০২. কাজের ছেলেটির নাম বদু

মিসির আলির কাজের ছেলেটির নাম বদু। বয়স পনের-ষোল। বামন ধাঁচ আছে, লম্বা হচ্ছে না। ছেলেটা বোকা ধরনের, তবে অত্যন্ত অনুগত। রাতে মিসির আলির বাড়ি ফিরতে দেরি হলে চিন্তিত মুখে সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুদিন পরপর ‘এত কম বেতনে কাম করমু না’ বলে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। মিসির আলি তাকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করছেন। গত তিন মাসে সে ‘অ’

‘আ’ এবং ‘ই’ পর্যন্ত শিখেছে। তাও ভালোমতো শিখতে পারে নি। অ এবং আ-তে গণ্ডগোল হচ্ছে। কোনটা অ, কোনটা আ, এখনো ধরতে পারে না। তার পরেও পড়ালেখার কাজটি সে খুব আগ্রহ নিয়ে করে।

মিসির আলি ঘরে ঢুকে দেখলেন বদু পড়ছে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে। বই স্লেট পেনসিল চারদিকে ছড়ানো। মিসির আলি বললেন, কেউ কি পাখির খাঁচা দিয়ে গেছে?

বদু বলল, হ। সুন্দরমতো একটা লোক আইছিল।

‘লোকটা কী বলল?’

বলছে, ‘বদু, খাঁচাটা রাখো। স্যার এলে তাঁর হাতে দিও। আর এই নাও একটা চিঠি।’

বদু কথাগুলো হুবহু বলে গেল। মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। বদু মুশফেকুর রহমানের কথাগুলো যন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছে। স্মৃতিশক্তির কোনো সমস্যা এখানে হচ্ছে না অথচ সামান্য আ অ, তার মনে থাকছে না। এর কারণটা কী?

‘তোকে বলল, বদু! খাঁচাটা রাখো?’

‘জে বলছে।’

‘তোর নাম জানল কীভাবে?’

‘তা ক্যামনে কব। হে তো আমারে বলে নাই।’

‘তুই অবাক হোস নি। অপরিচিত একটা লোক তোর নাম ধরে ডাকছে।’

‘জে না, অবাক হব ক্যান? তার ইচ্ছা হইছে ডাকছে। নাম ধইরা ডাকলে দোষের কিছু নাই।’

মিসির আলি ঘরে ঢুকে খাঁচা দেখলেন। বেশ বড় লোহার খাঁচা। সাদা রঙ করা হয়েছে। রঙ এখনো শুকায় নি। হাতে লেগে যাচ্ছে। খামে ভরা নোটটাও তিনি পড়লেন—আপনার পক্ষীবিষয়ক গবেষণার সাফল্য কামনা করছি। বল পয়েন্টের লেখা নয়—কলমের লেখা। দামি কলম নিশ্চয়ই। মসৃণ লেখা। যে কাগজে লেখা হয়েছে সে কাগজও দামি, কোনো প্যাড থেকে ছেঁড়া হয়েছে। ক্রিম কালারের প্যাড। প্যাডের পাতা থেকে হালকা গন্ধ আসছে। মিসির আলিকে সবচেয়ে মুগ্ধ করল হাতের লেখা। অনেকদিন তিনি এত সুন্দর হাতের লেখা দেখেন নি। অক্ষরগুলো আলাদা আলাদাভাবে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে।

‘বদু!’

‘জে।’

‘লোকটা কি খাঁচা দিয়েই চলে গেল, না কিছুক্ষণ ছিল?’

‘কিছুক্ষণ ছেল—গল্পসল্প করল।’

‘কী গল্প করল?’

‘আমার বড়ি কই, কতদিন আপনের সঙ্গে আছি এই হাবিজাবি। আমিও দুই- চাইরটা হাবিজাবি কথা বললাম।’

‘হাবিজাবি কথা কী বললে?’

‘যেমন ধরেন লেহাপড়া কিছু মনে থাকে না। কোনটা স্বরে অ কোনটা স্বরে আ খালি গোলমাল হয়। তখন লোকটা একটা নিয়ম শিখাইয়া দিল। বলছে, এই নিয়মে পড়লে মনে থাকবে।’

‘নিয়মটা কী?’

‘স্বরে অ হইল হাতের মুঠি বন্ধ। স্বরে অ বলনের সময় হাতের মুঠি বন্ধ করণ লাগব। স্বরে আ হইল মুঠি খোলা। নিয়মটা ভালো—অখন আর ভুল হয় না।’

‘লোকটার মধ্যে অদ্ভুত কিছু দেখেছিস বদু?’

‘জে না।’

‘ভালো করে মনে করে দেখ। লোকটা কথা বলার সময় হেসেছে?’

