০২. গণিকা এবং চৌষট্টি কলার সমন্বয়

০২. গণিকা এবং চৌষট্টি কলার সমন্বয়

বর্তমানে ধাত্রীবিদ্যা, উদ্যানবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি যেমন নানাপ্রকারের বিশেষ শিক্ষা আছে, ঠিক তেমনই সেকালে গণিকাবিদ্যাও ছিল এমনই এক শিক্ষণীয় বিষয় এবং সেই শিক্ষা এক্কেবারেই নিন্দনীয় ছিল না। এই বিষয়ে পৃথক বিদ্যালয়ও ছিল। রীতিমতো পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলন দ্বারা আগামীদিনের হবু গণিকাদের এইসব বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হতে হত। নৃত্য-গীত-বাদ্য ছাড়াও চিত্রকলা, জ্যোতিষশাস্ত্র, অভিনয়, রন্ধনবিদ্যা, ভাষাশিক্ষা, লিখন, মার্জিত ভাষায় কথা বলা, মালা গাঁথা ইত্যাদি এরকম ৬৪ কলায় পারদর্শী করে তোলা হত। ৬৪ কলায় সুশিক্ষিতা, রূপবতী গণিকারাই জনসমাজে বা রাজদরবারে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হতেন, সমাদর পেতেন।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা বলছে–গণিকাবৃত্তি হল স্বামী বা বন্ধুকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে নগদ অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে বাছবিচারহীন ভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই পণ্য-দুনিয়ায় নারী-মানুষকে পণ্য করার বা পণ্য হওয়ার নেটওয়ার্কগুলির জোয়ার ক্রমবর্ধমান। আজকাল প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিয়েই যৌনকর্মী নিয়োগ ও কাস্টমারদের আহ্বান করা হচ্ছে। জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিরাপত্তা সহ অন্যান্য সুবিধাগুলি। যৌন বাণিজ্যে এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফা।

বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রম’ গ্রন্থের ‘বৈশিকাখ্যং’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“রুচি হইতে যে পুরুষগ্রহণপ্রবৃত্তি, তা স্বাভাবিক আর ‘অর্থাৰ্জনার্থ’ যে প্রবৃত্তি তা কৃত্রিম।” বাৎস্যায়ন উল্লিখিত ‘অর্থাৰ্জনার্থ’ এই কৃত্রিম প্রবৃত্তিই নিন্দাহ। এই গণিকাবৃত্তিই বর্তমান বিশ্বে পয়লা নম্বরের বাণিজ্য-উপজীব্য। এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নেতা, মন্ত্রী, পুঁজিপতি, সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী ও পুরুষ। অনেক দেশের রাজকোশ উপচে পড়ে গণিকাবৃত্তির রাজস্বতে। কৌটিল্য বিভিন্ন কারণে যৌন-ব্যাবসাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলেন। অবৈধ নারীসংসর্গ বোঝাতে তিনি ‘বাহবিহার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ‘বাহবিহার’-এর পক্ষে বা বিপক্ষে স্পষ্ট করে কিছুই তিনি বলেননি। বাৎস্যায়ন বলেছেন–গণিকা অথবা বিধবাদের সঙ্গে দেহসম্ভোগ সমর্থন করা হয় না, আবার নিষিদ্ধও নয়।

সমাজবিদ লেকির মতে, গণিকাবৃত্তি হল সমাজের মাত্রাতিরিক্ত যৌনকামনা বেরিয়ে যাওয়ার একটি সেফটি ভালভ। লেকি মনে করেন, নিজে মূর্তিমতী পাপীষ্ঠা হলেও পরিণামে পুণ্যের অধিকারিণী এই মেয়েরা। এরা না থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত।” তাহলে কি গণিকারা যুগের পর যুগ সমাজের বিষ-ক্লেদ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠী হয়ে থেকে যাবে? উঁহু, গণিকারা লেকির সঙ্গে একমত নয়। গণিকারা মনে করে না, তাঁরা সমাজের সেফটি-ভালভ। তাঁরা মনে করেন গণিকা ছাড়াও এই সমাজে প্রচুর নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা গোপনে যৌন-বিনোদন দিয়ে থাকেন। গণিকারা মনে করে না, সেই কারণে তাঁরা পুণ্যের অধিকারিণী। গণিকারা মনে করে না, তাঁরা না-থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত। গণিকালয়ে গিয়ে প্রচুর গণিকাদের সঙ্গে কথা বলে আমার অন্তত সেটাই মনে হয়েছে।

নারীবাদী কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন একটি ব্লগে লিখেছেন–ক্রীতদাস প্রথার সঙ্গে পতিতাপ্রথার মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন তুলো ক্ষেতে চাষের কাজ করত, দাসমালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেত। ত্বক যাঁদের একটু কম কালো, সাধারণত তাঁদেরকেই পছন্দ করত। বাজারে নিয়ে যৌন-ব্যাবসার জন্য ভাড়া খাটাত, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই নগদ টাকায় ক্রীতদাসীদের বিক্রি করে দিত। আঠারো-উনিশ শতকে যে প্রথাটিকে বলা হত ক্রীতদাস প্রথা, বিংশ একবিংশ শতকে সেই প্রথাকে বলা হচ্ছে পতিতাপ্রথা।” লেখিকা অনেক পুরোনো ধারণা নিয়ে লিখেছেন বোঝাই যাচ্ছে তাঁর বক্তব্য পড়ে। সময় বদলে গেছে অনেক। সব গণিকাই ক্রীতদাস নয়। এখন বহু সাধারণ মহিলারা স্বেচ্ছায় এই গণিকাবৃত্তিকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিচ্ছেন আর পাঁচটা জীবিকার মতোই এবং স্বাধীনভাবেই জীবিকা করেন। বর্তমানে কোনো মেয়ে বা মহিলাকে জোর করে কোনো গণিকালয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া এত কাজ নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় এক চিত্র পাওয়া যায়। কী বলছে অর্থশাস্ত্র? অর্থশাস্ত্র বলছে দেহ-ব্যাবসা একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপনীয় নয়। কৌটিল্যের সময় দেহ-ব্যাবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এই শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। অর্থশাস্ত্রের ২৭ অধ্যায়ে গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে।এখানে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কার বহু পুরুষগামী বারাঙ্গনা নারীদের হাল-হকিকৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বলা হয়েছে, গণিকাধ্যক্ষের কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত করা ও দেখভাল করা। গণিকাধ্যক্ষদের নিযুক্ত করতেন দেশের রাজা। গণিকাধ্যক্ষের আর-একটা প্রধান কাজ ছিল গণিকাদের আয় ও ব্যয়ের হিসাবপত্র রাখা। কোন্ গণিকার দিনে কত খরিদ্দার আসছে, খরিদ্দার-পিছু পারিশ্রমিক কত, উপরি পাওনা বা বকসিস কী ও কত, তার ব্যয়ই-বা কত ইত্যাদি সবকিছুই সে জাবেদা খাতায় নথিভুক্ত করত। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, কোনো গণিকা যদি তাঁর বৃত্তি ছেড়ে চলে যায়, অথবা কোনো কারণে মারা যায়, তাহলে তাঁর মেয়ে বা বোন তাঁর বৃত্তি গ্রহণ করবে। এই কারণেই তাঁর ত্যাজ্য সম্পত্তিরও সে মালিক হবে। অথবা সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মা তাঁর শূন্যস্থানে অন্য কোনো যোগ্য মেয়ে দ্বারা পূরণ করতে পারবে। যদি সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মেয়ে বা বোন বা মাতৃনিযুক্ত প্রতিগণিকা না-থাকে সেক্ষেত্রে তাঁর ত্যাজ্য ধন রাজকোশে জমা পড়বে।

