ওদের বিয়ে হতে দশ দিন লাগল। বিয়ের লাইসেন্স বের করা এদেশে অনেক যন্ত্রণা। অনেক টেস্ট-ফেস্ট করতে হয়। ডাক্তাররা আগে নিশ্চিত হয়ে নেন এই দম্পতির সন্তান বংশগত কোনো রোগের শিকার হবে না। তারপরই সার্টিফিকেট দেন। সেই সাটিফিকেট দেখিয়ে লাইসেন্সের জন্য দরখাস্ত করতে হয়।
বিয়ের পরপব লিলিয়ান ডা. ভাবমানের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ডা. ভারমান চশমার ফাঁক দিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, মিস থেকে মিসেস হয়েছ?
হ্যাঁ। কী কবে বুঝলেন? আমার কপালে তো লেখা নেই মিসেস।
অবশ্যই লেখা আছে। সেই লেখা সবাই পড়তে পারে না। আমি পারি। তুমি কি ঐ ছেলেটিকেই বিয়ে করেছ?
হ্যাঁ।
দুঃস্বপ্ন এখন নিশ্চয়ই দেখছি না?
জ্বি-না, দেখছি না।
শুনে খুব খুশি হলাম। মনস্তত্ত্ববিদ্যা একটি বড় বিদ্যা–তা কি বুঝতে পারছ?
পারছি।
ভবিষ্যতে যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমার কাছে আসবে। তবে আমার মনে হয়। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না। যদি হয় তুমি নিজে তার সমাধান করতে পারবে। পাববে না?
হ্যাঁ পারব।
তোমার হাসি-খুশি মুখ দেখে ভালো লাগছে। সত্যিকাব হাসিমুখ অনেক দিন দেখি না। চারদিকে ভেজাল হাসি দেখি।
হাসির ভেজালও আপনি ধরতে পারেন?
অবশ্যই পাবি। আমার নিজের মুখে যে হাসিটি আমি ঝুলিযে রাখি তা হলো ভেজাল হাসি। একশ ভাগ ভেজাল। তুমি তোমার জীবনে ভেজাল হাসিকে আসতে দিও না। মনে কষ্ট পেলে কাদবো। মনের কষ্ট চাপা দেয়ার জন্য হাসির ভান করাধ প্রয়োজন নেই।
আমি আপনার উপদেশ মনে রাখব ডা. ভারমান।
ডা. ভারমানের উপদেশের জন্যই হয়তো দেশ থেকে মার চিঠি পেয়ে লিলিয়ান সারাদিন কাঁদল। চিঠিটি তিনি মেয়ের বিয়ের সংবাদ পাওয়ার পর লিখেছেন। সংক্ষিপ্ত চিঠি। যদিও লিলিয়ানের মার হাতে লেখা। তবু লিলিয়ান জানে–এই চিঠি তার বাবা লিখে দিয়েছেন। মা শুধু দেখে দেখে কপি করেছেন। কপি করতে গিয়েও মার বানান ভুল হয়েছে। বাবা সেইসব বানান শুদ্ধ করেছেন।
লিলিয়ান,
তোমার বিবাহের সংবাদ পাইয়াছি। আনন্দে উল্লসিত হই নাই। তুমি নিশ্চয়ই তা আশাও কর না। তুমি খুব ভালো জানো তুমি আমাদের সবার অতি আদরের ধন ছিলে। তোমাকে নিয়া আমাদের স্বপ্নের অন্ত ছিল না। তুমি সব স্বপ্নের অবসান ঘটাইয়াছ। আমি তোমাকে দোষ দেই না। ঈশ্বরের হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না। এই ক্ষেত্রেও তাঁর ইচ্ছারই প্রতিফলন হইয়াছে। আমি তোমার এবং তোমার স্বামীর সুখী সুন্দর জীবন কামনা করি। যে সুখের জন্য তুমি আমাদের পরিবারের সকলের সুখ তুচ্ছ করিয়াছ, ঈশ্বর যেন সেই সুখ তোমাকে দেন ইহাই আমাদের সকলের কামনা।
এখন তোমাকে কিছু কথা বলিব, মন দিয়া শোন। তোমার বাধা পরিবারের সদস্য হিসেবে তোমাকে গ্ৰহণ করিবার ব্যাপারে অনিচ্ছা! প্ৰকাশ করিয়াছেন। আমাদের সকলেরই সেইমতো অভিমত। সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে তোমাকে বর্জন করা হইয়াছে। ইহাতে মনে কষ্ট পাইও না। তুমি সকলকে ত্যাগ করিয়া একজনকে পাইতে চাহিয়াছ। ঈশ্বর তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করিয়াছেন।
এক্ষণে বাড়িতে তোমার নাম আর উচ্চারিত হইবে না। তোমার ব্যবহারী জিনিস, তোমার ফটোগ্রাফ সমস্ত নষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তুমি আমাদের সহিত কোনো রকম যোগাযোগ রাখিবার চেষ্টা করিবে না। যোগাযোগ করিবার চেষ্টার অর্থই হইবে আমাদিগকে কষ্ট দেওয়া এবং নিজে কষ্ট পাওয়া।
ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। ঈশ্বরের নিকট তোমার প্রসঙ্গে ইহাই আমাদের শেষ প্রার্থনা।
তোমার হতভাগিনী মা।
পুনশ্চ: মা, তোমার দুঃস্বপ্ন দেখা কি বন্ধ হয়েছে?
লিলিয়ানের ধারণা চিঠির শেষের পুনশ্চ অংশটি মার লেখা। মা বাবাকে না জানিয়ে এই বাক্যটি লিখেছেন। কেন মায়েরা এত ভালো হয়? কেন হয়? সে নিজে কি কোনো একদিন এমন একজন মা হবে?
লিলিয়ান কাঁদতে কাঁদতে ভাবল আমার প্রথম সন্তানটি যেন মেয়ে হয়। মেয়ে হলেই আমি মার নামে তার নাম রাখতে পারব।