অধ্যায় ২
কোপার্নিকাসের বিপ্লব
ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মধ্যে তুমুল সংঘাতটা শুরু হয়েছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে। কোনো কোনো দিক থেকে সংঘাতটা ছিল চমকপ্রদ। বিতর্কের বিষয়টি ছিল আমরা যাকে সৌরজগত বলি তার কেন্দ্রে পৃথিবী না সূর্য, কোনটা অবস্থান করছে। টলেমির তত্ত্বটি ছিল প্রাচীন ও গোঁড়া। ওই তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবী, এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থির হয়ে আছে এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ ও স্থির নক্ষত্রের ব্যবস্থাটা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে পৃথিবীকে আবর্তন করছে। কোপার্নিকাসের নতুন তত্ত্ব অনুসারে স্থির থাকার পরিবর্তে পৃথিবীর বরঞ্চ দু’ধরনের গতি আছে। এই গতির প্রথমটি হলো এক দিনে একবার পৃথিবী নিজ কক্ষপথে ঘুরছে। এবং বছরে একবার সে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
যাকে আমরা কোপার্নিকাসের তত্ত্ব বলছি সেটা ষোলো শতকে এক অভিনবত্ত্বের সাড়া জাগিয়েছিল। কিন্তু আসলে এটি আবিস্কৃত হয়েছিল গ্রীকদের দ্বারা যাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশাল দক্ষতা ছিল। পিথাগোরাসের মতাবলম্বীরা এই তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন। সম্ভবত ঐতিহাসিক সত্যতা ছাড়াই তারা পিথাগোরাসকে এই মতের প্রবক্তা ভেবেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গ্রীসের সামাসের অধিবাসী অ্যারিস্টার্কাসই প্রথম জ্যোতির্বিদ যিনি সর্বপ্রথম এই আবর্তনের বিষয়টি শিক্ষা দিয়েছিলেন। নানা দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনি তত্ত্বগতভাবে যুক্তিসিদ্ধ একটি প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করে সূর্য ও চন্দ্রের আপেক্ষিক দূরত্বের বিষয়টি আবিষ্কার করেন। যদিও ত্রুটিপূর্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাঁর আবিষ্কৃত ফলাফলগুলো সঠিক ছিল না। গ্যালিলিওর মতো তিনিও অধার্মিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং স্টোইক দার্শনিক ক্লিনথেসের দ্বারা প্রকাশ্যে ধিকৃত হন। কিন্তু তিনি এমন একটা যুগে বাস করতেন যখন দেশের সরকারের উপর গোড়াপন্থীদের তেমন প্রভাব ছিল না। ফলে প্রকাশ্যে ধিকৃত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কোনো ক্ষতি স্বীকার করতে হয়নি।
জ্যামিতিবিদ্যায় গ্রীকদের খুবই দক্ষতা ছিল। ফলে কতিপয় বিষয়ের বৈজ্ঞানিক প্রতিপাদনে তাঁরা সক্ষম ছিলেন। তারা গ্রহণের কারণ জানতেন। চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়া দেখে তারা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, পৃথিবীটা গোলাকৃতির। এরাতোস্থেনিস, যিনি অ্যারিস্টার্কাসের কিছু পরের দিকের বিজ্ঞানী, আবিষ্কার করেছিলেন কিভাবে পৃথিবীর আকার হিসেব করে বের করা যায়। কিন্তু গ্রীকরা গতিবিজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞানেরও অধিকারী ছিলেন না। এই কারণে যারা পিথাগোরাসের তত্ত্বকে মান্যতা দিতেন, তাঁরা তাঁদের মতের সপক্ষে কোনও শক্তিশালী যুক্তি দিতে পারতেন না। টলেমি, সম্ভবত ১৩০ খ্রিষ্টাব্দে অ্যারিস্টার্কাসের মতকে খারিজ করে দেন এবং মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবীর সুবিধাজনক অবস্থানের তত্ত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। প্রাচীন যুগের শেষভাগ থেকে শুরু করে গোটা মধ্যযুগ ধরে টলেমির এই মতের বিরুদ্ধে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।
কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) এই সম্মানের অধিকারী হলেন। কোপার্নিকাসের তত্ত্বে তার নাম যুক্ত হলো। সম্ভবত এ সম্মান তার প্রাপ্য নয়। তরুণ বয়সে ক্রাকাউ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা শেষ করে তিনি ইতালিতে গিয়েছিলেন। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তিনি রোমে গণিতের অধ্যাপনা শুরু করেন। যাই হোক, বছর তিনেক পরে তিনি পোল্যান্ডে ফিরে আসেন। সেখানকার প্রচলিত মুদ্রার সংস্কারের কাজে যুক্ত হন এবং টিউটোনিক নাইটদের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৫০৭ থেকে ১৫৩০, তাঁর অবসর সময়ের এই তেইশ বছরে তিনি তার মূল্যবান কাজটি করেন। তিনি রচনা করেন জ্যোতিষ্কসমূহে’ কক্ষপথের আবর্তন (On the Revolution of the Heavenly Bodies) শীর্ষক বইটি। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৫৪৩ সালে, তাঁর মৃত্যুর ঠিক আগে।
কল্পনার ফলপ্রসূ প্রচেষ্টা হিসাবে কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই তত্ত্বটির ফলে আরও অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। তবুও এটি খুবই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আমরা এখন জানি যে, গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে নয়, উপবৃত্তাকারে ঘুরছে। সূর্য কেন্দ্রে নয়, অবস্থান করছে উপবৃত্তের একটি ফোকাসে। কোপার্নিকাস দৃঢ় অভিমত পোষণ করতেন যে, গ্রহগুলির কক্ষপথ অবশ্যই বৃত্তাকার হবে। বিচ্যুতির ব্যাখ্যা হিসাবে তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, সূর্য কক্ষপথগুলির কোনটিরই কেন্দ্রে অবস্থান করছে না। এটা অংশত তাঁর তত্ত্বকে সরলতা থেকে বঞ্চিত করে। এটাই ছিল টলেমির তত্ত্বের চাইতে বেশি সুবিধাজনক। কেপলার যদি কোপার্নিকাসের এই ত্রুটি সংশোধন না করতেন তাহলে নিউটনের পক্ষে তাঁর তত্ত্বকে সার্বজনীন করা সম্ভব হত না। কোপার্নিকাস এ-বিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, তার কেন্দ্রীয় মতবাদটি তার আগেই অ্যারিস্টার্কাস শিখিয়ে গেছেন। যা ছিল টুকরো জ্ঞান, যার জন্য তাঁর ইতালির ক্লাসিক্যাল শিক্ষার প্রতি ঋণ রয়েছে। এই জ্ঞানটুকু ছাড়া, ইতালির সেই সময়ে যখন প্রাচীনত্ত্বের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ক্রিয়াশীল ছিল তখন তার পক্ষে তার তত্ত্ব প্রকাশের সাহস হত না। যাজক সম্প্রদায়ের ভর্ৎসনায় তাঁর প্রবল ভয় ছিল। এই কারণেই তিনি তাঁর তত্ত্বের প্রকাশনায় দীর্ঘ প্রতীক্ষা করেছিলেন। নিজে গীর্জার পুরোহিত হয়েও তিনি পোপকে তাঁর বইখানা উৎসর্গ করেন। তাঁর প্রকাশক অসিয়েনডার একটি মুখবন্ধ জুড়ে দিয়েছিলেন। এই মুখবন্ধটি সম্ভবত কোপার্নিকাস অনুমোদন করেননি। মুখবন্ধটিতে বলা হয়েছিল যে, পৃথিবীর গতি সম্বন্ধীয় তত্ত্বটি একটি প্রকল্প হিসাবে হাজির করা হচ্ছে এবং এটি সত্য-আধারিত নয়। একটা সময় পর্যন্ত এই কৌশল কার্যকরী হয়েছে। কিন্তু গ্যালিলিওর সাহসী অমান্যতার ফলে কোপার্নিকাসের উপর অতীতে-আসতে পারত এমন সরকারি ধিক্কার নেমে এল।
প্রথমে প্রোটেস্টান্টরা কোপার্নিকাসের প্রতি, ক্যাথলিকদের চেয়েও বেশি তিক্ততা প্রকাশ করেছিলেন। প্রোটেস্টান্ট লুথার বলেছিলেন যে, মানুষ ঐ উঁইফোড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীটার কথায় কান দিচ্ছে, যে-নাকি বিরুদ্ধতা করে দেখাতে চাইছে যে পৃথিবী ঘুরছে আর স্বর্গ, আকাশ, সূর্য, চন্দ্র এরা সব ঘুরছে না। যদি কেউ খুব ধুরন্ধর চালাক বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে চায় তো সে একটা নতুন রীতিনিয়ম প্রস্তুত করুক, যা কি না সমস্ত রীতিনিয়মের থেকে উন্নততম হবে। ওই আহাম্মকটা জ্যোতিবিাকে উল্টে দিতে চায়। কিন্তু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আমাদের বলেছে যে, যশুয়া সূর্যকে স্থির হয়ে থাকতে আদেশ করেছেন, পৃথিবীকে নয়। মেলাঞ্চথনও সমানভাবে জোরালো ভাষায় নিন্দা করেছিলেন। তারপর কেলভিনও ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন পৃথিবীও প্রতিষ্ঠিত হল, যাকে নড়াতে পারা যাবে না’ (Ps.xciii.I)। তিনি জয়োল্লাসে সিদ্ধান্ত টেনে বলেছিলেন যে, ‘পবিত্র আত্মার কর্তৃত্বের ওপর কে প্রতিষ্ঠা করবে ওই কোপার্নিকাসের কর্তৃত্ব?’ এমনকি ওয়েসূলি, অষ্টাদশ শতাব্দীর মতো যুগেও খুব জোরালোভাবে বলার সাহস না দেখিয়েও বলেছিলেন যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই নতুন তত্ত্ব নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এ-ব্যাপারে আমার মনে হয় যে, একদিক দিয়ে ওয়েসলি সঠিক। ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট, এই দুটি ধর্মগ্রন্থেই শিক্ষার অপরিহার্য অংশটি হ’ল মানুষকে গুরুত্ব দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল মনুষ্য সংশ্লিষ্ট। অবতারবাদ ও প্রায়শ্চিত্ত সম্পর্কিত উপদেশাবলীর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকত না যদি ঈশ্বরসৃষ্ট সব কিছুর মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি না হত। কোপার্নিকাসের জ্যোর্তিবিজ্ঞানে এমন কিছুই নেই মানুষকে এর থেকে গুরুত্বহীন প্রমাণিত করে, (যা আমরা স্বভাবতই নিজেদের সম্পর্কে ভেবে থাকি।) কিন্তু, আমাদের গ্রহের অবস্থানচ্যুতি এই ধারণাই জন্ম দেয় যে, গ্রহের অধিবাসীরাও একইভাবে অবস্থানচ্যুত হবে। যখন এটা ভাবা হয়ে থাকে যে ঐ সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ ও স্থির নক্ষত্ররা আমাদের পৃথিবীকে এক দিনে একবারই প্রদক্ষিণ করে, তখন এটা সহজেই অনুমেয় যে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহনক্ষত্ররা আমাদের সুবিধার জন্যই বিদ্যমান। আর আমরা সেই স্রষ্টার বিশেষ সুবিধাভোগী সৃষ্টি। কিন্তু যখন কোপার্নিকাস ও তাঁর উত্তরসূরিরা জগতে এই বিশ্বাস উৎপাদন করে চলেছিলেন যে, পৃথিবী ও আমরা যখন আবর্তিত হই তখন আমাদের পৃথিবী নক্ষত্রদের নজরে আসে না। যখন এটা প্রতীয়মান হয় যে একাধিক গ্রহ ও সূর্যের তুলনায় পৃথিবী অনেক ক্ষুদ্র, যখন গণনার দ্বারা ও দূরবীক্ষণের দ্বারা আমাদের সৌরজগতের, ছায়াপথের ও পরিশেষে অসংখ্য ছায়াপথ সমন্বিত মহাবিশ্বের অসীম ব্যাপ্তি উদ্ঘাটিত হয়, তখন এটা বিশ্বাস করা ক্রমবর্ধমান দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে যে, কি করে বহুদূরবর্তী ও সঙ্কীর্ণ একটা আশ্রয়স্থল মানুষের বাসস্থান হিসাবে প্রত্যাশিত গুরুত্ব পেতে পারে। আর তা যদি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধর্মতত্ত্ব অনুসারে সৃষ্টিসংক্রান্ত গুরুত্বের অধিকারী হয় মানুষ। কেবলমাত্র পরিমাপের দ্বারাই এই ধারণার সৃষ্টি করে যে সম্ভবত আমরা এই মহাবিশ্বের অভীষ্ট লক্ষ্য নই। আমাদের ভেতরে বিলম্বে জাগ্রত আত্মসম্মানবোধ যেন ফিসফিস করে বলে চলে, যদি আমরা মহাবিশ্বের অভীষ্ট লক্ষ্য না হই তবে আমাদের কোনো প্রয়োজনই নেই। অবশ্য এটা আমি বলতে চাই না যে আমার এই চিন্তাপ্রসূত ব্যাপারটা একটা অকাট্য যুক্তি। তবুও যা ছিল অপেক্ষাকৃত পরিমাণে ক্ষুদ্র তা বিশালভাবে উদ্ভূত হয়েছিল কোপার্নিকাসের মতবাদের দ্বারা। আমি শুধুমাত্র এটাই বলতে চেয়েছি যে, কোপার্নিকাসের মতবাদ এমনই একটা ব্যাপার যা উদ্দীপিত করেছিল সেই সব মানুষকে যাদের মন ছিল এ ব্যাপারে প্রাণবন্ত।(১)
সেইজন্য মোটেই আশ্চর্যের বিষয় ছিল না যে খ্রিষ্টান যাজক সম্প্রদায়, প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথলিক নির্বিশেষে এই নতুন জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করবে আর সঙ্গত কারণ অনুসন্ধান করবে যাতে এই জ্যোতির্বিজ্ঞানকে প্রচলিত ধর্মের বিরোধী বলে চিহ্নিত করা যায়।
জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে এক বিরাট পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কেপলার (১৫৭১ ১৬৩০)। কেপলার যদিও গ্যালিলিওর সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন, তবুও তিনি যাজকদের সঙ্গে কোনও সংঘাতে যাননি। বিপরীতে, ক্যাথলিক কর্তাব্যক্তিরা তাঁকে প্রোটেস্টান্ট মতবাদের অনুগামী হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমা করেছিলেন তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ে বিশিষ্টতা(২) থাকার জন্য।
তাঁর অধ্যাপনা কালে যখন গ্রাঞ্জ (Gratz) শহরের কর্তৃত্ব প্রোটেস্টান্টদের হাত থেকে ক্যাথলিকদের হাতে চলে গেল, তখন প্রোটেস্টান্ট শিক্ষকরা বিতাড়িত হয়েছিলেন। তিনি পালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে জেসুইটরা পুনবহাল করেন। তিনি সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফের অধীনে রাজকীয় গণিতজ্ঞ হিসাবে বিজ্ঞানী টাইকোব্রাহের উত্তরাধিকারী হন। এবং টাইকোব্রাহের অমূল্য জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক নথিপত্র উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে যান। যদি তিনি শুধুমাত্র তাঁর সরকারি পদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতেন, তাহলে তাকে অনশনে কাটাতে হত কারণ তার বেতনের পরিমাণ বেশ বড়ো মাপের হওয়া সত্ত্বেও বেশির ভাগ সময়েই তা বাকি থাকত। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি তিনি জ্যোতিষচর্চাও করতেন। খুব সম্ভবত তিনি আন্তরিকভাবে জ্যোতিষেও বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি যখন সম্রাটের ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত ধনবান ব্যক্তিদের জন্মকুণ্ডলী তৈরি করতেন তখন তিনি তাদের কাছ থেকে মোটা অর্থ দাবি করতেন। তিনি তাঁর সারল্য ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এই মন্তব্য করেছিলেন যে, প্রকৃতি যখন প্রত্যেক প্রাণীর জীবনধারণের জন্য উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছে তখন প্রকৃতিই ফলিত জ্যোতিষকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ ও মিত্র বলে নির্ধারণ করেছে। কোষ্ঠি তৈরি করাই কেপলারের জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায় ছিল না। তিনি এক ধনী উত্তরাধিকারীনিকে বিবাহ করেছিলেন। যদিও তিনি সব সময়ই নিজেকে দারিদ্রপীড়িত বলে অভিযোগ করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল যে, তিনি মোটেই নিঃস্ব ছিলেন না।
কেপলায়ের বৌদ্ধিক চরিত্র ছিল অদ্বিতীয়। তিনি যেমন একদিকে কোপার্নিকাসের প্রকল্পকে সর্বাগ্রে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি সূর্য উপাসনাকে যুক্তিগ্রাহ্য করেছিলেন। শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টার দ্বারা তিনি তিনটি সূত্রের আবিষ্কার করেন। কেপলার কল্পনাপ্রসূত এক উদ্ভট প্রকল্পের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বলেছিলেন যে, বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি–এই গ্রহগুলি পাঁচটি সুষম কঠিন পদার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কেপলারের এই আবিষ্কারটি উদ্ভট আবিষ্কারের একটি চরমতম নিদর্শন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে অবশ্য এটা বিরল ঘটনা নয়। ওই ধরনের তত্ত্বগুলি যা আবিষ্কারকদের মনে সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয় তা আসলে অদ্ভুত কল্পনাপ্রসূত ও অবাস্তব। আসল ঘটনা হচ্ছে যে, সঠিক প্রকল্প অনুধাবন করা খুবই মুশকিলের। বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত জরুরি এই বিষয়টিকে সহজতর করার প্রয়োগকৌশলের কোনো অস্তিত্বই জগতে নেই। ফলস্বরূপ কোনো সুশৃঙ্খল পরিকল্পনার দ্বারা যখন নতুন প্রকল্পগুলির ধারণা জন্মায় তখন তা সঙ্গতভাবেই উপযোগী হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারাটার ওপর যদি দৃঢ়বিশ্বাস রাখা যায় তাহলে তা অনুসন্ধানকারীকে ধৈর্যশীল করে তোলে আর ক্রমাগত পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন নতুন সম্ভাবনারও সৃষ্টি হয়। যাই হোক, অতীতে এরকম অনেক প্রকল্পকেই খারিজ করতে হয়েছে। কেপলারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর অবিশ্বাস্য ধৈৰ্যশীলতার জন্য চরম সাফল্য এসেছিল, বিশেষ করে তার তৃতীয় সূত্র আবিষ্কারের ব্যাপারে। কিন্তু তাঁর ধৈৰ্য্যশীলতার মূল কারণ ছিল অতীন্দ্রিয়তায় বিশ্বাস। এই বিশ্বাস একটি সূত্রের যোগান দিয়েছিল। সূত্রের কথা, গ্রহগুলো আবর্তনের দ্বারা একটা গাণিক সঙ্গীত সৃষ্টি করে। এই সঙ্গীত কেবল সূর্যের আত্মাই শুনতে পায়। এর কারণ এই ধারণায় তিনি দৃঢ় ছিলেন যে, সূর্য হলো কম বা বেশি স্বর্গীয় আত্মার একটি দেহ।
কেপলারের প্রথম দুটি সূত্র ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তৃতীয়টি প্রকাশিত হয় ১৬১৯ সালে। আমাদের সৌরজগতের সাধারণ ছবিটার দৃষ্টিকোণ থেকে এই তিনটির ভিতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রথমটি। এই সূত্রে বলা হয়েছিল যে, গ্রহরা সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকারে ঘুরে চলেছে, আর সূর্য, একটি ফোকাস অধিকার করে রয়েছে। উপবৃত্ত আঁকতে, ধরা যাক, এক ইঞ্চির দূরত্বে দুটো পিনকে পৃথকভাবে এক টুকরো কাগজে আটকানো হলো। তারপর দুই ইঞ্চি লম্বা এক টুকরো সুতো নেওয়া হলো এবং সুতো টুকরোর দুটি প্রান্ত ওই দুটো পিনে বেঁধে দেওয়া হলো। সুতোটিকে দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী যে-কোনো বিন্দু থেকে টেনে টেনে যে-বিন্দুগুলোতে পৌঁছানো যায় সেই বিন্দুগুলো যোগ করলে একটি উপবৃত্ত পাওয়া যাবে। ওই পিন দুটোর অবস্থান হবে ওই উপবৃত্তের দুটো ফোকাস। এর অর্থ হলো একটি উপবৃত্ত সেইসব বিন্দুর সংযোগে গঠিত যে-বিন্দুগুলোর ক্ষেত্রে ফোকাস থেকে ওই বিন্দুগুলোর দূরত্বের সমষ্টি সবসময় সমান। প্রথমে গ্রিকরা এটা ধরে নিয়েছিল যে, আকাশে অবস্থিত সবকিছুই চক্রাকারে ঘোরে কারণ বৃত্তই হলো সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বদ্ধ বক্ররেখা। যখন তারা দেখলেন যে, এই প্রকল্প কাজে আসছে না তখন তারা একটি নতুন প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত করল। এই প্রকল্পের কথা, গ্রহরা ‘উপচক্রাকারে ঘোরে। এর মানে বৃত্তগুলো যে-বিন্দুর চারদিকে ঘোরে, সে-বিন্দু নিজেই বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। (একটি উপচক্র তৈরি করতে একটা বড় চাকা নিয়ে সেটা মাটিতে রাখতে হবে। তারপর একটি ছোটো চাকা নিতে হবে যার বেড়ে কাঁটা থাকবে। তারপর বড়ো চাকাটিকে ঘিরে ছোটো চাকাটি ঘোরালে মাটিতে পেরেক দ্বারা চিহ্নিত দাগগুলো হবে একটি উপচক্র। পৃথিবী যদি সূর্যের চারদিকে বৃত্তাকারে ঘোরে আর চাঁদ যদি পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকারে ঘোরে তাহলে বলা হবে যে, চাঁদ সূর্যের চারদিকে উপচক্রাকারে ঘুরছে।) যদিও গ্রীকরা উপবৃত্তগুলি সম্বন্ধে বেশ ভালো রকমই জানত, এবং তারা যত্ন সহকারে গণিতের উপাদানগুলি নিয়ে পড়াশোনাও করেছিল। কিন্তু এট তাদের মনে আসেনি যে আকাশে অবস্থানকারী বস্তুগুলি বৃত্ত এবং বৃত্তের জটিলতাগুলি ছাড়াও ঘুরতে পারে। কারণ তাদের নান্দনিক বোধ তাদের অনুমানকে প্রভাবিত করেছিল। এবং এক সুসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রকল্প ছাড়া সবকিছুতেই খারিজ করেছিল। গ্রীকদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পণ্ডিতসুলভ মনোভাবের জন্যে তারা সংস্কারবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কেপলারই সর্বপ্রথম সাহস করেছিলেন এ ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা করতে। পূর্বকৃত ধারণাগুলির যদি নান্দনিক উৎস থাকে তাহলে তারা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। যেমনটা নৈতিক বিচার ও ধর্মতত্ত্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে ঘটে থাকে। এ-ব্যাপারে কেপলারই একজন প্রথম শ্রেণীর নূতনত্বের প্রবর্তনকারী। যাই হোক, তার ওই তিনটি সূত্র বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বিরাট স্থান অধিকার করে আছে। কারণ এই সূত্র তিনটি নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের প্রমাণ জুগিয়েছিল।
কেপলারের সূত্রগুলি, মাধ্যাকর্ষণের সূত্রের বিপরীতে নির্ভেজাল বর্ণনামূলক ছিল। তার সূত্রগুলো গ্রহগুলোর আবর্তন সম্বন্ধে কোনো সাধারণ কারণ দর্শায়নি। কিন্তু কতকগুলি সরলসূত্রের ধারণা দিয়েছিল যার দ্বারা পর্যবেক্ষণের ফলাফলের উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। বর্ণনার সারল্যে এই তত্ত্বের একটাই সুবিধা ছিল যে গ্রহগুলো পৃথিবী নয়, সূর্যের চারদিকে ঘুরত। এবং আপাত প্রতীয়মান স্বর্গের দৈনিক আবর্তনের কারণ পৃথিবীর ঘূর্ণন। সপ্তদশ শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কাছে এটা প্রতীয়মান হয়েছিল যে, সংযুক্ত সারল্যের চাইতে পৃথিবী সত্যিতেই ঘুরছে এবং গ্রহরাও সত্য সত্যই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এই মতটি নিউটনের কাজের শক্তিবৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। কিন্তু আসলে যেহেতু সব গতিই আপেক্ষিক, যে-প্রকল্পে সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ঘঘারে আর যে-প্রকল্পে পৃথিবীকে ঘিরে সূর্য ঘোরে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় আমরা করতে পারি না। একই ঘটনার মাত্র দুটি ভিন্ন ধরনের বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন ক, খ,–কে বিবাহ করে অথবা খ, ক-কে বিবাহ করে। কিন্তু আমরা যখন পুংখানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষা করি তখন কোপার্নিকাসের বর্ণনার সারল্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, কোনো সুস্থির মস্তিষ্কের মানুষ, পৃথিবী অনড়, এই তত্ত্বের জটিলতা দ্বারা নিজেকে ভারাক্রান্ত করবেন না। আমরা বলে থাকি যে, একটা ট্রেন এডিনবরার দিকে যাত্রা করছে। কিন্তু এটা বলি না যে, এডিনবরা ট্রেনের দিকে যাত্রা করছে। বৌদ্ধিক ভুল ছাড়া আমরা দ্বিতীয়টাও বলতে পারতাম। সেক্ষেত্রে এটা আমাদের ধরে নিতে হবে যে, সমস্ত শহরগুলো এবং মাঠগুলো ট্রেনের লাইন ধরে হঠাৎ অত্যন্ত দ্রুতবেগে দক্ষিণ মুখে ধেয়ে চলেছে। এই ব্যাপারটা ট্রেনটি ছাড়া পৃথিবীর সবকিছুর ক্ষেত্রে বিস্তৃত করা যায়। এটা যুক্তির দিক দিয়ে সম্ভব কিন্তু অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল। টলেমির প্রকল্প একইভাবে নক্ষত্রগুলির দৈনন্দিন আবর্তনের ব্যাপারে নিয়মবহির্ভূত ও উদ্দেশ্যবিহীন। কিন্তু একইভাবে বৌদ্ধিক ভুল থেকে মুক্ত। যাই হোক, কেপলার, গ্যালিলিও এবং তাদের বিরোধীপক্ষ যেহেতু গতির আপেক্ষিকতার সত্যতা স্বীকার করেননি, সেহেতু বির্তকের প্রশ্নটা বর্ণনার সুবিধার্থে গ্রাহ্য নয়, এটি গ্রাহ্য বিষয়গত সত্য হিসাবে। এই ভুলটা মনে হয়, সেই সময়কাল জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য একটি প্রয়োজনীয় উদ্দীপক বিষয় ছিল। কারণ স্বর্গীয় বস্তুর অবস্থার নিয়ন্ত্রণের নিয়ম কখনই আবিষ্কৃত হতো না যদি না কোপার্নিকাসের প্রকল্প সারল্যের কথা না বলতো।
গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২) তার আবিষ্কারগুলির জন্য এবং যাজকদের বিচারসভার বিরোধিতার জন্য সেই সময়কার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানব্যক্তিত্ব বলে স্বীকৃত ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র গণিতজ্ঞ। এবং তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন লাভজনক শিক্ষার দিকে তার ছেলেকে চালিত করতে। উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি গ্যালিলিওকে গণিত যে-একটি বিষয়, সে ধারণা থেকে দূরে রাখতে সফল হয়েছিলেন। গ্যালিলিও আড়ি পেতে জ্যামিতি সম্পর্কিত বক্তৃতা শুনলেন। তিনি ঐকান্তিক আগ্রহে বিষয়টি গ্রহণ করেন। এটি ছিল তাঁর কাছে আকর্ষণীয় নিষিদ্ধ ফলের মতো। দুর্ভাগ্যবশত এই ঘটনার নৈতিকতা স্কুলশিক্ষকের আবর্তে হারিয়ে গেছে।
গ্যালিলিওর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব ছিল এই যে, তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যান্ত্রিক দক্ষতার মিলন ঘটিয়ে তাঁর সূত্রগুলিকে গাণিতিক সূত্রে রূপ দিতে পেরেছিলেন। গতিবিজ্ঞানের শিক্ষা অর্থাৎ বস্তুর গতিকে নিয়ন্ত্রণের সূত্র তাঁর হাতেই শুরু হয়েছিল। গ্রীকরা স্থিতিবিদ্যা অর্থাৎ ভারসাম্যের সূত্রগুলি অধ্যয়ন করেছিল। কিন্তু গতির, বিশেষ করে বিভিন্ন বেগসম্পন্ন গতির সূত্রগুলিকে গ্রীকরা এবং ষোড়শ শতাব্দীর মানুষেরা সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছিল। শুরুতে, এটা ভাবা হয়েছিল যে, গতিসম্পন্ন বস্তুকে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে সেই বস্তু নিজে থেকেই থেমে যাবে। পক্ষান্তরে গ্যালিলিও প্রমাণ করলেন যে, বস্তুটি সমান গতিবেগে একটি সরলরেখায় চলবে যদি বাইরের সমস্ত রকমের প্রভাব থেকে বস্তুটি মুক্ত থাকে। বিষয়টি অন্যভাবে রাখলে, পরিবেশ সংক্রান্ত অবস্থাগুলিকে বিচারের জন্য অবশ্যই বিচারের মধ্যে আনতে হবে, বস্তুর গতির জন্য নয়, গতি পরিবর্তনের জন্য, সেটা লক্ষ্য অথবা বেগ অথবা দুইয়েরই পরিবর্তনের জন্য। গতিবেগ অথবা গতির অভিমুখের পরিবর্তনকে ত্বরণ বলা হয়। এইভাবে বস্তুগুলো আন্দোলিত হয়। কিন্তু কেন, তার ব্যাখ্যায় বলা হয় এটা ঘটে ত্বরণের জন্য, বেগের জন্য নয়। এটা প্রমাণ করে যে, গতির প্রয়োগ বাইরে থেকে হয়। এই তত্ত্বের আবিষ্কারটা ছিল গতিবিজ্ঞানে প্রথম অপরিহার্য পদক্ষেপ।
তিনি তাঁর পড়ন্ত বস্তুগুলি সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন। অ্যারিস্টটল শিক্ষা দিয়েছিলেন, যে-গতিতে একটি বস্তু ওপর থেকে পড়ে সেটি সেই বস্তুর ওজনের সমানুপাতিক। অর্থাৎ একটি বস্তু, ধরা যাক, তার ওজন দশ পাউণ্ড এবং অপর একটি বস্তু যার ওজন এক পাউন্ড তাদের একই উচ্চতা থেকে একই সময়ে নিচে ফেলে দেওয়া হলো। এক পাউন্ড ওজনের বস্তুটি দশ পাউন্ড ওজনের বস্তুটির দশগুণ বেশি সময় নেবে মাটিতে পড়তে। পিসার অধ্যাপক গ্যালিলিওর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য অধ্যাপকদের অনুভূতির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা ছিল না। অ্যারিস্টটলপন্থী অধ্যাপকদের লেকচার দিতে যাওয়ার পথে পিসার হেলানো মিনার থেকে গ্যালিলিও ওজনগুলো মাটিতে ছুঁড়ে ফেলতেন। বড়ো এবং ছোটো সীসার পিণ্ডগুলো মাটিতে যুগপৎ প্রায় একই সঙ্গে এসে পড়ত। এই ঘটনা গ্যালিলিওর কাছে এটা প্রমাণ করেছিল যে, অ্যারিস্টটল ভুল করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য অধ্যাপকদের কাছে এটা ছিল গ্যালিলিরও দুষ্টুমিপনা। অসংখ্য বিদ্বেষপরায়ণ প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে এটি ছিল একটি বিশেষ ধরনের নমুনা। গ্যালিলিওকে বিরামহীন ঘৃণা পেতে হয়েছিল তাদের কাছে যারা বিশ্বাস করতেন যে, সত্যের অনুসন্ধান করতে হবে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নয়, বই পড়ে।
গ্যালিলিও আবিষ্কার করেছিলেন যে, বাতাসের বাধা ছাড়াও যখন বস্তুগুলি মুক্তভাবে পড়তে থাকে তখন সেগুলি একইরূপ ত্বরণের সাথে পড়তে থাকে, যা একটি সম্পূর্ণ শূন্য অবস্থায় সকলের জন্য একই ভাবে ঘটে। তা সেই বস্তুগুলি স্তূপাকৃতিই হোক অথবা বস্তুগুলি উপাদানেই গঠিত হোক। যখন একটি বস্তু শূন্যতার মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে পড়তে থাকে তখন তার গতি প্রতি সেকেন্ডে বাড়তে থাকে ৩২ ফুট হিসাবে। তিনি আরও প্রমাণ করেছিলেন যে, যখন একটি বস্তুকে আড়াআড়িভাবে ছুঁড়ে দেয়া হয়, ঠিক বুলেটের মতো, এটি তখন একটি অধিবৃত্তের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। অথচ আগে এটা ধরা হত যে বস্তুটি কিছুক্ষণের জন্য আড়াআড়িভাবে চলবার পর লম্বাভাবে পড়তে থাকে। এই ফলাফলগুলি এখন খুব রোমাঞ্চকর বলে মনে হয় না। কিন্তু বস্তুগুলি কী করে আন্দোলিত হয় তার সঠিক গাণিতিক জ্ঞানের এগুলিই ছিল সূচনা। তাঁর সময়কালের আগেও বিশুদ্ধ গণিত ছিল। যা ছিল অবরোহী পদ্ধতির এবং পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভরশীল। তখন পুরোপুরি একধরনের পরীক্ষামূলক গবেষণা ছিল, বিশেষ করে সেটা ছিল অপরসায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি পরীক্ষা নিরীক্ষার অভ্যাসটির সূত্রপাতের জন্য যথেষ্ট কাজ করেছিলেন। তাঁর কাজের লক্ষ্য ছিল একটি গাণিতিক নিয়মে পৌঁছানো। এই নিয়মকে বস্তুতে প্রয়োগের ক্ষেত্রে গণিতকে সক্ষম করা, যা নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত জ্ঞান থাকত না। তিনি সচেষ্ট ছিলেন নাটকীয়ভাবে এবং অকাট্যভাবে এটা প্রমাণ করতে যে, সামান্যতম পরীক্ষার চেষ্টা করলেই যেটা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারত বংশপরম্পরায় সেটা করা হয়নি। অ্যারিস্টটলের থেকে গ্যালিলিও, এই দু’হাজার বছর ধরে কেউই এটা বুঝতে চায়নি যে অ্যারিস্টটলের বলা পড়ন্ত বস্তুগুলি সম্পর্কিত সূত্রগুলি সঠিক কিনা। এইরকম বিবৃতিগুলিকে পরীক্ষা করা এখন আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু গ্যালিলিওর সময়ে এর জন্য প্রতিভাধরদের প্রয়োজন ছিল।
পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলি যদিও পণ্ডিতম্মন্যদের খেপিয়ে তুলত, তবুও ধর্ম-আদালত এর নিন্দা করতে পারেননি। দূরবীক্ষণই গ্যালিলিওকে খুবই বিপজ্জনক রাস্তায় ঠেলে দিয়েছিল। একজন ওলন্দাজ ওই ধরনের একটা যন্ত্র আবিষ্কার করছেন শুনে গ্যালিলিও এমনটি পুনঃআবিষ্কার করলেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন নতুন জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় ঘটনা আবিষ্কার করলেন, যার মধ্যে তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বৃহস্পতির একাধিক উপগ্রহের অস্তিত্ব। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব অনুযায়ী ওইগুলি সৌরজগতের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ওগুলোকে টলেমির তথ্যের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো মুশকিল ছিল। অধিকন্তু স্থির নক্ষত্রদের কথা বাদ দিয়েও আরও নানাধরনের জানার বিষয় ছিল। মহাকাশে সাতটি বস্তুর আবশ্যিকতাই গ্রাহ্য হত (সূর্য, চন্দ্র এবং আর পাঁচটি গ্রহ)। অতিরিক্ত চারটির আবিষ্কারই ছিল সবচেয়ে বিপর্যয়কারী। ওখানে কি এ্যাপোক্যালিপসের সাতটি সোনার বাতিদান ছিল না আর এশিয়াতে কি সাতটি গীর্জা ছিল না? অ্যারিস্টটলপন্থীরা দূরবীক্ষণের মাধ্যমে অবলোকন করাকে সর্বতোভাবে প্রত্যাখান করেছিলেন এবং অনমনীয়ভাবে এইমত পোষণ করেছিলেন যে বৃহস্পতির চারটি চাঁদের কথা হল একটা বিভ্রান্তি।(৩)
কিন্তু গ্যালিলিও বিচক্ষণতার সঙ্গে টুসক্যানির গ্রান্ড ডিউকের নামে তাদের নামকরণ করেছিলেন ‘সিডেরা মেডিসিয়া (মেডিসিয়ান স্টার)’। এটা গ্রহসমূহের বাস্তবতা সম্বন্ধে অনেকটাই সরকারের প্রত্যয় জন্মাতে সাহায্য করেছিল। তারা যদি কোপার্নিকাসের তত্ত্বের জন্য যুক্তি প্রদান না করতেন তাহলে তারা তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিলেন তারা বেশি দিন পর্যন্ত তাঁদের মতকে ধরে রাখতে পারতেন না।
বৃহস্পতিবার চাঁদগুলি ছাড়া, দূরবীক্ষণ ধর্মতাত্ত্বিকদের পক্ষে ভয়ংকর অন্যান্য অনেক জিনিসের রহস্য উঘাটন করেছিল। দূরবীক্ষণ প্রমাণ করেছিল যে, শুক্র গ্রহের চাঁদের মতো চন্দ্রকলা আছে। কোপার্নিকাস এটাকে তার তত্ত্বে প্রত্যাশা করেছিলেন। গ্যালিলিওর যন্ত্র কোপার্নিকাসের বিরুদ্ধে উখিত যুক্তিকে তাঁর স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে বদলে দিল। যন্ত্রে দেখা গেল চাদে অনেক পাহাড় আছে যেটা কতিপয় কারণে বেদনাদায়ক মনে হয়েছিল। আরও ভয়ঙ্কর ছিল এই কথাটা যে, সূর্যের কলঙ্ক আছে। সেই সময় এটা বিবেচিত হয়েছিল যে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কলঙ্কযুক্ত বলে দেখানো যাচ্ছে। ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সূর্যের কলঙ্কের কথাকে উল্লেখ করতে নিষিদ্ধ করেছিলেন। এবং তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ এই নিষেধ শতাব্দীকাল ধরে মেনেছিলেন। একজন ডোমিনিক সন্তের পদোন্নতি করা হয়েছিল শ্লেষাত্মক পুঁথির একটি উপদেশের জন্য, ‘ওহে গ্যালিলির অনুসরণকারী মানুষেরা, তোমরা স্বর্গের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ কালক্রমে এই ডোমিনিকান এইমত পোষণ করেছিলেন যে, জ্যামিতি শয়তানের শাস্ত্র এবং ওইসব গণিতজ্ঞদের সমস্ত ধর্মবিদ্বেষের প্রবক্তা হিসাবে নির্বাসিত করা উচিত। ধর্মতাত্ত্বিকরা এটা নির্দেশ করতে দেরি করেননি যে, নতুন মতবাদ অবতারবাদকে বিশ্বাস করাতে খুবই মুশকিলে পড়বে। সর্বোপরি, যেহেতু ঈশ্বর উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছু করেন না, আমরা অবশ্যই ধরে নেব যে অন্যান্য গ্রহগুলিই স্বাভাবিক আবাসস্থল। কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা কি নোয়ার বংশধররূপে উদ্ভূত হয়েছিলেন অথবা বিশ্বের ত্রাণকর্তা তাদের ত্রাণ করেছিলেন? কার্ডিনাল এবং আর্চ বিশপদের মতে ওইগুলিই ছিল কিছু ভয়ঙ্কর সন্দেহের ব্যাপার যা গ্যালিলিওর অপবিত্র অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তুলতে চাইবে। এ-সবের ফলস্বরূপ ধর্ম-আদালত জ্যোতির্বিজ্ঞানকে তাদের এক্তিয়ারে অন্তর্ভূক্ত করেছিল এবং নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ব্যাপারে সিন্ধান্ত নিয়েছিল।
‘প্রথম প্রস্তাব ছিল যে, সূর্য কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে না, এটা বলা মূর্খত, ধর্মতত্ত্বের বিচারে মিথ্যা এবং প্রচলিত ধর্মমত বিরোধী, কারণ পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বিপরীতে এটা বলা হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো পৃথিবী কেন্দ্রে অবস্থিত নয়, কিন্তু সূর্যের চারদিকে ঘোরে, এটাও অসম্ভব, দর্শনশাস্ত্র অনুযায়ী মিথ্যা এবং অন্তত ধর্মতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সত্যবিশ্বাসের বিরোধী।
এর অব্যবহিত পরেই গ্যালিরিওকে পোপ আদেশ করেছিলেন ধর্ম-আদালতে উপস্থিত হবার জন্য। ধর্ম-আদালতে গ্যালিলিওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল শপথপূর্বক তার ভুলগুলিকে পরিত্যাগ করতে। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি তা পালন করেছিলেন। তিনি ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি আর কখনই কোপার্নিকাসের মত অবলম্বন করবেন না কিংবা ওই মতের শিক্ষা তিনি লিখিত বা মৌখিকভাবে দেবেন না। এটা অবশ্যই মনে রাখার বিষয় যে, ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারার মাত্র ষোলো বছর পর এটা ঘটেছিল।
পোপের নির্দেশে, পৃথিবী ঘোরে, এটা-বলা সব বইপত্র ইনডেক্সের ওপর টী গ্যালিলিও ফ্লোরেন্সে চলে গেলেন। সেখানে একান্তে কিছুদিন বাস করলেন এবং তার বিজয়ী শক্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেন না।
গ্যালিলিও, যাই হোক, একজন আশাবাদী মানসিকতার মানুষ ছিলেন। এবং সবসময়ে তাঁর প্রবণতা ছিল মূর্খদের বিরুদ্ধে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তিকে পরিচালিত করা। ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বন্ধু কার্ডিন্যাল বারবেরিনি, অষ্টম আরবান এই উপাধি নিয়ে পোপ নিযুক্ত হলেন। এটা গ্যালিলিওর মনে একটা নিরাপত্তার বোধ এনে দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাবলী এটা ভুল প্রমাণ করে। তিনি তার Dialgus on the Two Gratest Systems of the World বইটি লেখার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এই বইটি ১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে সম্পূর্ণ হয়ে ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই বইটিতে তিনি একটি ক্ষীণ অজুহাত রেখেছিলেন দুটি বিরাট তত্ত্বের বিষয়কে আলোচনায় রাখতে। যার একটি ছিল টলেমির আর অন্যটি কোপর্নিকাসের। আসলে কিন্তু এটা ছিল শেষোক্ত ব্যক্তির পক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তির অবতারণা। এটি একখানা বুদ্ধিদীপ্ত বই। সারা ইউরোপ জুড়ে সাগ্রহে বইটি পড়া হয়েছিল।
বিজ্ঞানের জগৎ এই বইটিকে প্রশংসা করেছিল, কিন্তু গীর্জার পাদ্রিরা ক্ষেপে উঠেছিলেন। গ্যালিলিওর উপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপানো নীরবতার সময়কালে তার শত্রুরা সংস্কার বাড়ানোর সুযোগ নিয়েছিল এমন কতিপয় যুক্তির দ্বারা, যার উত্তর দেওয়া হঠকারিতার পর্যায়ে পড়ত। এটা দাবি করা হয়েছিল যে, ঈশ্বরের ধর্ম সম্বন্ধীয় উপদেশাবলীর সঙ্গে গ্যালিলিওর শিক্ষার কোনো সঙ্গতি নেই। জেসুইট ফাদার মেলচিওর ইচোফার বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবী ঘুরছে এই মতটি প্রচলিত ধর্মবিদ্বেষের বিশ্বাসগুলির মধ্যে সবচেয় জঘন্য, ভীষণ ক্ষতিকর, এবং সবচেয়ে কুৎসাপূর্ণ। পৃথিবী যে-গতিহীন অনড় এটা সবচেয়ে পবিত্র ব্যাপার। আত্মার অবিনশ্বরতার, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, এবং অবতারবাদ এসবের বিরুদ্ধে যুক্তিকে যদিও সহ্য করা যায় কিন্তু পৃথিবী ঘুরছে এটা প্রমাণ করার যুক্তিকে সহ্য করা যায় না। শেয়ালকে দেখে শিকারিরা যেমন চিৎকার করে, ধর্মতত্ত্ববিদেরা সেই রকম চিৎকার শুরু করেছিল এবং একে অপরকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। একজন বৃদ্ধ, অশক্ত, অসুস্থ, এবং প্রায়ান্ধ মানুষকে খুঁজে বার করার জন্য তারা সবাই হন্যে হয়ে চেষ্টা চালালো। গ্যালিলিওকে আরেকবার ধর্মযাজকদের ধর্ম আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্যে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ধর্ম-আদালতের নির্দেশ অমান্য করছেন, এটা ধরে নিয়ে ১৬১৬ সালের নির্দেশের চাইতে কড়া মেজাজ দেখান হতে থাকল। প্রথমে সনির্বন্ধ আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন, তিনি এতই অসুস্থ যে, ফ্লোরেন্স থেকে যাত্রার ধকল তাঁর সহ্য হবে না। পোপ অবিলম্বে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসককে ওই অপরাধী (গ্যালিলিও)-কে পরীক্ষা করার জন্য পাঠাবেন বলে হুমকি দিলেন। যদি অসুস্থতা সাংঘাতিক বলে প্রমাণিত না হয়, তাহলে তাকে শৃঙ্খলিত করে আনা হবে, এই হুমকিতে গ্যালিলিও তার শত্রুর চিকিৎসক দূতের রায়ের জন্য অপেক্ষা না করে যাত্রা শুরু করলেন। কারণ অষ্টম আরবান তখন গ্যালিলিওর ক্রুদ্ধ প্রতিপক্ষ ছিলেন। রোমে পৌঁছলে তাঁকে ধর্ম আদালতের কারাগারে আটক করা হয়। এই বলে হুমকি দেয়া হয় যে, পূর্বেকার ধারণা পরিহার না করলে তাঁকে শরীরিক অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হবে। ধর্ম আদালতে প্রভু যিশু ও তাঁর মহিমান্বিত কুমারী মা মেরির নাম উচ্চারণ করে আহান জানিয়ে হুকুম জারি করেছিল যে, গ্যালিলিও প্রচলিত ধর্মমতের বিশ্বাসের বিরুদ্ধতার জন্য শাস্তির দায় বহন নাও করতে পারেন, যদি তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে এবং অকৃত্রিম বিশ্বাসের সঙ্গে ওই বিচারকদের উপস্থিতিতে তাঁর ভুলগুলোকে এবং প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে বিশ্বাসগুলিকে শপথপূর্বক পরিত্যাগ করেন। পূর্বের বিশ্বাস পরিত্যাগ করলেও এবং কৃতপাপের জন্য অনুতপ্ত হলেও, আমাদের ইচ্ছানুযায়ী বিবেচিত সময়ের জন্য এই পবিত্র আদালতের কারাগারে থাকতে হবে। কল্যাণকর প্রায়শ্চিত্তের প্রসঙ্গে, আমরা আপনাকে এই আদেশ প্রদান করছি যে, পরবর্তী তিন বছর ধরে, সপ্তাহে একবার, প্রায়শ্চিত্ত বিধানগ্রন্থের সাতটি স্তোত্র আপনাকে আবৃত্তি করতে হবে। তুলনামূলকভাবে কোমল এই রায় পূর্বতন বিশ্বাস পরিত্যাগের শর্তসাপেক্ষ ছিল। গ্যালিলিও ওই রায় অনুযায়ী হাঁটু গেড়ে বসে যাজকদের দ্বারা তৈরি দীর্ঘ অনুমোদিত বিধানগুলিকে উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন। স্বীকারোক্তির এই প্রক্রিয়ায় তিনি বললেন, ‘শপথপূর্বক আমি আমার ভুলগুলিকে ও প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধতাকে পরিত্যাগ করছি, ঘৃণা করছি ও অভিশাপ দিচ্ছি। আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, ভবিষ্যতে মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে আর কখনই এমন কিছুই বলব না, ঘোষণা করব না যা আমার প্রতি এই ধরনের সন্দেহ জাগায়।’ তিনি যাজকদের বিচারসভার সামনে প্রতিজ্ঞা করে আরও বললেন যে, এরপর তিনি প্রচলিত ধর্মমতের কোনো বিরুদ্ধবাদী ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেলে যিনি বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবী ঘুরছে, তাহলে তাকে তিনি বর্জন করবেন। তিনি খ্রিষ্টের উপদেশাবলী সম্বলিত গ্রন্থের উপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করে বললেন যে, তিনি নিজে তার পূর্বতন মতবাদকে শপথপূর্বক পরিত্যাগ করছেন। সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটিকে দিয়ে তাঁর শপথভঙ্গের মাধ্যমে ধর্মীয় ও নৈতিক স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে এতে সন্তুষ্ট হয়ে ধর্ম-আদালত তাঁর বাকি জীবনটা বন্দিদশায় এবং নিঃসঙ্গতায় কাটানোর অনুমতি দিল। এই বন্দিজীবন কারাগারে নয় সত্য, কিন্তু তাঁর সমুদয় চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং তার পরিবারের লোকজন ও বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে যে-বছর নিউটন জন্মগ্রহণ করেন সেই বছর তিনি প্রয়াত হন। যাজক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে-থাকা সমস্ত বিদ্বজ্জন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে সত্য হিসাবে কোপার্নিকাসের তত্ত্বের শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। পৃথিবী ঘোরে এই শিক্ষা সম্বলিত যাবতীয় বইপত্র ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত কেবল সূচিপত্রেই রয়ে গেল। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ওয়ার্শতে থরওয়াল্ডসেনের তৈরি কোপার্নিকাসের মূর্তির আবরণ যখন উম্মোচিত হল, তখন এক বিরাট জনতা ওই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে সমবেত হয়েছিল। কিন্তু কোনো ক্যাথলিক যাজক ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। ক্যাথলিক ধর্মযাজকেরা প্রায় ২০০ বছর ধরে অনিচ্ছাভরে একটি তত্ত্বের বিরুদ্ধে দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধতা বজায় রেখেছিলেন। অথচ সেই পুরো সময় ধরে যোগ্য জ্যোতির্বিদদের দ্বারা এই তত্ত্ব সমর্থিত ছিল।
এটা মনে করা অবশ্যই ঠিক নয় যে, প্রোটেস্টান্ট ধর্মতাত্ত্বিকরা প্রথমে ক্যাথলিকদের চেয়ে এই তত্ত্বের প্রতি বেশি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। কিন্তু নানা কারণে তাদের বিরোধিতা কম কার্যকর ছিল। প্রোটেস্টান্ট প্রভাবিত দেশগুলিতে ধর্মমতের গোড়ামিকে জোরদার করার ব্যাপারে রোমান ক্যাথলিক যাজকদের চেয়ে ক্ষমতাশালী তেমন কেউ ছিলেন না। অধিকন্তু সম্প্রদায়গত বৈচিত্র্যের জন্য ধর্মগত কারণে নির্যাতন চালানো মুসকিল ছিল। এ-ভাবেই ধর্মকে কেন্দ্র করে যে-যুদ্ধ তাতে যুক্তফ্রন্টই কাম্য হয়ে উঠেছিল। দেকার্ত ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দের গ্যালিলিওর দণ্ডাদেশের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। এবং হল্যান্ডে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার শাস্তির কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন এবং হল্যান্ডে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার শাস্তির কথা শুনে হল্যান্ডের ধর্মতত্ত্ববিদরা হইচই করেছিলেন কিন্তু সেখানকার সরকার ধর্মীয় সহনশীলতার নীতিকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন। সর্বোপরি অভ্রান্ততার দাবি থেকে প্রোটেস্টান্ট গিজাসমূহের কোনো ক্ষতিই হয়নি যদিও খ্রিষ্টীয় ধর্মশাস্ত্র মৌখিকভাবে অনুপ্রেরণাদানকারী বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যার ব্যাপারটা ব্যক্তিগত বিচারের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই ব্যাপারটা শীঘ্রই ধর্মমতের অসুবিধাজনক রচনাগুলিকে ব্যাখ্যার দ্বারা দূর করার রাস্তা দেখিয়েছিল। প্রোটেস্টান্টাবাদ গীর্জার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হিসাবে শুরু করেছিল এবং সর্বত্র খ্রীষ্টান যাজকদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের শক্তি বৃদ্ধি ঘটাচ্ছিল। এ নিয়ে প্রশ্ন নেই যে, ধর্মযাজকেরা ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তবুও কোপার্নিকাসের মতবাদের ব্যাপ্তিকে রোধ করার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করত। সুতরাং একটু দেরিতে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান লুথারেন টিচার্স সেমিনারির একজন প্রাক্তন সভাপতি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর লেখা একটি বই সেন্ট লুই থেকে প্রকাশ করলেন। তাতে এই ব্যাখ্যা দেওয়া হলো যে, সত্যকে বাইবেলের মধ্যে খুঁজতে হবে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বইতে নয়। এই কারণে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং তাঁদের উত্তরসূরীদের শিক্ষাকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে। কিন্তু ওই বিলম্বিত প্রতিবাদ শুধুমাত্র করুণ অবস্থাই প্রাপ্ত হয়। এটা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে যে, কোপার্নিকাসের তত্ত্ব চূড়ান্ত নয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হিসাবে এটারও প্রয়োজন ছিল।
যদিও ধর্মতত্ত্ববিদরা গ্যালিলিওর উপর তাদের সর্বনাশা জয়ের পর একটা বিজ্ঞ বিবেচনায় পৌঁছলেন। বিবেচনাটা হলো, এর পর থেকে তাঁরা গ্যালিলিও ঘটনায় যে-সরকারি অবস্থানে ছিলেন সেটা এড়িয়ে যাবেন। বিজ্ঞানের প্রতি দুৰ্জেয়বাদকে তাদের সাহস অনুযায়ী তারা বিরোধিতা করবেন। ধূমকেতুর বিষয়ে তাঁদের মনোভাবেই এটা স্পষ্ট হয় যে, আধুনিক মানসিকতায় ধূমকেতুর সঙ্গে ধর্মের মনে হয় কোনো ঘনিষ্ট সম্পর্ক নেই। মধ্যযুগীয় ধর্মতত্ত্বে যেহেতু এটি একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য ব্যবস্থা ছিল তাই তাকে অপরিবর্তনীয় মনে করা হত। এই ধর্মতত্ত্ব প্রায় সমস্ত ব্যাপারে সঠিক মতামতগুলিকে এড়িয়ে চলতে পারত না এবং যার ফলে বিজ্ঞানের সমস্ত দিকগুলির সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য দায়ী হয়েছিল ধর্মতত্ত্বের প্রাচীনতত্ত্ব যার বেশিরভাগই ছিল একটি সংগঠিত অজ্ঞতা। আলোকপ্রাপ্ত যুগে ভুলগুলির উপর পবিত্রতার সুগন্ধ ছড়িয়েও বেশিদিন সেগুলোকে বাঁচানো যায়নি। ধূমকেতু সম্বন্ধে ধর্মযাজকদের মতামতের দুটি উৎস ছিল। একদিকে আইনের শাসনকে আমরা যেভাবে বুঝি সেভাবে বোঝা হত না। অপরদিকে এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরে যা কিছুই আছে সবই ধ্বংসাতীত।
শুরু করা যাক আইনের শাসন নিয়ে। এটা ভাবা হয়েছিল যে, নিয়মিতভাবে কিছু জিনিস ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, সূর্যোদয় এবং ঋতুর পরিবর্তন। অন্যগুলি হল কিছু প্রতীক ও ভবিষ্যতের পূর্ব লক্ষণ, যা ঘটনার পূর্বাভাস দেয় অথবা মানুষকে তার কৃতপাপের জন্য অনুতপ্ত হতে সক্রিয় করে তোলে। সেই গ্যালিলিওর সময় থেকেই বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে পরিবর্তনের নিয়ম বলে ধরে নিয়েছিল। পরিবর্তনের এই নিয়মগুলো বলতে একটা বিশেষ অবস্থায় বস্তুগুলি কী করে আন্দোলিত হয় এবং ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা গণনা করে বলতে আমাদের সক্ষম করে। কিন্তু এগুলো শুধুমাত্র এটা বলে না যে, যা ঘটেছে তা ঘটবে। আমরা জানি যে, বহুদিন ধরে সূর্য উদিত হতে থাকবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত বস্তুগুলির সংঘর্ষের কারণে এটা আর ঘটবে না। যে-নিয়মগুলোর কারণে সূর্য উঠছে সেই একই নিয়মের জন্য সূর্য আর উঠবে না। মধ্যযুগীয় মানসিকতায় এই ধরনের ধারণা অসম্ভব ছিল। ওই মানসিকতা কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে বুঝতে পারত পুনঃ পুনঃ সংগঠিত হবার কারণে। যা কিছু অস্বাভাবিক অথবা পুনঃ পুনঃ সঙ্ঘটনশীল নয় তাকে তারা প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলেই নির্দিষ্ট করত এবং প্রাকৃতিক নিয়মের কারণে এগুলো ঘটে বলে বিবেচনা করত না।
মহাশূন্যে প্রায় সবকিছুই নিয়মাধীন। একটা সময় গ্রহগুলিকে নিয়মের ব্যতিক্রম বলে ধরা হত এবং কুসংস্কারগ্রস্ত আতঙ্ক জাগিয়ে তুলত। কিন্তু ব্যাবিলনের যাজকদের দ্বারা এটি একটি নিয়মে পর্যবসিত হয়েছিল। সূর্য এবং চন্দ্র, গ্রহসমূহ এবং স্থির নক্ষত্রগুলো বছরের পর বছর ধরে ঘুরত এবং প্রত্যাশা মতো কাজ করত। নতুন কোনো কিছুকেই পর্যবেক্ষণ করা হত না। এবং সুপরিচিতদেরও বয়স বাড়ত না। এই মনোভাব অনুযায়ী এটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপরে অবস্থিত সবকিছুই মাত্র একবারের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং সেটা করা হয়েছে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী। ক্রমবৃদ্ধি ঘটা এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া এটা আমাদের পৃথিবীর জন্যই সীমাবদ্ধ। এটা আমাদের আদি পিতা-মাতার কৃত পাপের অংশবিশেষ। সেইজন্য উল্কাপিণ্ড এবং ধূমকেতুরা যারা অচিরস্থায়ী তাদের অবস্থান অবশ্যই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে, চাঁদের ঠিক নিচে। এটা যেন চন্দ্রাবস্থানের নিচে। উল্কাপিণ্ড সম্বন্ধে এই দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক ছিল। কিন্তু ধূমকেতু সম্বন্ধে এটি সঠিক ছিল না। ধর্মতত্ত্ববিদেরা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে এই দুটি মতকে মেনে চলত যে, ধূমকেতুরা দূর্লক্ষণ এবং তারা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতরেই অবস্থিত। পুরাকাল থেকে ধূমকেতুদের সবসময়ই বিপর্যয়ের বার্তাবাহক বলে মেনে নেওয়া হত। এই মতটি শেক্সপীয়ারের দ্বারাও স্বীকৃত হয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ ‘জুলিয়াস সীজার’ আর পঞ্চম হেনরি’র নাটকের উল্লেখ করা যায়। তৃতীয় ক্যালিক্সটাস যিনি ১৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৫৮ খ্রিষ্টাব্দ অবধি পোপের পদে আসীন ছিলেন, তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তুর্কিদের দ্বারা কনস্ট্যান্টিনোপল দখলের ঘটনায়। এই বিপর্যয়কে একটা বিশাল ধূমকেতুর আবির্ভাবের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। পোপ প্রার্থনা করার আদেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যা কিছু আসন্ন দুর্যোগ সেসব খ্রিষ্টানদের দিক থেকে তুর্কিদের দিকে ঘুরে যাবে। এবং এই প্রার্থনা সংগীতের সঙ্গে আরও একটু যোগ করা হয়েছিল, “হে মহান ঈশ্বর, ওই ধূমকেতু আর তুর্কিদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করুন। ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে ক্রামার অষ্টম হেনরিকে লিখতে গিয়ে সেইসময় দৃশ্যমান একটি ধূমকেতু সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, এই প্রতীকগুলো এরপর কি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটাবে তা কেবল ঈশ্বরই জানেন। কারণ এই প্রতীকগুলো হালকাভাবে আবির্ভূত না হয়ে কতিপয় বিরাগ ঘটনায় প্রেক্ষিতে ঘটেছে। ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে যখন একটি অস্বাভাবিক আশঙ্কাজনক ধূমকেতুর আবিভাব ঘটেছিল তখন একজন বিশিষ্ট স্কটিশ ধর্ম-উপদেষ্টা প্রশংসনীয় জাতীয়তাবাদের আবেগে ঘোষণা করেছিলেন যে, ধূমকেতুগুলো এই দেশে আমাদের পাপের জন্য মহান বিচারের অত্যাশ্চর্য এবং অসাধারণ নির্দশন। কারণ এর আগে কখনো ঈশ্বর এই দেশের মানুষের উপর এত প্ররোচিত হননি। এ-ব্যাপারে তিনি খুব সম্ভবত অজ্ঞানতাবশত লুথারের নজিরকেই অনুসরণ করেন যিনি ঘোষণা করেছিলেন, ধর্মহীন বর্ববেরা লিখছে যে, ধূমকেতু প্রাকৃতিক কারণে আবির্ভূত হয়। কিন্তু ঈশ্বর এমন কিছুই সৃষ্টি করেন না যেটি নিশ্চিত দুর্যোগকে সূচিত করে না।
ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টান্টদের অন্যান্য বিষয় নিয়ে যা কিছু পার্থক্য থাকুক না কেন ধূমকেতুর ব্যাপারে তারা একই মত পোষণ করত। ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপকদের একটি শপথ নিতে হত যা ছিল ধূমকেতু সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক ধারণার পক্ষে অসংগত। রোমের ক্লেমেনটাইন কলেজের রেকটর ফাদার অগাস্টিন ডে এ্যাঞ্জেলিস ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আবহাওয়াবিজ্ঞানের ওপর একটি বই প্রকাশনা করেছিলেন। ঘটনাক্রমে তিনি বলেছিলেন যে, ধূমকেতুগুলি কোনো স্বর্গীয় বস্তু নয়, এগুলি চাঁদের নিচে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেই উৎপন্ন হয়। যা কিছু স্বর্গীয় তা অসীম ও নিষ্কলুষ কিন্তু ধূমকেতুদের একটা শুরু আছে এবং শেষ আছে। অতএব ধূমকেতুরা স্বর্গীয় বস্তু হতে পারে না।’ টাইকো ব্রাহেকে অগ্রাহ্য করে এটা বলা হয়েছিল। টাইকো ব্রাহে পরবর্তীকালে কেপলারের সমর্থনে বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য প্রচুর কারণ দর্শিয়েছিলেন। একটি কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল যে, ১৫৭৭ সালের ধূমকেতুটি চাঁদের উপরে ছিল। ফাদার অগাস্টিন ধূমকেতুর অস্থির বিচলন সম্পর্কে এই মত দিয়েছিলেন যে, ধূমকেতুগুলির দ্বারা এই ধরনের কাজ করানোর জন্য দেবদূতরা স্বর্গীয় নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন।
র্যালফ থেরেসবি এফ. আর.এস. যিনি প্রকৃত অর্থে একজন ব্রিটেনের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর ডায়েরিতে আপোস মীমাংসার মূল নীতির বিষয়ে একটি উল্লেখ আছে। ১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দে হ্যাঁলির ধূমকেতু আবির্ভূত হয়েছিল এবং সর্বপ্রথম ওই ধূমকেতুর কক্ষপথকে গণনা করা সম্ভব হয়েছিল। তখনই থোরেসবি লিখেছিলেন, “ঈশ্বর যে-কোনো পরিবর্তনের জন্য আমাদের উপযুক্ত করুন। যদিও আমি এ ব্যাপারে অজ্ঞ নই যে, ওই ধরনের ধূমকেতুরা প্রাকৃতিক কারণেই উদ্ভূত হয়ে থাকে, তবুও তারা প্রায়শই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।
তিনজন মানুষের জন্য এটা শেষমেষ প্রমাণিত হয়েছিল যে, ধূমকেতুরা প্রাকৃতিক নিয়মেরই একটি বিষয় এবং এরা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে থাকে না। ডোয়েরফেল নামে সুইজারল্যান্ডের একজন অধিবাসী প্রমাণ করেছিলেন যে, ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ধূমকেতুর কক্ষপথ বলে যা ধরা হত তা ছিল মোটামুটিভাবে একটি উপবৃত্তের মতো। হ্যাঁলির নামে নামাঙ্কিত ১৬৮২ সালের ধূমকেতুটি কনস্টান্টিনোপলের পতনে ১০৬৬ সালে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এটি সম্পর্কে হ্যাঁলি বলেছিলেন যে, এর কক্ষপথ একটি ঝুলন্ত উপবৃত্ত। ১৬৮৭ সালে নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’ দেখালো যে, ধূমকেতুর গতির ব্যাখ্যায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যতটা সন্তোষজনক ছিল, গ্রহদের গতির ক্ষেত্রেও ব্যাখ্যাটি একই রকম সন্তোষজনক। ধর্মতাত্ত্বিকরা যারা অশুভ ঘটনার পূর্বাভাস প্রত্যাশা করতেন, তারা ভূমিকম্প এবং অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলেন। এসব ঘটনা কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের নয়, একটি পৃথক বিজ্ঞানের বিষয়। সেটি হলো ভূবিজ্ঞান, যেটি • পরে বিকশিত হয়েছে। এই ভূবিজ্ঞানেরও অজ্ঞতার-যুগ-থেকে প্রাপ্ত ধর্মীয় আপ্তবাক্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নিজস্ব যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।
——-
১. উদাহরণস্বরূপ, জিওর্দানো ব্রুনো, ধর্মীয় বিচারে সাত বছর কারাগারে যাকে বন্দি করে রাখার পর ১৬০০ সালে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
২. অথবা সম্ভবত অন্যান্য গুণাবলী, কারণ সম্রাট তাঁর জ্যোতিষবিদ্যাগত পরিষেবাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
৩. উদাহরণস্বরূপ, ফাদার ক্ল্যাভিয়াস বলেছিলেন যে, ‘জুপিটারের চারটি উপগ্রহকে দেখতে হলে মানুষকে এমন যন্ত্র আবিষ্কার করতে হবে যা এই উপগ্রহগুলোকে সৃষ্টি করবে।’–White এর Warfare of Science with Theology. প্রথম খণ্ড, ১৩২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।