০২. একটি গহীন গ্রাম
রাস্তার পাশে রিকশা-ভ্যানটা থামিয়ে রিকশাওয়ালা নেমে গামছা দিয়ে মুখ মুছে বলল, “আর সামনে যাবে না। বাকিটা হেঁটে যেতে হবে।”
আম্মু অন্যমনস্কভাবে বললেন, “হেঁটে যেতে হবে?”
“জে।” মাঝবয়সী রিকশাওয়ালা সামনের কাঁচা রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, “বর্ষার সময় সব পানিতে ডুবে যায় তখন নৌকা করে যাওয়া যায়।”
আম্মু বললেন, “ও।” বহুদিন পর আম্মু এখানে এসেছেন। আজকাল যেখানেই কিছুদিন পরে যান গিয়ে জায়গাটা চিনতে পারেন না। ফাঁকা একটা জায়গা বাড়িঘরে ঘিঞ্জি হয়ে যায়। এই এলাকাটার কোনো পরিবর্তন হয়নি, সেই ছোট থাকতে যে রকম দেখেছিলেন এখনো সে রকমই আছে।
রাশ রিকশা-ভ্যানে পা তুলে বসেছিল, এবারে নেমে পড়ে। গতরাতে তারা রওনা দিয়েছে, সারারাত ট্রেনে কেটেছে, সকালে নেমে বাস ধরেছে। বাসের পর স্কুটার তারপর রিকশা-ভ্যান। বাকিটা হেঁটে যেতে হবে। রাশা অন্যমনস্কভাবে চারপাশে তাকাল কিন্তু খুব ভালো করে কিছু দেখল বলে মনে হয় না। একটু আগে জলার ধারে একটা গাছের ওপর একটা মাছরাঙা পাখি বসেছিল, এত সুন্দর রঙিন পাখি সে জীবনে কখনোই দেখেনি, কিন্তু তারপরেও পাখিটা দেখে তার ভেতরে কোনো আনন্দ হলো না। আসলে তার ভেতরটা এখন মনে হয় মরে গেছে, আনন্দ বা দুঃখ কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে চারপাশে যেটা ঘটছে তার পুরোটাই একটা দুঃস্বপ্ন। মনে হচ্ছে এক্ষুণি তার ঘুম ভেঙে যাবে আর ঘুম থেকে উঠে দেখবে সে তার ঘরে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। রাশা জানে এটা দুঃস্বপ্ন নয় এটা সত্যি, তাই সম্পূর্ণ অপরিচিত একধরনের দুঃখ, হতাশা আর আতঙ্কে বুকের ভেতরটা অসাড় হয়ে আছে।
আম্মু রিকশা-ভ্যান থেকে নেমে রাশাকে বললেন, “নেমে আয় মা। হেঁটে যেতে হবে। পারবি না?”
রাশা কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে জানাল যে সে পারবে। রিকশাওয়ালা ভ্যান থেকে আম্মুর ছোট ব্যাগ আর রাশার বড় স্যুটকেসটা নামাল। এই স্যুটকেসের মাঝে তার বাকি জীবনটা কাটানোর জন্যে যা যা লাগবে সেটা আঁটানো হয়েছে। আম্মু বারবার বলেছেন, “যা যা লাগবে সব নিয়ে নে মা। আর তো নিতে পারবি না।” রাশা তখন খুব চিন্তা ভাবনা করেনি। অনেকটা অন্যমনস্কভাবে হাতের কাছে যা পেয়েছে স্যুটকেসে ভরেছে। সে তখনো বিশ্বাস করেনি যে সত্যি সত্যি এটা ঘটছে। স্যুটকেসের মাঝে তার কিছু জামা-কাপড় আছে, কিছু বই। তার কম্পিউটারটা আনতে পারলে হতো, কিন্তু আম্মু বলেছেন তারা যেখানে যাচ্ছে তার আশেপাশে কোথাও ইলেকট্রিসিটি নেই। তা ছাড়া এত বড় একটা কম্পিউটার, সেটা আনবে কেমন করে? এই স্যুটকেসটা আনতেই কত ঝামেলা হয়েছে।
রাশা রিকশা-ভ্যান থেকে টেনে স্যুটকেসটা নামাল। নিচে চাকা লাগানো আছে, রাস্তা ভালো হলে টেনে নেয়া যেত। কাদামাটির এই কাঁচা রাস্তায় কেমন করে নেবে সে জানে না।
আম্মু রিকশাওয়ালাকে বললেন, “আমি কিন্তু আজকেই ফিরে যাব। মনে আছে তো?”
মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “জে মনে আছে।”
আম্মু রাশার স্যুটকেসটা দেখিয়ে বললেন, “এই সুটকেসটা পৌঁছে দিতে হবে। কাউকে পাওয়া যাবে?”
মানুষটা বলল, “আমি পৌঁছে দেব।”
“রিকশা-ভ্যান? কেউ নিয়ে যাবে না তো?
“এইখানে কারো বাড়িতে রেখে যাব। কেউ নিবে না। এই গাঁও গেরামে সবাই সবাইরে চিনে।”
কিছুক্ষণের মাঝেই তিনজনের এই ছোট দলটা এগিয়ে যেতে থাকে, সামনে রাখার স্যুটকেস মাথায় রিকশাওয়ালা, তার পিছনে আম্মু সবার পিছনে রাশা। আম্মু মাঝে মাঝে থেমে রাশার সাথে একটা-দুইটা কথা বলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু রাশা হুঁ-হ্যাঁ ছাড়া আর কিছু বলেনি, তাই আলাপ বেশি দূর এগুতে পারেনি।
গ্রামের কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রাশা দুই পাশে তাকাচ্ছিল। যদি স্কুলের সব ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে পিকনিক করতে আসত তাহলে এতক্ষণে চারপাশের ক্ষেত, মাঠ, খাল, গাছপালা, গরু, ছাগল, পাখি এসব দেখে সবাই উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠত। সবাই মিলে মাঠে দৌগাদৌড়ি করত, খালের পানিতে লাফঝাঁপ দিত, গরুর বাছুরকে ধরে ছবি তুলত। এখন সবকিছুকে মনে হচ্ছে পুরোপুরি অর্থহীন। মেঠোপথে মানুষজন খুব বেশি নেই, হঠাৎ হঠাৎ এক-দুইজনকে দেখা যায়। তারা তখন কৌতূহলী হয়ে তাদের দিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকায়। রাশাও একবার ঘুরে একটা মেয়ের দিকে তাকাল, আট-নয় বছরের শুকনো লিকলিকে একটা মেয়ে, কুচকুচে কালো গায়ের রং মাথায় লাল চুল রুক্ষ–বাতাসে উড়ছে, খালি গা, শুধু একটা বেড় প্যান্ট পরে আছে। হাতে একটা চিকন বাঁশেল কঞ্চি, সেটা হাতে নিয়ে উদাস মুখে সে একটা ক্রুদ্ধ চোখে দেখে রাশার ভয়ে বুক কেঁপে উঠে, কিন্তু এই লিকলিকে ছোট মেয়েটির বুকে কোনো ভয়ডর নেই, রাশা। আবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা বড় বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আম্মু বললেন, ঐ যে তালগাছটা দেখছিস সেটা হচ্ছে তোর নানু বাড়ি। রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, আগে দুইটা তাল গাছ ছিল, একটা বাজ পড়ে পুড়ে গেছে।
.
রাশা এবারেও কোনো কথা বলল না, তাকিয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করল, দুটো তালগাছ হলে সেটা কেমন দেখাত। ধীরে ধীরে রাস্তাটা আরো সরু হয়ে গেলে, একেবারে শেষে একটা বাঁশের সাঁকো পার হতে হলো। আম্মু তার স্যান্ডেল দুটো খুলে হাতে নিয়ে নিলেন, রাশা জুতো পরেই পার হয়ে গেল। কিছু ঝোঁপঝাড় পার হয়ে একটা বিবর্ণ টিনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আম্মু বললেন, “এইটা তোর নানু বাড়ি।”
রাশ চোখ তুলে তাকাল। টেলিভিশনে মাঝে মাঝে যখন কোনো গ্রাম গঞ্জের খবর দেখায় তখন সে খবরের মাঝে এরকম বাড়ির ছবি দেখেছে, এই প্রথমবার সত্যি সত্যি দেখল। বাইরের টিনের ঘরের পাশ দিয়ে আম্মু ভেতরে ঢুকলেন, মাঝখানে খালি একটা উঠান, তার দুই পাশে দুইটা ঘর। একটা ঘরের টিনের ছাদ অন্যটার খড়ের ছাউনি। মাঝখানের উঠানটুকু বড় আর তকতকে পরিষ্কার। কোথাও কোনো জনমানুষ নেই, শুধু একটা মুরগি তার ছানাদের নিয়ে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল। তাদের দেখে মুরগিটা কঁক কঁক করে একটা সতর্ক শব্দ করল, অমনি সবগুলো ছানা ছুটে এসে মুরগির তলায় আশ্রয় নিল। তাদের দেখে যখন বুঝতে পারল কোনো বিপদ নেই তখন আবার সবগুলো আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে থাকে।
রিকশাওয়ালা মানুষটি তার মাথা থেকে স্যুটকেসটা উঠানে নামিয়ে রেখে গামছা দিয়ে তার মুখ-গলা মুছতে থাকে। আম্মু এদিক-সেদিক তাকিয়ে ডাকলেন, “মা।”
কেউ উত্তর দিল না। আম্মু তখন টিনের ঘরের সামনে গিয়ে দরজাটি ধাক্কা দিলেন, দরজাটি সাথে সাথে খুলে গেল। আম্মু ভেতরে ঢুকে একটু পরে বের হয়ে বললেন, “ভিতরে কেউ নাই।”
রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, “আয় বাড়ির পিছনে যাই। বাড়ির পিছনে পুকুর ঘাটে আছে কিনা দেখি।”
আম্মু টিনের ঘরের পাশ দিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে রওনা দিলেন। রাশা অপেক্ষা করবে নাকি পিছনে পিছনে যাবে ঠিক বুঝতে পারছিল না, শেষে আম্মুর পিছনে পিছনেই গেল। বাড়ির পিছনে অনেক গাছপালা, বড় বড় বাঁশঝাড়। তার নিচে শুকনো পাতা মাড়িয়ে রাশা আম্মুর পিছনে পিছনে যেতে থাকে। সামনে একটা বড় পুকুর, পুকুরের কালো পানি টলটল করছে। পুকুরের পাশে ছায়াঢাকা একটা পুকুর ঘাট। রাশা দেখল সেই পুকুরঘাটে হেলান দিয়ে গুটিশুটি মেরে একজন মহিলা বসে আছেন, মহিলা পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আছেন তাই তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না।
আম্মু ডাকলেন, “মা।”
মহিলাটি পিছনে ঘুরে না তাকিয়ে বললেন, “কে?”
“আমি মা। আমি নীলু।”
রাশার মায়ের নাম নীলু, বহুদিন তাকে এই নামে কেউ ডাকে না। পুকুর ঘাটে বসে থাকা মহিলাটা একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সাথে কে?”
“আমার মেয়ে। রাশা।”
কথা বলতে বলতে আম্মু তার মায়ের পাশে দাঁড়ালেন কিন্তু তার মা একবারও মাথা ঘুরিয়ে মেয়েকে দেখার চেষ্টা করলেন না। শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোর পাগলি, মাথা খারাপ মায়ের কাছে কেন এসেছিস?”
আম্মু থতমত খেয়ে গেলেন, আমতা আমতা করে বললেন, “না, মানে ইয়ে আসলে-”
“এত বছর পার হয়ে গেল কখনো একবারও খবর নিলি না। এখন হঠাৎ করে একেবারে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিস। ব্যাপারটা কী?”
আম্মু ইতস্তুত করে বললেন, “আমি আসলে একটু দেশের বাইরে যাব অস্ট্রেলিয়াতে। রাশাকে–মানে আমার মেয়েকে কোথায় রেখে যাব ঠিক করতে পারছিলাম না। তাই ভাবলাম তোমার কাছে রেখে যাই।”
“কত দিনের জন্যে যাচ্ছিস?”
“মানে, আসলে বেশ কিছুদিন, মানে হয়েছে কী”
“আরেকজনকে বিয়ে করেছিস?”
আম্মুর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল, মাথা নিচু করে বললেন, “হ্যাঁ।”
“জামাই তোর মেয়েকে নিবে না?”
আম্মু কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলেন।
“তাই মেয়েটাকে এখানে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছিস? এর চাইতে মেয়েটার গলাটা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিলি না কেন? তোর মেয়ে এই গাঁও-গেরামে কিভাবে থাকবে?”
আম্মু বললেন, “আসলে মা তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। আমার কোনো উপায় ছিল না–”
“আমার মাথাটা আউলাঝাউলা সেই কথা সত্যি। আমি পাগল মানুষ সেইটাও সত্যি কিন্তু আমি তো বেকুব না নীলু! তুই তোর মেয়ের এত বড় সর্বনাশ কেন করতে যাচ্ছিস?”
“আমি সর্বনাশ করতে যাচ্ছি না মা–আমি একটু গুছিয়ে নিয়ে–”
রাশা দেখল তার নানি হঠাৎ করে হাত তুলে তার আম্মুকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, “আমার নাতনি কই? আমি কপাল পোড়া মেয়েটাকে একবার দেখি।”
তার নানি তখন ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকালেন, এই প্রথম রাশা তার মাথা খারাপ পাগলি নানিকে দেখতে পেল। তার নানি দেখতে কেমন হবেন সেটা সে গত কয়েক দিনে অনেকবার কল্পনা করেছে। সাদা শণের মতো রুক্ষ চুল, তোবড়ানো গাল, মুখে বয়সের বলিরেখা, কোটরাগত লাল ক্রুদ্ধ চোখ—-কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল তার নানির চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ নেই, দেখে মনে হয় তার মায়ের বড় বোন। চুলে অল্প একটু পাক ধরেছে, রোদে পোড়া চেহারা, তার মাঝে শুধু জ্বলজ্বলে তীব্র এক জোড়া চোখ। রাশার মনে হলো সেই চোখ দিয়ে তার নানি তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেললেন।
নানি কিছুক্ষণ রাশার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হাত নেড়ে ডাকলেন, বললেন, “আয়। কাছে আয়।”
রাশা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল, নানি হাত দিয়ে তাকে ধরলেন, তারপর কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “আমি জানতাম তুই আসবি। তাই আমি সেজেগুজে তোর জন্যে অপেক্ষা করছি।”
রাশা অবাক হয়ে তার নানির দিকে তাকাল, বলল, “কী বললে?”
“বলেছি যে আমি তোর জন্যে অপেক্ষা করছি। আমি জানতাম তুই আজকে আসবি।”
“কেমন করে জানতে?”
“আমি তো পাগল মানুষ, মাথার ঠিক নাই। উল্টাপাল্টা জিনিস মাথায় আসে। আজকে সকালবেলা মাথায় এসেছে তুই আসবি। সেই জন্যে ট্রাঙ্ক থেকে এই শাড়িটা বের করে পরেছি।”
রাশা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার এই মাথা খারাপ নানির দিকে তাকিয়ে রইল। নানি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি না? ঠিক আছে তোর হাতটা খোল—”
রাশা তার হাতটা খুলল। নানি তার মুঠি খুলে কিছু একটা বের করে তার হাতে দিয়ে তার মুঠি বন্ধ করে বললেন, “এই যে–তোকে দেয়ার জন্যে এইটা আমি হাতে নিয়ে বসে আছি। এখন তোকে দিলাম।”
“এইটা কী?”
“আমার মা আমাকে দিয়েছিল। আমার মা পেয়েছিল তার মায়ের কাছে। তার মা পেয়েছিল তার মায়ের কাছ থেকে।”
রাশা আবার কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এইটা কী?”
“একটা মাদুলি।”
“কী হয় এইটা দিয়ে?”
“কাছে আয় তোকে কানাকানি বলি।” রাশা তার মাথাটা এগিয়ে দেয়, তার নানি রাশার থুতনিটা ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “পাক সাফ পবিত্র হয়ে এই মাদুলিটা হাতে নিয়ে তুই যেটা চাইবি সেটাই পাবি।”
“সেটাই পাব?”
“হ্যাঁ। কিন্তু সবকিছু চাইতে হয় না। যেটা পাওয়া যায় না সেটা চাইতে হয় না। সেইটা চাইলে মাদুলির গুণ নষ্ট হয়ে যায়। আমার হাতে গুণ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি চাইলে আর পাই না। তুই পাবি।”
“তুমি কিভাবে গুণ নষ্ট করেছ?”
“নীলুর বাপের জানটা ফেরত চেয়েছিলাম সেই জন্যে গুণ নষ্ট হয়েছে। মওত হয়ে গেলে জান ফেরত চাইতে হয় না–”
আম্মু বললেন, “মা, তুমি এখন এইসব কথা রাশাকে কেন বলছ?”
নানি বললেন, “ইচ্ছে হয়েছে বলেছি। তাতে তোর কী? তুই তোর মেয়েকে আমার কাছে ফেলে যাচ্ছিস কেন? আমি কি বলেছিলাম তোকে ফেলে যেতে?”
“না, মানে, রাশা ছোট মানুষ, তোমার এইসব কথা যদি বিশ্বাস করে ফেলে—”
“বিশ্বাস করবে না কেন? আমি কি মিথ্যা কথা বলেছি?”
আম্মু চুপ করে গেলেন। নানি রাশার মাথাটা আবার নিজের কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বললেন, “আমি এই মাদুলিটা তোর মাকে দিই নাই। তোর জন্য রেখেছি।”
“কেন?”
আম্মু যেন শুনতে না পান সেভাবে গলা নামিয়ে বললেন, “তোর আম্মু এইটার যোগ্য না। এটা রাখতে হলে যোগ্যতা থাকতে হয়।”
“আমার যোগ্যতা আছে?”
“আছে।”
রাশা তার নানির চোখের দিকে তাকাল তখন নানি একটু হাসলেন, তার কঠিন মুখটা হঠাৎ কেমন যেন নরম হয়ে উঠল।
রাশা শক্ত করে মাদুলিটা ধরে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “খোদা তুমি আমাকে বাঁচাও, প্লিজ খোদা–আমি খুব বিপদে আছি!”
.
উঠানের একপাশে আম্মু রাশার হাত ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন, বললেন, “রাশা মা তুই আমাকে মাফ করে দিস।”
রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, “মা-ই মনে হয় ঠিক বলেছেন। তোর গলাটা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিলেই মনে হয় বেশি ভালো
রাশা এবারেও কোনো কথা বলল না। আম্মু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কঁদিতে বললেন, “আমি একটু গুছিয়ে নিয়ে তোকে নিতে আসব। খোদার কসম।”
রাশা চোখের পানি আটকে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”
আম্মু তখন তার ব্যাগ থেকে একটা মোটা খাম বের করে রাশার হাতে দিয়ে বললেন, “নে। এটা রাখ।”
“এটা কী?”
“কিছু টাকা। বেশি দিতে পারি নাই। দশ হাজার টাকা আছে। তোর কাছে রাখ। লুকিয়ে রাখিস, কাউকে জানতে দিস না।”
রাশা বলল, “আমি টাকা দিয়ে কী করব?”
“তোর লাগবে! সাথে রাখ। নে মা।”
রাশা প্যাকেটটা হাতে নিল। আম্মু তখন চোখ মুছে বললেন, “আর শোন।
“তোর নানির উল্টাপাল্টা কথা বিশ্বাস করিস না। মাথা খারাপ মানুষ, অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে।”
রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, “সেভেন্টি ওয়ানে যখন বাবাকে মেরে ফেলল তখন থেকে আস্তে আস্তে মাথা খারাপ হয়ে গেল।”
রাশা বলল, “ও।”
“মাথা খারাপ মানুষ তো, একটু মানিয়ে চলিস।”
“চলব।”
আম্মু তখন রাশাকে জড়িয়ে ধরলেন, খানিকক্ষণ ধরে রাখলেন, তারপর ছেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি যাই?”
“যাও।”
“কিছু একটা বল।”
“কী বলব?”
“কিছু বলবি না তোর মাকে?”
“আমার জন্য চিন্তা করো না। আমার ব্যবস্থা আমি করে নেব আম্মু।”
রাশা চাইছিল না তবুও তার মুখে কেমন যেন একটা হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসিতে কোনো আনন্দ নেই, সেই হাসিতে গভীর বিষাদ। আম্মু অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ঘুরে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে লাগলেন।
রাশা টিনের ঘরের বারান্দায় বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মুরগি তার ছানাগুলোকে নিয়ে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছানাগুলো তার মায়ের আশেপাশে থাকে, ছানাগুলো জানে তাদের মা সবসময় তাদের দেখেশুনে রাখবে, বিপদ থেকে রক্ষা করবে। রাশা তাকিয়ে দেখল, তার মা তাকে একটা গহীন গ্রামে তার মাথা খারাপ নানির কাছে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
সে দুই হাতে তার মুখ ঢেকে ফেলে। বিড়বিড় করে বলল, “কাঁদব না। আমি কাঁদব না। কিছুতেই কাঁদব না।”
তারপরেও সে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।