কোড কলকাতা
সেটা সত্তরের দশক। টালমাটাল অস্থির সময়। সন্ধে আটটা নাগাদ দুটো ছেলে। গায়ে আলোয়ান জড়ানো, কলেজ স্কোয়্যারের গা ঘেঁষে সূর্য সেন স্ট্রিট ধরে এগোচ্ছিল নিচু গলায় কথা বলতে বলতে— ‘লালের স্টক কী রকম?’
‘তা মোটামুটি ভালই’, ‘আর সাদা-র কী খবর?’ ‘সমর তো বলল কালকের মধ্যে সাপ্লাই এসে যাবে।’ ‘তা হলে তো আর চিন্তা নেই, এত পেটো ঝাড়ব যে মাকুরা পুরো এলাকা থেকে সাফ হয়ে যাবে।’
পাঠকবর্গ, এইটুকু বলার পর যদি হেড এগজামিনারের ভাষায় প্রশ্ন করা যায়— ‘উপরোক্ত বাক্যগুলির ভাবার্থ বর্ণনা করো…।’ কী হল? হযবরল-র কাকেশ্বর কুচকুচের মতো হাতে পেনসিল হয়ে গেছে তো? আরে না না, ইয়ার্কি মারছি না একদম, আসলে ওপরের রহস্যময় কথোপকথনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কয়েকটি ছোট্ট শব্দ— ‘কোড’। আসুন আর হেঁয়ালি না করে ব্যাপারটা পরিষ্কার করি।
প্রথম জন ‘লাল’ এর স্টক জিজ্ঞেস করছে। ‘লাল’ মানে পটাশ। এক ধরনের রাসায়নিক। ‘সাদা’-র অর্থ ম্যাগনেশিয়াম মোমছাল। সেটাও রাসায়নিক। আর এক ধরনের। দুটো রাসায়নিকের ভূমিকাই ‘পেটো’ অর্থাৎ হাতবোমা বাঁধার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই দু’জন যুবক নকশালপন্থী। ‘মাকু’ মানে ওদের প্রধান রাজনৈতিক শত্রুদলের সংক্ষিপ্ত কোডনেম। ওই রাজনৈতিক দলটির সমর্থকরাও নকশালপন্থীদের ‘নকু’ কোডনামে ডাকত।
কোনও রাজনৈতিক দলের আদর্শ বা মতবাদকে হেয় বা খাটো করার ন্যূনতম প্রয়াস এই প্রতিবেদকের নেই। আসলে সেই সময় কলকাতা তথা গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে কোড বা সাংকেতিক ভাষাগুলো রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রচলিত ছিল তার একটা নিরপেক্ষ এবং নির্ভেজাল বর্ণনা দেবার চেষ্টা করছি মাত্র। যাই হোক, বহু প্রাণ এবং ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে সত্তর দশক তো বিদায় নিল, কিন্তু পরবর্তীতে কোডগুলো ছড়িয়ে পড়ল অপরাধজগতে। এর মধ্যে ‘মাকু’ আর ‘নকু’ আজকাল আর তেমন শোনা না গেলেও ‘লাল’ ‘সাদা’ আর পেটো কিন্তু স্বমহিমায় বিরাজ করছে আজও।
এ ভাবে কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কোড বা সাংকেতিক ভাষা। যেরকম ‘রামপুরিয়া’ বা ‘কানপুরিয়া’ উত্তরপ্রদেশের দুটো জেলায় তৈরি ছ ইঞ্চি ফলার চাকু। কলকাতায় আগমন ষাটের দশকে। খাপের ভাঁজ থেকে টেনে বা স্প্রিং টিপে খুলতে হত। এদিকে ‘পেটো’ ছাড়াও হাতবোমার একাধিক সাংকেতিক নাম রয়েছে, যেরকম— ‘মাল’ ‘গ্যানা’ অথবা ‘নাড়ু’। বিভিন্ন অস্ত্রের বিভিন্ন কোডনেম। ‘যন্তর’ ‘চেম্বার’, ‘মেশিন’ বা ‘ছোট রড’ আসলে পিস্তল, রিভলবার বা ওয়ানশটার। ‘দানা’ বা ‘ক্যাপসুল’ মানে বুলেট। ‘ন্যাপালা’-র অর্থ ভোজালি বা কুকরি। রাইফেল, মাস্কেট বা বন্দুক যথাক্রমে ‘বড় রড’ বা ‘হনুমান’। গ্রেনেড তো অনেক দেখেছেন হলিউডি বলিউডি সিনেমায়। অপরাধ জগতে এর ছদ্মনাম ‘আতা’। একটু খুঁটিয়ে ভাবুন। আকৃতির অদ্ভুত মিলটা চোখে পড়বে। আশির দশকের গোড়ার সময় থেকে একটি অস্ত্র অপরাধীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ক্ষুর— ছোট, হালকা, লুকিয়ে রাখার পক্ষে আদর্শ। কোডনেম ‘আওজার’ বা ‘আস্তুরা’। অস্ত্রের ঝনঝনানি ছেড়ে চলুন এবার একটু অপরাধীদের ডেরায় ঢুকি।
