২. কি ঘটে এবং কি পর্যবেক্ষণ করা হয়
এক ধরনের উঁচুদরের মানুষ জোরের সঙ্গে সবই আপেক্ষিক’ বলতে ভালবাসেন। কথাটা একেবারেরই অর্থহীন। কারণ, সবই যদি আপেক্ষিক হতো তাহলে আপেক্ষিক সম্পর্ক স্থাপন করার মতো কিছু থাকত না। অধিবিদ্যক অসম্ভাব্যের (metaphysical absurditiies) ভিতর না গিয়েও কিন্তু বলা যায় ভৌত জগতের সবকিছুই একজন পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ আপেক্ষিক (relative to an observer)। এ দৃষ্টিভঙ্গি সত্য কিংবা মিথ্যা যাই হোক না কেন ‘অপেক্ষবাদ’ (theory of relativity) কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেনি। নামটার হয়তো ভাগ্য খারাপ। এ নাম দার্শনিকদের এবং অশিক্ষিত লোকদের গোলমালে ফেলেছে। তারা কল্পনা করেন নতুন তত্ত্ব প্রমাণ করেছে ভৌতজগতের সবকিছুই আপেক্ষিক। অথচ ও তত্ত্বের একমাত্র প্রচেষ্টা-যা আপেক্ষিক সেটা বাদ দিয়ে ভৌতবিধি সম্পর্কে এমন জ্ঞাপনীতে (statement) পৌঁছানো যে জ্ঞাপনী কোনোক্রমেই পর্যবেক্ষকের পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর নির্ভর করবে না। দেখা গিয়েছে পর্যবেক্ষক যা দেখতে পান তার উপরে এই সমস্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব আগে যা ভাবা গিয়েছিল তার চাইতে বেশি। একথা সত্য হলেও পারিপার্শ্বিকের এই ক্রিয়া কি করে সম্পূর্ণ দূর করা যায় অপেক্ষাবাদ সেটাই দেখায়। এ তত্ত্বে বিস্ময়কর যা কিছু আছে এটাই তার উৎস।
এককরূপে কল্পিত একটি ঘটনা যখন দুজন পর্যবেক্ষক অনুভব করেন তখন তাদের অনুভুতির ভিতর কিছু মিল থাকে আবার কিছু অমিলও থাকে। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে এ পার্থক্য ঢাকা পড়ে। কারণ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে সর্বক্ষেত্রেই এ পার্থক্য গুরুত্বহীন। কিন্তু পদার্থবিদ্যা এবং মনস্তত্ত্ব তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি ঘটনা সম্পর্কে একের অনুভূতির সঙ্গে অপরের অনুভূতির পার্থক্যের উপর জোর দিতে বাধ্য হয়। এই পার্থক্যগুলির খানিকটা কারণ পর্যবেক্ষকদের মস্তিষ্কের পার্থক্য, খানিকটার কারণ তাদের বোধেন্দ্রিয়ের পার্থক্য এবং খানিকটার কারণ ভৌত পরিস্থিতির পার্থক্য, এই তিন প্রকার পার্থক্যের নাম দেওয়া যেতে পারে মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য, শারীরবিদ্যাভিত্তিক পার্থক্য এবং ভৌত পার্থক্য। আমাদের জানিত কোনো ভাষায় যদি কোনো মন্তব্য করা হয় তাহলে সেটা শোনা যাবে, কিন্তু একই রকম উচ্চগ্রামের মন্তব্য অজানা ভাষায় করা হলে হয়তো একেবারেই গ্রাহ্য করা হবে না। আল্পস পর্বতে দুজন ভ্রমণকারীর একজন দৃশ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করেন, অন্যজন বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের জন্য জলপ্রপাত লক্ষ্য করেন। এ পার্থক্য মনস্তাত্ত্বিক । হ্রস্বদৃষ্টিসম্পন্ন (short-sighted) এবং দীর্ঘদৃষ্টি সম্পন্ন (long sighted) লোকদের ভিতরের পার্থক্য কিংবা বধির ব্যক্তি এবং শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের ভিতরের পার্থক্য শারীরবিদ্যাভিত্তিক, এই দুরকম পার্থক্যের কোনোটি নিয়েই আমার মাথা ব্যথা নেই। এগুলির প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার জন্যই শুধু আমি এগুলি উল্লেখ করেছি। শুদ্ধ ভৌতিক পার্থক্য নিয়েই আমাদের বিচার। পর্যবেক্ষণের স্থানে যদি ক্যামেরা কিংবা রেকর্ড করার যন্ত্র (recording macehine) প্রতিস্থাপন করা যায় এবং ফিল্ম কিংবা গ্রামোফোনে সেগুলি পুনরুৎপাদন করা যায় তাহলে দুজন পর্যবেক্ষকের ভিতরকার ভৌত পার্থক্য রক্ষিত হবে। দুই ব্যক্তি যদি তৃতীয় এক ব্যক্তির কথা বলা শোনে এবং তাদের ভিতরে একজন যদি অন্যজনের তুলনায় বক্তার নিকটতর হয় তাহলে নিকটতর ব্যক্তি অপরের তুলনায় উচ্চগ্রামে শুনবে এবং সামান্য আগে শুনবে। দুই ব্যক্তি যদি একটি গাছ পড়তে দেখে তাহলে তারা দেখবে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে। এই দুরকম পার্থক্য নথিভুক্ত করার যন্ত্রে সমভাবে দেখা যাবে। পর্যবেক্ষকদের বৈশিষ্ট্য কোনোক্রমেই এ পার্থক্যের কারণ হতে পারে না। এ পার্থক্য আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ ভৌত প্রকৃতি প্রবাহের অংশ।
সাধারণ মানুষের মতো পদার্থবিদ্যাবিদরাও বিশ্বাস করেন : তাঁদের অনুভূতি শুধু তাদের নিজস্ব একান্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জ্ঞান দান করে তাই নয়, ভৌত জগতে বাস্তবে যা ঘটেছে, অনুভূতি (perceptions) সে সম্পর্কেও তাঁদের জ্ঞান দান করে। পেশাগতভাবে তারা ভৌত জগৎকে বাস্তব (real) মনে করেন শুধুমাত্র মানুষের স্বপ্নভিত্তিক কিছু ভাবেন না। উদাহারণ : উপযুক্ত অবস্থান থেকে যে কোনো ব্যক্তি সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং এই উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত ফটোগ্রাফের প্লেটও পর্যবেক্ষণ করতে পারে। যারা সূর্য কিংবা তার ফটো দেখেছে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়াও বাস্তবে আরো কিছু ঘটেছে, পদার্থবিদ্যাবিদরা একথা বিশ্বাস করেন। স্বতঃপ্রতীয়মান মনে হলেও এ বিষয়ে আমি জোর দিয়েছি। তার কারণ অনেকে মনে করেন অপেক্ষবাদ এ বিষয়ে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। আসলে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করেনি।
কিন্তু একই ভৌত ঘটনা কিছু সংখ্যক লোক পর্যবেক্ষণ করতে পারে, পদার্থবিদ্যাবিদদের এ বিশ্বাসের যদি কোনো যৌক্তিকতা থাকে তাহলে ঘটনার যে অবয়বগুলি সমস্ত পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ সমরূপ পদার্থবিদ্যাবিদ সেগুলি নিয়েই কাজ করবেন : এ তথ্য স্পষ্ট। কারণ, অন্য অবয়বগুলি ঘটনার সঙ্গে স্বতত সংযুক্ত এরকম বিচার চলে না। যে সমস্ত একই রকম উত্তম’ পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ সমরূপ’ অন্তত তারই ভিতর পদার্থবিদ্যাবিদদের সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। যে সমস্ত পর্যবেক্ষক অনুবীক্ষণ যন্ত্র কিংবা দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করেন। তার কারণ প্রথমোক্তরা যা দেখতে পান না, তাঁদের যারা এগুলি ব্যবহার করেন। তার কারণ প্রথমোক্তরা যা দেখতে পান না, শেষোক্তরা সেগুলি দেখতে পান এবং দেখতে পান তার চাইতে বেশি আরো কিছু। সুবেদী (sensitive) ফটোগ্রাফিক প্লেট হয়তো তারও বেশি দেখতে পায়। তখন যে কোনো চোখের চাইতে সেগুলিকে বেশি পছন্দ করা হয়। কিন্তু দর্শনানুপাতে (perspective) পার্থক্য কিংবা দূরত্বের ভিন্নতার দরুণ আকারের বৈসাদৃশ্য ইত্যাদি সেই সেই বস্তুতে আরোপ করা যায় না। এগুলির জন্য দায়ী শুধুমাত্র দ্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি। বস্তু বিচারকালে সাধারণ বুদ্ধি এ বৈসাদৃশ্যগুলিকে পরিত্যাগ করে। একই পদ্ধতিকে পদার্থবিদ্যা আরো অনেক দূর অবধি এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু মূল নীতি অভিন্ন।
আমি পরিষ্কার বলতে চাই : যাকে যথাযথ বলা যায় না সেরকম কোনো বিষয় নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার বিচার এমন কতকগুলি সঙ্টনের (occur rences) সত্যকারের ভৌত পার্থক্য নিয়ে, যেগুলির প্রতিটি একটি বিশেষ ঘটনার নির্ভুল সাক্ষ্য। এ বিচার আমি করতে চাই ঘটনার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। একটা কামান যখন দাগা হয়, তখন যারা খুব কাছে না থাকে তারা আগে দেখতে পায় আলোর ঝলক, পরে শুনতে পায় আওয়াজ। তাদের বোধেন্দ্রিয়ের কোনো দোষ এ ঘটনার জন্য দায়ী নয়। এর কারণ শব্দের গতি আলোর গতির তুলনায় মন্থর। আলোর গতি এত দ্রুত যে, ভূ-পৃষ্ঠের অধিকাংশ পরিঘটনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোক চলাচলকে তাৎক্ষণিক মনে করা যেতে পারে। পৃথিবীতে ঘটমান যা কিছু আমরা দেখতে পাই কার্যত সে সমস্তই ঘটে আমরা যে মুহূর্তে সেগুলি দেখতে পাই সেই মুহূর্তে। আলোকের গতি সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার (প্রায় ১,৮৬,০০০ মাইল)। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসতে আলোকের প্রায় ৮ মিনিট সময় লাগে আর তারাগুলি থেকে আসতে সময় লাগে ৪ থেকে কয়েক হাজার মিলিয়ন বছর পর্যন্ত। আমরা অবশ্য, সূর্যে একটা ঘড়ি বসিয়ে সেখান থেকে গ্রিনউইচ মধ্যক সময় (Greenwich Mean Times) ১২ টাতে আলোর ঝলক পাঠিয়ে গ্রিনউইচে সেই আলোর ঝলককে ১২টা ৮ মিনিটে ধরতে পারি না। আলোকের দ্রুতি নির্ধারণে আমাদের পদ্ধতি শব্দের ক্ষেত্রে প্রতিধ্বনি ব্যবহারের মতো। আমরা আলোকচ্ছটা (flash of light) আয়নার দিকে পাঠাতে পারি এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারি প্রতিফলনের আমাদের কাছে আসতে কত সময় লাগে। তাহলে আমরা পাই আয়না অবধি যাতায়াতের সময় অর্থাৎ ভ্রমণকালের দ্বিগুণ। আয়নার দূরত্ব যদি মাপা যায় তাহলে আলোকের দ্রুতিও (speed) গণনা করা সম্ভব।
কাল মাপনের পদ্ধতি আজকাল এত নির্ভুল (precise) যে এ পদ্ধতি এখন ব্যবহার করা হয় দূরত্ব নির্ধারণের জন্য–আলোকের দ্রুতি মাপনের জন্য নয়। ১৮৯৩ সালের একটি আন্তজার্তিক চুক্তি অনুসারে ‘এক সেকেন্ডের ১,২৯৯৭৯২৪৫৮ সেকেন্ডে শূন্যস্থানে আলোক যে পথ অতিক্রম করে সেটাই এক মিটার। পদার্থবিদ্যাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোকের দ্রুতি এখন রূপান্তর গুণকে (conversion factor) পরিণত হয়েছে। ঠিক যেমন গুণক ০.৯১৪৪ ব্যবহার করা হয় গজ-হিসাবে দূরত্বকে মিটার হিসাবে-দূরত্বে রূপান্তরিত করার জন্য তেমনি আলোকের দ্রুতিতে ব্যবহার করা হয় দূরত্বকে সময়ে রূপান্তরিত করার জন্য। সূর্য আট মিনিট দূরে কিংবা নিকটতম বাস স্টপ ১ সেকেন্ডের ১০ লক্ষ ভাগ দূরে এই সমস্ত কথাই আজকাল নির্ভুল অর্থবহ।
দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি অনুমোদন এমন একটি সমস্যা, যে সম্পর্কে পদার্থবিদ্যা চিরকাল সম্পূর্ণ সচেতন : একথা বলা যেতে পারে। আসলে কোপার্নিকাসের আমল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে (astronomy) এই সমস্যা প্রাধান্য বিস্তার করেছে এ কথা সত্য। কিন্তু অনেক সময় ফল সম্পূর্ণ আহরণের আগেই নীতিগুলি গৃহীত হয়। যদিও তত্ত্বের দিক দিয়ে এ নীতি সমস্ত পদার্থবিদ্যাবিদই মেনে নিয়েছিলেন তবুও চিরায়ত পদার্থবিদ্যার অনেকাংশের সঙ্গে এই নীতির সঙ্গতি ছিল না।
একগুচ্ছ বিধান (rule) ছিল। সেগুলি ছিল দার্শনিক মনোভাবাপন্নদের অস্বস্তির কারণ। প্রয়োগক্ষেত্রে কিন্তু এগুলি ছিল কার্যকর। সুতরাং পদার্থবিদ্যাবিদরা বিধানগুলি মেনে নিতেন। লক্ (Locke) ‘অপ্রধান’ গুণগুলিকে (secondary qualities) ব্যক্তিনিষ্ঠ (subjective) গুণ আখ্যা দিয়ে পৃথক করেছিলেন, যেমন : রঙ (colour) কোলাহল (noise) স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদি। অন্যদিকে আকার (shape) অবস্থান (position) এবং আয়তনকে (size) বলেছিলেন প্রধান গুণ (primary quality)। তাঁর মতে এগুলি ভৌত বস্তুর অকৃত্রিম ধর্ম। পদার্থবিদ্যাবিদের বিধানগুলি ছিল এই মতবাদের ফলস্বরূপ। রঙ এবং কোলাহল ব্যক্তিনিষ্ঠ হওয়ার অনুমোদন পেল কিন্তু তার কারণ ছিল নির্দিষ্ট নিশ্চিত গতিতে চলমান তরঙ্গ। ক্ষেত্র অনুসারে শব্দ কিংবা আলোকতরঙ্গ উৎস থেকে বোদ্ধা (percpien) পর্যন্ত চলমান। বাহ্যতঃ প্রতীয়মান আকারের পরিবর্তন হয় দর্শনানুপাতের বিধি (law of perspective) অনুসারে। এ বিধিগুলি কিন্তু সরল-ফলে বাহ্যত ও প্রতীয়মান কয়েকটি চাক্ষুষ আকার থেকে বাস্তব (real) আকার অনুধাবন করা সহজ। তাছাড়া বস্তুপিণ্ডগুলি নিকটস্থ হলে স্পর্শের সাহায্যেও বাস্তব’ আকার নির্ণয় করা যায়। আমাদের বোধের কাল এবং প্রেরণার গতি (velocity of transmission) বিচার করে একটি ভৌত ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ কাল নির্ণয় করা সম্ভব। পরিস্থিতি অনুসারে প্রেরণের গতি হতে পারে আলোকের, শব্দের কিংবা স্নায়ুবিক প্রবাহের (current)। পেশাবহির্ভূত সময়ে তাদের বিবেক দংশন যে রকমই হোক না কেন, কার্যক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যাবিদরা এই দৃষ্টিভঙ্গিই গ্রহণ করতেন।
যতদিন পর্যন্ত পদার্থবিদ্যাবিদরা ভূ-পৃষ্ঠে প্রচলিত গতির তুলনায় অতি বৃহৎ গতি নিয়ে কাজ না করেছেন ততদিন পর্যন্ত এ দৃষ্টিভঙ্গিতে ভালই কাজ চলেছে। একটা এক্সপ্রেস ট্রেন মিনিটে দু-মাইল যায়, একটি গ্রহ যায় সেকেন্ডে কয়েক মাইল। সূর্যের কাছে থাকলে ধূমকেতুগুলি অনেক বেশি দ্রুতগামী কিন্তু অবিচ্ছিন্নভাবে আকারের পরিবর্তন হওয়ার দরুণ খুব নির্ভুলভাবে তাদের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কার্যক্ষেত্রে, ঠিকভাবে গতিবিদ্যা প্রয়োগ করার উপযুক্ত বস্তুপিণ্ডগুলির ভিতরে গ্রহই ছিল সবচাইতে দ্রুতগামী। তেজস্ক্রিয়তা ও মহাজাগতিক রশ্মি আবিষ্কার এবং অধুনা উচ্চশক্তিসম্পন্ন ত্বরণ যন্ত্র (acclerating machine) আবিষ্কারের ফলে পর্যবেক্ষণকে নতুন অঞ্চলে (new range) প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে। একক ঊনপারমাণবিক বস্তুকণা এখন পর্যবেক্ষণ করা যায়। তাদের গতি আলোকের গতির চাইতে খুব কম নয়। প্রাচীন তত্ত্বগুলি যে প্রত্যাশ্যার পথিকৃৎ এই বিরাট দ্রুতিতে চলমান বস্তুপিণ্ডগুলির আচরণ সেরকম নয়। একটা ব্যাপার :দ্রুতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নির্ভুল, নিশ্চিত, নির্দিষ্টভাবে ভর বৃদ্ধি পায়। অতি চলমান একটি ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, : তার উপরে একটি নির্দিষ্ট বলের ক্রিয়া স্বল্প গতিসম্পপন্ন অবস্থার তুলনায় বেশি বেগসম্পন্ন অবস্থায় কম। একটি বস্তুপিণ্ডের আয়তন তার গতি দ্বারা প্রভাবিত হয়–এ চিন্তনের যুক্তি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। উদাহরণ; একটি ঘনককে (cube) যদি আপনি অতি দ্রুত চালনা করেন তাহলে তার সঙ্গে চলমান নয়–এরকম ব্যক্তি সাপেক্ষ ঘনকটির দৈর্ঘ্য গতির অভিমুখে হ্রস্বতর হবে। কিন্তু তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে (অর্থাৎ ঘনকের সঙ্গে চলমান পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ) ঘনকটি একই রকম থাকবে। আরো বিস্ময়কর আবিষ্কার ছিল : কালাতিপাত (lapse of time) গতির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ দুটি সম্পূর্ণ নির্ভুল ঘড়ির একটি যদি অন্যটি সাপেক্ষ দ্রুত চলমান হয় এবং ভ্রমণ সমাপ্ত করে ঘড়ি দুটি যদি আবার একত্রিত হয় তাহলে তারা একই সময় প্রদর্শন করবে না। এ অভিক্রিয়া (effect) এত ক্ষুদ্র যে এতদিন পরীক্ষা করা যায়নি। কিন্তু আন্তঃতারকা ভ্রমণ বিকাশে যদি আমরা কখনো সাফল্য লাভ করি তাহলে এ তথ্য পরীক্ষা সম্ভভ হবে। কারণ তখন আমরা দীর্ঘ ভ্রমণ করতে পারব যে যাকে এই কাল শ্লথন (time dilatation)বলা হয়-সেটা বেশ বোধগম্য হবে।
কাল থনের কয়েকটি প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য রয়েছে কিন্তু সে সাক্ষ্য পাওয়া যায় একটু অন্যভাবে। এ সাক্ষ্য আসে মহাজাগতিক (cosmic) রশ্মি পর্যবেক্ষণ থেকে। এ রশ্মিগুলি নানারকম পারমাণবিক বস্তুকণা দিয়ে গঠিত। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতরে এদের গতি অত্যন্ত দ্রুত। এর ভিতরে মেসন (Meson) নামে কতগুলি কণা উড়ন্ত অবস্থায় বহুভাগে ভেঙে যায়। এই বিভাজন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে মেসনের গতি যত দ্রুত তার বিভাজনের সময় লাগে তত বেশি। এই ধরনের পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত : যাকে আমরা ব্যক্তিনিরপেক্ষ বিজ্ঞানের পরাকাষ্ঠা বলে মনে করতাম, ঘড়ি এবং ফুটবলের সাহায্যে করা সেই আবিষ্কারগুলিও আংশিকভাবে আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত পরিবেশের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ নির্ভরশীল পরিমাপ করা বস্তুপিণ্ড সাপেক্ষ আমাদের গতির চরিত্রের উপর।
এ থেকে বোঝা যায়, কতটা পর্যবেক্ষকের অধিকারে এবং কতটা যে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে তার অধিকারে এ সম্পর্কে প্রচলিত সীমারেখার বদলে ভিন্ন। একটি সীমারেখা আঁকতে হবে। নীল চশমা পরলে আপনি বুঝতে পারেন, আপনার দেখা সবকিছুর নীল রঙের কারণ ঐ চশমা। আপনি যা দেখছেন রঙটা তার অংশ নয়। আপনি যদি দুটি বিদ্যুৎচমক পর্যবেক্ষণ করেন, আপনার পর্যবেক্ষণ দুটির অন্তবর্তী সময় যদি আপনার জানা থাকে, বিদ্যুৎচমকের স্থানগুলি যদি আপনি জানেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোকের আপনার কাছে আসতে কতটা সময় লাগে সেটা যদি বিচারের ভিতর গ্রহণ করেন, আপনার কালমাপক যন্ত্র যদি নির্ভুল হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে দুটি বিদ্যুৎচমকের অন্তবর্তীকাল আপনি আবিষ্কার করেছেন, একথা আপনার পক্ষে ভাবা স্বাভাবিক। তাছাড়া এও ভাবতে পারেন এ আবিষ্কার আপনার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু নয়। অন্যান্য যে সমস্ত সতর্ক পর্যবেক্ষকের সংবাদ আপনার জানা সম্ভব, তারা যদি আপনার অনুমানের সঙ্গে একমত হন, তাহলে এই দৃষ্টিভঙ্গি আপনার কাছে সত্য বলে প্রতিপন্ন হবে। আসলে এর কারণ, আপনারা সবাই পৃথিবীবাসী এবং পৃথিবীর গতির অংশীদার। এমনকি বিপরীত অভিমুখগামী দুটি মহাকাশযানে অবস্থিত দুজন পর্যবেক্ষকের আপেক্ষিক বেগ (relative velocity) হবে ঘণ্টায় প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার মাইল। সেকেন্ডে ১,৮৬.০০০ (আলোকের বেগ) মাইলের তুলনায় এ বেগ অতি অল্প। সেকেন্ডে ১,৭০,০০০ মাইল বেগসম্পন্ন একটি ইলেকট্রন দুটি চমকের অন্তবর্তীকাল মাপলে, আলোকের বেগ গণনার ভিতর গ্রহণ করেও তার অনুমান হতো সম্পূর্ণ পৃথক। পাঠক জিজ্ঞাসা করতে পারেন : আপনি কি করে জানলেন? আপনি ইলেকট্রন নন, এই রকম ভয়ঙ্কর দ্রুত আপনি চলতে পারেন না, আপনার বিবৃতির সত্যতা প্রমাণ করার জন্য কোনো বৈজ্ঞানিকও পর্যবেক্ষণ করেননি। তা সত্ত্বেও এই দৃঢ় ঘোষণার সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে এবং পরের অংশে সে যুক্তি আমরা দেখব। প্রথম যুক্তি পরীক্ষাভিত্তিক, দ্বিতীয়টি যৌক্তিক। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার: এ যুক্তির ভিত্তি যে কোনো সময়েই করা যেত কিন্তু যতদিন পর্যন্ত পরীক্ষায় না দেখা গিয়েছে যে আগেকার যুক্তি নিশ্চয়ই ভুল ততদিন পর্যন্ত সে ভিত্তি তৈরি হয়নি।
অপেক্ষবাদের আবেদন একটি সাধারণ নীতির কাছে। দেখা গিয়েছে যে, কোনো লোকের অনুমানের চাইতে সে নীতি বেশি ক্ষমতাশালী। আপনি যদি জানেন, এক ব্যক্তি অন্য একজনের চাইতে দ্বিগুণ ধনী তাহলে তাদের সম্পদ পাউন্ড, ডলার, ফ্রাঁ কিংবা অন্য যে কোনো মুদ্রায়ই মাপুন না, কেন ব্যাপারটা একই রকম দেখাবে। সম্পদের পরিমাণজ্ঞাপক রাশির পরিবর্তন হবে, কিন্তু একটি রাশি সব সময়ই হবে অন্যটির দ্বিগুণ পদার্থবিদ্যায় হয়েছে একই রকম ব্যাপারের পুনরাবির্ভাব তবে আরো জটিলভাবে। যে কোনো গতিই আপেক্ষিক সুতরাং আপনি যে কোনো বস্তুপিণ্ডকেই প্রমাণ নির্দেশক বস্তুপিণ্ডরূপে (standard body of reference) গ্রহণ করে সমস্ত গতিকে সেই বস্তুপিণ্ড সাপেক্ষ গণনা করতে পারেন। আপনি যদি একটি ট্রেনে থাকেন এবং খাবার ঘরে হেঁটে যান তাহলে স্বাভাবিক কারণেই আপনি ট্রেনটাকে স্থির ভাবেন এবং আপনার গতি মাপেন ঐ ট্রেন সাপেক্ষ। কিন্তু আপনি যখন নিজের ভ্রমণের কথা চিন্তা করেন তখন আপনার বিচারে পৃথিবীটা স্থির। সে সময় বলেন-আপনি চলেছেন ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে। যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীর চিন্তন সৌরতন্ত্র নিয়ে তার বিচারে সূর্য স্থির এবং আপনি আবর্তনশীল (rotating) এবং ঘূর্ণায়ন (revolving)। এই গতির তুলনায় ট্রেনের গতি এত ধীর যে হিসাবেই আসতে চায় না। তারকীয় মহাবিশ্বে যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীর আকর্ষণ তিনি হয়তো এর সঙ্গে তারকার গড় গতি সাপেক্ষ সূর্যের গতি যোগ করবেন। আপনার গতি নির্ধারণের এই পদ্ধতিগুলির ভিতরে একটির চাইতে অন্যটি বেশি নির্ভুল, একথা আপনি বলতে পারেন না। নির্দেশবস্তুপিণ্ড যখনই আরোপিত হয় তখন প্রতিটি পদ্ধতিই বিশুদ্ধ নির্ভুল। অন্য সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন না করেও আপনি যেমন একটি সম্পদ বিভিন্ন মুদ্রায় গণনা করতে পারেন তেমনি বিভিন্ন নির্দেশ বস্তুপিণ্ডের সাহায্যে একটি বস্তুপিণ্ডের গতি নির্ধারণ করতে পারেন। এর ফলে সেই গতির সঙ্গে অন্য গতির সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হবে না। পদার্থবিদ্যার চিন্তনের সবটাই সম্পর্ক নিয়ে সুতরাং সংশ্লিষ্ট যে কোনো একটি বস্তুপিণ্ডকে প্রমাণ মাপক (standard রূপে গ্রহণ করে সমস্ত বস্তুপিণ্ডকে সেই মাপক সাপেক্ষ বিচার করে সম্পূর্ণ ভৌতবিধি প্রকাশ করা নিশ্চয়ই সম্ভব।
ব্যাপারটা অন্যভাবেও বলা যেতে পারে। পদার্থবিদ্যার উদ্দেশ্য ভৌতজগতে বাস্তবে কি ঘটেছে সে সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া। শুধুমাত্র একাধিক বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষকের একান্ত (privarte) অনুভূতি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া পদার্থবিদ্যার উদ্দেশ্য নয়। সুতরায় পদার্থবিদ্যার অবশ্যই ভৌত পদ্ধতির সেই সমস্ত অবয়ব নিয়ে চিন্তা করতে হবে যে অবয়বগুলি সমস্ত পর্যবেক্ষকের ক্ষেত্রেই সমরূপ : কারণ একমাত্র সেই অবয়বগুলিকেই ভৌতঘটনার নিজস্ব বলে ভাবা যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন, সে ঘটনা একজন পর্যবেক্ষকের কাছে কি রকম দেখায় কিংবা অপরের কাছে কি রকম দেখায় সে তথ্য নির্বিশেষে পরিঘটনা সম্পৰ্কীয় বিধিগুলির অভিন্ন হওয়া। এই একটিমাত্র নীতিই সমগ্র অপেক্ষবাদের উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্যই অপেক্ষবাদের জনক।
এতদিন পর্যন্ত আমরা যেগুলিকে ভৌতঘটনার স্থানিক এবং কালিক ধর্ম ভেবেছি এখন দেখা যাচ্ছে সেটা অনেকাংশে নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের উপর। শুধুমাত্র অবশিষ্ট অংশকেই ঘটনার নিজস্ব গুণ বলা যেতে পারে। যে ভৌতবিধির সত্য হওয়া সম্ভাবনা পূর্বত সিদ্ধ (a prion), সে বিধিগুলি গঠনে শুধুমাত্র এই অবশিষ্ট অংশই জড়িত হতে পারে। আইনস্টাইন হাতের কাছে শুদ্ধ গণিতের এই। অবশিষ্ট অংশই জড়িত হতে পারে। আইনস্টাইন হাতের কাছে শুদ্ধ গণিতের একটি সাধনী (instrument) পেয়েছিলেন, তার নাম টেন্সর (Tensor) তত্ত্ব। সে তত্ত্বের সঙ্গে প্রাচীন বিধির আসন্ন (approximate) ঐক্য থাকবে। সে সব ক্ষেত্রে অপেক্ষাবাদের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে প্রাচীন বিধির পার্থক্য, সে সব ক্ষেত্রে অপেক্ষাবাদের ভবিষ্যদ্বানীর সঙ্গে পর্যবেক্ষণের ঐক্য বেশি। এ তথ্য ইদানীংকাল পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে।
ভৌত জগতে যদি বাস্তবতা কিছু না থাকত, শুধুমাত্র যদি থাকত কিছু লোকের দেখা কয়েকটি স্বপ্ন তাহলে একজনের স্বপ্নের সঙ্গে আর একজনের স্বপ্ন সংযুক্ত করে কোনো বিধি আমাদের আশা করা উচিত হতো না। এক ব্যক্তির অনুভূতির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির অনুভূতির মোটামুটি তাৎক্ষণিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বিভিন্ন অনুভূতির সাধারণ বাহ্যিক উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস সৃষ্টি করে। আমরা যাকে একই ঘটনা বলি সে সম্পর্কে পদার্থবিদ্যা বিভিন্ন ব্যক্তির অনুভূতির ঐক্য এবং অনৈক্যের কারণ প্রদর্শন করে। এ কাজ করতে গেলে পদার্থবিদ্যাবিদদের প্রথম প্রয়োজন ঐক্যগুলি ঠিক কি সেটা নির্ধারণ করা। সেগুলি ঠিক ঐতিহ্যগত অনুমান নয়। কারণ এককভাবে স্থান কিংবা কালকে সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ বলে গ্রহণ করা যায় না। বস্তুনিষ্ঠ বলা যায় স্থান-কালের’ এক ধরনের মিশ্রণকে। এর ব্যাখ্যা সহজ নয় কিন্তু চেষ্টা করতেই হবে। সে চেষ্টা শুরু হবে পরের অধ্যায়ে।