দ্বিতীয় অধ্যায় – কাম-বিক্রম
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর, মরীচি অত্রি প্রভৃতি সেই মুনিগণ, ব্রহ্মার অভিপ্রায় বুঝিয়া সেই পুরুষের অনুরূপ নামকরণ করিয়াছিলেন। ১
আর সেই দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণ, ব্রহ্মা মুখের দিকে চাহিলেন দেখিয়াই বৃত্তান্ত বুঝিয়া তাহার উপযুক্ত স্থান নির্দেশ ও পত্নী দান করিয়াছিলেন। ২
হে দ্বিজোত্তমগণ। মরীচি প্রভৃতি বিপ্ৰমণ্ডলী, নিশ্চয় করিয়া এই পুরুষের নিকট সঙ্গতভাবে তদীয় নাম কীর্তন করিতে লাগিলেন। ৩
যেহেতু তুমি আমাদিগের এবং বিধাতার চিত্ত মথিত করিয়া উৎপন্ন হইয়াছ, এইজন্য লোকে তুমি মন্মথ নামে অভিহিত হইবে। ৪
তুমি জগতের অসাধারণ কামরূপী; তোমার সদৃশ কেহ নাই। অতএব হে মনোভব! তুমি কাম নামে বিখ্যাত হও। ৫
লোককে মত্ত কর বলিয়া তোমার নাম মদন; আর তুমি মহাদেবের দর্পনাশে সমর্থ বলিয়া দর্পক এবং কন্দর্প নামে জগতে বিখ্যাত হইবে। ৬
তোমার পঞ্চশরের যে রূপ পরাক্রম; বৈষ্ণবাস্ত্র, রৌদ্রাস্ত্র এবং ব্রহ্মাস্ত্রেরও তাদৃশ পরাক্রম নহে। ৭
স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল বা সনাতন ব্রহ্মলোক–সকল স্থানেই তুমি থাকিবে; যেহেতু তুমি সৰ্বব্যাপী। অধিক বলিয়া কি হইবে? ফল কথা এই যে, তোমার সমান কেহ নাই। ৮
তৃণ হউক আর বনস্পতিই হউক, প্রাণী যে যে স্থানে থাকিবে, ব্ৰহ্মসভা হইতে তত্তৎ সমুদয় স্থানই তোমার হইবে। ৯
হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! এই আদি প্রজাপতি স্বয়ং দক্ষই তোমার ইচ্ছামত শোভনা পত্নী প্রদান করিবেন। ১০
আর ব্রহ্মার মানসজাতা এই সুন্দরী কন্যা ত্রিভুবনে সন্ধ্যা নামে বিখ্যাতা হইবেন। ১১
যেহেতু এই বরবৰ্ণিনী ব্রহ্মার সম্পূর্ণ ধ্যানসময়ে উৎপন্ন হইয়াছেন, সেইজন্য জগতে ইহার ‘সন্ধ্যা’ বলিয়া প্রসিদ্ধি হইবে। ১২
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–হে দ্বিজবরগণ! সেই মুনিগণ, এই কথা বলিয়া ব্রহ্মার মুখাবলোকনপূর্বক তাহার সম্মুখে বিনয়-নম্রভাবে মৌনী হইয়া রহিলেন। ১৩
হে দ্বিজোত্তমগণ! অনন্তর কামদেব-রমণী ভ্রূ-সদৃশ বক্র, উন্মাদননামক কুসুমনিৰ্মিত শরাসন এবং হর্ষণ, রোচন, মোহন, শোষণ ও মারণ নামে প্রসিদ্ধ, মুনিদিগেরও জ্ঞাননাশক, পুষ্পময় পঞ্চশর গ্রহণ করিয়া সেইখানেই প্রচ্ছন্নরূপে অবস্থিতি করা কর্তব্য চিন্তা করিতে লাগিলেন। ১৪-১৬
ব্রহ্মা আমার যে নিত্যকৰ্ম্ম স্থির করিয়া দিয়াছেন, তাহার পরীক্ষা এই খানে মুনিগণ সন্নিধানেই এই ব্রহ্মার উপরেই করিয়া দেখি। ১৭
এখানে মুনিগণ আছেন; দক্ষ প্রজাপতি আছেন; স্বয়ং ব্রহ্মাও আছেন, আর এই বরাঙ্গনা সন্ধ্যাও এখানে অবস্থিত। ১৮
এই সকল পুরুষ এবং সন্ধ্যাও আজ আমার শরব্য হইবেন। ১৯
“অন্য প্রাণীর কথা দূরে থাক, আমি বিষ্ণু এবং মহাদেবও তোমার অস্ত্রের বশবর্তী” ব্রহ্মা এখনই এই কথা বলিয়াছেন। আমি আজি তাহা সার্থক করিব। ২০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–কামদেব ইহা মনে মনে চিন্তা করিয়া স্থির করিলেন। অনন্তর, তিনি কুসুমশরাসনের কুসুমগুণে শরযোজনা করিলেন। ২১
তখন ধনুর্ধরপ্রধান কামদেব আলীঢ়-প্রণালী-অনুসারে উপবেশন করত যত্নপূর্বক শরাসন আকর্ষণ করিয়া বলয়াকার করিলেন। ২২
হে মুনিবরগণ! তিনি কার্মুকে শরসন্ধান করিলে, তথায় পরমানন্দকারী সুগন্ধ অনিল বহিতে লাগিল। ২৩।
অনন্তর, মদন, ব্ৰহ্মা দক্ষাদি-প্রজাপতি ও ব্রহ্মার সমস্ত মানস পুত্রগণকে পৃথক পৃথক্ কুসুমশরপ্রহারে মোহিত করিলেন। অনন্তর, শরপীড়িত সেই সমস্ত মুনি এবং ব্রহ্মা মোহিত হইয়া মনে মনে কিঞ্চিৎ বিকার প্রাপ্ত হইলেন। ২৪-২৫
তাহারা সকলে বিকার প্রাপ্ত হইয়া বারংবার সন্ধ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন; দেখিতে দেখিতে তাহাদিগের অত্যন্ত কাম বৃদ্ধি হইল। কেননা, রমণী হইতেই কামবৃদ্ধি হইয়া থাকে। ২৬
তখন সেই দুষ্ট মদন তাহাদিগকে পুনঃপুনঃ মোহিত করিয়া, যাহাতে তাহাদিগের বহিরিন্দ্রিয়ের বিকার হয়, তাহা করিল। ২৭
অনন্তর যখন ব্রহ্মা, উদগতেন্দ্রিয় হইয়া সন্ধ্যাকে দেখিতে লাগিলেন, তখন তাহার শরীর হইতে একোন-পঞ্চাশৎ সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাব হইল। ২৮
হে দ্বিজগণ। আর কামশরবিদ্ধা সন্ধ্যা হইতে বিব্বোকাদি হাবসকল এবং চতুঃষষ্টি কলা উৎপন্ন হইল। ২৯
তাহারা সন্ধ্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে থাকিলে সন্ধ্যাও বারংবার কটাক্ষ পাত ও কটাক্ষসঙ্কোচ প্রভৃতি মদন-শরপাত-সনভূত বিবিধ ভাবপ্রকাশ করিতে লাগিলেন। ৩০
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ উঠিলে, মন্দাকিনীর যেমন শোভা হয়, তদ্রূপ স্বভাবসুন্দরী সন্ধ্যাদেবীও মদন-বিকার-জনিত সেই সেই ভাব প্রকাশ করত অত্যন্ত শোভা পাইয়াছিলেন। ৩১
অনন্তর বিধাতা সেই ভাববতী সন্ধ্যাকে অবলোকন করিতে করিতে বিধাতার শরীরে স্বৈদজলধারা বহিতে লাগিল; তিনি সন্ধ্যার প্রতি অভিলাষী হইলেন। ৩২
অনন্তর মরীচি, অত্রি প্রভৃতি সেই সমস্ত মুনি ও দক্ষ-প্রমুখ মুনিবরগণও ইন্দ্রিয়বিকার প্রাপ্ত হইলেন। ৩৩
তখন মদন, বিধাতাকে, দক্ষ-মরীচি-প্রমুখ মুনিগণকে এবং সন্ধ্যাকে তথাবিধ বিকার প্রাপ্ত অবলোকন করিয়া আপনার কৰ্ম্মপটুতার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিলেন। ৩৪।
ব্রহ্মা আমার যে কৰ্ম্ম কৰ্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন, আমি তাহা করিতে পারি, তাহার এই আত্মাদরবর্ধক বিশ্বাস জন্মিয়াছিল। ৩৫
ইত্যবসরে, আকাশচারী মহাদেব ব্রহ্মাকে এবং দক্ষ-সমেত মানস পুত্র গণকে তাদৃশ বিকারপ্রাপ্ত অবলোকন করিয়া হাস্য উপহাস করিলেন। ৩৬
হে দ্বিজবরগণ! বৃষধ্বজ তাহাদিগকে ধিক্কার প্রদানপূর্বক পুনঃপুনঃ হাস্য করত লজ্জিত করিয়া এই কথা বলিলেন,–অহে ব্ৰহ্মা। নিজের তনয়াকে দেখিয়া তোমার কি না কামভাব উপস্থিত হইল! ছিঃ! যাহারা বেদানুসারে চলে, এ কাজ তাহাদিগের যোগ্য নহে। ৩৭-৩৮
পুত্রবধূ ও কন্যা মাতৃতুল্য; ইহা বেদের সিদ্ধান্ত। তুমিই এই সিদ্ধান্তের প্রকাশক। বিধি! তুমি সামান্য কামের প্রভাবে তাহা বিস্মৃত হইলে কিরূপে? ৩৯
হে চতুরানন! ধৈৰ্য্য তোমার মনকে সর্বদা সতর্ক করিয়া রাখে। বিধি! তথাপি ক্ষুদ্রকাম কি না তোমার সে মন বিগড়াইয়া দিল। ৪০
হে একান্তযোগী, সৰ্ব্বদা দিব্যদর্শী দক্ষ মরীচি প্রভৃতি মানস পুত্রগণ! কি তোমরা রমণীলোলুপ হইলে! ৪১
ছিঃ! আজ কি না মন্দবুদ্ধি কামের বাসনা পূর্ণ হইল! অবসরানভিজ্ঞ স্বল্পবুদ্ধি কাম তোমাদিগকে শরব্য করিল! ৪২
হে মুনিবরগণ! কামিনী হঠাৎ যাহার ধৈৰ্য্য লোপ করিয়া চিত্ত চঞ্চল করে, তাহাকে ধিক্। ৪৩
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–মহাদেবের এই কথা শুনিয়া লজ্জাবশে ব্ৰহ্মার ক্ষমধ্যে দ্বিগুণ ঘৰ্ম্ম হইতে লাগিল। ৪৪
চতুরানন সেই কামরূপিণী সন্ধ্যাকে গ্রহণ করিতে ইচছুক হইলেও অতঃপর ইন্দ্রিয়বিকার সম্বরণ করিলেন, তাহাকে আর গ্রহণ করিলেন না। ৪৫
হে দ্বিজবরগণ! তাহার শরীর হইতে যে ঘৰ্ম্মজল পতিত হইয়াছিল, তাহা হইতে অগ্নিষ্বাত্ত ও বর্হিষদ পিতৃগণ উৎপন্ন হইলেন। ৪৬।
তাঁহাদিগের সকলের বর্ণ দলিতাঞ্জন-সদৃশ; নয়ন ফুল্ল-কমল-সন্নিভ। তাঁহারা সকলেই অত্যন্ত যতি, পরম পবিত্র এবং সংসার পরাঙ্মুখ। ৪৭।
হে দ্বিজগণ। কথিত আছে, অগ্নিষ্বাত্তগণ চতুঃষষ্টি সহস্র; বর্হিষদগ ষড়শীতি সহস্র। ৪৮
দক্ষ-শরীর হইতে যে ঘৰ্ম্মজল ভূমিতলে পতিত হইয়াছিল, তাহা হইতে নিখিল গুণশালিনী এক কোমল-কৃশাঙ্গী বরবৰ্ণিনী উৎপন্ন হইলেন। ৪৯
তাহার মধ্য ক্ষীণ; লোমাবলি স্বল্প; দশনপংক্তি মনোহর; এবং বর্ণ তপ্ত কাঞ্চনবৎ সুচারু। ৫০
ক্রতু, বসিষ্ট, পুলস্ত এবং অঙ্গিরা ব্যতীত মরীচি প্রভৃতি অপর ছয় জন ঋষি, ইন্দ্রিয়বিকার-নিরোধে সমর্থ হইয়াছিলেন। ৫১
হে দ্বিজগণ! ক্রতু প্রভৃতি বারজন ঋষির যে ঘৰ্ম্মজল ভূতলে পতিত হইয়াছিল, তাহা হইতে অপর পিতৃগণ উৎপন্ন হইলেন। ৫২
তাহার সোমপ, আজ্যপ, সুকালিন্ এবং হবির্ভুজ, (হবিষ্মন্ত) নামে বিখ্যাত, তাহারা সকলেই কব্যবাহী। ৫৩
সোমপগণ ক্রতুর পুত্র; সুকালিনগণ বসিষ্ঠের পুত্র; আজ্যপগণ পুলস্ত্যের পুত্র; এবং হবিষ্মন্তগণ অঙ্গিরার পুত্র। ৫৪
হে বিপ্রশ্রেষ্ঠগণ! অগ্নিষ্বাত্ত প্রভৃতি সেই কব্যবাহী লোক-পিতৃগণ চারিদিকে উৎপন্ন হইলে ব্ৰহ্মা সৰ্ব্বভূতেরই পিতামহ হইলেন। আর সন্ধ্যা পিতৃগণের জননী হইলেন। কেননা সন্ধ্যা তাহাদিগের গর্ভধারিণী না হইলেও উৎপত্তির নিদান বটে। ৫৫-৫৬
অনন্তর পিতামহ, শঙ্করের কথায় লজ্জিত হইয়া তৎক্ষণাৎ কন্দর্পের প্রতি ক্রুদ্ধ হইলেন। ক্রোধে তাহার বদনমণ্ডল ভ্রূকুটীভীষণ হইল। ৫৭
সেই অপরাধী মন্মথও প্রথম হইতেই ব্রহ্মার অভিপ্রায় বুঝিয়া তাহার ও মহাদেবের ভয়ে সত্বর শরাসন গোপন করিল।* ৫৮ [* “শরান্ ন সঞ্জহারাশু” এই পাঠ থাকিলে তাহার অর্থ “তিনি যোজিত শর পরিত্যাগ করিলেন না” এইরূপ হইবে।]
হে দ্বিজবরগণ! অনন্তর লোকপিতামহ ব্রহ্মা রোষাবিষ্ট হইয়া যাহা করিলেন, একাগ্ৰমনে তাহা শ্রবণ কর। ৫৯
দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত ॥ ২