০২. এই বাড়ি আমাদের না

শুরুতে আমি বলেছিলাম যে, এই বাড়ি আমাদের না, আমরা এই বাড়ির কেয়ারটেকার— এটা আর প্রযোজ্য নয়। এ বাড়ির এখন আমরাই মালিক। দরিদ্র মধ্যবিত্ত এখন আর আমাদের বলা চলে না। আমরা ঢাকা শহরে আস্ত একটা দোতলা বাড়ির মালিক। কাগজপত্রও এখন আমাদের কাছে আছে। দানপত্র রেজিস্ট্রি হয়েছে। আইনের কোনো ফাঁক নেই। আমার ইনজিনিয়ার মেজোভাই ইতোমধ্যেই চিন্তাভাবনা শুরু করেছে এই বাড়ি ভেঙে সাততলা একটি কমপ্লেক্স হবে। পুরো বাড়িটা হবে আরসিসির উপর। একতলায় থাকবে গ্যারেজ, শপিং মল, লন্দ্রি। অ্যাপার্টমেন্ট। এই বিশাল কমপ্লেক্সের জন্যে বাড়তি কোনো ব্যাংক লোনেরও প্রয়োজন হবে না। কিছু কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিলেই টাকাটা উঠে আসবে। প্ৰায় এক বিঘা জমির উপর বাড়ি। জমির দামই ত্রিশ-চল্লিশ লাখ টাকা। আমরা এক ধাক্কায় অনেক দূরে উঠে গেলাম।

দূরে ওঠা মানুষদের কাছে পৃথিবী অনেক ছােট মনে হয়— আমাদেরও সে রকম মনে হওয়া উচিত ছিল। আমাদের সবারই আচার-আচরণ এবং মানসিকতা খানিকটা হলেও বদলানো উচিত। আশ্চর্যের ব্যাপার, তেমন বদলাল না। বড় ভাই আগের মতোই একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পা নাচাতে লাগলেন। মা সবার সঙ্গে সমানে ঝগড়া করে যেতে লাগলেন। নীতু নিজেকে তরুণী হিসেবে জাহির করার জন্য আগের মতোই ব্যস্ত রইল। তবে কিছুটা পরিবর্তন যে হল না তা না। যেমন, হয়তো দেয়ালে পেরেক পুতছি, মা ছুটে এসে বললেন, এসব কী, দেয়াল জখম করছিস কেন? যেন এই বাড়ি এখন আর বাড়ি না— এটা এখন মানুষ। এর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর দেয়াল জখম করলে এ ব্যথা পায়। অবশ্যি এই বাড়ি মেজোভাইকে বেশ খানিকটা বদলে দিল। একদিন দেখি গজফিতা নিয়ে জমি মাপামাপি হচ্ছে। সঙ্গে বিষন্ন চেহারার বুড়ো একজন মানুষ। আমি দোতলার জানালা থেকে দেখলাম, মেজোভাই হাত নেড়ে নেড়ে বুড়োকে কী যেন বলছে। একদিন আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে তিনি একটা মিটিংও বসালেন। তার ভাবভঙ্গি থেকে মনে হল গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। দরজা ভিড়িয়ে দিলেন। তার গলার স্বর নিচে নেমে গেল। বুনোভাই পা নাচানো বন্ধ করে বিস্মিত স্বরে বললেন, তুই এরকম করে কথা বলছিস কেন? তো কী হয়েছে? এনিথিং রং?

মেজোভাই বিরক্ত স্বরে বললেন, কিছু হয় নি। আমি কী বলতে চাচ্ছি। দয়া করে মন দিয়ে শোন। এই যে প্ৰপাটি আমরা পেয়েছি। এর ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে তোমারা কী ভাবিছ সেটা প্ৰথমে আমি জানতে চাই। তারপর আমার কিছু কথা আছে, যা আমি বলতে চাই। বুনোভাই প্রথমে তুমি বল।

বুনোভাই উঠে বসতে বসতে বললেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে আমরা একটা ফরম্যাল মিটিং করছি। যদি তাই হয় তাহলে একজন সভাপতি ঠিক করা দরকার। কে হবে সভাপতি? আমি তোর নাম প্ৰস্তাব করতে পারি করব? মেজোভাই রাগী স্বরে বললেন, আজেবাজে কথা বলার আমি কোন অর্থ দেখছি না। লেট আস ডিসকাস।

বুনোভাই বললেন, ডিসকাস করার আমি তো কিছু দেখছি না। মইনুদ্দিন চাচার মেয়ের কাছ থেকে এই বাড়ি নেয়াই আমাদের উচিত হয় নি। কাজটা ভুল হয়েছে।

কেন?

চাচা যা করেছেন, ঝোঁকের মাথায় করেছেন। তার যদি ক্যানসার না হত, মৃত্যু যদি তাঁর সামনে এসে না দাঁড়াত তাহলে তিনি এই কাজ করতেন না। তিনি ঠিকই বাড়ি দেখতে আসতেন এবং বাড়ির কোনো কাজ হয় নি দেখে বাবার সঙ্গে রাগারগি করেতেন। হয়তো আমাদের বেরও করে দিতেন। মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে বেচারার সব এলোমেলো হয়ে গেল। তাঁর এই দান গ্রহণযোগ্য নয়।

মোজোভাই হতভম্ব গলায় বললেন, এইসব তুমি কী বলছ?

সত্যি কথা বলছি। পাগল অবস্থায় কেউ উইল করলে সেই উইল গ্রাহ্য হয়। না। তিনি পাগল অবস্থায় বাড়ি দান করেছেন। এই দানও গ্রাহ্য নয়।

উনি পাগল ছিলেন তোমাকে কে বলল?

কেউ বলে নি–আমি অনুমান করতে পারি। পাগল মানে কী? পাগল হচ্ছে সেই মানুষ যার পক্ষে র‍্যাশনালি চিন্তা করা যে কোনো কারণেই হোক সম্ভব না।

তুমি তাহলে কী করতে বল?

আমি ভাবছি বাবাকে বলব— বাড়িটা ঐ মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে। ঐ মেয়ের হাতেও খুব টাকা-পয়সা আছে বলে মন হল না। আমার ধারণা জমানো সব টাকা বাবার চিকিৎসায় খরচ করে ফেলেছে। ঢাকায় মইনুদিন চাচা আর একখানা বাড়িও করেন নি। কাজেই আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে মেয়েকে বলা— দেখ তানিয়া তোমার বাবা মৃত্যুর আগে একটা কথা বলেছেন। সেই কথা নিয়ে তুমি ছােটাছুটি করছ, এ কথার কোনো মানেই নেই। এই বাড়ি তোমার। তুমি দয়া করে ফেরত নাও।

চুপ কর তো।

আমি তো চুপ করেই ছিলাম। তুই কথা বলতে বললি বলেই কথা বলছি। আমার এত কী দায় পড়েছে? তবে ব্যাপরটা নিয়ে আমি খুব চিন্তা করছি।

তোমাকে এত চিন্তা করতে কেউ বলে নি। তুমি দয়া করে অজগর সাপের মতো শুয়ে থাক, আর পা নাচাও।

তুই এত রেগে আছিস কেনো?

রেগে আছি কারণ তোমার মধ্যে কোনো ড্রাইভ নেই। উন্নতি করার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি চাচ্ছি। আমরা তিন ভাই মিলে একটা লিমিটেড কোম্পানি খুলে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং প্রজেক্ট হাতে নেব। আর তুমি উল্টাপাল্টা কথা শুরু করলে। যেন বিরাট ফিলাসফার।

বড় ভাই শান্ত গলায় বললেন, অন্যের জায়গার উপর তুই মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং করবি? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল?

অন্যের জায়গা হবে কেন?

অবশ্যই অন্যের জায়গা। আগেই তো বললাম মইনুদিন চাচার এই বাড়ি আমাদের দেয়ার বিন্দুমাত্ৰ ইচ্ছা ছিল না। পুরো ব্যাপারটা একজন অসুস্থ মানুষের ঝোঁকে ঘটে গেছে।

তুমি এত বেশি বেশি বোঝ বলেই তো তোমার আজ এই অবস্থা!

কী অবস্থা?

দিনরাত বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে হয়।

বুনোভাই হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, ফাইন্যাল পরীক্ষা সামনে। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। দিনরাত বাড়ি, প্ৰপাটি, ডেভেলপমেন্ট মাথায় ঘুরলে তো তুই ফেল করবি।

আমার পরীক্ষা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি তো আর অসুস্থ না, আমি সুস্থ। আমি আমার নিজের ভালোমন্দ বুঝি?

মেজোভাই মুখ লাল করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। বুনোভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, রঞ্জু, তুই বোস।

আমি বসলাম। তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে আগ্রহ নিয়ে বললেন, মইনুদ্দিন চাচার মেয়েটাকে দেখেছিস?

হ্যাঁ।

মেয়েটাকে তোর কেমন লাগল?

ভালো।

শুধু ভালো?

দেখতেও মন্দ না।

আর কিছু?

আর কিছু তো মনে পড়ছে না।

বুনোভাই উঠে বসলেন। তাঁর চোখে-মুখে কৌতুহল এবং আগ্রহ। চাপা গলায় বললেন, খুব স্পিরিটেড মেয়ে। আমার মেয়েটাকে খুব পছন্দ হয়েছে। মইনুদিন চাচা মেয়েটাকে মরার সময় একটা অন্যায় কথা বলেছেন–মেয়ে অক্ষরে অক্ষরে সেই কথা পালন করছে। তার আত্মীয়স্বজনরা নিশ্চয়ই অনেক বাধা দিয়েছে, এই মেয়ে কিছুই শোনে নি। ভুল বললাম নাকি, রঞ্জু?

না, ভুল বল নি।

একটি জিনিস লক্ষ করেছিস— মেয়েটা তার বাবার কথা, অসুখে কথা, মৃত্যুর কথা আমাদের ইলাবরেটলি বলল। বলতে গিয়ে একবারও কীদল না। আমি এই জিনিসটা খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম। তুই লক্ষ করেছিস?

হুঁ।

আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার লক্ষ করলাম–শুরুতে মেয়েটাকে আমার মোটেই আকর্ষণীয় মনে হয় নি—চলে যাবার সময় মনে হল, বাহ্‌, মেয়েটা দেখতে ভালো তো!

তিনি আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। হাতে দুদিন আগের পত্রিকা। এটা হচ্ছে তার সিগন্যাল। কথা শেষ হয়েছে–এখন চলে যাও। আমি উঠে দাড়াতে দাঁড়াতে বললাম বুনোভাই। তিনি মুখের উপর থেকে পত্রিকা না নামিয়েই বললেন, বলে ফেল।

তুমি যে জীবনটা শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিচ্ছ তোমার খারাপ লাগে না?

না। পৃথিবীতে প্রচুর লোক আছে যারা দিনরাত পরিশ্রম করে— অল্প কিছু আছে যারা কিছুই করেন না। আমি সেই অল্পের দলে। মাইনরিটি হবার যন্ত্রণা যেমন আছে, আনন্দও আছে।

এ রকম কতদিন থাকবে?

বেশিদিন থাকব না। একদিন দেখবি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছি। চাকরিবাকরি করছি।

বুনোভাই আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন, যেন আমাকে আশ্বস্ত করতে চান। আমি বললাম, বুনোভাই যাই।

যা। বাবার দিকে লক্ষ রাখিস।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তোমার কথা বুঝতে পারছি না। কার দিকে লক্ষ রাখব?

বাবার দিকে লক্ষ রাখবি। আমার মনে হচ্ছে বাবার মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে।

বুনোভাই মুখের উপর থেকে পত্রিকা নামিয়ে হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, এমনি বললাম— তোকে ভয় দেখলাম।

বুনোভাইয়ের কথা আমি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলাম না। বাবার দিকে খানিকটা লক্ষ রাখলাম। তেমন কিছু চোখে পড়ল না, সহজ স্বাভাবিক মানুষ। তাকে বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় বেশির ভাগ সময় কাটাতে দেখা গেল। একদিন এগিয়ে গিয়ে বললাম এখানে কী করছ? তিনি বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, কিছু না, বসে আছি।

রোদে বসে আছ যে?

এমনি। দাঁতে ব্যথা–এই জন্যে।

দাঁতে ব্যথা হলে কেউ রোদে বসে থাকে? চল ডাক্তারের কাছে। যাই।

বাদ দে।

বাদ দেবে কেন চল যাই।

সেদিন বিকেলই ডেনটিষ্টের কাছে নিয়ে গেলাম। ডেনটিস্ট প্রথম দিনেই দুটা দাঁত টেনে তুলে ফেলল। সাধারণত ডেনটিস্টরা তা করে না, প্রথমে কিছু ওষুধপত্র দেয়। মনে হয় এ ডেনটিস্টের ধৈর্য কম।

রিকশায় করে ফেরার পথে তাকিয়ে দেখি বাবার গাল ফুলে ঢোল হয়ে আছে।

বাবা, ব্যথা করছে।

হুঁ।

এত তাড়াতাড়ি তো ব্যথা শুরু হবার কথা না।

বাবা নিচু গলায় বললেন, শরীরের ব্যথা কিছুই না। শরীরের ব্যথার জন্যে ওষুধপত্র আছে। ডাক্তার-কবিরাজ আছে মনের ব্যথার কিছুই নেই।

কিছু নেই তাও ঠিক না, বাবা। মনের অসুখের ডাক্তারও আছে।

অসুখের কথা তো বলছি না। মনে ব্যথার কথা হচ্ছে। মনের অসুখ আর মনের ব্যথা দুটা দুই জিনিস।

তোমার মনে কোনো ব্যথা আছে?

থাকবে না কেন? আছে। সবার মনেই অল্পবিস্তর আছে। আমারও আছে।

কী নিয়ে ব্যথা?

এই যে মইনুদিনের বাড়ি নিয়ে এত বড় অন্যায় কাজটা করলাম। বেচারার কাছ থেকে টাকা-পয়সা এনে খরচ করে ফেললাম। রেলিং দিলাম না, ছাদে ঘর করলাম না। দারোয়ান আর মালির ঘরটাও হল না।

উনি তো আর সেই খবর পান নি।

যখন বেঁচেছিল তখন পায় নি। এখন পাচ্ছে। মৃত মানুষ সব জায়গায় যেতে পারে। সবকিছু দেখতে পারে। সে তো এখন সব কিছুই দেখছে। এই যে আমরা রিকশা করে যাচ্ছি হয়তো সেও যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে।

বাবা চুপ করে গেলেন।

বুনোভাইয়ের কথা মনে হচ্ছে পুরোপুরি ভুল না। বাবার মনের মধ্যে কোনো একটা গণ্ডগোল হয়েছে। আমরা যারা তার চারদিকে ঘোরাঘুরি তাদের কারো চোখে পড়ছে না। আর যে লোকটি দরজা বন্ধ করে সরক্ষণ পা নাচিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে সে সব জেনে বসে আছে, আশ্চর্য তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *