পুষ্প কোনো রকম চিন্তা করিস না। জেলখানায় বিশ দিনে মাস হয়। দুই মাস আসলে চল্লিশ দিন। চল্লিশটা দিন তুই কোনো রকমে পার করে দে। পারবি না মা?
আমার বড় বোন পুষ্পের কথা কি এর আগে তোমাকে বলেছি?
জ্বি না।
ডাকমান পুষ্প, ভালো নাম লতিফা বানু।
হিশামুদ্দিন সাহেব চুপ করলেন। সামনে রাখা পানের বাটা থেকে পান নিলেন। রুমালে ঠোঁট মুছলেন। আবার মাথা উঁচু করে ফ্যানের দিকে তাকালেন।
হাসান।
জ্বি স্যার।
মানুষের প্রধান সমস্যা হলো সে কোনো কিছুই খুঁটিয়ে দেখে না। তার সব দেখা, সব observation ভাসা ভাসা। ঠিক না?
হাসান চুপ করে রইল। মানুষের প্রধান সমস্যা কী তা নিয়ে সে কখনো ভাবে নি। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ মানুষের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন কেন তাও তার কাছে পরিষ্কার না। তবে হিশামুদ্দিন সাহেবের এই স্বভাব আছে। কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। তারপর আবার মূল বক্তব্যে ফিরে আসেন।
হিশামুদ্দিন বললেন, তুমি এক শ টাকার নোট অনেকবার দেখেছি। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে তুমি বলতে পারবে না এক শ টাকার নোটের দু পিঠে কী ছবি আছে। বলতে পারবে?
জ্বি না স্যার।
একপিঠে আছে লালবাগ দুর্গের ছবি, আরেক পিঠে তারা মসজিদের ছবি। তোমার সঙ্গে এক শ টাকার নোট আছে না? আমার কথা মিলিয়ে দেখ।
এক শ টাকার নোট নেই স্যার।
কত টাকার নোট আছে?
দশ টাকার।
দশ টাকার নোটের এক দিকে আছে কাপ্তাই বাঁধের ছবি, আরেকদিকে টাঙ্গাইলের একটা মসজিদের ছবি–আতিয়া জামে মসজিদ। মানিব্যাগ খুলে দেখ।
দেখতে হবে না। স্যার। আপনি যখন বলছেন তখন অবশ্যই আছে।
তবুও তুমি একবার দেখে নাও।
হাসান মানিব্যাগ বের করে দেখল। হিশামুদিন সাহেব বললেন, নোটের গায়ে কী ছবি আঁকা থাকে তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। তারপরেও আমি মনে করি–আমাদের দৃষ্টি আরো পরিষ্কার থাকা দরকার। মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে এই কথাটা তোমাকে বললাম। কেন বললাম বল তো?
বলতে পারছি না। স্যার। আমার বুদ্ধি সাধারণ মানের।
আজ এই পৰ্যন্তই থাক।
জ্বি আচ্ছা।
হিশামুদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হাসান খুবই অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। না সে রকম কোনো ঘটনা ঘটে নি–লুঙ্গি গড়িয়ে নিচে নেমে যায় নি। হিশামুদিন সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কাঁটায় কাঁটায় চারটা বাজছে। হিশামুদিন সাহেব চারটা থেকে সাড়ে চারটা এই ত্রিশ মিনিট তাঁর শোবার ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। নিজের ইচ্ছায় না, ডাক্তারের নির্দেশে। দুটা বড় ধরনের স্ট্রোক তার হয়ে গেছে। তৃতীয়টির জন্যে অপেক্ষা। অপেক্ষার সময়টায় নানান নিয়মকানুন মেনে চলা। আজ হিশামুদিন সাহেব নিয়মের খানিকটা ব্যতিক্রম করলেন। শোবার ঘরে ঢোকার আগে মতিঝিলে হিশামুদিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের হেড অফিসে টেলিফোন করলেন। টেলিফোন ধরল জীবন। জীবনকে তিনি একটা কাজ দিয়েছিলেন। হাসান সম্পর্কে খোঁজখবর করা। ছেলেটি সম্পর্কে কৌতুহল বোধ করছেন বলেই অনুসন্ধান।
আজ হাসানের একটা ব্যাপার তাঁর চোখে পড়েছে। তিনি যখন বলছিলেন–সিলিং থেকে ফ্যান খোলা হচ্ছে আর তাঁর বাবা দূরে দাঁড়িয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে হাসছেন–তখনই তিনি লক্ষ করলেন হাসানের চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখের পানি সামলাবার জন্যে দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়েছে। হিশামুদিন সাহেবের অনেক প্রিয় গল্পের মধ্যে এই গল্পটি একটি। অনেককে এই গল্প বলেছেন। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনেছে। কারো চোখে পানি আসে নি। শুধু তাঁর মেয়ে চিত্ৰলেখার চোখে পানি এসেছিল। তাঁর মেয়েটি সেদিন স্কুল থেকে জ্বর নিয়ে ফিরছে। চোখ লাল। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি করছে। জ্বরে কাতর মেয়েটিকে দেখে তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। রাত ন’টায় তিনি রওনা হবেন জাপানে। এয়ারপোর্টে সন্ধ্যা সাতটায় রিপোটিং। মেয়েটিকে একা রেখে তাকে যেতে হবে। বিশাল এই বাড়িতে চিত্ৰলেখা একা একা ঘুরবে। তিনি এয়ারপোর্টে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে মেয়ের পাশে বসলেন। না, জ্বর বেশি না। উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। চিত্ৰলেখা বলল, তোমার এয়ারপোর্ট যাবার সময় হয়ে গেছে। তাই না বাবা? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
কতক্ষণ থাকতে পারবে। আমার পাশে?
আধঘণ্টা।
তাহলে একটা গল্প বল।
তিনি তাঁর বাবার ফ্যানের গল্পটা বললেন। গল্পের এক পর্যায়ে চিত্ৰলেখা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তিনি সহজ গলায় বললেন, কাঁদছ কেন মা?
তোমার বাবার কথা মনে করে কান্না পাচ্ছে।
ও আচ্ছা।
তোমার বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। তাই না? এখন তোমার কত টাকা! ইচ্ছে করলে বাংলাদেশের সব ফ্যান তুমি কিনে নিতে পার তাই না বাবা?
হুঁ।
তোমার বাবা তোমার ভাইবোনদের মধ্যে কাকে সবচে’ ভালোবাসতেন?
আমার বড় বোনকে, তাঁর নাম পুষ্প।
তাকে সবচে’ ভালবাসতেন কেন?
বড়বুবু দেখতে অবিকল আমার মা’র মতো ছিলো, এই জন্যেই বোধহয়। তাছাড়া প্ৰথম সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র একটা আলাদা মমতা থাকে।
তোমাকে কতটা ভালবাসতেন?
আমাকে খুব সামান্য। আমি সবার শেষের দিকে তো এই জন্যে বোধহয়। মাঝে মাঝে আমার নাম পর্যন্ত ভুলে যেতেন।
কী যে তুমি বল বাবা নাম ভুলবে। কী করে?
ভুলে যেতেন। আমার ঠিক আগের ভাইটার নাম ফজলু। আমার ডাকনাম বজলু। তিনি আমাকে ডাকতেন ফজলু বলে।
তুমি রাগ করতে না?
না।
আমি হলে খুব রাগ করতাম। আমাদের অঙ্ক আপা আমাকে মাঝে মাঝে ডাকেন চিত্ররেখা। আমি জবাব দিই না। চিত্ররেখা তো আমার নাম না। চিত্ররেখা ডাকলে আমি কেন জবাব দেব? ঠিক না বাবা?
হ্যাঁ ঠিক।
এখন তোমার এয়ারপোর্টে যাবার সময় হয়ে গেছে তুমি চলে যাও।
তোমার জন্যে কিছু আনতে হবে?
না।
কিছু না?
না, কিচ্ছু না।
হিশামুদ্দিন সাহেব তাঁর বাবার গল্প যখন বলছিলেন তখন ঠিক যে জায়গায় এসে চিত্ৰলেখা কেঁদে ফেলেছিল। সেই জায়গায় হাসান ছেলেটার চোখে পানি এসেছে। ব্যাপারটা তুচ্ছ, আবার ঠিক তুচ্ছও না। জীবনকে এই ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজখবর করতে বলেছিলেন। সে কতটা খোঁজখবর করেছে কে জানে!