‘জে হাসছে।’

‘হাসি দেখে অদ্ভুত কিছু মনে হয়েছে?’

‘জে না।’

মিসির আলি হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় উঠলেন। মুশফেকুর রহমানের দেওয়া পাখিবিষয়ক বইটির পাতা উল্টালেন। নতুন বই। খুব সম্ভব আজই কেনা হয়েছে। বইয়ের দাম পঁচাত্তর পাউন্ড। বইটির প্রথম পাতায় ঠিক আগের মতো লেখা—’আপনার পক্ষীবিষয়ক গবেষণার সাফল্য কামনা করছি।’ মিসির আলি আবারো মনে মনে বললেন, কী সুন্দর হাতের লেখা! তিনি সত্যি সত্যি লেখাগুলোর ওপর দিয়ে আঙুল বুলিয়ে নিয়ে গেলেন।

লোকটি সম্পর্কে মিসির আলি ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করলেন। বিত্তবান মানুষ — তা ধরে নেওয়া যায়। পঁচাত্তর পাউন্ড দামের বই উপহার দেওয়া, খাঁচা কিনে আনার কাজগুলো একজন বিত্তমান মানুষই করবে।

মুশফেকুর রহমান তাঁকে কৌতূহলী করবার জন্যে খাঁচা উপহার দিয়েছে। এর প্রয়োজন ছিল না। একবার হাঁ করলেই মিসির আলি তার সম্পর্কে কৌতূহলী হতেন। তা করে নি। মিসির আলি যখন কৌতূহলী হয়েছেন, তখনই সে তার ভয়ংকর জিহ্বা দেখিয়েছে, তার আগে না। সে তার শরীরের এই অস্বাভাবিকতা গোপন রাখতে পারে। এই ক্ষমতা তার আছে। সে বদুর সঙ্গে অনেক গল্প করেছে। বদু তার কালো জিহ্বা দেখতে পায় নি। ইচ্ছা করলে মিসির আলির কাছেও গোপন রাখতে পারত। তা রাখে নি। তার মনে কোনো একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা কী? সে কি ভয় দেখাতে চেয়েছে, না চমকে দিতে চেয়েছে?

চমকে দেওয়ার একটা প্রবণতা লোকটির মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। পাখির খাঁচা কিনে আনায় তাই প্রমাণিত হয়। বদুকেও সে চমকে দিতে চেয়েছে তার নাম ধরে ডেকে। বদুর চমকাবার মতো বুদ্ধি নেই বলে চমকায় নি। মুশফেকুর রহমান যে অসম্ভব বুদ্ধিমান এই ব্যাপারটিও সে জানাতে চায়। মনে রাখার একটি কৌশল সে বদুকে শিখিয়েছে। তার মূল লক্ষ্য বদু নয়, মূল লক্ষ্য মিসির আলি। যেন সে বলার চেষ্টা করছে বুদ্ধির খেলায় তুমি আমাকে হারাতে পারবে না। অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ সব সময় এই ছেলেমানুষিটা করে। তাদের বুদ্ধির ছটায় অন্যকে চমকে দিতে চায়। মিসির আলি নিজেও এই কাজটি করেন—খুব সূক্ষ্মভাবে করেন। এই লোকটিও সূক্ষ্মভাবেই করছে।

সে বলল, আমি একজন সাইকোপ্যাথ। সাইকোপ্যাথ শব্দের মানে সে কি জানে? পত্রপত্রিকা এবং সিনেমার কল্যাণে শব্দটি প্রচলিত, যদিও এই শব্দের ব্যাপকতা সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে।

সে দুটি খুনের কথা বলছে—একজন সাইকোপ্যাথ তা করবে না। উপন্যাসের সাইকোপ্যাথরা বড় গলায় সবাইকে খুনের কথা বলে। বাস্তবের চরিত্র হবে নিভৃতচারী।

লোকটির মধ্যে অনুসন্ধিৎসাও প্রবল। পাখির চাল না খাওয়ার ব্যাপারটা তাকেও বিস্মিত করেছে। সে রহস্য নিয়ে ভাবছে। কারণ পাখির বইটি সে শুধু কেনে নি, পড়েছেও। বইয়ের বিভিন্ন পাতায় পেজ মার্ক দেওয়া। বইটি পড়তে হলে তাকে অনেকখানি সময় দিতে হবে। আচ্ছা, পাখির কথা তিনি তাকে কবে বললেন? পরশু না তার আগের দিন? আচ্ছা, এই বইটিতে কি লোকটির হাতের ছাপ আছে?

মিসির আলি চিন্তিত বোধ করছেন। তাঁকে আরো ভালোভাবে ভাবতে হবে। আরো ঠাণ্ডা মাথায়। মোটেই উত্তেজিত হওয়া চলবে না। প্রথম লোকটির সঙ্গে কোথায় দেখা হল—পার্কে না রাস্তায়? প্রথম দিন কী কথা হয়েছিল? আচ্ছা, প্রথমদিন তার গায়ে কি কাপড় ছিল? মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। আজ কী কাপড় ছিল। কোট না স্যুয়েটার? কী রঙের কোট কিংবা কী রঙের স্যুয়েটার? অনেক চিন্তা করেও মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। তিনি খুবই বিস্মিত হলেন। এরকম কখনো হয় না। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি ভালো। সারা জীবন তিনি তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখিয়ে অন্যদের চমৎকৃত করেছেন। নিজেও চমৎকৃত হয়েছেন। আজ পারছেন না কেন?

‘বদু!’

‘জি স্যার।’

‘যে লোকটা এসেছিল, তার গায়ে কী ছিল? কোট?’

‘খিয়াল নাই।

‘লোকটার গায়ের রঙ কী ছিল? ফর্সা না কালো?’

‘খিয়াল নাই।’

মিসির আলি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন—শুধু যে বদুর খেয়াল নেই তা নয়, তাঁর নিজেরও খেয়াল নেই। এর কোনো মানে হয়? তিনি নিজের ওপর নিজে বিরক্ত হচ্ছেন।

রাতের খাবার খেলেন নিঃশব্দে। খাওয়া শেষে সিগারেট ধরালেন। সারা দিনে তিনি এখন একটাই সিগারেট খান। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে বদু এসে তার পড়া বলল। এই প্রথমবার সে স্বরে অ স্বরে আ-তে কোনো ভুল করল না। হাত মুঠিবন্ধ করে বলল, স্বরে ‘অ’। মুঠি খুলে বলল স্বরে ‘আ’। বদু নিজের সাফল্যের আনন্দে হেসে ফেলল। ঠিক দশটায় মিসির আলি দশ মিলিগ্রাম ফ্রিজিয়াম খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে। স্নায়ুকে ঠাণ্ডা করার প্রয়োজন বোধ করলেন। ঘুম এল না। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল মুশফেকুর রহমান। লোকটার গায়ের রঙ মনে নেই কেন? কী কাপড় পরে এসেছিল তাও মনে নেই। এর কারণ কী? যুক্তি দিয়ে এই সমস্যার কাছে কি পৌঁছা যায় না? নিশ্চয়ই যায়। সেই চেষ্টাই করা যাক। একজন মানুষের দিকে যখন আমরা তাকাই তখন তার চোখের দিকেই প্রথম তাকাই। তারপর তার মুখ দেখি, মাথার চুল দেখি। এক ফাঁকে সে কী কাপড় পরে এসেছে তা দেখি। যদি আমরা তার চোখ থেকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই তা হলে চোখ ছাড়া লোকটির আর কিছুই দেখা হয় না। চোখ থেকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার ব্যাপার কখন ঘটবে? তখনই ঘটবে যখন লোকটির চোখের তীব্র বিকর্ষণী ক্ষমতা থাকবে। চোখ কখন বিকর্ষণ করে? যখন চোখে কোনো সূক্ষ্ম অস্বাভাবিকতা থাকে।

মিসির আলি মনে মনে বললেন, মুশফেকুর রহমান নামের লোকটির চোখের অস্বাভাবিক বিকর্ষণী ক্ষমতার জন্যেই তাকে কখনো ভালোভাবে লক্ষ করা হয় নি। তাকে ভালোভাবে দেখার আগেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আমি তার কুৎসিত কালো ‘জিব’ দেখেছি—কারণ সে আমাকে ইচ্ছে করে তা দেখিয়েছে।

মিসির আলি নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। সম্ভবত এখন তাঁর ঘুম আসবে। হাই উঠছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। রাতে তাঁর সুনিদ্রা হল। শেষরাতের দিকে পাখি নিয়ে কিছু ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন দেখলেন। একটি স্বপ্নে চড়ুই পাখি দুটি তাঁর সঙ্গে কথা বলল। মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল, মিসির আলি সাহেব, শরীরের হাল অবস্থা ভালো?

তিনি বললেন, জি-না, ভালো না।

‘রোজ খানিকটা পাইজং চাল খাবেন। চা চামচে এক চামচ। খালি পেটে। ‘জি আচ্ছা, খাব।’

স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলি নিজেকে বোঝালেন—এ জাতীয় স্বপ্ন দেখার পেছনে যুক্তি আছে। তিনি ক্রমাগত পাখি নিয়ে ভাবছেন বলেই এরকম দেখছেন। এ জগতে যুক্তিহীন কিছু ঘটে না। অযুক্তি হল অবিদ্যা। এ পৃথিবীতে অবিদ্যার স্থান নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *