আমার বন্ধুরা শেষ পর্যন্ত একটা কেবিন যোগাড় করে ফেলল। কেবিন নাম্বার দু শ এগারো। বন্ধুবান্ধবরা যোগাড় করল বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না, করল মনসুর। বিয়ে করার পর তার কিছুনতুন যোগাযোগ হয়েছে। তার শত্রবাড়ির লোকজন, যে কোনো কারণেই হোক, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চেনে। মনসুরের বিয়েতে এক জন মেজর জেনারেল পর্যন্ত এসেছিলেন। মেজর জেনারেলদের চেহারা এমন সাধারণ হয় আমার জানা ছিল না। এরাও পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বিয়ে খেতে আসে এবং রোস্টের টুকরো বদলে দিতে বলে দেখে আমি যথেষ্ট অবাক হয়েছিলাম। মনসুরের শ্বশুর তাকে তুই তুই করে বলেছিলেন, সেও এক বিস্ময়।
আমার সীট যোগাড় করার ব্যাপারে এই ভদ্রলোকের হাত আছে বলে আমার ধারণা। মনসুর অবশ্য ভেঙে কিছু বলল না। শুধুবলল–খুব ভালো ঘর। দিন-রাত হাওয়া খেলে। ভাবটা এরকম–যেন হোটেলের ঘর পছন্দ করছি। হাওয়া খেললে নেব, নয়তো নেব না। আমি বললাম, কবে যেতে হবে?
সোমবারে। সোমবারে খালি হবে। যে আছে সে রিলিজ হয়ে যাবে।
জন্মের রিলিজ নাকি?
আরে না। অসুখ সেরে গেছে। এখন পেশেন্ট বাড়ি যাচ্ছে।
বলেই মনসুর গলা টেনে-টেনে অনেকক্ষণ ধরে হাসল–র মানে হচ্ছে পেশেন্টের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক নয়। পুরোপুরিই রিলিজড হয়ে অন্য কোথাও যাবে। মনসুর বলল, তুই প্রিপারেশন নিয়ে নেয়।
কী প্রিপারেশন নেব?
কাপড়টাপড় গুছিয়ে ফেল। থার্মোফ্ল্যাক্স আছে? নেই–না? একটা থামোফ্লাস্ক দরকার।
থার্মোয়াঙ্ক দিয়ে কী হবে? চাটা খাবি। বললেই এনে দেবে।
মনসুর খুব উৎসাহ দেখাতে লাগল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটায় সে একটা উৎসব নিয়ে আসতে চেষ্টা করছে। যেন খুব ফুর্তির ব্যাপার।
বড়ো সুটকেস আছে?
নাহ।
হ্যাণ্ডব্যাগ? হ্যাণ্ডব্যাগ তো আছে?
আছে বোধ হয়। দেখ চৌকির নিচে।
মনসুর আমার সবুজ রঙের হ্যাণ্ডব্যাগ টেনে বের করল এবং তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার করতে বসল। কিন্তু সোমবারের এখনো অনেক দেরি, আজ মাত্র বুধবার। এবং বুধবারও শেষ হয়ে যায় নি। সবে শুরু হয়েছে। এখন বাজছে দশটা। আমি বললাম, চা খাবি?
খাব। এই হ্যাণ্ডব্যাগ নিয়ে যেতে পারব না। হ্যাণ্ডেলফ্যাণ্ডেল কিছুই নেই। আমি একটা নিয়ে আসব। থামোয়াক্কও আনব।
ঠিক আছে।
আর কী কী লাগবে বল, লিষ্টি করে ফেল।
হাসপাতালে যেতে হলে কী কী নিতে হয় কে জানো টুথপেস্ট এবং টুথব্রাশ, এই দুটি জিনিস নিশ্চয়ই লাগে। টুথপেস্ট আছে। এ মাসের দু তারিখেই কেনা হয়েছে। চিরুনি নিতে হয় নিশ্চয়ই। নাকি, চিরুনি দিয়ে কেউ মাথা আঁচড়ায় না? রুগীদের এসব করতে নেই।
হাসপাতাল সম্পর্কে আমার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। প্রায় এক যুগ আগে বড়োআপ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেই যাওয়া ছিল উৎসবের যাওয়া। আমাদের মধ্যে দারুণ হৈ-চৈ ও উত্তেজনা। একটি প্রকাণ্ড স্যুটকেস ঠেসে বোঝাই করা হল। সেখানে সকালে পরার শাড়ি, বিকেলে পরার শাড়ি। গায়ে মাখার পাউডার, পানের মশলা, সবই আছে। বড়োপা ক্ৰমাগত কাঁদছে, আমাদের খুব ফুর্তি। সবাই হাসছি। আমি এবং আমার মেজো ভাই ছুটে গিয়ে বেবিট্যাক্সি নিয়ে এলাম। বড়োজাপা তার বিশাল পেট নিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে উঠল বেবিট্যাক্সিতে। বড়ো সুখের যাত্রা। আমার বাবা, যিনি প্রায় কোন ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করেন। না, মুখ সবসময় আমশি করে রাখেন, তাঁকেও দেখা গেল হাতে সিগারেট নিয়ে হাসিমুখে কথা বলছেন। (কথা বলছেন, মানে উপদেশ দিচ্ছেন। আমার বাবা উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন না হলে কথা বলেন না।) দুলাভাই লাজুক ভঙ্গিতে বড়োআপার পাশে গিয়ে বসলেন। আমার মা বললেন, বজলু, তুমি ব দিকে বস। মার অনেক ডান-বামের ব্যাপার ছিল। দুলাভাই বাধ্য ছেলের মতো মার কথা শুনলেন। মা বেবিট্যাক্সিতে ওঠার আগে তিন মিনিটি দাঁড়িয়ে লম্বা কী একটা দোয়া পড়লেন। খুব সম্ভব সুরা আর রহমান। এই দোয়াটি তাঁর খুব পছন্দ। খুব নাকি কড়া দেয়া। খুব কাজের।
বিভিন্ন রকম দোয়া দরুদ মার মুখস্থ। তাঁর কাছে এক কপি নেয়ামুল কোরান আছে। এই গ্রন্থটিকে তিনি যাবতীয় সমস্যার সমাধান বলে মনে করেন। এক বার তাঁর বালিশের নিচ থেকে আংটি চুরি হয়ে গেল। তাঁর মুখ হয়ে গেল মরা মানুষের মতো। দেখলাম তিনি নেয়ামুল কোরানের পাতা ওল্টাচ্ছেন। সেখানে নাকি হারান জিনিস খুঁজে পাওয়ার একটা দেয়া আছে। সারা দুপুর মা সেই দোয়া পড়লেন। মাঝারি সাইজের এক বালতি চোখের পানি ফেললেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে আংটি পাওয়া গেল। মা গম্ভীর গলায় বললেন, বিশ্বাস তো করি না, দোয়ার মরতবা দেখলি?
মার দোয়া অবশ্যি সব সময় কাজ করে না। কাজ করলে বড়োআপ হাসপাতাল থেকে ফিরত। সে ফেরে নি। বার-তের বৎসর আগের ব্যাপার। এখন আর সব কিছু পরিষ্কার মনে নেই।
কষ্টের ব্যাপারগুলি মানুষের ভালো মনে থাকে না। সে কখনো মনে রাখতে চায় না। কিন্তু সুখের ব্যাপার খুব ভালোভাবে মনে থাকে। কারণ এগুলি নিয়ে প্রায়ই ভাবা হয়। যেমন আমার মেজো ভাইয়ের জার্মানী যাওয়ার ব্যাপারটা। এক দিন সন্ধ্যাবেলা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল-সে জার্মানি যাচ্ছে।
বাবা প্রচণ্ড ধমক লাগালেন, কী বলছিস এসব? জার্মানি যাচ্ছি মানে?
বাবা বিদেশযাত্রার পক্ষপাতী নন এবং এজন্যেই ধমকাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। তিনি না ধমকে কথা বলতে পারেন না। পরবর্তী সময়ে আমি এর কারণ বের করেছিলাম। বাবার চাকরিটা ছিল ছোট। অফিসে সবাই তাঁকে ধমকাত। বাসায় এসে তা ভুলতে চেষ্টা করতেন। এবং প্রায় প্রতিটি ব্যাপারেই চেঁচাতেন। জার্মানির ব্যাপারেও তিনি চেঁচাতে শুরু করলেন, পাখা উঠেছে? জার্মানি-আমেরিকা? টাকা দেবে কে? গাছ থেকে আসবে? বৃক্ষ থেকে আসবে?
টাকা দিতে হবে না।
যাবি কী ভাবে, সাতার দিয়ে? এ্যাঁ, সন্তরণ?
মেজো ভাই থমত খেয়ে বলল, টাকা ওরা দিচ্ছে। স্কলারশিপ। আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না। চিরকাল শুনে এসেছি ওর ভাই বাইরে যাচ্ছে, ওর চাচা যাচ্ছে। মামা আমেরিকা থেকে জিনসের প্যান্ট পাঠিয়েছে। খালা জাপান থেকে হাওয়াই শার্ট পাঠিয়েছে। মেজো ভাইয়ের ব্যাপারটা আমাদের কারো বিশ্বাস হল না। তবু এক দিন সে বেমানান একটা কর্ডের কোট পরে সত্যিই জার্মানি চলে গেল। এয়ারপোর্টে বাবা কেঁদেকেটে তাঁর চারপাশে ভিড় জমিয়ে ফেললেন। আরো অনেকের আত্মীয়স্বজন যাচ্ছিল। তাদের হয়তো কাঁদার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বাবার। কান্না দেখে সবার চোখে পানি এল। এক জন অপরিচিত বয়স্ক লোক বাবাকে জড়িয়ে ধরে–কাঁদবেন না ভাই, কাঁদবেন না ভাই বলে নিজেও বাবার মতো আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলেন। সেই ভদ্রলোক গাড়িতে করে আমাদের বাসায় পৌছে দিলেন। অনেক টাকা বেঁচে গেল আমাদের। এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট। বাস ভাড়াই নেয় দু টাকা। আমরা এতগুলি মানুষ।
বাবার শোকের ভঙ্গি সব সময়ই এরকম। বড়োআপার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি যে গভীর দুঃখের প্রকাশ দেখিয়েছিলেন, জগতের আর কোনো বাবা এরকম দেখিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। আমি সেদিন বাবার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলাম।
বড়োনার প্রতি বাবার একটি আলাদা পক্ষপাতিত্ব ছিল। তাকে তিনি কখনো ধমক দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। খুব ছোটবেলায় এক বার নাকি একটা চড় দিয়েছিলেন। এতেই বড়োপাকাঁদতে-কাঁদতে বিছানা নেন এবং তাঁর টাইফয়েড হয়ে যায়। জীবনসংশয় যাকে বলে। ব্যাপারটা হাস্যকর। টাইফয়েড একটা জীবাণুঘটিত ব্যাপার। চড় দিয়ে কারো টাইফয়েড বাধিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু বাবাকে এসব কে বোঝাবে? টাইফয়েডের এই গল্পটি তিনি কয়েক লক্ষ বার করেছেন এবং অনেককেই অস্বস্তিতে ফেলেছেন।
টাইফয়েডের জন্যই হোক বা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, বড়োআপার প্রতি তাঁর মমতা ছিল। এবং এটা এত বেশি পরিমাণে ছিল যে সবার চোখে পড়ত। এক বার ঈদের সময় বোনাস পেলেন না। বোনাস না পেলে ঈদের কাপড় হয় না, আমরা জানতাম। কাজেই আমরা বেশ সহজভাবেই পুরনো কাপড় লড়ি থেকে ইস্ত্ৰি করিয়ে আনলাম। নতুন কাপড় কিছুনা দেওয়াটা খারাপ বলে আমরা তিন ভাই তিন জোড়া মোজা পেলাম। নতুন মোজার সঙ্গে ম্যাচ করাবার জন্যে আমরা বুট পালিশওয়ালার কাছ থেকে জুতো পালিশ করিয়ে আনলাম। এক টাকা করে নিল প্রতি জোড়া।
ঈদের আগের রাতে দেখি বাবা বড়োনার জন্যে সাদার মধ্যে লাল ফুল আকা একটা ক্ষক নিয়ে এসেছেন। আমাদের কারো জন্যে কিছুই আনেন নি। এবং এজন্যে তাঁকে বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা দুঃখিত মনে হল না। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জেদী হচ্ছে অনু। সে বলল, আমি ঈদ করব না।
বাবা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, তুই ঈদ না করলে ঈদ আটকে থাকবে? যত ফালতু বাত।
ঈদের দিন আমরা সবাই মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। বাবা বড়োআপার হাত ধরে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাঁর বন্ধুদের বাড়িতে গেলেন। বড়োআপা ছাড়াও যে তাঁর আরো ছেলেমেয়ে আছে, তা বোধ হয় তিনি মনে করতেন না।
মনসুর চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ফাইন চাচা তেমন ফাইন নয়। কিন্তু মনসুর আজ সব কিছুতেই ফাইন বলবে। আলগা একটা ফুর্তির ভাব মুখের উপর ঝুলিয়ে রাখবে। খুব সম্ভব ওর ধারণা হয়েছে, হাসপাতাল থেকে আমি আর ফিরব না। ডাক্তাররা ওকে কিছু হয়তো বলেছে।
ফাসক্লাস চা হয়েছে রে। আরেক কাপ খাবি? না।
আমি একটা সিগারেট ধরালাম। অন্য সময় হলে সে ছোঁ মেরে সিগারেট নিয়ে ফেলে দিত। আজ কিছুই করল না। এসব ভালো লক্ষণ নয়। তাহলে কি ফেরার সম্ভাবনা একেবারেই নেই? ওয়ান-ওয়ে জানি?
পিজির যে ডাক্তার আমার অপারেশন করবেন, তাঁর কথাবার্তায় অবশ্যি সেরকম মনে হয় না। আমার ধারণা ছিল বুড়ো না হলে প্রফেসর হওয়া যায় না। কিন্তু এই ভদ্রলোকের বয়স মনে হয় চল্লিশও হয় নি। কানের কাছের কয়েকটি চুল শুধু পাকা। চমৎকার চেহারা। দেখে মনে হয় এই লোকটি রাগ করতে জানে না। চেচিয়ে কথা বলতে জানে না। মিথ্যা কথা বলতে পারে না। এ শুধু সবার সঙ্গে মজার মজার গল্প করে এবং ছুটিছাটা পেলেই ছেলেমেয়েদের হাত ধরে পার্কেটার্কে বেড়াতে যায়, বাদাম কেনে–কিন্তু বাদামের খোসাগুলি যেখানে-সেখানে ফেলে না, আধ মাইল হেঁটে ডাস্টবিনে ফেলে আসে।
ভদ্রলোক কথাবার্তায়ও খুব চমৎকার। রু করলেন এইভাবে, তারপর ফরিদ সাহেব, পেট কাটবার জন্যে তৈরী তো? হু, চর্বি-টবি বিশেষ নেই। আরাম করে চামড়া কাটা যাবে। সার্জন হয়ে কি মুসিবত হয়েছে জানেন? কাউকে দেখলেই কেটে ফেলতে ইচ্ছা করে। হা-হা-হা।
ডাক্তারদের নিয়ে একটা ভালো রাসিকতাও করলেন। এক রুগীর অপারেশন হবে। অপারেশন টেবিলে শোণ্ডয়ান হয়েছে। রুগী কাঁপা গলায় সার্জনকে বলল, স্যার, এটা আমার প্রথম অপারেশন। বড়ো ভয় লাগছে। সার্জন ভদ্রলোক তখন। নার্ভাস গলায় বললেন, আমারও প্রথম অপারেশন। আমারও ভয় লাগছে ভাই। রুগীকে এনেসথেশিয়া করা হচ্ছে। জ্ঞান হবার আগমুহূর্তে রুগী শুনল সার্জন সাহেব একমনে দোয়া ইউনুস পড়ছেন।
গল্প শেষ করে তিনি শব্দ করে হাসলেন। বড়ো ডাক্তাররা এত শব্দ করে হাসে না, এবং গল্পগুজবও করে না। বোধ হয় ইনি বড় ডাক্তার নন। আমি বললাম, আশা করি আমার পেট কাটার আগেও আপনি কিছু কাটাকাটি করেছেন?
ডাক্তার সাহেব আবার ঘর কাপিয়ে হাসলেন এবং তাঁর জীবনের প্রথম অপারেশনের গল্প করতে লাগলেন। বেশ জমাটি গল্প। ইনি আমার সঙ্গেই এমন গল্পগুজব করলেন, না সবার সঙ্গেই করেন? শুধু আমার সঙ্গে করে থাকলে তার অর্থ অন্যরকম হয়। খুব একটা ভালো অর্থ তা নয়।
মনসুর উঠে দাঁড়াল। সহজ স্বরে বলল, অফিসের সময় হয়ে গেল, যাই। বিকেলে আসব।
চল, এগিয়ে দিয়ে আসি।
এগিয়ে দিতে হবে না। শুয়ে থাক। ঘুম দে।
সোমবার থেকে শুয়েই থাকব, এখন একটু হাঁটাহাঁটি করি।
আমি মনসুরকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। চেনা পানের দোকান থেকে দশটা ফাইভ ফাইভ কিনলাম। মনসুর দেখল। কিছুই বলল না। ভালো লক্ষণ নয়। তার নিষেধ করা উচিত ছিল।
বিকেলে ঘরে থাকিস, আমি আসব।
কাজ থাকলে আসার দরকার নেই।
না, কাজ কিছু না। আর শোন, রাতে আমার এখানে খাবি। আমি বৌকে বলে এসেছি।
ঠিক আছে। সিগারেট খাবি নাকি একটা?
মনসুর একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে টানতে লাগল।
আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। মানুষের উপর আমার মায়া পড়ে না। কিন্তু জড় বস্তুর উপর সহজেই মায়া পড়ে যায়। আমার সব সময় মনে হয় জড় বস্তুরও একটা আলাদা জীবন আছে। এবং তারাও যেন মানুষের মতোই ভালোবাসতে পারে।
ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষায় এলাউ হবার জন্যে ছোটমামা আমাকে একটা রাইটার কলম কিনে দিয়েছিলেন। রোজ এটাকে বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমাতাম। এবং ঘুমাবার আগে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলতাম। যেমন, কি ভাই ঘুম পেয়েছে? আচ্ছা ঠিক আছে, ঘুমাও। ব্যাপারটা অকারণে প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং বাবা আমাকে প্রচণ্ড চড় দিয়ে মেঝেতে উন্টে ফেলে দেন। সেই সঙ্গে হুঙ্কার দিতে থাকেন, মানুষের সাথে কথা নাই, কলমের সঙ্গে কথা। পাগলছাগলের ঝাড়। পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলব আর যদি কোন দিন শুনি।
এই ঘরটির উপর আমার মায়া পড়ে গেছে, দীর্ঘদিন থাকলাম এখানে প্রায় দু বছর। বত্রিশ বছর যদি আয়ু হয়, তাহলে জীবনের ষোল ভাগের এক ভাগ। বড়ো দীর্ঘ পরিচয়। দশ ফুট বাই আট ফুট এই কামরায় আর কি কোনো দিন ফিরে আসব? কত পরিচিত জিনিস চারিদিকে। কত কিছুই না আছে। লেজ নেই একটি বুডো টিকটিকি। এর কোনট সঙ্গী বা সঙ্গিনী নেই, এর পাশে অন্য কোনো টিকটিকি কোন দিন দেখি নি। আরো দুটি আছে তারা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এই বুড়টির সাথীরা একে ছেড়ে গেছে।
বাথরুমে কুৎসিত একটা মাকড়সা আছে। সে শুধু কুৎসিত নয়–ভয়াবহ। তার পেটে চকচকে রূপালী একটা ডিমের থলি। এই থলি নিয়ে বেশির ভাগ সময়ই সে বেসিনের নিচে কোনো এক অন্ধকার কোণে লুকিয়ে থাকে। রাতদুপুরে হঠাৎ করে বেরিয়ে এসে আমাকে দারুণ চমকে দেয়।
আমার এ ঘরে একটিমাত্র জানালা। বেশ বড়োসড়োজানালা। তবে তেমন কিছু জানালা দিয়ে দেখা যায় না। শুধু পাশের ফ্লাটের অনেকখানি চোখে পড়ে। একটি বালিকাকে প্রায়ই দেখি বারান্দায় বসে আচার খাচ্ছে কিংবা বই পড়ছে। সুন্দর দৃশ্য। এই মেয়েটির উপরও মায়া পড়ে গেছে। সোমবারের পর এই চমৎকার দৃশ্যটিও হয়তো দেখা যাবে না।
জীবনের ষোল ভাগের এক ভাগ যেখানে কাটল তার উপর মায়া তো পড়বেই। পড়াই স্বাভাবিক। টাঙ্গাইলের এক হোটেলে এক বার সাত দিন ছিলাম। এমন মায়া পড়ে গেল। ছেড়ে চলে আসবার সময় বুক হু-হু করতে লাগল। চোখ ভিজে ওঠার উপক্রম।
আমি পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা টেনে নিলাম। একটু যেন শীতশীত করছে। তলপেটে ব্যথা শুরু হয়েছে।
সূক্ষ্ম একটা ব্যথা। মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি আছি। তোমার ভিতর বাস করছি। আমাকে ভুলে যাওয়া ঠিক নয়।
বাইরের রোদ নরম হয়ে আসছে। মেঘ জমতে শুরু করেছে। বর্ষা আসি-আসি করছে। এবার খুব জাঁকিয়ে বৰ্ষা আসবে। তার সাজসজ্জা টের পাওয়া যাচ্ছে। আমার ঘর থেকে আকাশ দেখা যায় না। কেন যেন মেঘ দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি উঠে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। আচার-খাওয়া সেই বালিকাটি রেলিং-এ হেলান। দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৈশোরে এরকম একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। মেয়েটির নাম নীলিমা। তার বাবা নেত্রকোণা কোর্টের পেশকার ছিলেন।
সেই নীলিমাও খুব আচার খেত। ক্লাস নাইনে ওঠামাত্র নীলিমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্যে রাত জেগে পড়ছি। বাবা রোজ এক বার করে বলছেন, ডিভিশন না পেলে জুতো দিয়ে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব। নীলিমার বিয়ে আমাকে অভিভূত করে দিল। বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হল। রাতে বালিশে মুখ গুঁজে ভেউ ভেউ করে কাঁদলাম। বড়োআপ অবাক হয়ে বললেন, এই, তোর কী হয়েছে রে?
পেটে ব্যথা।
কোন জায়গায় ব্যথা দেখি?
আমি আরো শব্দ করে কাঁদতে লাগলাম। বড়োআপা মাকে ডেকে আনল। এবং দুপুররাতে মা আমার পেটে তেল মালিশ করতে লাগলেন। কৈশোরের সেই বিরহ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। আমি যথারীতি পরীক্ষা দিই এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটি লেটার নিয়ে ফাষ্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ি।
এই আচার-খাওয়া মেয়েটির সঙ্গে খুব সম্ভব নীলিমার কোন মিল নেই, তবু মাঝে মাঝে এই মেয়েটিকে নীলিমা ভাবতে ভালো লাগে। শুধু এই মেয়েকে কেন, পৃথিবীর সব বালিকাকেই আমার কাছে নীলিমা বলে মনে হয়।
টিপ টপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আমি পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তুমুল বৰ্ষণ হচ্ছে বাইরে। চারদিক অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটি নেই। মনসুরের আসবার কথা চারটায়, বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে। নিচয়ই। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি বারান্দায় হারিকেন জ্বালানর চেষ্টা করছেন করিম সাহেব। তাঁর ঘর থেকে শো-শোঁ শব্দ আসছে। কুকারে ভাত চড়িয়েছেন বোধ হয়। করিম সাহেব আমাদের মত হোটেলে খান না। নিজে রান্না করেন।
এই যে ফরিদ ভাই, আজ শরীরটা কেমন?
ভালোই।
ব্যথাট্যথা নেই তো?
জ্বি-না।
ঘুমিয়েছিলেন নাকি?
জ্বি। দেশ ভাসিয়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে। ক্যাট্স্ এণ্ড ডগ্স্ যাকে বলে। চা খাবে, নাকি?
জ্বি-না, থাক।
আসেন আসেন, এক কাপ চা খান। চা সব সময় খাওয়া যায়।
করিম সাহেবের ঘরে গিয়ে বসতে হল। চাও খেতে হল। আজকাল লোকজন আমাকে খুব খাতির করছে।
অপারেশনের ডেট দিয়েছে?
জ্বি-না।
অপারেশন আজকাল ডাল-ভাত হয়ে গেছে। ভয়ের কিছুই নাই। তলপেটের অপারেশন তো ডাক্তাররা এখন চোখ বন্ধ করে বা হাতে করে। হা-হা-হা।
আমি চুপ করে রইলাম। পরিচিত-অপরিচিত প্রায় সবাই এখন আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, অপারেশনটা কত সহজ। আমার দিক থেকে তার কোন প্রয়োজন নেই। অপারেশন সহজ বা জটিলে কিছু আসে যায় না। করিম সাহেব চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বললেন, কত সিরিয়াস সিরিয়াস অপারেশন হচ্ছে। হার্ট, ব্রেইন। একেবারে ছেলেখেলা ব্যাপার।
তা ঠিক।
করিম সাহেব ভাত টিপে দেখলেন। তারপর বেশ আন্তরিকভাবেই বললেন, আজ চারটা ভাত খান না আমার সঙ্গে, খাটি গাওয়া ঘি আছে। বেগুনভাজা, গাওয়া ঘি। তার সঙ্গে শুকনা মরিচ ভেজে দেব। খারাপ লাগবে না।
আজ থাক। আরেক দিন খাব।
আজ অসুবিধা কী? বৃষ্টির দিন হোটেলে যেতে কষ্ট হবে। আসেন, দুজনে মিলে খাই।
আমাকে নিতে আসবে, এক জায়গায় খাওয়ার কথা আছে।
এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে নিতে আসবে কীভাবে?
কথাটা সত্যি। বেশ দুযোগ বাইরে। রাস্তায় বাতিও নেই। মনসুর আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবুও সে আসবে। আমি আমার অন্ধকার ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। মোমবাতি আছে, তবুও জ্বালাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কে যেন বলেছিল–প্রতীক্ষা করতে হয় অন্ধকারে। বোধহয় মিলনের প্রতীক্ষার কথা বলা হয়েছে। বসে থাকতে-থাকতে আটটা বেজে গেল। আমি প্রায় নিশ্চিত মনসুর আসবে না, তখন সে এল। গা দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ঝড়োকাকের মতো চেহারা, কাঁপছে ঠকঠক করে।
রিকশা দাঁড় করিয়ে এসেছি, চল।
মনসুরের বাসায় যেতে আমার ভালো লাগে না। সে নতুন বিয়ে করেছে, নতুন বৌরা স্বামীর বন্ধুদের সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এমন ভাব দেখায়, যেন স্বামীর বন্ধুদের জন্য খুব ব্যস্ত। মনসুরের বৌ সে-ভাটাও দেখায় না। সে স্পষ্টতই বিরক্ত হয়। সবাই তার বিরক্তি ধরতে পারে। মনসুর পারে না। উঠতে গেলেই মনসুর বলে, এত তাড়া কিরে, আরেকটু বস, আরেকটু বস।
মনসুরের স্ত্রী রীনা তীক্ষ্ণ কষ্ঠে বলে, বসতে বলছে, বসুন না।
মনসুর তাতে উৎসাহ পায়। হাসিমুখে বলে, রীনা আমাদের একটা গান শোনাও না। প্লীজ।
আজ না, আরেক দিন।
আহ্ শোনাও না। এই তোরা একটু রিকোয়েস্ট কর না। তোরা রিকোয়েস্ট করলে শোনাবে।
রিকোয়েস্ট করতে ইচ্ছে হয় না, তবু করতে হয়এবং এক সময় রীনা তী কণ্ঠে একটা রবীন্দ্রসংগীত শোনায়–আজি এ বসন্তে মাঘ মাসের দুর্দান্ত শীতে বসন্তের গান শুনে আমরা প্রশংসা করি। মনসুর দাঁত বের করে হাসে। এর বুদ্ধিশুদ্ধি এমনিতেই কম। বিয়ের পর আরো কমে গেছে। তার ধারণা হয়েছে, এরকম একটা ভাল বিয়ে পৃথিবীর আর কেউ করে নি। শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে তার উৎসাহ সীমাহীন। কেনটাকিতে তার স্ত্রীর এক ভাই থাকে। তাদের নতুন কেনা গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়ে পড়ে গেছে। এই নিয়ে মনসুরের চিন্তার শেষ নেই। অথচ সেভাইকে সে চোখেও দেখে নি।
কাটা দেখ, নতুন কেনা গাড়ি। সিক্স থাউজেন্ড ইউ এস ডলার দাম। অবশ্যি ইনসুরেন্স আছে। সব কভার করবে।
আমরা উৎসাহ না দেখালেও ক্ষতি নেই। মনসুর মুগ্ধ ভঙ্গিতে শ্বশুরবাড়ির গল্প করে যাবে, বুঝলি, আমার শ্বশুর সাহেবের ইচ্ছা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকা। গ্রামের বাড়ি হলে কি হবে, হুলস্থূল ব্যাপার। বাড়ির পিছনে আলিশান পুকুর। গত বৎসর তিন হাজার রুইয়ের পোনা ছাড়া হয়েছে। এর মধ্যেই এক হাত বড়ো হয়ে গেছে।
নির্বোধের মতত গল্প। শুনলেই অস্বস্তি হয়। তবু শুনতে হয়। হাসতে হয়। ভান। করতে হয় যেন খুব আগ্রহ বোধ করছি। রীনা বসে থাকে পাথরের মূর্তির মতো। তার চোখে-মুখে যাচ্ছিল্যের একটা ভাব। মনসুরের গল্পগুলি সে কী ভাবে গ্রহণ করে বুঝতে পারি না।
আজ অবশ্য রীনা খুব যতুট করল। তোয়ালে নিয়ে এল মাথা মোছর জন্য এবং আমাকে অবাক করে বলল, মাথা নিচু করুন, আমি মুছিয়ে দিচ্ছি। আমি আমার বিস্ময় গোপন করে বললাম, কোনো রমণীর কাছে আমি মাথা নিচু করি না। চির উন্নত মম শির।
রীনা একটু হকচকিয়ে গেল। আমি কথাবার্তা কম বলি, এরকম কিছু বলব আশা করে নি বোধ হয়। মনসুর উচু গলায় বলল, আজ আমাদের ম্যারেজ ডে।
তাই নাকি?
আরে গাধা, রীর ড্রেস দেখে বুঝতে পারছি না? বিয়ের শাড়ি। তুই আর আমি গিয়ে কিনলাম নগদ দুই হাজার টাকায়। টাকা শর্ট পড়ল, তোর কাছ থেকে নিলাম দু শ টাকা। মনে নেই কিছু?
শাড়ির এ ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ল না কেন? ঝড়-বাদলার দিনে কোনো মেয়ে তো এমন বেনারসী পরে ঘরে বসে থাকে না। ঘরে অবশ্যি ইলেকট্রিসিটি নেই, হারিকেন জ্বলছে। তবুও এ আলোতেও তো চোখে পড়া উচিত ছিল। মনসুর নিচু গলায় বলল, কেকের অর্ডার দিয়েছিলাম, সেটা আনতে গিয়েই দেরি হল। কেকের উপর লেখা থাকবে–শ্রীনার জন্যে। শালা শুওরের বাচ্চারা লিখেছে। মীনার জন্যে। যে লেখে সেই ব্যাটার জন্য অপেক্ষা করতে-করতে দেরি হল। শালা আর আসলই না। কাণ্ড দ্যাখ!
কেকটা আবার কেন?
রীনার ইচ্ছা, খাওয়াদাওয়ার পর কেক কাটবে। বয়স তত বেশি না, ছেলেমানুষ এখনো। নে, একটা সিগারেট খা। খাবার গরম করতে সময় লাগবে।
এখন অনেক কিছুই আমার চোখে পড়ছে না। এত বড় একটা কেকের বাক্স সঙ্গে ছিল, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। আমি হালকা স্বরে বললাম, বিবাহবার্ষিকী-টার্ষিকী নিজেদের মধ্যে করতে হয়। আমাকে শুধু শুধু ডাকলি কেন?
মনসুর গলা ফাটিয়ে হাসল, যেন আমি খুব একটা হাসির কথা বলেছি। আমি বললাম, উপলক্ষটা বললে একটা কিছু আনতে পারতাম।
শালা তুই আবার আনবি কি? শুধু ফর্মালিটি।
মনসুর গভীর মনোযোগর সঙ্গে কেকের লেখা মীনাকে রীনা বানানর চেষ্টা করতে লাগল। রীনা এক বার জিজ্ঞেস করে গেল, চা দেব ভাই? খাবার দিতে দেরি হবে। একটা জিনিস ভাজতে হবে। কুমড়া ফুলের বড়া।
না, চা লাগবে না।
খান না একটু, আমিও আপনাদের সঙ্গে খাব।
ঠিক আছে, আনেন।
মনসুর গভীর হয়ে বলল, রীকে তুই আপনি-আপনি করিস কেন? তুমি করে বলবি। স্ট্রেইট তুমি।
আমি কিছু বললাম না। ওর এই বিচিত্র স্বভাব, বন্ধুবান্ধবকে সে তাদের দু জনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চায়। এটা হবার নয়, তা বুঝতে চায় না।
আমি হালকা সুরে বললাম, আর কাউকে বলেছি?
নাহ্, শুধু তোকে। অনলি ইউ।
কেন, শুধু আমাকে কেন?
মনসুর তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি সহজভাবেই বললাম, তোর কি। ধারণা আমি আর ফিরে আসব না? মনসুরের মুখ কালো হয়ে গেল। এই কথাটি তাকে না বললেই হত। কেন বললাম?
রীনা চা নিয়ে এসে বসল আমাদের সঙ্গে। বেশ লাগছে মেয়েটিকে। এমনিতে তাকে এতটা ভালো লাগে না। আমি লক্ষ করেছি অসুন্দর মেয়েদেরও মাঝে মাঝে অপরূপ রূপবতী মনে হয়–যেমন গায়ে হলুদের দিন। শুধু এই দিনটিতেই কোনো এক বিচিত্র কারণে তারা দেবীমূর্তির মতো হয়ে যায়।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, আমরা চা খাচ্ছি নিঃশব্দে। রীনা খুব কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি বললাম, আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
বিয়ের শাড়িতে সবাইকে সুন্দর লাগে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। মনসুর বসে আছে গম্ভীর হয়ে। সে কি কেকের মীনাকে রীনা করেছে? আমি বললাম, কটা বাজে রে?
যতটা বাজুক, তুই বসে থাক চুপচাপ। রাতে তোক যেতে দেব না।
বলিস কি!
রীনা নিচু স্বরে বলল, হাসপাতালে ভর্তি হবার আগের কটি দিন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
মনসুর বলল, আমি কাল সকালে তোর জিনিসপত্র সব নিয়ে আসব।
নতুন জায়গায় আমার ঘুম হয় না।
না হলে না হবে। ফালতু কথা।
রীনা বলল, আপনি থাকবেন বলে আপনার বন্ধু চাদর-বালিশ এই সব কিনে এনেছে। না থাকলে ওর কষ্ট হবে। কয়েক দিনের ব্যাপার তো, থেকে যান।
আমি কঠিন স্বরে বললাম, মনসুর, আমি জানি আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে আসব না। কাজেই যে কটা দিন আমি আছি, আমাকে নিজের মতো থাকতে দে। এই নিয়ে ঝামেলা করি না।
মনসুর গম্ভীর স্বরে বলল, এখানে তোর কোনোকষ্ট হবে না।
জানি কষ্ট হবে না, এখানে অনেক সুখে থাকব। তবু তুই আমাকে আমার মতো থাকতে দে।
রীনা বলল, আজকের রাতটা অন্তত থাকুন। বেচারা আপনার জন্যে নতুন চাদর-বালিশ কিনেছে।
আমি কিছু বললাম না। রীনা নরম স্বরে বলল, ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ফেরত যাবেন কী ভাবে? রাতও অনেক হয়েছে। আজকের রাতটা থাকুন। এক রাতে কী হবে?
ঠিক আছে, থাকব।
মনসুর মুখ কালো করে বলল, ইচ্ছা না হলে থাকতে হবে না।
কিছু কিছু মানুষের বয়স বাড়ে না। তারা মনসুরের মতো সারা জীবন শিশু থেকে যায়। আজ সারা রাত সে হয়তো কথাই বলবে না। অথচ আমাকে এখানে জড়ানর তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আজকের এই ঝড়জলের রাত হচ্ছে তাদের দু জনেরা আজ তাদের একটা চমৎকার উৎসবের রাত। আমার এখানে স্থান কোথায়?
অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত পরিবেশে আমি ঘুমুতে পারি না। তার উপর আজ বিকেলেই বড় একটা ঘুম দিয়েছি। আমি মশারির ভেতর গা এলিয়ে শুয়ে রইলাম। ঘুম আসবে না জানি, ঘুমাবার চেষ্টা চালিয়ে যাবার কোনো অর্থ হয় না।
মেঝেতে হারিকেন ডিম করা। কেমন গ্রাম-গ্রাম লাগছে। আলো না থাকলেই বোধহয় ভালো ছিল। কিন্তু মনসুর শুধু হারিকেন নয়, একটা টৰ্চলাইটও বালিশের নিচে রেখে গেছে। যতের চূড়ান্ত করতে চেষ্টা করছে দুজনেই।
টেবিলের উপর ঝকঝকে পানির জগ, গ্লাস। রাতে খিদে পেলে খাওয়ার জন্যে হরলিকসের টিনে কিছু বিসকিট। গোবার আগে রীনা এল মশারি গুজে দিতে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ছি ছি, আমি বুঝি মশারি খুঁজতে জানি না? লাভ হল না। মনসুর কমপক্ষে দশ বার বলল, অসুবিধা হলেই ডাকবি। আমার পাতলা ঘুম, এক বার ডাকলেই হবে।
ঘড়িতে রাত প্ৰায় একটা। ফিসফিস করে ওরা কথা বলছে। এক বৎসর পরও এত কথা থাকে নাকি কারো? স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার কথাবার্তা শুনতে বড়ো অস্বস্তি লাগে। ওদের কথাবার্তা অবশ্যি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, তবু বড়ো অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে একটা কিছু অপরাধ যেন করে ফেলেছি।
আমার বড়োভাইয়ের বিয়ের পরও এমন অবস্থা। তাদের লাগোয়া ঘরটিতে আমি থাকি। গভীর রাত পর্যন্ত দু জন কথা বলে। শুনতে ইচ্ছা করে না, তবু শুনতে হয়। যত অর্থহীন কথাবার্তা অর্থহীন রসিকতা। সকালবেলা ঘুম ভেঙে ভাবীকে দেখলেই বড়ো লজ্জা লাগে। চোখ তুলে তাকাতে পারি না, এমন অবস্থা। ভাবীর আচার-আচরণ কিন্তু খুব স্বাভাবিক। সবার সঙ্গে হাসছে, গল্প করছে। নতুন নতুন রান্নাবান্না করছে। ভাবীকে দিয়ে আমাদের সংসারের শ্ৰী ফিরে গেল। বাবু পর্যন্ত নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। মাঝে-মধ্যে হাসতেও লাগলেন।
তারপর এক দিন বাসায় এসে শুনি বড়োভাই আলাদা বাসা করেছেন। তাঁর শশুর নাকি অল্প ভাড়ায় কী একটা বাসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধু বাসাই নয়, তিনি নাকি তাকে একটা সাইড বিজনেসের কথাও বলেছেন। টাকা তিনি দেবেন। বড়োভাই অতিরিক্ত রকমের উৎসাহের সঙ্গে বললেন, এই সংসারের খরচ আমি আগে যেমন দিতাম এখনো দেব। চিন্তার কিছু নেই। মা বিশেষ ভরসা পেলেন না। মায়েরা অনেক জিনিস আগে আগে বুঝতে পারে।
আসলে আমাদের কারোরই মা-বাবার প্রতি তেমন টান ছিল না। মেজো ভাই জার্মানি গিয়ে চুপচাপ হয়ে গেল। দু মাস তিন মাস পরপর চিঠি আসে। একটি চিঠিতে জানলাম ল্যাঙ্গুয়েজ পরীক্ষায় পাস করতে পারে নি। সম্ভবত তাকে দেশে ফিরে আসতে হবে। বাবা প্রায় পাগলা কুকুরের মতো হয়ে পড়লেন। সে অবশ্যি দেশে ফিরল না। মাস ছয়েক পর চিঠি এল, সুইডেনে চলে এসেছে। সে চিঠিতে কোনো ঠিকানা নেই, লেখা আছে এখনো কোন স্থায়ী ঠিকানা হয় নাই। হওয়া মাত্রই জানাইব। এক বৎসরেও তার কোন স্থায়ী ঠিকানা হল না। আমরা তাকে কিছু লিখতে পারি না। কোন খবর দিতে পারি না। কী অবস্থা। এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল, কাগজপত্র না থাকায় তাকে নাকি সুইডেনের এক জেলখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। খবর কতটুকু সত্যি জানার উপায় নেই।
সেসময় আমাদের এখানেও অনেকগুলি খবর তৈরি হল, যেগুলি তাকে জানান গেল না। যেমন অনুর বিয়ে হয়ে গেল নারায়ণগঞ্জের এক উকিলের সঙ্গে। খুবই ভালো বিয়ে। শহরের উপর তাদের বাড়িটাড়ি আছে। ছেলের চেহারাও সুন্দর। অনুর (যে খানিকটা তোতলিয়ে কথা বলে) এতটা ভালো বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। আমরা খুবই খুশি। পরে অবশ্য জানা গেল, উকিল সাহেব আগে এক বার বিয়ে করেছিলেন এবং সেই বিয়ের একটি ছেলেও আছে। দ্বিতীয় বার বিয়ের সময় স্ত্রীর খবর চেপে গিয়েছেন। ভদ্রলোক কেন এটা করলেন কে জানে?
বিয়ের এই খবর মেজো ভাইকে জানান গেল না। মা মারা যাবার খবরও জানান গেল না। তিনি মারা গেলেন হঠাৎ করেই। রাতের বেলা জেগে উঠে বললেন, তাঁর বুক জ্বালা করছে। বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, ও কিছু না, খেসারির ডাল বেশি খেয়েছ, তাই অম্বল হয়েছে। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে শুয়ে থাক। মা তাই করলেন। ঘন্টা খানিক পর উঠে বসে বললেন, বুক জ্বলে যাচ্ছে। বাবা বললেন, এক গ্রাস লেবুর শরবত করে খাও। খেয়ে শুয়ে থাক।
বাবার কথা মার কাছে নবীর ওহীর মতো। ঘরে লেবু ছিল না। চিনির শরবত বনিয়ে খেলেন এবং ছটফট করতে লাগলেন। বাবা বললেন, চেঁচামেচি করলে কি আর ব্যথা কমবে? শুয়ে থাক। ভোরবেলা ডাক্তারকে খবর দেব।
শেষ রাতে আমরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা বললেন, ফুড পয়জনিং আলুপটলের তরকারি এবং খেসারির ডাল খেয়ে আমাদের কারো কিছু হল না, তাঁর ফুডপয়জনিং হয়ে গেল? কোন মানে হয়।
বৃষ্টি থেমে গেছে। মনসুরের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। ওরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? আমি সাবধানে উঠে বসলাম, তলপেটের ব্যথাটা টের পাচ্ছি। লক্ষণ ভাল নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ব্যথা আমাকে কাবু করে ফেলবে। মনসুরকে হয়তো ডাকতে হবে। আমি প্রাণপণে ব্যথাটা সামাল দিতে চেষ্টা করলাম। কিছু কিছু জিনিসকে কিছুতেই সামাল দেওয়া যাবে না। একেও যাবে না। এর নিজস্ব একটি জীবন আছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে নাড়িজুড়ি ফেটে বেরিয়ে আসবে। ডাকব না ওদের, কিছুতেই ডাকব না। বমি করতে ইচ্ছা হচ্ছে। হারিকেনের আলো ক্ৰমেই বাড়ছে। আমি মৃদু স্বরে মাকে ডাকলাম, মা তুমি কোথায় আছ? এস, ব্যথা কমিয়ে দাও।
পাশের ঘর থেকে শব্দ হচ্ছে। মনসুর উঠে আসছে। রীতার গলা পাওয়া যাচ্ছে। কী যেন বলছে সে। আমি ক্ষীণ স্বরে ডাকলাম, মনসুর। কেন ডাকলাম? সে কিছুই করতে পারবে না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া এখন কেউ কিছু করতে পারবে না। তবু মনে হয় কেউ আসুক। পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকুক। মনসুরের গলা পাওয়া যাচ্ছে, এই ফরিদ, কী হয়েছে? আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মরে যাচ্ছি। আমি মরে যাচ্ছি।
মনসুর আমার হাত ধরে রেখেছে। রীনাবসে আছে আমার ডান পাশে। সেবড়ো ভয় পেয়েছে। রীনা ফিসফিস করে বলল, কোথায়, কোন জায়গায় ব্যথা? ঘরের আলো কমে আসছে। রীতার মুখ অসম্ভব বড় মনে হচ্ছে। রীনা আবার বলল, কোথায় ব্যথা? কোথায়?
ঠিক অন্য সব দিনের মতোই আমার ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে দেখলাম মনসুর এবং রীনা বসে আছে চেয়ারে। মশারি তোলা। মাথার কাছে একটা ছোট টেবিল ফ্যান। পাখা ঘুরছে।
কি রে, কেমন লাগছে?
ভালো।
কিছুক্ষণ পরই তুই ঘুমিয়ে পড়লি। রীনা বলেছিল, তুই অজ্ঞান হয়ে গেছিল। মাথায় পানি ঢাললাম।
আমি ফ্যাকাশেভাবে হাসতে চেষ্টা করলাম। রীনা বলল, ব্যথাটা আপনার কতক্ষণ থাকে?
বেশিক্ষণ না। কমে গেলেই ঘুম এসে যায়। লম্বা ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হয়ে যাই।
আপনি কিছু খাবেন? চা আর টোস্ট এনে দিই? নাকি এক পিস কেক খাবেন?
চা খাব। শুধু চা।
রীনা উঠে চলে গেল। মনসুর বলল, ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলি। হাত-মুখ ধুবি? পানি এনে দিই?
এনে দিতে হবে না। নিজেই বাথরুমে যাব।
চুপচাপ শুয়ে থাক, নড়াচড়া করি না।
এখন আর কিছু হবে না। মনসুর বলল, আজ আমি আর অফিসে যাব না। ঠিক করেছি, ঘরেই থাকব। সে হাই তুলল। তার চোখ লাল। বেচারা সারা রাত কষ্ট করল।
মনসুর।
বল।
চা খেয়ে আমি বেরুব।
কোথায়?
মীরপুর পাঁচ নম্বর সেকশন। বাবাকে দেখে আসি।
আজ শুয়ে থাক, নড়াচড়া করিস না।
আজ না গেলে আর সময় পাব না।
চল আমিও যাই তোর সঙ্গে।
না।
আমি তোর সঙ্গে গেলে অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। ঐ বাসায় কাউকে নিয়ে যাই না।
ভেবেছিলাম আমাকে যেতে দিতে রীনা আপত্তি করবে। সে করল না। মেয়েটি ভয় পেয়েছে। কাল রাতের মতো কোনো দৃশ্য সে সম্ভবত দ্বিতীয় বার দেখতে চায় না। না চাওয়াই ভালো।
সারা রাত বৃষ্টি হবার জন্যেই বোধহয় রাস্তাঘাট ঝকঝক করছে। গাছের পাতা অন্য দিনের চেয়েও বেশি সবুজ। চারদিক চকলেটের রাতার মতো ঝিলমিল করছে। মন ভালো হয়ে যাবার মতো একটা সকাল। অপূর্ব। এরকম একটি সকালে পুরনো কথা মনে পড়ে না, শুধু বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
ভেবেছিলাম বাসে করে যাব। এই সময় মীরপুরের দিকের বাস ফাঁকা যায়। কিন্তু মনসুরের জন্যে পারা গেল না। সে আমাকে কিছুতেই বাসে উঠতে দেবে না। বাসে উঠলেই নাকি আমার তলপেটের নাড়িতুড়ি ঝাঁকুনিতে ফেটে চৌচির হবে। সে বাইশ টাকায় এক বুড়ো রিকশাওয়ালাকে রাজি করিয়ে ফেলল। গলার স্বর নামিয়ে অন্তরঙ্গ স্বরে বলল, বুড়ো মিয়া, খুব আস্তে আস্তে চালাবেন। রুগী মানুষ। দু দিন পর অপারেশন।
রিকশাওয়ালাকে এত কথা বলার কোনোই দরকার নেই। রিকশাওয়ালা চলবে তার নিজের মতো।
ফরিদ।
বল।
চাচাজীর সঙ্গে দেখা করেই ফিরে আসবি। আমার এখানে চলে আসবি, স্ট্রেইট চলে আসবি। নো হেংকিপেংকি।
আমি হাসলাম। যার মানে হা-না–দুই-ই হতে পারে।
আসবি কিন্তু।
দেখি।
বুড়ো মিয়া, সিরিয়াস রুগী। রিকশা খুব ধীরে টানবেন। যান, আরেক টাকা বখশিশ–আস্তে চালালে। ফরিদা তেইশ টাকা দিয়ে দিস। শোন, হুড তুলে দে।
বাবা বর্তমানে আছেন নাজির ভাইয়ের সঙ্গে। নাজির হোসেন আমার বড় মামার ছেলে। বত্সর দুই আমাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছেন।
এই দুই বৎসরেই তিনি সমগ্র পাড়ায় একটা ত্রাসের সৃষ্টি করেন। সেই সময় তিনি আই. কম. পড়তেন। এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। তার পড়াশোনার কথা আমার মনে নেই, কিন্তু সাতসকালে বালির বস্তার উপর কিল-ঘুষির কথা মনে আছে। অল্পদিনের মধ্যে আমার বড়োভাইও তাঁর সঙ্গে জুটে গেলেন। এবং দুজন একই সঙ্গে ফেল করলেন।
ফেল করবার পর বড়ভাইয়ের উৎসাহ খানিকটা মিইয়ে গেল, কিন্তু নাজির ভাই বিপুল উৎসাহে নাজির ড্রামা ক্লাব খুলে বসলেন। সেই ক্লাবের রিহার্সেল হত আমাদের বাসায়। দারুণ হৈ-চৈ ব্যাপার! নাজির ভাইয়ের অনেক শাকরে জুটে গেলো। বাবার মতো লোক পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করতে শুরু করলেন।
ছোটখাট অনেক রকম কাণ্ডকারখানা নাজির ভাই করতে লাগলেন। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপারটি করলেন দুর্গাপূজার রাতে। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে মডেল স্কুলের হেডমাস্টার অমিয় বাবুর মেয়ের গলা থেকে ওড়না টেনে পাগড়ি বানিয়ে তিনি মাথায় দিলেন এবং অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে বললেন, সুফিয়া, বালিকা, তুমি কি করে জানলে ইংরেজ বিজয়ে আমরা অক্ষম?
সেই রাতেই পুলিশ তাঁর খোঁজে এল। তিনি পালিয়ে গেলেন সরিষাবাড়ি এবং কাঠের ব্যবসায় লেগে গেলেন। বাবাকে শেষ বয়সে নাজির ভাইয়ের সাথে থাকতে হচ্ছে, এটা ভাবতেও কষ্ট। কিন্তু কোনো উপায় নেই।
বাবা হয়ত যৌবনে প্রচুর পাপ করেছিলেন, এখন তাঁর প্রায়শ্চিতের কাল চলছে। ভাসমান জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কিছুদিন বড়োভাইয়ের সঙ্গে। ভালোই ছিলেন। সকালে মর্নিংওয়াক করতেন। বিকেলে পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকতেন। তারপর ভাবীর সঙ্গে ঝামেলা হতে লাগল। যখনই যাই, নানান অভিযোগ–ভাবী নাকি ইচ্ছা করে তরকারিতে লবণ বেশি দিচ্ছে। কাজের মেয়েকে বলে দিচ্ছে যেন তাঁর ঘর পরিষ্কার না করা হয়। এখানে থাকার চেয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকা ভালো।
নিয়ে গেলাম আমার ছোট বোন অণুর কাছে–নারায়ণগঞ্জে। মাস ছয়েক ভালোই থাকলেন। তারপর এক দিন তাঁর টিনের ট্রাংক আর দুটি চটের ব্যাগ নিয়ে গেলেন নাজির ভাইয়ের সঙ্গে। সেখানেই নাকি থাকবেন। এখন সেখানেও টিকতে পারছেন না। গত সপ্তাহে চিঠি পেয়েছি তিনি অনুর কাছে ফিরে যেতে চান! বেশি দিন তোতা আর বাচবেন না। শেষ কটা দিন মেয়ের সঙ্গে থাকতে চান। নাজির হচ্ছে পরের ছেলে। নিজের ছেলে-মেয়ে থাকতে পরের কাছে থাকবেন কেন? ইত্যাদি। মনে হয় না বাবার সে-আশা পূর্ণ হবে। অনু রাজি হবে না।
নাজির ভাই বাসাতেই ছিলেন। তাঁর মুখ এমনিতেই লম্বা। আমাকে দেখে সেই মুখ আরো লম্বা হয়ে গেল। আমি বললাম, কেমন আছেন নাজির ভাই?
ভালো। তুমি কেমন আছ?
ভালোই আছি।
হাসপাতালে নাকি ভর্তি হচ্ছ?
হুঁ।
হয়েছেটা কি? সিরিয়াস কিছু?
টিউমার।
ক্যানসার নাকি? না শুধু টিউমার?
জানি না, ডাক্তার তো কিছু বলে না।
এই সব জিনিস কি আর ডাক্তার আগ বাড়িয়ে বলবে? বুঝে নিতে হয়।
আমার মনে হল নাজির ভাই আমার অসুখের খবরে বেশ খুশিই হলেন। লোকটিকে আমি দেখতে পারি না। এই কারণেও এ রকম মনে হতে পারে। মানুষ যত খারাপই হোক, অন্যের অসুখে খুশি হয় না। তাছাড়া নাজির ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই।
ফরিদ।
জ্বি।
ফুপাকে আমার এখান থেকে নিয়ে যাও। তোমার ভাই বা বোনের কাছে রাখ। এখানে আর পোষাচ্ছে না।
ঠিক আছে।
ঠিক আছে না। এসেছ যখন, আজই নিয়ে যাও। আবার কবে আসবে, তার কোনো ঠিক আছে নাকি?
দেখি।
দেখাদেখি না। নানান রকম যন্ত্ৰণা। তোমরা তো অন্যের ঘাড়ে চাপিয়েই খালাস।
আমি চুপ করে রইলাম। সত্যি সত্যি আজ নিয়ে যেতে হলে মুশকিল। কিন্তু নাজির ভাইয়ের যা ভাব দেখা যাচ্ছে, আজই হয়ত গছিয়ে দেবে।
বাবা বাসায় নেই?
বাজারে গেছে। এসে পড়বে। চা খাও।
না, চা খাব না।
ঠাণ্ডা কিছু খাবে?
নাহ্।
না কেন? খাও। একটা কোক খাও। পেটটা ঠাণ্ডা থাকবে।
আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে নাজির ভাই ভিতরে চলে গেলেন। এ বাড়িতে পর্দাপ্রথার ব্যাপার আছে। নাজির ভাইয়ের স্ত্রী বোরা পরেন। বাড়িতে কোনো পুরুষ কাজের লোক রাখা হয় না। নাজির ভাই নিজেও নাকি কোন পীরের কাছে যাতায়াত করছেন। গত বৎসর শুনেছিলাম হন্ধে যাবেন। লটারিতে নাম ওঠে নি। কোথায় বারো শ টাকা ঘুষ দিলেই ব্যবস্থা হয়। ঘুষ দিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে যাওয়া বাতিল করেছেন। এ বছর চেষ্টা করবেন।
নাজির ভাইয়ের বসবার ঘর বেশ সাজান। সাজানর ধরনটাও আধুনিক। ফ্রেমে বাঁধান কাবা শরিফের ছবি নেই। কামরুল হাসানের একটি পেইনটিং আছে। কার কাছ থেকে মাত্র সাড়ে তিন শ টাকায় কিনেছেন। দুটি আলমারি আছে, বই-এ ভর্তি। শংকর থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-রচনাবলী। এই সব বই নাজির ভাই পড়েন বলে মনে হয় না। তবে কেউ এক জন পড়ে নিশ্চয়ই। অনেকগুলি বই ছেড়া, যত্ন করে কাগজ দিয়ে মোড়া। পেছনে কলম দিয়ে নাম লেখা।
কোক পাওয়া গেল না, সেভেন আপ নিয়ে এসেছে।
আপনি দোকানে যাবেন না নাজির ভাই?
যাব। গাড়ি আসবে এগারটায়, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে মতিঝিল গেছে।
আমি চমকে উঠে বললাম, গাড়ি কিনেছেন কবে? গত মাসে।
নতুন গাড়ি?
নতুন গাড়ি কেনবার পয়সা কোথায়? পুরনো। ড্রাইভারের বেতন দিতে গিয়ে অবস্থা কাহিল।
কত দেন বেতন?
আট শ। তোমার খবর বল।
কী খবর চান?
করছ কী?
তেমন কিছু করছি না।
নাজির ভাই বিরক্ত স্বরে বললেন, কখন তো কিছু করতে শুনি না। ফলে কী ভাবে?
চলে কোথায়? চলে না। থেমে থাকে।
চার-পাঁচটা প্রাইভেট ট্যুশনি করতে, এখনো কর?
একটা এড-ফার্মে কাজ করি। দুটা টিউশনি করি।
এটাও খারাপ বিজনেস না। এক ঘন্টা পড়াতে এক জন চার শ পাঁচশ টাকা চায়, দেখ অবস্থা।
আমি কিছু বললাম না। নাজির ভাইকে মনে হল ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছেন। কেন কে জানে।
এত বড়ো অপারেশন করা, হাতে টাকাপয়সা আছে?
আছে কিছু।
কত আছে?
তিন হাজার টাকার মতো আছে।
বল কি। প্রাইভেট টুশনি করে এত টাকা জমিয়েছ?
আমি উত্তর দিলাম না। নাজির ভাই শুকনো গলায় বললেন, দরকার লাগলে চাইবে আমার কাছে। লজ্জা করবে না।
না, দরকার হবে না।
হবে না, বুঝলে কী ভাবে? তিন হাজার টাকা আজকাল কিছুই না।
তা ঠিক।
শোন ফরিদ, তোমার যে ভাই সুইডেনে আছে, তার নামটা কি যেন? বাবুল না? বাবুলই তো নাম?
জ্বি।
তাকে টাকাপয়সার জন্য লেখ না কেন? ভাইয়ের কাছে চাইতে আবার লজ্জা কি? সভাইও না। নিজের মায়ের পেটের ভাই। তোমাদের দাবি আছে।
দেখি, লিখব এবার। তার নিজেরই বোধহয় চলে না।
না চললেও লিখবে। বুড়ো বাপ আছে, তাঁর দায়িত্ব আছে না?
জ্বি, তা তো ঠিকই।
তার উপর তোমার এত বড় অপারেশন।
আমি লিখব।
এর মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। যে দেখে না, তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়। এটাই নিয়ম।
এগারটার আগেই গাড়ি এসে পড়ল। সেকেণ্ডহ্যাণ্ড গাড়ি মনেই হয় না। নতুন কাঁচা টাকার মতো চকচক করছে।
ফরিদ, আমি গেলাম। দুপুরে খেতে আসব। তুমিও দুপুরে খেয়ে তারপর যাবে। হুট করে চলে যে না।
দেখি।
দেখাদেখি না। আমি আসলে তারপর যাবে। ড্রাইভার পৌছে দিয়ে আসবে। অসুবিধা হবে না।
বাবা এলেন বারোটায়। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। এই শরীরে কোথায় হাঁটাহাঁটি করছিলেন কে জানে। আমাকে দেখে প্রথম যে-কথাটি বললেন, সেটি হচ্ছে–কি, আমাকে নিতে এসেছিস?
কোথায় যাবেন?
অনুর বাসায়। আর কোথায় যাব? যাওয়ার জায়গা আছে? অপদাৰ্থ ছেলেপুলে তৈরি করে শেষ বয়সে এই কষ্ট। ছিঃ ছিঃ।
আমি প্ৰসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বললাম, আমার অপারেশনের কথা শুনেছেন?
হুঁ। অপারেশন কবে?
এখনো ডেট হয় নি। সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হব। একুশ নম্বর কেবিন।
বাবাকে খুব চিন্তামগ্ন মনে হল। মাথা নিচু করে বসেছিলেন। বেশ কয়েকবার মুখ তুলে তাকালেন। পরাজিত মানুষের মুখ। সারা জীবন অসংখ্য যুদ্ধ করেছেন। এখনো করছেন। একটিতেও জয়লাভ করেন নি। কিছু কিছু মানুষ কি শুধু পরাজিত হবার জন্যেই জন্মায়। এক সময় থেমে থেমে বললেন, নাজিরের বাসায় আর থাকতে পারব না। হারামজাদা ছোেটলোক।
অতি সামান্য আহতই হলাম। বাবা আমার কথা মমাটেই ভাবছেন না। আমার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া না-হওয়ায় তার কিছুই যায় আসে না। তিনি ভাবছেন তার নিজের কথা।
ফরিদ।
বলেন।
ওরা খায়দায় ভাল। খাওয়াটাই তো সব না। ইজ্জত নিয়ে থাকতে হয়। এখানে পদে পদে বেইজ্জত।
অনুর বাসাতেও তো তাই।
তবু সেটা মেয়ের বাসা। নিজের লোকের কাছে বেইজ্ঞাতি হওয়া অন্য কথা।
বাবা আবার চিন্তায় ড়ুবে গেলেন। আমি মৃদু স্বরে বললাম, বাবা আমার কিছু টাকা দরকার। হাজার দুই।
টাকা, আমি টাকা পাব কোথায়? তোর কি মাথাটাথা খারাপ?
বাবা দারুণ চমকে উঠলেন। এতটা চমকানর প্রয়োজন ছিল না। কারণ তার কছে টাকা আছে। চার-পাঁচ হাজার থাকার কথা। বেশিও হতে পারে।
মার মৃত্যুর পর বাবা ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে বড় ছেলের বাড়িতে থাকতে গেলেন। আলনা, চেয়ার, টেবিল থেকে শুরু করে শিল-পাটা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেল। এ ছাড়াও মায়ের দু ভরি ওজনের একটা গলার হার ছিল, যা বাবা বহু চেষ্টা করেও মার জীবদ্দশায় বিক্রি করতে পারেন নি, সেটিও নিশ্চয় এত দিনে বিক্রি হয়েছে। এবং তাঁর মতো কৃপণ লোক একটি টাকাও খরচ করবে বিশ্বাস হয় না–সবই জমা আছে।
বাবা, অপারেশনে অনেক খরচপত্ৰ আছে।
সরকারী হাসপাতালে অপারেশনের আবার খরচ কিসের?
কেবিন নিয়েছি। কেবিনের চার্জ আছে।
কেবিন নিলি কেন? কেবিনে কি আলাদা করে চিকিৎসা হয়? সব একপদের চিকিৎসা। চেষ্টাচরিত্র করে জেনারেল ওয়ার্ডে চলে যা।
বাবা, কিছু টাকা দিন। আপনার কাছে তো আছে।
যা আছে, সেটা বিড়ি-সিগ্রেট খাওয়ার খরচ। একটা পয়সা কেউ দেয়? বাবুল দিয়েছে কিছু?
আমি তো দিতাম! মাসে পঞ্চাশ করে দিতাম।
পঞ্চাশে কী হয়? হটেলে এক বেলা খেতে লাগে কুড়ি টাকা।
যা পেরেছি দিয়েছি। আপনি এখন কিছু দিন।
আমার কাছে টাকা নেই। বাবুলের কাছে এতগুলি চিঠি লিখলাম, টাকাপয়সার কথা লিখলাম। তার কোনো উত্তর নেই। সে তার মেমসাহেবের ছবি পাঠিয়েছে। হারামজাদা!
দেখি ছবিটা।
বাবা ছবি আনতে গেলেন। বাড়ির কাজের মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আমি গোসল করব কিনা। আমি বললাম, আমি এখানে ভাত খাব না। চলে যাব। মেয়েটি মনে হল বেশ অবাক হয়েছে। আমাকে বোধ হয় সেই শ্রেণীর গরিব আত্মীয়দের মতো দেখাচ্ছে, যারা ভাত না খেয়ে কখনো যায় না। যাবার আগে টাকা ধার চায়।
না, শুধু মেমসাহেবের ছবি নয়–পুরো ফ্যামিলির ছবি। বিদেশিনী একটি বাচ্চাকে নিয়েছে ঘাড়ে, অন্যটি এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। বাবুল তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে। বাবুলের চেহারা বিশেষ বদলায় নি। শুধু মোটা হয়েছে, একটু গম্ভীর হয়েছে। কিন্তু মেমসাহেব ছবিতে খুব হাসিখুশি। মনে হচ্ছে এই মেয়েটি কথায় কথায় হাসে। ছবি অবশ্য কখনো সত্যি কথা বলে না। আমার নিজের ছবিতে আমাকে খুব হাসিখুশি দেখায়, বাস্তব জীবনে আমি বিশেষ হাসি না। হাসি আসে না।
বাবা, ছেলে দটি কি ওদের?
ওদের না তো কার? রাস্তার বাচ্চা ধরে এনেছে নাকি? কী যে বেকুবের কথাবার্তা! চেহারাও তো বাবুলের মতো।
মেয়েটার চেহারা তো ভালোই।
মেয়েটা বলছিস কেন? সম্পর্ক দেখবি না? সম্পর্ক যা হয়, তাই ডাকবি। ভাবী ডাকবি।
আসলে ডাকব। আসবে-টাসবে না।
আমি উঠে পড়লাম। বাবা বললেন, খেয়ে যা। আজ চিতল মাছ এনেছে, বড়ো চিতল। পিঠের মাছটা কোপ্তা করছে আর বড়ো বড়ো পেটি।
তুমি জানলে কীভাবে?
রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আসলাম। অসুবিধা কী? আমার সাথে কেউ পর্দা করে না। বুড়ো মানুষের সাথে আবার পর্দা কী?
বাবা আমাকে বাসে উঠিয়ে দিতে বাস-স্ট্যাণ্ড পর্যন্ত এলেন। অনুর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আর কথা হল না। এখানকার খাওয়াদাওয়া ছেড়ে যেতে তার বোধ হয় খানিকটা দ্বিধা আছে। বেশ কয়েক বার খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গ এল।
বুঝলি, এদের খাওয়াটা ভালো। মাসে দু বার পোলা হয়।
তাই নাকি?
নাজির পোলাও খায় না, তার পেটের ট্রাবল। তার জন্যে পোলাওয়ের চালের ভাত। মোহনভোগ চাল। দিনাজপুর থেকে আসে।
ভালোই তো।
নাজিরের বৌ রাঁধেও ভালো। রান্নাটা নিজেই করে, চাকরের হাতে দেয় না।
তাই বুঝি?
হুঁ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও খুব। সব জিনিস নিজের হাতে ধোয়।
আপিনি সারা দিন রান্নাঘরে বসে থাকেন নাকি?
রান্নাঘরে বসে থাকব কেন? মাঝেমধ্যে যাই।
বাস-স্ট্যাটা অনেকখানি দুরে। দেখলাম, বাবার কষ্ট হচ্ছে। বয়স হয়েছে। কষ্ট হওয়ারই কথা। আমি বললাম, চলে যান। আসতে হবে না। গোসল করে খাওয়াদাওয়া করেন। বাবা উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকলেন। বেচারা।
ফরিদা।
বলুন।
কড়া করে একটা চিঠি লেখ বাবুলকে। বাপ-মার হক আছে ছেলেপুলের উপর। আছে না?
তা তত আছেই।
খুব কড়া করে চিঠি দে। লিখে দে–বাবা অন্যের বাড়িতে ভিক্ষুকের মতো অবস্থান করিতেছেন।
আমি বহু কষ্টে হাসি সামলালাম। ভিক্ষুকের মতো অবস্থান। কঠিন শব্দের প্রতি বাবার খুব টান। এক বার চিঠি লিখলেন–বড়ো বৌমার আচরণে কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আছি। গ্লাস ভাঙার বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করা তার উচিত হয় নাই। আমি তার পিতৃস্থানীয়। গ্লাস এমন কোনো মূল্যবান বস্তু নহে। জগই অনিত্য।
দারুণ ফিলসফি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দার্শনিক ভাবটা বাবার মাথায় চাড়া দিয়ে উঠেছে। কথায় কথায় জীবন-দর্শন চলে আসছে।
চিঠি কিন্তু দিবি বাবুলকে।
দেব।
আর বেশি করে পানি খাবি।
কেন?
পানিটা পেটের জন্যে ভালো। জল-চিকিৎসা। খুব উপকার হয়।
ঠিক আছে, খাব।
আর শোন, একটা বিয়ে-শাদিক। বুড়ো হয়ে গেলি তো।
রোজগারপাতি নেই।
রোজগারপাতি নেই বলেই সংসার করবি না? ভিক্ষুকরাও তো বিয়েটিয়ে করে। করে না?
আবার একটা কঠিন শব্দ–ভিক্ষুক।
হাসপাতাল থেকে ফিরেই বিয়ে করে ফেল। চিঠি লিখে দে বাবুলকে টাকা পাঠাতে। তুই ছোট, তোর হক আছে। বিয়ের খরচ দিতে বল।
ঠিক আছে, লিখব।
বাড়ি ফেরার জন্যে বাবাকে আমি একটা রিকশা করে দিলাম। দু টাকা দিয়ে দিলাম রিকশাওয়ালাকে। বাবা আকাশ থেকে পড়লেন।
এখান থেকে ওখানে রিকশা? পাগল নাকি?
রোদের মধ্যে কষ্ট করবেন কেন? চলে যান। হুড তুলে দেন।
বাবা খুবই অবাক হলেন। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন। এত অবাক হবার কী আছে। এক জন বুড়ো মানুষের প্রতি আমি কি একটু মমতা দেখাতে পারি না? মমতার পরিমাণ খুবই সামান্য, তাতে কি? কিন্তু বাবা এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন কেঁদে ফেলবেন।
কত নম্বর বেড বললি?
একুশ নম্বর।
আচ্ছা এক দিন যাব। তুই বাবুলকে চিঠি লিখবি মনে করে।
লিখব।
খুব কড়া করে লিখবি।
আচ্ছা লিখব।
বাবা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে চলে গেল। বাবা বেশ হাত-পা ছড়িয়ে বসেছেন। হুড তোলেন নি। কড়া রোদ। তবু আমার মনে হল, তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে না। গিয়েই হয়তোে গোসল সেরে চিতল মাছের পেটি নিয়ে বসবেন। খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমুবেন। সন্ধ্যাবেলা টিভি সেটের সামনে বসবেন।
আজকের দিনটা বাবার সঙ্গে কাটালেই হত। ফিরে যাবার একটা ক্ষীণ ইচ্ছা হতে লাগল। যাব নাকি ফিরে? বললেই হবে–শরীরটা ভালো লাগছে না। বিকেলে বাসায় যাব। কিংবা হয়তো থেকেই গেলাম আজ রাতটা। দোটানা ভাব দীর্ঘস্থায়ী হল না। বাসে উঠে পড়লাম। পাশের ভদ্রলোক একটা চিত্রালী কিনেছেন। প্রথম পাতায় কোনো এক জন নায়িকার ছবি ছাপা হয়েছে। মোটা মোটা ঠোট। ইয়া লাশ। বডিবিল্ডারদের মতো ফিগার। এমন একটি ধুমসী মেয়ে কী করে খুকিদের মতো কামিজ পরে আছে কে জানে? নাম কি নায়িকাটির? নাম-ধাম লেখা নেই। হয়তো এত পরিচিত যে নামের প্রয়োজন নেই। আমি আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, এই নায়িকার নাম কি? ভদ্রলোক অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। কেন হলেন কে জানে? বিরক্তি কি আমার অজ্ঞতার জন্যে? আমার বোধ হয় জানা উচিত ছিল, কী নাম।