হ্যালো জীবন?
জ্বি স্যার।
হাসান ছেলেটি সম্পর্কে তোমাকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম–খোঁজ নিয়েছ?
জ্বি স্যার। খুবই সাধারণ ছেলে স্যার।
এ ছাড়া আর কী?
ঝিকাতলায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। এড্রেস হচ্ছে এগার বাই…
হিশামুদ্দিন বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকালেন। হড়বড় করে এড্রেস বলছে–এড্রেস তো তার অফিসেই আছে। জীবন এখন পর্যন্ত কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে নি। ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। তবু এই ছেলেটিকে তাঁর বেশ পছন্দ।
হাসান সম্পর্কে আর কী জান?
কয়েকটা প্ৰাইভেট টিউশ্যানি করে?
কটা?
একজক্ট বলতে পারছি না। স্যার।
বিয়ে করেছে?
জ্বি না।
তার কোনো পছন্দের মেয়ে কি আছে?
জ্বি স্যার, একজনের বাসায় মাঝে মাঝে যায়–সেই বাসার এড্রেস হলো স্যার—কলাবাগান—ভেতরের দিকে দুই বাই…
হিশামুদ্দিন আবারো ভুরু কুঁচকালেন। জীবন মনে হয় এড্রেস ছাড়া আর কিছু বলতে পারবে না। সে এড্রেস-বিশেষজ্ঞ।
জীবন।
জ্বি স্যার?
মেয়েটির নাম কী?
কোন মেয়ের নাম স্যার?
হাসানের পছন্দের মেয়েটির নাম…
ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, নাম স্যার জানি না। তবে নাম-এড্রেস সব সংগ্ৰহ করতে পারব।
থাক সংগ্ৰহ করতে হবে না। আমি হাসানকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।
হিশামুদ্দিন সাহেব টেলিফোন রেখে শোবার ঘরে ঢুকলেন। ঘর কেমন অন্ধকার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে আকাশে মেঘ করেছে। তাঁর হিসেব মতো বৃষ্টি হবার কথা রাত ন’টা-দশটার দিকে। এখুনি আকাশ এত অন্ধকার হলো কেন?
তাঁর ব্যক্তিগত বেয়ারা মোতালেব চায়ের কাপ নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। ঠিক সাড়ে চারটার সময় তিনি এক কাপ হালকা লিকারের চা খান। বিকেল পাঁচটায় অফিসে উপস্থিত হন। আজ নিয়ম ভাংতে ইচ্ছে করছে।
তিনি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, মোতালেব আকাশে কি মেঘ আছে?
মোতালেব বিস্মিত হয়ে বলল, জ্বি।
কী মনে হয় তোমার, বৃষ্টি হবে?
ঝুম বৃষ্টি হবে স্যার। আসমান অন্ধকার কইরা মেঘ করছে।
তুমি টেলিফোন করে জীবনকে জানিয়ে দাও যে আজ অফিসে যাব না।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ঝুম বৃষ্টি যদি নামে তাহলে আজ বৃষ্টিতে গোসল করব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
হিশামুদ্দিন সাহেব লক্ষ করলেন মোতালেব তাঁর কথায় অবাক হলো না। মোতালেবকে এখন পর্যন্ত তিনি বিস্মিত হতে দেখেন নি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হিশামুদ্দিন সাহেব বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
তাঁর খুব অস্থির লাগছে। অস্থির লাগছে কেন? তৃতীয় স্ট্রোকের সময় কি হয়ে গেছে? কপাল ঘামছে? পিঠের মাঝখানে ব্যথা বোধ হচ্ছে।
তিনি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। তাঁর কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কথা বলার জন্যে মোতালেবকে কি ডেকে পাঠাবেন? সে বিছানার কাছে এটেনশন হয়ে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে–তিনি কথা বলে যাবেন। তিনি ডাকলেন–মোতালেব।
মোতালেব ছুটে এল। তিনি কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তার বাবার ফ্যান চুরির গল্পটা কি বলবেন? গল্পটা সে কীভাবে নেবে? সবাইকে কি সে বলে বেড়াবে–আমাদের স্যারের বাবা ছিলেন চোর। কথাগুলো সে বলবে ফিসফিস করে। যারা শুনবে তারাও অন্যদের কাছে ফিসফিস করবে।
মোতালেব।
জ্বি স্যার।
বৃষ্টি কি নেমেছে?
জ্বি না। স্যার।
আচ্ছা তুমি যাও–এক কাজ কর, টেলিফোন হ্যান্ডসেটটা দিয়ে যাও।
মোতালেব বের হয়ে গেল। হিশামুদিন সাহেব তাঁর শোবার ঘরে টেলিফোন রাখেন না। টেলিফোন কেন–কিছুই রাখেন না। বিশাল একটা ঘর, ঘরের মাঝখানে প্ৰকাণ্ড একটা খাট-আর কিছু নেই। কাপড় বদলানোর জন্যেও তাকে পাশের ঘরে যেতে হয়। ফাঁকা একটা ঘরে রাতে যখন ঘুমোতে আসেন তখন তাঁর মনে হয় তিনি খোলা মাঠে শুয়ে আছেন।
টেলিফোন নিয়ে মোতালেব ঢুকাল না, ঢুকল রহমতউল্লাহ। শঙ্কিত গলায় বলল, স্যারের শরীর কি ভালো?
হিশামুদ্দিন বললেন, শরীর ভালো। তুমি টেলিফোন রেখে চলে যাও।
কাকে করবেন বলুন স্যার, আমি লাইন লাগিয়ে দি।
কাকে করব বুঝতে পারছি না। তুমি রেখে যাও।
ডাক্তার সাহেবকে কি খবর দেব স্যার?
না।
আজ রাত আটটায় আপনার ডিনারের দাওয়াত, চেম্বারস অব কমার্সের মিটিং। আপনি কি যাবেন?
আটটা বাজতে তো দেরি আছে–আছে না?
জ্বি স্যার।
আমি যাব। তবে বৃষ্টি নেমে গেলে যাব না। আজ বৃষ্টিতে ভিজব।
রহমতউল্লাহ অস্বস্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। হিশামুদ্দিন বললেন, আচ্ছা তুমি যাও। রহমতউল্লাহ গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। হিশামুদ্দিন বললেন, তুমি কিছু বলবে?
জ্বি না স্যার।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, যাও।
হিশামুদ্দিন টেলিফোন সেট হাতে নিয়ে বসে আছেন। কাকে টেলিফোন করবেন? এমন কেউ যদি থাকত যার সঙ্গে সহজ স্বাভাবিকভাবে গল্প করা যায় তাহলে ভালো হতো। এমন কেউ নেই। ক্ষমতাবান মানুষরা ধীরে ধীরে কী পরিমাণ নিঃসঙ্গ হয় তা তিনি এখন বুঝতে পারছেন। তাঁর ক্ষমতা আরো বাড়বে–তাকে অর্থমন্ত্রী করার কথা হচ্ছে। প্রস্তাব এখনো সরাসরি আসে নি, তবে চলে আসবে। তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। পেছনের সিটে তিনি গা এলিয়ে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে থাকবেন। ফাইল হাতে ড্রাইভারের পাশে তার চেয়েও বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে থাকবে তার পিএস। পেছনের একটা গাড়িতে বসে থাকবে সিকিউরিটির লোকজন।
হাসানকে তাঁর বাবার গাড়িগ্ৰীতির গল্পটা বলা হয় নি। একদিন বলতে হবে। তাঁর বাবার গাড়িগ্ৰীতি ছিল অসাধারণ। কিছু টাকা-পয়সা যোগাড় হলেই তিনি একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেলতেন। ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে আধঘণ্টা বা এক ঘণ্টা শহরে ঘোরা।
মোতালেব ঘরে ঢুকল। হিশামুদ্দিন বললেন, কিছু বলবে মোতালেব?
বৃষ্টি নামছে স্যার।
বেশি নেমেছে না ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে?
ফোঁটা ফোঁটা।
যখন ঝুম বৃষ্টি নামবে তখন বলবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার। চা দিমু?
না।
হিশামুদ্দিন টেলিফোনের নাম্বার টিপছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ কিন্তু টেলিফোন নাম্বার মনে থাকে না। মনে রাখার চেষ্টাও অবশ্য করেন না। টেলিফোন নাম্বারা মনে রাখার জন্যে তার লোক আছে। একটা টেলিফোন নাম্বারই তার মনে থাকে। মেয়ের নাম্বার। মেয়েকে টেলিফোন করে কি পাওয়া যাবে? সামারে সে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।
কে? চিত্ৰলেখা?
বাবা তুমি!! কী ব্যাপার?
এত অবাক হচ্ছিস কেনা! আমি টেলিফোন করতে পারি না?
অবশ্যই পার। আমি সে জন্যে অবাক হচ্ছি না। আমার অবাক হবার কারণ ভিন্ন।
কারণটা কী?
আমি ক্যাম্পিং করতে যাচ্ছি ভার্জিনিয়াতে। গাড়িতে সব জিনিসপত্র তোলা হয়েছে। গাড়ি স্টার্টও দিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো সব নেয়া হয়েছে, কাগজ-কলম নেয়া হয় নি। কাগজ-কলম নেবার জন্যে আবার ফিরে এসেছি–শুনি টেলিফোন বাজছে। তুমি কেমন আছে বাবা?
ভালো।
তোমার ডিপ্রেশন কেটেছে?
আমার আবার ডিপ্রেশন কী?
শেষবার যখন তোমার সঙ্গে কথা হলো–তখন মনে হলো–তুমি খুব ডিপ্রেশনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ।
আমি ভালো আছি।
তোমার জীবনের মজার মজার ঘটনাগুলো যে কাকে দিয়ে লেখাচ্ছিলে–এখনো কি লেখাচ্ছ?
লেখা কেমন এগোচ্ছে?
খুব এগুচ্ছে না।
যা লিখেছি আমার কাছে ফ্যাক্স করে পাঠাও, আমি পড়ে দেখি।
আচ্ছা পাঠাব।
তোমাদের ওখানে ওয়েদার কেমন?
খুব গরম পড়েছে। অনেক দিন বৃষ্টি হচ্ছে না।
এদিকে ওয়েদার খুব চমৎকার। তোমাকে কি আমি একটা অনুরোধ করতে পারি বাবা?
হ্যাঁ করতে পারিস।
তুমি আমার কাছে চলে এস। আমরা দুজনে মিলে ক্যাম্পিং করব। তাবুর ভেতর থাকব। নিজেরা জঙ্গল থেকে কাঠ এনে রান্না করে খাব। হ্রদে মাছ ধরব। সেই মাছ বারবিকিউ করে খাব। বাবা আসবে?
না।
তুমি এত কঠিন করে না বলা শিখেছ কীভাবে?
না বলতে পারাটা খুব বড় গুণ মা। বেশির ভাগ মানুষ ‘না’ বলতে পারে না। এতে তারা নিজেরাও সমস্যায় পড়ে, অন্যদেরও সমস্যায় ফেলে। আমার বাবা কখনো না বলতে পারতেন না। যে যা বলত–তিনি বলতেন, আচ্ছা। শুধু এই কারণেই সারা জীবন তিনি একের পর এক সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছেন…
বাবা!
হুঁ।
তুমি যে-কোনো আলাপে তোমার বাবাকে নিয়ে আসা কেন? তাঁর ব্যাপারে তোমার কি কোনো অপরাধবোধ আছে?
হিশামুদ্দিন সাহেব জবাব দিলেন না। চিত্ৰলেখা বলল, বাবা আমি এখন রওনা হচ্ছি। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব। আর শোন–কোনো কারণে আমি যদি তোমার মন খারাপ করিয়ে দিয়ে থাকি তাহলে–সরি। এপোলজি কি গ্রান্টেড বাবা?
হ্যাঁ গ্রান্টেড।
হিশামুদিন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোতালেব চা নিয়ে ঢুকাল। তিনি চা চান নি। কিন্তু এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, বৃষ্টি কি নেমেছে?
মোতালেব লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি না স্যার।
বৃষ্টি না নামার অপরাধে সে নিজেকে অপরাধী ভাবছে।