গঙ্গায় জোয়ার-ভাঁটা আসে, চোরাবানে আচমকা কখনও দু কুল ড়ুবিয়ে বেড়ে ওঠে, আবার নেমে যায়। প্রতি মুহূর্তে চলমান, মৃত্যুহীন। অম্বুবাচি আসে, ঋতুস্রাবে চিরযৌবনা গজার অথৈ লাল জল দু কুল প্লাবিত করে বয়ে চলে কখনও হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরে, কখনও নিস্তরঙ্গ ক্লান্ত, সমুদ্রের নীল জলের ধারায় স্বচ্ছ টলটলে। বয়ে চলার বিরাম নেই।
বিরাম নেই রাত্রি আসার, দিন যাওয়ার। মাস যায়, আসে নতুন বছর। আবার যায় আবার আসে। কিন্তু যা যায় তা আসে না, নতুন মানুষ আসে, কিশোর যুবক হয়, যুবক বৃদ্ধ হয়। সে দিনের আঁচল-চাপা মেয়ের গর্ভে আসে সন্তান, নতুন বকনা গাই বিয়োয় বাদুর। ঘাস জ্বলে কোথাও মাটি হয় বন্ধ্যা, নতুন ঘাস গজায় কোথায়, কোথাও মাটি রসসিক্ত উর্বরা হয়ে ওঠে।
জঙ্গলপীরের দহ থেকে গঙ্গা সরে। ফরাসডাঙার ঢ্যাপচ্যাপে ঘাটের কোল কিঞ্চিৎ বমি হয়ে ওঠে। ঐতিহ্য নিভে আসে দীনেমার গড়ের। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে একবার ফরাসডাঙার থানায় থানায় বেজে ওঠে নাকাড়ার শব্দ। ঢিমে তালের ঢ্যাপচ্যাপে সেই শব্দ। বিদেশি শাসনের চাপে ভেঙে পড়ে আগের সমাজব্যবস্থা, মানুষ তার লেনদেনে পর হয়, পরস্পর কেবলি দুরে যায়।
জগদ্দলের সেনেরা কোম্পানির দেওয়ানির চোগা-চাপকান পরে লাখ থেকে দু লাখ, তারপর লাখ লাখ মোহর টাকায় সিন্দুক ভরে তোলে। সোনাদানায় ভরা ভরতি ভাঁড়ারে রক্তের দাগ লেগে থাকে, ছাতা পড়ে। চরণাশ্রিত দেওয়ানের দুর্ধর্ষ লাঠিয়ালেরা মাসে মাসে হিসাব কষে, কোন অভিযানে কত টাকা এল, কী ক্ষয়-ক্ষতি হল। দেওয়ান না বাঘ, বাঘ না দেওয়ান কিংবা সেনেরা সিংহ, তারা বাঘ, শক্তি ও হিংস্রতার এ হিসাব মেলানো মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পড়ে তাদের পক্ষে। তবে তার দরকার নেই খুব। নীল রক্তের আবর্তে সাদা ফেনার মতো শুভ্র পবিত্র। প্রভুভক্তিতে উজ্জ্বল তারা। রক্ত পিপাসার্ত জীবনে মাঝে মাঝে ঝিমুনি এসেছে, দেওয়ানি অভিযানের বিশ্রাম সেটা। কিন্তু সেনেদের আস্তাবলের ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি ও পা ঠোকার খুরের শব্দে আচমকা ঝিমুনি কেটে গেছে, রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিক গতি যেন ফিরে পেয়েছে। জীবনের এই তো পথ। গড়া নয়, দেওয়া নয়, গ্রাম জনপদ শুধু রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া, কালো বিশাল দেহ নিয়ে শক্ত বাঁশের লাঠির ঝাপটায় ঝড়ের বেগে উড়ে যাওয়া। কিন্তু হেষাধ্বনির জবাবে হয়তো ঝঙ্কার পড়েছে বীণার তারে, সুললিত কষ্ঠে প্রাণ রাঙানো রাগিণী উঠেছে প্রাসাদ-প্রকোষ্ঠে। বিশ্রাম শেষ হয়নি এখনও। নয় তো দেওয়ানি অভিযান নয়, চওড়া সড়কের বুকের উপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে কেশর ফুলিয়ে অশ্ব সওয়ার নিয়ে ছুটে গেছে দক্ষিণে আতপুর রাজপ্রাসাদের খিলানে শব্দ তুলে, শ্যামনগর পেরিয়ে গাড়লিয়ার নীলকুঠিতে কিংবা গঙ্গার বুকে ভাউলের দাঁড় সন্তর্পণে ককিয়ে উঠেছে, ফরাসডাঙার আকাশে ড়ুবন্ত সূর্যের লাল আলোয় চকচকিয়ে উঠেছে ইংরেজি বুটজুতা ভাউলের ছাতে বসা যাত্রী দেওয়ানেরা। দেওয়ানি বিলাস-ভ্রমণ।
কখনও কয়েদখানা থেকে ভেসে আসে কয়েদির আর্তনাদ, শিকলের ঝনাঙ্কার, বাগদী সিপাহির হুঙ্কার। সেনেদের কয়েদখানাও আছে। কোম্পানি তাদের এ অধিকার দিয়েছে, পনেরো দিন পর্যন্ত কয়েদ করবার অধিকার আছে তার অপরাধীদের। কিন্তু সবই তো কটাক্ষের ব্যাপার। যার উপর কোপকটাক্ষ পড়েছে তার কত পক্ষকালই কেটে যায়, যার উপর দয়া আছে সে দুদিনেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে। এ বে-আইনের খবর কোম্পানিকে দেওয়ার সাহস কারও নেই, কোম্পানিরই বা অবসর কোথায় সে খবর নেওয়ার।
দরবারের সরকার কায়স্থের রক্তে দেওয়ানি-সুরা যেন ঐশ্বর্যের গৌরবে মত্ত করে তুলেছে। জগদ্দল বলে লাভ কী? সেনপাড়া বলাই ভাল। ওই নামের মহিমা আর সব নামই তো গ্রাস করেছে।
তা ছাড়া আছে দান ধ্যান। আশ্রিত মানুষেরা এদের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির কামনা করে ভগবানের কাছে। পালা পার্বণে নতুন গামলা ভরতি মিষ্টি, মাটির হাঁড়ি ভরতি তেল, চাকরবাকরদের সংসার তো পরিপূর্ণ। কথায় কথা আমদানি হয়। দেওয়ান গৌরী সেনের নামে মুখে মুখে কথা ছড়ায়, লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। সেনেদের কল্যাণে স্যানপাড়ায় দুঃখ নেই, অভাব নেই, গাঁয়ের বাসিন্দারা নামের গরিমায় গর্বিত।
আগুরীপাড়ার ঘাটে বসে বুড়ো কালো দুলে গল্প করে, কী আর দেখলে বাছা তোমরা? আমরা যা দেখেছি খেইয়াছি পেইয়াছি, এখন তো তার আদ্ধেকখানেক দেখেছ তোমরা? কত দূর দেশ থেকে মানুষ এয়েছে সেনেদের কাছে অভাবে দুঃখে। বিমুখ তো দূরের কথা, যা পেয়েছে তা নিয়ে যেতে পথেঘাটে বেপদ-আপদের ভয়ে সঙ্গে দিয়েছে, লেঠেল পাইঠে।…হ্যাঁ, আমার বড় ব্যাটা অই মতি তখন পেটে, সোহাগ করে বউ বলল নাক তুলে, তার একখানা নাকছাবি চাই।… বড় কত্তা চেরকালই বড় ভালবাসতেন আমাকে। গেনু তার কাছে পায়ে পায়ে। যাওয়া এক কথা, সামনে গে মুখখোলা বড় চাড্ডিখানি নয়। গিয়ে গড় করনু। কত্তা একবার মুখ তুলে খালি বলল, কী চাই কালো? বাবারে বাবা! গলা কাঠ হয়ে গেল, মুখে রা ফোটে না। কেমন করে বলি, পোয়াতি মাগ আমার সাধ করে কিছু খেতে চায়নি, চেয়েছে নাকছাবি! ওদিকে দরজার আড়ালে চুড়ি বেজে উঠল ঝুনঝুন করে। কত্তা দাঁইড়ে পড়ে বললেন, কিছু তো বললি না কালো, কোনও আপদ-বিপদ হয়নি তো?
বলে ফেলনু, তা বেপদই কত্তা, লইলে পোয়াতি বউ খেতে না চেয়ে নাকছাবি চায়? কত্তা হো হো করে হেসে উঠলেন, এই কথা? কিন্তু তার আগেই দরজার আড়াল থেকে রানীমা বেরিয়ে এলেন। হীরে বসানো নাকছাবি টুক করে নিজের নাক থেকে খুলে বললেন, সেদিন দেখেছি তোমার বউকে। নাকছাবি লাগাবার মতোই নাক বটে। এটা নিয়ে গে পইরে দেও।
কত্তার হাতের কাছে রুপোর বাটায় কিছু মোহর ছেল। কারও হয়তো আসবার কথা ছেল। বাটাসুদ্ধ আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, পঞ্চামৃতের খরচের জন্য এটা নিয়ে যাও। আর ছেলে হলে সোনার মল ঝিনুক আর বাটি নিয়ে যেয়ো, মেয়ে হলে সবই রুপোর পাবে।
ওমা! এদিকে দপাস করে রানীমার চোখ দুটো যেন জ্বলে গেল। গলা থেকে সোনার চাঁদহার খুলে দিল সেই মোহর দেওয়া, রুপোর বাটায়। বলল, মেয়ে হলে গলায় পরিয়ে দিয়ে। আর ছেলে হলে তোমার বউকে দিয়ো।
কত্তা তো হো হো করে হেসে উঠলেন, যে মা ছেলে প্রসব করে রানীমা তাকেই গলার চাঁদহার পুরস্কার দেয়, বুঝলি কালো। এবার তুই যা। আমি তো কিছু বুঝলুম না। সব যেন আঁধার মনে হল, ভয়ে-ময়ে কান্না পেল আমার। রানীমার মুখ তো নয় যেন লকলকে আগুনের শিষ। যাবার জন্য পেছন ফিরনু, রানীমার ভারী গলা শুনতে পেনু, নিশ্চয়, মেয়েমানুষ না হলে ছেলে প্রসব করবে কে? পুরস্কার যা তা মেয়েরই প্রাপ্য। সব পুরুষই তাদের গর্ভে জন্ম নেয়।
দরজার কাছখানে এসে পড়েছি, শুননু কত্তার কথা, আর সেটা পুরুষেরই ঔরসে।
–ব্যস! কোঁচড়ে ঢেকে ঢুকে তো সে হার মোহর ঘরে নে এনু, সেদিনই শুননু, কত্তা দিল্লির গাইয়ে মেরজা ওস্তাদকে সঙ্গে নে রানীকে বজরায় করে গঙ্গার হাওয়া খেতে গেছেন। আর রাতভর জেগে রইনু আমি আর মতির মা। আকাশে অ্যাই মস্ত চাঁদ, আলোর যেন বান ডেকেছে। মতির মা-র নাকে সেই নাকছাবি, কী মাতনই লাগল আমার বুকে। কিন্তু মনটা বড় দমে গেইছেল কত্তা আর রানীমার কাণ্ড দেখে। মতির মা কানে কানে বলল আমাকে, মিনসে তুমি ঠাওর পাও না, ওসব হল কত্তা আর রানীমার খুলমুটি খেলা। পিরিত বোঝে না।
–বুঝনু, কিন্তু অনেক পরে। যখন মতির জমো হল তখন কত্তা-রানীর দুজনের আমোদ দেখে। সে বছরই রানীমা গর্ভবতী হলেন।–
জগদ্দলের জোয়ানেরা আগুরীপাড়ার ঘাটে বসে স্তব্ধ বিস্ময়ে সে সব কথা শোনে। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে চুপ করে চেয়ে দেখে গঙ্গার জোয়ার-ভাঁটা। গঙ্গা ছোট হয়ে আসছে ধীরে ধীরে, ঠাহর করা ভার। তেমনি ভেঙে আসছে সেনেরাও। কথায় কথায় সোনা-মোহর নেই আর, আছে গামলা ভরতি মিষ্টি, তেল ভরতি হাঁড়ি। এও কি আর চেরকাল থাকবে?
কিন্তু কালো দুলে থামতে পারে না। আগুরীপাড়া ঘাটের হাওয়ায় গলা মিলিয়ে বলে, এত বড় কী আর চেরকালই ছিল স্যানেরা। না, তা নয়। তবে বলি শোন, কোম্পানির সঙ্গে পাঞ্জাবে না রেঙ্গুনে ত্যাখন যুদ্ধ চলছে। শীতকাল। স্যানেদের এক কত্তা রোদ পোয়াতে গিয়ে গঙ্গার ধারে ঘুমে পড়েছে। কোম্পানির সেপাইয়ের নৌকা চলেছে গঙ্গার উপর দে। সেপাইদের সঙ্গে যে সায়েব ছেল, সে ভেড়াল নৌকো পাড়ে, অনেক ইডিংমিডিং করে কী সব জিকেসাবাদ করল কত্তাকে। কত্তারা তো বরাবরই খুব চরকো। জবাব দিলে চটপট। অমনি সায়েব ধরে বসল, বাবু, তোমাকে যেতে হবে আমার সাথে নড়ই করতে। কত্তা তো ভেবে-মেবে রাজি হল। কিন্তু বায়না ধরল, যেতে হলে সাহেবকে কিছু টাকা দিতে হবে তার মাকে দে যাওয়ার জন্য। সায়েব তাতেই রাজি। মাকে টাকাপয়সা দে কত্তা বেরিয়ে পড়ল। দিন গেল, মাস গেল অ্যানেক, কোম্পানির জিত হল সে যুদ্ধে। আর জিত হলেই তো লুটপাট। সায়েব বলল, বাবু, তুমিও লুট করো। বাবু তো বাগদী-কেওরের মতো বন্দুক কাঁধে লুট করবে না। তিনি গে দখল করল এক বাড়ি, তার এক ঘরে শুধু ন লক্ষ টাকার পয়সা। কত্তা বলল, সায়েব, এত আমি নিয়েই বা যাব কী করে, আর তুমিই দেবে কেন? কিন্তু তখনকার ফিরিঙ্গিরা ছেল ভাল নোক, এখনকার মতো ছোঁচা ছেল না। বলল, এ-সবই তোমার, নে যাওয়ার সব বন্দবস্ত হবে। সেই থেকেই…
কিন্তু কেউ কেউ বাধা দেয় কালো দুলের কথায়। বলে, তবে যে শুনি বেধবা মেয়েকে দেখে–?
হাঁ, সেটাও কথা বটে। কালো দুলে অমনি বলে ওঠে। তবে সেটা হল ইজ্জতের কথা। কত্তারা স্বীকার পায় না, আর আমরাও চোখে দেখিনি। তবে ঘরে ঘরে খুব ফিসফাস হয়েছিল।…তখন ভরা বর্ষা, ভরাভরতি গঙ্গা। স্যানেদের এক মেয়ে অকালে বেধ্ব হয়ে বাপ-ভায়ের ঘরে ছেল। আর সে কী রূপ। আপসরীও হার মানে তার রূপের কাছে। সে গেছে একা গঙ্গা নাইতে। তখন এক ফিরিঙ্গি যাচ্ছিল দক্ষিণে তাদের গোবিন্দপুরের কেল্লাতে। তার চোখে পড়ল সেই মেয়েকে। বজরা ভেড়ালে সায়েব ঘাটে, বললে সে মেয়ের পায়ের কাছে বসে, সুন্দরী, তোমার রূপে আমার পরান ভুলেছে, তুমি আমার সঙ্গে চলো। কী জানি সে মেয়ে গোরার মনোহর রূপ দেখে ভুলেছে কি না। সে মেয়ে পাইলে গেল না, চুলের গোছায় মুখ ঢেকে আড়চোখে সায়েবকে দেখল, কী কথা হল। সে থেকেই এ দেওয়ানি।
সবাই চুপ করে শশানে, শুনেও চুপ করেই থাকে। কালো দুলের কথার রেশ টেনে চলে অবিরত বয়ে চলা গঙ্গার ছলছলানি। সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের আগ্রহ নেই। শুধু শুনেই খালাস। শেষ নেই শুধু সেকাল আর একালের। যুগে যুগে কেবলি সেকাল যায়, একাল আসে।
আতপুরস্থিত চারার রাজবাড়ির হাতিগুলোর বয়স বাড়ে। চঞ্চল ঘণ্টার শব্দ হয়ে আসে ধীর মন্থর। দুই হাতি—পবন পেয়ারী আর লক্ষ্মীপেয়ারী। বিশাল দুই গাব গাছে বাঁধা থাকে। নতুন দুটো চারা এনে লাগানো হয়েছে আসামের কামাখ্যা পাহাড়ের কোল থেকে। বেড়ে উঠলে হাতি বাঁধা হবে ওই গাছেই।
রাজা বরোদাকান্তর মা ভাঁটা-পড়া বয়সে যশোর থেকে গঙ্গাস্নানের ও অবিরত গঙ্গাদর্শনের আকাঙক্ষা প্রকাশ করেছিলেন ছেলের কাছে। তাই আতপুরের এ প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল। তবু ছেলেরা মাকে ছেড়ে বড় একটা থাকতেন না। তা ছাড়া, বিদেশি হলেও আতপুরের লোকেরা তাঁদের পর মনে করেনি, উপযুক্ত সম্মান দিয়েছে। মাকালীর বরপুত্র হিসাবে তাঁরা বরাবরই বিখ্যাত। ধর্মাচরণে তাঁরা সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বড়কত্তা আর নমশাই অর্থাৎ জ্ঞানদা ও বরোদাকান্ত প্রথমবারে গঙ্গাস্নান করতে এসে পরপর দুখানি মন্দির তৈরি করালেন। তা ছাড়া, কালীপুজো, গানবাজনা ভোজ উৎসব বারো মাস লেগেই থাকে। পশ্চিম থেকে বজরায় করে আসে ইহুদি বাঈজী। বিচিত্র বিদেশি মিঠা বুলি ও চোখের চাউনি ও নাচের ছন্দে আশপাশের সমস্ত চাকলা যেন মাতাল হয়ে ওঠে। ময়দার পাহাড় ওঠে, ঘিয়ের গন্ধে বুঝি সারা চবিবশ পরগনাই মাতোয়ারা। ঝাড়লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত রাজপ্রাসাদ।
সবাই এসে সেখানে ভিড় করে। জগদ্দল সেনপাড়ার লোকেরা আসে। দুলে বাগদী ডোম বামুন কায়েত বদ্যি। নিমন্ত্রণ দেওয়াই আছে। বিশেষ নিমন্ত্রণ যায় বিশেষ বিশেষ বাড়িতে। কেবল সেনপাড়ার পিরুলী বামুনেরা নিমন্ত্রণের অংশগ্রহণে সব সময় এগিয়ে আসেন না, তাঁদের কাছে সব সময় নিমন্ত্রণ যায়ও না। হালদার, মজুমদার, চক্রবর্তী জগদ্দলের এসব পরিবারই প্রায় পিরুলী বামুন। সাধারণভাবে এরা কেরেস্তান বলেই গণ্য। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে এলোমেলো সুতোর জটের মতো এরা প্রায় সকলেই না হোক, দু-এক ঘর জড়িত। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সম্পর্কহীন।
ইংরেজের দরবারে সকলেই প্রায় কোনও না কোনও উচ্চ পদে এঁরা অধিষ্ঠিত। শিক্ষায়-দীক্ষায় অগ্রগামী এরা সাধারণত। সেনপাড়া থেকে ভাউলে ভাসিয়ে কলকাতায় যান চাকরি করতে।
আপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ সেনপাড়া জগদ্দল চেহারা পালটায়। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে তার ধাক্কাটা ধনীজনদের ঘরে যত সুস্পষ্ট, বাকি জনপদে তার ছায়া তত চোখে পড়ে না।
শুধু উত্তর থেকে দক্ষিণের দীর্ঘ চওড়া সড়কটা তেমনি নির্জন ঝিমিয়ে পড়ে থাকে। বর্ষায় নতুন খানাখন্দ হয়, গরুর গাড়ি চলে, কোথাও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। পথটা বুড়ো হয়ে গেছে, বুড়ো বট অশখ দেবদারুর সঙ্গে বার্ধক্যের মিতালিতে একসঙ্গে যেন ঝিমোয় সারা দিনরাত্রি ধরে। পথের ধারে কাছে যারা থাকে তারা কখনও মাটি দিয়ে খাল গর্ত বুজিয়ে দেয়, বউ-ঝিয়েরা ঝাঁটা বুলিয়ে সাফ করে রাখে খানিক জায়গা। তবু আবার ধুলো জমে, পথ ভাঙে।
পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। এখুনি সে আকাশ ফুঁড়ে বেরুবে সূর্য। গাছের নতুন পাতায় হাওয়ার মাতন। পাখি ডেকে ডেকে অস্থির। জোয়ারের ছলছলানিতে গল্প জুড়েছে গঙ্গা।
বুড়ো পাটনির পুরনো নৌকায় ছেলে চুড়ামণি বসে বসে হাতের চেটোয় গাঁজা ডলে। আপন মনে গোঁফের ফাঁকে ফাঁকে হাসে। আর থেকে থেকে ও-পাড়ের ঢ্যাপট্যাপে ঘাটের ঝুপসিবাড়ের দিকে চোখ তুলে কী যেন খোঁজে। নিরাশ হয়ে চওড়া বুকটা ফুলে উঠে একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। তারপর হঠাৎ নজরে পড়ে নৌকার গলুইয়ের কাছে মস্ত এক শ্যামাকান্তী জোয়ান তার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে নীরবে। কে লখাইদাদা নাকি গো? এসো, বসো।
সেই বুড়ো পাটনির লখীন্দর, শ্যাম বাগদীর ঘরে তোলা মা মনসার বরপুত্র সেই গোঁফ-দাড়ি ভরা বিড়ম্বিত পলাতক সিপাহি। সেদিন ছিল একুশ বছরের তরুণ, জীবনের সমস্ত দুর্যোগে চেহারা ছিল ঢাকা। আজ গোঁফ-দাড়ি কামানো ছত্রিশ বছরের মস্ত জোয়ান। যেন তার যৌবনের এটাই শুরু। তার সিপাহি ব্যারাকের ও মরুভূমির রুক্ষ চোখ-মুখে এক শান্ত ছাপ পড়েছে, কটা চামড়া খানিক শ্যামল হয়েছে, মসৃণ হয়েছে শক্ত সুঠাম শরীরের ত্বক। তবু চোখ দুটো যেন তেমনিই আছে। সেই নবজন্মলব্ধ শিশুর মতো বিস্ময়ে ভরপুর। শ্যাম বাগদী জোর করেই তার মাথায় বাবরি চুল রাখিয়েছে। তাইতেই যেন তার মস্ত শরীরটায় পুরো রূপটুকু খুলেছে। নবজন্মই বটে। সে মানুষটাই আর নেই। আজ সে এ দেশের ভাষা বুঝতে পারে। বলতে পারে। শ্যামের বউ কালী তাকে শিখিয়েছে মাছ খাওয়া। মছলি তো সে খেত না আগে। বাগদীঘরে সে আজ হয়েছে লখাই বাগদী। পড়ে-পাওয়া মা মনসার বর-পাওয়া ছেলে। তার লখীন্দর হওয়ার কাহিনী আজ সেও জানে। জেনে শুনেই সে লখাই হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম কত কথা। দুলে বাগদী ডোম পাড়ায় পাড়ায় শুধু এক কথা-শ্যামের ঘরে নাকি লখীন্দর। আতপুর শ্যামনগর থেকে তাকে দেখতে এসেছিল লোকেরা।
কিন্তু কেউ কেউ ছড়াল বিষ। শ্যামের বউ কালীর নামে দিল কলঙ্ক। কী ভাগ্যি, নারানের বউ কাঞ্চন তখন ডেঙোডাঁটা নরম ডাঁটির মতো একহারা লম্বা একটি বালিকামাত্র। নইলে সে হয়তো রেহাই পেত না। শেষে ব্যাপারটা ছড়াতে ছড়াতে গেল সেনবাবুদের কানে। বিচার বলল, শাস্তি বলল সব তো তাঁরাই করবেন। বসল পঞ্চায়েতে, বিচার করলেন স্যানকত্তা। শ্যাম বাগদী চিরকাল সেনেদের অনুগত বলেই হোক বা ব্যাপারটা মিথ্যে ভেবেই হোক কিংবা লখীন্দরের চেহারা দেখে ভুলেই হোক কত্তারা রায় দিলেন শ্যামের পক্ষে। যারা দুর্নাম রটিয়েছিল, তারা অপরাধ স্বীকার করল। কেবল জরিমানা হল দুজনের। হরি কানা আর দাশু মালোর। হরি কানা কানা নয়। ওদের বংশের এই নাম। জরিমানা হল এক-একজনের দুধামা চাল আর দুগ করে ডাব আর চার গণ্ডা করে পয়সা। পরে অবশ্য ওই চার গণ্ডা পয়সা অনেক কাকুতিমিনতি করে মাপ হয়েছিল। বৈশাখের পয়লা দিনে সকলের মিলিত ধর্মপুজোয় জরিমানার দ্রব্য দিতে হয়েছিল তাদের, আর লখায়ের বিরাট শরীর সুন্দর স্বাস্থ্যের সম্মান দিয়ে বাবুরা তাকে প্রহরী নিযুক্ত করেছিল অতঃপুরে প্রবেশের বাইরের দালানে। শ্যামের জীবনে নতুন সৌভাগ্য। মা মনসার বরপুত্রকে ঘরে তুলেছে যে সে।
সে কথাও আজ জগদ্দল সেনপাড়ার মানুষেরা ভুলতে বসেছে। আস্তে আস্তে একথাও কালো দুলের গল্পের ঝুলিতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। ও-পাড়ের সিয়াজী পীরের দিকে তাকিয়ে আগুরীপাড়ার ঘাটে বসে তাকে বলতে শোনা যায়, হাঁ গো, নিজের চোখে দেখেছি খায়ের সারা গায়ে মা মনসার পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরার দাগ। জোয়ারের মুখে হুই জঙ্গলপীরে আটকে বিষহারিণী বিষ তুলে ভাঁটার টানে এই তো দে গেল রাজবাড়ির ঘাটের ধারে। একটা নয়, অনেক জগদ্দলের মানুষরা লখাইকে ভয়ও পেত। মা মনসা নিয়ে কথা। হয়তো মা-কে সে কখন কার উপর লেলিয়ে দেবে। কে বলতে পারে। আর সেনেদের বাড়িতে তাকে যে কাজে নিল তাতে সকলেই ব্যাপারটা বুকে নিজেদের মধ্যে একচোট মাথা নাড়ল। অর্থাৎ বাগদী শ্যাম বুঝুক বা না বুঝুক, তারা বুঝেছে, কত্তারা মনসার ছেলেকে ইচ্ছে করেই ঘরে নিয়ে তুলল। এমনি করে কারণে-অকারণে লখাইকে চেনে সবাই। জগদ্দল, আতপুর, শ্যামনগর।
একে তো নবজন্মই বলে। নাম গোত্র পরিচয়, সবই ঢাকা রইল, নতুন ঘরে নতুন মানুষ হয়ে সে জন্মাল। আজ সে লখাই বাগদী, স্যানেদের প্রহরী।…তবু মাঝে মাঝে তাকে দেখা যায়, প্রহরী অবস্থায় বড় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ঝাড়লণ্ঠনের দিকে চেয়ে থাকে, নয়তো শ্যামের ঘরের দাওয়ায় গালে হাত দিয়ে বসে কী যৈন ভাবে। ডাকলে সাড়া নেই, খাওয়া ভুলে যায়, নাওয়া ভুলে যায়। সবাই বলে, মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। ..না, কথা সে বলে না। কয়েকটা ছবির ছেড়া ছেড়া টুকরো অংশ মাঝে মাঝে আচমকা তার চোখের উপর ভেসে ওঠে। সে ছবির কোথাও ভয়াবহ যুদ্ধ, কামানের ছুটন্ত গোলর অগ্নিকণা, মাত্র একবার দেখা বিদ্রোহী সেনাপতির বীরত্বব্যঞ্জক মুখ। তারপর পরাজিত বিচ্ছিন্ন এক পলাতক সিপাহি হওয়ার আগে ধুলোর ঝড়ে জনপদের ধারে ধারে জঙ্গল মাঠ পাহাড় ভেঙে ছুটে চলেছে। আর দীর্ঘ সময় বয়ে যাওয়ার প্রহর গোনার ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো চোখের সামনে দোলে একখানি সোনার টিকলি।
কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে সেই দোলানি থেমে গিয়ে সোনার টিকলি থেকে থেকে কাঁচপোকার একখানি টিপ হয়ে জ্বলে জ্বলে ওঠে।
চুড়ামণির ডাকে লখাই গিয়ে বসল তার কাছে পাটাতনের ওপর। চুড়ামণি কলকেতে গাঁজা সাজিয়ে মালসা থেকে আগুন তুলে বলল, এতখানি সকালেই এদিকে কী মনে করে গো লখাইদাদা? কাজে যাওনি?
লখাই বলল, রাতভর তো পাহারা জেগে এলাম। এয়েছিলাম হেই বাগানে নারকেল পাড়াতে আর দু কাঁদি কলা। কালীবাড়ি যেতে হবে একবার দুই বউকে নে। তা তুমি ঢ্যাপঢেপিয়ার দিকে কাকে খুঁজছিলে?
বলে সে মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। চুড়ামণি সরবে হেসে কলকেটা এগিয়ে দিল লখাইয়ের দিকে। কলকে না নিয়ে লখাই বলল, ওপার থেকে এপারেই এত? ভিন দেশে গেলে তুমি তো বউপাগলা হয়ে যাবে। তারপর গলা নামিয়ে বলে, খুব খুবসুরত বুঝি?
মুহূর্তের জন্য কলকে ভুলে যায় চুড়ামণি। বউয়ের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে ভাষার অভাবে ধু চোখ জ্বলে উঠল তার। রূপ বর্ণনা আর হল না। বলল, সে তুমি যদি দেখতে গো দাদা, কী তার নাক-চোখ নাড়ার ঘটা! খালি আমার গাঁজার কলকে হাতে রাখবে, আর লৌকা নিয়ে বেরুবার সময় রোজ কাছা ধরে রাখবে।
আর রোজ খেয়া-পাটনিকে দেখতে গঙ্গায় ড়ুবতে আসবে বিহান বেলা, না? বলে উঠল লখাই। চূড়ামণি হো-হো করে হেসে উঠল। কিন্তু লখাই আচমকা গম্ভীর হয়ে গাঁজার কলকেটা টেনে নিয়ে দমভর টানতে শুরু করে দিল। যেন হঠাৎ কেউ থাবড়া মেরেছে তার মুখে কিংবা অশরীরী জীব দেখেছে—এমনি চকিতে ছায়া ঘনিয়ে এল তার মুখে।
চূড়ামণি বিস্মিত হয়। একটা মস্ত নিশ্বাস ফেলে কলকেয় দম দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, তা এট্টা কথা বলি দাদা। তুমি এট্টা বেটে করে ফেললা না কেন? কার অপেক্ষায় চুপ মেরে আছ তুমি? এই বয়েস, এই শরীল বউ নইলে কি চলে? বলে, আমার এমনিতেই মনে লয় কী আরও দু-চারটে বে করি। আর তুমি–
সে কথার কোনও জবাব দিল না লখাই। গাঁজার দম নিয়ে চোখ বুজে চুপ করে রইল। এমনিতেই সে খুব কম কথা বলে, এ-সব কথা হলে সে একেবারেই বোবা হয়ে যায়।
চূড়ামণির চোখে খানিক সংশয় দেখা দিয়ে হঠাৎ সচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল সে, আগের জন্মের কথা তোমার কিছু মনে-টনে পড়ে লখাইদাদা?
আগের জন্মের? খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে লখাই। চলমান গঙ্গার জলের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে। যেন সত্যিই মনে করবার চেষ্টা করছে তার গত জন্মের কথা। চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে ওঠে, কপালের শিরাগুলো ওঠে ফুলে। তারপর মাথা নেড়ে বলল, না, কিছুই মনে পড়ে না।
গাঁজার নেশায় দুজনের চোখই লাল। আধবোজা চোখে দুজনেই খানিক চুপ করে থাকে। তারপর চুড়ামণি হঠাৎ বলে, হয়তো বাপ-মা বে দিইছেল তোমার সাধ-আহ্লাদ করে, ছেল হয়তো তোমারও সোন্দর বউ। কিন্তু লখীন্দরের ভাগ্য নে জন্মেছ তুমি। সে জীবন তোমার কপালে নেই।
লখাই তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলল, ছেড়ে দাও ও-সব কথা, ভাল করে সাজাও আর এক কলকে। খেয়াঘাটে লোক এসে পড়বে এখুনি।
হ্যাঁ, সাজাই, বলে কলকে সাজাতে সাজাতে চূড়ামণি বলে, বাপের বড় সাধ ছেল মরবার আগে তোমাকে একবারটি দেখবার। রোজ রাতে মার কাছে তোমার গল্প করত। আর আমার কী মনে হয়েছেল জানো লখাইদাদা? বার বার লখাইকে বলা কাহিনী আবার সে শুরু করে। সে তাকে অশরীরী প্রেত ভেবেছিল। সব কথা জানা সত্ত্বেও ক রাত্রি তার মোটে ঘুম হয়নি। মাঝগজায়, ঝোপেঝাড়ে কেবলি সেকথা মনে হয়েছে, মনে মনে রামকে ডেকে থুতু ছিটিয়েছে বুকে। আবার কলকে সাজানো হয়, দুজনে টানে। ওদিকে কাঁচা রোদে হেসে ওঠে গাছপালা, মাঠ নদী।
হঠাৎ চূড়ামণির নজরে পড়ে ওপারের ঘাটে কলসি কাঁখে এক বউ জলের ধারে দাঁড়িয়ে। নজর পড়ে লখাইয়েরও। সে চুড়ামণির পিঠে চাপড় মেরে বলে, নাও, ওদিকে রাজবাড়ির মেজকতার আদালি এসে পড়েছে। চটপট পার করে দাও। পারানি দেখানি দুই-ই হবে।বলে হাসতে হাসতে নৌকা থেকে নেমে পড়ল সে। চুড়ামণি হেসে উঠল হো-হো করে।