খানিক্ষণ একটা নিস্তব্ধতা।
আমি বুঝতে পারছিলাম আমাদের চারদিকে দলের নারী-পুরুষ সবাই মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আমার ভয় ছিল ছোটো বাচ্চাগুলোকে নিয়ে। কিন্তু তারাও আশ্চর্যজনক ভাবে নিশ্চুপ। কারো গলা দিয়ে কোনো কান্না, চীৎকার বা উশখুশের শব্দ শোনা গেল না। মৃত্যু বা বিপদের সম্মুখীন হলে মানুষ যে বয়েস নির্বিশেষে নির্বাক হয়ে যায় এ অভিজ্ঞতা আমার এমনভাবে আগে কখনো হয় নি। আমি সীমাকে বললাম, আরও কতক্ষণ এভাবেই থাকুন। দেখা যাক কপালে কী আছে। আমার মনে হয় যারা গুলী ছুঁড়েছে, তারা বুঝতে পেরেছে আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। আনিসের দলও হতে পারে।
হায় ভগবান।
সীমা ফুঁপিয়ে উঠল।
আমার ওপাশ থেকে নন্দিনী আমার হাত চেপে ধরে আমাকে ইশারা করে বলল, কারা যেন আসছে।
আমি মাথা তুলে মাঠের অপর দিকে মাথা উঁচু করা মাত্রই দেখতে পেলাম কয়েকটা ছায়ামূর্তি মাঠের মাঝামাঝি এসে গেছে। খুব সতর্কতার সাথে তারা এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকে সামনের দিকে ঝুঁকে কোনোকিছু খোঁজার ভঙ্গিতে এগোচ্ছে। সম্ভবত এদের প্রত্যেকের হাতেই রাইফেল বা স্টেনগান বাগানো আছে। মুহূর্ত মাত্র। লোকগুলো আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে বলে মনে হল। আমি বুকে ভরসা নিয়ে চীৎকার দিয়ে উঠলাম। আনিস আমরা, গুলী ছুঁড়ো না।
উঠে দাঁড়া হারামজাদা। তোর আনিসের মায়েরে..। সাবধান, দৌড় দেবার চেষ্টা করলে সবগুলোকে জানে মারব।
একটা বাজখাঁই গলায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
নন্দিনী ও সীমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আর্ত কান্না ছড়িয়ে পড়ল আমাদের দলের মধ্যে। এখন পূর্বদিক একটু ফর্সা হয়ে এসেছে। সামনের ঝোপঝাড় থেকে সুর করে অনেকগুলো কোকিল ডেকে উঠল। বাদুড়ের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে মাঠ পার হয়ে। মাঠের ওপাশ থেকে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউও শুনতে পেলাম। মনে হয় সামনের জমাটবাঁধা অন্ধকারের মতো জায়গাটা আসলে কোনো গ্রামই হবে। সম্ভবত সেখানকার লোকজনও গুলীর শব্দে এতক্ষণে জেগে গেছে। মনে মনে এখন আশা করছিলাম আশেপাশের গাঁয়ের মানুষ স্মাগলার কিংবা যত খারাপই হোক, এগিয়ে এসে আমাদের বাঁচাক। আমি বুঝতে পারছিলাম আমরা এখন প্রকৃত শত্রুদের হাতে পড়ে গেছি। এরা নিশ্চয়ই এই অঞ্চলের সবচেয়ে খারাপ গুণ্ডা বদমাইশের দল যারা পাক-হানাদার বাহিনীর প্ররোচনায় শান্তিবাহিনী বা রাজাকারদের খাতায় নাম লিখিয়েছে।
আমি আমার দুপাশে দুটি মহিলাকে নিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। আমাদের দাঁড়াবার আগেই দলের শিশু বৃদ্ধ সকলেই মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিলাপ শুরু করেছে। বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এর মধ্যেই এগিয়ে গিয়ে রাজাকারদের সর্দার লোকটার পা জড়িয়ে ধরতে গিয়ে লাথি খেয়ে ফিরে এল। লোকগুলো প্রথমেই আমাদের সকলের বোঁচকাবুচকি কেড়ে নিয়ে এসবের ভেতর টাকা-পয়সা গয়নাগাটি যা কিছু ছিল হাতিয়ে নিল। দলের কারোরই পরণে কোনো গয়নাপত্র ছিল না বলে এখন পর্যন্ত কারো গায়ে হাত দিতে হয় নি। দলে সীমা ও নন্দিনী ছাড়া আর যে কয়জন বয়সের দিক দিয়ে যুবতী বলে মনে হচ্ছিল, এদের প্রত্যেকের কোলে বা পাশে শিশু সন্তান থাকায় লোকগুলোর দৃষ্টি ছিল সীমা ও নন্দিনীর ওপর। তাছাড়া আমাদের দলের প্রায় সকলের পোশাক-আশাক ও ছবিসুরৎ দেখলে সহজেই বোঝা যায় এরা নিম্নশ্রেণীর হিন্দু। নমশূদ্র পরিবারের ভয়ার্ত নরনারী। কৃষক, জেলে, কামারকুমার যারা পাকিস্তানী আমলে বাস্তুভিটা, সামান্য চাষবাসের জমি ও জন্মগত পেশা পরিত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে পারে নি এরাই এখন দলে দলে ভারতে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে গ্রাম খালি করে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন মাটি এবং মানচিত্র পরিত্যাগ করতে উদ্যত। সকলের চেহারার মধ্যেই এক অচেনা মৃত্যুর আতংক। এখন সকালের প্রথম আলো এসে পড়লো আমাদের ওপর। নন্দিনী ও সীমা যে নিম্নশ্রেণীর কোনো পেশাজীবী পরিবারের মেয়ে নয় তা এদের ফর্সা গাত্রবর্ণ, পোশাকের ঈষৎ আভিজাত্য ও চেহারা দেখলেই আঁচ করা যায়।
রাজাকারদের গ্রুপ লীডারটি এতক্ষণ দলের প্রত্যেকটি সদস্যকে তার রাইফেল উচিয়ে ঘুরে ফিরে পরখ করছিল। লোকটা বেশ লম্বা। একমাত্র তার পরণেই একটা নীল রংয়ের প্যান্ট ও গায়ে খাকি রংয়ের শার্ট। কোমরের বেল্টে একটা পিস্তলও ঝুলছে। অন্যেরা লুঙ্গি ও জামা পরা। কারো গায়ে শুধু গেঞ্জি। গ্রুপ লীডারটির গায়ের রং রোদে। পোড়া তামাটে। লম্বা নাকের নিচে মোটা একজোড়া গোঁফ। বয়স পঁয়ত্রিশের মতো হবে। অন্যেরা সকলেই অল্প বয়স্ক গাঁয়ের দীনমজুর শ্রেণীর কিশোর। গ্রুপ লীডারটা সীমা, নন্দিনী ও আমাকে বাদ দিয়ে দলের প্রায় সকলের সামনে গিয়েই এদের প্রত্যেককে পরখ করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে পকেট থেকে একটা বগা সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে কাঠিটা সীমার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চমকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
এই মালাউনদের সর্দার কে, তুমি?
হ্যাঁ, আমার সাথেই এরা যাচ্ছে।
আমি যথাসম্ভব দৃঢ়তার সাথেই জবাব দিতে চেষ্টা করলাম। যদিও আমার হৃদপিণ্ডটা তখন আতংকে এমন তোলপাড় করে লাফাচ্ছিল যে এ অবস্থায় মানুষের গলা দিয়ে সাধারণত কথা সরে না।
লোকটা সামনের দিকে তাকিয়ে সিগ্রেটে ঘন ঘন টান দিতে লাগল। আমি তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করতে গিয়ে দেখি মাঠটার পরে গাছপালার ভিতর মানুষের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো মানুষজনকে দেখছি না। হয়তো কেউ এখনো ঘুম থেকে জাগে নি। সূর্য তখন গাছপালার ওপর এসেছে। আকাশে গতরাতের মেঘলা ভাব থাকলেও, পূর্বদিকের প্রান্তসীমা পরিচ্ছন্ন থাকায় আকাশের নীলে উঠে আসা সূর্যের বিচ্ছুরণ থেকে রোদ ছিটকে পড়ছে। এ সময় এ অঞ্চলের কোনো গ্রামবাসীরই ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। সম্ভবত এই গোলযোগের সময় সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলো এখন জনশূন্য।
লোকটা সিগ্রেট ফেলে দিয়ে আমার সাথে কথা বলা শুরু করল, তোমার লোকদের বল টাকা-পয়সা গয়নাপাত্র কাপড়চোপড় বাসনকোশন যার কাছে যা কিছু আছে আমার সামনে রেখে দিতে। যদি কেউ কিছু লুকানোর ফিকির করে তবে বেটাছেলের মুখের ভেতর নল ঢুকিয়ে গুলী করব। আর মাগীদের ঐ জায়গায় রাইফেল ঢুকিয়ে দেব।
লোকটা নন্দিনীর দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করল।
আমার কণ্ঠ থেকে কথা বেরুবার আগেই দলের নারী-পুরুষ সকলে, রাজাকাররা একটু আগে সকলের গাট্টি-বোঁচকা হাতিয়ে সবকিছু নিয়ে নেয়ার পরও, যা অবশিষ্ট ছিল তা খুলে লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। লোকটা তার দলের একটি ছোকরার দিকে কী ইঙ্গিত করতেই ছেলেটা কাঁধের লাল গামছাটি দলপতির কাল বুট জুতা পরা পায়ের দিকে বিছিয়ে দিল। তার ইঙ্গিতে সকলেই যার কাছে যা টাকা-পয়সা ও লুকানো দুএকগাছি সোনারূপোর বালাচুড়ি বা হার ছিল তা নিঃশব্দে রেখে দিল। আমি চোখের ইশারায় সীমাকে তার শেষ সম্বল কিছু থাকলে গামছায় রেখে দিতে বললাম। বিনা বাক্যব্যয়ে সীমা ও নন্দিনী তাদের লুকানো কিছু একশো টাকার নোট ও গয়নার পুটলি গামছায় রেখে দিল।
লোকটা আমার দিকে ফিরে হাসল, তোমার কাছে কিছু নেই? তোমার মাগীগুলোতো বেশ মালদার। নিজের কাছে কিছু লুকিয়ে রাখো নি? থাকলে ভালোয় ভালোয় গামছায় ফেল। পরে কিছু পাওয়া গেলে যা বলেছি তাই করব।
আমার প্যান্টের একটা গুপ্ত পকেটে হাজার দুএক টাকা ছিল। আমি একটু সাহস ও স্বার্থপরতার সাথে জবাব দিলাম, আমার স্ত্রী ও বোনের কাছে যা ছিল তা গামছায় রাখা হয়েছে। হঠাৎ একটা ঘরবাড়ি ফেলে আসা পরিবারের এর বেশি কি থাকে?
লোকটা কোনো কথা না বলে পকেট থেকে আবার সিগ্রেট বের করে ধরাল। ইতরের মত নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে হাসল, আসল মালতো এখনও গামছায় পড়ে নি। ও দুটো বিছানায় পড়লেই চলবে।
আমি তার ইতর ইঙ্গিতের প্রতিবাদ করে বললাম, সাবধান, মুখ সামলে কথা বল। ভদ্র মহিলাদের সব কিছু তোমাদের দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে আর কিছু নেই।
আছে, আছে। এখনও সবচেয়ে দামি জিনিসটাতেই তো হাত পড়ে নি।
অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে কথাগুলো বলেই লোকটা আচমকা আমার মুখের ওপর সজোরে একটা ঘুষি মারল। আমি ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলাম। মনে হল আমার ওপরের ঠোঁটটায় কেউ বিদ্যুতের শক দিয়ে সারা চোয়ালটাই অবশ করে ফেলেছে। নন্দিনী ও সীমা ছুটে এসে আমাকে ধরতে চাইল। কিন্তু লোকটা সীমার শাড়ির আঁচল ও নন্দিনীর ব্লাউজের পেছন দিকটা এমনভাবে টেনে ধরল যে দুজনই বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়াল। উভয়েরই অসংবৃত অবস্থা দেখে লোকটা জোরে হেসে উঠে বাঁ হাতে কায়দা করে টেনে নন্দিনীর গায়ের ব্লাউজটা ছিঁড়ে ফেলল। আর সীমার শাড়ি এমনভাবে টেনে আনতে লাগল যে সীমা ভয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে কোমরের বাঁধন থেকে পরনের শাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। শুধু কালো একটা সায়াসহ সীমা আব্রু ঢাকতে মাটিতে বসে পড়ল। নন্দিনীর ব্রেসিয়ার পরা থাকলেও সে তার পরনের শাড়িতে গা ঢেকে এগিয়ে গিয়ে সীমাকে জড়িয়ে ধরল। লোকটার হাতে সীমার শাড়ি।
আমার থুতনী বেয়ে রক্ত বেরিয়ে এলেও আমি একবার উঠে দাঁড়াতেই চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটার সাথে ছেলেগুলো আমার ওপর লাফিয়ে পড়ে আমার মাথাটা মাটিতে ঠেসে ধরল। লোকটা সীমার শাড়ি আমার পিঠের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, বাঁধ।
লোকগুলো শাড়িটা মুহূর্তের মধ্যে পাকিয়ে দড়ি বানিয়ে আমাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। আমাদের সাথের লোকগুলো ভয়ে কবুতরের মত কাঁপছিল। ভয়ের চোটে কারো মুখ দিয়ে কান্নার শব্দ পর্যন্ত বেরুচ্ছে না। দলের নারী-পুরুষ ঘটনার আকস্মিকতায় অসাড় নিস্পন্দ। লোকটা নন্দিনীর দিকে ফিরে বলল, তোমার শাড়িটাও লাগবে। তুমি খুলে দেবে না আমার লোকেরা খুলবে? পুরো নেংটো হতে হবে না পেটিকোট তো আছে।
নন্দিনী এতক্ষণ সীমাকে জড়িয়ে ধরে বিহ্বল হয়ে বসেছিল। লোকটার কথায় উঠে দাঁড়িয়ে শাড়িটা খুলতে লাগল।
লোকটা জোরে হেসে উঠল, দারুণ।
কাঁধ থেকে রাইফেলটা খুলে তার পাশের স্যাঙাতকে দিল। আর নিজে কোমরের বেল্ট থেকে টেনে বের করল পিস্তল। পিস্তলটা আমাদের দলের অন্যান্য নরনারীর শিশুর দিকে তাক করে চেঁচিয়ে বলে উঠল, মালাউনের বাচ্চারা, তোদের মাসীর বাড়ির পথ এই দিকে। যেতে চাস তো এই মুহূর্তে দৌড়ে পালা। চোখের পলকে মাঠ পার হবি। পেছনে ফিরে দেখবি অমনি গুলী। পণ্ডিত নেহরুর বেটির ঐটা চাট গিয়ে যা। দৌড়, দৌড়।
আমরা ছাড়া পুরো দলটা দৌড়ুতে শুরু করল। কেউ আমাদের দিকে একবার পেছন ফিরেও তাকাল না। মাঠের মাঝামাঝি গিয়ে শিশুসহ একটা মা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়তেই বুকের শিশুটিও ছিটকে পড়ল ঘাসে।
দৃশ্যটা দেখে লোকটা পিস্তলের নলটা আকাশের দিকে রেখে পর পর দুটি ফাঁকা গুলী ছুঁড়ল। মাটিতে পড়ে যাওয়া মা তার শিশুটিকে বুকে নিয়ে দিশেহারার মতো উল্টো দিকে অর্থাৎ আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে দেখে রাজাকার ও তার দলবল হো হো করে হেসে উঠল। মাটা শিশুসহ আমাদের খুব কাছাকাছি এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েই আমাদের অর্থাৎ মাটিতে আষ্টেপৃষ্টে শাড়ি দিয়ে বাঁধা আমি, উদাসীনভাবে চুলের খোঁপাখুলে পিঠ ঢেকে বসে থাকা সীমা ও শাড়ি খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। নন্দিনীকে দেখেই সে আবার পেছন ফিরে দৌড়ুতে লাগল। তার সাথের সকলেই এর মধ্যে মাঠ পার হয়ে গাছপালার আড়ালে চলে গেছে। ফাঁকা মাঠের ওপর শিশুটিকে বুকে চেপে ধরে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে দেখে লোকগুলো পেছন থেকে রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ ও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। মেয়েটা মাঠের শেষ সীমায় পৌঁছে আরও একবার আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে আবার উঠে দৌড়ুতে লাগল। মেয়েটা চোখের আড়ালে চলে গেলে লোকটা নন্দিনীর হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে সঙ্গীদের দিকে ছুঁড়ে দিল।
এই মুরগী দুটোকেও বাঁধ। টাকাকড়িগুলো গুটিয়ে বেঁধে আমার হাতে দে। আর সব কয়টাকে নিয়ে আয়, এই দিলা।
লোকটা তার এক সঙ্গীকে ইঙ্গিত করল। দিলা বলল, হুকুম করেন সুবেদার সাব।
তোর বাড়িতে নিয়ে আয়। কাল সকালে ঠিক জায়গায় চালান করব। আজ রাত একটু হাতিয়ে দেখতে হবে সোনা-রুপো কিছু এখনও শরীরটরিরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে কিনা! তোর বাড়িতে আজ আমরা সবাই মেহমান।
কথাগুলো বলে সুবেদার দিলার দিকে ইশারা করে হাসল।
দিলা আমতা আমতা করে বলল, স্যার আমার বাড়িতে এতগুলো মানুষের জায়গা কোথায়? তাছাড়া এই গাঁয়ে একটাও মানুষ নাই। সব ইণ্ডিয়ায় চলে গেছে। সব এখন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আর আমার মেয়ে থাকি। মেয়েটার জামাই মেয়েটাকে ফেলে ইণ্ডিয়ায় ভেগেছে। আমরা আপনার কথায় বর্ডার পাহারা দিই। আমার বাড়িতে ঐসব কারবার দেখলে আমার মেয়েটা ভয় পাবে। তাছাড়া….
থাক, থাক। তুই আর অজুহাত দেখাবি না। ঠিক আছে তোর বাড়িতে যখন একটা মেয়ে আছে তখন গাঁয়ের অন্য একটা খালি বাড়িতেই এদের নিয়ে চল। তোর মেয়েকে দিয়ে শুধু আমাদের জন্য রান্নাটা বেঁধে আনবি। নাকি এটাও পারবি না? এদিকে তো প্রতি ক্ষেপে টাকাকড়ি সোনাদানার ভাগ ঠিকই নিচ্ছো। হারামজাদা!
গালমন্দ করবেন না সাব। ঠিক আছে, আমার বাড়ি থেকে আমি ডালভাত যা পারি বেঁধে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব, আপনি কোথায় কার বাড়িতে আস্তানা গাড়বেন বলুন?
বেশ ঠান্ডা আর দৃঢ় গলায় দিলা তার মতামত ব্যক্ত করল। সুবেদার আর তেরিমেরি না করে বলল, এদের নিয়ে নিতাই মেম্বারের খালি বাড়িতে চলে আয়। সেখানেই আজকের মালামাল ভাগবাটোয়ারা হবে। আমি চললাম। তোরা পেছন পেছন এদের নিয়ে আয়। গামছাটা গুটিয়ে বেঁধে দিস্?
.
যে লোকটা গামছায় রাখা টাকাকড়ি ও গহনাপত্র এতক্ষণ গুটিয়ে নিয়েছিল সে নিঃশব্দে সুবেদারের হাতে তা তুলে দিল।
একিন কর, আমি তোদের বখরা মেরে দেব না। আর যে হারামিপনা করবে তাকেই গুলী খেয়ে মরতে হবে। সোজা ক্যাম্পে চালান দেব। সাবধান। আমার সাথে যতক্ষণ আছিস পাঞ্জাবিরা তাদের ঘাটাবে না। বেগারও খাটতে হবে না। প্রতিরাতেই তো তোদের মালদার বানিয়ে দিচ্ছি। একবেলা ভাত জোটাতে পারতিস না, এখন তিনবেলা মুরগি আর ছাগলের রান চিবুচ্ছিস। আর সব শালাদের তো ঐসবেরও ভাগ দিচ্ছি।
বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা সোজা কারে একটা অশ্লীল ভঙ্গীতে হাসল লোকটা। একবার নন্দিনী ও সীমার অসংবৃত দেহের ওপর চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
সঙ্গের অন্যান্য লোকগুলো এবং দিলা কিন্তু হাসল না। এরা রাইফেল আমার ওপর বাগিয়ে রেখে মাথা নুইয়ে রাখল। পিস্তলটা কোমরের বেল্টে খুঁজে রেখে সুবেদার মাঠের দিকে হাঁটা দিল।
লোকগুলো আমাদের পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে মাঠ পার করে ঠেলে নিয়ে চলল। হাঁটার সুবিধার জন্য আগেই আমার পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছিল। বাড়তি শাড়ির দড়িটা দিয়ে আমার বাঁধা হাতগুলো আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে গিট দেয়া হয়েছে। সীমা ও নন্দিনীর হাত খুলে দিয়ে নন্দিনীর শাড়িটাকেও পাকিয়ে দড়ির মতো করে দুপ্রান্ত দিয়ে দুজনের কোমর পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধা। বাঁধার সময় এরা যেমন কেউ বাধা দেয় নি তেমনি মানুষগুলোও মেয়েদের সাথে কোনোরূপ অশালীন আচরণ করে নি। সুবেদার চলে গেলে দিলার নির্দেশেই রাইফেলধারী ছেলেগুলো আমাদের বাঁধাছাদা করেছিল। এখন তার হুকুমেই তিনজনেরই পিঠে নল ঠেকিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আমরা কেউ কোনো কথা বলছিলাম না। এমন কি পরস্পরের মধ্যেও না। নন্দিনী শুধু আমার শাড়ির দড়িতে বাঁধা বাহু ধরে হাঁটছে। তার চোখেমুখে কিছুক্ষণ আগের সেই ভয়বিহ্বল পাঁশুটে ভাবটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সীমাকেই শুধু আমার কাছে প্রাণহীন লাশের মতো মনে হল। তার চুলগুলো খোঁপা ভেঙে উদ্দাম হয়ে পিঠ ছাপিয়ে কোমর ঢেকে ফেলেছে। তার পরনের পেটিকোট ও খালি ব্লাউজে তাকে উপজাতীয় মেয়ের মতো লাগছে। নন্দিনী আরও একটু বেশি নিরাভরণ হয়ে হাঁটছে। পরনে পেটিকোট থাকলেও তার গায়ের ব্লাউজটা টেনে ছিঁড়ে ফেলায় সে শুধু একটা সিকের কাঁচুলী পরা। তবে নিরুপায় অবস্থায় নারীর লজ্জা উন্মুক্ত করে ফেললে তাদের মধ্যে এক ধরনের উপেক্ষা ও উদাসীনতাই অদৃশ্য পোশাক হয়ে যায় বলে আমার ধারণা হল। কারণ আমার সঙ্গিনী দুজনই এখন আমাদের শত্রু এবং ইজ্জতের জিম্মাদারদের সামনে নিজের অর্ধাচ্ছাদিত দেহ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন।
আমরা এতক্ষণে মাঠ পার হয়ে গাঁয়ের পায়ে চলা পথ ধরেছি। লাল মাটির পিচ্ছিল পথ। এখানে সেখানে খানাখন্দে পানি জমে আছে। সতর্ক হয়ে না হাঁটলে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। পথের দুপাশে কাটায় ভর্তি কেয়াঝোপ আর আনারস গাছের মেশামেশি জঙ্গল। মাঝে মাঝে বুনোকুল পেকে গাছের ডালসহ রাস্তায় ঝুঁকে পড়েছে। আমরা রাতে এদিকে যে সব বড় গাছের জন্য মাঠ থেকে এলাকাটাকে অন্ধকার অরণ্য। ভেবেছিলাম, এখন দেখছি এগুলো সবি কাঁঠাল গাছ। রাস্তা থেকে আশে পাশে তাকিয়ে গ্রামটিকে একটা মস্ত কাঁঠালবাগান বলে মনে হচ্ছে। একটু এগিয়ে মাটির দেয়াল তোলা দুএকটা ছনের ঘর ও শূন্য উঠোন দেখে বুঝলাম যে পুরো গাঁটাই জনশূন্য মৃত্যুপুরীর মতো পড়ে আছে। একটা বাড়ির ভেতর থেকে হঠাৎ একটা দেশী কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, লাফিয়ে এসে আমাদের সামনে লেজ নেড়ে কুঁই কুঁই শব্দ করে কাঁদতে লাগল। সম্ভবত কুকুরটা ক্ষুধার্ত। গাঁয়ে মানুষজন না থাকায় খাবার খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ এখন কয়েকজন মানুষ দেখে রাস্তায় বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যাকুল। নন্দিনীর সায়ায় ঢাকা হাঁটুর কাছে মুখ তুলে শুঁকতে লাগল। নন্দিনী কুকুরটার কাণ্ড দেখে মুহূর্তমাত্র একটু দাঁড়াতেই দিলা রাইফেলের বাট দিয়ে কুকুরটাকে মারতে গেলে সে লাফিয়ে সরে চিৎকার করে কঁকিয়ে উঠল। নন্দিনীর পিঠে অন্য একটি অস্ত্রধারী তরুণ রাইফেলের নল ঠেকিয়ে, হাঁট মাগী। কুত্তার সাথে আর রঙ্গ করতে হবে না। যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানকার পাগলা কুত্তাটাই তোর রস চেটে খাবে।
ছেলেটার কথায় তার সঙ্গীরা হঠাৎ হেসে উঠল। গ্রুপটার এখনকার নেতা দিলা অবশ্য হাসল না। সে বরং ঘাড় বাঁকা করে ছেলেটার দিকে একবার তাকাল মাত্র। আর এতেই সবার হাসি উবে গেল। কেউ আর টুঁ-শব্দটি করছে না। আমরা বন্দি তিনজন কোনো কথা না বলে হেঁটে চললাম।
রাস্তাটা একটু এগিয়েই বাঁক নিয়েছে ডান দিকে। ডান দিকে ঘুরে আমরা আরও কয়েকটি গৃহস্থ বাড়ির মতো ঘরবাড়ি ও উঠোন দেখতে পেলাম। জায়গাটা আমার ঠিক চেনা বলে মনে না হলেও খুব অপরিচিত এলাকা বলেও মনে হল না। আমি নন্দিনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, আমরা বর্ডার এলাকার কাছেই আছি। মনে হচ্ছে এটা বামুটিয়া বাজারের কাছেরই কোনো গ্রাম।
নন্দিনী বা সীমা কোনো জবাব দিল না। শুধু সীমা একবার শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে হাঁটতে লাগল।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির গেটের সামনে এসে পৌঁছলে দিলা আমাদের থামতে বলল। আমরা মেহেদীর বেড়া দেওয়া একটা আঙিনার কাঠের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গেটটা ঠেলে দিলা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এখানে এদের নিয়ে তোরা দাঁড়া আমি ভেতরে গিয়ে দেখে আসি সুবেদার বেটা কি ব্যবস্থা করেছে।
দিলা ভেতরে ঢুকে গেট ঠেলে দেওয়াতে আমি বাড়ির সামনের ঘর বা বারান্দা কিছুই দেখতে না পেয়ে মেহেদীর বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করতে লাগলাম। এটা বোধ হয় এ গাঁয়ের কোনো মান্যলোকের পরিত্যক্ত বাড়ি।
পরিবারটি হয়তো পাকবাহিনীর ভয়ে ভারতে পালিয়েছে কিংবা মুক্তিবাহিনীর অপারেশনের ভয়ে দেশের ভেতরেরই কোনো আত্মীয়-স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। কাঠের গেটের ওপর আঙুল দিয়ে লেখা ‘ওঁ হরি’ এবং সিঁদুরের কয়েকটি রক্তবর্ণ ফোঁটা। নন্দিনীও একবার চোখ তুলে গেটের লেখা ও সিঁদুরের ফোঁটাগুলো দেখে মুখ নামিয়ে নিল।
একটু পরেই দিলা ফিরে এসে আমাদের নিয়ে গেটের ভেতরে ঢোকার ইঙ্গিত করলে আমাদের পিঠে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে এতক্ষণ যে তিনজন দাঁড়িয়েছিল তারা ব্যারেলের গুঁতোয় সামনে এগোবার নির্দেশ দিল। দিলা গেটের কাঠের পাল্লা দুটো মেলে ধরেছে। তার মুখ এখনও গভীর। খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফে বোঝা যায় না লোকটার বয়স কত। আন্দাজ চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। আজ ভোরের আবছা অন্ধকারে এরা যখন আমাদের ঘেরাও করে তখন সুবেদার ছাড়া কারো মুখের দিকেই আমার তাকিয়ে দেখার ফুসরৎ ছিল না। এখন লোকটাকে ভালো করে দেখলাম। মধ্যবয়স্ক গ্রামচাষীর মুখের মতোই সাদামাটা। এ গাঁয়ে লোকটার একটা মেয়েও আছে, সুবেদারের সাথে এর কথা কাটাকাটির সময় তা বুঝেছিলাম। লোকটার মধ্যে সামান্য ব্যক্তিত্বের গন্ধ পেয়েই কিনা জানি না, সীমা ও নন্দিনীর ব্যাপারে মারাত্মক কিছু ভাবতে মন চাইছিল না। তবুও ভয়ে ভয়ে গেট পার হলাম। ভেতরে সযত্নে লাগানো গেন্ধাফুলের ঝুপড়ি মতন গাছে হলুদ ফুল ফুটে আছে। পুদিনা পাতার ঝোপে আঙিনাটা প্রায় ঢাকা। ঘরের বারান্দায় ওঠার সরু পথটা ইট বিছানো। আমরা আঙিনায় প্রবেশ করে দেখলাম একটা বড় ঢেউটিনের চারচালা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। দেড় হাত উঁচু পাকা বারান্দা। বারান্দায় উপুড় করা একটা শূন্য মাটির কলসের ওপর বসে সুবেদার সিগ্রেট টানছে। তার গোঁফের ফাঁকে প্রথম দেখার সেই ক্রুর হাসি। আমাদের উঠোনে প্রবেশ করতে দেখে সে হাতের ইঙ্গিতে ঘরের ভিতরে নিয়ে যেতে বলল। আমরা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠামাত্র সুবেদার উঠে সোজা আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তোমার সাথে কথা আছে। তুমি এখানেই দাঁড়াও।
আমি দাঁড়ালাম। আমার পিঠ থেকে রাইফেলের নলটা সরে গেল। নন্দিনী ও সীমা তখনও আমার দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে। পাকানো তাঁতের শাড়ির শক্ত বাঁধনে আমার হাতের শিরাগুলো দড়ির মত ফুলে উঠেছে। যে ছেলেটা আমার পিঠে এতক্ষণ রাইফেল ঠেকিয়ে ঠেলে এখানে নিয়ে এসেছে এখন সে রাইফেলের বাট মাটিতে ঠেকিয়ে আমার সামনে অর্থাৎ সুবেদারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। সুবেদার পেছন দিকে না তাকিয়েই ছেলেটাকে আমার হাতের বাঁধন খুলে দিতে বলল, খুলে শাড়ি দুইটা দুই মাগীকে পরতে দিয়ে পাশের কামরায় তালা বন্ধ করে রাখ।
সুবেদারের কথা শুনে আমার পাহারাদার ছেলেটা এবার পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এল, তালা পাব কই স্যার।
ছেলেটা আমার হাতের শক্ত বাঁধন খুলতে গিয়ে রাইফেলটা ঘরের টিনের বেড়ায় ঠেক দিয়ে রেখে এল।
সুবেদার বলল, তালা যোগাড় করতে হবে। এখন ঘরে ঢুকিয়ে শিকল তুলে দে। পালাবার চেষ্টা করলে অমনি গুলী। কুছ পরোয়া নেই। আগামীকাল ক্যাম্পে চালান। আর এটার সাথে কথা হয়ে গেলে এটাকে রান্না ঘরের বাঁশের সাথে বাঁধবি। কি দড়িদড়াও যোগাড় করতে পারবি না দামড়া কোথাকার?
পারব।
হাসল ছেলেটা। একুশ বাইশ বছর বয়েস হবে। পরনে লুঙ্গি ও কালো গেঞ্জি। দেখতে রেলের কুলির মতো চেহারা। মনে হয় এসব কাজে এখনও তেমন দক্ষ হয়ে ওঠে নি। খাওয়া পরা ও নগদ টাকার লোভেই এদের সাথে জুটেছে। ছেলেটা আমার বাঁধন খুলে দিল। হাতের কবজি ও কনুই হঠাৎ দারুণভাবে ব্যথা করে উঠল। এতক্ষণ রক্ত চলাচল অসার থাকায় কোনো অনুভূতি ছিল না। তবুও আমি বাহুটা ঝাঁকুনি দিতে পারছিলাম না। আস্তে করে শুধু কনুইয়ের নিচের অংশটা নাড়ালাম। ততক্ষণে অন্য দুজন রাইফেলধারী তরুণ ও দিলা সীমা আর নন্দিনীর কোমরের বাঁধন খুলে দুজনের হাতে তাদের শাড়ি তুলে দিল। নন্দিনী সাথে সাথেই শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে আঁচল কাঁধের ওপর রাখল। কিন্তু সীমা শাড়িটা হাতে নিয়ে শূন্যদৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরল না। বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া সিঁথিতে এখনও আবছামতো লালের তোবড়ানো রংটা রয়ে গেছে। হাতে শাদা শাখা দুগাছি মাত্র।
আমি বললাম, দিদি শাড়িটা পরুন।
আমার কথায় সীমা কোমরে আঁচলের প্রান্ত ভাগটা গুঁজল।
সুবেদার হেসে বলল, তুমিও মালোয়ানের বাচ্চা নাকি?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। সীমার শাড়ি পরা হয়ে গেলে দিলা এদের ঠেলতে ঠেলতে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। তার সাথে গেল সীমা ও নন্দিনীর পাহারাদার দুজন। খালি বারান্দায় আমাকে বসতে ইঙ্গিত করে সুবেদার উল্টানো শূন্য মাটির ঠিলার গোল পেটের ওপর বসল। আবার একটি সিগ্রেট ধরিয়ে আমার মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সিগ্রেট খাও?
না।
বড় মাগিটা তোমার বৌ?
না।
এরা তোমার কে?
এ প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আমি একটু চিন্তা করে নিলাম। আমি চুপ করে আছি দেখে সুবেদার আবার প্রশ্ন করল, এদের সাথে তোমার কী সম্পর্ক? এদের কোত্থেকে এনে বর্ডার পার করে দিচ্ছিলে? তোমাকে তো দেখে মালোয়ান বলে মনে হচ্ছে না? তুমি মুক্তিবাহিনীর খবর জানো? তোমাকে যা জিজ্ঞেস করি ঠিক ঠিক জবাব দেবে। মিথ্যে বলে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করলে এক্ষুণি তোমাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে এই পিস্তলের গুলীতে শেষ করে দিয়ে আসব।
আমি বললাম, নন্দিনী আমার স্ত্রী। আর সীমা তার বড় বোন।
তুমি হিন্দু?
না। আমি মুসলমান।
তোমার বিবি তবে মালোয়ান হয় কি করে! তুমি হিন্দু বিয়ে করেছ?
একটু বিস্ময় মেশানো গলায় সুবেদার জানতে চাইল।
আমিও অসংকোচে মিথ্যে বললাম, হ্যাঁ।
কতদিন বিয়ে হয়েছে?
ছাব্বিশ মার্চ রাতে।
আমার সাথে ফাজলেমি করছ?
ফাজলেমি করব কেন?
আমিও সহজভাবে জবাব দিতে গিয়ে একটু বাড়িয়ে বললাম, ছাব্বিশে মার্চ গোলযোগ বাধার সম্ভাবনা আছে ভেবেই আমরা সন্ধে রাতে বিয়ের আয়োজন করি।
কাজী ডেকে বিয়ে?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
তোমার বৌ কলেমা পড়েছিল?
হ্যাঁ। মুসলমান না হলে কী করে কাজী ডেকে বিয়ে হয়।
আমার কথায় লোকটা কী যেন একটু চিন্তায় পড়ে গেল। শেষে আচমকার মতো আমার নাম জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?
সৈয়দ আবদুল হাদি মীর।
ঢাকায় কী করতে?
সরকারি চাকুরি। পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ান।
আমি বেশ দৃঢ়তার সাথেই আমার আত্মপরিচয় দিতে চেষ্টা করলাম। মনে হল আমার অকম্পিত কণ্ঠস্বরে লোকটা রেগে গেল, তুমি সরকারি কর্মচারী হও আর যাই হও তুমি মুক্তিবাহিনীর লোক। আমি তোমাদের তিনজনকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঞ্জাবিদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেব। আগামীকাল সকালে আমাদের টহল বোট আসবে। আজকে রাতটা শুধু তোমার বৌ আর শালীকে নিয়ে একটু মজা করব। পরে তো পাঞ্জাবিরাই এদের শেষ করবে। তার আগে আমরা একটু করলে কী আর ক্ষতি হবে? কী বল!
লোকটা অদ্ভুত ভাবে হাসল।
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, মেয়েদের ইজ্জতের ওপর হামলা হলে, তুমি যেই হও তোমাকে এবং তোমার সমস্ত পরিবার পরিজনকে এর মারাত্মক খেশারত দিতে হবে, এটাও ভেবে দেখো।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই হারামজাদা হঠাৎ পায়ের বুট তুলে আমার মুখের ওপর সজোরে লাথি মেরে আমাকে বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিল। রাজাকার ছেলেটাকে চেঁচিয়ে বলল, শুয়োরের বাচ্চাটাকে মাগীগুলোর পাশের কামরায় হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখ। ওর তেজ আমি কমিয়ে দেব।
বারান্দার নিচে পুদিনার ঝোপের ওপর চিৎ হয়ে পড়া আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে সে বলল, আজ রাতেই তোর বৌ আর শালীর ইজ্জত পিছলা করে দেব। ও ঘরে কাট্টা হয়ে শুয়ে শুনতে পাবি কুত্তার বাচ্চা।
রাজাকার ছেলেটা লাফিয়ে নিচে এসে আমাকে উঠে বসতে সাহায্য করল।
সুবেদার তার হোলস্টার থেকে পিস্তল টেনে বের করে আমার মাথার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে উঠে দাঁড়ালাম। আমার কষ বেয়ে থুতনির ওপর রক্তের আঠালো ফোঁটা ঝুলছে। বাম চোখটা ফুলে মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ প্রায়। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মাথা ঘুরছে। এর মধ্যেই ছায়ার মতো দেখলাম দিলা তার সঙ্গী দুজনসহ ঘরের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে আমাকে বারান্দায় টেনে তুলতে গিয়ে বলল, বেকুফ।
বারান্দায় উঠলে আর আমাকে এখানে দাঁড়াতে দেওয়া হল না। টেনে হিঁচড়ে একটা কামরায় এনে গরুবাঁধার শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে মেঝেয় ঠেলে শুইয়ে দিল। আমার পিঠের নিচে সিমেন্টের ছোঁয়া লাগামাত্র আমার সারা শরীর ও মাথা হিস্টিরিয়া রোগীর মতো থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে। অসম্ভব শীতে আমি কুঁকড়ে যেতে লাগলাম।
.
এ অবস্থায় ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ পড়েছিলাম কিছুই আমার মনে নেই। সম্ভবত আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন চেতন পেলাম তখনও শরীরটা স্বাভাবিক বলে মনে হল না। এখনও মাথাটা ঝিম ধরে আছে। একটা পা উরতসহ ঝটকা দিয়ে কেঁপে উঠছে। এই প্রথম আমার মনে হল আমি বোধ হয় দুদিন ধরে কিছু খাই নি। পেট, নাড়িভুড়ি খিদেয় এখন ব্যথা করছে। বাইরে একটানা ঝিঁঝির ডাক শুনে আন্দাজ করলাম এখন গভীর রাত।
রাত? আমি চমকে উঠলাম আর তক্ষুণি মনে পড়ল আমার শারীরিক খিঁচুনির কোনো এক সময় আমি নন্দিনীর আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলাম। সে ভগবানের দোহাই দিয়ে এদের হাত থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল। সীমার ফুঁপিয়ে কান্নার সাথেও যেন আমি কয়েকবার ভগবানের নাম শুনতে পেয়েছিলাম।
এখন সারাটা বাড়ি নিস্তব্ধ হলেও ঝিঁঝির তীক্ষ্ণ সূঁচালো আওয়াজে আমার সচেতনতা ধীরে ধীরে সজাগ হচ্ছিল। দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হাতপায়ের অসাড়তা খানিকটা অনুভব করলেও কোমরের বেদনা বোধই টের পাচ্ছি না। হঠাৎ কেন জানি মনে হল, অতীতে আমি কোনো দিশেহারা বিপদে হতভম্ভ হয়েও আমার নিজের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর ভরসা হারায় নি। মুখে প্রকাশ না করলেও আমার বন্ধুরা আমাকে একজন নাস্তিক বলেই জানে বা ধারণা করে এসেছে। আমার সামান্য রচনায় স্বাভাবিক উপমা উত্থাপনে বাস্তবতার বোধ বা কল্পনার দৌরাত্ম্য দৈব নির্ভর ছিল না। এখন হঠাৎ মনে হল আমি এখন যে অবস্থায় আছি এ অবস্থায় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। আমার এ ভাবনায় আমি অত্যন্ত মুষড়ে পড়লাম এবং ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে, আল্লাহ আল্লাহ শব্দটি ক্রমাগত বেরিয়ে আসতে লাগল। আমি আবার গত সকাল বেলার ঘোরের মতো অবস্থায় তলিয়ে যেতে লাগলাম।
.
প্রচণ্ড গোলাগুলীর আওয়াজে সকাল বেলা আমার ঘোর আর ঘুম উভয় অবস্থাই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। আমি মেঝের ওপর থেকে দারুণ বিস্ফোরণের শব্দে হকচকিয়ে গেলেও মাথা তুলতে পারছিলাম না। আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে অথচ মাথাটা একটা গোল ভারী পাথরের মতো মেঝেতে লুটানো। বাড়িটার বারান্দায়, প্রাঙ্গণে এবং পাশ্ববর্তী কামরায় মানুষের ছোটাছুটি, কান্না ও গোঙানির শব্দে আমি আরও একবার আপ্রাণ চেষ্টায় মাথাটা উঁচু করা মাত্র দড়াম করে আমার ঘরের দরজাটা খুলে আনিস ঘরের ভিতর লাফিয়ে পড়ল। তার হাতে স্টেনগান বাগানো। তার পিছে পিছে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তড়িৎ চাতুর্যে কামরায় প্রবেশ করে, জয় বাংলা বলে ধ্বনি দিল। আনিস তাদেরকে তাড়াতাড়ি আমার বাঁধন খুলে দিতে বলে দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। নন্দিনীদের কথা জিজ্ঞেস করার আগেই আনিস চলে যাওয়াতে আমি যে মুক্তিযোদ্ধাটি আমার দড়ির বাঁধন দাঁত দিয়ে টেনে খুলে দিচ্ছিল তাকে বললাম, আমার সাথে আরও দুজন মহিলা ছিলেন। পাশের কামরায় এদের ওপর রাতে নির্যাতন হয়েছে। এরা কই?
এদের বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দাঁড়াতে পারছেন না। এরা মারাত্মকভাবে রেপড। একজনের সেন্স এখনও ফেরে নি। চলুন আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে।
দড়িদড়া খুলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাটি আমাকে উঠে বসতে ঘাড়ের নিচে হাত রেখে টান দিল। আমিও আপ্রাণ চেষ্টায় শরীরটা তুলে কোনো মতে বসলাম। পা দুটো ও মাথা অসম্ভব রকম টন টন করে উঠল। আমি ছেলেটাকে আবার তাড়াতাড়ি মেঝেয় শুইয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে কঁকিয়ে উঠলাম, বসতে পারছি না। শুইয়ে দাও।
ছেলেটি তাড়াতাড়ি আমাকে আগের মতো শুইয়ে দিয়ে বুকটা মালিশ করতে লাগল। সে এখন আমার অবস্থা পুরোপুরি আন্দাজ করতে পেরেছে। আমি বললাম, রাজাকাররা কী পালিয়েছে?
সবগুলো খতম। একটাও পালাতে পারে নি।
উৎফুল্ল মুখে বলল মুক্তিযোদ্ধা তরুণটি। বয়স বাইশ তেইশের বেশি হবে না। মুখে একটা দুঃসাহসী প্রাণমাতানো সরল বিজয়ী হাসি।
আমি বললাম, পালের গোদাটা, খাকি জামাপরা গোঁফঅলাটাকে মারতে পেরেছ?
বাইরে এসে দেখুন না, ঘরে সিঁড়ির পাশে গেঁদাফুলের ঝোপের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ওর নাড়িভুড়ি সারা উঠোনটায় ছড়িয়ে গেছে। আর বাকিগুলোর লাশ রাস্তায় পড়ে আছে। পালাতে চেয়েছিল। দুই ব্রাস ফায়ারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ছেলেটা মুখে আবার হাসি ছিটকে ছড়িয়ে গেল। আমি বললাম, আনিস তাহলে দৌড়ে আবার কোথায় গেল?
গাঁটা সার্চ করতে গেছে। লোকজন নেই যদিও। তবুও একবার সার্চ করে যাওয়া ভালো।
ছেলেটার উদ্দীপনা দেখে এবার আমি বুকের ওপর থেকে ওর হাত আস্তে সরিয়ে দিয়ে নিজের চেষ্টায় দাঁতে দাঁত চেপে উঠে বসলাম। সারা শরীরে টনটনে ব্যথা অনুভব করলেও আমি শক্ত হয়ে বসে থাকলাম। ছেলেটা বলল, আরও একটু বসে থাকুন এখুনি উঠবার চেষ্ট করবেন না। আমি তার কথা না শুনে মনের জোরে তার কাঁধের ওপর ভর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম, আমাকে মেয়েদের কাছে বারান্দায় নিয়ে চলো। ছেলেটি আমার কোমর হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরার জন্যে তার স্টেনগান ডান হাত থেকে বাঁ হাতে বদল করল এবং দ্রুত ডান হাতে আমার কোমরটা পেঁচিয়ে ধরল। আমি তার সাথে হিঁচড়ে এগোতে লাগলাম। আমার শরীরের নিম্নাংশ প্রবল কাঁপুনি ঝটকা দিয়ে উঠলেও আমি হাঁটা না থামিয়ে ছেলেটির সাথে বারান্দার দিকে প্রাণপণে চলতে লাগলাম। ছেলেটা আমাকে টেনে হিঁচড়ে বারান্দায় এনে বসিয়ে দিল। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা সীমার পাশে এসেই বসেছি। নন্দিনী চুপচাপ উদাস দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তার পরনে শুধু সায়া। শরীরে ব্লাউজ বা ব্রেসিয়ার কিছু নেই। পিঠ ও বুক নগ্ন এবং পাশবিক অত্যাচারের চিহ্নে ক্ষত বিক্ষত। আমাকে কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে দেখেই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। আমি কোনো মতে টেনে হিঁচড়ে নন্দিনীর কাছে গিয়ে তার হাত ধরতেই সে দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে জোরে বিলাপ করে কেঁদে উঠল। আমার মুখ থেকে কোনো কথা বেরুল না। আমি বারান্দায় পড়ে থাকা রক্তে ভেজা নোংরা শাড়িটাই টেনে এনে তার শরীরের ওপর মেলে দিলাম। আমার এতটুকু সহানুভূতিতেই নন্দিনীর সম্ভ্রমবোধ যেন ফিরে এল। সে বসে থেকেই শাড়িটা পেঁচিয়ে পরে নিল। এ সময় অকস্মাৎ সীমাও পাশ ফিরে আমার দিকে চোখ পড়ায় ফুঁপিয়ে কতক্ষণ কাঁদল। আমি সীমার মাথায় হাত রাখতেই সীমা উঠে বসল। তার পরণেও একটা সায়া ছাড়া আর কিছু নেই। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটা অবস্থা দেখে ঘরের ভেতর থেকে সীমার পরিত্যক্ত শাড়িটা কুড়িয়ে এনে আমার হাতে দিল। সীমা আমার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে পরতে গিয়ে চীৎকার করে পিছিয়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পুদিনা ঝোপের দিকে তাকিয়ে রইল। পুদিনা ঝোপে স্টেনগানের ব্রাস ফায়ারে বিদীর্ণ সুবেদারের লাশ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সারা উঠোনের ঝোপঝাড় আর লতাগুল্ম রক্তে মাখামাখি। মানুষের পীতাভ হলদে নাড়িভুড়ি লাশটার পাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এক ধরনের দুর্গন্ধে মুহূর্তের মধ্যে আমার বমির উদ্রেক করলেও আমি ঢোক গিলে আমার অস্বস্তি চাপবার চেষ্টা করতে লাগলাম। সীমা ও নন্দিনী উভয়েই এখন বিস্ফারিত চোখে সুবেদারের লাশটা দেখছে। আমি বললাম, আনিসের দল আমাদের বাঁচিয়েছে। রাজাকাররা সবি মারা পড়েছে। এখন আর ভয়ের কিছু নেই।
আমার কথার সমর্থনে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটিও সায় দিল, আর একশো গজের মধ্যে বর্ডার। আপনারা একটু হাঁটতে পারলেই পার্বত্য ত্রিপুরায় ঢুকে যাবেন। আমাদের লোকজন আনিস ভাইয়ের সাথে গাঁটা সার্চ করতে গেছে। এখনই ফিরে আসবে। আপনারা মনে একটু সাহস আনুন। আমরা রাতেই অপারেশন বেরিয়েছিলাম। কিন্তু আপনাদের হদিস বের করতে পারি নি। আনিস ভাই পথ চিনে এগিয়ে আসতে না পারায় আপনাদের এই দুর্গতি পোহাতে হল। তবুও ভাগ্য ভালোই বলতে হবে যে আমাদের কেউ প্রাণে মারা পড়ে নি। আপনারা যাওয়ার জন্যে রেডি হোন, আমি দেখছি। আনিস ভাই ও আমাদের এ্যাকশন পার্টির ছেলেরা কোন দিকে গেছে।
আমি ছেলেটাকে হাতের ইঙ্গিতে দাঁড়াতে বলে বারান্দায় উঠে দাঁড়ালাম। যদিও আমার পা দুটি তখনও থর থর করে কাঁপছে। বললাম, দাঁড়াও। তোমার নাম কি?
বাহাউদ্দিন।
ছাত্র?
হ্যাঁ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়তাম।
বাহাউদ্দিন কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে মুখ তুলে হাসল।
আমি বাহাউদ্দিনকে বললাম, তোমরা যাই করো একটু তাড়াতাড়ি করো। কাল এই হতভাগা সুবেদারটার মুখে শুনেছি আজ এদিকে পাঞ্জাবিরা টহল বোট নিয়ে আসবে। এরা আসার আগেই আমি যাতে মেয়ে দুজনকে নিয়ে বর্ডার পার হয়ে যেতে পারি তার ব্যবস্থা করা দরকার। তোমাদের হাতে অস্ত্র আছে। তোমরা হয়তো ওদের কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রেখে ধীরে সুস্থে পালাতে পারবে কিন্তু আমাদের একটু আগেই যাওয়া দরকার।
আমার কথা শুনে বাহাউদ্দিন দ্রুত বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আমি এখনই আনিস ভাইকে খবর দিচ্ছি। আপনি আপনার পাশের মহিলার জ্ঞান ফিরিয়ে আনুন।
আমাদের কথাবার্তার চেতন পেয়েই কিনা জানি না সীমা ধড়মড় করে উঠে বসেই বলল, চলুন। আমি হাঁটতে পারব।
জানি না এতক্ষণ সীমা অজ্ঞান অবস্থায়ই ছিল কিনা। কিংবা হয়তো সম্ভ্রম হারানোর লজ্জায় অচেতনের ভান করে পড়ে ছিল। আমি বললাম, দিদি, একটু অপেক্ষা করুন। আনিস আসুক।
আমার কথায় সীমা নন্দিনীর দিকে তাকাল। নন্দিনী আগের মতোই উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আমার ইঙ্গিতে সীমার দিকে ফিরে বলল, শাড়িটা পরে নাও। এখন আর কারো সাহায্যের দরকার হবে না। চলো আমরা নিজেরাই হাঁটা শুরু করি। সামনে যদি বর্ডার হয়ে থাকে তবে আর ভয় কি?
নন্দিনীর কথায় যে শ্লেষ আছে তা যে আমাকেই বিদ্ধ করার জন্যে উচ্চারিত তা আমি বুঝতে পেরে লজ্জায় ও অক্ষমতার গ্লানিতে মাথা নুইয়ে রাখলাম।
নন্দিনী এগিয়ে এসে সীমাকে বারান্দায় সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে গেলে আমিও সাহস করে সীমার ডান কনুই ধরে দাঁড়ালাম। এখন আমার ও নন্দিনীর মুখ একেবারে সামনা সামনি। নন্দিনী আমাকে ধরতে দেখে বোনের হাত ছেড়ে দিয়ে সীমার পায়ের কাছে চটচটে শুকনো রক্তের দাগে ভরা লুটিয়ে পড়া শাড়িটা তুলে তাকে পরিয়ে দিতে লাগল। শাড়িটা গিট দিয়ে নাভির ওপর বাঁধতে গিয়ে একবার আড়চোখে আমার দিকে চাওয়া মাত্রই আমি কথা বলার সুযোগ পেয়ে বললাম, নন্দিনী আমার অক্ষমতাকে মাফ করে দাও। তুমিই বলো, কালকের পরিস্থিতিতে ওদের হাতে বাধা থেকে বেদম মার খেয়ে অজ্ঞান অবস্থায় আমি কী করতে পারতাম?
নন্দিনী কতক্ষণ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল, আমাকে আর দিদিকে ওরা চিরকালের মতো শেষ করে দিয়েছে হাদী ভাই। এখন আমাদের কী গতি হবে আপনিই বলুন?
আমি জবাবে বললাম, ওরা সুযোগ পেয়ে তোমাদের যে ক্ষতি করেছে, নন্দিনী, তা আমার মা বোনের ওপরই করেছে। এ জন্য কী তোমাদের কোনো সামাজিক জবাবদিহির প্রয়োজন আছে? অত্যাচারিত ও অসহায়ভাবে ধর্ষিতা বাংলাদেশের প্রতিটি নারীই এখন স্বাধীনতার বলি। এখন এ নিয়ে কথা বলে বা অনুযোগ করে কী কোনো লাভ আছে নন্দিনী? যদি তোমাদের হাঁটার শক্তি থাকে তবে চলো আমরা এক্ষুণি বর্ডারের দিকে চলা শুরু করি। আমাকেও এরা বেঁধে রেখে পিটিয়ে সারা রাত অজ্ঞান আর অচল করে দিয়েছে। তবুও আমি মাইল খানেক প্রাণপণ চেষ্টায় হেঁটে যেতে পারব।
নন্দিনী আমার কথায় হঠাৎ যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে সীমার মুখের দিকে তাকিয়ে বল, চল দিদি।
কিন্তু আনিসরা ফিরে এসে আমাদের না পেয়ে আবার খোঁজা শুরু করে বিপদে পড়বে। বরং একটু অপেক্ষা করে এদের সাথেই যাওয়া ভাল।
সীমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমরা বাড়ির বাইরে একটা হই চই শুনতে পেলাম। একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের সাথে মানুষের কথাবার্তা শোনা গেল। আনিসের গলাই আমাদের কানে এল, হারামজাদি রাজাকারের মাগী। আজ তোর বারোটা বাজাবো।
বলতে বলতে একটা মেয়েকে প্রায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে আনিস বাড়িটার ভেতর এসে ঢুকল। মেয়েটা বাজান গো কে তোমারে এমন কইরা মাইরা ফালাইয়া রাখছে গো–বলে সামনে বিলাপ করছে এবং আনিসের হাত থেকে তার মাথার চুলের গোছা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছে।
আনিস ভেতরে ঢুকেই আমাদের দেখতে পেয়ে বলে উঠল, এই হারামজাদিকে দিলা রাজাকারের বাড়ি থেকে ধরে এনেছি। এদের ভয়েই এই গাঁয়ের সব মানুষ ইণ্ডিয়া পালিয়ে গেছে। দিলা রাজাকার আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফজু সুবেদার পাঞ্জাবিদের পথ ঘাট চিনিয়ে দিয়ে বহু পরিবারের সর্বনাশ করেছে।
আমি বুঝলাম এ মেয়েটির কথাই কাল দিলা বলেছিল। বলেছিল মেয়েটির স্বামী তাকে ফেলে ইণ্ডিয়া চলে গেছে। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। আনিসের টানা হ্যাঁচড়াতে মেয়েটির পরনের শাড়ি খুলে গেলেও সে প্রাণপণে শাড়ির একটা প্রান্ত হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে। তার চুলের গোছা আনিসের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। আনিসের পাশে তার অন্য চারজন সঙ্গি, এদের মধ্যে বাহাউদ্দিনও আছে, মেয়েটাকে তাদের হাতিয়ার দিয়ে কখনো গুঁতো আবার কখনো নির্মমভাবে বাড়ি মারছে।
আমি সোজাসুজি আনিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, একে ছেড়ে দাও আনিস।
আপনি কী বলছেন? একটা কোলাবরেটরের মেয়েকে ছেড়ে দেব? যার বাপ গত রাতে আপনার সাথের ভদ্র মহিলাদের র্যাপ করেছে?
ঐ কাজের জন্য এই মেয়েটি দায়ী নয়।
তার বাপ দায়ী।
তার বাপ এবং বাপের সঙ্গিরা তাদের কৃতকর্মের সাজা পেয়েছে। যদিও আমার জানা নেই গতরাতে দিলা সীমা ও নন্দিনীর ওপর কোনো জুলুম করেছে কিনা। করুক বা না করুক কোলাবরেটরের যোগ্য শাস্তি তারা পেয়েছে। মৃত্যুর ওপর কোনো সাজা নেই। তোমরা তাদের সকলকেই গুলী করে মেরেছে। এই মেয়েটি এর জন্য দায়ী নয়। একে ছেড়ে দাও।
আমি এগিয়ে গিয়ে আনিস যে হাতে দিলার মেয়েটার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে রেখেছে সে হাতেরই কব্জিটা ধরলাম। আমার ব্যবহারে আনিস মুহূর্তের জন্য একটু বিব্রতবোধ করলেও হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠল, সরে দাঁড়ান কবি সাহেব। আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। আমি আনিসের হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম, তুমি একে নিয়ে কী করতে চাও?
গত রাতে আপনার সঙ্গিনীদের সাথে রাজাকাররা যা করেছে আমরাও এর ওপর এখন তাই করব। ভয় নেই, এর বেশি কিছু করবো না।
বলে আনিস তার সঙ্গিদের দিকে তাকিয়ে একটু ব্যঙ্গের হাসি হাসল। আমি অসহায়ের মতো একবার নন্দিনী ও একবার সীমার দিকে তাকালাম। দেখলাম, তারা কী করবে ভেবে না পেয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভেবেছিলাম সীমা ও নন্দিনী মেয়েটাকে বাঁচাতে এখনি আনিসের ওপর বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু পরিস্থিতি তাদেরও এমন নিরুপায় করে রেখেছে দেখে আমি নিজেই আবার আনিসের হাত চেপে ধরলাম।
আনিস, আমি তোমাদের একাজ করতে দিতে পারি না।
আপনি সরে যান।
আনিস আমার হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে, আমি আরও শক্ত করে তার কব্জি চেপে ধরতে চেষ্টা করলাম। আনিস আমার ব্যবহারে অত্যন্ত চটে গেল। এবার সে তার হাতের হাতিয়ার দিয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, সরে যা শুয়োরের বাচ্চা। এটা এ্যাকশনের সময়। এখন আমার সামনে যেই দাঁড়াবে তাকেই ব্রাশ মেরে দেব। এটা লড়াইয়ের স্পট। কবিতা-ফবিতার জায়গা নয়।
স্টেনগানের একটা গুঁতো এসে আমার কণ্ঠার হাড়ের ওপর পড়ল। আমি বাহাউদ্দিনের হাতের ধাক্কায় দুহাত পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। আর সাথে সাথেই আনিসের অন্য সঙ্গিরা আমাকে জাপটে ধরে এমন প্যাঁচ কষল যে আমি মুহূর্তের মধ্যে নন্দিনীর পায়ের কাছে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। নন্দিনী ও সীমা এসে আমাকে ধরল। আর এই সুযোগে দিলার মেয়েটাকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে আনিস ও তার সঙ্গিরা ঘরের ভেতরে ঢুকে গিয়ে খিল এঁটে দিল। ভেতর থেকে মেয়েটা আর্ত চিৎকার করে আল্লার সাহায্য চাইতে লাগল, আল্লাগো বাঁচাও। আপনারা আমার ধর্মের ভাই। আমারে ছাইড়া দ্যান।
ঐ সেই ঘর, গত রাতে রাজাকাররা সীমা ও নন্দিনীর ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিল আর তারা ভগবানের নাম ধরে ডাকাডাকি করে রেহাই পায় নি।
আমি তাড়াতাড়ি নন্দিনীর কাঁধে ভর রেখে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়েই বললাম, আর এক মুহূর্তও এখানে নয়। চলো বর্ডারের দিকে হাঁটা দিই।
নন্দিনী বলল, চলুন আমরা যেতে পারব। আমাদের আপনি শুধু পথ দেখিয়ে নিয়ে চলুন।
আমরা দ্রুত উঠোন পেরিয়ে বাইরে এসে দেখি, একেবারে গেটের সামনেই দিলার গুলী খাওয়া মৃত দেহটা পড়ে আছে। মৃতের চোখ দুটি একটু অস্বাভাবিকভাবে বিস্ফারিত। আর পথের ওপর বিক্ষিপ্ত ভাবে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে অন্যান্য রাজাকাররা। যে কুত্তাটা গতকাল আমাদের দেখে ঘেউ ঘেউ করে কিছু খাবারের লোভে পিছু নিয়েছিল এখন সে রাস্তায় ছিটকে পড়া জমাটবাধা মানুষের রক্ত মজা করে চাটছে।
অবস্থাটা দেখে সম্ভবত নন্দিনীর গা ঘুলিয়ে উঠল। সে পথের ওপরই বসে পড়ে ওয়াক করে বমি করতে লাগল। আমি ও সীমা তাকে টেনে তুলে রাস্তা ধরে সামনের দিকে ছুটে চলতে লাগলাম।
.
কিছুদূর এগিয়েই পথ সোজা পূর্বদিক বাঁক নিয়েছে। নিবিড় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথটা সরু হয়ে সামনের দিকে গেছে। আমরা এতক্ষণ নন্দিনীকে মাঝখানে রেখে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। অল্পক্ষণ ছুটেই সকলে হাঁপিয়ে গেলাম। নন্দিনী হঠাৎ তার গতি কমিয়ে সাধ্যমতো হেঁটে চলতে লাগল। আমি বুঝলাম সে আর দৌড়ুতে পারছে না। আমি ও সীমা গতি কমিয়ে তার সাথে হেঁটেই চলতে লাগলাম। এর মধ্যে পথের মাঝেই নন্দিনী একটা গাছের গুঁড়িতে তলপেট চেপে ধরে বসে পড়ল। আমি লক্ষ করলাম তার পায়ের পাতায় উরু বেয়ে তাজা রক্তের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে আমার ও সীমার মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হল না। আমরাও তার সাথে গাছের গোড়ায় বসে পড়লাম। আমি বললাম, কোনো ভয় নেই। তার চলতে অসুবিধে হলে এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা ধীরে সুস্থেই হেঁটে যাবো।
নন্দিনী সামনের দিকে মাথা নুইয়ে তার পেট চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তার দেখাদেখি সীমাও কাঁদছে। আমার তখন একটা দিশেহারা অবস্থা। আমি নন্দিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। আমার মুখে সান্ত্বনার কোনো ভাষা না যোগালেও বললাম, নন্দিনী একটু সহ্য করে আরেকটু হাঁটতে হবে। আমরা বোধহয় বর্ডারের খুব কাছেই চলে এসেছি। এখন তো ভেঙে পড়লে চলবে না। আর একটু সাহসের পরিচয় দিতে হবে। যদি কিছু মনে না করো তবে আমার কাঁধে ভর রেখে, আমাকে জড়িয়ে ধরে চলো।
আমার কথায় নন্দিনী হঠাৎ আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল, আমাকে এরা একদম শেষ করে দিয়েছে। রক্ত তো থামছে না। এখন আমি কী করি বলুন না। আমি তো আর দাঁড়াতেই সাহস পাচ্ছি না। আমি কী করে যাব, মাগো।
যদিও নন্দিনীর ভয়াবহ শারীরিক অসুবিধার দিকটা আমার ও সীমার বুঝতে বাকি রইল না তবুও তাকে আমরা উভয়েই পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। সে তার দু বাহু আমাকে ও সীমাকে জড়িয়ে ধরেই হাঁটার চেষ্টা করতে লাগল। আমরা তাকে প্রায় হিঁচড়ে নিয়েই চলা শুরু করলাম।
সকাল বেলার আমেজ কেটে গিয়ে তখন গাছের ওপর ও পাতার ফাঁক দিয়ে পথের পরিচ্ছন্ন সূর্যের আলো এসে পড়ল। রোদের তাপ বাড়ছে। নন্দিনীর পা বেয়ে যে রক্তের ধারা নামছিল তা সম্ভবত এখন একটু থেমেছে। সে তার কাঁধ থেকে আমার ও সীমার হাত সরিয়ে নিতে ইঙ্গিৎ করলে আমরা তাকে ছেড়ে দিলাম। সে হাঁটছে। যদিও খুব ধীরে তাকে পা ফেলতে হচ্ছে তবুও নিজের শক্তিতে হাঁটতে পারছে দেখে আমি মনে মনে একটু স্বস্তি বোধ করলাম। উৎসাহ দেয়ার জন্য একবার বললাম, আগরতলা গিয়েও আমি তোমাকে ফেলে পালাব না। আমি দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তোমার সাথেই থাকব।
নন্দিনী কিছু না বলে মাথা নুইয়ে খুব ধীরে হিসেব করে পা ফেলে সামনের দিকে চলতে লাগল। শুধু একবার ঘাড় ফিরিয়ে আড়চোখে আমাকে দেখল। আমি তার চোখে চোখ রেখে আপনজনের মতো একটু হাসির আভাস ব্যক্ত করতে চাইলাম। নন্দিনী আমার আশ্বাসের ইঙ্গিৎ সম্ভবত খানিকটা বুঝতে পারল। কারণ তার চোখের কোণ মুহূর্তের জন্য ভিজে গিয়ে একটু চিক চিক করে উঠতেই আমি বললাম, এই যুদ্ধে যা কিছু ঘটেছে এবং ঘটবে তার নিরপেক্ষ সাক্ষী হব তুমি আর আমি। আমরা যুদ্ধ চলাকালে কোনো অবস্থাতেই পরস্পরকে ছেড়ে যাব না, তুমি আমাকে কথা দাও।
আমাকে নিয়ে আপনার শুধু ঝামেলাই বাড়বে।
বেশ স্পষ্ট করে কথাগুলো বলল নন্দিনী। সীমা যে আমাদের সাথেই আছে একবারও সেদিকে তাকাল না। আমি বললাম, ঝামেলাটাতো আর আমাদের ইচ্ছেয় তৈরি হয় নি। দৈবই আমাদের হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে।
নন্দিনী আর কোনো কথা না বলে হাঁটতে লাগল।