কারও পদতলে বেহেস্ত নয়
বিশ-একুশ শতকে যোগাযোগ ব্যবস্থার এতো উন্নতি হয়েছে যে, তা কল্পনাও করা যায় না। ফলে পৃথিবীটা সত্যি খুবই ছোটো হয়ে গেছে। একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যও এখন আর আগের মতো অবিকৃত রাখা সম্ভব নয়। তাতে এসে মিশে যায় অন্য অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। চীনা খাবার সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। হাট-ডগ আর হ্যাম্বাৰ্গার এখন ঢাকা-কলকাতার তরুণ-তরুণীরা শখ করে খান! যে-ইংরেজরা পঞ্চাশ বছর আগেও ভাত চিনতেন না, রাইস-কারি না-হলে এখন তাদের মুখে রোচে না। কিন্তু সারা বিশ্বের দূরত্ব এতো কমে গেলেও, পৃথিবীর তাবৎ সমাজ অভিন্ন হয়ে যায়নি। সমাজ বরং বহু ভাগে বিভক্ত এখনো। কেবল একটা জায়গায় গোটা বিশ্বের সমাজ এখনো অভিন্ন–সব সমাজ পুরুষশাসিত। পেশী আর আয় করার ক্ষমতা দিয়ে এখনো পুরুষরা মহারাজা নিজের নিজের পরিবারে। এতো বড়ো অন্যায়কে জ্ঞানবিজ্ঞানের অসাধারণ উন্নতি সত্ত্বেও গোটা বিশ্ব মেনে নিয়েছে, এমন কি, সব ধর্মগ্রন্থও কমবেশি একে সমর্থন করেছে। সব ধর্মগ্রন্থেই বলা হয়েছে নারীরা পুরুষদের তুলনায় নিকৃষ্ট।
স্বামীর পদতলে নারীর বেহেস্ত–কোনো ধর্মগ্রন্থে এমন কথা লেখা নেই। তা সত্ত্বেও মনু থেকে শুরু করে আধুনিক ধর্মগুরুদের ফতোয়া কাজে লাগিয়ে নারীদের হীনতা এবং অধীনতাকে জোরদার করা হয়েছে। এক শতাব্দী আগে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো সমাজ-সংস্কারক তাই লিখেছিলেন যে, ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়েই মহিলাদের পদতলে রাখতে চেষ্টা করেন। পুরুষরা। তিনি আরও লিখেছিলেন যে, ধর্মপ্রবর্তকরা মহিলা হলে ধমীয় বিধিবিধান হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। বস্তৃত, ধর্মের নামে মহিলাদের শাসন-শোষণ করার অপচেষ্টা আজও অব্যাহত রয়েছে। তাই তসলিমা নাসরিনের মতো এ যুগের সংস্কারকরাও ধর্মের সমালোচনায় সোচ্চার হন।
একটু নজর দিলেই দেখা যায়, আজকের জ্ঞানবিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগেও পুরুষরা ধর্মগ্রন্থের দোহাইতো দেনই, তা ছাড়া আরও বিচিত্র উপায়ে স্ত্রীদের দাসীর মতো অধীনে রাখতে চেষ্টা করেন। না, ভুল বললাম, চাকরানির যে-সব মৌলিক অধিকার তাঁরা দিতে বাধ্য থাকেন, স্ত্রীকে তারও সবগুলো দেন না। প্রকৃত পক্ষে, যেসব কাজ চাকরানিরও করতে হয় না, স্ত্রীর তাও করতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর বৈষম্য এতো বেসুমার এবং পর্বতপ্রমাণ যে, তার গোটা কয়েক মোক্ষম দৃষ্টান্ত দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবু চেষ্টা করছি। যেমন, ভালো-ভালো রান্নার সিংহভাগ কে খায়? স্বামীরা, না স্ত্রীরা? ঘরের কাজগুলো সবই অথবা বেশির ভাগই কে করে? পুরুষরা, না মেয়েরা? অতি-প্রয়োজনীয় জিনিশের বাইরে যেসব ব্যয় করা হয়, সেই শখ পূরণের বেশির ভাগ ব্যয় কে বেশি করে? পুরুষরা, না। নারীরা? ন মাস ধরে গৰ্ভ ধারণ করার অসহ্য যন্ত্রণা কে সহ্য করে? পুরুষরা, না মেয়েরা? তার পর সেই সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব কে বেশি পালন করে? পুরুষরা, না মেয়েরা? এই সন্তান উৎপাদন এবং লালন-পালন করার ব্যাপারে বেশির ভাগ পুরুষের ভূমিকা কী? স্ত্রীকে একবার অথবা কয়েকবার যৌনসঙ্গম করে তার অমূল্য শুক্রাণু দান করা, এই তো! সেই যৌনসঙ্গমের সময়ে স্ত্রী সুখ অথবা চরম সুখ পেলেন। কিনা, তারও হদিস নেন। না পুরুষপ্রবর। তসলিমা নাসরিন যে লিখেছেন, “প্রতি রাতে আমার বিছানায় এসে শোয় এক নপুংসক পুরুষ। … আমাকে উত্তপ্ত করে নপুংসক বেঘোরে ঘুমোয়।”–সে কথা খাঁটি, সর্বাংশে।
কিন্তু স্ত্রীকে শোষণ করে যে সুখ নেই, এমন কি উপযুপরি রমণ করেও সুখ নেই, এটা পুরুষরা অনেক কাল আগেই টের পেয়েছিলেন। ভাষাহীন বালিশ অথবা বস্তার সঙ্গে আদানপ্রদান হয়? অশিক্ষিত স্ত্রী কি একজন শিক্ষিত পুরুষের সঙ্গিনী হয়ে উঠতে পারে? পুত্র জন্ম দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে সত্যিকারের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটা উপভোগ্য সম্পর্ক তৈরি হতে পারে? পারে না। ধরা যাক, সমাজে কৃতিত্বযোগ্য কিছু করলে বাড়িতে এসে স্ত্রীকে সেটা খবর হিশেবে জানানো সহজ, কিন্তু তার মর্ম অথবা গুরুত্ব শিক্ষাহীন অথবা বঁদিমার্কা স্ত্রী অনুভব করতে পারবেন। কি? পারবেন না। তাই উনিশ শতক থেকে গোটা বিশ্বেই শিক্ষার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের মধ্যে এক অপূর্ণতার ভাব দেখা দেয়। সেই অভাববােধ থেকে দেখা দেয় স্ত্রীকে শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন।
লক্ষ্য করবেন, মেয়েদের স্কুলে যারা লেখাপড়া শেখে, তারা স্ত্রী নয়, বালিকা; তা সত্ত্বেও বাংলায় সেই শিক্ষাকে বলে স্ত্রীশিক্ষা। তার কারণ, উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষিত পুরুষরা গোপনে স্ত্রীদেরই প্রথমে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। মেয়েদের শিক্ষার নাম তাই হয়ে যায়, স্ত্রীশিক্ষা। তা ছাড়া, পরে যখন বালিকাদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়, তখনও তাকে বলা হয় স্ত্রীশিক্ষা। কারণ, মেয়েদের স্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়াই ছিলো তার উদ্দেশ্য। সে যুগে, এমন কি, বিশ শতকের গোড়াতেও, মেয়েদের লিখতে-পড়তে শেখানো হতো, কিছু অঙ্ক করা শেখানো হতো, কিন্তু গুরুত্ব দেওয়া হতো চিঠি লেখার ওপর। বেচারা বালিকারা না-প্ৰেম জানতো, না-জানতো প্রেমপত্র লেখার উপযুক্ত ভাষা। তাই সেকালে চিঠি লেখার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু এ ধরনের শিক্ষার আয়োজন করলেও কর্তারা অথবা সাহেবরা মেয়েদের পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। কোনো কোনো সংস্কারক বরং মেয়েদের গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদির মতো বিষয় না-শেখানোর দাবি করেছেন। তাদের মতে, এ সব বিষয় শেখালে নারীদের কোমলতা বিনষ্ট হতে পারে।
বিশেষ করে এ ধারণা তখন জন্ম নেয়নি যে, নারীও মানুষ এবং সব ব্যাপারে তারা পুরুষের সমান। সত্যি বলতে কি, এ শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন বঙ্গদেশ কেন, পৃথিবীর অন্য কোনোখানেও বিশ শতকের আগে দেখা দেয়নি। বিশ শতকে এসে তবেই পশ্চিমা জগৎও স্বীকার করলো যে, মেয়েরাও মানুষ এবং তাদের শিক্ষা লাভের অধিকার আছে। অবশ্য তখনও পুরুষকুলের বিশ্বাস থাকলো যে, মেয়েদের মেধা পুরুষের তুলনায় নিম্নমানের। লেখাপড়ায় তাঁরা চিরদিন পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে থাকবেন। সুতরাং তারা যখন অফিসে কাজ করতে আরম্ভ করেন, তখন তা হলো কনিষ্ঠ কেরানির। তা ছাড়া, মেয়েদের জন্যে বেতনও নির্ধারিত হলো পুরুষের তুলনায় কম। ১৯৮৬ সালের আগে পর্যন্ত ব্রিটেনেও এ অন্যায় নিয়ম বেআইনী বলে বিবেচিত হয়নি। এমন কি, তখনো এ ধারণা বহুলভাবে প্রচলিত ছিলো যে, ব্যবস্থাপনার কাজে তাদের ওপর নির্ভর করা যায় না। এমন কি, শয্যায়ও তারা নিম্নশ্রেণীর। সেখানে তারা তুলনামূলকভাবে অসক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন। দাপাদাপি করে সুখ নেবেন পুরুষরা।
তবে নারীদের ইতর শ্রেণীর জীব হিশেবে গণ্য করলেও, এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে নিজেদের সঙ্গী করে তোলার প্রয়োজনীয়তা পুরুষরাই অনুভব করেছিলেন, এবং নিজেদেরই স্বার্থে। তাই তার জন্যে উদ্যাগও গ্ৰহণ করেছিলেন তারাই। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত নারীমুক্তির যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেসব বেশির ভাগই হলো: সেই উদ্যোগের কথা–নারীর অবস্থার উন্নতির জন্যে পুরুষরা কী কী করেছেন, তার ইতিহাস। পরবর্তী পর্যায়ে প্রশ্ন দেখা দিলো: পুরুষদের এই তথাকথিত নারীমুক্তির প্রয়াসে মহিলারা কিভাবে সাড়া দিয়েছেন। তার চেয়েও বড়ো কথা নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্যে মহিলারা নিজেরা কী করেছেন? সে জন্যে মোটামুটি ১৯৮০-এর দশক থেকে নারীমুক্তির ইতিহাসের বিষয়বস্তু পাল্টে গেলো। যেমন, বাঙালি মহিলাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে রামমোহন রায়, গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, দুৰ্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সমাজ-সংস্কারক যে-আন্তরিক প্রয়াস চালিয়েছিলেন সে কথা উষা চক্রবর্তী পর্যন্ত অনেকেই লিখেছিলেন। কিন্তু মহিলারা পুরুষদের সেই প্রচেষ্টার প্ৰতি কেমন সাড়া দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আমিই প্রথম বই লিখি “রিলাক্টেন্ট ডেবিউটেন্ট” নামে, ১৯৮২ সালে। এ বইয়ের নাম থেকে পুরুষদের প্রয়াসের প্রতি প্ৰথম দিকের মহিলাদের উৎসাহের অভাবই বোঝা যায়। বই-এর উপশিরোনামে আমি তাই আর-একটু ব্যাখ্যা করে লিখি “রেসপন্স অব বেঙ্গলি উইমিন”। তারপর বাঙালি নারীদের উন্নতির ইতিহাস মেরেডিথ বোর্থউইক, মালবিকা কার্লেকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত, সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, চিত্রা দেব ইত্যাদি অনেকেই লিখেছেন। তারাও সবাই পুরুষদের প্রয়াসের বদলে মহিলাদের প্রচেষ্টা এবং প্রতিক্রিয়ার প্রতি বেশি জোর দিয়েছেন।
মেয়েদের মধ্যেও এ সময়ে নারীমুক্তির ধারণা পাল্টে যায়। এক সময়ে মনে করা হতো, মেয়েরা একটু লেখাপড়া শিখলে, বাইরে চলাফেরা করতে পারলে, আধুনিকা ও কেতাদুরস্ত হলে, সন্তান মানুষ করতে পারলে, স্কুলে শিক্ষকতা অথবা অফিসে সেক্রেটারির কাজ পারলে অথবা নার্স হতে পারলে, তার ওপর আবার একটু গানটান জানলে–ব্যস, তাঁরা হলেন বিদগ্ধ, শিক্ষিত, মুক্ত নারী। কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এসে এ ধারণায় ফাটল ধরে। এ সময়ে মেয়েরা উচ্চশিক্ষার দিকে গেলেন। কেবল তাই নয়, তারা ছেলেদের চেয়ে ভালো ফলাফল করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি পেলেন। অপর পক্ষে, তাদের বড়াই-করা পুরুষ বন্ধুরা থাকলেন পিছিয়ে। অন্যান্য পেশাতেও তেমনি পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করলো।
এখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও মহিলারা অনেক পুরুষালি কাজ করছেন। গাড়ি চালান, বিমান চালান, পুলিশে কাজ করেন, এমন কি ফৌজী বাহিনীতে যোগ দেন। জজ, ব্যারিস্টার, ডিসি, সচিবের তো কথাই নেই। দেশের অনেক পার্লামেন্ট সদস্যই মহিলা। এমন কি, বাংলাদেশে পর-পর দু-দুজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী হলেন। এঁদের “ম্যাডাম, ম্যাডাম” করে পুরুষরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, একজন মহিলাও কর্তৃত্বের পদে বসতে পারেন, এবং বসলে তাঁকে মান্য করতে হয়। সত্যি বলতে কি, রাজনীতির মাধ্যমে মেয়েদের সমান অধিকার যতোটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। এ কথা পশ্চিমা জগৎ সম্পর্কে যেমন সত্য, তেমনি সত্য ভারত, বাংলাদেশ, শ্ৰীলঙ্কা, এমন কি, পাকিস্তান সম্পর্কেও। খালি মধ্যপ্রাচ্যে এখনো ধর্মের মোটা বোরকা দিয়ে এই অধিকার ঢেকে রাখা হয়েছে।
নারীদের প্রতি পুরুষ সমাজের ধারণা একদিনে বদলে যায়নি। অন্তত দেড় শো বছর লেগেছে তার জন্যে। তার ফলে এখন পুরুষদের সঙ্গে বৈষম্যের আইন এবং রীতি দূর হয়েছে। মোটামুটি সমান অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই স্বীকার করতে হবে, এসবের ফলে পরিবার এবং সমাজে নারীদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি পাল্টে গেছে অনেকাংশে। স্বামীদের কাছ থেকে তারা যা আশা করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পূরণ হয় না। ফলে কেলেঙ্কারীর ভয়ে বিবাহবিচ্ছেদ না-করলেও, পরিবারের ভেতরে আগের তুলনায় মন কষাকষি এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব হলো নারীমুক্তির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক। বিশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে নারীমুক্তি কেবল নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করার চেষ্টাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তার ঝোকটা পাল্টে গেছে–এখন আর নারীর উন্নতি নয়, যথার্থভাবেই এবং যুক্তিসঙ্গতভাবেই নারীও যে পুরুষদের মতো সমান মানুষ-নারীসমাজ এটার দিকেই নজর দিয়েছেন। যতো দিন নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না, ততোদিন পুরুষরা অনুগ্রহ করে যেটুকু দিতেন–এমন কি, শয্যায়ও যতোটুকু দিতেন, সেটাকেই সাধারণ মেয়েরা মেনে এসেছেন স্বাভাবিক বলে, কিন্তু জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার পর তার স্বাদ পেয়ে তাদের মনের অবস্থা এবং প্রত্যাশা বদলে গেছে দ্রুত গতিতে।
অধিকার সম্পর্কে অনেক মহিলা সচেতন হয়েছিলেন উনিশ শতক থেকেই। তাদের সংখ্যাও বাড়ছিলো। অবশ্য পরিবেশ অনুকূল না-থাকায় লড়াইতে তাঁরা তেমন জুত করতে পারেননি। লেখাপড়া করতে গেলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার দিলো না। (অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ এই অধিকার দেয় ১৯২০ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে।) মেয়েরা সম্পত্তিতে অধিকার চাইলেন, কিন্তু ১৮৮৫ সালের আগে ব্রিটেনে তার কোনো স্বীকৃতিই ছিলো না। তাদের সেই অধিকার ধাপে ধাপে স্বীকৃত হয় এক শো বছর ধরে। এখন বিয়ে না-করে আপনি কোনো মেয়ের সঙ্গে ছ। মাসের বেশি একত্রে বাস করলে তিনি আপনার সম্পত্তিতে অধিকার দাবি করতে পারেন! মেয়েরা ভোটাধিকার চাইলেন, কিন্তু পঞ্চাশ বছরের চেষ্টাতেও তা পেলেন না। (আর কোনো কোনো আরব দেশ এখনো সে অধিকার দেয় নি!!)
মেয়েদের ঠেকিয়ে রাখার নানা উপায় ছিলো। সবচেয়ে বড়ো উপায় ছিলো সামাজিক এবং রাষ্ট্ৰীয় কাঠামোয়। সেখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিলো পুরোপুরি পুরুষদের হাতে। তা ছাড়া, মেয়েদের অত্যাচার বলছিনে, কিন্তু দমিয়ে রাখার আরও উপায় ছিলো। তাঁদের গর্ভবতী করে দিতে পারলে দুতিন বছরের জন্যে বেশ নিশ্চিন্ত থাকা যেতো। গৰ্ভবতী হওয়াও ছিলো খুব সহজ। জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় ছিলো মা–কনডম ছিলো না, অপারেশান ছিলো না, পিল ছিলো না, গর্ভপাতের ব্যবস্থাও ঙিলো অপ্রতুল। সুতরাং তাদের ওপর কয়েকবার চেপে বসতে পারলেই গর্ভ হতো। এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের মায়ের চোদ্দোটি সন্তান হয়েছিলো। তা-ও দেবেন্দ্রনাথ বেশির ভাগ সময় কলকাতায় থাকতেন না। এমন চোদ্দো সন্তানের জননীর শ্বাস ফেলার সময় আছে! অথবা স্বাধীনতা কী বস্তু, তা ভাববার!
এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে পরিবারের ভেতরে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করা ছিলো একেবারে অত্যাবশ্যক। এই উন্নতির একটা অংশ ছিলো সন্তানদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। তাই গৰ্ভ ঠেকিয়ে রাখার উপায় নিয়ে তারা গবেষণা করতে থাকেন। একটা সনাতন উপায় তো ছিলোই! গৰ্ভপাত ঘটানো। (অবাঞ্ছিত গৰ্ভ হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ জন্যে মেয়েদের খুনও করা হতো!), কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে কিভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে, নিরাপদে গর্ভপাত করা যায়, তার ব্যবস্থা হতে থাকে। এমন কি, একজন দুঃসাহসী মহিলা লন্ডনে গর্ভপাত করার একটা ক্লিনিকও খুলে বসলেন সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু সমাজের বিরোধিতার মুখে সেখানে সহজে সাফল্য আসতে পারেনি। ধর্মীয় চাপও কম প্ৰবল ছিলো না। এখনো ক্যাথলিক দেশ আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত করা নিষিদ্ধ। কয়েক বছর আগে একটি পনেরো বছরের মেয়েকে তার বাবার বন্ধু ধর্ষণ করে গর্ভবতী করেন। তবু সেই মেয়েটিকে গর্ভপাত করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তারপর সে দেশে গর্ভপাত নিয়ে যে-গণভোট হয়, তাতেও গর্ভপাতের অধিকার স্বীকৃত হয়নি। আর, অ্যামেরিকায় আইন থাকলেও সেখানেও একটা বিরাট গোষ্ঠী এর তীব্র বিরোধী। যে-ডাক্তাররা গর্ভপাত করেন, তাদের খুন করার ঘটনাও ঘটেছে সেখানে।
তা সত্ত্বেও মহিলারা থেমে থাকলেন না। গর্ভের সঙ্গে যুক্ত অন্য তাবৎ বিষয় নিয়ে তাঁরা গবেষণা করতে থাকলেন। এমন কি, এ ব্যাপারে পুরুষ বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে আসেন। মেয়েদের সাধারণত কখন গৰ্ভ হয়, গর্ভের সঙ্গে হমেীনের যোগাযোগ কী, সেই হর্মেীনের নিয়ন্ত্রণ করে কিভাবে গৰ্ভ ঠেকিয়ে রাখা যায় ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়েই তারা গবেষণা করতে থাকেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধেই তারা সেটা আবিষ্কার করে ফেলেন। এমন কি, সে রকমের গর্ভনিরোধক বড়িও তৈরি করেন তারা। কিন্তু ১৯৬০ সালের আগে সরকারী অনুমোদন মেলেনি সে বড়িকে আইনসঙ্গতভাবে ব্যবহার করার।
সম্প্রতি (২০০৪) ঢাকার কালি ও কলম পত্রিকায় এই বড়ি বা পিল সম্পর্কে অত্যন্ত তথ্যমূলক এবং মূল্যবান প্ৰবন্ধ লিখেছেন পূরবী বসু। পিল সম্পর্কে যাঁরা আরও জানতে চান, তারা এই প্ৰবন্ধ পড়ে দেখতে পারেন। এই পিল কি করে আবিষ্কার হলো, কারা তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন, এই পিলের গুণাগুণ কী ইত্যাদি সব খবরই আছে। এই প্রবন্ধে। সেই সঙ্গে এই পিল নারীমুক্তিতে যেঅসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে, তারও বিবরণ দিয়েছেন পূরবী বসু। কিন্তু তাঁর প্ৰবন্ধের সমালোচনা হয়েছে। এমন কি, আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েরাও সমালোচনা করেছেন। তাঁরা বিশেষ করে জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্যের ওপর পিলের কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে, তার ওপর। যেমন, তাঁরা বলেছেন যে, বহু বছর ব্যবহার করলে পিল থেকে কোনো কোনো রকমের রোগ হওয়া অসম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি, কোন ওষুধটা আছে এই পৃথিবীতে, যা বহু বছর ব্যবহার করলে তা থেকে আর একটা রোগ দেখা দিতে না-পারে? সুতরাং পিলের এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলে পিলের গুণ এবং তার ভূমিকাকে ছোটো করে দেখা আসলে অযৌক্তিক; এবং তা হলে সেটা হবে একটা মহান ব্যাপারকে ছোটো করে দেখার সামিল। পিল ব্যবহারের ফলে মহিলারা নিজেদের পরিবারের আয়তন নিয়ন্ত্রণের অসামান্য অধিকার পেয়েছেন। এমন কি, অনেক মহিলা গোপনে পিল খেয়ে স্বামীর অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করেছেন। পিল যুগ যুগ জীউ!
জন্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া, পিলের সঙ্গে নারীমুক্তির ইতিহাসের আর-একটা যোগাযোগ ঘটলো পিল বাজারে ছাড়া পাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে। আমার ধারণা, সেই অসাধারণ ঘটনার কথা না-বললে নারীমুক্তির ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক অকথিত থেকে যায়। সন্তানের সংখ্যা সীমিত রাখার সুযোগ পেয়ে যৌনতার একটা ফলাফল থেকে মহিলারা বেঁচে গেলেন। কিন্তু তা দিয়ে তাদের সমস্ত অধিকার আদায় হলো না। মহিলারা যৌনতা কতোটা উপভোগ করেন, কতোটা উপভোগ করতে চান, পুরুষ সে প্রত্যাশা কতোটা পূরণ করেন–এসব তখনো অজানা ছিলো। আন্দাজঅনুমানের ওপর ভিত্তি করেই নারী এবং পুরুষ গবেষকরা এসব নিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু বিবাহিত না হয়েও যে মহিলারা যৌনসুখ প্রত্যাশী হতে পারেন, তা পরিষ্কার হয়ে গেলো। কয়েক বছরের মধ্যে। ১৯৬২ সালে প্ৰকাশিত “সেক্স এবং দ্য সিঙ্গল গ্যার্ল” নামে একটি বই বিক্রয় তালিকার শীর্ষে চলে গেলো। কয়েক বছরের মধ্যে অবিবাহিত মেয়েদের যৌনতা নিয়ে আরও কয়েকটি বই এবং কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু একেবারে নতুন দিগন্ত খুলে গেলো। ১৯৬৬ সালে–মাস্টার্স এবং জনসনের বই প্ৰকাশিত হওয়ার পরে।
উইলিয়াম মাস্টার্স এবং ভ্যার্জিনিয়া জনসন এগিয়ে এসেছিলেন মধ্যবিত্ত নারীদের যৌনতা সম্পর্কে গবেষণা করার জন্যে। এরা ৬৯৪ জন পুরুষ এবং মহিলার চরম যৌনসুখ সম্পর্কে গবেষণা করেন। এবং সেই গবেষণার ভিত্তিতে ১৯৬৬ সালে তাঁরা “হিউম্যান সেন্ধুয়াল রেসপন্স” নামে একটি বই লেখেন। তাতে পুরুষদের যৌনতা সম্পর্কে পিলে চমকে দেওয়ার মতো কোনো তথ্য ছিলো না, কিন্তু ছিলো মেয়েদের যৌনতা সম্পর্কে। বিশেষ করে তাদের যৌনজীবনের অপূর্ণতা এবং হতাশা সম্পর্কে। তাতে দেখা যায় যে, মেয়েরা পুরুষদের মতোই যৌন আনন্দ উপভোগ করতে সমর্থ এবং আগ্রহী। তবে পুরুষরা স্বার্থপরতার কারণে তাদের স্ত্রী অথবা মেয়েবন্ধুর যৌনজীবনের পরিপূর্ণতার খবর রাখেন না। অথবা তাঁদের হতাশা থাকলে তা দূর করার কোনো সক্রিয় প্ৰযত্ন করেন না। এই জন্যে এই গবেষকরা উপদেশ দেন যে, তাদের নারীসঙ্গিনীর যৌনতৃপ্তি দিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ কমানোর জন্যে পুরুষদের আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে। এই গ্ৰন্থ যে মহিলাদের যৌনতা সম্পর্কে বহু নিষিদ্ধ ধারণাকে বরবাদ করেছিলো, এ সম্পর্কে সন্দেহ নেই। এবং অনেকটা এর ফল হিশেবে মহিলারা বিবাহ সম্পর্কের মধ্যে থেকেও নানা উপায়ে অথবা বিবাহ বহির্ভূত নানা সম্পর্কের মাধ্যমে যৌনসুখ পাওয়ার ব্যাপারে আগের তুলনায় বেশি আগ্রহী এবং উৎসাহী হন। লেজবিয়ান সম্পর্কও এ সময়ে জোরদার হতে থাকে।
একবার মাস্টার্স এবং জনসনের বই প্ৰকাশিত হওয়ার পর এ ব্যাপারে বই লেখার অথবা যৌনসুখ বাড়ানোর উপায় নিয়ে বই লেখার আরও কোনো বাধা থাকলো না। ১৯৭১ সালে ডেইভিড রুবেন লেখেন “অ্যানি উম্যান ক্যান” এবং তার চেয়েও মূল্যবান এবং সচিত্র বই অ্যালেক্স কমফটের “দ্য জয় অব সেক্স” (১৯৭২) এবং “মোর জয় অব সেক্স” (১৯৭৪)। সত্যি বলতে কি, মাস্টাস অ্যান্ড জনসনের-এর গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর আরও বহু গবেষণা হয়েছে এবং তার ফলাফল প্ৰকাশিত হয়েছে। তা থেকে দেখা যায় যে, প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ মহিলা কোনো সময়ই চরম সুখ পান না। চরম সুখ পাওয়ার জন্যে যে-শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা দরকার, তাদের তা নেই। ব্যাপারটা কি, তা-ই তারা জানেন না। অপর পক্ষে, যারা চরম সুখ পেতে শারীরিকভাবে সক্ষম, তেমন মেয়েরাও বেশির ভাগই সময়ই পুরুষ-শরিকের নিস্ক্রিয়তার ফলে চরম সুখ লাভ করেন না। তাঁরা যে চরম সুখের খোজে বিবাহবহির্ভূত নানা রকম সম্পর্ক গড়ে তুললেন, তাকে অনেক পুরুষ, এমন কি, অনেক সনাতনপন্থী মহিলাও এক কথাতেই অ-সতীত্ব বলে মার্কা মেরে দিলেন। অর্থাৎ বহু শতাব্দীর বঞ্চনা এবং প্রবঞ্চনাকে এতো দিন সতীত্বের নামে গৌরবারোপিত করে ঢেকে রাখা হয়েছিলো, কিন্তু পিল এসে সতীত্বের সেই কিংবদন্তীকে ভেঙে দিলো।
অথচ তত্ত্বত এটা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, অন্য পাঁচজন মানুষের অর্থাৎ পুরুষ মানুষের মতো মেয়েদেরও যৌনজীবনের পরিপূর্ণতা লাভের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এবং সে অধিকার পূরণ না-হলে মানুষ হিশেবে সে নারীর জীবনে পূর্ণতা আসতে পারে না, স্বাধীনতা লাভ দূরে থাক। মহিলাদের মুক্তির এই দিকটা উন্মুক্ত করে দিয়েছে পিল। পূরবী বসু পিলের অন্য দিকটা নিয়ে বললেও নারীমুক্তির একটা বড়ো দিকে তার ভূমিকা কী, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেননি।
প্রসঙ্গত নারীমুক্তির আরও কয়েকটি দিক সম্পর্কে বলা দরকার। কারণ এ সম্পর্কে আমাদের দেশের সর্বশক্তিমান পুরুষদের ধারণা তো ভ্ৰান্ত বটেই, এমন কি, শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মহিলাদের ধারণাও ভ্ৰান্ত। বেশির ভাগ লোকই মনে করেন যে, নারী স্বাধীনতার মানে হলো নারীদের শিক্ষা, চার দেওয়ালের বাইরে যাওয়ার অধিকার, এবং পরিবারের মধ্যে খানিকটা অধিকার লাভ, বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে অধিকার। কিন্তু এইটুকু নিয়েই কি একজন নারী তাঁর জীবনের পরিপূর্ণতা অনুভব করতে পারেন?
সমস্যাটা মেয়েদের নিজেদের লেখা থেকে আমি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। প্রথমে পড়ি চীনা মহিলাদের লেখা একটি বই। এতে তাঁরা লিখেছিলেন যে, গৃহবধূ। হিশেবে বেঁচে থাকার ব্যাপারেই তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিরক্তি ধরে গিয়েছিলো তাদের জীবনেই। তারা তাই মনে করলেন, তারা এমন একটা কিছু করবেন যা থেকে সন্তোষ এবং পরিপূর্ণতার স্বাদ পেতে পারবেন। এ জন্যে তাঁরা দশ পনেরোজন মিলে একটি ছোটো কারখানা করলেন। সেখানে ছোটো ছোটো খেলনা তৈরি করতে আরম্ভ করেন তারা। তাদের এই প্ৰয়াস দু’দিক থেকে সফল হয়একদিকে, এ থেকে তাঁরা টাকা পয়সা উপার্জন করার সুযোগ পান, কিন্তু তার চেয়েও বড়ো একটা আনন্দ পান এই ভেবে যে, বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে তাঁরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। অর্থাৎ তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী নারীর জীবনের পরিপূর্ণতা লাভের জন্যে তাঁদের রীতিমতো সমাজ এবং অর্থনীতিতে একটা অর্থবহ। ভূমিকা রাখতে হবে। নারী-জীবনের সাফল্যের অন্যান্য দিকের মধ্যে আছে পুরুষদের সমান অধিকার লাভ, ব্যবস্থাপনার কাজে অধিকার, নেতৃত্ব দানের অধিকার। এবং তারা যে যে-কোনো পুরুষের সমান মেধার অধিকারী এবং যে-কোনো কাজ করার মতো ক্ষমতার অধিকারী–এই ধারণাও তারা প্ৰতিষ্ঠা করতে চান।
বাঙালি অথবা পশ্চিমা মহিলাদের সঙ্গেও আলাপ করে বোঝার চেষ্টা করেছি, কী তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ–অর্থাৎ পারিবারিক জীবনের বাইরে। তাতে আমার মনে হয়েছে, পরিবারে স্বামী, সন্তান এবং স্বামীর ও নিজের তরফের আত্মীয়দের নিয়ে যেপরিধি রচিত হয়, তার মধ্যে থেকেই তারা ঠিক সুখী হন না। বরং তার বাইরে চাকরি সূত্রে তাদের যে একটা পরিচিতি এবং বন্ধুত্বের মহল তৈরি হয়, সেখানে তাঁরা জীবনের সফলতা খোঁজেন। সেখানে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু করতে পারলে তৃপ্তি পান। অপর পক্ষে, সেখানে ব্যর্থ হলে বিষাদ নেমে আসে।
সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মহিলাদের ভাবমূর্তিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে প্রকাশ্য সমাজে মহিলা বলতে বোঝাতো গুরুগম্ভীর, বোবার মতো একজন মানুষ; কিন্তু নারীমুক্তির ধারণা এসে তাঁদের কথা বলার, তর্ক করার এবং বক্তব্য রাখার অধিকার দিলো। তাঁরা আর চুপ করে থাকলেন না। তাঁরা রসিকতা করতে আরম্ভ করলেন। এমন কি, এ রকমের রসিকতা, যা আগে পুরুষের একচেটিয়া ছিলো। তাঁরা প্রকাশ্যে খিলখিল করে হাসতে শুরু করলেন, যেটাকে আগে মেয়েদের জন্যে অভব্যতা বা অশিষ্ট বলে মনে করা হতো। এখনো এ ধারণা যে একেবারে চলে গেছে, তা নয়। কদিন আগেও রিপা নামে আমার এক পাঠিকা। আমাকে লিখেছেন যে, তিনি জোরে হাসায় তাঁর বড়োকর্তা–ব্যাংকের ম্যানেজার–এসে তাঁকে শাসন করেন।
সমাজে যখন নারীদের জায়গাটা প্রশস্ত হলো, তখন পোশাকের দিকেও তারা মজর দিলেন। এমন কি, নিজের শরীরে যেসব সৌন্দর্যের বস্তু আছে, তাও অল্পবিস্তর প্ৰকাশ করতে আরম্ভ করেন। কারণ, তা দিয়ে তারা সমাজের আর-পাঁচজন মানুষমারী ও পুরুষ–উভয়কেই মুগ্ধ করতে চেষ্টা করেন। কোনো একটা পোশাক পরে অফিসে অথবা পার্টিতে গেলে যদি স্মার্ট লাগে, সুন্দর লাগে, তা হলে সে পোশাক তারা কেন পরবেন না? কেন তা দিয়ে অন্যের চোখে নিজের একটি প্রভাব বিস্তার করার মতো ভাবমূর্তি গড়ে তুলবেন না?
পশ্চিমা দেশগুলোতে এখন নারীর সমান অধিকার কমবেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যারা নারীদের নির্যাতিত একটি শ্রেণী হিশেবে দেখতেন এবং সেই শ্রেণীর সদস্য হিশেবে নিজেদের শনাক্ত করতেন, অর্থাৎ নিজেদের নারীবাদী হিশেবে চিহ্নিত করতেন, তারা যে তাই বলে সুখী হয়েছেন, তা মনে করার অবশ্য কারণ নেই। কারণ, বৈষম্য দূর হলে অথবা সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই সুখ আসে না। সুখ একটা মানসিক অবস্থা। সে জন্যে নারীবাদীরা এখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, অতঃপর কী? অধিকার, প্রতিষ্ঠা, জীবনের সাফল্য, পুরুষের সমান হওয়ার বাসনা–সবই দরকার; কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে: জীবনে সুখী হচ্ছি। তো? অনেক লড়াইয়ের পর পোস্ট-ফেমিনিস্টরা এখন কী পাইনি তার হিশাব মিলাতে ব্যস্ত। কিন্তু, তওবা, অন্তত ফের তারা পুরুষের পদতলে বেহেস্ত খুঁজবেন না!
(যুগান্তর, জানুয়ারি ২০০৫)