মল্লিকবাজারের মোড়। দু’দল যুবক। ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারা। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে— ‘হামলোগকা মিস্তিরি বোল রহা থা কি পার্টি মে দো চার লেবার কম পড় রহা হায়। তেলোগকা পার্টি সে আগর কুছ লেবার মিল যায়ে তো বড়ি মেহেরবানি হোগি।’ আপাতদৃষ্টিতে মনেই হতে পারে খুবই স্বাভাবিক কথাবার্তা। একটা শ্রমিকদলে কয়েকজন শ্রমিক কম তাই সেই দলের হেডমিস্তিরি অন্য আরেকটি দলের কাছে ক’জন শ্রমিক ধার চাইছে। আজ্ঞে না মশাই। ব্যাপারটা মোটেই অতটা সোজা নয়। ওরা আসলে দু’দল পকেটমার। এখানে ‘মিস্তিরি’-র অর্থ দলের পান্ডা মানে মূল কাজটা যে করে। অর্থাৎ আমার আপনার পকেট থেকে ট্রামবাসের ভিড়ে মোবাইল বা মানিব্যাগটা তুলে নেয়। এ কাজে ‘মিস্তিরি’-কে যে সাহায্য করে তার কোডনেম ‘সেয়ানা’। এদের কাজ হল ঠাসাঠাসি করে শিকারকে ভিড়ের মধ্যে চেপে ধরা, যাতে সে একদম নড়াচড়া না করতে পারে। দলে সবচেয়ে নিচু পদ ‘লেবার’। গেটের দিকে নজর রাখা এবং যে-কোনও পরিস্থিতিতে দলকে সাহায্য করাটাই এদের ডিউটির মধ্যে পড়ে। পকেটমার জগতে কোড অজস্র। সামান্য কয়েকটি নমুনা দিলাম এখানে।
মানিব্যাগ—‘কালা তাকিয়া’, মোবাইল—‘রোতা বাচ্চা’ (ক্রন্দনরত শিশু), গলার হার—‘ছল্লি’ অথবা ‘পাক্কি’। মহিলা যাত্রী—‘তরকারি’, কাঁচি বা ব্লেড—‘চিপটেন’, কানের দুল— ‘টিংকা’, একশো, পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট যথাক্রমে ‘গজ’, ‘গান্ধি’ এবং ‘লালপান’। পুরোটা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং কিছু বিশেষ ধরনের তস্করদের কথা বলি।
হাওড়ায় ট্রেন ধরতে গেছেন। ট্রেন ছাড়তে অনেকটা দেরি হবে। প্রচুর যাত্রী ওয়েটিং রুমে, প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত। অনেকেই মেঝেতে চাদর অথবা কাগজ পেতে ঘুমিয়ে রয়েছেন। আপনিও কিছু একটা বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন তাদের পাশে। চোখ লেগে এল, ঘুম ভেঙে দেখলেন সঙ্গের লাগেজ উধাও। এটা ‘পড়িবাজ’-এর কীর্তি। ঘুমন্ত যাত্রীর অভিনয় করে নিরীহ যাত্রীর মালপত্র লুটে নিয়ে পালিয়ে যায় এরা। অপরাধ জগতে ঘুমের কোডনাম ‘পড়ি’। সেটা থেকেই ‘পড়িবাজ’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও তিন ধরনের ‘বাজ’-এর সন্ধান মিলবে আমাদের এ শহরে।
‘কটবাজ’-পাতি বাংলায় চিটিংবাজ। বিভিন্ন কায়দায় লোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার করাটাই এদের একমাত্র পেশা। মধ্য কলকাতার পার্ক সার্কাস, তালতলা, বউবাজার অঞ্চলে এরকম বেশ কয়েকটা বড় বড় ‘কটবাজ’ গ্যাং সক্রিয় ছিল বা আছে। এদের মধ্যে দু’জন তো ভিন রাজ্য থেকে আসা কোনও অবাঙালি ব্যবসায়ীকে নিজস্ব বাংলো বলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর ব্রিগেডকে ধানি জমি দেখিয়ে বেচে দিয়েছিলেন এ রকম প্রবাদ আছে বাজারে।
এবার ‘ঢোলবাজ’। মুটে বা কুলি সেজে ট্রেনের বাঙ্ক থেকে যাত্রীর মাল নামিয়ে দ্রুতপায়ে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এদের দক্ষতা অপরিসীম।
তবে সেরার সেরা ‘বাজ’ হচ্ছে ‘গাব্বাবাজ’। যে-কোনও ধরনের তালা দু’-এক মিনিটের মধ্যে খুলে বা ভেঙে ফেলা এদের কাছে জলভাত। ক্রাইমের দুনিয়ায় তালার সাংকেতিক কোড ‘গাব্বা’। সেখান থেকে ‘গাব্বাবাজ’-এর উৎপত্তি বলেই মনে হয়। খোলা ছাড়াও নিঃশব্দে যে-কোনও তালা ভেঙে ফেলার ব্যাপারেও এদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তাই এদের আর এক নাম ‘গাব্বা ভসকান’। তালা খোলার চাবি একটা সরু লোহার তার। সামনের দিকটা ঈষৎ বাঁকানো। কোডনেম ‘গামছা’। জোর করে ধমকে চমকে টাকা আদায় করার নাম যে ‘তোলা’ বা ‘হপ্তা’ সেটা মিডিয়ার দৌলতে আজকাল অনেকেই জানেন। কিন্তু এর আরও দুটো নাম যে ‘খিরাজ’ বা ‘তোড়িং’ অনেকেই তা জানেন না বোধহয়। লুঠ করা সম্পদের ভাগ বাঁটোয়ারাকে বলা হয় ‘হিস্সা’। এই হিস্সা নিয়ে মামলা অনেক সময় খুনখারাপি পর্যন্ত গড়ায়। যে-কোনও ধরনের অপরাধীর সঙ্গেই যাদের সম্পর্ক অনেকটা ননদ-বউদির মতো তারা হল পুলিশ আর ইনফর্মার। অপরাধ জগৎ এদেরও সাংকেতিক নামকরণ করেছে। পুলিশ—‘মামা’ বা ‘মামু’। আর ইনফর্মার হল গিয়ে ‘খোঁচড়’, ‘টিকটিকি’ বা ‘খবরি’। অপরাধ করেই অকুস্থল থেকে চম্পট দেওয়াই অপরাধীদের মূল লক্ষ্য। ক্রাইম ওয়ার্ল্ডের ভাষায় এর নাম ‘ঢিল দেওয়া’ ‘নও দো এগারা’ অথবা ‘কালটি’।
ছোট বড় যে-কোনও অপরাধীরই শেষ ঠিকানা জেল। এখানেও রয়েছে একাধিক নিজস্ব ভাষা, যা জেলেই একমাত্র শুনতে পাওয়া যায়। যেমন ‘চৌকা’ মানে রান্নাঘর। ‘লালটোপি’— রেপকেসের আসামি। ‘চিল্লর’-চামউকুন। ‘পাগলি’-র অর্থ বিপদ সাইরেন। ‘পলিতা’-র অর্থ কেরোসিন ভেজানো ন্যাকড়ার সলতে জ্বালিয়ে কোনও বন্দির পায়ের পাতায় ‘ছ্যাঁকা’ দেওয়া। তবে কাউকে হেনস্থা করার সবচেয়ে উত্কৃষ্ট পন্থাটি হল ‘পোচাড়া’ মানে ন্যাকড়ায় মলমূত্র মাখিয়ে গায়ে ছুড়ে মারা। আরও দুটো কোড বহুল প্রচলিত ছিল জেলে ষাট সত্তর দশকে। তবে অপরাধীদের নয়। রাজনৈতিক বন্দিদের মধ্যে। জেনারেল বডি মিটিং, সংক্ষেপে জিবি, ‘বড় কম্বল’ আর ছোট গ্রুপ মিটিং পরিচিত ছিল ‘ছোট কম্বল’ নামে। অপরাধ জগতের প্যাঁচপ্যাঁচানি তো সেরে ফেলা গেল মোটামুটি। চলুন এবার একটু নেশার দুনিয়ায় ঝিম খাই।
এই গোটা শহরটা জুড়ে, নেশারু আর নেশার উপকরণের ছড়াছড়ি। অলিতে গলিতে অজস্র বার, ঠেক আর জয়েন্ট। তালিকায় ‘র্যাঙ্কিং ওয়ান’ অবশ্যই মদ। এর একাধিক নাম, প্রায় কৃষ্ণের অষ্টতর শতনামের মতো। কত নামে যে রসিকরা আদর করে ডাকে! ‘তেল’, ‘জল’, ‘সাদাজল’, ‘লালজল’, ‘গরমজল’, ‘মাল’, ‘খাট্টু’, ‘পিকআপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি…। ঘরে তৈরি বেআইনি দেশি মদের নাম ‘চুল্লু’ বা ‘চৌ এন লাই’। আবার সরকারি দেশি মদেরও একাধিক কোডনাম রয়েছে সুরাপায়ীদের কাছে। ‘বাংলা’, ‘বাংলু’, ‘ব্যাং ব্যাং’। গাঁজার কোড— ‘তামাক’, ‘থাম’, ‘খাম’, এবং সাহেবি কেতায় ‘গ্রাস’। চরস পরিচিত ‘চেরি’ বা ‘পিচ’ নামে। ডেনড্রাইট ‘আঠা’। ফেনসিডিল বা কোরেক্স জাতীয় কাশির সিরাপের আদুরে নাম ‘জুস’। তবে সবচেয়ে রোম্যান্টিক কোড ম্যানডেক্স কামপোজ বা স্প্যাসমোপ্রক্সিভন জাতীয় নেশার ট্যাবলেটের— ‘চাঁদ কা টুকরা’। শিরায় মাদক নেওয়া নেশাড়ুদের কোড— ‘মেইনলাইনার’। গাঁজার কলকে মানে ‘বন্দুক’ আর কলকে প্যাঁচানোর ন্যাকড়া মানে ‘সাপি’। হেরোইন মানে ‘পাতা’ আর হেরোইনখোর মানে যে ‘পাতাখোর’ সেটা এখন পাড়ার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাও জানে। তাই এগুলোকে আর কোডের পর্যায়ে ফেলছি না।
এবার যে দু’টো দুনিয়ার কথা বলব তাদের ব্যবহৃত কোডগুলো একান্তই তাদের নিজস্ব এবং এক্সক্লুসিভ। সেগুলো হল নিষিদ্ধপল্লী আর হিজড়ে সমাজ। লালবাতি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী যৌনকর্মীদের বলা হয় ‘পার্মেন্ট’ (পার্মানেন্ট)। ঠিক একই ভাবে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীরা পরিচিত ‘ফেলাইন’ (ফ্লাইং) নামে। বহু জায়গায় মদের একাধিক কোডনেম শুনেছি কিন্তু ‘কেরোসিন’ কোথাও শুনিনি। এটা একান্তভাবেই এ পাড়ার নিজস্ব। এ ছাড়াও এই এলাকায় দেশি মদের আরেক নাম ‘ক্যান্টি’ (কান্ট্রি লিকারের অপভ্রংশ বোধ হয়)। ‘দাল্লা’ বা ‘ভেরুয়া’-র অর্থ এখানে দালাল। ‘ক্যাসেট’ মানে পাচার হতে আসা নাবালিকা। কন্ডোম—‘বেলুন’, আর পুলিশভ্যান— ‘চাক্কা’। উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা সুন্দরী এবং হাই প্রোফাইল যৌনকর্মীরা পরিচিত ‘আগ্রাওয়ালি’ বা ‘বেরিয়া’ বলে। কলকাতায় একমাত্র সোনাগাছিতেই এদের দেখা পাওয়া যায়। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মুম্বইয়ের বিভিন্ন বার এবং অনুষ্ঠানে নাচতে যাওয়া মেয়েদের ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আইডেনটিটি—‘আইটেম’। এই কোড প্রথম মুম্বইয়ে চালু হলেও হালফিল কলকাতায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
কোডের গোপনীয়তায় সবাইকে টেক্কা দিতে পারে হিজড়ে বা বৃহন্নলারা। যা মেইনস্ট্রিম বা সমাজের মূল ধারার কাছে অজানা অচেনা এক শব্দকোষ। এদের ভাষাজগতে বহু শব্দ বা বাক্যের মানে দ্বিমাত্রিক। যেমন— ‘ঝোলকি’ মানে রোজগার বা আয়, ‘থাপ্পু’ মানে টাকা বা নোট। ‘খোবরা’ মানে মাংস। ‘বড় খোবরা’ মানে পাঁঠার মাংস, আর ‘ছোট খোবরা’ মানে মুরগি। ‘আকুয়া’-র অর্থ বহিরঙ্গে পুরুষ কিন্তু হৃদয়ে নারী। ‘ছিবড়ি’— পুরোপুরি পুরুষ কিন্তু জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার তাগিদে হিজড়ে পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ‘ছিন্নি’ মানে খোজাকরণ। ‘গুরুমা’ বা ‘মুখ হিজড়ে’ কথার অর্থ দলপতি বা গোষ্ঠীপতি। প্রায় প্রত্যেক হিজড়েরই এক অথবা একাধিক পুরুষবন্ধু থাকে। এদের বলা হয় ‘পারিক’, ও ‘ডবল ডেকার’। এরা যথাক্রমে সমকামী ও উভকামী। এ ছাড়াও কমপক্ষে শতাধিক কোড রয়েছে উপরোক্ত দুই জগৎ জুড়ে। ‘সো কলড’ শালীনতার সীমা অতিক্রম করবে তাই সেগুলোর উল্লেখ আর এখানে করলাম না।
চলুন এবার একটু সংখ্যালঘু মহল্লায় চক্কর কেটে আসি। এই সব এলাকার নিজস্ব কিছু কোড আছে যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই বললেই চলে, স্থানীয় বাসিন্দাদের নিজস্ব ভাষায় গোমাংসের নাম ‘ভক্কর’ বা ‘দো নম্বর’। মোষের মাংস ‘জামসি’। খাসির মাংস ‘এক নম্বর’ আর শুয়োরের মাংস অবশ্যই ‘হারাম’। জবাই করা প্রাণীর মাংসকে বলা হয় ‘হালাল’। অন্যদিকে বলি দেওয়া কোনও প্রাণীর মাংস পরিচিত এবং পরিত্যাজ্য ‘ঝটকা’ আর ‘হারাম’ বলে। খাওয়াদাওয়ার পপুলার কোডনেম ‘জাবরোটি’। বড় বড় কথা বলা বা গুল মারার অভ্যাসকে বলা হয় ‘ফেকফাক’ বা ‘ছোড়মঞ্জন’। অর্থাৎ দাঁতের মাজন বিক্রেতাদের বড় বড় কথায় খদ্দেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মাল বিক্রি করার দক্ষতার সঙ্গে উপমাটির মিল টানা হয়। মেয়েলি ধরনের পুরুষ বা হিজড়েদের ‘ছক্কা’ অথবা ‘আট্ঠা’ বলে সম্বোধন করা খুব কমন প্র্যাকটিস এখানে। কিন্তু ফল বিক্রি করা যাদের পেশা তাদের কেন ‘কুঁজড়া’ বলে ডাকা হয় এর কোনও সংগত ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি আজও। এর শেষে একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিই আগেভাগেই। সংখ্যালঘু এলাকার রাস্তায় কোথাও মারামারি বাধলে যদি শোনেন কেউ হুঙ্কার ছাড়ছে—‘আবে, লঙ্গি নিকাল…’ সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ার চেষ্টা করবেন। কারণ ‘লঙ্গি’ মানে তরোয়াল বের করার কথা বলছে। অতএব সাধু সাবধান।
সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য কোড, শহরের অলিতে গলিতে রাস্তায়। শ্যামপুকুর স্ট্রিট ধরে যাচ্ছি। পাড়ার রকে ক’টা ছেলে। সিরিয়াস আলোচনা— ‘জানিস তো, গেল রাতে মিত্তিরদের বাড়িতে যে চোরটা ধরা পড়েছিল, সবাই মিলে সেটাকে এমন সেঁকল যে আর একটু হলে খরচাই হয়ে যাচ্ছিল…তা হলে তো বিলা হয়ে যেত মাইরি।’ এই সম্পূর্ণ বাক্যটার মধ্যে অন্তত তিনটে কোড লুকিয়ে রয়েছে। ‘সেঁকল’ মানে প্রচণ্ড মার মারল। ‘খরচা’ হয়ে যাচ্ছিল অর্থাৎ মরে যাচ্ছিল। সবশেষে ‘বিলা’-র মানে ঝামেলা বা গণ্ডগোল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটা কোড অত্যন্ত জনপ্রিয় শহর জুড়ে। ‘মুরগি’। ঠকে যাওয়া বা বোকা বনে যাওয়া মানুষের কোডনেম। এ ছাড়াও ট্যারা কাউকে ‘দেড় ব্যাটারি’ বা মেয়েলি ধরনের পুরুষকে ‘বউদি’ বলে হামেশাই ডেকে থাকি আমরা। কারও ঠকে যাওয়া, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা একটা অন্য ধরনের চালচলন নিয়ে রসিকতা, সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতার কাছে বিশেষ প্রাপ্তি বই কী। বলতে ভুলেই গেছি ‘স্যাঁকা’ ছাড়াও পেটানোর আরও চারটে কোড চালু আছে কলকাতায়। সেগুলি হল যথাক্রমে ‘সাইজ করা’, ‘বানানো’, ‘ক্যালানো’, আর ‘বাটামবাজি’। একই ভাবে ঘুসি মারারও তিনটে কোড— ‘টিক’, ‘ঠুসো’ আর ‘হাতোড়া’। এর মধ্যে শেষেরটা শোনা যাবে একমাত্র অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়। ‘হাতোড়া’ হিন্দি শব্দটির বাংলা মানে হাতুড়ি। সেক্ষেত্রে হাতুড়ির মতো মুষ্ট্যাঘাত, এ ধরনের একটা সামঞ্জস্য খুঁজে নেওয়াই যেতে পারে। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই অধম যখন ক্লাস এইট-নাইন, সে সময় প্রেমিকার দুটি কিউট কোডভাষা চালু ছিল উত্তর কলকাতায়— ‘ছাবি’ আর ‘ভাতি’। বর্তমানে অবশ্য বিলুপ্তপ্রায়। জলদাপাড়ার গন্ডার বা সুন্দরবনের বাঘের মতো সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়।
এবার যে কোডগুলির কথায় আসব তা একেবারেই শহুরে নয় এবং প্রতিবেদনের শিরোনামের সঙ্গে আদৌ খাপ না খেলেও প্রচণ্ড ইন্টারেস্টিং। তাই বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। পেশাগত প্রয়োজনে বসিরহাট সংলগ্ন ঘোজাডাঙা সীমান্ত এলাকায় গেছি। সকাল সাড়ে দশটায় ব্যস্ত ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার। ছোপ ছোপ হলুদ জলপাই উর্দির বিএসএফ। সাদা পোশাকের ডিআইবি। সারি সারি মানি এক্সচেঞ্জ স্টল। প্রচণ্ড ভিড় স্টলের সামনে। সীমান্ত পেরিয়ে মানুষজন এপারে আসছেন। ওপারে যাচ্ছেনও অনেকে। রাস্তার ধারে লাইনে দাঁড়ানো অটো। প্রাণপণে হাঁক পাড়ছে ড্রাইভাররা—‘বসিরহাট বসিরহাট…।’ একদম সামনের চালককে পেছনের চালক জিজ্ঞেস করছে— ‘তোর পোকায় কটা ধুর?’ সামনের জন— ‘ছটা’। ‘কটা সাফা, কটা ধাক্কা?’ প্রথমজন— ‘চারটে ধাক্কা দুটো সাফা।’ ‘তা হলে আর চিন্তা কী? তোর তো হয়ে গেল গুড়-রুটি। নে নে পোকা চালু কর, আমাকে ধুর ধরতে দে।’ কথা হচ্ছিল অত্যন্ত নিচুস্বরে। তবু চির-কৌতূহলী কান তার র্যাডারে তুলে নিল এই বিচিত্র কথোপকথন। দ্বিতীয় অটোওয়ালার অটো তখনও ভরেনি। ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালাম পাশে। মনে দমচাপা কৌতূহল। দেশলাই চাওয়ার বাহানায় কথাবার্তা শুরু। সিগারেট জ্বালিয়ে ওকেও দিলাম একটা। মিনিট পাঁচেক বার্তালাপের পর উপরোক্ত কথোপকথনের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটিত হল। জানা গেল পোকা আসলে অটো। আর ‘ধুর’ শব্দের অর্থ বাংলাদেশ থেকে আগত মানুষজন। ‘সাফা’ মানে যাদের কাছে আইনি পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি আছে। আর যারা বেআইনি পথে এপারে এসেছেন, স্থানীয় কোডে তারা ‘ধাক্কা’। এই ‘ধাক্কা’ জাতীয় ‘ধুর’-রা চালকের ‘পোকা’ থুড়ি অটোয় যত বেশি থাকবেন তার তত বেশি ‘গুড়রুটি’ বা পোয়াবারো। কারণ ‘ধাক্কা’দের ক্ষেত্রে অটোভাড়া ‘সাফা’র তুলনায় প্রায় তিনজন। আইনরক্ষকদের দিয়েথুয়েও বেশ ভালই থাকে। বিশ্বাস না হলে স্বগমনে পরীক্ষা প্রার্থনীয়। তবে চোখ কান একটু খোলা রাখতে হবে।
ফিমেল কোড। এক্সক্লুসিভলি মহিলাদের। মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মহলে প্রচণ্ড জনপ্রিয়। দু’-এক টুকরো সংলাপ শোনাই। ধরুন দুটি অল্পবয়েসি মেয়ে। একজন অপরজনকে বলছে— ‘তুসপুই কোসমোসপোথায় যাসপাসছিস’, অপরজন— ‘মিসতাসের রাবড়ি’। এবার প্রথমজন— ‘আসফামি যাসপাচ্ছি ফাসনা।’ এটুকু শুনে কারও মনে হতেই পারে— যাঃ বাব্বা! হিব্রু না জুলু কোন ভাষায় কথা বলছে? অবগতির জন্য জানাই হিব্রু-জুলু-নেপচুনগ্রহ বা আলকায়দা কোনওটাই নয়। পাতি বাংলায় কথা বলছে এরা। ঘাবড়ে না গিয়ে ধৈর্য ধরে কথাগুলোকে ডিকোড করার চেষ্টা করুন। দেখবেন ব্যাপারটা একদম জলবৎ তরলং হয়ে গেছে। আসলে এটা আর কিছুই না একেকটা বাক্যের সামনে বা মাঝখানে কিছু অহেতুক অক্ষর জুড়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র। প্রকৃত সংলাপ—‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’ ‘মিতাদের বাড়ি’, ‘আমি যাচ্ছি না’। ওপরের লাইনগুলোয় আর একবার চোখ বোলালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে সব খেলারই একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। এ খেলার নিয়ম হল একেকটি বাক্যের প্রথম অক্ষরটিকে যথাসম্ভব আর শেষ অক্ষরটিকে অবশ্যই সঠিক অবস্থানে রাখতে হবে। কথার গতিও হওয়া চাই বেশ দ্রুত যাতে ধাঁধা লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যারা আজ প্রথম এই খেলাটা শিখলেন, আজ থেকেই প্র্যাকটিস শুরু করে দিন। পরিচিত মহলে সুপার ডুপার হিট হবেই। গ্যারান্টি।
তখন বয়স বাও কি ত্যাও। পুরনো পাড়া গড়পারে একটি মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক কাউন্টারের সামনে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফাস গলায় দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন—‘সেনবাবু আছেন?’ দোকানি অর্থপূর্ণ চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল, মানে আছে। তারপর দোকানের কর্মচারী ছেলেটিকে বলল—‘দাদাকে ভেতর থেকে দশটা সেনবাবু এনে দে।’ কর্মচারী চলে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদে ফিরে এল হাতে একটা প্যাকেট। তড়িঘড়ি খদ্দেরের হাতে গুঁজে দিল। ভদ্রলোক যেন রাজ্য লটারির ফার্স্ট প্রাইজ মেরেছেন এরকম মুখের ভাব, দাম মিটিয়ে চলে গেলেন কোনওদিকে না তাকিয়ে। সেনবাবু কী করে প্যাকেটে থাকেন? দোকান মালিককে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি। সন্ধের পর বাবা বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞেস করে গূহ্য কথাটা জানতে পারি। সেটা ষাটের দশক। অদ্ভুত এক সরকারি নির্দেশে মিষ্টির দোকানে ছানার ব্যবহার বন্ধ করা হয় বেশ কিছুদিনের জন্য। কিন্তু বাঙালি বলে কথা। সন্দেশ রসগোল্লা ছাড়া কি চলে? অনেক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীই লুকিয়ে চুরিয়ে তৈরি করতে শুরু করলেন ছানার মিষ্টি। রাজ্যের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের নামে মিষ্টির কোডনাম হল ‘সেনবাবু’। অনেককাল পরে এই সেনবাবুর মতো আর এক দাসবাবুর আবির্ভাব ঘটেছিল বাজারে। নব্বইয়ের শেষ বা দু’হাজারের গোড়ায়। সঠিক সময়টা ভুলে গেছি। বাজারে রিলিজ করেছে সঞ্জয় লীলা বনশালীর (শরত্চন্দ্রের নয়) দেবদাস। সুপার ডুপার হিট। দর্শক ফেটে পড়ছে হলে। শোয়ের পর শো হাউসফুল। এই সাফল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হল ভিডিও পাইরেসি। পঞ্চাশ-একশো টাকায় জাল দেবদাসে ছেয়ে গেল বাজার। প্রমাদ গুনলেন প্রোডিউসার-ডিস্ট্রিবিউটররা। আইনের দ্বারস্থ হলেন তাঁরা। ভিডিও পার্লার স্টলে শুরু হল রেইড। ফলে দেবদাস নামক সিডি মহোদয় নাম পরিবর্তন করিয়া হইলেন ‘দাসবাবু’। হুবহু গড়পারের সেই ভদ্রলোকের মতো দোকানে গিয়ে স্রেফ ‘দাসবাবু’র খোঁজ করবার ওয়াস্তা। খবরের কাগজ বা কালো পলিপ্যাকে মোড়া কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি চলে আসবে ক্রেতার হাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘সেনবাবু’ ‘দাসবাবু’রা বিদায় নিলেও ‘পাকা পেঁপে’, ‘গরমমশলা’ বা ‘পানু’রা কিন্তু বাজারে রয়ে গেছে। পার্মানেন্টলি। আজ্ঞে হ্যাঁ। পর্নোগ্রাফির ভিডিও সিডি বাজারে এ নামেই পরিচিত।
সবশেষে একটু বাজারে ঢোকা যাক। ভবানীপুরের রূপচাঁদ মুখার্জি লেনে মামাবাড়ি। জয়েন্ট ফ্যামিলি। এক রোববারে বাবা-মা’র সঙ্গে গেছি। ঠিক হল মাংস হবে। বাজারের দায়িত্বে মেজোমামা। সঙ্গে থলে হাতে ল্যাংবোট আমি। জগুবাজারে মাংসের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পাঞ্জাবি দোকানদার, দাড়িভর্তি মুখে একগাল হাসি— আরে, বাবুরা এসে গেছে। ভেতর থেকে ভাল দেখে দে। এহেন আপ্যায়নে মেজোমামা তো বটেই ভাগ্নেও যারপরনাই পুলকিত। বিজয়গর্বে হাতে থলে ঝুলিয়ে বাড়ি তো ফেরা হল। ধুয়ে পাকলে কড়াইয়ে চাপাতেই সে এক কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড। উৎকট বোঁটকা গন্ধে টেকা দায়। নাকে আঁচল চেপে দিদিমার চিল চিৎকার— ‘ফ্যালায়া দে। ফ্যালায়ে দে… পচা মাংস দিছে…মাগো…।’ নামী কোম্পানির দামি অফিসার বড়মামা—‘পচা নয়। রামপাঁঠা। ইট মাস্ট বি হি গোট।’ হাঁড়ির সামনে বসা মা’র মুখটা অনেকটা স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধে পরাজিত হিটলারের মতো। পাড়ার লোকে তেড়ে এসে মারতে বাকি রেখেছিল। অনেকদিন বাদে মার্কেট ইন্সপেক্টর পদে বদলি হয়ে জগুবাজারে আসা বাবার এক বন্ধুর কাছে জানা গিয়েছিল ‘ভেতর থেকে’ আর ‘ভাল দেখে’ এই দুটো নাকি খাসির বদলে রাম ছাগলের মাংস গছিয়ে দেবার কোড। এ ধরনের অজস্র দুর্মূল্য কোডরত্ন ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতার বাজারময়। কবজির সূক্ষ্ম মোচড়ে পাল্লা হেলিয়ে দেবার কায়দাকে বলে ‘হ্যাটা’ বা ‘হাতাবাবা’। পচা মাছের সাংকেতিক নাম ‘তেলো’ বা ‘লুসো’। একশো থেকে এককিলো ওজনের কাটা বা জাল বাটখারার একাধিক কোডনেম। যেমন ‘ডাকটাকি’, ‘সিকচাকি’, ‘নেত্যচাকি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ নিয়ে আর বেশি মুখ খুলব না। বুঝতেই পারছেন ছাপোষা মধ্যবিত্ত। ৩৬৫ দিন বাজার করে খেতে হয়। একটা মারও বাইরে পড়বে না। তবে এই সিরিয়ালের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এপিসোডটা দেখেছিলাম উত্তর কলকাতার নতুন বাজারে। দুধের হোলসেল মার্কেট। সার সার খড় চোবানো দুধের ড্রাম। লম্বা লম্বা চাতালে লাইন দিয়ে বিক্রেতারা বসে রয়েছেন। ডান হাতটা গামছা ঢাকা। খদ্দেররা এগিয়ে গামছার তলায় হাত ঢুকিয়ে কানে কানে বিজাতীয় ভাষায় কী সব যেন বলছেন। গামছার নীচে আঙুলের নড়াচড়া… বিক্রেতাও ফিসফিস করে উত্তর দিচ্ছেন ওই একই ভাষায়। অত্যন্ত বিনীতভাবে মানে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বোম্বাই ধমক ছাড়া কপালে আর কিছুই জোটেনি। আমার দ্বারা তো হল না। আপনারা একবার চেষ্টা করে দেখুন না। জানতে পারলে অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। এই অধমের কোড ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আরও কিছু জমা পড়বে।