কৌটিল্যের সময় গণিকাদের তিনভাগে ভাগ করা হত। যেমন–কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম। কোন গুণাবলি বিবেচনা করে এই বিভাজন? বিভাজন হত কোন্ গণিকার কীরকম রূপ, কীরকম শারীরিক গঠন, কীরকম বয়স–সব মিলিয়ে তাঁর পুরুষকে আকর্ষণ ও মনোরঞ্জনের ক্ষমতা কতখানি, এসব দেখে তাঁকে উত্তম বা মধ্যম বা কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার স্বীকৃতি দেওয়া হত। এই স্বীকৃতি বা সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা ছিল একমাত্র গণিকাধ্যক্ষের। গণিকার শ্রেণিভেদে বেতন তথা পারিশ্রমিকও ছিল ভিন্ন। যেমন–কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল ১০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল। ৩০০০ পণ। সেসময় কোনো রাজকুলে নিযুক্ত গণিকারা যদি রাজসেবা থেকে কোনো কারণে মুক্তি চাইত, তাহলে সেই গণিকাদের রাজার কোষাগারে ২৪,০০০ পণ মুক্তিমূল্য দিতে হত। এমনকি গণিকাদের সন্তানদের দাসত্ব (গণিকার সন্তানদের ‘দাস’ হিসাবে গণ্য করা হত) থেকে মুক্তি পেতে ১২,০০০ পণ নিষ্ক্রয় দিতে হত। গণিকাদের কাছ থেকে শুধুই নিঙড়ে নিত যাঁরা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, তাঁদের বলি–নিঙড়ে যেমন নিত, তেমনি নিরাপত্তার দিকটিও কঠোরভাবে দেখা হত। যেমন–কোনো কামনারহিত গণিকাকে কোনো পুরুষ (খরিদ্দার) তাঁর ঘরে আবদ্ধ করে রাখে, অথবা কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখে এবং তাঁর শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি করে, দাঁত দিয়ে তাঁর বিশেষ বিশেষ স্থানে আঘাত করে তাঁর রূপ নষ্ট করে–তাহলে সেই পুরুষপুঙ্গবটিকে ২৪,০০০ পণ এবং প্রয়োজনে ৪৮,০০০ পণ পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এখানেই শেষ নয়, যে গণিকা রাজার ছত্র, ভৃঙ্গার (জল ছিটানোর ছিদ্রযুক্ত পাত্রবিশেষ) বহনের কাজে নিযুক্ত হয়েছে, তাঁকে কোনোরকম মারধর করলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত পুরুষটিকে ৭২,০০০ পণ অর্থদণ্ড করা হত।

শুধু খরিদ্দার-পুরুষদের জন্যেই শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল, তা কিন্তু নয়। শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল গণিকাদেরও। যেমন–(১) রাজার আজ্ঞা বা আদেশ সত্ত্বেও যদি কোনো গণিকা কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় আপত্তি জানায়, তাহলে সেই সংশ্লিষ্ট গণিকাকে ১০০০ বার চাবুক মারা হবে। কখনো-কখনো ৫০০০ পণ পর্যন্ত গুণগারি দেওয়ার রীতি ছিল। (২) যদি কোনো গণিকা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনক্রিয়া করার শর্তে অগ্রিম অর্থ নিয়ে দুর্ব্যবহার করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট গণিকা অগ্রিম অর্থের দ্বিগুণ পুরুষটিকে ফেরত দিতে হত। (৩) যদি কোনো গণিকা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনক্রিয়া করবে এই শর্তে রাত্রিযাপনের কোনোরূপ আগাম অর্থ নিয়েও যৌনমিলন না করে, তাহলে উক্ত পুরুষ গণিকাটিকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছিল তার আট গুণ অর্থ ফেরত দিতে হত। (৪) কোনো গণিকা যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে কোনো পুরুষকে হত্যা করে, তাহলে সেই মৃত পুরুষের জ্বলন্ত চিতায় খুনী গণিকাকেও পুড়িয়ে মারার বিধান ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *