কোনো পরিবারে একজন কেউ কানে কম শুনলে বাকি সবাই জোরে কথা বলে। আনিকাদের বাড়ির কেউই কানে কম শোনে না, তারপরেও সবাই জোরে কথা বলে। মনে হয় এ বাড়ির লোকজন সবাই সারাক্ষণ ঝগড়া করছে।
শওকত আনিকার কাছে এসেছে। সে বসেছে বারান্দায় পেতে রাখা চৌকিতে। কলাবাগানে মোটামুটি আধুনিক একটি ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় তোষকবিহীন চৌকি পেতে রাখা সাহসের ব্যাপার। আনিকাদের সে সাহস আছে। চৌকিটা বাড়তি বিছানা হিসেবে কাজ করে। হঠাৎ কোনো অতিথি এসে পড়লে চৌকিতে ঘুমুতে দেয়া হয়। পরিবারের কোনো সদস্য রাগ করলে এই চৌকিতে ঝিম ধরে বসে থাকে। আনিকা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমাদের এই চৌকিটার নাম রাগ-চৌকি। তুমি যদি কখনো রাত দুটা-তিনটার সময় আসো, তাহলে দেখবে কেউ না কেউ রাগ করে চৌকিতে বসে আছে। শওকত বলেছিল, দুজন যদি একসঙ্গে রাগ করে, তখন কী হয়? দুজন পাশাপাশি বসে থাকে?
আনিকা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তোমার কি ধারণা বাড়িতে আমরা সব সময় ঝগড়া করি? আমাদের সম্পর্কে তোমার এত খারাপ ধারণা?
তাদের সম্পর্কে শওকতের ধারণা খুব যে উঁচু তা না। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। ছুটির দিনে সবার মন-মেজাজ ফুরফুরে থাকার কথা। অথচ শওকত আধঘণ্টা বসে থেকে চড়-থাপ্পড়ের শব্দ শুনেছে। কান্নার শব্দ শুনেছে। আনিকার বাবার গর্জন কিছুক্ষণ পরপরই শোনা যাচ্ছে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব! আমি অবশ্যই তোকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব! যাকে পুঁতে ফেলার কথা বলা হচ্ছে, তার নাম মিতু। আনিকার ছোটবোন। মিতু এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। গত পরশু রাতে সে বাসায় ফিরে নি। বান্ধবীর জন্মদিনের কথা বলে বান্ধবীর বাসায় থেকে গেছে। পরদিন জানা গেছে বান্ধবীর জন্মদিন ছিল না। বান্ধবীর বাসায় মিতু থাকে নি।
অপরাধ অবশ্যই গুরুতর। শওকত অবাক হয়ে দেখল, কিছুক্ষণের মধ্যে সব স্বাভাবিক। আনিকার বাবা মতিয়ুর রহমান টিভি ছেড়েছেন। সেখানে তারা চ্যানেলে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখাচ্ছে। তিনি আগ্রহ নিয়ে স্ত্রীকে ছবি দেখার জন্যে ডাকছেন। এই ভদ্রলোক একা কোনো ছবি দেখতে পারেন না। ছবি দেখার সময় তার আশেপাশে সবসময় কাউকে না কাউকে লাগে। এক সময় দর্শকের সন্ধানে তিনি বারান্দায় উঁকি দিয়ে শওকতকে দেখে বললেন, তুমি কখন এসেছ?
শওকত উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বেশিক্ষণ হয় নি।
তুমি চুপি চুপি বারান্দায় এসে বসে থাকবে এটা কেমন কথা! তোমাকে চা-টা দিয়েছে?
জি।
আনিকার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
জি দেখা হয়েছে। ও আমাকে নিয়ে কোথায় যেন যাবে— এই জন্যে খবর দিয়েছে। মনে হয় তৈরি হচ্ছে।
মতিয়ুর রহমান বললেন, মেয়েদের তৈরি হওয়া তো সহজ ব্যাপার না। ঘণ্টা দুই লাগবে। এই ফাঁকে এসো একটা ছবি দেখে ফেলি। উত্তম-সুচিত্রার ছবি। আগে দেখছ নিশ্চয়ই। সাগরিকা।
চাচা, ছবি দেখব না।
কিছুক্ষণ দেখ। একা ছবি দেখে মজা নাই। আনিকার সাজ শেষ করে বের হতে দেরি আছে। আমার মেয়েদের আমি চিনি না! এদেরকে হাড় মাংসে চিনি।
শওকত ছবি দেখতে বসল। মতিয়ুর রহমান ছবি দেখতে দেখতে ক্রমাগত কথা বলতে থাকলেন।
মিতুর ঘটনা শুনেছ?
জি-না।
অতি হারামি মেয়ে। বান্ধবীর জন্মদিন। রাতে বান্ধবীর সঙ্গে না থাকলে বান্ধবী না-কি কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাবে। তারপর কী হয়েছে শোন। কাজী নজরুলের কবিতা পড়বি পর মালীর ঘাড়ে সে ছিল গাছের আড়ে। সেই বান্ধবী সকালে বাসায় উপস্থিত। আমি বললাম, মা, জন্মদিন কেমন হলো? সেই মেয়ে অবাক হয়ে বলল, কিসের জন্মদিন চাচা? এইদিকে মিতু আবার চোখ ইশারা করতে করতে বলছে— তোর জন্মদিনের কথা হচ্ছে। ঐ যে কালরাত সবাই মিলে তোর বাসায় সারারাত হৈচৈ করলাম। মিতুর বান্ধবী গেল আরো হকচকিয়ে। সে একবার আমার দিকে তাকায়, একবার মিতুর দিকে তাকায়। বুঝেছ শওকত, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কোনো কিছুই ঠিকমতো পারে না। একটা মিথ্যা পর্যন্ত গুছিয়ে বলতে পারে না। মিতুকে প্রিলিমিনারি একটা ক্যাচা দিয়েছি। রাতে আরো একডোজ ওষুধ পড়বে। তার খবর আছে।
উত্তম-সুচত্রার সাগরিক অনেকখানি দেখে শওকত বের হলো। আনিকা মোটামুটি কঠিন টাইপ সাজ করেছে। তাকে দেখে শওকতের মায়া লাগছে। সাজলে এই মেয়েটাকে ভালো লাগে না। কোনোরকম সাজসজ্জা ছাড়া সে যখন সাধারণভাবে থাকে, তখন তার চেহারায় মিষ্টি মায়া ভাব থাকে। সাজলে সেটা থাকে না। চেহারা রুক্ষ হয়ে যায়। বয়স্ক মা-খালা ধরনের মহিলা মনে হয়। আনিকার এমন কিছু বয়স হয় নি। ত্রিশ বছর অবশ্যি হয়ে গেছে। একটি কুমারী মেয়ের ত্রিশ বছর তেমন বয়স না। অথচ এই মেয়েটাকে দেখে মনে হয় দ্রুত তার বয়স বাড়ছে। মাথার চুল পড়তে শুরু করেছে।
শওকত বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আনিকা বলল, আমার সাজসজ্জা দেখে বুঝতে পারছ না কোথায় যাচ্ছি?
না, বুঝতে পারছি না।
আমার সাজ কেমন হয়েছে?
খারাপ না— একটু শুধু কটকটা হয়েছে।
কটকটা মানে কী?
হাওয়াই মিঠাই টাইপ।
আনিকা আহত গলায় বলল, আমি যত সুন্দর করেই সাজি না কেন–তুমি সবসময় বলো, কটকটা। তুমি কি চাও আমি বিধবাদের কাপড় পরি? সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ?
তোমার যা পছন্দ তাই পরবে।
আনিকা বলল, আজ রিকশায় উঠব না। এসি আছে এমন কোনো ইয়োলো ক্যাব নাও।
শওকত বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
আনিকা বলল, মগবাজারে যাচ্ছি।
কোনো বিয়ের দাওয়াত?
আনিকা কঠিন গলায় বলল, বিয়ের দাওয়াত-ফাওয়াত না। আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। মগবাজার কাজি অফিসে যাব।
শওকত বলল, ঠাট্টা করছ?
আনিকা বলল, ঠাট্টা করব কেন? তুমি তো জানো আমি ঠাট্টা করার মেয়ে। তোমার পাল্লায় পড়ে আমি অনেক দিন ঘুরেছি। আমার আর ভালো লাগছে। হয় তুমি আজকে আমাকে বিয়ে করবে; আর যদি তা না হয়, বিয়ে করতে কখনো বলব না। আমার নিজেকে সিন্দাবাদের ভূত বলে মনে হয়। তোমার ঘাড়ে চেপে আছি। তুমি যতই ফেলতে চাচ্ছ, আমি ততই কাঁচকি মেরে বসছি।
শওকত হাসল। আনিকা বলল, এভাবে হাসবে না। আমি হাসির কোনো কথা বলছি না। দাঁড়িয়ে আছ কেন? ট্যাক্সি আন। এসি আছে এমন গাড়ি আনবে। আজ কেন জানি আমার খুব গরম লাগছে। হাঁসফাঁস লাগছে।
ট্যাক্সিতে উঠে আনিকা সত্যি সত্যি ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, মগবাজার যাবেন? মগবাজার কাজি অফিস। চিনেন না?
ট্যাক্সিওয়ালা বলল, চিনি।
আনিকা বলল, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা আপনার ট্যাক্সিটা ভাড়া করতে চাই। ঘণ্টায় এত রেট এ ধরনের ফালতু অ্যারেঞ্জমেন্টে আমি যাব না। সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত থাকবেন। কত নিবেন বলেন। প্যাকেজ ডিল।
এক হাজার টাকা দেন।
পাঁচশ পাবেন। চিন্তা করে দেখেন। বখশিশ আলাদা দেব। এক্ষুণি জবাব দিতে হবে না। মগবাজার কাজি অফিসে যেতে যেতে চিন্তা করেন।
শওকত বলল, আমরা কি সত্যি সত্যি কাজি অফিসে যাচ্ছি?
আনিকা ক্লান্ত গলায় বলল,। তোমার কি অসুবিধা আছে? বিয়ের কথা তো অনেক দিন থেকেই বলছ। সামনের বছর বিয়ে। এই শীতে না, পরের শীতে। এই করে করে সাত বছর পার করেছ। আর কত?
শওকত বলল, একটা সিগারেট ধরাই?
ধরাও। ড্রাইভার সাহেব গাড়ির কাচ নামিয়ে দিন। আর আপনি চিন্তাভাবনা করছেন তো? আমি আরো একশ বাড়িয়ে দিলাম। ছয়শ।
শওকত সিগারেট টানছে। তারা কাজি অফিসে যাচ্ছে এই নিয়ে সে খুব যে চিন্তিত তা না। এক্ষুণি বিয়ে করতে হবে— এরকম একটা ঝোকের ভেতর দিয়ে আনিকা প্রায়ই যায়। ঝোক কেটেও যায়। আজকেও নিশ্চয়ই সে-রকম কিছু হবে। তবে ট্যাক্সি নিয়ে কাজি অফিসের দিকে রওনা দেয়াটা বাড়াবাড়ি। একে ঝোঁক বলা ঠিক হচ্ছে না।
আনিকা বলল, তুমি কথা বলছ না কেন?
চিন্তা করছি।
আও বিয়ে করার ব্যাপারে তোমার আপত্তি আছে? আজ শুভদিন। শুক্রবার। অক্টোবরের তিন তারিখ। ১৩ আশ্বিন।
শওকত বলল, বিয়ের মতো বড় ব্যাপারে প্রিপারেশন লাগবে না?
আশিক। বলল, তুমি তো সাত বছর ধরেই প্রিপারেশন নিচ্ছ। আরো প্রিপারেশন লাগবে?
শওকত বলল, বিয়ের পর তুমি কি আমার এখানে উঠবে?
আনিকা বলল, তোমার বাসায় আমি কীভাবে উঠব? বাবার এক পয়সা। রোজগার নেই। পুরো সংসার চলছে আমার টাকায়।
শওকত বলল, তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে–বিয়ের পর তুমি তোমার বাসায় থাকবে। আমি আমার বাসায়।
আনিকা বলল, তুমি আমার বাসায় উঠে আসবে। আমি একটা আলাদা ঘর নিয়ে থাকি তুমি আমার ঘরে থাকবে। কিছুদিন পর মিতুর বিয়ে হয়ে যাবে। তখন মিতুর ঘরটায় তুমি তোমার ছবি আঁকার জিনিসপত্র রাখবে।
ঘরজামাই হবো?
আমরা মেয়েরা যদি ঘরবউ হতে পারি, তোমাদের ঘরজামাই হতে অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নেই।
সিগারেট তো শেষ হয়ে গেছে, হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?
শওকত সিগারেট ফেলে দিতে দিতে বলল, তোমাকে একটা খবর দিতে চাচ্ছি।
কী খবর দেবে?
আমার ছেলে এসেছে ঢাকায়। সে কয়েক দিন আমার সঙ্গে থাকবে। আমার সঙ্গে জন্মদিন করবে।
ছেলে নিশ্চয়ই একা আসে নি। ছেলের মাও এসেছেন। তিনিও কি ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে তোমার সঙ্গে থাকবেন?
ছেলের মা অন্য একজনের স্ত্রী।
তাতে কী হয়েছে? পাকা রঙ এত সহজে যায় না। বাবা-মা দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছেলে জন্মদিনের কেক কাটবে। বাবা-মা একসঙ্গে সুর করে গাইবে— হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। তারপর তারা নিজেদের দিকে তাকিয়ে লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে হাসবে। সেই হাসির ছবি তোলা হবে।
ট্যাক্সি মগবাজার কাজি অফিসের সামনে থামল। ড্রাইভার জানাল সে ছয়শ টাকাতে রাজি আছে। শুধু বখশিশের পরিমাণ যেন বাড়িয়ে দেয়া হয়।
আনিকা বলল, বখশিশ নির্ভর করবে ভালো ব্যবহারের উপর। আপনি মাই ডিয়ার ব্যবহার করবেন, আমি আপনার বখশিশ বাড়িয়ে দেব। এখন আপনি যান, এককাপ চা খেয়ে আসুন। গাড়ি চালু রেখে যান। আপনার ঠাণ্ডা গাড়িতে বসে এই লোকের সঙ্গে কিছুক্ষণ ঝগড়া করব। আমাদের ঝগড়া আপনাকে শোনাতে চাই না।
শওকত গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল, করো ঝগড়া করো।
আনিকা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাক ঝগড়া করব না। তোমার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে আজ থেকে আমি একজন সেকেন্ডহ্যান্ড হাজবেন্ডের সন্ধানে বের হবো।
সেকেন্ডহ্যান্ড?
আনিকা বলল, অবশ্যই সেকেন্ডহ্যান্ড। আমার কপাল হলো সেকেন্ডহ্যান্ডের। আমার যখন সতেরো বছর বয়স, তখন বিয়ের যে প্রপোজল এলো সেই পাত্র সেকেন্ডহ্যান্ড। স্ত্রী মারা গেছে। বিরাট বড়লোক। তুমি চিন্তাই করতে পারবে না সেই সেকেন্ডহ্যান্ডওয়ালার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে সবার সে কী চাপাচাপি! তারপর আরেকটা প্রপোজল এলো। ছেলে ইতালিতে থাকে। বিয়ে যখন প্রায় হয় হয় অবস্থা, তখন জানা গেল ছেলে কাগজপত্রের জন্যে জার্মান এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এক বছর তারা ছিল এক সঙ্গে। সেই পাত্রও বাবার পছন্দ। বাবা বললেন, প্রয়োজনে সে জার্মান বিয়ে করেছে। শখের বিয়ে তো না। সমস্যা কী? শেষমেষ সেকেন্ডহ্যান্ড আধবুড়ো তুমি উদয় হলে। আমি বুড়োর প্রেমে হাবুড়ুবু ও আমার জানরে, ও আমার পাখিরে অবস্থা।
শওকত বলল, আনিকা তোমার কি জ্বর না-কি?
আনিকা বলল, আমার কথাবার্তা কি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার মতো শোনাচ্ছে?
চোখ লাল, এই জন্যে বলছি।
গায়ে হাত দিয়ে দেখ জ্বর কি-না। তোমার সঙ্গে আমি যে আচরণ করি, তা মোটামুটি বেশ্যামেয়েদের মতোই। বেশ্যামেয়ের গায়ে যে-কোনো সময় হাত দেয়া যায়।
শওকত বলল, তোমার জ্বর। বেশ ভালো জ্বর। বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাক।
আনিকা বলল, আমি দুটা পর্যন্ত ক্যাব ভাড়া করেছি। ছটা পর্যন্ত ক্যাব নিয়ে ঘুরব। একা একা ঘুরব।
একা একা?
দোকা কোথায় পাব? একা একাই ঘুরব। বাসায় আমি ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারি না। মাঝে মাঝে বাইরে বের হই নিঃশ্বাস নেবার জন্যে। এখন তুমি যদি কিছু মনে না কর, তোমাকে একটা অনুরোধ করব।
করো অনুরোধ।
গাড়ি থেকে নেমে যাও। আমি চাচ্ছি না তুমি আমার সঙ্গে থাক।
ছটা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে থাকতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি জানো আমি এমন কোনো ব্যস্ত মানুষ না।
আনিকা বলল, তোমার সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। প্লিজ নেমে যাও।
শওকত গাড়ি থেকে নেমে গেল।
ড্রাইভার বলল, আপা কোথায় যাব?
আনিকা বলল, আমার শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ। আমাকে বারবার প্রশ্ন করে বিরক্ত করবেন না। আপনাকে তো বলেছি সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে ঘুরবেন।
শহরের বাইরে যাব আপা?
বাইরে মানে কোথায়?
গাজীপুর শালবন। কিংবা বিশ্বরোড ধরে কুমিল্লার দিকে যেতে পারি।
শহরের ভেতর ঘুরতে আপনার অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নেই। শহরের ভেতরে যানজট। গাড়ি নিয়ে বসে থাকতে RI
আপনার যেখানে ইচ্ছা যান। ছটার সময় বাসায় পৌছলেই হবে। আমার বাসা কলাবাগানে।
আনিকা চোখ বন্ধ করল। তার শরীর হঠাৎ করেই বেশ খারাপ করছে। বুকের ভেতর ধ্বক ধ্বক শব্দ। নিঃশ্বাসে কষ্ট। নিঃশ্বাসের এই কষ্ট যখন হয়, তখন খুব পানির তৃষ্ণা হয় অথচ পানি খেতে গেলে বমির মতো আসে। আনিকার ধারণা তার বড় ধরনের কোনো হার্টের অসুখ হয়েছে। মেয়েদের জন্যে হার্টের অসুখ খুব খারাপ। হার্ট দুর্বল মেয়েরা বাচ্চা নিতে পারে না। আনিকার এক বান্ধবীর (শারমিন) হার্টের অসুখ ছিল। ডাক্তাররা তাকে বাচ্চা নিতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। শারমিন এখন অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানে তার বাচ্চা হয়েছে কি-না কে জানে! হবার কথা। অস্ট্রেলিয়ায় বড় বড় ডাক্তার আছে। তারা নিশ্চয়ই শারমিনের হার্ট ঠিক করে ফেলেছে।
আনিকার খুব বাচ্চার শখ। শখটা বাড়াবাড়ি রকমের বলেই তার ধারণা এই শখ কোনোদিন মিটবে না। এই পর্যন্ত তার একটি শখও মিটে নি। বড় বড় শখ তো অনেক পরের ব্যাপার, ছোটখাটো শখও মিটে নি। স্কুল থেকে একবার ঠিক করা হলো সবাই মিলে ময়নামতিতে যাবে। বেশি দূর তো না। ঢাকা থেকে দুঘণ্টা মাত্র লাগে। সে সত্তর টাকা চাদাও দিয়েছিল। যেদিন যাবার কথা, তার আগের রাতে উত্তেজনায় সে ঘুমাতে পর্যন্ত পারে নি। সারারাত ধরে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন। যেমন সে কাপড় খুঁজে পাচ্ছে না। সকাল নটার মধ্যে স্কুলে উপস্থিত হবার কথা। নটা বাজতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। যখন অতি সাধারণ একটা জামা পরে বের হলো, তখন ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে। সে স্কুলে যাবার জন্যে কোনো রিকশা পাচ্ছে না। কারণ সেদিনই রিকশা হরতাল দেয়া হয়েছে। গাড়ি ঠিকই চলছে, শুধু রিকশা নেই।
ময়নামতি যাওয়া শেষপর্যন্ত হয় নি। আনিকার বাবা সকালে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হুঙ্কার দিলেন কিসের শিক্ষা সফর! এইসব ফাজলামি আমি জানি। শিক্ষা সফরের নামে যেটা হয়, তাকে বলে কুশিক্ষা সফর। কোথাও যেতে হবে না। ঘরে বসে টিভি দেখ।
সামান্য ময়নামতি যাবার শখ যেখানে মেটে না, সেখানে নিজের বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করার শখও তার মিটবে না। অথচ সে বাচ্চার নাম পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছে। ডাক নাম। ভালো নাম রাখবে ছেলের বাবা। ডাক নাম হচ্ছে— ছেলে হলে ক। মেয়ে হলে আ। কেউ যখন ছেলেকে জিজ্ঞেস করবে, বাবা, তোমার নাম কী? ছেলে গাল ফুলিয়ে বলবে, আমার নাম ক?
তোমার নাম কি? শুধু ক?
হ্যাঁ।
এই নাম কে রেখেছে?
আমার মা রেখেছেন।
তোমার কি আরো ভাইবোন আছে?
আমরা তিন ভাইবোন। আমার আরো দুটা বোন আছে।
ওদের নাম কী?
একজনের নাম অ, আরেকজনের নাম আ।
আনিকা ঠিক করে রেখেছে তার তিনটা ছেলেমেয়ে হবে। তিন খুবই লাকি নাম্বার। ছেলেমেয়েরা তিনজন আর তারা দুজন। সব মিলিয়ে পাঁচজন। পাঁচও লাকি নাম্বার।
আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি থামল। আনিকা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। সে চোখ মেলল। ফাঁকা অচেনা রাস্তা। মনে হচ্ছে শহর থেকে তারা অনেকদূরে চলে এসেছে।
আনিকা বলল, আমরা কোথায়?
ড্রাইভার বলল, আশুলিয়ায়।
আনিকা বলল, সেটা আবার কোন জায়গা?
উত্তরার কাছে। ভালো ভালো চটপটির দোকান আছে। আপা, চটপটি খাবেন?
আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, না। চটপটি খাব না। আমি চটপটি খাওয়া টাইপ মেয়ে না।
ড্রাইভার বলল, আপা, আপনারে একটা কথা বলি, কিছু মনে নিয়েন না।
আনিকা জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার ধারণা জ্বর আরো বেড়েছে। তার উচিত বাসায় ফিরে সিটামল টাইপ কোনো ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়া। জ্বর কমাতে হবে। কাল সকাল নটা থেকে অফিস। অফিস কামাই দেয়া যাবে না। ক্যাজুয়েল লিভ পাওনা নেই। সেকশান অফিসার সিদ্দিক সাহেব তাকে ভালো চোখে দেখেন না। সারাক্ষণ চেষ্টা কীভাবে ভুল ধরবেন। কয়েক দিন আগে জ্যামে পড়ে অফিসে যেতে এক ঘণ্টা দেরি হয়েছে, সিদ্দিক সাহেব বলেছেন, আরে ম্যাডাম, আজ যে এত সকালে! লাঞ্চ করে এসেছেন তাই না? ভেরি গুড। নেক্সটটাইম শুধু লাঞ্চ করে আসবেন না, লাঞ্চের শেষে ঘুম দিয়ে আসবেন। দুপুরের ঘুম স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো।
ড্রাইভার বলল, আপা, আপনাদের বিয়েটা হয় নাই?
আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, না।
ড্রাইভার বলল, পুরুষজাতের কোনো বিশ্বাস নাই। পুরুষজাত বিরাট হারামি। আমিও হারামি। আমার জীবনেও এইরকম ঘটনা আছে।
আনিকা বলল, আপনার জীবনের ঘটনা শুনতে চাচ্ছি না। আপনি গাড়ি চালান। গাড়ি চালানোর সময় এত কথা বলেন কেন?
আপা, গান দিব?
গান দিতে হবে না। আপনি বরং ফিরে চলুন। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
লেকের ধারে নামবেন না?
আনিকা বলল, না। আমি লেক-ফেক দেখি না। আমার এত শখ নাই।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরাল। আনিকা বাসায় ফিরছে— এটা ভাবতে তার নিজের কাছে খারাপ লাগছে। ঝগড়া খেচাখেচির মধ্যে পড়তে হবে। এর মধ্যে আবার সিনেমাও দেখা হবে। তার বাবা সিনেমায় গানের দৃশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে তাল দেবেন। দেখে মনে হবে সঙ্গীতের বিরাট ওস্তাদ বসে আছেন। ওস্তাদ মতিয়ুর রহমান খান।
বাসায় না ফিরে অন্য কোথাও গেলে কেমন হয়? শওকতের বাসায় হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তাকে চমকে দেয়া যায়। শওকত দরজা খুললেই সে বলবে, আমার খুব জ্বর। আজ আমি তোমার বাসায় থাকব। তুমি আমার সেবা করবে। মাথায় জলপট্টি দেবে। শওকত হকচকিয়ে বলবে, কী বলো পাগলের মতো! রাতে আমার এখানে থাকবে মানে?
আনিকা সহজ গলায় বলবে, স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে থাকবে, এতে সমস্যা কী?
শওকত আরো অবাক হয়ে বলবে, স্ত্রী মানে? তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে কখন হলো?
আনিকা বলবে, আজই তো বিয়ে হলো। মগবাজার কাজি অফিসে বিয়ে হলো। না-কি হয় নি? তাহলে বোধহয় জ্বরের ঘোরে এইসব মনে হচ্ছে। সরি। আমি চলে যাচ্ছি।
এরকম মজার নাটক আনিকার মাঝে-মাঝে করতে ইচ্ছা করে। অবশ্যি সে কখনোই করে না। সে ইচ্ছা-সুখ মেয়ে না। ইচ্ছা-সুখ হলো— যা করতে ইচ্ছা করে সেটা করে সুখ পাওয়া। আনিকা হলো ইচ্ছা-অসুখ মেয়ে। যা করতে ইচ্ছা করে তা না করতে পেরে অসুখী হওয়া।
শওকতের বাড়িতে যাবার প্রশ্নই আসে না। তার উচিত প্রাণপণে শওকতকে ভুলে থাকার চেষ্টা করা। সে এমন কিছু না যে তাকে ভেবে সারাক্ষণ কষ্ট পেতে হবে। মানুষটার বয়স হয়েছে পঞ্চাশ। বাংলাদেশের মানুষদের গড় আয়ু চল্লিশ। সেই হিসেবে সে দশ বছর বেশি বেঁচে ফেলেছে। তার ঘণ্টা বেজে গেছে। যেকোনো সময় ফুড়ৎ। প্রাণপাখি উড়ে যাবে। প্রাণপাখি নিয়ে সুন্দর একটা গানও আছে–
উড়িয়া যায়রে প্রাণপাখি তিন দরজা দিয়া
খবর আইছে প্রাণপাখির আইজ সইন্ধ্যায় বিয়া॥
মানুষটার প্রাণপাখি তিন দরজা দিয়ে বের হয়ে বিয়ে করতে যাবে। তখন আনিকার কী হবে! সে বিধবাদের সাদা শাড়ি পরে অন্য কোনো সেকেন্ডহ্যান্ড পুরুষের সন্ধানে বের হবে? তার জীবন কেটে যাবে সন্ধানে সন্ধানে? সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ড হ্যান্ড, ফোর্থ হ্যান্ড।
শওকতের টাকা-পয়সাও নেই। ঘরে টিভি নেই। গান শোনার যন্ত্র নেই। শোবার ঘরে একটা ফ্যান আছে, সেখান থেকে সারাক্ষণ কটকট ঘটঘট শব্দ হয়। মিস্ত্রি ডাকিয়ে ফ্যান সারাবে— সেই পয়সাও হয়তো তার নেই।
মানুষটার বাসা ভাড়া করার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। অন্যের বাসায় থাকে। ঠিক অন্যের বাসাও না— তার মামার বাসা। মামা-মামি থাকেন দেশের বাইরে। তারা শ্যামলীতে সাত কাঠা জায়গা কিনে দুই কামরার টিনের একটা হাফ বিল্ডিং বানিয়ে শওকতকে পাহারাদার হিসেবে রেখে দিয়েছেন। যেন জমি অন্য কেউ দখল নিতে না পারে। মামা-মামি দেশে ফিরে এই জমিতে বাড়ি করবেন। তারা যে-কোনো দিন দেশে চলে আসবেন। তখন শওকতের কী হবে? মামা-মামি অবশ্যই গলাধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেবে। সে যাবে কোথায়? কাক-বকগাছপালা এঁকে কি কোনো মানুষ জীবন চালাতে পারে? শওকত একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে একটানে একটা ছাগল এঁকে ফেলতে পারে। তাতে লাভ কী? ছাগল আঁকার দরকারটাই বা কী! ক্যামেরায় ছাগলের ছবি তুললেই হয়।
অনেকদিন পর তার ছেলেটা তার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে। ভালো-মন্দ কিছু যে সে এই ছেলের জন্যে করতে পারবে তা তো মনে হয় না। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা দিনরাত টিভি দেখতে চায়। তার উচিত ছোট হলেও একটা রঙিন টিভি কেনা। সুন্দর সুন্দর কিছু বিছানার চাদর কেনা। কিছু খেলনা কেনা।
আনিকা ঠিক করে ফেলল, কাল অফিস থেকে ফেরার পথে শওকতের বাসায় যাবে। একটা খামে কিছু টাকা ভরে দরজার নিচ দিয়ে ফেলে দেবে। সাদা মুখবন্ধ খাম দেখে শওকত বুঝতে পারবে না টাকাটা কোত্থেকে এসেছে। বোঝার দরকারই বা কী?
কত টাকা দেয়া যায়? পাঁচ হাজার। টিভি কিনতে চাইলে পাঁচ হাজারে হবে। দশ হাজার দেয়া দরকার। আনিকার টাকা আছে। প্রতি মাসেই সে বেতনের টাকার একটা অংশ জমায়। বোনাসের টাকার পুরোটাই জমায়। দুই লাখ এগারো হাজার টাকা তার জমা আছে। টাকাটা সে জমাচ্ছে বিয়ের জন্যে। নতুন সংসার শুরু করতে কত কিছু লাগে। প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিসের জন্যে সে তো আর শওকতের কাছে হাত পাততে পারবে না। অবশ্যি যদি শওকতের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
আনিকা বাসায় ফিরল সন্ধ্যা সাতটায়। তাকে দেখে তার মা মনোয়ারা ছুটে এসে বললেন, ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়েছে। এক লোক বাসায় টেলিফোন করে তোর বাবাকে হামকি ধামকি করেছে। শুণ্ডাদের মতো মোটা গলা। তোর বাবা ভয়ে অস্থির। ভীতু মানুষ তো!
আনিকা বলল, বাবাকে হামকি ধামকি করবে কেন?
মনোয়ারা বললেন, মিতুকে তোর বাবা মেরেছে–সেই খবর পেয়ে টেলিফোন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবা যদি তার মেয়েকে মারে, বাইরের লোক হামকি ধামকি করবে কেন?
মিতু কী বলে?
সে বলে, আমি কিছু জানি না।
মিতু কোথায়?
দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে। অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছি। দরজা খুলছে না। সাড়া-শব্দও করছে না। ঘুমের ওষুধ-টষুধ কিছু খেয়েছে কি-না কে জানে। তুই একটু দেখবি?
আনিকা বলল, আমি কিছু দেখতে-টেখতে পারব না মা। আমার জ্বর। আমি গরম পানি দিয়ে গোসল করে শুয়ে থাকব।
জ্বরের মধ্যে গোসল করবি কেন?
গা ঘিনঘিন করছে। এই জন্যে গোসল করব।
গোসল করতে করতে আনিকা শুনল, তার মা মিতুর ঘরের দরজা খোলার জন্যে খুবই চেষ্টা চালাচ্ছেন। মা দরজা খোল। তোকে কেউ কিছু বলবে না। আচ্ছা যা, দরজা না খুললে খুলবি না, একটু কথা বল। তোর বাবাকে যে টেলিফোন করেছে, সেই ছেলেটা কে?
মিতুর ঘর থেকে কোনো শব্দ আসছে না।